Golpo romantic golpo বাবরি চুলওয়ালা

বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২


১২
উজ্জ্বল রোদেলা এক সকালে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয়েছি, বাবাও আমার সঙ্গে আছেন। অফিসে যাচ্ছেন তিনি। পথে নানান গল্পের ফাঁকে বললেন, ‘মুনযির বলছিলো একটা গাড়ি কিনে ফেলতে। এখন অনেক জায়গায় কাজ থাকে, মিটিং থাকে। বড় বড় লোকজনদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে হয়। তাছাড়া ওইদিন বৃষ্টির কারণে রাতে ফিরতে পারলাম না। ও বলছিলো একটা গাড়ি কেনা উচিৎ আমার। কি বলিস তুই?’

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম, ‘ভালো হবে। ঠিক বলেছে উনি। কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার রাখা তো বেশ ঝক্কির। ওনার বেতনের টাকায় আরেকটা সংসার চালানো যাবে।’

বাবা হেসে বললেন, ‘সেটারও সমাধান মুনযির দিয়েছে। যেহেতু আমি প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে বের হবো না। মাঝেমাঝে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাওয়ার সময় নিবো। সেহেতু ড্রাইভার রাখার প্রয়োজন নেই। মুনযির ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে।’

‘বাব্বাহ, উনি ড্রাইভিংও জানে! উনি না গরীব ঘরের ছেলে? ড্রাইভিং শিখলো কখন?’

‘ওর এক বড়লোক বন্ধুর গাড়ি আছে। ওর কাছেই নাকি শিখেছে। একটা স্কিল শেখা থাকলে কখন কোন কাজে লাগে বলা যায়? এজন্য শিখে রাখছে।’

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘ভালোই তো। ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। তোমার একজনকে দিয়েই অফিস আদালত, বিয়েবাড়ির দায়িত্ব, এখন আবার ড্রাইভারের কাজও তাকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারছো।’

বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তা পারছি। ছেলেটা আসলেই অনেক ভালো রে। নয়তো আজকালকার দিনের ছেলেরা কাজের ভয়ে নিজের এসব দক্ষতার কথা কাউকে বলবেও না। দোয়া করি, একদিন ও নিজের সব স্বপ্ন পূরণ করুক।’
‘তুমি তাকে হেল্প করতে পারো চাইলে?’
‘তা কি আমি ভাবিনি? আমার পরিকল্পনা আছে ওকে নিয়ে।’
‘ভালো। খুব ভালো।’

বাবা পথে নেমে গেলেন। ভার্সিটিতে এসে পড়াশোনায় মনযোগ দিলাম আমি। মাঝখানে কতগুলো দিন কেটে গেছে। এখনো সেদিন রাতের ব্যাপারটা আমাকে পীড়া দেয়। ওকে নিজের মনের কথাগুলো বলতে না পারার আক্ষেপ হয়তো আজীবন আমাকে এভাবে তাড়া করে বেড়াবে।

দিন কাটতে লাগলো তার নিজের নিয়মে। বাবরি চুলওয়ালার কোনো খবরও আমি জানিনা। সে তার জায়গায়, আমি আমার। দু’জনে যার যার জীবনকে এগিয়ে নিচ্ছি। পড়াশোনায় আগের চাইতে বেশী মন দিয়েছি। আজকাল সবার মুখে শুনি আমি নাকি বদলে গেছি অনেক! বন্ধুরা আমাকে চিনতে পারেনা। এমনকি বাবাও মাঝেমাঝে বলেন, মীরা ইদানীং কথাবার্তা খুব কম বলে। একবারে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলে না।

আমি জানিনা সত্যিই তাই কিনা। তবে, নিজেকে বুঝতে শিখেছি খুব। ধরতে পেরেছি নিজের অপূর্ণতা। যে আচরণের জন্য আমায় লোকে কথা শোনায়, সেই আচরণ গুলো করা ছেড়ে দিয়েছি। এইটুকু বিশ্লেষণ করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করতে আমার অনেক সময় লেগে গেলো।

