বেলতুলি – [১৭]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
কমলাপুর রেলস্টেশন। ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছুঁইছুঁই। ডাক্তার পরিবার ট্রেন ছাড়ার ঠিক শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে। পরিবার বড়ো কিংবা বাচ্চা-কাচ্চা থাকলে দেরী হয়ে যায়। রাজিয়া শেখের যন্ত্রণা যত এই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। জুনায়েদকে পইপই করে বলে দিয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশে তারা রাতেই রওনা দিবে, নয়টায় ট্রেন। কিন্তু ছেলে বিকালে উধাও হয়ে গেছে, অন্য পাড়ায় ক্রিকেট খেলতে চলে গিয়েছে। ফিরেছে সাতটা নাগাদ। এসেই তার জামা-কাপড় আবার গোছগাছ করেছে, মায়ের গোছানো তার পছন্দ হয়নি। এ নিয়ে জুনায়েদকে এক দফা বকেছেন।
এশার বেলায়, সে মার্কেটে নতুন জুতা দেখেছে, সে জুতো রিয়াজ সাহেব বিকালের দিকে এনেও দিলেন। কিন্তু তার জুতার সাথে মোজাও লাগবে। গরমের দিনে কে মোজা পড়ে? তার ওপর এশার গরমে এলার্জি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এজন্য বেশ সাবধানেই রাখতে হয় মেয়েকে। কিন্তু এশা কী এত কথা শোনার পাত্রী? সে নাছোড়বান্দা! তার মোজা লাগবেই লাগবে, নয়তো সে বিছানাতেই ঘাপটি মেরে বসে থাকবে, কোথাও যাবে না। অগত্যা, রিয়াজ সাহেবের এক পরিচিত ছেলেকে দিয়ে আনিয়ে দিল। রাজিয়া শেখ এশার এই জেদের জন্যেও কতক্ষণ বকাবকি করলেন।
মৌনোর দেখা গেল অন্য সমস্যা। তার এক জোড়া কানের দুল আর চারশো টাকা হারিয়ে গেছে। তা খোঁজাখোঁজি করতে গিয়ে সে সাড়ে সাতটা বাজিয়ে ফেলল। টাকার সাথে নিবিড়ের চিঠিটাও ছিল, এজন্য তার যে করেই হোক খামটা লাগতই। শেষমেষ পেল জুনায়েদের কাছে। তার প্রাইভেট স্যারের বেতন দিবে, এজন্য ভেতরে কি আছে চেক না করেই খাম এনে রেখেছে নিজের কাছে। ভেবেছে কিছু থাকলেও খাম থেকে বের করে এটা স্যারের বেতনের সাথে দিয়ে দিবে। জুনায়েদের অদ্ভুত স্বভাব আছে, তার নাকি খালি হাতে স্যারদের টাকা দিতে লজ্জা লাগে। এজন্য এই অবধি সে সবসময় খাম ব্যবহার করে। এ নিয়ে রাজিয়া শেখের মৌনোকেও বকাবকি করলেন।
যখন ধমকিয়ে মৌনোকে তৈরি হতে পাঠালেন তখনো রিমঝিমের ফেরার হুঁশ নেই। রিয়াজ সাহেব দু’বার কল দিয়ে ফেলেছেন রিমঝিমকে। সে বারবার ‘আসছি’ বলে কল কেটে দিয়েছে। রিমঝিম ফিরল একদম আটটা বাজার কিছুক্ষণ আগে। রাজিয়া শেখ রাগটা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, কিন্তু যখন দেখলেন রিমঝিম তৈরি হওয়ার বদলে বাথরুমে ঢুকছে তার মেজাজ সাত আসমানে পৌঁছে গেল। তিনি চেঁচালেন,
–“এই, বাথরুমে গামছা নিয়ে যাচ্ছিস কেন?”
