০৭
আজ বিয়ে। সকালবেলা ঘুম ভাংলো মায়ের ডাকে। কনে’কে নিয়ে পার্লারে যেতে হবে।
রাতে ঘুমাতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো। তাই উঠতেও দেরী করে ফেললাম। মা খুব তাড়া দিচ্ছেন তারাতাড়ি উঠে সব গুছিয়ে নেয়ার জন্য।
বাসার বাইরে একটা মাইক্রো কার এসে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। মেজো চাচী আর আমি কনেকে নিয়ে যাবো। গাড়িতে ওঠার মুহুর্তে বড় চাচা বললেন, একজন ছেলে সঙ্গে নিয়ে যাও।
আমার চাচাতো ভাইদেরকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। ফোন দিয়েও কাউকে পাওয়া গেলো না। ফুফুর বড় ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে আমাদের সঙ্গে যেতে বলায় সে খুব বিরক্ত হয়ে বললো, ‘মেয়েদের সঙ্গে গিয়ে আমি কি করবো?’
ছোট দুলাভাই নাচতে নাচতে এসে দাঁড়ালেন। চাচী আমাকে ফিসফিস করে বললো, ‘এরচেয়ে তোমার চাচাকে নিয়ে গেলেই পারতাম।’
মেজো চাচী কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার দুলাভাইদেরকে পছন্দ করে না। মেজো চাচীর বয়স কম। অল্পবয়সে শাশুড়ী ডাকটাও ওনার পছন্দ না। অথচ আজকে ওনার জামাইদের তালিকায় আরও একজন যুক্ত হতে চলেছে!
আমি দুলাভাইকে বললাম, ‘আপনি এখানে থাকুন। বিয়েবাড়িতে কত কাজ। এগুলো সামলান। আমরা একাই যেতে পারবো।’
বড় চাচা পাশেই ছিলেন। উনি আবারও বললেন, ‘একা কেন যাবে? কোনো কিছু প্রয়োজন হলে পার্লার থেকে বের হয়ে তোমরা আবার বাইরে যাবা? দাঁড়াও তাসরিফকে কল দিচ্ছি।’
তাসরিফও ফোন রিসিভ করলো না। এমন সময় ভ্যানগাড়ি থেকে নামলো বাবরি চুলওয়ালা। দুই হাতে একগাদা বাজার সদাই। একটা বিশাল বস্তা ভ্যান চালকের সঙ্গে ধরাধরি করে নামিয়ে বাড়ির ভেতর রেখে আসতে গেলো।
চাচাজান মুগ্ধ হয়ে বললেন, এই ছেলেটা এত কাজের! আমাদের একটা ছেলেও যদি ওর মতো হতো। এ্যাই মীরা, তোমরা ওকে নিয়ে যাও।
আমি অবচেতন মনে পুলকিত বোধ করলাম। সেই পুলকের রেশ আমার সচেতন মনেও ধীরেধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। গাড়ির সিটে বসে গুণগুণ সুরে গান গাইতে লাগলাম আমি। দেখলাম বাড়ির ভেতর থেকে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বাবরিচুল ভ্যানের দিকে যাচ্ছে। বড় চাচা ওকে ডাক দিয়ে গাড়িতে উঠতে বলায় সে ভ্যান চালকের সঙ্গে কথা বলতে গেলো। আমি গাড়িতে বসেই খেয়াল করলাম, সে ভ্যান থেকে একটা বড় ব্যাগ তুলে ভ্যান চালকের কাঁধে তুলে দিলো। যতই তাকে দেখছি, মুগ্ধতা ক্রমশ বাড়ছে আমার। সাধারণত এই বয়সী একটা ছেলের মাঝে এত দায়িত্ববোধ থাকে না!
