১০
ফোনবুকে ঢুকে বাবরি চুলওয়ালার নাম্বারটা বের করে ভাবছি- কল দেবো কী না? সেদিন যখন ওর ফোন থেকে আমার নাম্বারে কল দিয়েছিলাম, নাম্বারটা সেদিনই সেভ করে রেখেছি।
সারাদিন বারবার নাম্বারটা বের করে তাকিয়ে থাকি। কল দেবো কিনা সেই দোটানায় ভুগি। বরাবরের মতো আমাকে এই চরম দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করলেন বাবা।
অনেকদিন পর রুম থেকে বেরিয়ে পুরো বাড়িটা ঘুরছিলাম। বাড়ির পাশে আমার নিজের হাতে লাগানো গাছগুলো যত্নের অভাবে মলিন হয়ে পড়েছে।
পেছনের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমগাছের ছায়া লম্বা হয়ে মাটিতে পড়েছে। গাছের নিচেই বাবা চেয়ারে বসে আছেন, হাতে পত্রিকা, চোখে চশমা। পত্রিকা থেকে চোখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত হাঁটাহাঁটি করছিস কেন?’
বাবার প্রশ্নটা খুব সাধারণ, কিন্তু আমি চমকে উঠি। উত্তর না দিয়ে উঠোনের মাটি দেখছিলাম। বাবাও আর প্রশ্ন বাড়ালেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ বললেন,
‘মানুষ যখন বারবার কোনো একটা জায়গায় আটকে থাকে, বুঝবি ওখানেই তার আশ্রয়।’
আমি চমকে তাকালাম। বাবা পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছিলেন, কিন্তু কথাটা আমার বুকের ভেতর এসে ধাক্কা দিলো। বাবার চেয়ারের পাশে এসে মাটিতে বসলাম আমি। চেয়ারের হাতলে হাত রেখে বাবার দিকে তাকাই।
বাবা নরম গলায় জানতে চান, ‘তোর চেহারা দেখে স্বাভাবিক লাগছে না। কোনো কিছু নিয়ে টেনশনে আছিস?’
‘হু।’
‘বল আমাকে?’
‘তুমি সেটা জানো।’
কথাটা বলে আমি মাটির দিকে তাকালাম। বাবা পত্রিকা বন্ধ করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা তুই কি চাস আমি ওকে আসতে বলি? কথা বলি ওর সঙ্গে?’
আমি চমকে উঠলাম। এমন প্রস্তাবের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না না। বুকের ভেতর কেমন একটা ধাক্কা লাগলো। একদিকে অদ্ভুত স্বস্তি, আরেকদিকে অকারণ ভয়। বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। মাথাটা অসম্ভব নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা শুকনো কাঠাল পাতা উড়ে এসে আমার সামনে পড়লো।
বাবা বললেন, ‘ওকে কি বলবো আমাকে বল?’
‘জানিনা আমি।’
লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো আমার। অসম্ভব কষ্টে নীল হতে হতেও আজ লজ্জায় আমি একেবারে লাল হয়ে উঠলাম। কী যে করি, কী যে বলি! উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও পাচ্ছি না।
বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি আজকেই রাতে ওকে আসতে বলি। কি বলবো বল? সময় দিবো?’
‘জানিনা।’
‘বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারবি তো?’
