প্রেমতৃষা
ইশরাতজাহানজেরিন
সমাপ্ত_পর্ব (১ম অংশ)
লোকটি দেশলাই জ্বালিয়ে তৃষার সামনে ধরতেই এবার তার গাঢ় বাদামী রঙের ফক্স আইগুলো তৃষার চোখে ধরা দেয়। তৃষা মুহূর্তেই আওরায়, “প্রেম আপনি?”
“কেন? অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি সোনা?”
“ভূতের মতো ভয় দেখিয়েছেন কেন?”
“কারণ আমি তোমাকে ভয় দেখাতে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসা খুব শক্ত আর হিংস্র বুঝলে তো। প্রেম তার নীতিতে প্রেম দিতে ভালোবাসে। সবার থেকে আলাদা সে। আলাদা ভাবেই রোমান্স করতে সে পারদর্শী।”
তৃষা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। কি ভয়টাই না পেয়েছিল। এমা প্যান্ট ভিজে যায়নি তো? আরেকটু হলে অবশ্যই যেত। শালার জীবন। প্রেমও উঠে দাঁড়ায়। তৃষার গালে আলতো করে হাত দিতেই শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠে তার বুক, তার সর্বাঙ্গ।
“কি করছেন?”
“করলাম কোথায়? তবে করব।”
“ইশ এখন মুড নেই। আচ্ছা এত বড়লোক হয়ে লাভ কি? যদি বাসায় কারেন্ট না থাকে? আপনার বাসায় জেনারেটর বা আইপিএস নেই?”
“আমার বাসায় আমি আছি তাতে পোষাবে না? আবার জেনারেটর আর আইপিএসকে দিয়ে কি করবে? চরিত্র ঢিলা হয়ে গেল নাকি?”
“আরে যন্ত্রের কথা বলেছি। আইপিএস আর জেনারেটর মেশিন।”
“মেশিনের সুইচ বন্ধ করে দিয়েছি।”
“প্রেম।”
প্রেম সুগন্ধি মোমবাতিটা জ্বালালো। পরপর কয়েকটা। তাতেই রুমে একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। প্রেম তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে আমি তোমার দিকে তাকাবো, আর তুমি আয়নার দিকে।”
“মানে?”
প্রেম কথা না বাড়িয়ে মোমের আলতো আলোতে রুমের সুদীর্ঘ আয়নার ওপর থেকে পর্দাটা সড়িয়ে দিয়ে তৃষাকে তার সামনে দাঁড়া করালো। তৃষা তখনো বুঝতে পারছে না এই উন্মাদ প্রেম নেওয়াজ কি চাইছে। হঠাৎ আলতো করে প্রেম তৃষার চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ের কাছের সেই বাটারফ্লাইটা ছুঁয়ে দেখল। তারপর তাতে আলতো চুমু বসিয়ে দিলো। মুহূর্তেই তা মৃদু কাঁপনে বদলে গেল। তৃষার ছটফটানি, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস প্রেমের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলল। সে তৃষাকে আরো গভীর স্পর্শে ডুবিয়ে দিলো। তৃষা তার স্পর্শে যত বেশি মরিয়া হচ্ছে প্রেমের ঠোঁটের কোণের হাসি যেন ততই বেড়ে চলেছে। তৃষার শিহরণে চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে আসতেই প্রেম আলতো করে তার গাল চেপে ধরে তাকে আয়নার দিকে তাকাতে বাধ্য করল। তারপর হাস্কি কন্ঠে ফিসফিস করে বলল, “আয়নার থেকে চোখ সরাবে না। আজকে আমি তোমাকে দেখব, আর তুমি আয়নায় নিজেকে দেখবে সোনা।”
–
ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, প্রেম তৃষা। প্রেম নেওয়াজ তৃষাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
“তো বিটারহার্ট!” প্রেমের গলায় আদরের গাম্ভীর্য, “ভালোবাসা কেমন লাগল?”
তৃষা লজ্জায় গম্ভীর মুখে বলল, “ইশরে, আপনি আবার জিজ্ঞেস করছেন? বেহায়া লোক একটা!”
প্রেম হেসে ফিসফিস করল, “বউয়ের জন্য বেহায়া হাওয়া দোষের না, গুনের। বুঝলে তো?”
“না, বুঝিনি।” তৃষার ঠোঁটে ক্ষীণ অভিমান।
“আসো তাহলে আবার বুঝাই,” প্রেম আরেকটু কাছে টানল।
“একটা দিবো ধরে!” তৃষা ধমকে উঠল।
“তুমি দিলে আমার নিতে বাঁধা কিসে?”
“প্রেম!”
“আচ্ছা আচ্ছা, সরি সোনা।” প্রেমের স্বর বদলে গেল।
তৃষা একটু চুপ থেকে বলল, “প্রেম… আপনাকে একটা কথা জানানোর ছিল।”
“সেটা একটু পরে শুনি?” বলেই প্রেম তৃষাকে নিয়ে উঠে দাড়াল। তারপর বলল, “আগে একটু চোখ বন্ধ করো। একটা জিনিস দেখানোর আছে।”
“আবার কী?” তৃষা বিরক্ত হলেও চোখ বন্ধ করল।
“আরে, একটু দেখোই না…”
তৃষা চোখ বন্ধ করতেই প্রেম তার হাতের তালুর ওপর কিছু একটা রাখল।
“এবার চোখ খুলো,” সে ফিসফিস করে বলল। চোখ মেলতেই তৃষার নিঃশ্বাস থমকে গেল। তার হাতের তালুতে ঝকঝকে দুটো ভিআইপি কনসার্ট টিকিট, সেই প্রিমরোজ ব্যান্ডের, যেটা দেখার জন্য সেই কবে থেকে সে তার বুকের ভিতর বইতে থাকা কঠিন ঝড় সামলাচ্ছিল।
তৃষার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। “এমা… এটা… এটা তো সেই কনসার্টের টিকিট!”
প্রেম মাথা নিচু করে হাসল। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেবল বলল, “বিটারহার্টের স্বপ্ন পূরণ করাটা আমার নিজের চেয়েও বেশি জরুরি আন্ডারস্ট্যান্ড সোনা?”
