০৪
বাড়ির গেটে দেখা হলো বাবরি চুলওয়ালার সঙ্গে। একদম মুখোমুখি। বলতে ইচ্ছে করলো অনেক কিছু। কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। অদ্ভুতভাবে আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।
সরল চাহনি তার। নড়াচড়া করার বালাই নাই। স্থির চোখে আমাকে দেখছে। চোখের দৃষ্টি নিষ্পাপ শিশুদের মতো। এদিকে আমি চাইলেও রাগ দেখাতে পারছি না। আমার সমস্ত কথা গলায় এসে আটকে গিয়েছে। ফলে আমার মুখখানা যে অসম্ভব কঠিন হয়ে উঠলো তা কল্পনা করতে অসুবিধা হলো না।
আমি তাকে পাশ কেটে চলে এলাম বাইরে। পেছন থেকে ডাক শুনলাম,
‘মিস মীরা।’
থমকে দাঁড়ালাম আমি। সে বললো, ‘আপনি নতুন বরকে খুঁজছিলেন তখন। বরপক্ষ আসবে একটু পরে। গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি, পাত্রও আসবে। আপনার বোনকে সারপ্রাইজ দিতে।’
আমি এই খবরে খুশি হতে পারলাম না। নতুন বর শব্দটা আমার মাথায় ঝনঝন করে বাজতে লাগলো। এই বাবরি চুলের ছেলেটা নাকি আমার বর হবে। ধুর…
অজান্তেই ছুটতে শুরু করলাম আমি। কয়েক সেকেন্ড ধরে কেবলই আকাশ বাতাস দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটলাম। বাড়ির পাশেই একটা পুরনো সুপারি বাগান। তার একদম গহীনে এসে থমকে দাঁড়ালাম আমি।
বাড়ি থেকে মিউজিকের সাউন্ড ভেসে আসছে। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে একটু পরে। সবাই খুঁজবে আমাকে। তা সত্ত্বেও আমার ইচ্ছে করছে চুপচাপ এখানে বসে থাকি। হঠাৎ করেই আমার জীবনের সমস্ত তরঙ্গ যেন থেমে গিয়েছে। আমি ভাবতে ভুলে গেছি, আওয়াজ করতে ভুলে গেছি, নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছি। শান্ত হয়ে সুপারি গাছে হেলান দিয়ে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।
খুব অল্প সময়েই আমার জীবনে বিশাল বড় ঘটনা ঘটে গেছে! একটা বিয়ের খবর, সেইসাথে আমাকে ওর আশেপাশে যেতে নিষেধ করার কারণটা আমাকে খুবই পীড়া দিচ্ছে। আমি নাকি নির্বোধ! আমার বুদ্ধিসুদ্ধি কম এটা জীবনে বহুবার শুনেছি। কখনো মানতে চাইনি। ভেবেছি আমি হয়তো খানিকটা বাচ্চাদের মতো আচরণ করে বসি। কিন্তু আমার নিজেকে কখনো নির্বোধ মনে হয়নি।
আজ একইসাথে আমার মনে বিভিন্ন রঙের অনুভূতি। রাগ, অভিমান, ভালোলাগা.. এখানে ভালোলাগা আসছে কোথা থেকে? ভালোলাগার মতো কোনো কিছু তো হয়নি।
মাঝেমাঝে আমি নিজেই নিজেকে বুঝতে পারিনা। বুঝতে চেষ্টাও করতে চাইছি না। ধীরেধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
বাড়িতে ঢোকামাত্র আমার বাবা হাসিমুখে ডাক দিলেন আমাকে, ‘আয় মা। তোর আইসক্রিম গলে যাচ্ছে দেখে ফ্রিজে রেখেছি। ভালো করেছি না?’
আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আব্বুর প্রতি প্রচণ্ড অভিমানে আমি তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। সোজা চলে এলাম মেজো চাচীর রুমে। আমার মায়ের গলা শোনা গেলো। ডাকছে আমাকে।
আমি ঠায় বসে রইলাম। আব্বুর সঙ্গে আমার একদমই কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। হঠাৎ দেখি আমার আব্বু রুমে আসলেন। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম।
আব্বু এসে আমার পাশে বসলেন। বললেন, আমাকে জড়িয়ে ধরবি বলছিলি না?
