১১
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।
বাতাসের শো শো শব্দ, জানালার কাঁচ, গাছের পাতায় বৃষ্টির টুপটাপ, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত ছন্দ তৈরি হয়েছে।
আমি দোতলার রুমে অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। নিচতলায় বাবরিওয়ালা। তাকে দেখা যায় না, তবু তার উপস্থিতি টের পাই।
নিচে নামার সাহস পাচ্ছি না। বেশ রাত হয়ে গেছে। এখন নিচে নেমে তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলে মা আচ্ছা করে বকে দেবে আমাকে। কিন্তু বাবরিওয়ালার সঙ্গে বিষয়টা খোলাসা করা দরকার।
একসময় মা দোতলায় নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি জানিনা কাজটা ঠিক হচ্ছে কিনা! খুব সাবধানে পা টিপে টিপে নিচে নামলাম। বাড়ির পাশেই বড় টিনের চাল দেয়া একটা গোডাউন থাকায় বৃষ্টির শব্দে চারপাশ মুখর হয়ে আছে।
যতটা ভেজা বিড়ালের মতো নিচে নামলাম, ততটাই শক্তিশালী সিংহের মতো এসে তার দরজায় কড়া নাড়লাম। সে দরজা খুলে চোখ কপালে তুলে বললো, ‘মিস মীরা!’
আমি বুকে হাত বেঁধে ভাব নিয়ে দাঁড়ালাম, ‘দেখুন, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমি বিষয়টা ক্লিয়ার করে দিচ্ছি।’
‘ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলি?’
উত্তম প্রস্তাব। তার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি দেখলে আম্মু সন্দেহ করে বসবে। আমি ড্রয়িংরুমের আলো জ্বালিয়ে দিলাম। সে এসে সোফায় বসলো। আমি বসলাম মুখোমুখি।
তারপর বললাম, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন আমি আপনাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলাম। আসলে বিষয়টা সেরকম নয়।
‘যা ভাবছি তা আপনি কিভাবে জানলেন?’
‘আপনি তো বললেনই আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না। দেখুন আমি মোটেও চিন্তিত ছিলাম না। এমন ঝড়বৃষ্টির রাত, আপনি নিজে আমাদের জন্য রিকশা নিয়ে আসলেন। ছাতা নিয়ে আসছেন। সেখানে আপনার কি হাল হলো সেটা জানতে চাওয়াটা একটা ম্যানার্সের মধ্যে পড়ে। আমি সৌজন্যতার খাতিরে মেসেজটা পাঠিয়েছি।’
বাবরিচুল মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘বেশ তো। ধন্যবাদ।’
‘এখন হয়তো ভাবছেন মায়ের কথা কেন বলেছি? দেখুন আমি মেসেজ পাঠালে বিষয়টা অস্বস্তিকর হয়ে যায়। তাই মায়ের কথা বলেছি যাতে আপনি কিছু মনে না করেন।’
সে আবারও মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘বেশ তো। আমি কিছু মনে করছি না।’
‘আপনি সত্যিই কিছু মনে করেননি?’
‘উহু, করিনি। আপনারা বের হবার পরপরই একটা রিকশা পেয়ে যাই। অফিসের ওখানে গিয়ে দেখি বিল্ডিংয়ের মেইন গেট ভেতর থেকে বন্ধ। মেইন গেটের চাবি আমার কাছে ছিলো না। ওখানে সবসময় দাড়োয়ান থাকে। আজ দাড়োয়ানকে ফোন দিয়েছিলাম অনেকবার, রিসিভ করে নি। বৃষ্টিতে তো আর বাইরে থাকা যায় না। এরপর আংকেলের কাছে ফোন দিলে উনি বললেন বাসায় চলে যাও।’
‘আচ্ছা। আশা করছি আমার মেসেজটাতে আপনি কিছু মনে করবেন না।’
সে মুচকি হেসে বললো, ‘ঠিক আছে। এমনিতেও কিছু মনে করিনি।’
‘কথা শেষ। আপনি যান এখন।’
আমি ড্রয়িংরুমের বারান্দার দরজাটা খুলে দিলাম। বৃষ্টির ছাট এসে গায়ে লাগলো। দারুণ ঠাণ্ডা বাইরে। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। ঠাণ্ডা জলের স্পর্শে শরীরটা কেঁপে উঠলো হালকা করে।
এমন সময় বাবরিচুল আমার ঠিক পাশেই এসে দাঁড়ালো। আমি চমকে উঠে বললাম, ‘আপনি রুমে যাননি?’
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
‘কি কথা!’
‘আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন?’