আমি চাই, আর কেউ যেন কোনোদিন আমায় অবুঝ, ইমম্যাচিউর, বাচ্চা মেয়ে, এসব বলতে না পারে। প্রতিটা বয়সের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, সৌন্দর্য আছে। যে বয়সে যেমন আচরণ করা দরকার, সেখানে সেটাই মানানসই। পরিণত বোধে পূর্ণ থাকার বয়সে অপরিণত আচরণ করাটাকে মোটেও গৌরবের বিষয় বলা যায় না।

মাসখানেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো।

একদিন বিকেলে বাবা গাড়ি কিনে বাসায় আনলেন। অফিসের সব কর্মচারীদের গাড়িতে করে ছোটখাটো রাইড দেয়া হলো। আমরা সবাই অত্যন্ত খুশি।

ছোট চাচীর মৃত্যুবার্ষিকী একদিন পরেই। বাবা বললেন, ‘গাড়ি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাই চলো। সবাইকে গাড়িতে চড়ে ঘুরিয়ে নেয়াও হবে, মিলাদেও থাকা হবে।’

পরদিন সকালবেলা।
সূর্য বেশ কড়া রশ্মি ছড়িয়েছে। এমন ঝলমলে দিনে আমিও রোদের মতো উজ্জ্বল এক পোশাক পরেছি। শ্যাম্পু করা চুলগুলো এলিয়ে দিলাম পিঠের ওপর। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে হয়ে গেলাম পুরোদস্তুর মেমসাহেব।

বাসার সম্মুখেই আমাদের সাদা রংয়ের গাড়ি। দীর্ঘ পথ ড্রাইভ করতে হবে। বাবরি চুলওয়ালা সঙ্গে ওনার সেই বড়লোক বন্ধুকে নিয়ে এসেছে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো এভাবে, ‘মীরা, ও আমার বন্ধু তনয়। একদিন যার বাইকে উঠতে আপনি আপত্তি জানিয়েছিলেন। তনয়, ও আমাদের সবার প্রিয় মীরা।
‘ওহ আচ্ছা। পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো। আপনার গল্প অনেক শুনেছি।’ তনয় হাসিমুখে বলে কথাটা।

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘আমার গল্প! কার কাছে?’
‘মুনযিরের কাছে। ইনফ্যাক্ট আংকেল, অফিসের যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কমবেশী সবাই আপনার কথা বলে। আপনি সবার কাছে খুবই ফেমাস।’
‘কিসের কারণে?’
‘খুব টাফ কুয়েশ্চন হয়ে গেলো আমার জন্য।’
‘ওকে, তাহলে মিস্টার বাবরিচুল আপনিই বলুন। আমি কিভাবে আপনাদের সবার প্রিয় মীরা হয়ে গেলাম?’
‘মিস্টার বাবরিচুল! হোয়াট অ্যা নেইম।’ বললো তনয়।

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘ওনার প্রকৃত নামটা আমার মনেই থাকেনা। আমি ওনাকে বাবরিচুল বলেই জানি। যাইহোক, আপনি আমার ব্যাপারে কি কি গল্প শুনেছেন আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।’
‘নিজের ব্যাপারে তো আপনি জানেনই। তবুও?’
‘হ্যাঁ। আজ থেকে দুইমাস আগের মীরা আর আজকের মীরা এক নয়। সবাই আগের ভার্সনটাকে কেন ফেমাস বানিয়েছে আমার জানা দরকার।’

এমন সময় আব্বু আম্মু গাড়ির কাছে এলেন। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। আমরা তিনজন, মা বাবা ও আমি পিছনের সিটে বসলাম। আর সামনে বসলো তনয়, ড্রাইভিং সিটে বাবরিচুলওয়ালা। গাড়ি ঠিকঠাক চালাতে পারবে কিনা, কোনো ভুল হয়ে যাতে না যায়, সবকিছু দেখার জন্যই তনয় সঙ্গে আছে।