আমি চুপ।
আব্বু আবারও বললেন, ‘কে যেন আমাকে মিস করছিলো?’
আমি এখনো চুপ। টের পেলাম আমার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আব্বু সেটা মুছে দিয়ে বললেন, ‘আমার মীরা মাকে কেউ কিছু বলেছে? কাঁদছে কেন সে?’
আমি প্রচণ্ড অভিমানী গলায় বললাম, ‘তুমি ওই ছেলেটার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছো?’
বাবা খানিকটা হতচকিত হয়ে গেলেন। হয়তো এরকম কিছু আশা করেননি। মুচকি হেসে বললেন, ‘বাবার প্রতি তোর বিশ্বাস আছে না? দেখবি সিদ্ধান্তটা খুবই ভালো হবে। ওর সঙ্গে তুই অনেক ভালো থাকবি।’
‘আমাকে জানাও নাই কেন কেউ?’
‘আহারে মা আমার। রাগ করিস না। জানতাম তুই শুনলে মন খারাপ করবি। এজন্য বলিনি। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোকে আমরা কোথাও পাঠাবো না। আমাদের বাসাতেই থাকবি তুই। বাবার রাজকন্যা হয়ে।’
আমি চুপ করে রইলাম। তবে আমার কান্নার গতি বাড়তে লাগলো।
বাবা আমাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘মা রে, তুই আমার চোখের মণি। সারাজীবন আমি চেয়েছি তোর চোখে যেন এক ফোঁটাও পানি না আসে। তুই আমার সামনে কাঁদিস না। তোর যদি ওকে পছন্দ না হয় আমাকে বলতে পারিস।’
আমি হঠাৎ বলে বসলাম, ‘পছন্দ অপছন্দ করার সুযোগ দিয়েছো তুমি? আমাকে তো বলছো ওর আশেপাশে যাতে না যাই। কি বিশ্রি ব্যাপার। যেন আমার চরিত্র খারাপ? আমার প্রতি তোমাদের কারো আস্থা নাই। আজকে ফুফুর মুখে আমার শুনতে হলো আমার জ্ঞানবুদ্ধি কম। কখন কাকে কি বলি এই সেন্স নাই। এজন্য ওই ছেলে আমাকে বিয়ে করবে না। এরচেয়ে অপমানের একটা মেয়ের জন্য আর কি হতে পারে? আমি খুবই অপমানিত বোধ করছি মণ্ডল সাহেব। এই অপমানের দায় আপনার।’
আব্বু ফিক করে হাসতে গিয়ে হাসি আটকে ফেললেন। আমার হাত ধরে বললেন, ‘ওকে। তোর ফুফুকে আমি কথা শুনিয়ে দিবো। আমার মেয়ের জ্ঞানবুদ্ধি কম এটা কে বলেছে? আমার মেয়ে অনেক বুদ্ধিমতী। একটুখানি সরল, ওটা তো ভালো দিক।’
আমি এবার খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম, ‘তাই বলে আমাকে তোমরা এই কারণে ওর আশেপাশে যেতে নিষেধ করবা? মানে এটা কোনো কারণ হলো? আমি ভাবতাম তুমি আমাকে কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে দিতে চাও না।’
কথাটা বলতে গিয়ে আব্বুকে ফোন দিয়ে কথা বলার সেই মুহুর্তটা মনে পড়ে গেলো। ফুফুর কথা শোনার আগ পর্যন্ত আব্বু ছিলো আমার চোখে আমার সবচেয়ে আপনজন। আমার প্রতিরক্ষার ঢাল। আমি কী করে আব্বুকে এসব বলছি! নিজেকে সংযত করে বললাম, ‘তুমি এত বড় ব্যাপারটা আমাকে বলতে পারতে। আমি কি এতটুকু ক্লোজ নই তোমার?’