–“গোসল দিব।”
রাজিয়া শেখের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো! ট্রেন নয়টা বাজে, এখন ঘড়িতে আটটা ছুঁইছুঁই। কমলাপুর রেলস্টেশনে যেতেও তো সময় লাগবে! রাজিয়া শেখ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
–“লাগবে না করা, তৈরি হ দ্রুত।”
–“কী যে বলো মা, রোগীর জীবাণু নিয়ে এসেছি, গোসল ছাড়া আমি এক পাও চলতে পারব না।”
মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিমঝিম দরজা আটকে দেয়। মায়ের চেঁচামেচিতে দশ মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে গেল। যেখানে তাদের বোনদের গোসল করতে সময় লাগে বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট! রাজিয়া শেখ সব ছেলে-মেয়েকে বকতে বকতে গলা ভেঙে ফেললেন। সারা রাস্তা স্বামীর সাথে অভিযোগ করতে করত আসলেন,
–“এজন্য আমি কোথাও যেতে চাই না! একেকজনের একেক কীর্তি আর ভালো লাগে না। দেখে নিবেন, একদিন দু’চোখ যেদিকে যাবে সেদিকে চলে যাব। আপনার ছেলে-মেয়ে নিয়ে আপনি থাকবেন।”
বাবার কোলে বসা এশা তখন বলে,
–“তোমার কাছে তো টাকা নেই আম্মু। কোথাও যেতে হলেও তো বাবার থেকেই টাকা নিয়ে যেতে হবে।”
রিয়াজ সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। মেয়েরাও হাসল, তবে ঠোঁট চেপে। নয়তো আবারও মায়ের রাগ সইতে হবে।
কমলাপুর এসে শুনল ট্রেন দশ মিনিট লেট হবে। বাবা-মা হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। মালপত্র নিয়ে আসতে ওদের সাহায্য করেছে প্রণভ। রিকশার জন্য যখন দাঁড়িয়ে ছিল ওরা প্রণভই সাহায্য করেছিল। যখন সবাই প্লাটফর্ম অনুযায়ী ট্রেনে উঠছিল, সবার শেষে ছিল রিমঝিম এবং প্রণভ। প্রণভ মালপত্র জায়গামতো রেখেই চলে আসবে। রিমঝিম বলল,
–“আপনিও আসুন ভাইয়া, আমাদের সাথে।”
প্রণভ হেসে বলল,
–“তুমি বলেছ, এতেই খুশি হয়েছি ঝিম। পরেরবার যাব।”
–“ধন্যবাদ সাহায্যের জন্য।”
প্রণভ রিমঝিমের দিকে তাকাল। নিয়ন আলোয় রিমঝিমকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। প্রণভ মাথা নাড়ায়।
–“কদিনের জন্য যাচ্ছ?”
–“সপ্তাহখানেক।”
–“রোগীরা ছুটি দিল?”
রিমঝিম হেসে ফেলল। হাসি বজায় রেখে বলল,
–“জি, তারাও জানে তাদের ডাক্তারের বিশ্রামের প্রয়োজন।”
–“যাক, তুমি তবে সৌভাগ্যবতী।”
–“চা খাবেন?”
প্রণভ ওদের কেবিনে লাগেজ ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
–“চায়ের লোভ করলে দেখা যাবে আমাকে নিয়েই ট্রেন রওনা হয়েছে।”
রিমঝিম আবারও হাসল। এশা বলল,
–“ভাইয়া, আমি কিন্তু এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছি পড়া থেকে। মাকে বলে দাও, ওখানে গিয়ে যাতে পড়ার কথা না বলে। বিয়ে বাড়িতে কেউ পড়তে যায় নাকি?”
প্রণভ মুচকি হেসে এশার চুল এলোমেলো করে দিল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। প্রণভ সকলের থেকে বিদায় নিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকাল,
–“সাবধানে যাবেন, ঝিম। এক সপ্তাহ মন খুলে বাঁচবেন। ধরে নিন, এই সপ্তাহ শুধু আপনার নিজের। কোনো সেক্রিফাইজ নয়। নিঃস্বার্থ মানুষদেরও নিজেকে সময় দেওয়ার দরকার হয়। আসি, আল্লাহ হাফেজ।”
রিমঝিমকে প্রণভের বলা কথাগুলো মৌনোও শুনল। তার মাথায় আবারও নিবিড় ঘুরঘুর করছে। মৌনো মাথা চেপে বসে রইলো। কেন যে সব জায়গায় শুধু নিবিড় বিচরণ করে। নিবিড়কে এত ভাবার কী আছে? মৌনো মাথা চেপেই বলল,
–“আপা, আমাকে চা দাও। মাথা ধরেছে।”
নাহিয়ান দীপ্তকে পড়াতে এসেছে। দীপ্তকে পড়ানো শেষ হলেই শুহারার পড়ানোর পালা হবে। অবশ্য, শুহারা সপ্তাহে তিন দিন পড়ে। দীপ্তর থেকে জেনেছে দীপ্তর মা বাড়ি নেই, কোন কাজে নাকি বেরিয়েছেন। এতে নাহিয়ানের অস্বস্তি হলো। দীপ্ত থাকলেও ঘরে অল্পবয়সী মেয়ে আছে। ব্যাপারটা কেমন দেখা যায়।
শুহারা এর মাঝে আসল নাস্তা নিয়ে। সে প্রায়ই এটা সেটা বানিয়ে এনে নাহিয়ানকে খাওয়াবে। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। কিন্তু প্রতিবারই খাবার দিয়েই শুহারা চলে যায়। আজ গেল না, অন্য এক চেয়ারে গিয়ে বসল। ভাবভঙ্গি এমন যেন খুব সিরিয়াস কিছু বলতে যাচ্ছে। নাহিয়ান ওর দিকে খুব একটা ফিরে দেখল না। দীপ্তর করা অংকে লাল কলমে দাগ দিতে দিতে বলল,
–“কিছু বলবে?”