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। উঠে বাবাকে জাপটে ধরলাম। বাবা আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভেবেছিলাম তোকে কখনো চোখের আড়াল করবো না। সবসময় চোখের সামনে রেখে দিবো। কিন্তু এভাবে তো রাখতে চাইনি মা। তুই দুঃখ পেতে পেতে শেষ হয়ে যাবি, এই মুখ তো তো আমি সহ্য করতে পারিনা। ওকে ডাকি, তোরা নিজেরা কথা বলে দ্যাখ।’
আমি এক দৌড়ে ঘরে চলে আসি। বাবার জন্য আমার অসম্ভব মন কেমন করছে। বাবা আমাকে কতটা ভালোবাসেন আমি জানি। আমার নিজেকে খানিকটা অপরাধী মনে হতে লাগলো৷ তার পছন্দের ছেলেকেই তো মনেমনে চেয়েছি, অথচ তবুও মনে হচ্ছে বাবাকে যেন কষ্ট দিয়ে ফেললাম! বাবা তো বিষয়টা এভাবে চাননি।
ঘড়ির কাঁটায় রাত নয়টা ছুঁই ছুঁই। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অস্থিরতা। ভয় নাকি উত্তেজনা, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
হঠাৎ গেট খোলার শব্দ! খুব শব্দহীন পায়ে হেঁটে আসছে সে। যেন বাড়িটাকে বিরক্ত করতে চায় না। আমার নিঃশ্বাস আটকে এলো। বুকের ভেতর ধপধপ শব্দটা এত জোরে হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, সে বুঝি শুনে ফেলবে। আমি বড় করে শ্বাস নিচ্ছি নিজেকে শান্ত রাখার জন্য।
বাবরিচুলকে ড্রয়িংরুমে নয়, বাবার রুমে বসতে বলা হলো। এরপর মা এসে আমাকে ডাকলেন। আমি একটু একটু করে বাবার রুমের দিকে যাচ্ছি। আর বুঝতে পারছি আমার হার্টবিট ক্রমশ বাড়ছেই।
একদম নিঃশব্দে বাবার রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। মাথা তুলে কোনোদিকে তাকানোর দুঃসাহস আমার হলো না। বাবা ডাকলেন, আয় মা। এখানে আয়।
বাবা আমাকে টেনে নিলেন নিজের একদম কাছে। তিনি বসে আছেন বিছানায়। আমাকে তার পাশে বসালেন। অন্যপাশে বসিয়েছেন বাবরি চুলওয়ালাকে। মাঝখানে বসে এমন শান্ত ভঙ্গীতে কথা বলছেন, যেন আমরা তাঁরই দুই স্নেহের সন্তান। এক মুহুর্তের জন্য তিনি আমাদেরকে দূরত্ব অনুভব করতে দিলেন না।
বাবা বললেন, ‘মীরা মা, আমি মুনযিরকে অনেক পছন্দ করি। আমার দেখা সবচেয়ে ভালো ছেলে ও। এরকম কাউকেই খুঁজছিলাম আমি তোর জন্য। এখন সমস্যা হলো, মুনযির বিয়ের জন্য প্রস্তুত না। ওর অনেক স্বপ্ন আছে। সেগুলো সে বিয়ের পরেও পূরণ করতে পারবে, এরকমই আশ্বাস ওকে দিয়েছি আমি। সংসারের বোঝা তোমাদের কারো ওপরেই আমি চাপিয়ে দিতে চাই না। আমি চাই, তোমরা ভালো থাকো। যেভাবে তোমরা চাও, সেভাবে ভালো থাকো। মুনযির তার স্বপ্ন পূরণ করবে, এতে আমার বা মেয়ের কারোরই বাঁধা আসবে না। তবুও মুনযির প্রস্তুত না। সে জানেনা এই প্রস্তুতি নিতে কতদিন সময় লাগতে পারে। এক বছর, পাঁচ বছর কিংবা দশ বছর। এখন অপ্রস্তুত অবস্থায় কারো ওপর কিছু চাপিয়ে দেয়া ঠিক না। আমি আমার জায়গা থেকে যা যা বলার সব বলেছি। এখন তোমরা দুইজন কথা বলো। নিজেরা বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্ত নাও। আমার কোনোটাতে কোনো “না” নাই।’
বাবা মাঝখান থেকে উঠে গেলেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। আমি আর মুনযির পাশাপাশি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করতে অসম্ভব লড়াই করে যাচ্ছি। তবুও টের পাচ্ছি, আমার নিশ্বাসের শব্দ কত দ্রুত আওয়াজ করছে!
‘মিস মীরা..’
আমি চমকে উঠি। মাথাটা নিচু করতে করতে একদম গলার সঙ্গে লাগিয়ে ফেলি।
‘মিস মীরা, আপনি অনেক নিষ্পাপ মনের একটা মেয়ে। অনেক লক্ষী একটা মেয়ে। আমার জীবনের কোনো অংশেরই কোনো কিছুই আপনি জানেন না। আমি অনেক পোড় খাওয়া মানুষ। আমাকে দেখতে যতটা ইনোসেন্ট আর সুখী মনে হয়, আসলে আমি এ জীবনে বহু ঝড় ঝাপটা সয়ে আসা একটা ছেলে।’
আমি স্থির হয়ে আছি। একটুও নড়ার সাহস পাচ্ছি না। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুজন মানুষ, অথচ দুজনে কেউ কারো মনের খবর জানিনা!
