বেলতুলি – [০৩]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
নিবিড়ের মুখ থেকে “ছোটোলোক” শব্দটা বের হতে নিলেও মশিউর সাহেব তার হাত ধরে আটকে দিলেন। রিয়াজ সাহেবের হাসি-খুশি মুখে গাম্ভীর্য ভর করল। থমথমে গলায় বললেন,
–“আপনাদের আমার মেয়ের ছবি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বয়স, বৃত্তান্ত সব আপনাদের সামনে নৈতিকতার সাথে তুলে ধরেছি। এখানে এসে আপনারা সুর বদলাচ্ছেন কেন? আমার মেয়েকে অপমান করতে তো আমন্ত্রণ জানাইনি আপনাদের?”
ঘটক হোসেন সাহেব ভড়কে চুপ করে বসে রইলেন। তিনি মুখ খুলতে পারছেন না। দুপাশ থেকেই তার সমান লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা। সে আপাতত দেখতে চায় কার দল ভারী হবে। তাহলে সুযোগ বুঝে সেই দলেই ঢুকে যাবে। পাত্রের মা মুখ ফসকে বলে বসলেন,
–“ছবিতে তো আরও জোয়ান লাগছিল।”
এবার নিবিড় মুখ খুলল,
–“আমাদেরও তো বলা হয়েছিল আপনার ছেলে ফিটফাট। তাহলে এর বয়স এত বেশি কেন? মাথার চুল এত কম কেন? বেটে কেন? আবার দেখছি ভুড়িও আছে। কয় বেলা করে ভাত খাওয়াতেন?”
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেল পাত্রের। আগে দেখত পাত্রীদের বিচার করা হয়। পাত্রের যত টাকা, তার চাহিদাও তত বেশি। সেখানে আজ নতুন নিয়ম দেখছে। পাত্র বলল,
–“নিজের পছন্দে বিয়ে করা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়?”
–“অপরাধ না, তবে একজনকে দেখতে এসে আরেকজনকে পছন্দ করা চরম নোংরামি। আজ এভাবে আরেকজনের উপর নজর দিচ্ছেন। বিয়ের পর পরকিয়া করবেন না তার কী গ্যারান্টি?”
–“মুখ সামলে কথা বলুন।”
নিবিড় গা ছাড়া ভাব নিয়ে একই ভাবে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–“মাই, ফুট! আপনাদের যে মানসিকতাতে ঢের সমস্যা তা আমাদের বোঝা হয়ে গেছে। যেহেতু আমাদের পাত্রীর মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন সেই অনুযায়ী সালামী দিন আর বিদায় হোন।”
পাত্র রেগে গেল। চ্যাংড়া পোলা তারে হুমকি ধামকি দেয়? তার মার্কেটে দুটো দোকান আছে, বেশ ভালো ইনকাম তার। এই ছেলের কী যোগ্যতা তাকে অসম্মান, অপমান করার? সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–“তুই কে রে? চিনোস আমারে?”
নিবিড়ও উঠে দাঁড়ায়, তার লম্বাটে দেহের কাছে মোটামুটি ভুড়ি ওয়ালা পাত্রকে বেড়াল ব্যতীত কিছুই মনে হলো না। নিবিড় গলায় তেজ ফুটিয়ে নিজের আগা-গোড়া পরিচয় দিল, দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আমার নাম লেফটেন্যান্ট নিবিড় ইশতিয়াক। নামটা ভুলে যাবি না। কোন এলাকায় কী অবস্থায় আছিস সব জেনে নিলে তুই খতম।”
মশিউর সাহেবও গম্ভীর গলায় নিজের পরিচয় দিলেন। বাপ-ছেলের পরিচয় শুনে পাত্র গুটিয়ে গেল। সে যে জমের কবলে পড়েছে বুঝতে বাকি নেই। নিবিড় এবার ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“সালামিটা দিন, আর বিদায় হন। এই বাড়ি তো দূর, বেলতুলির ত্রি-সীমানাতেও যেন দেখি।”
ভদ্রমহিলা রেগে গেলেন,
–“তুমি তো আস্ত একটা নাবিক, সারা মাস সমুদ্রের মাঝখানে গিয়ে ম(১)রে থাকো। তোমার সাহস..”