পার্লারে পৌঁছাতে খুব বেশী সময় লাগলো না। আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে বাবরিচুল চাচীকে বললো, ‘আন্টি, আমি বাড়িতে যাই। ওখানে উপস্থিত থাকলে ওরা রান্নাটা ভালো করে করবে। আপনাদের কিছু লাগলে আমাকে জাস্ট একটা কল দিলেই হবে। আমি দ্রুত হাজির হবো।’ ।’
মেজো চাচী বললেন, ‘বাড়িতে কাজ করার জন্য অনেক মানুষ আছে। অনেক তো করলে। আজকের দিনটা নাহয় এনজয় করো।’
বাবরিচুল হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চাচী বললেন, ‘ তুমি গাড়িতে বসে ওয়েট করো। কিছু লাগলে আমি ডাকবো। সারা রাত জেগে এটা সেটা কাজ সামলেছো। উঠেছো ভোরবেলা। এখন গাড়িতে বসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও তো বাছা।’
বাবরিচুল খানিকটা বিব্রত বোধ করছে। মৃদু হেসে বলল, ‘আমার যে কাজ ফেলে বসে থাকতে ভালো লাগে না। ওখানে থাকলে একটা না একটা কাজ তো করে দিলে ভালো হবে।’
‘অত ভালো দেখতে হবেনা বাপু। অনেক দেখেছো। আজকে বিয়ের আনন্দটা একটু উপভোগ করো। আচ্ছা, শোনো। তোমার তো জামায় দাগ লেগে গেছে। বিকেলে পরার জন্য ভালো ড্রেস এনেছো?’
বাবরিচুল খানিকটা ইতস্তত বোধ করে বলল, ‘হ্যাঁ আছে। পাঞ্জাবি তোলা আছে।’
‘তুমি যদি কিছু মনে না করো, আমি তোমাকে একটা গিফট দিতে চাই। তুমি কি কিছু মনে করবে?’
‘না না, তার প্রয়োজন নেই আন্টি।’
‘আরে চুপ করো তো। তুমি এখন মার্কেটে যাও, পছন্দসই একটা ব্লেজার কিনবে। আর একটা জমকালো পাঞ্জাবি। আজকের অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবি পরতে পারো। আর বৌভাতে যাওয়ার সময় ব্লেজার পরে যাবে। তুমি কি মাইন্ড করবে এইটুকু গিফট নিতে?’
বাবরিচুল বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছে। লজ্জিত হাসি দিয়ে বলল, ‘এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। থ্যাংকস।’
‘আমাদেরমাদের জন্য তুমি এতকিছু করলে। আর এই আন্টি তোমাকে সামান্য একটা উপহার দিতে চায়, সেটা তুমি নেবে না?’
সে অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে একবার আমার মুখের দিকে আর একবার চাচীর মুখের দিকে তাকাতে লাগলো। চাচী আমাকে বললেন, ‘মীরা, তোর এখানে কোনো কাজ নেই। আমি মাইশার সঙ্গে আছি। তুই ওকে নিয়ে মার্কেটে যা। দেখেশুনে ভালো দেখে শপিং করবি। আর হ্যাঁ, নিতে না চাইলে জোর করে নিয়ে দিবি।’
চাচী আমার হাতে ওনার পার্সটা দিয়ে মাইশাকে নিয়ে পার্লারের ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি লাজুক হেসে বললাম, ‘এত লজ্জা পাবার কিছু নেই। অ্যাপল তো আমাদের ফ্যামিলিরই ছেলে তাইনা?’
সে হতচকিত মুখে আমার দিকে তাকালো। আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। আবার মাইন্ড করবে না তো! মুখ ফসকে এই কথাটা কেনই বা বলতে গেলাম আমি.. ধুর।
বাবরিচুল আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, ‘এসবের কোনো প্রয়োজন নেই মিস মীরা। আপনি আন্টিকে বুঝিয়ে বলুন।’
‘আমার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটা আমাকে ঠিকঠাক পালন করতে দিন। এখন কি মার্কেটে যাবেন নাকি আমি হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবো?’
সে চমকে উঠে বললো, ‘যাবো।’
দুজনে পাশেই একটা শপিংমলে চলে এলাম। ছেলেদের পোশাক সম্পর্কে আমার ধারণা কম। তবে, বাবরিচুল যেটাই পরে ওকে সেটাতেই সুন্দর লাগে। সুন্দর মানুষের এই একটা সুবিধা। আলাদা করে পোশাক পছন্দ করার বালাই নাই!