কনসার্টের রাত। আকাশে ঝকঝকে তারা, বাতাসে কেমন একটা আর্দ্রতা। শহরের আলো দূরে ঝলমল করছে, কিন্তু এখানকার মঞ্চ আলোর ঝলকে যেন এক আলাদা জগৎ তৈরি করেছে। তৃষা ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে সবটুকু খেয়াল করতে লাগল। মঞ্চ সাজানো হয়েছে ঝকঝকে রঙিন লাইটে, লাল-নীল সব আলো একসাথে নাচছে, বিটের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। ব্যান্ডের যন্ত্রপাতি ঝকঝক করছে, গিটার, ড্রাম, কীবোর্ড সবকিছু যেন পেশাদার নিখুঁত। মঞ্চের পাশে কয়েকটা বিশাল স্ক্রিনে ব্যান্ডের লোগো জ্বলজ্বল করছে। ধীরে ধীরে ভিড় জমছে। সবাই উত্তেজনায় মুখে হাসি, চোখে উদ্দীপনা।
তৃষা ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখল—কেউ লাইটের দিকে তাকিয়ে, কেউ ফোনে মুহূর্তগুলো ধরে রাখছে, কেউ গান গাইছে। কনসার্ট এখনো শুরু হয়নি। তৃষা শিমলার দিকে তাকালো। অংকুরের হাত ধরে আছে সে। দু’জনের কি মাখোমাখো প্রেম। তৃষা একটা নিশ্বাস ছাড়ল। তার পাশে যে প্রেম নেই। তৃষার আজকে দুপুরের কথা মনে পড়ে গেল। দু’দিন ধরে করা পরিকল্পনা সব নষ্ট হলো। আজকে দুপুরে তৃষা জরুরি কিছু জিনিসপত্র যখন প্যাক করছিল তখন প্রেম তার সঙ্গেই ছিল। হঠাৎ তার একটা কল এলো। কথা বলে কল রাখতেই প্রেম বলল,
“বিটারহার্ট… একটা জরুরি রেসের শিডিউল পড়ে গেছে। স্পনসাররা আজই সময় দিয়েছে। মিস করা মানে পুরো টিমের ক্ষতি… আমি..”
তৃষা কথা শেষ হতে দিল না। “মানে আপনি আজ কনসার্টে যেতে পারবেন না?”
ওপাশে ভয়ানক নীরবতা। তারপর প্রেম খুব আস্তে করে বলল,“চেষ্টা করব তাড়াতাড়ি শেষ করে আসতে। প্লিজ রাগ করো না, সোনা।”
তৃষা ঠোঁট কামড়ায়। চোখ হঠাৎই ঝাপসা হয়ে আসে। যে স্বপ্নটা বুকে লালন করছিল… আজ সেই দিনে প্রেম থাকবে না? কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে। “হুম। ঠিক আছে। কাজটা আগে করা দরকার” — অন্তত একজন বাইক রাইডার হিসেবে তো এসব তৃষাকে বলতেই হতো।
তৃষা একবার টিকিটের দিকে তাকালো। টেবিলের ওপর রাখা ভিআইপি টিকিট দুটো যেন উপহাস করছে—একটি যাত্রী অনুপস্থিত।
গাড়িতে তুলে দেয় তৃষাকে প্রেম। প্রেম নিজে যেতে পারছে না বলে অংকুরকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর শিমলা তো আছেই। দেখা যাক পুরান ঢাকার কাজ শেষ করে ঢাকায় পৌঁছানো যায় কিনা! তৃষার কিছুই ভালো লাগছে না। এখানে এত মানুষের ভিড়! সুবিশাল একটা স্টেডিয়াম। তবে যাকে সে খুঁজছে সে তো নেই।
তৃষার আজ কিছুতেই মন বসছে না। এত মানুষের ভিড়ে তার শ্বাসরুদ্ধ লাগছে। সুবিশাল এই স্টেডিয়াম। চারদিকে আলো, ধাতব শব্দ, তীব্র উত্তেজনা। অথচ যার সন্ধান সে করছে, যে মুখটিকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সে তো নেই। প্রেমের অনুপস্থিতি তার চারপাশের উজ্জ্বলতা ধুয়ে মুছে যেন নিস্তেজ করে ফেলছে। কিন্তু ঠিক তখনই চারদিকের হট্টগোল আচমকা চূড়ান্তে পৌঁছে গেল। মানুষের ঢেউয়ের মতো গর্জন ছড়িয়ে পড়ল স্টেডিয়ামজুড়ে। শিমলা তৃষার বাহু ধরে টেনে ফিসফিস করে বলল, “আরে, পেছনে দেখ তৃষা… আঁধার আসছে!”
তৃষা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই মুহূর্তটা থমকে গেল। দর্শকসারির মাঝখান দিয়ে সোজা স্টেজ পর্যন্ত একটি সরু আলোর পথ তৈরি হয়েছে। সেই পথ ধরে এগিয়ে আসছে কালো হুডি পরা দীর্ঘদেহী এক পুরুষ। তাকে ঘিরে আছে পনেরো–বিশজন নিরাপত্তাকর্মী। হুডির নিচে তার মুখ পুরোপুরি ঢাকা। কেবল মাস্কের ওপরে থাকা চোখদুটো স্পটলাইটের আঘাতে ঝলসে উঠছে। দুইপাশে দাঁড়ানো মানুষজনগুলো তাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ কেউ সিকিউরিটির বাহু এড়িয়ে সামান্য সামনে ঝুঁকে পড়ছে। ভিড়ের উত্তেজনা এতটাই তীব্র যে মনে হয়, মুহূর্তের ব্যবধানে দাঙ্গার মতো বিশৃঙ্খলা শুরু হতে পারে।
তৃষার ভিআইপি সিটটি ঠিক সেই পথের একেবারে সামনে। তাই আঁধারকে এত কাছ থেকে দেখার ভাগ্য তারও হলো। স্পটলাইটের কঠিন আলোয় কালো হুডির ছায়া আরও গভীর হয়ে ওঠে, আর সে যখন কাছে আসে, তৃষার চারপাশের সমস্ত শব্দ এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তবে এত নিরাপত্তাকর্মীর ভিড় ঠেলে তার দেখা পাওয়া আসলেই অনেক মুশকিল।
স্টেজের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। চারপাশে গাঢ় নীল অন্ধকারের ঢেউ নেমেছে। কেবল মাঝখানের স্পটলাইটটি ধীরে জ্বলে উঠছে। একটি সূক্ষ্ম, রুপালি আলোর সরু স্তম্ভ, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে কালো হুডি পরা আঁধার। তৃষার নিশ্বাস আটকে যায়। পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে অতল নিস্তব্ধতা। হাজার মানুষের ভিড় থাকা সত্ত্বেও কারও গলা থেকে শব্দ পর্যন্ত বেরোচ্ছে না। যেন সবাই একসাথে শ্বাস রোধ করে বসে আছে এই মুহূর্তটির অপেক্ষায়। হঠাৎই স্টেজের পেছন থেকে মৃদু সাউন্ডের কম্পন উঠল। ড্রামের ধুকধুক শব্দ বাজল। আঁধারের গায়ের সঙ্গে একটা গিটার। সেই ইলেকট্রিক গিটারের ধোঁয়াটে সুর বেজে উঠল। আঁধার স্পটলাইটের নিচে তার ইলেকট্রনিক গিটার বাজিয়ে গান ধরল,
~ প্রেমেরই আবেশে আমার বারেবার
বুক ভাসে….