–“আন্টি, আপনি বড়ো বলে এতক্ষণ সম্মান দিচ্ছি। অথচ এখানকার সবাই জানে নিবিড় ইশতিয়াকের ব্যবহার সম্পর্কে। আমার মুখও অসম্ভব লাগামহীন। সমুদ্রের মাঝখানে থাকলেও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে কীভাবে, কাকে সোজা করতে হয় তা আমার ভালোই জানা আছে।”
ভদ্রমহিলার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। পাত্র একদমই নিভে গেছে। সে পুরুষ মানুষ, এক পুরুষ আরেক পুরুষের ভাব-ভঙ্গি বোঝে। এই নেভি শালায় যে এক শব্দও মিথ্যে বলছে না তাও ঢের টের পাচ্ছে। শুকনো গলাটা লালা দিয়ে ভিজিয়ে দ্রুত মাকে খোঁচাল। ভদ্রমহিলা বাধ্য হয়ে পাঁচশো টাকা ধরিয়ে দিলেন রিমঝিমকে। এত অপমানের পর পাঁচশ টাকা তো দূর, এক টাকা দেওয়ারও ইচ্ছে ছিল না।
যাওয়ার আগে বলে গেল,
–“দেখব নে আপনাদের বুড়ি মেয়ের জন্য ঘোড়ায় চড়ে কোন রাজপুত্র আসে।”
নিবিড় চেঁচাল,
–“লিভ!”
পরপর ঘটকের দিকে রক্তচক্ষু নজরে তাকান। যেন ঘটককে বলছেন, “দেখে নিবেন।”
ঘটকও সেই উত্তরে নিজের অসহায়ত্ব বোঝাতে চাইলেন। মহিলারা বিদায় হতেই হোসেন মিয়া একটা বিস্কুট হাতে তুলে নিল। তা দেখে রিয়াজ সাহেব কাঠ কাঠ গলায় বললেন,
–“বিস্কুটটা হাতে নিয়েই বিদায় হোন ঘটক সাহেব। আপনার হিসাব তো পরে নিচ্ছি।”
ঘটক যাওয়ার পরপরই এশা হামলে পড়ল মেহমানদের খাবারের ওপর। সে মিষ্টির বাটি থেকে এক কামড়ে অর্ধেক গিলে নিল। জুনায়েদ বলেছে তার জন্য ঝাল চানাচুরের প্লেটটা নিয়ে যেতে। এশা বাধ্য মেয়ের মতো দ্রুত করে প্লেটটা নিয়ে জুনায়েদের ঘরের দিকে ছুটল। ভাইয়ার থেকে যে তার এখনো ললিপপ পাওয়া বাকি।
মৌনো চুপ করে ঘরে চলে গেল, তার মন ভার। নিবিড় চলে যাওয়া ধরতেই রিমঝিম পিছু ডাকল। নিবিড় দাঁড়াতেই রিমঝিম এগিয়ে এসে বলল,
–“ভাইয়া, কামরুলকে বলবেন দশ প্যাকেট বিরিয়ানি এনে দিতে?”
রিমঝিম নিজের হাতের টাকাটা গছিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু নিবিড় নিতে চাইল না।
–“টাকার দরকার নেই। আমি পাঠিয়ে দিব।”
–“না, না ভাইয়া। আমি এই টাকা হাতে রাখতে চাচ্ছি না। তার চেয়ে বরং খেয়ে উড়িয়ে দেই, আমি আরও কিছু টাকা এড করছি..”
নিবিড় চুপ করে টাকাটা নিয়ে বলল,
–“আর এড করতে হবে না।”
বলেই নিবিড় চলে গেল। এই ঘটনা রিমঝিমের জন্য অপমানজনক হলেও যখন সবাই মিলে তার পাশে দাঁড়াল, তার কিছুটা নির্ভার লাগল। রাজিয়া শেখকে এই ঘটনায় হতাশ দেখালেও মেয়েকে কিছু বললেন না। উলটো তিনিই বিড়বিড় করে বলছেন,
–“কি ছোটোলোক পরিবার। ভাগ্যিস আগে থেকে আসল রূপ দেখে নিয়েছি।”
রিমঝিম গেল মৌনোর কাছে। মৌনোর মুখ ভার দেখে রিমঝিম বলল,
–“মন খারাপ কেন?”
–“আমার জন্যে..”