তাও জোরপূর্বক আমি একটা ব্লেজার ট্রায়াল দিতে বললাম। তাকে ব্লেজারে এত চমৎকার দেখাচ্ছে যে, আমি চাই সে এটা আগামী ৩৬৫ দিনই পরে থাকুক। ঘুমের সময়ও পরে থাকুক, ওয়াসরুমেও পরে যাক। এটা যেন কখনো গা থেকে না খোলে।
সে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি?’
‘সুন্দর। নিয়ে নিন।’
ব্লেজারটা প্যাকেট করে দিলো। আমি তাকে অনুরোধ করলাম আর একটা ব্লেজার ট্রায়াল দেয়ার জন্য। সে ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো, ‘কেন?’
‘দিন তো। এত কথা বলছেন কেন?’
‘একটা তো নিয়েছি।’
‘আরেকটাটা পরুন দেখি কেমন লাগে। আমি একজনের জন্য কিনবো।’
‘কার জন্য! সে কি আমার সাইজের?’
‘হ্যাঁ। সে আপনিই।’
সে কিছু বলার আগেই আমি তাকে ঠেলে ট্রায়াল রুমে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর কাউন্টারে গিয়ে আমার নিজের পার্স থেকে বিল পরিশোধ করে দিলাম। আমার তো উচিত নিজের হবু বরকে মানানসই জামাকাপড় গিফট দেয়া। যাকে যেটাতে বেশী ড্যাশিং লাগে, তাকে তো সেটাই সবসময় পরা উচিত।
আমরা যে প্যান্টটা কিনেছি সেটা আমেরিকান কোম্পানির। সাইজে কয়েক ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে। মার্কেটের পাঁচতলায় দর্জির কাছে এলাম প্যান্টের সাইজ ঠিক করতে। দর্জি মাপ নিয়ে আমাদেরকে বললেন, ‘পনেরো মিনিট বসুন।’
বাবরিচুল আমাকে বসিয়ে রেখে আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করে এলো। আমি তার ব্লেজারের ব্যাগ কোলে নিয়ে বসে আছি। জানিনা কেন, জীবনে প্রথমবার কারো জন্য কেনাকাটা করে আমার এত আনন্দ হচ্ছে!
বাবরিচুল বললো, ‘চলুন চা কফি কিছু খেয়ে আসি। ওপরে একটা কফিশপ আছে।’
তাকে অনুসরণ করলাম আমি। ভেতরে ভেতরে আনন্দে ঝলমল করছি। আমি এখনো একটুও সাজগোজ করিনি। খানিকটা আফসোস হচ্ছে সে কারণে। মনে হচ্ছে আসার আগে বেশ কড়া একটা সাজ দেয়া দরকার ছিলো।
রুফটপ কফিশপ। চারপাশ খোলামেলা। জায়গাটা ছোট হলেও ছিমছাম গোছানো। বাবরিচুল বললো, ‘আপনি যা যা খেতে চান অর্ডার দিন। আমি নামাজ পড়ে আসি। দ্রুত চলে আসবো।’
‘আচ্ছা।’
সে চলে গেলে আমি ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। নিচেই মেইনরোড। গাড়ির হর্নের শব্দ কানে আসছে। কফির কড়া সুঘ্রাণ আর এলোমেলো বাতাস আমার হৃদয়ে সুখের অনুরণন তুলছে ক্রমশ।
ওপর থেকেই দেখতে পেলাম রাস্তার পাশ দিয়ে বাবরিচুল দ্রুতপদে হেঁটে যাচ্ছে। অদূরেই একটা মসজিদ। সেখানে যাচ্ছে সে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার হেঁটে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ করেই মানুষটা আমার এত আপন হয়ে উঠলো! ক্ষণিকের জন্যও তাকে অপরিচিত মনে হয় না। যেন হাজার বছর ধরে আমাদের পরিচয়, আমাদের কথোপকথন, একসাথে পথচলা। সম্পূর্ণ নতুন একটা মানুষের জন্য এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে আমার!