বাবাকে এবার খানিকটা অপরাধী দেখালো। নিজেরই মন খারাপ হয়ে গেলো আমার। আব্বু অপরাধীর মতো গলায় বললেন, ‘আমি যাইই বলি, যাইই করি, জেনে রাখবি এটা তোর ভালোর জন্যই। তোর গায়ে একটুও আঘাত আমি সহ্য করতে পারবো না মা। তোকে কেউ খারাপ কথা বলুক, তা আমি চাই না। তোর দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও আমি সহ্য করতে পারবো না।’
আমি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘এখন থেকে আমি তোমার সব কথা শুনবো। যদিও আমি রাগ করে আছি। তাও শুনবো।’
আব্বু হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘রাগ ভাঙানোর জন্য আমি কি করতে পারি?’
‘একটু চিন্তা করে বলবো। কিন্তু তুমি প্রস্তুতি নিয়ে রাখো। বড় কিছু চাইবো তোমার কাছে।’
পাত্রপক্ষ চলে এসেছে গায়ে হলুদের ডালা নিয়ে। সবাই ছুটে যাচ্ছে সেদিকে। আব্বু আমাকেও পাঠিয়ে দিলেন সেখানে। সবাই মিলে হৈ হুল্লোড় করে তাদেরকে বরণ করে নেয়া হলো। দেয়া হলো নাস্তাপানি। হাসিতে, উল্লাসে, নাচে গানে মুখর হয়ে উঠলো বিয়ে বাড়ি।
কিন্তু আমার মনে একটুও আনন্দ দোল দিচ্ছে না। এক ধরনের বিষাদে ডুবে আছি আমি। আমাকে যে কারণে বাবরি চুলের আশেপাশে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল, তা এখনো হজম করতে পারছি না। আমার মতো চঞ্চলা পাখি আজকের এই হলুদ সন্ধ্যায় একেবারে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো শান্ত হয়ে আছে।
এক সময় মেজো চাচী বললেন, ‘মীরা, তোমার এখনো মন খারাপ?’
আমি ম্লান হেসে বললাম, ‘না তো।’
‘তোমার মন খারাপ। কি হয়েছে মা?’
‘কিছু হয়নি।’
‘আমার ছবি তুলে দাও।’
চাচী সামনে গিয়ে পোজ দিয়ে দাঁড়ালেন। আমি ছবিতে ক্লিক করেছি, এমন সময় সেখানে এসে দাঁড়ালো বাবরিচুল!
চাচীকে বললো, ‘আপনাকে ওখানে একটু যেতে হবে। লাইটের ব্যাগটা দিয়েছিলাম সেটা কোথায়? একটু কষ্ট করে বের করে দিন প্লিজ।’
চাচী ছুটে গেলো ঘরের দিকে। বাবরিচুল আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বরকে দেখেছেন?’
‘না।’
অথচ মনেমনে বললাম, ‘দেখতেছি তো। আমার বরকে! নাহ, আমার বরের চেহারা সুরত ভালোই। নায়ক নায়ক একটা ভাব আছে। জামাকাপড় একটু কম স্টাইলিশ। টাকা পয়সা হলে জামাকাপড়েও নায়কীয় ভাব আসবে। অবশ্য পাঞ্জাবিতে ভালোই দেখাচ্ছে। বাংলায় একটা বিখ্যাত গান আছে, বাবরিচুল ওয়ালা, ওরে লাল কুর্তাওয়ালা.. সেই গানটা মনে হচ্ছে ওনার জন্যই লেখা হয়েছে। গানের রচয়িতা বেচে থাকলে জিজ্ঞেস করতে হবে, উনি আমার হবু বরকে কল্পনা করেই গানটা লিখেছিলেন কী না!