সে বললো, ‘আমার পড়াশোনার খরচ কেউই দিতে চাইতো না। ভাইয়ারা সবাই চাইতো আমি তাদের মতো মাঠে কাজ করে সংসারের হাল ধরি। আমি সবসময় বড় স্বপ্ন দেখে এসেছি। মানুষের বাসায় থেকে, তাদের বাচ্চাদের পড়িয়ে নিজের পড়াশোনা চালিয়েছি। কিন্তু আমার জীবনে অনেক অপমানজনক অধ্যায় আছে। কত মানুষের খোঁটা, অপবাদ, আর লাঞ্চনা সহ্য করেছি এ জীবনে! গরীব হওয়ায় কেউ দুই পয়সার দাম দিতো না। আমি সারাজীবন প্রতিজ্ঞা করেছি, একদিন অনেক বড় হবো। আমার ক্যারিয়ারের এখনো কিছুই শুরু হয়নি। বহুদূর যাওয়া বাকি। আমি সেই জায়গায় পৌঁছালেই সবার সব অপমানের জবাব দেয়া হয়ে যাবে। আমার মতো একটা ছন্নছাড়া ছেলেকে কেনই বা আপনার বাবা পছন্দ করলেন আমি জানিনা! আমি যদি কখনো আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকি, মাফ করবেন আমাকে।’
আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না। আমার ভয় হচ্ছে, সে হয়তো আর কিছু না বলেই চলে যাবে! গত দুই ঘন্টা ধরে নিজেকে প্রস্তুত করেছি তার সঙ্গে কথা বলার জন্য। অথচ এইমুহুর্তে কিছুই বলতে পারছি না।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, ‘আপনার আর কিছু বলার নেই?’
সে একটা শ্বাস ফেলে বললো, ‘বলার থাকলেই বা কি! আমি আমাকে আপনার যোগ্য মনে করি না। শুধু চেহারা আর চরিত্র ভালো হলেই হয় না। ক্যারিয়ার থাকতে হয়, একটা রাজকন্যাকে রাজরানী বানানোর সামর্থ্য থাকতে হয়। আমার স্ত্রীকে আমি কখনো তার বাপের টাকায় ফুটানি করা দেখতে পারবো না। আবার শ্বশুরবাড়িতে নিজের সংসার ফেলে রাখতেও পারব না। আমি যেদিন বিয়ে করবো, সেদিন আমার নিজের বাসায় আমার স্ত্রী রানী হয়ে আসবে। যেখানে পুরোটাই থাকবে তার রাজত্ব। দুই কামড়ার সংসার হোক বা দশ কামড়ার। সে পুরো বাড়িতে রাজ করবে। তার মায়ের সংসারের পুতুল হয়ে থাকলে সেটা আমি মানতে পারবো না। আপনি কখনো ভাববেন না যে আমি আপনাকে পছন্দ করিনি। বা নিজেকে তুচ্ছ ভাবার কারণ নেই। আপনি অনেক বেশী কিছুর প্রাপ্য, যার সিকিভাগও আমার নেই।’
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বললাম না। তাকে সুযোগ দেয়া উচিৎ।
সে আরও কিছুক্ষণ পর বললো, ‘এতকিছু আংকেলের সামনে বলতে পারিনি। তিনি তার জায়গা থেকে সঠিক। আমিও আমার জায়গা থেকে। আমার স্ত্রী আমার ঘরের রাণী। আমি যেদিন রাজা হবো, সেদিনই সেটা সম্ভব হবে। আর কবে তা হবে, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমি আংকেলের মনে কষ্ট দিয়েছি। জেনেশুনেই। এর জন্য আমি আপনার কাছেও ক্ষমা চাই।’
খানিকক্ষণ থেমে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কিছু বলতে চান মীরা?’
আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকালাম। সেও তাকালো আমার চোখের দিকে। অসহ্যকর একটা মুহুর্ত। ইচ্ছে করলো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ভয়ংকর রকমভাবে জড়িয়ে ধরি। এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরি যাতে আর কক্ষনো নিজেকে ছাড়াতে না পারে। কিন্তু, তা সম্ভব নয়। আমি ধীরেধীরে চোখ সরিয়ে নিলাম।
সে আবারও জানতে চাইলো, ‘কিছু বলবেন না?’