কয়েক কিলোমিটার খুবই ধীরগতিতে চললাম আমরা। আস্তে আস্তে গতি বাড়লো। পথে গাড়ি থামিয়ে আমরা নাস্তা করলাম। তারপর আবারও চলতে শুরু করি৷ যেতে যেতে বাবা, তনয় ও বাবরিচুল নানান বিষয় নিয়ে গল্পগুজব করছে। আমি আর মা চুপচাপ। আমি বাইরে তাকিয়ে আছি। এছাড়া করার কিছুই নেই। ছোটচাচীর মৃত্যুবার্ষিকী না হলে আমি গ্রামে যেতাম না আজ।

পথেই একটা বাজার দেখে থমকে গেলাম আমি। একদিন এই বাজারেই আমাদেরকে অটোচালক নামিয়ে দিয়েছিলো। আমি আর বাবরিচুলওয়ালা পুরোটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক, সবচেয়ে স্মরণীয় সেই দিন। আমি অজান্তেই স্মৃতির ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। বিষণ্ণতা আঁকড়ে ধরে আমায়।

দাদুবাড়িতে পৌঁছাতেই মেজো চাচী এসে জড়িয়ে ধরলেন। আমি বললাম, ‘তোমাকে খুবই মিস করেছি।’
‘আমিও মীরা। তোমরা চলে যাওয়ার পর কয়েকদিন বুকটা খুব খাঁ খাঁ করছিলো। বাড়িটা এমন শুন্য হয়ে গেছে কী বলবো!’

রোহান দৌড়ে এসে বললো, ‘আপু, আই মিসড ইউ সো মাচ।’

রোহান বিয়ের অনুষ্ঠানের পর থেকে এখানেই আছে। ছোটচাচার একমাত্র ছেলে রোহান। রোহানের জন্মের সময় গর্ভকালীন জটিলতায় ওর মা মারা যান। এরপর রোহানকে দত্তক নিয়ে নেয় আমার বাবা। রোহান আমার পরিবারেই বড় হয়েছে। ছোট চাচা এরপর থেকে আর বিয়ে করেননি। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যায়নি। তিনি চলে যাবেন কয়েকদিন পর। এই কয়েকদিন তিনি রোহানকে কাছে রাখতে চান।

বাবা গাড়ি নিয়ে এসেছে শুনে পুরো এলাকায় হৈ চৈ পড়ে গেলো। এলাকায় কারো প্রাইভেট কার নেই। গাড়ি দেখার জন্য বাড়ির সামনে রীতিমতো ভীড় জমে গেলো। কেউ কেউ খুব কৌতুহলী হয়ে গাড়ির সঙ্গে ছবি তুলতে আসে, বাবরিচুল সবার ছবি তুলে দেয়। কাছের লোকজনদের গাড়িতে করে কাছাকাছি একটা রাইডও দিয়ে আসে।

বেশ কয়েক পদের পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়েছে। গরম গরম পিঠা খেয়ে দাদীর রুমে এসে আরাম করে শুয়ে পড়ি। মুহুর্তেই সেই প্রথমদিন দাদুবাড়িতে এসে অন্ধকার ঘরে বাবরিচুলের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। সময় অনেক গড়ালো। কতগুলো দিন! কত পরিবর্তন জীবনে। অথচ এখনো মাঝেমাঝে কিছু জায়গা, কিছু গন্ধ, কিংবা কিছু সুর – বারবার তাকে মনে করিয়ে দেয় অবচেতনে..

সন্ধ্যাবেলা নাস্তা সেরে বাবরিচুল ও তার বন্ধু শহরে ফিরে গেলো। অনেকদিন পর একটা সুন্দর দিন কাটালাম আমরা। দাদুবাড়িতে ছোট ছোট ভাইবোনরা আছে, চাচা চাচী আছে। সবার সঙ্গে আনন্দময় মুহুর্ত পার হলো।

দুইদিন পর দাদুবাড়ি থেকে বাসায় চলে আসি। ফেরার সময় বাবরিওয়ালা একা ড্রাইভ করবে। পাশের সিটে বাবা আমাকে বসতে বললেন। সামনের সিটে এসির হাওয়া বেশী গায়ে লাগে, বাবার অসুবিধা হয়। আমি চুপচাপ বাবরিওয়ালার পাশের সিটে বসি। একসময় পিছনে ফিরে দেখি মা, বাবা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাবরিচুল মন দিয়ে ড্রাইভ করছে। আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ে যাই।