–“জি, এজন্যই বসেছি।”
নাহিয়ান মাথা তুলে তাকাল। শুহারা বেশ প্রস্তুতি নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
–“আপনি নতুন টিউশনি খুঁজে নিন, ভাইয়া।”
শুহারার গলায় ‘স্যার’ এর বদলে ‘ভাইয়া’ ডাক শুনে সে একটু চমকাল। হঠাৎ এই মতিভ্রম কেন? কী চলছে এই ছোটো মাথায়? নাহিয়ান গলা পরিষ্কার করে বলল,
–“সরি? বুঝিনি।”
–“বলেছি, আমি এখন থেকে আর আপনার কাছে পড়ব না। আম্মু বাসায় নেই, থাকলে আম্মুই আপনাকে সুখবরটা দিত।”
–“পড়বে না কেন? কোন ভূত চেপেছে আবার মাথায়?”
শুহারা উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তর রুম থেকে যাওয়া ধরেছে।
–“আপনি একবার বলেছিলেন শিক্ষক হচ্ছে পিতার সমান। আমার আব্বু আছে, আমি চাই না আপনাকে পিতার মতো সম্মান দিতে।”
বলেই নাহিয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শুহারা একবার পালাল। নাহিয়ান বোকার মতো বসে রইলো। আজব এক মেয়ের খপ্পরে পড়েছে সে। খাবারের ঢাকনা উঠাতেই দেখল কেক। কেকের সাথে শুহারার লেখা এক চিরকুট,
“আজ আমার জন্মদিন ভাইয়া। এই জন্মদিনে আপনাকে স্যার হিসেবে ত্যাজ্য করলাম। এখন থেকে ভাইয়া ডাকব, সামনে নাম ধরেও ডাকতে পারি। তবে সেটা সামনের জন্মদিনে ভাবব। দীপ্তর পড়া শেষে ডেকে একটু আমাকে “হ্যাপি বার্থডে” জানাবেন প্লিজ?”
এই চিরকুট পড়ার পর নাহিয়ানের মাথায় একটা প্রশ্ন খেলে গেল, মেয়েটা বোকা? পাগল? নাকি বেয়াদব?
দীপ্তকে পড়ানো শেষে নাহিয়ান বের হতে নিল, এমন সময়ই তার শুহারাকে মনে পড়ল। সে দীপ্তকে ডেকে বলল,
–“শুহারাকে ডাকো।”
শুহারা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসল। অবাক কাণ্ড! শুহারার হাত মৃগ রোগীর মতো কাঁপছে কেন? শুহারা কাঁপা গলায় বলল,
–“ডে-ডে-ডেকেছেন ভাইয়া?”