বাবরিচুল চলে গেলো। তবে রেশ রেখে গেলো তার। আমার মনটা আগের চাইতে একটু ভালো। চাচাতো বোনের নতুন বরকে দেখার জন্য এসে দাঁড়ালাম। সাধারণত এরকম অনুষ্ঠানে বর আসে না। শুধু বাড়ির লোকজনরা আসে। বর এসেছে কনেকে সারপ্রাইজ দিতে। ব্যাপারটা নাকি রোমান্টিক! সবাই এটা নিয়ে হাসাহাসি করছে।
আমি কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই পাত্রকে দেখলাম। হঠাৎ করেই আমার মুখে হাসি চলে আসলো। আমার ভালো লাগছে এই ভেবে যে, আমার বর মাইশার বরের চাইতে হ্যান্ডসাম। বাবরিচুল যদি হয় নায়ক, বাকিরা সেখানে সাইড নায়কের ক্যারেক্টর।
মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম আমি। তবে, আমি যে হবু বরকে পেয়ে খুবই খুশি সেটা কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না। এমনিতেই আমার মান ইজ্জতের কাম সারা করে বসে আছি। আর কমতে দেয়া যাবেনা। অনেক হয়েছে, এবার সবাই নতুন এক মীরাকে দেখবে।
এমন সময় ছোটচাচাকে দেখতে পেলাম। চাচার কাছে গিয়ে বললাম, ‘খাওয়া দাওয়া করেছো?’
‘হ্যাঁ মামণি। তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। আমার পরী মা।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’
‘তুই কি সত্যিই আমার সঙ্গে যাবি?’
আমি কি বলবো ভাবনায় পড়ে গেলাম। গতকাল অভিমানে চাচাকে বলেছিলাম “আমাকে তোমার ওখানে নিয়ে যাও। এখানে আমার কোনো স্বাধীনতা নেই।”
কিন্তু এখন যদি আমি ইউরোপে চলে যাই, বাবরিচুলকে বিয়ে করবে কে? ছেলেটা তো বিয়ের আগেই বউহারা হয়ে যাবে। আমার তো একটা মানবিকতা আছে। তাকে তো এভাবে বউহারা করতে পারি না। কিন্তু চাচার কাছে সেটা বলা যাবে না। সবাইকে দেখাতে হবে মীরা অভিমানে ইউরোপ চলে যেতে চায়। মীরাকে সবাই গাধা মনে করো। মীরা যে কত বড় ধড়িবাজ, দেখাচ্ছি তোমাদের।
আমি অভিমানী কণ্ঠে চাচাকে বললাম, ‘যেতে তো চাইই। কিন্তু আমার বাপ আমাকে কোথাও যেতে দেবে না।’
‘কেন? আমি তোর বাপের চেয়ে কোনো অংশে কম? আমার ছেলেকে কি তোর বাপের কাছে দিয়ে দেইনি? আমি দ্বিতীয়বারও ভাবিনি সেটা করতে। রোহান তোর বাবাকে আব্বু বলে ডাকে। ও তোদেরই ফ্যামিলির অংশ হয়ে গেছে। তাহলে আমি যদি তোকে নিয়ে যেতে চাই, তোর বাবা কেন আটকাবে?’
আমি কিঞ্চিৎ ঠোঁট ভাঁজ করে বললাম, ‘সেটাই তো। আমার ওপর তোমার চাচাগত একটা অধিকার আছে। কিন্তু আব্বু তো হাজার হলেও তোমার বড় ভাই। ভাইয়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারবে না।’
‘পারবো না কেন? আমি আজকেই তোর বাবাকে বলবো। তোকে আমি নিয়ে যাবো আমার ওখানে। তারপর দেখবো কে তোকে স্বাধীনতা না দেয়! ওখানে তুই যা ইচ্ছে করবি। যেখানে যেতে ইচ্ছে হয় যাবি। সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর জায়গা গুলোতে ঘুরবি। এস্থেটিক রেস্টুরেন্টে বসে ছবি তুলবি।’
আমি মনেমনে ভাবলাম, ওসব জায়গায় নিজের স্বামী নিয়ে ঘুরতে পারলে ভালো হতো। চাচাকে যদি বলতে পারতাম, ‘বিয়ের পর যাই?’ হি হি, আমি মনেমনে যা বলি, তা কখনো মুখে বললে লোকে আমার কথা শুনে হার্টফেল করতো।