আমি খানিকটা কেঁপে উঠি তার প্রশ্ন শুনে। এমন গভীর রাত। শিরশিরে বাতাসে মিশে থাকা প্রবল বর্ষণের শব্দ। বাতাসে যখন গাছের পাতা দোল খায়, মনে হয় অন্য এক জগতে চলে এসেছি। প্রকৃতি তার নিজেকে মেলে দিয়েছে এক অভিনব রোমান্টিক কায়দায়। তার ওপর যখন প্রিয় মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে এমন প্রশ্ন করে, সত্যিই কি স্থির হয়ে থাকা যায়?
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। মুখ ঘুরিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকটা ধুকপুক করছে। যায় না কেন সে!
চলে যাওয়ার বদলে সে আরও কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, ‘বলুন মিস মীরা? আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলেন?’
আমি পালটা প্রশ্ন করলাম, ‘আমার রাজি থাকা, না থাকাতে কি আসে যায়?’
‘অনেক কিছু।’
‘কিহ!’
‘অনেক কিছু আসে যায়। আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন?’
তার অনুভূতি জানার জন্য আমি খানিকটা মিথ্যার আশ্রয় নিলাম, ‘যদি বলি আমার আপত্তি ছিলো? আমি চাইনি আপনার আর আমার বিয়ে হোক।’
সে একটা বড় শ্বাস ফেলে বললো, ‘বাঁচালেন আমায়। আমার ভেতরে একটা অপরাধবোধ জেগে উঠেছিলো। অজান্তেই আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি কীনা! আপনি রাজি ছিলেন না শুনে স্বস্তি পেলাম।’
আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, আমি বলে দেই, “আপনাকে খুব করে চেয়েছিলাম”। কিন্তু পারলাম না। বলে দিলেই তো সবকিছু বদলে যাবে না।
সে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে বললো, ‘সেদিন আপনি কিছুই বলেননি। তাই….’
‘সেদিন আমার সুযোগ ছিলো না বলার।’
‘আজকেও কি সুযোগ নেই মীরা?’
আমি দ্বিতীয়বারের মতো কেঁপে উঠলাম। সেই চিরচেনা তরঙ্গ আরও একবার আমাকে কম্পিত করে দিয়ে চলে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘আমার এখন আর কিছুই বলার নেই।’
‘এখন! আর! তারমানে আগে ছিলো?’
‘আমি খুবই সারপ্রাইজড হচ্ছি জানেন তো? এতদিন পর এসে আপনি আমার কথা জানতে চাচ্ছেন। যখন প্রস্তাবটা নাকচ করে দিয়েছেন, তখন তো একবারও জানতে চাননি মীরা কি চায়?’
সে কেমন যেন অপরাধীর মতো তাকিয়ে রইলো। অথচ সেই চাহনিতে তাকে আরও নিষ্পাপ দেখাতে লাগলো। আমি চাইলেও কঠিন করে কিছু বলতে পারলাম না।
অস্ফুটে বললো, ‘আপনি কি চান!’
‘এখন জানতে চেয়ে কোনো লাভ আছে? যখন জানার দরকার ছিলো তখন শুধু নিজের অস্তিত্বটাই জানান দিয়ে গেছেন। একবার ফিরেও তাকাননি।’
‘আমি ভাবতেও পারিনি আপনারও কিছু বলার থাকতে পারে। আমি জানতাম এটা আংকেলের সিদ্ধান্ত। ওনার পছন্দ, ওনার চাওয়া।’
‘বেশ তো। সব মিটে গেছে। এতদিন পরে এসে আমার মতামত জানতে চাওয়ার কারণ কি?’
সে মেঝের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আমার সবসময় মনে হতো আমি হয়তো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই ফ্যামিলি, আংকেলের বিজনেস কিংবা টাকা পয়সার জন্য নয়। আপনার জন্য। আমার মনে হতো, আপনাকে গ্রহণ না করাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।’
আমি হঠাৎ শুকনো মুখেও হেসে ফেললাম। বাংলা ভাষায় যাকে বলে হাতছাড়া করা, সেটাকে উনি বলছে “গ্রহণ না করা।” তার শব্দচয়ন আমাকে মুগ্ধ করলো। কাউকে খুব কাছের না ভাবলে কি এভাবে বলা যায়!
সে বললো, ‘এখন শুনে খুশি হলাম যে আপনিও চাননি বিয়েটা হোক। ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে আমাদের দুজনেরই ভালো হবে।’
কী বলবো বুঝতে পারছি না। আমার অনুভূতির সমস্তটাই তার কাছে অজানা। আজকের প্রকৃতিও বোধহয় চায় আমি তাকে সবকিছু জানিয়ে দেই। তার কাছে কি আমার নিজেকে প্রকাশ করে দেয়া উচিত? আমার অনুভূতিগুলো জানার পরে সে কি করবে? আমার হয়ে যাবে? নাকি প্রতিবারের মতো ক্ষমা চেয়ে বলবে, মাফ করবেন!