সে বলে, ‘হালকা ভলিউমে গান ছেড়ে দিবো?’
‘আপনার ইচ্ছা।’
‘গানে ওনাদের আবার অসুবিধা হবে। থাক।’

আবারও নিরবতা। গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। অভ্যস্ত হওয়ার আগে জোরে গতিতে ড্রাইভ করা যাবেনা, বাবার আদেশ। এভাবে চললে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগবে। আমি খুব করে চাই, বাবা ঘুম থেকে উঠুক। কথা বলুক তারা। তবুও এভাবে চুপচাপ বসে থাকার অস্বস্তিভাবটুকু দূর হোক আমার। কখন যেন নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। মায়ের ডাকে চমকে উঠে দেখি বাসার সামনে চলে এসেছি!

রাত্রিবেলা হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ। দরজা খোলাই আছে। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি বাবরি চুলওয়ালা!

আমি অবাক হওয়ার ভাবটা লুকিয়ে দরজায় এসে জিজ্ঞেস করি, ‘কিছু বলবেন?’
‘একটু কথা ছিলো।’
‘বলুন?’
‘ছাদে যাই?’
‘ছাদে! রাত আটটা বাজে।’
‘আমি যাচ্ছি, আপনি আসুন।’

সে ছাদে চলে যায়। আমি খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি। বাবা বাসার বাইরে। মা নিশ্চয়ই রান্নাঘরে। কিন্তু উনি ছাদে কেন ডাকছে আমায়! কি এমন কথা যা এখানে বলা যাবেনা? তাছাড়া এই প্রথম উনি আমার রুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুললো।

চিন্তিতমুখে ছাদে চলে এলাম আমি। সে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারের মাঝে। আমি গিয়ে পাশে দাঁড়ালাম, ‘বলুন?’
‘বাসায় কথা বললে আন্টি শুনতে পাবেন। তাই..’
‘এখন বলুন?’
‘কিভাবে যে বলি..’

আমি খানিকটা চমকে উঠে বলি, ‘কোনো সমস্যা? কি ব্যাপারে?’
‘প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমার বন্ধু তনয় আপনার ফেসবুক আইডিটা চেয়েছে।’
‘এটা আপনি আমার রুমেও বলতে পারতেন। তবে, আমার ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড আব্বুর কাছে আছে।’
‘ওহ হো। তাহলে হোয়াটসঅ্যাপ?’
‘নেই।’
‘তাহলে কি আপনার নাম্বারটা ওকে দিবো?’

আমি খানিকটা বিরক্ত মিশ্রিত স্বরে বললাম, ‘তাতে কি হবে?’
‘ও আপনাকে কিছু বলতে চায়।’
‘সেটা আপনি জানলে এখনই বলুন? কি কথা?’
‘জরুরি কথা। যার কথা, তার নিজেরই বলা উচিত।’
‘জরুরি কথা ফোনে কেন বলবে, সরাসরি বলতে বলুন।’
‘মিস মীরা..’
‘আপনি ওনাকে বলুন আমার সঙ্গে দেখা করতে।’
‘দেখা করবেন!’
‘জি। যেহেতু জরুরি কথা, শোনা উচিৎ। সে কি প্রেমে পড়েছে আমার?’

কয়েক সেকেন্ড নিরবতা। একটা নিশ্বাসের শব্দ। তারপর খানিকটা অপ্রস্তুত স্বরে সে বললো, ‘খুব সম্ভবত তাই।’
‘ওকে। আগামী পরশু দেখা করবো। লোকেশন ঠিক করে আমি আপনাকে মেসেজে জানিয়ে দিবো।’
‘আচ্ছা।’
‘আর শুনুন, আপনিও যাবেন আমার সঙ্গে। আমি কোনোদিন একা কোনো পুরুষের সঙ্গে কথা বলিনি, আপনি ছাড়া।’

কথাটা বলে আমি দ্রুত ছাদ থেকে নেমে আসি। রুমের দরজা বন্ধ করে দেই। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে দ্রুত পা নাচাতে থাকি। কপালে কি এই ছিলো! শেষ পর্যন্ত বাবরি ওয়ালার বন্ধু? কেন রে কপাল! কেন?