চাচা বললেন, ‘চিন্তা করিস না। তুই স্বপ্ন দেখ, চাচ্চু আছি তোর পাশে।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’
চাচা চলে গেলেন। আমি ঘুরে ঘুরে বিয়েবাড়ির আমেজ উপভোগ করতে লাগলাম। জায়গায় জায়গায় মহিলারা পোটলা হয়ে গল্পগুজব করছে। কার মেয়ের কী হয়েছে, কার জামাই কোন আজগুবি কাজ কারবার করেছে, অমুকের বউ তমুকের মা…
কোথাও আবার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে গ্যাঞ্জাম করছে। ডেকোরেটরের পেস্ট কালার চেয়ার নিয়ে টানাটানি। এক বাচ্চা আরেক বাচ্চার চেয়ারে গিয়ে বসছে। সে আবার ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে।
এক সাইডে আবার বিয়ের স্টেজ। সেখানে বসে আছে কনে। সবাই তার গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। নানান কিসিমের কারবার।
শেকসপিয়র বলেছিলেন, দুনিয়াটা একটা রঙ্গমঞ্চ। উনি বোধহয় বাংলাদেশের গ্রামীণ বিয়ে বাড়ি দেখেন নাই! কিন্তু জীবনানন্দও কি দেখেন নি? ওনার লিখে যাওয়া উচিত ছিলো, “বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই, দুনিয়ার রূপ খুঁজিতে চাইনা আর। গ্রাম বাংলার বিয়েবাড়িই একটা রঙ্গমঞ্চ।”
আপনমনে এসব ভাবছি আর হাসছি। দেখতে পেলাম দাদুভাই একা বসে আছেন। আমি গিয়ে বললাম, ‘খবর শুনেছো?’
‘কি খবর?’
‘তোমার নাতনি মীরা মণ্ডলের বিবাহ সংক্রান্ত খবর।’
দাদুভাই কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘হুম। শুনেছি।’
‘তোমাকে আমি ফার্স্ট কি বলছিলাম মনে আছে?’
‘কি?’
‘বলেছিলাম না তোমার ছেলে ঘরজামাই নিয়ে আসছে?’
‘হু।’
‘বিশ্বাস তো করো নাই। কিন্তু ভাবছি কি জানো? তোমার ছেলের রুচি এত খারাপ কী করে হয়! নিজে বিয়ে করছে একটা পরী। আর নিজের মেয়ের জন্য পরীর বাচ্চা তো দূরের কথা, কোথাকার কোন বাউল ধরে নিয়ে আসছে।’
দাদুভাই চশমার ওপর দিকে ভ্রু কুঁচকে আমাকে দেখলেন। আমি বিরস মুখে বললাম, ‘আমার কপাল খারাপ। ছেলের আর কী দোষ!’
কথাটা বলে চলে যাচ্ছিলাম। দাদুভাই বললেন, ‘ছেলেটাকে আমার ভালোই লাগে।’
‘যার যেমন রুচি..’
দাদুভাই আবারও চশমার ওপর দিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আমি দৌড়ে পালিয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলাম। আমার মনে যে কী সীমাহীন আনন্দ, এটা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাবেনা। আমাকে গাধা বলা হয় খুব, তাইনা?
মধ্যরাত পর্যন্ত এসব হৈ হট্টগোল চলতেই লাগলো। ধীরেধীরে কমতে লাগলো শব্দগুচ্ছ। বাচ্চাকাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। একে একে মুরুব্বীরা ঘুমের ঘোরে বসে ঢুলছে। কেবল আমরা ইয়াং জেনারেশন বসে বসে আড্ডা মারছি আর মোবাইলের আলোয় চোখ দুটোকে জ্বালিয়ে খাচ্ছি।
সারাদিনে অসংখ্য ছবি তুলেছি আমার। গ্যালারিতে ছবিগুলো দেখতে লাগলাম। হঠাৎ চাচীর ছবি সামনে আসলো। চাচীর পাশে বাবরিচুল এসে দাঁড়িয়েছে, সেইমুহুর্তে একটা ছবি উঠে গেছে। এরকমই হয়। গল্প উপন্যাসে নায়ক নায়িকাদের বেলায় এরকম কত রঙ্গ যে হয়! আমি নায়িকা থেকে কোনো অংশে কম কিসে? ভেবেই আমি হাসতে লাগলাম।
ছোট বোন ঝিকি বললো, ‘আপু, মিচমিচ করে হাসছিস কেন?’