রিমঝিম মৌনোর মাথায় এক চড় দিয়ে বলল,
–“তুই কখনো ভালো হবি না? এইযে সারাদিন খাটলি, এখন নিজেকে দোষারোপ করছিস কেন? তুই নিজেও জানিস এখানে তোর কোনো দোষ নেই।”
–“এরা এত জঘন্য কেন আপা? তুমি কী কম সুন্দর? একসময় কত শত প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছ, এলাকার কেউই তোমার পিছে ঘুরতে বাদ রাখেনি। আব্বাও কতশত প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। আর এরা কিনা তোমাকে অসুন্দর বলল?”
রিমঝিম হাসল।
–“জীবনে কালো অধ্যায় থাকলে সৌন্দর্যও কোথায় যেন গুটিয়ে যায় রে, মৌনো।”
তাদের কথার মাঝে এশা আসল। ভীষণ ব্যস্ত গলায় বলল,
–“আপা, সেমাইয়ের বাটিটা কোথায়? দুই বাটি দাও, আমি আর জুনায়েদ ভাই মিলে খাব।”
মৌনো গরম চোখে তাকাল। এশা তা মোটেও ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
–“মেহমান তো চলে গেছে। খাবার নষ্ট হওয়ার আগেই আমরা দুজন খেয়ে দেয়ে শেষ করে ফেলব।”
রিমঝিম হো হো করে হেসে দিল। অথচ আগে রাগ দেখাত রিমঝিম, এখন সে হাসছে। আর খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে মৌনো। কামরুল এসেছে শুনে রিমঝিম সে এশার সাথে বেরিয়ে যায়। এদিকে মৌনো নীরবে নিবিড়ের কথা ভেবে যাচ্ছে। লোকটা কীভাবে তার মনের কথাগুলো ওই জঘন্য লোকদের শুনিয়ে দিল। এমন শ্বশুরবাড়ি রিমঝিমের ভাগ্যে পড়লে তাকে ইহকালেই জা(১)হান্নাম দেখিয়ে দিত। মৌনোর কথা ছিল নিবিড়ের প্রতি তার মুগ্ধ হওয়া। কৃতজ্ঞতা আসলেও মুগ্ধতা আসছে না। তার জায়গায় হাফসা থাকলে হয়তো নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যেত? কিন্তু মৌনো জানে, আজ নিবিড় ভালো.. ঠিকই আগামীকাল কিছু না কিছু করে আবারও দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিবে। এই লোকটা হাতে-পায়ে বদলিয়েছে, বড়ো হওয়ায় মুখে কিছুটা লাগাম টেনেছে। কিন্তু তার ব্যবহার যে কতটা জঘন্য, তা মৌনো মৃ(১)ত্যুর আগেরদিন অবধি মনে রাখবে।
রিমঝিম কামরুলের সাথে পাঁচ প্যাকেট বিরিয়ানি পাঠিয়ে দিয়েছে। নিবিড়ের পরিবারের জন্য সাথে এক প্যাকেট কামরুলের জন্যেও। কামরুল বিরিয়ানি পেয়ে মহা খুশি। যাওয়ার আগে রিমঝিমকে বলে গেল,
–“কাজ থাকলে কইবেন।”
*****
জাবির গ্রাম থেকে এসেছে, দুদিন পর। বেলতুলিতে সে এক পুরাতন বাড়ির এক রুম নিয়ে ভাড়া থাকে। সারাদিন বখাটেপনা করবে আর সন্ধ্যার পর ক্যারাম খেলে বাজি জেতাই তার মূল ধান্দা। এছাড়াও স্থানীয় নেতা-ফেতার বিভিন্ন কাজ করে দিচ্ছে কিছু না কিছু। এরপর সেই কাজের উপর ভিত্তি করে তার পকেট ভরে। তবে গুজব আছে, সে জুয়া খেলে। তবে সেটা কতটুকু সত্য, তা অজানা।
জাবিবের বয়স আনুমানিক চব্বিশ। সবময় নেতা নেতা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। গলায় রূপা রঙের চেইন, হাতে কিসব চেইন, আংটি পড়ে ঘুরে বেড়ায়। সবসময় সেন্ডো গেঞ্জির সাথে বিভিন্ন শার্ট পরে, শার্টের বোতাম সবসময় খোলা থাকে, ভেতর থেকে সেন্ডো গেঞ্জি ভেসে আসে। এটাই নাকি জাবিরের স্টাইল, যার লুকেই তাকে সবাই এক নামে চিনবে।
জাবিরের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল। সে আসার পর থেকেই তার দলের ছেলেরা মুখ উঁচিয়ে আছে। এইতো মঞ্জু বলে উঠল,
–“আমাগো লেইজ্ঞা চমচম, ঘি আনেন নাই ভাই?”