নিজেই নিজের কপালে চাপড়াতে লাগলাম। আরেকজন এসেছে বন্ধুর জন্য ফোন নাম্বার চাইতে! আবার জিজ্ঞেসও করে, “পারমিশন দিবো?” তোমার পারমিশনের নিকুচি করি। এরকম আশ্চর্য হইনা অনেকদিন।

যথা সময়ে তনয় সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আমি বাবরি চুলওয়ালার সঙ্গে একটা রেস্টুরেন্টে চলে আসি। ভার্সিটি শেষ হবার আগেই বের হয়েছি। পথে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছে সে। রেস্টুরেন্টে বসে আমাদেরকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে বাবরিচুল উঠে যায়। আমি ডাক দিয়ে বলি, ‘এইযে, কোথায় যাচ্ছেন?’
‘এক্ষুণি আসছি।’

সে চলে যায়। আমি এবার বেশ মনযোগী শ্রোতার মতো তনয়ের দিকে তাকাই। ছেলেটা দেখতে বেশ সুদর্শন, গালে চাপ দাড়ি। সম্ভবত রাত জাগার স্বভাব আছে। চোখ দুটোর ওপর নিচে গভীর কালো দাগ পড়ে গেছে!

সে বললো, ‘আপনি কিছু অর্ডার দিন?’
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কি এখানে তেহারি খেতে এসেছি? নাকি বার্গার?’

সে হতভম্ব হয়ে বললো, ‘আপনার যেটা ভালো লাগে।’
‘আমরা কি শুধু খেতে এসেছি?’
‘না। দেখা করতে।’
‘আর?’
‘কথা বলতে।’
‘তাহলে কথা বলুন। খাওয়াদাওয়ার আলাপ পরে।’

তনয় হেসে বললো, ‘আপনি কি জানেন আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলেন?’
‘জানতাম না। থ্যাংকস। আমি সুন্দর দেখতে এটা জানি। এটা বাদ দিয়ে অন্যকিছু বলুন।’
‘আপনি কি রেগে আছেন মিস মীরা?’
‘রেগে থাকলে দেখা করতাম না। আপনার জরুরি কথাটা কি এখন বলা যাবে? নাকি আরো শিরোনাম বাকি?’

সে হেসে বললো, ‘বলছি। আচ্ছা বলুন, আপনার কিরকম ছেলে পছন্দ?’
‘আপনার বন্ধুর মতো।’
‘মুনযিরের মতো?’
‘হুম।’
‘সুদর্শন?’
‘সুদর্শন, বুদ্ধিমান, সৎ, ক্যারিয়ারে ফোকাসড আর মানবিক গুণসম্পন্ন।’
‘ওকে। যেহেতু মুনযিরের মতো ছেলে পছন্দ। কাজেই আমি বলতে পারি, মুনযির যদি কোনোকিছুর সার্টিফিকেট দেয়, সেটা আপনার বিশ্বাসযোগ্য?’
‘ডেফিনেটলি।’
‘ওওও…কেএএ..’

তনয় ফোন বের করে কাউকে কল দিলো। ফোনটা রাখলো লাউডস্পিকারে। রিসিভ করতেই শুনতে পেলাম মুনযিরের গলা। সে বললো, ‘হ্যাঁ তনয়, বল? কিছু লাগবে?’
‘তুই কই?’
‘আছি আশেপাশেই। কি হইছে?’
‘বন্ধু, বল তো। সুদর্শন, বুদ্ধিমান, সৎ, ক্যারিয়ারে ফোকাসড আর মানবিক- এই গুণগুলো কি আমার মধ্যে আছে?’
‘উমম.. হ্যাঁ আছে। শতভাগ আছে।’
‘ থ্যাঙ্কিউ বন্ধু।’

তনয় কলটা কেটে দিয়ে ফোনটা টেবিলে রেখে আমার দিকে তাকালো। আমি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছি। দারুণ মুভ! ভালো লাগলো তার এই কৌশলটা। নিঃসন্দেহে তাকে বুদ্ধিমানের তালিকায় ফেলা যায়। আমি হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছি।

সে বললো, ‘সমস্ত ক্রাইটেরিয়া ফুলফিলড। তাহলে এখন আমি যদি মনের মানুষ হওয়ার আবেদন করি, গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা কত পার্সেন্ট?’
‘সম্ভাবনা জেনে তারপর আবেদন করবেন?’
‘হুম। ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হতে চাই না।’
‘ফিফটি ফিফটি।’
‘কেন!’

