০৮
পাত্রপক্ষ চলে এসেছে। তাদেরকে বরণ করতে আমরা সবাই গেট আটকে দাঁড়িয়েছি। মিষ্টিমুখ ও শরবত খাইয়ে টাকা আদায় করা হবে। তারপর তাদেরকে বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি। আমাদের দাবি ছিলো দশ হাজার। কিন্তু মাত্র দুই হাজার টাকা দিয়ে পাত্রপক্ষ হই হট্টগোল শুরু করে দিলো। বাড়ির মুরুব্বীদের আদেশে আমরা গেট ছেড়ে দিয়ে সরে এলাম।
ঝলমলে আলো, আর বাড়িভর্তি মেহমান। বিয়েবাড়ির আমেজে ভরপুর। সবগুলো ঘরে গিজগিজ করছে মানুষ। গ্রামবাসী মহিলারা দলবেঁধে এসেছে বর কনেকে দেখার জন্য।
হঠাৎ খেয়াল করলাম বাবরিচুল আমার দেয়া ব্লেজারটা পরেছে। আজকে অসম্ভব ব্যস্ত সে। এই বিয়েবাড়িতে যেখানে সবাই আনন্দে মশগুল। সেখানে উনি সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা সেদিকটা নিয়ে ব্যস্ত। এই যেমন বরপক্ষের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা, নিমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, সবদিকেই তার খেয়াল।
বিয়ে পড়ানোর আয়োজন শেষ হতেই মিষ্টি খাওয়ার ধুম পড়ে গেলো। বাবরিচুল আমার সামনে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির। আমি হাত পেতে দাঁড়ালাম। সে আমার হাতে একটা মিষ্টি দিয়ে বললো, এরপর আপনার বিয়ের মিষ্টি বিতরণ করতে চাই।
আমি মুখ বাঁকা করে বললাম, শখ কত!
‘শখ থাকা কি দোষের? আপনিই এরপর বিবাহযোগ্যা কন্যা। তাছাড়া আপনার আজকে একটা প্রস্তাব এসেছে শুনলাম।’
‘কার কাছে শুনলেন?’
‘শুনেছি শুনেছি। ছেলেটাকেও দেখলাম।’
‘একজনকে?’
‘হুম।’
‘আমিমি তো শুনেছি আমার দুইজনের সঙ্গে বিয়ের আলাপ চলছে। আরেকজনকে দেখেননি শুনে খারাপ লাগলো।’
বাবরিচুল এবার খানিকটা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আমি শুধু আয়মান নামের একজনকে দেখলাম। আরেকজনও কি এখানকার?’
‘সেটা বলা যাবে না। খুঁজে বের করুন।’
‘আরে বলে ফেলেন।’
‘উহু, খুঁজে বের করুন দেখি।’।’
আমি মিষ্টি নিয়ে ওর সামনে থেকে আড়ালে চলে এলাম। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে মিষ্টিটা খেয়ে শেষ করেছি, এমন সময় শুনলাম মিষ্টি কম পড়েছে। এলাকাবাসী অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে আশেপাশে। বরপক্ষ যা মিষ্টি এনেছে, তা শেষ। এবার কি হবে!
বাবরিচুল গতকালের মিষ্টি গুলো ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলো। সে ওই মিষ্টি গুলো বের করে এনে সবার মাঝে বিতরণ করলো। সবাই প্রশংসা করতে লাগলো ওর। ছেলেটা গতকাল দশ কেজি মিষ্টি আনায় সবাই ওকে কত কথা শুনিয়েছে। অথচ ওর সেই মিষ্টি গুলোই এখন সম্মান বাঁচালো। সবার মুখে এমন প্রশংসা শুনে আমি মনেমনে ব্যাপক খুশি।
বরপক্ষের সঙ্গে অনেক অল্পবয়সী ছেলেপেলে এসেছে। ঝিকি আর মিকি অনেক্ষণ যাবত আমার পিছে ঘুরছে। মিকিকে কোন ছেলেটা পছন্দ করেছে সেটা জানার জন্য। আমি ওদেরকে ইনিয়ে বিনিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছি। এবার আর পারলাম না। হঠাৎ মিকি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। আঙুল উঁচিয়ে একটা ছেলেকে দেখিয়ে বললো, ‘ওটা না?’
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। চুপ করে আছি। মিকি বললো, ‘ছেলেটা আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে।’
‘ওহ।’
‘ওটা কি না?’
‘দ্যাখ, এসব ছেলে তোর সঙ্গে যায় না। তুই আরও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করিস। এজন্য আমি বলতে চাচ্ছিনা। আমার ছেলেটাকে পছন্দ হয়নি।’
সময় যতই গড়াতে লাগলো, সবার মনে যেন বিষাদ ভর করলো এসে। আনন্দঘন বিয়েবাড়িটা মুহুর্তেই অবসন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। কনে বিদায়ের কথা ভেবে সবাই মনমরা হয়ে গেছে। আমি চেষ্টা করছি চাচা চাচীদেরকে খানিকটা আনন্দমুখর রাখার। তাতে লাভ হলোনা খুব একটা। বড় চাচা গালে হাত দিয়ে অন্ধকার ঘরে বসে আছেন।
আমি চাচার সামনে বসে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করলাম। তিনি এতে আরও আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন, ‘আমার মেয়েটা আজকে থেকে চলে যাবে রে মা। আমার ঘর অন্ধকার করে দিয়ে আমার মা চলে যাবে।’
এমন কথায় স্বাভাবিক ভাবেই নিজেকে ধরে রাখা যায় না। আমি অশ্রুসিক্ত চোখে বললাম, ‘চাচা, কষ্ট পাবেন না। আপু অনেক ভালো থাকবে। দোয়া করুন ওর জন্য। আপনি কাঁদলে আপু কিভাবে যাবে বলেন?’
‘মা রে, আমার বুক ছিঁড়ে যায়। আমার মেয়েকে কিভাবে আমি আরেকজনকের হাতে তুলে দিবো রে মা?’
কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কষ্ট অনুভব করার শক্তি আমার নেই। কথা বলতে বলতে আমারই গলা ধরে আসলো। এই বিষাদ আমাদের পুরো বাড়ি ছেয়ে ফেললো আজ।
সকলের কান্নার শব্দ, হাহাকার, আর তীব্র মনোঃকষ্টের ভেতর দিয়েই কনের বিদায় সম্পন্ন হয়ে গেলো। চলে গেলো মাইশা। যেই বাড়িটা এই কয়েকদিন ধরে সবচেয়ে আনন্দের, আলোকিত আর হৈ হুল্লোড় নিয়ে মেতে ছিলো, সেই বাড়িটাই আজকে হয়ে উঠলো গ্রামের সবচেয়ে শান্তশিষ্ট বিষাদময় বাড়ি।
সবাই চুপচাপ। বাইরের আলোগুলো মলিন হয়ে জ্বলছে। রাতের আঁধার আজ পুরোপুরি গ্রাস করে ফেললো মণ্ডলবাড়ির আঙিনা।
পরদিন সকালে ঘুম ভাংলো বেলা করে। রৌদ্রজ্বল দিন। উঠে দেখি পোলাওয়ের ঘ্রাণে চারিদিক ম ম করছে। গতকালের কিছু পোলাও, বুটের ডাল বেচে গিয়েছিলো। সেগুলো এখন গরম করা হয়েছে। বিয়েবাড়ির এই রয়ে যাওয়া বাসি পোলাও আর বুটের ডাল আমার বড্ড পছন্দ। খুব আয়েশ করে খেলাম আমি। গতরাতের বিষাদ এখন অনেকটাই ফুরিয়ে গেছে সবার মাঝে।
বাইরে এসে দেখি সমস্ত প্যান্ডেল, গেট ও আলোকসজ্জা খুলে ফেলা হচ্ছে। বিয়ে শেষ, এসব আর থাকবে কেন! ভাবতেই আমার মনটা কেমন যেন করে উঠলো। যেদিন এসব প্যান্ডেল আর লাইট লাগানো হচ্ছিলো, সেদিন আনন্দটাও হয়েছিলো সীমাহীন!
মেহমানরা অনেকেই চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। বেশি রাত হওয়ায় যারা যেতে পারেনি, তারা এখন বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউবা ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে। আজকের দিনটাও আমার জন্য বিষণ্ণতার। আনন্দগুলো এভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া আমার মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়।
মন ভালো করতে সমবয়সী ভাই বোনদেরকে বললাম, চলো আমরা ঘুরতে যাই।
আমার প্রস্তাবটা সবার বেশ পছন্দ হলো। অতি উৎসাহে আমরা দল বেঁধে গ্রাম ঘুরতে বের হলাম। এক কিলোমিটার হেঁটে গেলে একটা নদী আছে। আমাদের উদ্দেশ্য সেখানে যাওয়া। পথে যেতে যেতে গ্রামের অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। সবার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করলাম। কোন এক অদ্ভুত কারণে গ্রামের মানুষরা আমাকে ভীষণ পছন্দ করে।
চলতি পথেই দেখা হয়ে গেল বাবরি চুলের সঙ্গে। ফুফাতো ভাইয়ের সাথে একটা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আমি বাদে আমার দলের সবাই ওদেরকে বলল, তোমরা যাবা নাকি আমাদের সঙ্গে?
ওরা অতি উৎসাহে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আমি জানি না কেন আমার মনটা হঠাৎ অসম্ভব ভালো হয়ে গেল। এই ছেলেটা আশেপাশে এলেই কেন আমার এত ভালো লাগে!
গাঁয়ের ছোট্ট নদী। নদীটা খুব বড় নয়। শান্ত, সরু এক নদী। পানি একদম পরিষ্কার, নিচের বালু পর্যন্ত দেখা যায়। হাওয়া আস্তে আস্তে বইছে, দুই পাড়ে কাশবনের ডগাগুলো দুলে দুলে যেন গান গাইছে।
আমাদের কারও হাতে চিপসের প্যাকেট, কেউ আবার ফোন বের করে ছবি তুলছে। হাসাহাসিতে চারদিকটা মুখর হয়ে উঠলো।
খালি পায়ে বালুর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম। হাতে থাকা জুতো জোড়া অজান্তেই দিয়ে দিলাম বাবরিচুলকে।
ছবি তোলা শেষে আবারও হাঁটা ধরলাম। পেছনে ওরা হৈ হুল্লোড় করছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে বাবরিচুল। আমি মৃদু স্বরে বললাম, ‘এই নদীটা না, দেখলে মনে হয় ছোট্ট করে কেউ আঁকাআঁকি করে রেখেছে। কত শান্ত!’
‘হুম। গ্রামে আসলে মনটাই অন্যরকম ভালো হয়ে যায়।’
হঠাৎ সবাই মিলে পানি ছিটানো শুরু করল। ছোট্ট নদীর সেই ঠাণ্ডা পানি গায়ে লাগতেই হাসির আওয়াজ বেড়ে যায় আমাদের। ওদের পানি ছিটাছিটি থেকে খানিকটা দূরে সরে এলাম। ইশারায় ডাকলাম বাবরিওয়ালাকে।
দুজনে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালাম নদীর বাঁকে। বাতাসে কাশফুল দুলছে। ওপাশে নদীতীরে সবজির ক্ষেত। এখানে এসে মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে আমার।
‘আজকে মিস মীরাকে খুব শান্ত মনে হচ্ছে! নদী দেখে?’
‘না। বিয়েবাড়ির ওপর একটা মায়া পড়ে গেছে। বিয়ে শেষ, আমেজটাও উধাও। বাড়িটা কেমন মনমরা হয়ে গেছে। ভালো লাগছে না কিছু।’
বাবরিচুল হেসে বললো, ‘এত ইমোশনাল হলে চলে?’
‘আপনার খারাপ লাগছে না?’
‘না। যার বিয়ের জন্য এত আয়োজন, তার বিয়েটা সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এটা তো আনন্দের ব্যাপার। আমি কেন মন খারাপ করে থাকবো?’
আমি অবাক হলাম। কত পরিপক্ক চিন্তাভাবনা! অথচ আমি এভাবে ভাবিনি কখনো। এজন্যই সবার চোখে আমি এখনো ছোট, অপরিণত!
হঠাৎ খেয়াল করে দেখি তার হাতে আমার জুতো জোড়া। আমি লাজুক হেসে জুতোটা চেয়ে নিলাম। অজান্তেই বেশ অধিকার খাটানো শুরু করেছি ভেবে একচোট হেসে নিলাম।
ফেরার সময় গ্রামের কাঁচা রাস্তাটা যেন আরও মধুর হয়ে উঠলো। পায়ের নিচে শুকনো মাটির হালকা খসখস শব্দ, গাছেদের ফাঁক দিয়ে হালকা কমলা রোদ এসে গায়ে লাগছে। সবাই নিজেদের মতো গল্প করতে করতে হাঁটছে, কিন্তু আমার মনটা শান্ত নদীর মতো।
বাবরিচুলওয়ালা একদম কোণায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যখনই আমি আড়চোখে তাকাচ্ছি, দেখি সেও আমার দিকে তাকাচ্ছে! আমাদের চোখে চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দু’জনেই হালকা চমকে গিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছি।
এই ক্ষণিকের ছোট্ট মুহূর্তটা আমার জীবনে হাজার কথার চেয়েও বেশি উষ্ণ মনে হলো!
বাড়ি ফিরলাম আনন্দ নিয়ে। দাদুভাই টংয়ের ওপর বসে হাওয়া খাচ্ছেন। আমি এসে মাত্রই পাশে বসেছি। বাবরিওয়ালা এসে বললো, ‘মীরা আপনি একটু এখান থেকে যান। দাদুর সঙ্গে আমার কথা আছে।’
বাবরিওয়ালার চোখেমুখে কাঠিন্যতা। আমি কোনো প্রশ্ন করলাম না। ইচ্ছেকৃতভাবে দেরীও করলাম না। উঠে চলে এলাম। টংয়ের পাশেই একটা খড়ের গাদা। তার আড়ালে এসে দাঁড়ালাম আমি। তাদের কথোপকথন শুনতে ইচ্ছে করছে।
বাবরিচুল দাদুভাইকে বেশ সিরিয়াস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘একটা কথা শুনেছি। ওটার সত্যটা আমাকে বলুন?’
‘কোন কথা শুনেছো?’
‘আমার নাকি মিস মীরার সঙ্গে বিয়ে?’
আমি চমকে উঠি। কথাটা সে আবিষ্কার করে ফেলেছে! কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে দাদুভাই বললেন, ‘হুম। ঠিক শুনেছো।’
‘আমার বিয়ে আর আমিই জানিনা। বাহ, কখন ঠিক হলো?’
‘মীরার বাপের সঙ্গে কথা বলতে হবে দাদুভাই। ও তোমাকে বলবে। শুধু ভালো সময়ের অপেক্ষা করছিল।’
‘বলার আর দরকার নেই। আমি আংকেলের মুখের ওপর কিছু বলতে পারবো না। আপনি ওনাকে জানিয়ে দিবেন, আমার পক্ষে মিস মীরাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।’
হৃদপিণ্ড যেন হুট করে একবার থেমে গিয়ে আবার জোরে ধাক্কা দিলো। মাথায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য শূন্যতা নেমে আসে আমার। কিছু বুঝতে পারি না, কিছু শুনতেও পারছি না। চারপাশের সমস্ত শব্দ যেন মাইল দূরের মতো লাগে, শুধু আমার নিজের নিঃশ্বাসের শব্দটাই অস্বাভাবিক জোরে শোনা যায়।
মনে হয় যেন শরীরটা নিজের ওজনেই নিচে পড়ে যাবে। বুকের ভেতরটা ধকধক করতে থাকে। আর মাথায় গরম একটা তরঙ্গ উঠে পুরো শরীরকে ধাক্কা দেয়। সত্যিই সে আমার হবেনা? চারপাশ থেকে বাতাস যেন আমার কানে এসে চিৎকার করে বলে যায়, সে তোমার ছিলোই না কোনোদিন!
চলবে..
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৬
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৯
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১০
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুলওয়ালা গল্পের লিংক
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৩
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২