আমি অকস্মাৎ চোখে চোখ রেখে জানতে চাই, ‘চোখের ভাষা পড়তে পারেন আপনি?’
‘না। পারিনা।’
‘শেখা উচিৎ।’
‘শিখবো। আমি আসি।’
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে বেরিয়ে যায়। ড্রয়িং রুমে গিয়ে বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ সৌজন্যতাসূচক কথা শেষ করে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। আমি বাবার রুমের একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি। মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে আমার। তার কথাগুলো নেগেটিভ অর্থের হলেও কথায় তেজ ছিলো না এতটুকুও। বরং থেকে থেকে তার গলার স্বর দূর্বল হয়ে পড়ছিলো। নিছক হীনমন্যতা বোধ নয়, বরং ব্যথার তীব্রতা!
তবে তার এই পুরো ব্যাপারটা আমাকে এক অদ্ভুত শক্তি জোগালো। আমি আর কষ্ট পাচ্ছি না। বরং মনে হচ্ছে, তাকে মুক্ত করে দেয়া উচিত। মাঝেমাঝে কিছু সিদ্ধান্ত সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়া ভালো।
বাবার রুমের বুকশেলফ থেকে একটা বই নিয়ে পাতাগুলো ওল্টাতে থাকি আমি। অনেক্ষণ সময় পার হয়ে যায়। কেউ আসে না রুমে। একসময় মা এসে বললেন, ‘যা ভাত খেয়ে নে।’
আমি নিঃশব্দে ডাইনিং টেবিলে এসে বসি। অল্পকিছু ভাত খেয়ে নিলাম। ভাবনা জুড়ে শুধুই সে। আমি আজ থেকে চেষ্টা করবো তাকে আমার ভাবনা থেকে বের করে আনার। পেট ভরে ভাত খেয়ে বিছানায় এসে কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে পড়ি।
সময় গড়ায়।
ভার্সিটিতে যাই, মন দিয়ে ক্লাস করি। ক্লাস শেষে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেই, ফুচকা খাই। তারপর রিকশা করে বাসায় ফিরে আসি। বিকেলটা কাটে ঘুমে, সন্ধ্যাটা পড়ার টেবিলে। রাত্রিবেলা পছন্দের কোনো বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি। চেষ্টা করছি আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার। সেই পুরনো আমি’টাকে নতুন করে ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় একেকটা মুহুর্ত পার করছি আমি।
মাঝেমাঝে মা এসে পাশে বসেন। ইনিয়ে বিনিয়ে সেই বিয়ের প্রসঙ্গে চলে যান। তাঁর বান্ধবীর ছেলেটা কেন ভালো, একবার আমি কথা বলা উচিত – এসব বলেন। আমি প্রত্যেকবারই এড়িয়ে চলি। তারপর আমার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বাবরিচুল আমার জীবনের একটা অংশ মাত্র, কিন্তু পুরো জীবন না। সে আমাকে রিজেক্ট করেছে বলে আমার জীবন থেমে যেতে পারে না। কিছুটা কষ্ট পাওয়া উচিত। তাই বলে জীবনের সবকিছু বন্ধ করে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো বোকা মেয়ে আমি নই।
একদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে ডিংডিং করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, হঠাৎ খেয়াল হলো ড্রয়িংরুমে কেউ বসে আছে। আমি ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করলাম, বাবরিচুল। হয়তো কোনো কাজে এসেছে। পাত্তা দিলাম না। সোজা নিজের রুমে চলে আসলাম।
বেশ কয়েকবার জানালা দিয়ে বাইরে উঁকিঝুঁকি মারছিলাম আমি, তবে নিজের কাজ ফেলে রাখলাম না। গোসল সারলাম, হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে সুন্দর একটা হেয়ারস্টাইল করলাম। বড্ড খিদে পেয়েছে।
ভাত খেতে নিচতলায় নেমে দেখলাম আব্বু আর বাবরি চুলওয়ালা টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছে। আমাকে দেখে বাবা বললেন, কখন আসলি?