‘কই হাসছি?’
‘হাসছো না মানে? এইযে ছত্রিশটা দাঁত দেখা যাচ্ছে।’
‘দাঁত বের করা হাসিকে মিচমিচ হাসি বলেনা। ওটাকে বলে অট্টহাসি। এখন সর এখান থেকে।’
ঝিকি বললো, মোবাইলে কি দেখছিলা? কার সঙ্গে চ্যাট করছো? বলো আপু।
‘হুরর..’
‘দেখি।’
ঝিকি আমার মোবাইলটা হাত থেকে খপ করে কেড়ে নিলো। মোবাইলের স্ক্রিনে বাবরিচুলের ছবি বের করা। সর্বনাশ! এই মেয়ে যদি সবাইকে বলে বেড়ায় আমি ওর ছবি দেখে হাসছিলাম? তাহলে তো আমার সমস্ত তপস্যা শেষ! সবাই বুঝে যাবে আমার ভং..
আমি মোবাইল নেয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলাম। ঝিকি উঠে দৌড় দিলো। ওর পেছনে দৌড়াতে লাগলাম আমিও। মুরুব্বিরা থামানোর চেষ্টা করছে। এতে আরও বড় বিপদ। তাদের হাতে পড়লে আমি ধরা খাবো নির্ঘাত। বুদ্ধি করে মৃদুস্বরে বললাম, একটা ছেলে মিকিকে পছন্দ করছে। মিকির জন্য নক দিয়েছে আমাকে।
মিথ্যা কথায় কাজ হলো। ঝিকি আর মিকি দুইজন জমজ বোন। মিকিকে পছন্দ করা মানে ঝিকিকে পছন্দ করা। যাকেই করুক না কেন, মুরুব্বিদেরকে এসব জানানো যাবে না। নিজের স্বার্থ বাঁচাতেই ঝিকি উঠানের দিকে দৌড় দিলো। আমি পিছুপিছু দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগলাম, ঝিকির বাচ্চা আমার মোবাইল দে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। ঝিকির হাত থেকে কৌশলে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং বাবরিচুল! বাহ, একেই তো বলে স্বামী। এভাবেই যুগে যুগে স্বামীরা বউদের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। ভাগ্যিস মোবাইলের স্ক্রিন অন্ধকার। নয়তো জায়গামতো ধরাটা খেয়ে যেতাম আজ!
ঝিকি বললো, ভাইয়া। ফোনটা আমার হাতে দাও, আমি তোমাকে পাঁচশো টাকা দিবো।
‘শিওর?’
‘একদম শিওর। নগদ কচকচে নোট।’
‘তোমার হাতে দিলে মীরা আবার তোমাকে ধাওয়া করবে। আমাকে ধাওয়া করতে পারবে না। তুমি চাইলে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারি। ডিল?’
ঝিকি দাঁত কেলিয়ে বললো, ডিল ডান। নগদে পাঁচশো দিবো। ফোনটা অন করে আমাকে বলো ছেলেটা কে?
বাবরিচুল ফোনের পাওয়ার বাটন চেপে ধরলো। আমি এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে জীবনে পড়ি নাই। দুই হাতে মুখ ঢেকে “মাগোমা” বলে বসে পড়লাম। আমার ফোনে কোনো লক দেয়া নাই! কোনোদিন পাসওয়ার্ড দেয়ার প্রয়োজন হয় নি।
চলবে..
(সম্মানিত পাঠক, আমার অনেক পরিশ্রমের, তিন ঘন্টা সময় নিয়ে লেখা আজকের পর্ব। অন্য কাউকে কপি করে পোস্ট করতে দেখলে প্রতিবাদ করবেন প্লিজ। ইনশাআল্লাহ সম্পূর্ণ গল্প প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে ফেসবুকে পোস্ট করা হবে। কেউ লেখক’কে ট্রিট হিসেবে সম্মানী প্রদান করতে চাইলে ইনবক্সে যোগাযোগ করবেন। ধন্যবাদ।)
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুলওয়ালা গল্পের লিংক
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৩
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৮
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১০