সে ফিরে এলো কিছুক্ষণ পরেই। দুই কাপ কফি আর ডোনাট অর্ডার দিলাম। মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসলাম দুজনে। মাঝখানে ছোটখাটো একটা টেবিল। সে ব্যস্ত ভঙ্গীতে মোবাইলে কিছু একটা করছে।
এক পর্যায়ে ফোন রেখে আমাকে বলল, ‘এরকম বিয়ের অনুষ্ঠানে কখনো থাকার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আসলে আমাদের ফ্যামিলি একটা ব্রোকেন ফ্যামিলি। আব্বু মারা গেছে অনেক বছর আগে। বছর চারেক আগে আম্মুও। আমি ভাইয়ার সংসারে বেড়ে উঠেছি। সেভাবে ফ্যামিলির মানুষদের সঙ্গে বোঝাপড়াও তৈরি হয়নি কখনো। আপনার পরিবারটা এত সুন্দর, আর বিশেষ করে দাদাবাড়িতে সবাই এত আন্তরিক। যৌথ পরিবারের আনন্দ আমি এখানেই প্রথম অনুভব করলাম। একটা বিয়েবাড়িতে সবাই কত আনন্দ করছে। এটা আমার লাইফে বেস্ট এক্সপেরিয়েন্স।’
আমি অবাক হয়ে তার কথাগুলি শুনছিলাম। সে কথা বন্ধ করতেই আমি কোনোকিছু না ভেবেই বলে ফেললাম, ‘আমাদের বিয়েও দাদাবাড়িতে আয়োজন করবো।’
‘আমাদের বলতে আপনার বিয়ে?’
আমি থ হয়ে গেলাম। গোটা জীবনে এত লজ্জায় কখনো পড়িনি। লজ্জায় ইচ্ছে করছে টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দেই। তাকে বিষয়টা বুঝতে না দিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ। আমার আর আমার বরের বিয়ে। রোহানের বিয়ে। আমরা দুই ভাই বোন দাদাবাড়িতে বিয়ের প্রোগ্রাম করবো। অনেক মজা হবে তাইনা বলেন?’
‘হুম। আপনার কি বিয়ে ঠিক হয়ে আছে নাকি?’
‘না না। সেরকম কিছু না। এমনি বললাম। জন্মেছি যখন, বিয়ে তো একদিন হবেই। যখন হবে, তখন দাদুবাড়িতে এসে প্রোগ্রাম করবো।’
সে মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, ‘হুম। ঠিক বলেছেন। জন্মেছেন যখন বিয়ে একদিন হবেই। বিয়ে নিয়ে এত আগ্রহের কারণ? বয়ফ্রেন্ড আছে মনে হচ্ছে?’
‘না না। ওসব ছাতার মাথা আমি রাখিনা। আমি আজ পর্যন্ত এই মনে কাউকে জায়গা দেই নাই। একদম আমার বিবাহিত বর হবে আমার প্রথম বয়ফ্রেন্ড।’
‘হু, ভালো।’
কফি চলে এসেছে অনেক্ষণ আগে। আমি বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে কফির মগে ঘনঘন চুমুক দিতে লাগলাম। সে জানতে চাইলো আমার কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম পছন্দ। আমি ফ্লেভারের নাম বলতেই উঠে গিয়ে একটা আইসক্রিম এনে দিয়ে বলল, ‘সেদিন আংকেল আইসক্রিম এনে আপনাকে খুব ডাকাডাকি করছিলো। তখন মনে হলো আইসক্রিম আপনার অনেক পছন্দ।’
‘হ্যাঁ। অনেক বেশী।’
‘বাচ্চাদের তো এসব পছন্দ হবেই।’
আমি আজ ঝগড়ার মুডে নেই। তাই কিছু না বলে মুচকি হাসলাম। আইসক্রিম শেষ করে ফিরে এলাম পার্লারে। গাড়িতে শপিং ব্যাগগুলো রেখে ভেতরে যাবো এমন সময় সে বলে উঠলো, ‘মিস মীরা..’
‘জি?’
‘কিছু না।’
‘বলুন?’
‘না। কিছু না।’
আমি জানিনা কেন, আমার বুকটা ধুকপুক করে উঠলো। দ্রুতপদে পার্লারে প্রবেশ করলাম আমি। মেজো চাচী ছুটে এসে আমাকে ধরে জানতে চাইলেন, ‘কতদূর এগোলো?’
‘কি?’
‘ তোমাদের গল্পটা।’
‘মানে?’