হতাশ হয়ে টেবিলে একটা চাপড় দিলো সে। আমি হেসে বললাম, ‘অলরেডি লাইনে একজন আছে। আয়মান, মায়ের বান্ধবীর ছেলে। মা প্রতিদিন এটা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। তাকে বাদ দিয়ে আপনাকেই কেন আমার ফ্যামিলি সিলেক্ট করবে? একটা কারণ দেখান?’
সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললো, ‘একটা না। আমি দুইটা কারণ বলছি। প্রথমত, আপনি। আপনার পছন্দের মানুষকে আপনার ফ্যামিলি একসেপ্ট করবে সহজেই। আর দ্বিতীয়ত, মুনযির। আমি শুনেছি আংকেল ওকে অসম্ভব ভালোবাসেন। এতটাই ভালোবাসেন যে আপনার সঙ্গে ওর বিয়েও দিতে চেয়েছেন। মুনযির যদি সুপারিশ করে, এটা আমার জন্য একটা বড় প্লাস পয়েন্ট।’

বাবরি চুলওয়ালা তার বন্ধুর বউ হওয়ার জন্য সুপারিশ করছে, বিষয়টা কল্পনা করেই আমি শিউরে উঠলাম। এমনও দিন জীবনে আসবে ভেবেছি কি কখনো? না, কখনোই ভাবিনি।

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘সুন্দর উত্তর দিয়েছেন। ভালো লেগেছে।’
‘আমাকে?’
‘না। আপনার উত্তর।’
‘আমাকে কেন লাগেনি?’
‘লাগেনি যে, এটা বলবো না। আপনি নিজেই বললেন সমস্ত ক্রাইটেরিয়া ফিলআপ করেছেন। আপনাকে যেকোনো মেয়েরই পছন্দ হবে। কিন্তু আমি আমার পরিবারের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবো। আপনি যাইই করতে চান, পরিবারের রাস্তা ধরে এগোতে হবে।’

সে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে উত্তর দিলো, ‘আপনি বলুন কবে আসবো?’
‘বাপ্রে! এত প্রেম?’
‘আমি আমার ফ্যামিলিকে নিয়ে যাবো। তবে হ্যাঁ, আমার মনে হয় ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলার আগে আমাদের নিজেদের একটু একে অপরকে জানার চেষ্টা করা উচিৎ। এতে করে দুজনেই বুঝতে পারবো আমরা একে অপরের জন্য পারফেক্ট কিনা। তারপর নাহয় ফ্যামিলি..’

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘আমাকে কিছুদিন সময় দিন। তারপর জানাবো আমি আপনাকে একসেপ্ট করবো কিনা।’
‘আমি কি কল দিতে পারবো?’
‘না। যেদিন আমার মনে হবে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি, আমি প্রস্তুত। সেদিন আপনাকে নিজে থেকেই কল দিবো। আপনি অপেক্ষা করুন।’
‘এ কেমন কঠিন পরীক্ষায় ফেললেন আমায় মীরা?’
‘এই সামান্য প্রতীক্ষাটুকু করতে পারবেন না? এটা তো ফার্স্ট স্টেপ। এরপর কথা বলতে বলতে আপনাকে আমার মনে ধরতে হবে। আপনাকে আমার জন্য পারফেক্ট মনে হতে হবে। তারপর আমি আপনাকে বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে আসার অনুমতি দিবো।’

তনয় অনেক্ষণ চুপ করে রইলো। গম্ভীর মুখে টেবিলে থুতনি লাগিয়ে কী যেন ভাবতে লাগলো। তার কাণ্ড দেখে হাসি পেয়ে গেলো আমার। হেসে বললাম, ‘এবার খাবার অর্ডার দিতে পারি।’

চলবে..

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply