বেলতুলি – [১৫]
লাবিবা ওয়াহিদ
[অন্যত্র কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
দুইদিন বাদে দুটো খবর এলো। এক, রত্নার মোবাইল চুরি গেছে আর দুই, কায়সার জেলে। রিয়াজ সাহেবের কাছে এমনই খবর এসেছে। রিমঝিমের হবু স্বামী অর্থাৎ কায়সারকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। এখন সে থানায়, পুলিশের হেফাজতে। রিয়াজ সাহেবের এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, তার প্রেশার লো হচ্ছে।
ঘণ্টাখানেক যাবৎ রিয়াজ সাহেব থম মে(১)রে সোফায় বসে আছেন। তার আশেপাশে সবাই চিন্তিত। জুনায়েদ এবং এশা দুজনেই স্কুলে। মৌনোর আজ ক্লাস ছিল না, তাই সে বাড়িতেই মাকে সাহায্য করছিল। রিমঝিম হাসপাতাল থেকে ফিরেই প্রেশার মেশিন নিয়ে বসেছে বাবার পায়ের কাছে। রিমঝিমকে আগে থেকে কিছু বলার প্রয়োজন হলো না। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আগে থেকেই সে অবগত, নয়তো এই অসময়ে সে কেন ফিরবে হাসপাতাল থেকে?
রিয়াজ সাহেব অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। অথচ মেয়ে তখনো নিশ্চুপ, স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি। মেয়েকে দেখে রাজিয়া শেখ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। রিয়াজ সাহেবের তুলনায় রাজিয়া শেখ বেশ শক্ত মানসিকতার। তিনি পরিস্থিতি বুঝতে, শুনতে বেশ পটু। নারীদের কথায় কথায় ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে ওঠা তার সঙ্গে খাটে না। ঠিক একই স্বভাব পেয়েছে তার মেয়েরা। রিমঝিম, মৌনোও জীবনে খুব কম কেঁদেছে। অন্তত রিমঝিমের তুলনায় মৌনো তো একদমই নয়। এশা পড়ে গিয়ে হাঁটু ছিলে ফেললে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায়, যা অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় কিছুটা অস্বাভাবিক। এশাকে কেউ কাঁদতে না দেখলে যখন জিজ্ঞেস করে, এশা ছিলে যাওয়া হাঁটু নিয়েই বলবে,
–“মা বলেছে শক্তিশালীরা কাঁদে না। আমিও শক্তিশালী আপুদের মতো।”
এটুকুনি বাচ্চার মুখে গোছানো কথা শুনে সবাই যেমন অবাক হয়, তেমনই টের পায় এই মেয়ে আস্ত ঝালমরিচ। যেই কাছে যাবে ঝালে কাঁদিয়ে ছাড়বে। অবশ্য, তাদের ধারণা মিথ্যে নয়।
রিমঝিম প্রেশার মেপে মায়ের উদ্দেশে বলল,
–“তেঁতুল আনো তো আম্মা।”
রাজিয়া শেখ ওতেই বুঝে গেলেন এই দুঃসংবাদে স্বামীর প্রেশার হাই। দ্রুতই তেঁতুলের ব্যবস্থা হতেই রিয়াজ সাহেব খেলেন। ততক্ষণে রিমঝিম বোনের উদ্দেশে বলল,
–“এশার ছুটি হয়ে গেছে, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নিয়ে আয়। জুনায়েদকেও পারলে ছুটি করিয়ে নিয়ে আসিস।”
মৌনো মেনে নিল। দ্রুত শুধু জামাটা পালটে ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়ে গেল। সে কখনো ভাবতে পারেনি কায়সার অর্থাৎ রিমঝিমের হবু বরকে কোনো ভদ্রমহিলা মামলা দিবে। অবস্থা যে সুবিধের নয় তা বুঝতে বাকি রইলো না। মৌনো ভরদুপুরের রোদ্দুরকে এড়িয়ে আকাশের পানে তাকাল। মিনমিন করে বলল,
–“আপার সাথে একই রঙের শাড়ি পরার ইচ্ছে তবে অপূর্ণ থাকল না।”
রিকশাতে ওঠার আগে মৌনো তার টিউশনির দু’বাড়িতে জানিয়ে দিল, আজ সে পড়াবে না।
রিয়াজ সাহেব মেয়ের পানে চেয়ে বললেন,
–“কায়সার জেলে আছে জানিস তো?”
–“হুঁ, তুমি এতে ভেঙে পড়ছ কেন?” রিমঝিমের স্বাভাবিক গলা।
রাজিয়া শেখ বলল,
–“তোকে কে বলেছে?”
–“যে মামলা দিয়েছে।”
রাজিয়া শেখ, রিয়াজ সাহেব দুজনই বিস্মিত এই কথাতে। রাজিয়া অস্ফুট স্বরে বললেন,
–“মানে কী?”
রিমঝিম আরেক সোফায় বসল। হাত বাড়িয়ে গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খেল। এর মাঝে খবর পেয়ে মশিউর সাহেব তৎক্ষণাৎ এলেন। রিমঝিমকে এত নীরব হয়ে বসে থাকতে দেখে তার ভালো লাগল। সাথে পুলিশি জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনি রিমঝিমের মুখ দেখেই বুঝে গেলেন কিছু তো হয়েছে। তিনি অন্য এক সোফায় বসে বললেন,
–“ভয় পাবে না রিমঝিম, যা মনে আছে সব ঝেড়ে ফেলো।”
রিমঝিম শুরুতে ইতঃস্তত করল, ভাবল বলবে কিনা। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
–“আমি আগে থেকেই তোমাদের বলতে চাচ্ছিলাম। তবে বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। গত সপ্তাহে এক অল্পবয়সী মেয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। খুব কম বয়স, বাইশ হবে। পেট উঁচু। মানে প্রেগন্যান্ট। ও আমাকে এসেই জিজ্ঞেস করল কায়সারের সাথে আমার কী সম্পর্ক? যেন সে এতদিন অন্ধ হয়ে ছিল, আমি উত্তরটা বললেই তো অন্ধত্ব কেটে যাবে।”
রিয়াজ সাহেবের মুখ আরও চিন্তিত দেখাল। মশিউর সাহেব বললেন,
–“এরপর? তুমি সত্যি বলেছ তো?”
–“জি। মেয়েটি ছিল আরেক আওয়ামীলীগের আদরের একমাত্র বোন। সাথে কায়সারের গর্ভবতী স্ত্রী।”
অবশেষে কোনো ঝামেলা ছাড়াই রিমঝিম আর কায়সারের বিয়েটা ভেঙে গেল। কায়সারের অসহায় বাবা রিয়াজ সাহেবকে আটকাননি। তিনি নিজেও ছেলের কর্মকাণ্ডে লজ্জিত। ছেলেকে কত বাঁধ সেধেছিলেন, যেন ছেলে নেতা না হয়। হলেও যাতে সীমা লঙ্গন না করে। রাজনীতি পাপ নয়, সে পাপীদের ছোঁয়ায় হারাম হয়েছে। রাজনীতি এমন একটা জিনিস যেখানে নিয়ন্ত্রণের লোভে মানুষ নিজের বোধগম্য হারিয়ে ফেলে। সেখানে কায়সার তো দুটো মেয়ের সাথে খেলতে গিয়েছিল। সেই মেয়ের বড়ো ভাই টেনে-হিঁচড়ে তার সমস্ত পাপ বের করে একটা একটা করে মামলা ঠুকছেন। তার ক্ষমা ছাড়া কায়সারকে ছাড়িয়ে আনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাকা-পয়সা খরচ করলেও লাভ হবে না। কায়সারের বাবা চাইলেই ছেলেকে শাস্তিস্বরূপ জেলে পচে ম(১)রতে দিতে পারতেন, কিন্তু পারলেন না। সন্তান যত অপরাধই করুক, সন্তানকে তারা দুঃখে, অশান্তিতে দেখতে পারেন না। তারাও সন্তানের সমান দুঃখ পান।
এলাকায় বাতাসের সাথে রিমঝিমের বিয়ে ভাঙার কথা ছড়াতে সময় নিল না। আজ একে থেকে পাঁচ জেনেছে। কাল হয়তো আরও জানবে। এই ভেবেই রিয়াজ সাহেব নিজের ঘরে শক্ত হয়ে বসে আছেন। তার ফুলের মতো ভালো মেয়ে, অথচ বারবার তার ফুলটা ঝড়ের বেগে পাঁপড়ি হারাচ্ছে। সুগন্ধি হারিয়েছে তো কবেই। কতবার চেষ্টা করলেন সেই সুগন্ধি ফিরিয়ে আনার। দরজায় কড়াঘাতে ওনার ধ্যান ভাঙল। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলেন রিমঝিম। মুখাবয়ব স্বাভাবিক করে হাসলেন তিনি। মেয়েকে কাছে ডাকলেন।
–“কিছু বলবে, মা?”