তোমারই উষ্ণ প্রেমতৃষায়
আমি হারিয়ে ফেলি শুধুই আমায় ~
গানটা শেষ হলো নিভে যাওয়া মোমের শিখার মতো। মুহূর্তেই সেই নীরবতা ভেঙে ছুঁড়ে ফেলল পুরো স্টেডিয়াম। একসাথে হাজার কণ্ঠ ফেটে পড়ল, “মুখটা দেখাও! আঁধার! মুখটা দেখাও!!” “ফেস রিভিল! ফেস রিভিল!” “একবার হুডি খুলে দেখাও!” “মাস্ক ওপেন!!”
চিৎকার, করতালিতে মুখরিত চারদিক। মিডিয়ার ক্যামেরার আলোর ঝলকানিতে পুরো স্টেজ ঝলসে উঠল। তৃষার ভেতরটাও দুলে গেল। আঁধার এতক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের মূর্তির মতো ছিল। চিৎকারে তার হুডির ছায়া মৃদু দুলে উঠল। মাস্কের নিচে তার ঠোঁটের রেখা দেখা যায় না, কিন্তু তবুও মনে হলো যেন সে মৃদু হাসল—নাকি তৃষাই ভুল দেখল? তবে যদিও আলোর কারণে ভালো করে চোখটাও দেখতে পাচ্ছে না। তবুও চেনা লাগছে, খুব চেনা। স্টেডিয়ামের আলো আবার কিছুটা ম্লান হল। আঁধার মাইকের সামনে এগিয়ে এসে গলা পরিষ্কার করল। নিঃশব্দতা নেমে আসার আগেই তৃষার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এবার কি সে মুখ দেখাবে? নাকি আবার অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে? আঁধার মাস্ক মুখের ওপর থেকে সরানোর আগে হুডি নামিয়ে দিলো। তার কানের ইয়ারপিসটা এখন স্পষ্ট। তবে তৃষার বুকের আতঙ্ক যেন আরো বেড়ে গেল। কী আন্দাজ করছে সে? হঠাৎ শীতল সেই কণ্ঠস্বর ভেসে এলো মাস্কের নিচ থেকে, “এই গানটা আমার নিজের লেখা, নিজের সুর করা। গানটি আমার ভালোবাসার চিহ্ন। তাই যাকে ঘিরে এই গান তাকে গানটি উৎসর্গ করলাম। এতদিন আপনারা অন্ধকারের গায়ক আঁধারকে চিনেছেন, আজকে আঁধারকে অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে আনা আলোর সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব।” বলেই সে তৃষার দিকে তাকায় এবং মুখ থেকে মাস্ক খুলে বলল—
“মাই বিটারহার্ট, মাই প্রিমরোজ… কাম হিয়ার।”
তৃষা এখনো বুঝতে পারছে না— সে কি জেগে স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তব?
এখনো কি ঘুমের মধ্যে আছে?
তার শরীর অবিশ্বাসে কাঁপছে।
কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে।
যা বলে বোঝানোর মতো নয়।
তৃষার ভেতর ঢেউয়ের মতো কাঁপুনি উঠল। চারপাশের মানুষ যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকাল। কেউ আশ্চর্যে, কেউ উত্তেজনায়, কেউ অবিশ্বাসে। পরমুহূর্তে জনতার ভিড় চেয়ারে ঠুকঠুক আওয়াজ তুলে, হাত উঠিয়ে, গলা ভেঙে চিৎকার করে তাকে স্টেজে যেতে বলতে লাগল। পাশ থেকে শিমলা ঠেলে দিয়ে বলল, “আরে যাহ জলদি। দুলাভাইয়ের সারপ্রাইজ দেওয়ার লেভেল তুঙ্গে।” তৃষার হাঁটু কাঁপতে কাঁপতে সে এগিয়ে যায় মঞ্চের দিকে। লাইটগুলো সরে গিয়ে পথ তৈরি করে দেয় তার জন্য। যেন পুরো কনসার্ট তার এক পা সামনে বাড়ানোর অপেক্ষায়। মঞ্চে পা রাখা মাত্র প্রেম নেওয়াজ তৃষার হাত নিজের মাইকের সামনে তুলে ধরে নরম গভীর কণ্ঠে বলল,
“এই হল আমার আলোর উৎস, আমার স্ত্রী তৃষা নুজায়াত। যাকে এক অসীম ভালোবাসায় ভালোবাসি আমি।”
তৃষার চোখে জল জমে, গলার কাছে ঢেউয়ের মতো কিছু আটকে যায়। সে এখনো ভাবতে পারছে না… এটা কি সত্যি ঘটছে? নাকি সে এখনো কোনো অপার স্বপ্নে ডুবে আছে? কিন্তু প্রেমের হাতের উষ্ণতা, তার চোখের গভীরতা, আর সেই ঘোষণা, যে তাকে পুরো বিশ্বের সামনে “স্ত্রী” বলে পরিচয় করিয়ে দিল। সবই বলে দিচ্ছে… এটা আর স্বপ্ন নয়।
এটা তার জীবনের সবচেয়ে বাস্তব মুহূর্ত।
প্রেম তৃষার চোখের জল আলতো করে মুছে দিয়ে বলল,
“এই দিনটার জন্যই আমার এত অপেক্ষা ছিল। দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো তৃষা। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বলো তো? তৃষা! তোমাকে ভালোবাসি। এই যে আজ সকলকে সাক্ষী রেখে বলছি—তোমায় আমি আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি। তুমি এভাবেই এই আঁধারের জীবনে আজন্ম, জন্মদাগের মতোই থেকে যাবে তো?”
তৃষা আর নিজেকে থামাতে পারল না। হাজারো মানুষের সামনে হুড়মুড় করে আঁধারের বুকে ঢুকে গেল। চারদিকে দর্শকের চিৎকার, করতালি, আলো–ঝলমলে উন্মাদনা… পুরো পরিবেশ মুহূর্তেই আরও মুখরিত হয়ে উঠল। প্রেমও অবাক না হয়ে পারে না, তবে সেই অবাকের মাঝেই সে তৃষাকে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। তৃষার চোয়ালে আলতো হাত রেখে গভীরভাবে চোখে চোখ মিলায়। সেই দৃষ্টির পরেই এক ঝটকায় হাজারো মানুষের সামনে তৃষার ঠোঁটে চুমু এঁকে দিল প্রেম। দু’জনের ঠোঁট এক হয়ে যায়, স্টেডিয়াম যেন নিঃশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু ঠিক সেই সময়
তৃষার শরীর ঢলে পড়ে।
“এ কী!” প্রেম ধরে ফেলে তাকে। স্টেজের সামনে মানুষ হাহাকার! প্রেমের চোখে বিস্ময়। ওমা, চুমুর পাওয়ারে তার বউটা সত্যিই অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি? হাঁ করে গেল প্রেম। আয় হায়, সর্বনাশা কাণ্ড! এখন কি সবাই বলবে স্বামীর চুমু সহ্য করতে না পেরে বউ স্টেজেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল? প্রেমের মনে মনে আফসোস।
হায়রে প্রেম, কাল সকালের ব্রেকিং নিউজের জন্য তৈরি হয়ে যা বাপু!
চলবে?
(এই পর্বের আরেকটু অংশ আছে। পরশু দিতে পারি। তারপর একেবারে সমাপ্ত। আর কালকে সন্ধ্যা ৭টায় চিত্রাঙ্গনা আসবে। আমি তাড়াহুড়োয় লিখছি তো বানানে ভুল থাকতে পারে। কিছু মনে করবেন না।)
( এখানে প্রেম যেই গানটি গেয়েছে সেটা Ai দিয়ে বানানো। তবে আমার লেখা। তাই কোথাও খুঁজলে পাবেন না। তবে গানটি শুনতে চাইলে আমার পোস্ট করা স্পয়লার ভিডিওটি দেখে আসতে পারেন। লিংক কমেন্ট বক্সে দেওয়া হলো।)
প্রেমতৃষা
ইশরাতজাহানজেরিন
সমাপ্ত_পর্ব ( শেষ অংশ)
হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর তৃষা পিটপিট করে তাকাতেই প্রথমে যাকে দেখল তার নাম প্রেম নেওয়াজ। তৃষা চারপাশে একবার ভালো করে তাকালো। নাকে ফিনাইলের একটা গন্ধ আসছে। প্রেম তার সামনেই বসা। সে তৃষার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল,”এবার ঠিক লাগছে তো? বলো সোনা, শরীর ঠিক আছে তো? ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করো না। যা খাও ওই জাঙ্গ ফুড। আজ থেকে তোমার ওইসব খাওয়াও বন্ধ একেবারে।”
“আমার কি হয়েছে? এখানে কেন আমরা? “
প্রেমের রাগ উঠল। আবার এই মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে! সে রেগে গিয়ে বলল,” তুমি মা হয়েছো আর আমি বাবা হয়েছি। এখন তোমার ডেলিভারি করে আমি আমার আবিষ্কৃত প্রোডাক্টটা বের করতে এসেছি।”
হঠাৎ রুমের ভেতর ডাক্তার প্রবেশ করে বলল” আরে আমি তো এখনো খবরই দেয়নি। এক্ষুণি বাচ্চার খবর কি করে জেনে গেলেন? যাই হোক সবে তো ১মাসের কাছাকাছি। ডেলিভারি হতে অনেক সময়। এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই।”
প্রেম, তৃষা দু’জনেই ডাক্তারের দিকে তাকালো। প্রেম কপাল কুঁচকে তাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা।”
“বুঝতে পারছেন না মানে? আরে আপনি বাবা হতে চলেছেন। আচ্ছা আপনি সেই আঁধার না? আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান। একটা অটোগ্রাফ দেওয়া যাবে?”
প্রেম চমকে উঠে। কি প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত আপাতত বুঝতে পারছে না। খুশিতে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে উঠে ডাক্তারের কাছে যায়। আবার জিজ্ঞেস করে, “কি বললেন আপনি? আবার বলেন।”
“আমি আপনার ফ্যান। অটোগ্রাফ দেওয়া যাবে।”
“এর আগে?”
“আপনি বাবা হতে চলেছেন।” প্রেম খুশিতে আত্মহারা হয়ে ডাক্তারের গালে চুমু খেয়ে বসে। যখন হুঁশে আসে তখন দেখতে পায় ডাক্তার তার দিকে অবাক করা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। প্রেম কি বলবে তার আগেই, ডাক্তার তাকে বলল, ” আমিও যখন প্রথমবার আমার বউয়ের প্রেগনেন্ট হওয়ার খবর জানতে পারি তখন আমিও এরকম আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম।”
“তারপর কি ডাক্তারকে চুমু খেয়েছিলেন?”
“না ডাক্তার তো আমিই ছিলাম।”
“তো কাকে খেয়েছিলেন?”
“নার্সকে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কি? আমার বউ আমাকে দিয়েছে?”
“কি দিয়েছে?”
“কিক মেরে ছেড়ে দিয়েছে। তাই কষ্টে নার্সকেই বিয়ে করে ফেলেছি।”
প্রেম জলদি তৃষার কাছে এসে বসে, বলে, “বউ আমায় ছেড়ো না। আমি ঠোঁটটা গঙ্গাজল দিয়ে পরিষ্কার করে আসব।”
তৃষার হাসি পেল। এই লোকও না। তবে সে তো ভুলেই গেছে। আসলেই কি সে মা হতে চলেছে? খুশিতে তৃষা প্রেমকে জড়িয়ে ধরতেই প্রেম ডাক্তারকে ইশারা করে, “ভাই টু মাচ পার্সোনাল কাজ করব। একটু যদি বাইরে যেতেন।”
ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে বের হয়। মনে মনে হয়তো একটাই প্রশ্ন, “টু মাচ পার্সোনাল কাজকারবার করে তো প্রডাক্ট অর্ডার তো দিয়েছেই। এখন আবার কি করবে?” তবে মনে মনে এসব বললেও মুখে বলল, “আমার অটোগ্রাফটা!”
প্রেম তীক্ষ্ণ চাহনিতে তার দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল, “আচ্ছা বাবা যাই, চোখ গরম করেন কেন?”
“প্রেমের কোনো কিছু গরম করার দরকার নেই। সে নিজেই গরম।”
পাশ থেকে তৃষা হেসে বলল, “তাই তো বলি আপনার নেই কেনো সরম।”
তখন ভোর হবে হবে। পুরান ঢাকা থেকে সিদ্দিক নেওয়াজ ছুটে এসেছিলেন রাতে খবর পেয়ে। সিদ্দিক নেওয়াজ পুরো হাসপাতালে মিষ্টি বিতরণ করেছেন।
সবাই কত খুশি। প্রেমা, মোখলেস, শিমলা, অংকুর সবাই বাচ্চার খবর পেয়ে দারুণ খুশি। একে তো মাঝে হঠাৎ কনসার্ট শেষ করতে হয়েছিল বলে দর্শক চিন্তায় পড়ে গেছে। হাসপাতালে আসতেও প্যারা নিতে হয়েছে। মিডিয়া আর মিডিয়া চারদিকে। এখন কি আর প্রেম নেওয়াজ শান্তি পাবে? কি একটা অবস্থা। প্রেম যে বাবা হতে চলেছে সেই খবরটাও ট্রেন্ডে চলে গেছে। রাতটা আজকে ঢাকাতেই থাকবে। তৃষা মাঝ রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে এখনো ঘুমায়নি। প্রেমের বুকের ওপর শুয়ে আছে। প্রেমের হাতটা তার পেটের ওপর। সে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ পাশ ফিরে বলল, “ছেলে বাবু হবে নাকি মেয়ে বাবু?”
“আপনার কোনটা চাই ছেলে নাকি মেয়ে?”
” একটা হলেই হলো। আমি চাই তুমি আর আমি মিলে ছোট্ট এক ‘আমরা’ জন্ম দিই আর কিছুই না।”
“যে আমাদের প্রেমের প্রমাণ হবে?”
“না… যে আমাদের প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
প্রেম তৃষাকে জড়িয়ে ধরল। তৃষা চোখ দু’টো বন্ধ করল। এবার যতটা সময় স্বামীর বুকে আরাম করে ঘুমিয়ে নেওয়া যায় আর কি।
–
আজ এক সপ্তাহ হয়েছে পুরান ঢাকা থেকে প্রেম, তৃষা সকলে ফিরেছে। আসার পর কত নিয়ম-কানুন যে এই লোকটা তৈরি করল! ঝুঁকা যাবে না, দৌড়াদৌড়ি করা যাবে না। এটা খাওয়া যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না। এত নিয়ম কানুন কি মানা যায়? রাত তখন দশটা বাজে। আজকে তৃষা নেওয়াজ বাড়িতেই থাকবে। এই বাড়িতে প্রেমের দোতলায় এত বিরাট একটা রুম আছে সেটা এইতো দুইদিন আগে জানল। পুরোটা গানের সরঞ্জাম দিয়ে ভরপুর। এই কারণেই প্রেম কখনো জানতে দেয়নি এখানে যে তারও একটা রুম আছে। আর ওইযে কাঠের বাড়ির যেই রুমটায় প্রেম তৃষাকে যেতে দেয়নি কখনো সেটায়ও গানের জিনিসপত্র। প্রেম যখন প্রথম দিন জানতে পেরেছিল তৃষা প্রিমরোজ ব্যান্ডের ভক্ত। তখন থেকেই ঠিক করেছিল একদিন তাকে সারপ্রাইজ দিবে। যেই সারপ্রাইজের কথা সে কখনো ভুলতে পারবে না। তাছাড়া ওই শিমলাটাও কত শয়তান হয়েছে, অংকুর তাকে জানানোর পরও একটু বলল না। যাক ব্যাপার না। তবে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে আর বেশিদিন থাকা হবে না। প্রেমের আমেরিকা থেকে মিউজিক অফার এসেছে। আর সে পারিবারিক ব্যবসাটাও সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। আজকে তৃষার জরুরি কাগজ গুলো নিয়ে বাইরে গেছে প্রেম। নির্ঘাত পাসপোর্টের জন্য। তৃষা প্রেমার রুমে এক পা দুই পা করে গেল। মেয়েটাকে বেশি বেশি সময় দেওয়ার চেষ্টা করে সে। মেয়েটাও তাকে সময় দেয়। তৃষা প্রেমার রুমে যেতেই দেখল সে গান ছেড়ে নাচানাচি করছে। তৃষা আর লোভ সামলাতে পারল না। প্রেমার থেকে রিমুটটা নিয়ে সাউন্ড বাড়াতেই প্রেমা বলে উঠল, “ওমা কত সাউন্ড দিয়েছো। প্রেম ভাই শুনলে কেলাবে।”
“তার আসতে দেরি আছে। সে এখনো বাইরে। আর নাচানাচির জন্য গান একটু বাড়িয়েই দিতে হয়। চলো একসঙ্গে নাচি।”
“কিন্তু তোমার তো নাচানাচি এখন একেবারে বন্ধ। বাবুর বাবা জানতে পারলে বাবুর ফুফু সহ মার খাবে।”
“বাবুর বাবা জানলে তো? আর আমি আজকেই রিলস ভিডিওতে দেখেছি নাচানাচি করলে বাবু হেলদি হয়। এটা একটা এক্সারসাইজ বুঝলে তো ননদিনী? “
“ওহ তাই নাকি?”
“আরে হ্যাঁ।”
“তাহলে চলো তো নাচি।”
দু’জনেই আগামাথা ছাড়া নাচ দিতে ব্যস্ত। কোনো নৃত্য শিল্পী এই নাচ দেখলে মির্কি রোগ বলে আখ্যায়িত করত সিউর। কিন্তু তাতে কি আসে যায়? যেই তিরিংবিরিং মনে আনন্দ জোগায় মূলত সেটাই হচ্ছে নৃত্য। হঠাৎ গানটা বন্ধ হয়ে যেতেই প্রেমা আর তৃষা থেমে যায়। তৃষা বিরক্তি নিয়ে বলে, “উফ, এই ঘোড়ার ডিম চুপ হয়ে গেল কেন?” হঠাৎ প্রেমা তৃষার পেছনের দিকে তাকায়। কাঁপা গলায় বলে, “মা….নে পে…ছনে দেখো।”
তৃষা বিরক্ত নিয়ে বলল, “পেছনে কে? যেমনে কাপছো যেন হারে বজ্জাত হাইব্রিড করলাটা চলে এসেছে।” বলেই তৃষা পেছনে ফিরে দেখল দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে, এক হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে প্রেম নেওয়াজ। অন্য হাতে রিমোটটা যেটা তৃষা খাটের ওপর ছুড়ে ফেলে নাচানাচি করছিল। প্রেমের শীতল দৃষ্টি দেখে তৃষার কলিজা হাতে চলে আসে। কি করবে এখন? আল্লাহ আজকে তো মার, বকা একটাও মাটিতে পড়বে না। তৃষা মেকি হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, “আ….রে আপ..নি? কখ..ন এসেছেন?”
প্রেম কিছু বলল না। কেবল বাঁকা হাসল। তবে ওই হাসি সুবিধার না। আজকে নির্গাত এই ফুটো কপালে আরো দু’টো ফুটো করবে মিস্টার প্রেম নেওয়াজ।
তৃষা রুমের মধ্যে মাথা নিচু করে বসে আছে। আপাতত রুমের দরজা লাগানো। পালানোরও পথ নেই। এবার একেবারে জায়গা মতো প্রেম নেওয়াজের ফাঁদে পড়েছে সে। জীবনে এভাবেও কেউ বাঁশ খায়? যদিও এখন বাঁশ খেতে খেতে খাদ্যের তালিকায় তা অতি পছন্দের হয়ে গিয়েছে। প্রেমের গায়ে একটা সাদা শার্ট। তাকে দেখলে এই শীতের মধ্যেও উষ্ণতা অনুভব করে তৃষা। তাই তাকানো যাবে না। এমনিতেই ব্যাটা বাঁশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ প্রেম বলে উঠল, “লুক অ্যাট মি।” তৃষা তাকালো না। তা দেখে প্রেম তার থুতনিতে আঙুল দিয়ে মুখটা উপরে তুলে বলল, “তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না, ওসব করতে? বলো কেন অবাধ্য হয়েছো?”
“ইয়ে মানে।”
“চুপ! যেটা বলেছি সেটার উত্তর দেও।”
“আচ্ছা আর হবে না সরি। এই যে কানে ধরছি, নাক মুলছি।”
“এত সাধারণ ক্ষমা আমার দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। তুমি যতবার কথার অবাধ্য হবে আমি ততবারই তোমাকে নতুন নতুন ভাবে শাস্তি দিব। আর ইউ রেডি?”
তৃষা চুপ করে থাকে। প্রেম তাকে টেনে কাছে এনে তার ঘাড়ে চুমু খেল। তৃষার শরীর কেঁপে উঠল। খামচে ধরল সে প্রেমকে। স্পর্শ বৃদ্ধি সঙ্গে সঙ্গে বাড়ল তৃষার মরিয়া হয়ে ওঠার মাত্রাও। তবে হঠাৎ করেই প্রেম থেমে গেল। তৃষাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”
“প্লিজ প্রেম, আমাকে ভালোবাসুন। প্লিজ, আমি শাস্তি চাই।”
“কিন্তু তুমি তো এখন প্রে…”
“কিছু হবে না।”
প্রেম মুচকি হেসে তৃষাকে কোলে তুলে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বাতি বন্ধ করে হারিয়ে গেল দুজন- দু’জনের মধ্যেখানে।
সকাল সকাল আজকে শিমলা এসেছিল। তৃষা ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলে মাত্রই ফোনটা রাখল। প্রেমের আজকে গানের রেকর্ডিং আছে। সে স্টুডিওতে গেছে। অংকুরও গেছে তার সঙ্গে। ওদের ফিরতে আজকে দেরি হতে পারে তাই শিমলাকে অংকুর তৃষার কাছে রেখে গেছে। এমনিতেও শিমলা বাসায় একাই থাকে। তৃষার বোধ-হয় এই সেমিস্টার মিস হয়ে যাবে। কাল রাতেও প্রেম ওয়াশিংটন যাওয়ার কথা বলছিল। এখন সিয়াটলে শিফট হবে নাকি ফর্কস সেটা সেই ভালো জানে। আরেকটা ব্যান্ডের সঙ্গে যে কোলাবোরেশান করেছে, একটা চুক্তি পত্র হয়েছে। চুক্তি শেষ হলে বাংলাদেশ ফিরে আসবে। তবে এতগুলো দিনতো আর মিস্টার প্রেম নেওয়াজ বউ ছাড়া বিদেশে থাকতে পারে না। আর এখন তো বউয়ের সাথে বাচ্চাও আছে। এই সময় দরকার হলে ক্যারিয়ার ছাড়বে, তবুও বউকে গর্ভবতী অবস্থায় একা রেখে কখনোই সে দূরে যেতে পারবে না।
তৃষা ভেবেছিল প্রেমের বাড়ি ফিরতে হয়তো অনেক দেরি হবে। তবে সে বিকেলের আগেই বাড়ি ফিরে আসে। প্রেমের কাঠের বাড়িতে আন্ডার পার্কিং এর জায়গা আছে। যা পেছন দিকে অবস্থিত। প্রেমকে আরো অনেকবার সে এ পথে আসতে দেখেছে, তবে আসতেই পারে। মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু আসেনি। আজকে প্রেম তৃষাকে সেই পার্কি লডে নিয়ে আসে। এখানে এসে তৃষার চোখ ছানাবড়া। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব দামি বাইকগুলোকে কালেকশন করে আস্ত একটা গোডাউন বানানো হয়েছে এখানে। তৃষা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেই বাইকগুলোর দিকে। শেষে প্রেম তুরি বাজাতেই সে হাসতে বাধ্য হয়। প্রেম হাঁটু গেঁড়ে তৃষার সামনে বসল। পেটে একটা চুমু দিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক ভালোবাসি বিটারহার্ট, মাই প্রিমরোজ।”
তৃষা প্রেমের থুতনিতে আঙ্গুল স্পর্শ করিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, “চলুন আরো একবার বাইক রাইড হয়ে যাক?”