‘মানে? মানে তোমার ইয়ে।’
‘আমাদের মাঝে কোনো ইয়ে নেই চাচী।’
‘এসব বাহানা আমাকে শুনিও না। মীরা, তোমাকে আমি ছোট্ট থেকে চিনি। তোমার আচার আচরণ, গলার টোন, চোখের চাহনি সবকিছু আমার চেনা। তোমার চোখেমুখে, প্রতিটা পদক্ষেপে তোমার শরীর জানান দেয় তুমি ওর প্রতি কতটা দূর্বল।’
আমি যেন খানিকটা স্তব্ধ হয়ে পড়লাম। এত করে চেষ্টা করার পরেও যদি সবাই বুঝে যায় তার প্রতি আমার দূর্বলতা, তবে তো বিপদ। আমি চাইনা কেউ আমার মনের খবর পড়তে পারুক। অন্তত বাবরিওয়ালা তো নয়ই। এই মুশকিল থেকে কিভাবে নিজের উদ্ধার করবো আমি?
মেজো চাচী মুচকি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা টেনশন কোরো না। এরকম হয়ই। জীবনে প্রথম যখন কোনো মানুষ আসে, তখন আসলে কোনো লজিক কাজ করেনা। সে আশেপাশে আসলেই ভালো লাগে। অথচ একটু দূরে গেলে অস্থিরতায় জান বের হয়ে যায়। এসব খুবই কমন সিম্পটম।’
‘কিসের সিম্পটম?’
‘প্রেমে পড়ার।’
‘যাঃ!’
‘যাঃ বলে লাভ নেই মীরা। তুমি এই হাসো, এই কাঁদো, এই আনমনে গুণগুণ করো, আবার এই অভিমানে ফেটে পড়ো। এসব কখন হয় বলোতো? যখন কেউ প্রেমে পড়ে, তখন।’
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে লাজুক স্বরে বললাম, ‘এত দ্রুত আমি কারো প্রেমে পড়ে যাবো এটা কোনোদিন ভাবিনি। আমার ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করে একটা বক্সে ঢুকে বসে থাকি।’
মেজো চাচী হাসতে হাসতে বললেন, ‘এরকমই হয় বুঝলে! তোমার চাচার সঙ্গে প্রথম প্রথম আলাপ হওয়ার পর আমারও এমন হয়েছিলো। আহা সে কী ফিলিংস! খেতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা। সারাক্ষণ অস্থির অস্থির লাগে। তাকে দেখলে আবার সব ঠিক হয়ে যায়। এই অনুভূতি অমূল্য। জগতের কোনো অনুভূতির সঙ্গে এর মিল নেই। এই অনুভূতি জীবনে শুধু এই মৌসুমেই হয়। প্রেমে পড়ার মৌসুমে। এরপর যখন সম্পর্ক হয়ে যায়, তখন আর এতটা ফিলিংস থাকেনা। যাকগে মীরা, তুমি সাজবে না?’
‘না।’
আমার অবশ্য খুব ইচ্ছে ছিলো সাজার। সাজগোজ করবো বলেই বাসা থেকে মস্ত বড় ব্যাগে সমস্ত জুয়েলারি, পারফিউম, এমনকি জুতা পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। যাতে গাড়ি থেকে নেমে বাসায় ঢোকার সময় সবাই হা হয়ে যায়। মনে হবে নায়িকা দিপীকা পাড়ুকোন আসছে। কিন্তু না, চাচীর মুখে এসব কথা শোনার পর আমার বড্ড মুড সুইং হচ্ছে। সাজসজ্জা তো দূরের কথা, কারো সামনেও যেতে ইচ্ছে করছে না।
চাচী খুব জোরাজোরি করলেন আমাকে পার্টি মেকআপ লুক ক্রিয়েট করার জন্য। কিন্তু আমার মোটেও সাজতে ইচ্ছে করছে না। সাজগোজ করলে সবাই ধরে নেবে আমি তার জন্য সেজেছি। যদিও সেটা সত্য কথা। কিন্তু আমার একদমই সেই সত্যিটা মানুষকে দেখিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে না।
আমি বললাম, ‘সাদা জামা পরে ভূতের মতো ঘুরে বেড়াবো। নো মেকআপ।’
‘ভূতেরাও মেকআপ করে মীরা। মানুষ সাজলে অনেকেই বলে তোমাকে ভূতের মতো লাগছে। না সাজলে কিন্তু এই কথা কেউ বলেনা।’
‘তাহলে তুমি বলছো ভূতেরাও সাজে?’