‘আধা ঘন্টা হয়ে গেছে।’
আমি কোনোকিছু ভ্রুক্ষেপ না করে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। বাবরিচুল মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি অবস্থা আপনার? ভালো আছেন?’
সে খাবার মুখে নেয়া অবস্থায় মাথা উঁচু করে তাকালো। আমি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো আছেন? অনেকদিন পর দেখা।’
‘হুম। ভালো আছি।’
আমি উচ্চস্বরে ডাকলাম, ‘ও মা। একটা প্লেট দাও।’
‘তুই প্লেট নিয়ে যেতে পারিস না?’
‘দাও না গো। বেশী ক্ষুধা লেগে গেছে আজকে। প্লেট আনতে গেলে পরিশ্রম হবে, আরো ক্ষুধা লাগবে।’
‘পাগলের কথা.. এত বড় মেয়ে, নিজে নিজে কিচ্ছু করবে না।’
মা বিড়বিড় করতে করতে একটা প্লেট দিয়ে গেলেন। আমি ভাত বেড়ে নিলাম। এক পিস লেবু, এক পিস মাছ আর সামান্য সবজি নিয়ে বাবাকে বললাম, ‘আমি উঠে গেলে বিষয়টা কি খারাপ দেখাবে?’
আব্বু বললেন, ‘এখানেই বসে খা। উঠবি কেন?’
‘রুমে যাই। কার্টুন দেখতে দেখতে ভাত খাবো।’
‘হা হা। ঠিক আছে যা।’
‘মূর্তির সামনে বসে খাওয়ার চাইতে কার্টুন দেখতে দেখতে ভাত খাওয়া ভালো।’
কথাটা বলতে বলতে ভাতের প্লেট নিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠে এলাম। তাদের দিকে না তাকিয়েও আমি বেশ বুঝতে পারলাম, বাবরিচুল হতভম্ব হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা কল্পনা করেই আমার হাসি চলে এলো।
রুমে এসে কার্টুন ছেড়ে ভাত খেতে বসলাম। আমি জানি, এইমুহুর্তে কার্টুন না ছাড়লে আমার তার কথা মনে পড়বে। আমি তাকে নিয়ে ভাবতে চাই না। আমার মস্তিষ্ককে অসম্ভব ব্যস্ত রাখতে হবে।
ভাত খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। প্রতিদিন বিকেলবেলা আয়েশী ঘুম দেয়াটা আমার সবচেয়ে প্রিয় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সবেমাত্র শুয়ে পড়েছি, এমন সময় বাবা বললেন, ‘মীরা মা, আসবো?’
‘আসো।’
‘আমি মিটিংয়ে যাচ্ছি। তোর মাকে নিয়ে সন্ধ্যায় হাসপাতালে যাবি। ডাক্তারের সিরিয়াল দেয়া আছে। কিছু লাগলে আমাকে কল দিস।’
‘ওকে। নো চিন্তা, ডু মিটিং। বেস্ট অব লাক।’
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুই সবসময় এমনই থাকিস মা। তোকে মনমরা দেখতে ভালো লাগে না।’
‘আই উইশ, তুমি আর কোনো বাবরি চুলওয়ালাকে ধরে এনে বাসায় জায়গা দিবা না।’
‘হা হা হা। না, আর কাউকে জায়গা দিবো না। মুনযিরকে আমিই আসতে বলেছিলাম। ওকে আসতে না বললে আর আসবে না।’
‘তোমার মুনযিরকে নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই। যা ভাল্লাগে করো। এখন একটু ঘুমাতে চাই।’
বাবা দরজা টেনে দিয়ে চলে গেলেন। জানি, আমি মুভ অন করাতে সবাই খুশি। কিন্তু এইটুকু করতে আমার কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি! সবাই কি ভেবেছিলো আমি দিনের পর দিন বিছানায় পড়ে কাঁদতে কাঁদতে পাগল হয়ে যাবো? মীরা ওরকম মেয়েই নয়। মীরা কষ্ট পায়, আবার উঠে দাঁড়ায়। কারো জন্য মীরার জীবন থেমে থাকবে না। কোনো হালকা ঝড় মীরাকে ভেঙে দিতে পারবে না।
মাকে নিয়ে হাসপাতালে কাজ শেষ করতে করতে রাত হয়ে গেলো। বাবা ফোন করে জানালেন, উনি জরুরি কাজে এলাকার বাইরে আছেন।
হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় দেখি বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে কোনো ছাতা নেই। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। কোনো সিএনজি বা রিকশাও দেখছি না। এদিকে বাড়ি থেকে কাউকে আসতে বলাও সম্ভব না কারণ রোহান আর দাদুভাই গ্রামের বাড়িতে। কী যে করি!