বাবার মুখে “মা” ডাকটাই সম্ভবত যথেষ্ট ছিল, হৃদয় শান্ত হবার জন্য। রিমঝিম গিয়ে বিছানায় বসল, রিয়াজ সাহেব ইজি চেয়ারে বসা। রিমঝিম কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
–“একটা আবদার করতে এসেছি, বাবা।”
–“নিশ্চয়ই, বলো।”
–“অন্তত ছয়-সাত মাস বিয়ের কথা বোলো না বাবা। আমি জানি আমার জন্য তোমরা চিন্তা করো, তবে আপাতত আমি বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে চাই। নিজেকে সময় দিতে চাই।”
বলেই রিমঝিম থামল।
–“এতদিন তোমাদের কথা শুনে গেছি। আজ আমাকে একটু শুনবে, বাবা?”
মৌনো অস্থিরতায় এক অভাবনীয় কাজ করতে বসেছে। সে আজ নিবিড়কে চিঠি লিখতে বসেছে, যা সে কোনোদিন করবে তা ভাবনাতেও আসেনি। যার সাথে সহজ হয়ে দুটো কথা বলেনি তাকে এক পৃষ্ঠার চিঠি লেখা কী মুখের কথা? কিন্তু হ্যাঁ, মৌনো আজ সত্যিই লিখছে। তার মনের কথাগুলো সে কাউকে বলতে পারছে না। তার পাশে আজ হাফসাও নেই, বাইরের একটা ছেলে তাকে কেড়ে নিয়েছে। অথচ তার সাথে সে খোলা বইয়ের ন্যায় চলতে পারত। হাফসা ছাড়া আর কে আছে? তখনই তার মাথায় কেন যেন নিবিড় উঁকি দিল। এরপর আর কি, সে সব ভুলে লিখতে বসল।
“প্রিয় নিবিড় ভাই,
চিঠির শুরুতেই সালাম নিবেন। আমি জানি আপনি ভালো থাকবেন, তবে এখানকার পরিস্থিতি জটিল। আমি কথা বলার মতো কাউকে পাইনি বলেই আপনাকে চিঠি লিখতে বসা। আমি এই আশা করছি না আপনার থেকে ফিরতি চিঠি পাব, তবে আমি একটু হালকা হবার লোভেই লিখে যাচ্ছি।
আপার বিয়েটা ভেঙে গেছে। এবার যার সাথে আপার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সে কায়সার ভাই, আমাদের গ্রামের। মুখ দেখে কেউই বলবে না সে কত বড়ো বিশ্বাসঘাতক। আপার বিয়ের দশদিন আগেই এক মেয়ে আপার কাছে আসে এবং জানায় সে কায়সারের স্ত্রী, পাঁচ মাসের অন্তসত্ত্বা। ভাবতে পারছেন কী ভয়াবহ কাণ্ড? একটা লোক নিজের প্রথম স্ত্রীকে লুকিয়ে আপাকে বুক ফুলিয়ে বিয়ে করতে এসেছিল। শুনেছি আপাকে নাকি বিয়ের আগেই খুব বিরক্ত করত। এর থেকেই আমি আবারও প্রমাণ পেয়েছি, আমি নেতাদের দেখতে পারি না, এটা যথাযথ। আপার থেকে সব শুনে সেই মেয়েটি আপাকে কথা দিল তাকে আর কষ্ট পেতে দিবে না। আর ঠকাতে দিবে না। তাই তো সে তার বড়ো ভাইকে সব বলে দিতেই সে রাগে অন্ধ হয়ে গেলেন। একে তো বোন পালিয়ে বিয়ে করেছে বিরোধী দলের নেতাকে, তার ওপর এত বড়ো ঠকবাজি। সে কী নিয়ন্ত্রণে থাকে? দিল কতগুলা মামলা ঠুকে। এখন মনে হয় না সহজে জেল থেকে ছাড়া পাবে। বাবা বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন। এই পুরো ঘটনায় আপা পুরো স্বাভাবিক। সে আরও এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘রত্নার মোবাইল চুরি গেল কী করে? এখনো পায়নি?’
বুঝতে পারলেন, ঠিক কেমন ধরণের স্বাভাবিক? ও হ্যাঁ, আপনার হবু বউয়ের ফোন চুরি গেছে। জানি আপনি জেনে যাবেন, তবুও কি ভেবে লিখলাম জানা নেই। তবে আপাকে দেখলে আমার খুব অবাক লাগে। আপা এত শক্ত কেন? ভাঙলেও বুঝতে দেয় না। আমার জীবনের একটাই ইচ্ছে, আমি আপার মতো শক্ত হতে চাই। আপার মতোই হতে চাই। সবদিক থেকে। আমার বিশ্বাস আপার জীবন ফুলের মতো হবে, সত্যি বলেছি না বলুন?
আমি নিশ্চিত আপনি এই ঘটনা শুনে গম্ভীর গলায় বলছেন, ‘ওকে ধরে পিটাও না কেন সবাই? পিটাও! না পারলে আমাকে বলো, দেখো ওর কী হাল করি। অ-জাত কোথাকার!’ কীভাবে বুঝলাম তার উত্তর নেই, হয়তো আপনার নেচার সম্পর্কে একটুখানি ধারণা হয়েছে।
আজ আর নয়, যতটুকু লিখেছি সম্ভবত বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বাজে কিছু বলে বসলে অগ্রীম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তবে আমি জানি, এই ঘটনায় আপাকে আপনিই সবার আগে সাপোর্ট দিবেন। ভালো থাকবেন, নতুন পদের জন্য অভিনন্দন।
ইতি,
মৌনো।”
মৌনো চিঠি লিখে বসতেই রিমঝিমের মোবাইল বেজে উঠল। রিমঝিম বাবার ঘরে গেছে। তাই মৌনো টেবিল থেকে উঠে বিছানায় চলে গেল। অচেনা নাম্বার থেকে কল। ফেলায় রাখাও যাচ্ছে না। রিমঝিম কখনোই অচেনা নাম্বার এড়িয়ে চলে না, যদি কোনো রোগী হয়? মৌনোও তাই ভাবল। তাই তো মোবাইল ধরে কল রিসিভ করল।
–“হ্যালো?”
নীরবতা ভেঙে ওপাশ থেকে ধীরে-সুস্থে একটা পুরুষালি, চিরচেনা কণ্ঠস্বর ভেসে আসল,
–“মৌনো? আর ইউ অলরাইট?”
®লাবিবা ওয়াহিদ
চলবে—
[যারা গল্পটি পড়ছেন তারা সাড়া দিবেন যাতে অন্যান্য পাঠকদের ফিডেও পর্বটি পৌঁছাতে পারে। অগ্রীম কৃতজ্ঞতা।]
বিঃদ্রঃ একটু একটু রিচেক দিয়েছি, বাকিটাও দিচ্ছি পরে। আপনারা যারা পড়ছেন সুন্দর করে মন্তব্য করবেন। আমি চেষ্টা করেছি আজকের ঘটনাপ্রবাহ সুন্দর করে বর্ণনা করার, রাজনীতির একটি দিক তুলে ধরার। উপন্যাস কিংবা গল্প এক, দুই চরিত্রকে কেন্দ্র করে হয় না। গল্পের প্রাণ হয় গল্পে উপস্থিত প্রত্যেক চরিত্রই। আপনাদের মৌনো, নিবিড়কেই লাগবে এমন নয়। বাকিদের চরিত্রকেও সমানভাবে প্রাধান্য দিতে হবে, নয়তো আমার এই পরিশ্রম বৃথা যাবে। সুন্দর সুন্দর মন্তব্যের অপেক্ষায়।
আগামী পর্ব শুক্রবার পাবেন, ইনশাআল্লাহ।
Share On:
TAGS: বেলতুলি, লাবিবা ওয়াহিদ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বেলতুলি পর্ব ১১
-
বেলতুলি পর্ব ৫
-
বেলতুলি পর্ব ১৭
-
বেলতুলি পর্ব ১৩
-
বেলতুলি পর্ব ৩
-
বেলতুলি পর্ব ৮
-
বেলতুলি গল্পের লিংক
-
বেলতুলি পর্ব ৬
-
বেলতুলি পর্ব ৪
-
বেলতুলি পর্ব ১৬