আমি কী করবো! মন বলে তাকে একবার বলে দেই, “আমি আপনাকে চাই। ভীষণ রকম চাই।” আবার একবার মনে হচ্ছে, যদি এটা জানার পর সে বলে, “আমরা এক হতে পারবো না।” তখন আমি নিজেকে নিয়ে কোথায় যাবো..
এক অদ্ভুত দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম। বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগতে লাগতে গা ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই আমার। আমার ভেতরে আগুন ধরে গেছে। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। এরকম সুযোগ আর কোনোদিন আসবে না। আমার তাকে বলে দেয়া উচিত আমি তাকে কতটা তীব্রভাবে চাইতাম। বলে দেয়া উচিত…
আমি কিছু বলার আগেই সে বললো, ‘মীরা, আমি জানতাম আপনি কখনো রাজি ছিলেন না। ভাগ্যিস আমিও রাজি হইনি। নয়তো আপনার জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতো। খুব ভালো একটা কাজ করেছি। এইযে এত রাতে নিজেকে ব্যাখ্যা করতে চলে এসেছেন। এটাই বলে দেয় আমার প্রতি আমার অপছন্দের রেশ কতখানি..’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সে রীতিমতো এখন আমাকে ভুল বুঝতে শুরু করেছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে এই বৃষ্টির জল আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাক। আমি এই মুখ আর নিজেকেও দেখাতে চাই না।
হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে গায়ে লাগতেই চমকে উঠলাম। যেন প্রকৃতিও বলছে, “বলে দে মীরা, বলে দে। সব বলে দে তাকে।”
আমি এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলি, “আপনার ধারণা ভুল। আমি শুরু থেকেই আপনাকে চাই।” এই কথাটা বলার জন্য অনেক সাহস দরকার। বাইরের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের ভেতর সেই সাহস সঞ্চার করতে চেষ্টা করে চলেছি। তাকে বলতে হবে। প্রতিক্রিয়া যাইই হোক, বলতেই হবে।
যখন চোখ মেলে পেছনে ফিরলাম, দেখি সে নেই! রুমে চলে গেছে। দরজা ধরে বসে পড়লাম আমি। কেন এমন হলো! এরকম সুযোগ আর কোনোদিন আসবে না আমি জানি। এত বিশাল সুযোগ পেয়েও কেন তাকে সবকিছু বলতে পারলাম না? একবার সবকিছু বলে দিলে হয়তো গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো। এই অপরাধবোধ কি আজীবন আমাকেও কষ্ট দিতেই থাকবে..
ভেবেছিলাম বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর নেমে যাবে। কিন্তু না, ব্যথায় ক্রমশ বুকের ভেতরটা আরো ভারী হয়ে উঠলো। যেন পাহাড়সম ব্যথা এসে জমে গেছে। একবার মনে হলো তার দরজায় গিয়ে ডাকি। মন খুলে বলে দেই, “আমি আপনাকেই চাই। আপনি প্লিজ আমার হয়ে যান।” পরক্ষণেই মনে হলো, “এতটা বেহায়া হতে পারবো না। সে যখন বলবে- এটা সম্ভব না। আমি লজ্জায় কখনোই আর তার সামনে যেতে পারবো না। ইচ্ছে করবে মাটির সাথে মিশে যেতে।” একই দ্বিধায় বারবার ঘুরপাক খেতে লাগলাম আমি।
কতক্ষণ বারান্দার দরজায় বসে রইলাম নিজেও জানিনা। একসময় মনে হলো, রুমে ফেরা উচিত।
পরদিন ঘুম থেকে উঠলাম দুপুরবেলা। গোসল সেরে ভাত খেতে নেমে দেখি আম্মু রান্নাঘর গোছাচ্ছেন। চুপচাপ প্লেটে ভাত নিয়ে বসি।
মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাতে নিচে নামছিলি কেন? অত রাতে কেন কথা বলতে হবে?’
আমি খাওয়া বন্ধ করে মা’র দিকে তাকালাম। কিছু বলতে পারলাম না।
মা বললেন, ‘অত রাতে ওর সঙ্গে কথা বলা তোর উচিত হয়নি। জানিনা তোদের মনোভাব কী। কিন্তু জিনিসটা আমার ভালো লাগে নাই।’
‘আমরা তেমন কিছু করি নাই যেটাতে তোমার খারাপ লাগবে। ভবিষ্যতে আর কোনোদিন এমন হবেনা। আমাদের দুজনের মাঝখানে এখন আর কোনো বিন্দু নাই। পুরোটাই দেয়াল। আমাদের আর কোনোদিন এক হওয়ার সম্ভাবনা নাই। দুজনের পথ চিরদিনের মতো আলাদা হয়ে গেছে।’
মা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর চলে গেলেন রান্নাঘরে। আমি খাবার গেলার জন্য ঘনঘন পানি খেতে লাগলাম।
চলবে..
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৪
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৯
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৩
-
বাবরি চুলওয়ালা গল্পের লিংক
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৭
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৪