‘হু। মানুষ ভূতের মতো সাজে।’
‘তাহলে কি আমার ভূতের মতো সাজুগুজু করা উচিৎ?’
মেজো চাচী হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুমি জাস্ট হালকা কিছু করো। ওইযে বললা নো মেকআপ। এটাই করো। নো মেকআপ লুক। আলিয়া ভাটের মতো লাগবে তোমাকে।’
আমি মনেমনে বললাম, ‘দিপীকা থেকে আলিয়া ভাট! কার জন্য? বাবরিওয়ালা কি কোনোভাবে রণবীর কাপুর?’ ভাবতেই আমার হাসি পেয়ে গেলো।
মেজো চাচী আমার জামাকাপড় বের করে জোরপূর্বক আমাকে সাজতে বসিয়ে দিলেন। একেবারে সামান্য মেকআপ করলাম। যেটুকু না করলেই নয়। শুধু চোখ দুটোকে সাজালাম। আর গালে হালকা ব্লাশ। আয়নায় তাকিয়ে দেখি নিজেকে আমার নায়িকার চেয়েও বেশী সুন্দর লাগছে। নাহ, এসব ঠিক না। সাজগোজ করতে না চাইলেও একটা মেয়েকে কেন এত সুন্দর লাগতে হবে?
মাইশাকে বউয়ের সাজে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ওর হাত ধরে খানিকক্ষণ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচানোর চেষ্টা করলাম। মাইশা বলল, ‘খুব নার্ভাস লাগতেছে আমার।’
খপ করে মেজো চাচীর হাত ধরে মাইশা বলল, ‘তোমাদেরকে ছেড়ে যেতে একদমই ইচ্ছে করছে না চাচী। তুমি সবসময় আমার বড় বোনের মতো আমার পাশে ছিলা। আই লাভ ইউ চাচী।’
মেজো চাচীর চোখ দুটো কান্নায় ভরে উঠলো। মাইশাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন উনি। মাইশাও চোখ মুছছে। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘এত দামী মেকআপ ধুয়ে ফেলিও না তোমরা। কান্নাকাটি বিদায়ের সময়ের জন্য জমিয়ে রাখো প্লিজ। এখন চলো।’
আমি পার্লার থেকে বের হয়ে গাড়ির দিকে যতই অগ্রসর হতে লাগলাম, আমার হৃদস্পন্দন তত বাড়তে লাগলো। মনে হচ্ছে ঠিকমতো হাঁটতেই পারছি না। মাইশা কিভাবে বধূর সাজে নিজেকে শক্ত রেখেছে আমি জানিনা। বাবরিচুলের মুখোমুখি হতে আমার ভয়ংকর রকম লজ্জা লাগছে।
টুপ করে গাড়িতে উঠে বসলাম আমি। বাবরিচুল আশেপাশে নেই। না থাকাই শ্রেয়। অন্তত শান্তিতে একটু নিশ্বাস নিতে পারবো।
খানিকক্ষণ পর সে এসে চাচীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আন্টি, চা খাবেন?’
‘খুব ভালো হয়। এইমুহুর্তে এক কাপ চা-ই দরকার ছিলো আমার।’
সে ছুটে গিয়ে সবার জন্য চা নিয়ে আসলো। আমি বসেছি একদম পিছনের সিটে। আমার চায়ের কাপটা চাচী এগিয়ে দিলেন। এখনো তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়নি।
বাড়িতে এসে গাড়ি থেকে নামার সময় সে আমাকে পিছন থেকে ডেকে বললো, ‘এটা নিলেন না?’
ফিরে দেখি ব্লেজারের ব্যাগটা। আমি বললাম, ‘এটা আপনার জন্য।’
‘মানে!’
‘সাকসেসফুলি প্রজেক্টটা ডিল করার জন্য। আমার তরফ থেকে গিফট।’
‘ভাই আপনাদের সমস্যা কি? আমাকে সবাই গিফট দিচ্ছেন কেন? আমি কি দেখতে পথশিশুদের মতো?’
আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। হাসি যেন থামছেই না আমার। সে দুইহাতে দুইটা ব্লেজারের ব্যাগ নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, ‘আমি যখন বিশেষ কিছু করবো তখন আপনিও আমাকে গিফট দিবেন। শোধবোধ।’
‘সুন্দর লাগছে আপনাকে।’
আমি চমকে উঠলাম। মনে হলো দম বন্ধ হয়ে আসবে আমার। একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। দ্রুত চলে এলাম সেখান থেকে।
মায়ের পুরনো দিনের এক বান্ধবী, মিনুখালা। বহু বছর পর আন্টিকে দেখে আমি সালাম জানালাম। আন্টি আমার হাত দুটো ধরে বললেন, ‘ মাশাল্লাহ। মাশাল্লাহ। আমাদের মীরা একদম পরীর মতো দেখতে হয়েছে।’
‘খালা আপনি পরী দেখেছেন?’
‘হা হা হা। শোনো মেয়ের কথা। পরী কথাটা শুনলেই একটা অসম্ভব সুন্দর চেহারা আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। এজন্য দেখতে হয় না রে মা।’
‘ওহ আচ্ছা। আমি অসম্ভব সুন্দর না, সম্ভব সুন্দর।’
‘ভারী দুষ্টু আছিস এখনো। ভেবেছিলাম বদলে গেছিস। না, এখনও সেই ছোট্ট মীরার স্বভাবটাই রয়ে গেছে।’
মিনু খালার সঙ্গে ছোটবেলা আমার গভীর সম্পর্ক ছিলো। আমরা তখন গ্রামেই থাকতাম। খালার বাড়িটা আমাদের বাড়ির পাশেই ছিলো। মা আর মিনুখালা একসঙ্গে পড়েছে। ভাগ্যক্রমে দুই বান্ধবীর পাশাপাশি বিয়ে হওয়ায় আমি মিনু খালার আদরের নয়নমণি হয়ে গেলাম। খালার একটা ছেলে ছিলো: আয়মান। আমার চাইতে তিনেকের বড়। বেশিরভাগ সময়ই খালা আমাকে বাসায় নিয়ে রাখতেন। নিজের ছেলের সঙ্গে আমাকে ভাত খাইয়ে দিতেন। আমি আর আয়মান খালার মাথাটা পাগল করে দিতাম। আমরা শহরে চলে যাওয়ার পর সম্পর্কে ভাটা পড়েছে। তবে এখনো মা’র সঙ্গে খালার যোগাযোগ হয়। ওনারা ফোনে গল্প করেন অনেক্ষণ ধরে।
আমি খালার থেকে বিদায় নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ শুনি মিনুখালা মাকে বলছেন, ‘তোর মেয়েটাকে আমাকে দিয়ে দে রে। ওকে আমি পুতুলের মতো করে সাজিয়ে রাখবো।’
আমি থমকে দাঁড়ালাম। মা মৃদু হেসে বললেন, ‘মীরা ওর বাবার চোখের মণি। এক পলক আড়াল হতে দেয়না ওর বাবা।’
‘আমি ওকে মাথায় তুলে রাখবো রে। আয়মানের বউ করে আনতে দে আমাকে। প্লিজ, তোর দুইটা পায়ে পড়ি। মীরাকে দেখে আমার আর মন মানছে না রে। আমার আয়মান খুব ভালো ছেলে।’
মা বললেন, ‘ওর বাবা তো মীরার জন্য এমন কাউকে আনবে যাকে আমাদের বাসাতেই রাখতে পারবে। মীরাকে শ্বশুর বাড়ি যেতে দিবেনা।’
‘ও.. আমি কি ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখবো রে? তুই একটু বুঝিয়ে বলবি। আজকালকার দিনে কেউ ঘরজামাই রাখে না। মীরার আলাদা সংসার হবে। ভালো হবেনা সেটা? তুই আমাকে দিয়ে দে তোর মেয়েটাকে। ওকে বড় ভালো রাখবো আমি।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি ঘরে চলে এলাম। অজান্তেই আমার ভেতর এক ধরনের চিন্তার ছায়া এসে পড়লো।
চলবে..
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১০
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৩
-
বাবরি চুলওয়ালা গল্পের লিংক
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৯
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৮
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৬
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৩