জাবির বিশ্রী এক গা(১)লি দিয়ে বলল,
–“তুমাগো লেইজ্ঞা বা(১)ল আনুম। ঘি যে আনমু, ঘরে কি বউ আছেনি যে ঘি দিয়া পরোটা ভাইজ্জা খাওয়াইব? নিজেও খামু না, তোগোরেও খাইতে দিমু না।”
রিপন বলে ওঠে,
–“কিসব যে কন না ভাই, আমাগো ভাবি আছে না? ভাবি খাওয়াইব।”
জাবির মুখে হাসি ফুটায়, পরপর রিপনকে এক কিল দিয়ে বসে। গলায় ঝাঁঝ মিশিয়ে বলল,
–“হ, তোগো ভাবি তো বইয়া আছে আমার লেইজ্ঞা। দুইদিন দেহি নাই, পাখি কই উড়াল দিছে কে জানে?”
–“চিন্তা কইরেন না ভাই, আমরা আছি না? আমরা থাকতে ভাবীরে উড়াল দেওয়ার সাহস কার আছে? ভাবি আপনেরই রইছে।”
মঞ্জুর কথাটা জাবিরের ভালো লাগল। চা খাওয়ার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“থাক তোরা, আমি একটু তোগো ভাবির বাড়ির সামনে থেইক্কা ঘুরান দিয়া আসি। মৌনডার চেহারা দেখি না দুইদিন।”
–“হ আমাগো আশিক ভাই, যান যান। দেইখা আহেন। তবে সাবধানে থাইকেন, এলাকার নেভিটায় আইছে।”
জাবিরের বুঝতে বাকি রইলো না ওরা কার কথা বলছে। সে মাছি তাড়ানোর মতো ভান ধরে পুরাতন মডেলের বাইক নিয়ে আসল মৌনর বাড়ির পেছন রাস্তায়। এদিক থেকে মৌনোর বাড়ির ছাদ স্পষ্ট দেখা যায়। আর সে জানে, শেষ বিকেলের দিকে মৌনো একবার হলেও ছাদে ওঠে। অবশেষে মৌনোকে সে দেখতে পেল। তাদের এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা মৌনো। তার প্রেমে হাবুডুবি খাচ্ছে চরম বখাটে ছেলেটা।
মৌনো জাবিরকে দেখতেই তার আত্মা উড়ে গেল। সে দ্রুত রেলিং থেকে দূরে চলে গেল, জাবিরের দৃষ্টি সীমানার বাইরে। আবারও অজানা আতঙ্কে বুক ঢিপঢিপ করছে তার। এমন সময়ই নিবিড়দের ছাদে তার চোখ পড়ল। ছাদে নিবিড় শেইনাকে কী নিয়ে যেন বকাঝকা করছে। মৌনো মুখ বাঁকাল, না জানে এই বিচ্ছিরি লোকটার বউয়ের কপালে কোন দুঃখ আছে? মুহূর্তেই নিবিড় মৌনোর দিকে তাকাল। বড়ো তীক্ষ্ণ, তেজি সেই নজর। সূর্যের শেষ রশ্মিটা তখন নিবিড়ের ওপর গিয়ে পড়েছে।
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে~~
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর নজরে দেখবেন। প্রথম পর্বের “সিফাত” নাম পালটে “জাবির” রাখা হয়েছে। বেশি বেশি রেসপন্স করে আমাকে অবাক করে দিন, তাহলে দেখবেন লেখা কীভাবে দৌড়ায়।
আর অবশ্যই মনে রাখবেন এই গল্পের পটভূমি ২০১০ সালের। বর্তমানের স্মার্টফোন কিংবা অত্যন্ত আধুনিক কিছুই পাবেন না। কমেন্ট করে জানাবেন কেমন লেগেছে।
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ৭
-
বেলতুলি পর্ব ১২
-
বেলতুলি পর্ব ১৬
-
বেলতুলি পর্ব ১৭
-
বেলতুলি পর্ব ৪
-
বেলতুলি পর্ব ৫
-
বেলতুলি পর্ব ৯
-
বেলতুলি পর্ব ২
-
বেলতুলি গল্পের লিংক
-
বেলতুলি পর্ব ১