“মোটেও না।”
“একবার প্লিজ। যদি বাইক রাইড না করতে দেন তাহলে বুঝবো আপনি আমাকে কম ভালোবাসেন।”
“শালীর ঘরের বউ, এগুলোই তো খালি করতে পারো। যাও গিয়ে জামা বদলে এসো। তবে গুনে গুনে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করব। ততক্ষণে যদি না আসতে পারো তাহলে তোমার বাইক রাইড করার সুযোগ শেষ হয়ে যাবে। তখন…” প্রেম পুরোটা শেষ করার আগেই তৃষা দৌড়ে বাড়ির দিকে দৌড়ায়। প্রেম চিন্তায় পড়ে যায়। পেছন থেকে বলে, “আরে আস্তে বউ, তুমি এখন আর বাচ্চা নও।”
তৃষার তৈরি হয়ে বের হতে পাক্কা আধঘন্টা সময় লাগে। তৃষা আসতেই প্রেম হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখে সানগ্লাসটা লাগিয়ে বাইকে বসে পড়ল। তৃষা চারপাশে একবার তাকিয়ে বলল, “আমার বাইকটা বের করেননি? একটু করলে কি এমন হতো?”
“পেছনে উঠে বসো।”
“মানে কি?”
“পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছিলাম, তুমি আমার এক্সট্রা পঁচিশ মিনিট খরচা করেছো। তোমাকে যে এই শীতের মধ্যে বাইরে নিয়ে যাচ্ছি এটাই অনেক।”
তৃষা হাবার মতো বাইকে উঠে সে। বাইক বাড়ির সীমানা ছেড়ে হাইওয়েতেই পৌঁছাতেই তৃষা পেছন থেকে প্রেমকে খোঁচা দিতে শুরু করল। একটু পর পর এখানে, ওখানে স্পর্শ করা। প্রেম বার বার নিজের আত্মরক্ষার জন্য তৃষার হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে। যা দেখে তৃষা আরো মজা পাচ্ছে, তার দুষ্টুমির মাত্রা বাড়ছে। শেষে প্রেম হেলমেটের নিচ থেকে বলল,” ছিঃ জুনিয়র আমার মতো শুদ্ধ পুরুষকে একা মান ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা করছো? বলে দিচ্ছি একেবারে মামলা করব। মানহানির মামলা।”
“ওরে আমার শুদ্ধ পুরুষ। শুদ্ধতা দিয়ে বাচ্চা পয়দা করে ফেলেছেন আপনি, এখন শুদ্ধ গিরি দেখাচ্ছেন?”
“তোমার বিশ্বাস হয় না আমি যে শুদ্ধ পুরুষ? তাহলে চলো আশেপাশে কোথাও থেমে তোমায় প্রমাণ দেখাচ্ছি।”
“ইশ ওইযে আপনার সুই ঘুরে ফিরে এক জায়গাতেই আটকায়।”
“হ্যাঁ আমার সুই, ঘুরে ফিরে তোমার সুতোয় গিয়ে থেমে যায়। তবে গবেষণা মোতাবেক, সুই কিন্তু মেয়ে।”
“আরে হ্যাঁ, সুই মেয়ে আর সুতো ছেলে। তাই সুইয়ের মধ্যে মানুষ সুতোকে ঢুকিয়ে দু’টোর বিক্রিয়ায় সেলাই কার্য করে। সুই আর সুতোর বিক্রিয়া না হলে বউ সেলাইয়ের জন্ম কি করে হতো বলোতো? বিষয়টা চিন্তার কিন্তু।”
তৃষা হঠাৎ পিছন থেকে প্রেমের পিঠে আস্তে করে একটা চিমটি কাটল। প্রেম একটু চমকে তাকাতে না তাকাতেই তৃষা দু’হাত দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। রাস্তায় গাড়ির আলো লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে যাচ্ছে। সামনেই পোস্তগোলা ব্রিজের লালচে আলো জ্বলজ্বল করছে।
প্রেমের চোখ সে আলোতে আটকে নেই। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় তার মন নেই আজ। ব্রিজের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া নদীর দিকে কোনো এক টান তাকে টেনে নিচ্ছে যেন।
“চলো, অন্য কোথাও যাই,” প্রেম নিচু স্বরে বললে তৃষা ভ্রু কুঁচকায়, “কোথায়?” প্রেম হাসে, জবাব না দিয়েই হাত ধরে টেনে নেয়। ব্রিজের পথ তারা এড়িয়ে চলে, সোজা নেমে যায় সদরঘাটের দিকে।
সদরঘাটে নদীর সোঁদা জল, মানুষের ভিড়, আর রাতের অদ্ভুত চঞ্চলতা। কোলাহলের মাঝে প্রেম তৃষাকে নিয়ে উঠে পড়ে একটি লঞ্চে। সেই পুরনো রাতটার পুনরাবৃত্তি হয়। সেই একই লঞ্চ এটা, একই যাত্রী তারা। তবে সেইদিন আর আজকের দিনের মধ্যে কতখানি পার্থক্য!
লঞ্চ ছাড়তেই ক্রমে শহরের আলো ছোট হয়ে আসে, শব্দগুলো থেমে যেতে থাকে। খোলা ছাদের ওপরে উঠে আসে তারা। আকাশ অসীম নীল-কালো, আর তারারাও আজ যেন একটু বেশি উজ্জ্বল। নদীর জলে লঞ্চের কাটতে থাকা ছোট ছোট ধাক্কা, বাতাসের ঠান্ডা আঁচ সব মিলিয়ে রাতটা গভীর হয়ে উঠছে। তারা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়ায়, হাত অদৃশ্যভাবে ছুঁয়ে থাকে। বাতাস তৃষার চুল উড়িয়ে দেয়, প্রেমের গালে শীতল স্পর্শ লাগে।
“বাইরে কি ঠান্ডা!” তৃষা কাঁপা গলায় বলে। প্রেম হালকা হাসে, নিজের জ্যাকেট খুলে তার কাঁধে জড়িয়ে দেয়।
নদীর জল কালো আয়নার মতো, আর সেই আয়নায় তারাভরা আকাশ দু’জনের অনুচ্চারিত অনুভূতিকে প্রতিফলিত করছে। এই রাত, এই নদী, আর এই বাতাস সেদিনের মতোই, কেবল তারা দুজন আজ একটু বেশিই কাছাকাছি।
নদীর বাতাস থেমে থেমে এসে তৃষার মুখে লাগে, চুলের গোছা উড়িয়ে যায়। প্রেম পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে—চোখে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু যেন অগণিত কথা জমে আছে। লঞ্চ নদীর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
তৃষা আস্তে করে বলল, “প্রেম… আপনি কি পুরোটা জীবন এভাবেই পাশে থাকবেন? শুধু ভালো দিনে না… খারাপ দিনেও?”