–“হুঁ! শুভ জন্মদিন। টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করো, আপাতত এটুকুই দোয়া দিতে পারলাম। কেকের জন্য ধন্যবাদ।”
শুহারার হাতের সাথে এবার শরীর কাঁপছে। কোনোরকমে মাথা নেড়ে বলল,
–“আ-আ-আমি কেক বানিয়েছি।”
নাহিয়ান আর কিছু বলল না, জুতো পরতে পরতে বলল,
–“কিছু মনে কোরো না, আমার মনে হচ্ছে তোমার মৃগরোগ আছে। তোমার চিকিৎসার প্রয়োজন।”
ভোর চারটা নাগাদ ওরা চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। কোনো রকমে মামা বাড়ি ফিরেই রিমঝিমসহ বাকি দুই ভাইবোন বিছানায় শুয়ে পড়েছে ঘুমে। এশা যেহেতু পুরো পথ ঘুমিয়ে এসেছে তার আর ঘুমানোর প্রয়োজন হলো না। সে ফেরার পর থেকেই মায়ের সাথে লেপ্টে রইলো। নতুন পরিবেশে সহজ হয়ে গেলেই আবারও সে বাঁদরামি শুরু করবে। ইয়ামিন তো বোন জামাই, বোনকে পেয়ে বড়ো ভাইয়ের সাথে বাজার করতে চলে গিয়েছে। ওরা বাজারের পরিকল্পনা করেই রেখেছিল, যেন ওরা আসলেই তাজা তাজা বাজার করতে বেরুবে।
মৌনো বিকালের দিকে মামাতো, খালাতো ভাই-বোন শিহাব এবং বুশরার সাথে বেরিয়েছে। রিমঝিমের মাথা ধরেছে, এজন্য সে বিশ্রাম নিচ্ছে। আর এশাকে তো এখানে আসার পর দেখাই যাচ্ছে না। মামাদের এই বাংলোতে সে একদম ছোটোবেলায় একবার এসেছিল, যখন নানা বেঁচে ছিল। এরপর প্রতিবারই এখানে আসবে আসবে করেও আসা হয়নি। আগে নানুর সাথে অন্য জায়গায় থাকত, নানু মারা যাওয়ার পর আবারও এই বাংলোতে সব ভাইরা উঠেছেন। নানা মা(১)রা যাওয়ার পর নানু কিছুতেই এখানে থাকতে চাননি। সে নাকি রোজ নানাকে স্বপ্নে দেখতেন, শোক সইতে পারতেন না। এজন্য তিনিই বায়না করলেন অন্য জায়গায় যাবেন। এজন্যই একপ্রকার বাধ্য হয়ে এই বাড়ি ছেড়ে দেওয়া।
এই বাড়ি থেকে রেলপথ কাছেই। ট্রেন গেলে বাড়ি খুব ঝাঁকুনি দেয়। ফুচকা খাওয়ার সময়ে মৌনো মামাতো ভাইয়ের থেকে শুনল কাছাকাছিই নাকি কলোনি আছে নেভিদের। মৌনো শুনে অবাকই হলো। এজন্যই এই এলাকা এত পরিচ্ছন্ন এবং ভিআইপি ধরনার। খাওয়া-দাওয়া সেরে সন্ধ্যায় যখন গোলাপি হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যখন ওরা হাইওয়ে পার হতে নিচ্ছিল, ওমনি মৌনো নিবিড়কে দেখে থমকে যায়। নিবিড় ঠিক রাস্তার ওপারে। সে কী স্বপ্ন দেখছে? মৌনো টেরই পেল না কিছু সেকেন্ডের মধ্যে মৌনোর দিকে একটি প্রাইভেট কার ছুটে আসছে। রাস্তার ওপার থেকে নিবিড় মৌনোকে স্পষ্ট দেখে চেঁচাল,
–“মৌনো, সাবধানে!”
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে~~~
[যারা গল্পটি পড়ছেন তারা রেসপন্স করবেন যেন বাকি পাঠকদের ফিডেও পর্বটি পৌঁছায়।]
বিঃদ্রঃ রিচেক পরে দিচ্ছি। দুঃখিত গতকাল গল্প দিতে না পারার জন্য, আমি লিখার আগেই ঘুমিয়ে গেছিলাম😒
কেমন লেগেছে জানাবেন। আর দেরী করতে চাই না বলে এটুকুই দিয়ে দিলাম। আবারও দুঃখিত সুইটিরা😭
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ১৩
-
বেলতুলি পর্ব ১২
-
বেলতুলি পর্ব ১০
-
বেলতুলি পর্ব ১৮
-
বেলতুলি পর্ব ২
-
বেলতুলি পর্ব ৪
-
বেলতুলি পর্ব ৮
-
বেলতুলি গল্পের লিংক
-
বেলতুলি পর্ব ১৫
-
বেলতুলি পর্ব ১