ফোন বের করলাম বাবাকে কল দেয়ার জন্য। হঠাৎ দেখি একটা রিকশা এসে সামনে দাঁড়ালো। কোল থেকে নীল প্লাস্টিক সরিয়ে রিকশা থেকে নামলো বাবরিচুল!
নেমেই একটা ছাতা আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘এটাতে বাসায় চলে যান।’
‘আপনি যাবেন কিভাবে?’
‘আমি যেতে পারবো। কোনো সমস্যা নেই।’
‘রিকশা পাবেন না তো।’
‘পাবো পাবো। না পেলে ভিজে যাবো। আপনারা যান।’
আমি রিকশায় উঠে হাত বাড়িয়ে তাকে ছাতাটা দিলাম। সে শুরুতে নিতেই চাইছিলো না। এরপর হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নিলো।
বাসায় ফিরে বারবার বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম, বৃষ্টি কমেছে কী না! কে জানে সে ঠিকঠাক অফিসে যেতে পারলো নাকি এখনো হাসপাতালেই বসে আছে..
এই ঝড়বৃষ্টির রাতে বাবাকে বাসায় আসতে নিষেধ করে দিলাম। যেখানে গিয়েছে ওখানেই এক আত্মীয় বাসায় থাকবে আজকের রাতটা। আমি বিছানায় এসে শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম আসছে না। বারবার মনে হতে লাগলো, সে কি বের হতে পেরেছে?
অনেক চিন্তাভাবনা করে একটা টেক্সট পাঠিয়ে দিলাম, ‘মা আপনার জন্য খুব চিন্তা করছে। আপনি কি বের হতে পেরেছেন?– মীরা।’
মেসেজটা পাঠানোর মিনিট দুয়েক পর রিপ্লাই এলো, ‘জি। আমি বাসায় এসেছি। আপনার আর চিন্তা করতে হবে না।’
আমি ভ্রু কুঁচকে রিপ্লাই দিলাম, ‘আমি চিন্তা করছি আপনাকে কে বললো? বললাম তো আমার মা আপনার জন্য চিন্তা করছে।’
‘আপনার মা আমার জন্য তরকারি গরম করতে গেছে। সো, ডোন্ট ওরি।’
মানে! আমি দ্রুত দরজা খুলে সিঁড়ির কাছে এসে দেখলাম নিচতলায় লাইট জ্বলছে। মা রান্নাঘরে, আর ড্রয়িংরুমে বসে আছে বাবরিচুল। শিট!
কিন্তু এই অসময়ে উনি এখানে কেন? এখানে আসবে সেটা কি আমি জানতাম নাকি? আশ্চর্য.. সে কী ভাবছে আমাকে নিয়ে? ধ্যাৎ..
চলবে..
ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল সন্ধ্যায় পোস্ট করা হবে। আমি ব্যক্তিগত জীবনে খুবই ব্যস্ত মানুষ। আমার প্রফেশনাল লাইফ আছে, সংসার জীবন আছে। টডলার বেবি আছে। সবকিছু সামলানোর পরেও দিনে ২/৩ তিন ঘন্টা সময় দিয়ে একেকটা পর্ব লিখি। অহেতুক গল্প কই গল্প কই করে ইনবক্সে মেসেজ দেয়া থেকে বিরত থাকুন। যেদিন দিবো না, সেদিন আগেই জানিয়ে দিবো। ইনবক্সে অপ্রয়োজনীয় মেসেজ দিবেন না প্লিজ। লেখক’কে উৎসাহিত করতে ট্রিট দিন। ধন্যবাদ।
Share On:
TAGS: বাবরি চুল ওয়ালা, মিশু মনি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৩
-
বাবরি চুলওয়ালা পর্ব ১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৪
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৬
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৩
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১১
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৯
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১২
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ১৫
-
বাবরি চুল ওয়ালা পর্ব ৪