প্রেম সোজা তাকায় তার চোখে, দীর্ঘ শ্বাস নেয়, “আমি পাশে থাকব। কেবল তোমার সুখের সাথী হয়ে নয় তোমার কান্নার দায়িত্ব নিতেও।”
তৃষা ভ্রু কুঁচকে হালকা হেসে ওঠে, “যদি কখনও আমি আপনাকে ক্লান্ত করে ফেলি?”
প্রেম কাঁধে হাত রেখে বলে, “ক্লান্তি হয় কাজের, ভালোবাসার নয়।”
তৃষা নিঃশব্দে বলল, “তাহলে যদি আমি বদলে যাই? যদি আমরা বদলে যাই?”
প্রেম উত্তর দেয়, “সময় বদলাবে, রঙ বদলাবে, স্বভাব বদলাবে… শুধু একটা জিনিস বদলাবে না—তুমি আমার ‘আপন’ হওয়ার সত্যি।”
তৃষা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ নামিয়ে বলে, “আপনি এত নিশ্চিন্ত কেন?”
প্রেম তার হাত ধরে দৃঢ়ভাবে বলল, “কারণ তোমাকে পাওয়ার পর জীবনটা আর প্রশ্ন নেই, সবই এখন উত্তর।”
তৃষা তার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে। “তাহলে আমরা একসাথে? শুধু এখন নয়…”
প্রেম হাসে, থমকে গিয়ে ফিসফিস করে, “সময় যত দূরেই যাক, শ্বাস যতদিনই থাকুক… আমরা দু’জন একই পাশে থাকব। হয়তো পথ বদলাবে, বয়স বদলাবে, স্মৃতি বদলাবে… কিন্তু হাতটা নয়।”
তৃষার চোখ ভিজে ওঠে। “আপনি কি সত্যিই আমার পাশে পুরো একটা জীবন কাটিয়ে দিতে চান?”
প্রেম কপালে চুমু খেয়ে বলে,“আমি শুধু জীবন কাটাতে চাই না… তোমার জীবনের অংশ হিসেবে আজীবন থাকতে চাই।”
তৃষা নদীর জলের দিকে তাকালো। পেটে একবার হাত দিয়ে বলল, “তাহলে বলুন তো এখন ভালোবাসা কী?
“ভালোবাসা এখন আর দুজনের আবেগ না…
তিনজনের দায়িত্ব।”
“দায়িত্ব?”
” হ্যাঁ। হৃদয়ের সাথে আরও একটা ছোট্ট প্রাণকে সুরক্ষার প্রতিজ্ঞা।”
“আমরা কি সত্যিই জীবনভর এমনই থাকব?”
“হ্যাঁ। আমরা ‘দুজন’ হয়ে পথ শুরু করেছিলাম…
এখন আমরা ‘তিনজন’ হয়ে জীবন শেষ করব।” প্রেম ঝুঁকে বসল। তৃষার পেটের ওপর আলতো করে হাত রেখে চুমু খেল। বলল, “এই যে নেওয়াজ বাড়ির নতুন সদস্য, পাপ্পা এখন একটু তোমার মাম্মাকে আদর করবে। তুমি লক্ষী বাচ্চার মতো ঘুমু দাও তো।” তৃষার সেই কান্ড দেখে হাসি পেল। সে লজ্জায় এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না। যেই শীত কেবিনে যেতে হবে। সে হাটা শুরু করতেই প্রেম তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। সাদা প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে নিজের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে গান ধরল,
~কি আবেশে তারে বারে বারে….
দেখি তবু যেনো মেটেনা তৃষা……
সে যে পথ চলে বুকে ঝড় তোলে….
জেগে ওঠে ঘুমোনো আশা~
প্রেম আর অপেক্ষা করল না। দৌড়ে গিয়ে শক্ত করে ধরল তৃষার হাত। কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“আমার শেষের গল্পে থেকে যাও,
এক অসীম গল্পকার হয়ে।
গল্পের পর গল্প জুড়ে যাক,
তোমায় পাওয়ার আমৃত্যু প্রেমতৃষা নিয়ে।”
(সমাপ্ত)
(শেষ ফাইনালি একটা হ্যাপি এন্ডিংয়ের সঙ্গে এই গল্পটা। শেষ হলো দুই থেকে তিনজন হয়ে ওঠার এই গল্প। এই দুই থেকে তিনজন হওয়ার যাত্রাটা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না, তবে তীব্র ভালোবাসা, আর ইচ্ছে থাকলে সবকিছুই সম্ভব। কথায় আছে কেউ ভালোবাসা পেয়ে ভালো হয়, কেউ না পেয়ে আবার কেউ পেয়ে হারানোর শোকে পাথর হয়। এই গল্পটাও সেইরকম। প্রেমতৃষা পূর্ণতা পেলেও প্রত্যুষকে তার ভাগ্য মেনে নিয়ে পেয়ে হারানোর শোকে হয়তো আজীবন থাকতে হবে। তবে সব কথার এক কথা, মানুষ চাইলে জীবনে সবই করতে পারে, তবে তার জন্য একটা মজবুত খুঁটির প্রয়োজন। প্রেমের খুঁটি শক্ত ছিলো বলেই সে পূর্নতার স্বাদ যেমন পেয়েছে তেমনই প্রত্যুষের খুঁটি দূর্বল ছিল বলেই সে প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ভুল পথে গেছে ধাবিত হয়েছে। তাই দশ কথার এক কথা, মরলে নিজের সিদ্ধান্তে মরো, অন্যের কোনো কথা, কিংবা দেখানো পথ অনুসরণ করে নয়। আর হ্যাঁ প্রেমতৃষা নিয়ে জলদি নতুন কিছু আসতে চলেছে, একটি নয় দু’টি। দারুণ সারপ্রাইজ আসছে কিন্তু 🌚👀)
Share On:
TAGS: ইশরাত জাহান জেরিন, প্রেমতৃষা
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৫+৩৬
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৯+সারপ্রাইজ পর্ব
-
প্রেমতৃষা পর্ব ২৫+২৬
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৮+৯+১০
-
প্রেমতৃষা সারপ্রাইজ পর্ব
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১২+১৩
-
প্রেমতৃষা ৪২ ( শেষ অর্ধেক)
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৩১+৩২
-
প্রেমতৃষা পর্ব ৪৫
-
প্রেমতৃষা পর্ব ১৫+১৬