Golpo romantic golpo প্রিয় পূর্ণতা

প্রেমতৃষা পর্ব ৩৫+৩৬


#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_৩৫ ( প্রেমতৃষাময় পর্ব)

ভোরের প্রথম রোদ জানালার কাচে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটার ভেতর দিয়ে এসে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। আলোটা কোমল, তবুও তৃষার মুখে পড়ে তাকে আরও দীপ্ত করে তুলল। তৃষার যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করল প্রেমের নগ্ন বুকের মাঝে। দু’জনে একেবারে জোড়াজুড়ি করে একে অপরের মাঝে হারিয়ে ছিল। ঘুমটা ভাঙতেই প্রেম তার ঠোঁটে চুমু বুলিয়ে দিলো। তৃষা নিজের দিকে তাকালো। এমা তার এই অবস্থা কেন? ছিঃ ছিঃ কি লজ্জার বিষয়। তৃষা লজ্জায় চাদরের নিচে মুখ লুকাতে গেলে প্রেম চাদরটা সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটু দেখতে দাও পাখি। একটু তোমায় মন ভরে দেখতে চাই।’

‘ইশ আপনি সুবিধার লোক না। দূরে যাবেন নাকি বলুন?’

‘দূরে যেতে বললে আরো কাছে চলে আসব। তখন নিঃশ্বাসটাও কিন্তু ঠিক করে নিতে পারবে না।’ বলেই প্রেম তৃষার ঘাড়ে ভালোবাসার গভীর চিহ্ন একে দিয়ে বলল, ‘কাছে আসো সোনা। এত ছটফট কেন করছো? এখন তো শুরু কেবল। এখনই এসব করলে চলবে নাকি?’ বলেই সে তৃষাকে কাছে টেনে নিজের অধিকার খাটিয়ে আরেক দফা ভালোবাসায় মাখা প্রতিটি আদরে রাঙিয়ে দিলো তাকে। খানিকক্ষণ বাদে প্রেম বিছানা ছেড়ে উঠে তৃষার সামনে দাড়াতেই তৃষা বলল, ‘ইশ এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান গিয়ে ফ্রেশ হন। নোংরামি খালি।’

‘সোনা এমন প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রকৃতির মাঝে গেলেও পাবে না। লাখ টাকার প্রাকৃতিক সম্পদ দেখাচ্ছি, দেখে চোখের জ্যোতি বাড়াও।’

‘লজ্জার মাথা খেয়েছেন।’

‘ওটা খেয়ে পেট ভরেনি, খাবার হিসেবে তুমি যদি নিজেকে সার্ভ করো তাহলে খেয়ে দেখতি পারি পেট ভরে কিনা। যদিও মেয়ে তোমার মুখের মতোই তুমি একটা তেতো চিরতা। টেস্টলেস হবেই বোধ-হয়। ‘

‘ওটাই তো চেটে চেটে খান।’ প্রেম প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি গোসল করবে না? শুনেছি গত শীতে তুমি নাকি মাসে একবার গোসল করতে?’ তৃষা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এসব ভুয়া খবর প্রেম পায় কই থেকে? মানে একটু একটু সত্য, তবে বাকি সব ভুয়াই। নির্গাত মা বলেছে। নানুর বাড়ি, দাদুর বাড়ি, এলাকা কোথাও বাদ নেই এসব ছড়ানোর। ওই মহৎ নারীকে নিয়ে তৃষা কোথায় যে যাবে? তৃষা ভাবতে ভাবতে চোখে আবার ঘুম চলে এলো। সারাটা রাত একটু ঘুমাতে পারেনি সে। বালিশে মুখ গুঁজতেই প্রেম টানে এক টানে শোয়া থেকে উঠিয়ে কথা না বাড়িয়ে সোজা ওয়াশরুমের দিকে যাওয়া শুরু করল। তৃষা হাত পা ছড়াছড়ি করতেই প্রেম ধমকে তাকে আরো শক্ত করে চেপে চুমু দিলো ঠোঁটে। পরক্ষণেই বলল, ‘দফায় দফায় আরেকবার হবে নাকি? মানে, না মানে কিছু না। চলো অতি আবশ্যক কাজটা সেরেই আসি?’

‘না প্রেম ভাই এত সকালে ঠাণ্ডা জল দিয়ে গোসল আমি ভুলেও করতে পারব না।’

‘ভুলে করা লাগবে না, সজ্ঞানে করলেই চলে যাবে।’

তৃষা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রেমের হাতে কামড় দেয়। প্রেম তবুও তা সহ্য করে নেয়। তবে তৎক্ষনাৎ প্রেম হুমকি দিয়ে তৃষাকে বলল, ‘আমি তোমার এমন জায়গায় দাগ বসাবো না সোনা, মানুষকে বলতেও পারবে না।’ বলেই সে ওয়াশরুম গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুলো ভালো করে হেয়ারড্রায়ার দিয়ে শুকাতে ব্যস্ত তৃষা। প্রেম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল তার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে তার ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে চোখটা বন্ধ করল। এই মেয়ের চুলের এই মাতাল করা গন্ধটা তাকে পাগল করে দেবে। দিনকে দিন এটা ভয়ানক নেশায় বদলে যাচ্ছে। চুল থেকে পানি গড়িয়ে তৃষার গালে পড়তেই প্রেম নিজের আঙুলে মুছিয়ে নিল। তারপর হেয়ার ড্রায়ারটা হাতে নিয়ে বিটারহার্টের চুল গুলো শুকিয়ে কপালে চুমু একে দিলো। দুজনের চোখ এক হতেই তৃষা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এভাবে তাকাবেন না… মনে হয় বুকটা থেমে যাবে।”

“তাহলে চোখ বন্ধ করো। আমি শুধু তোমাকে অনুভব করতে চাই।”

তৃষা চোখ বন্ধ করলেও বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ আরও বেড়ে গেল। প্রেম আস্তে করে তার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে মুখের কাছে টেনে আনল। আঙুলের ডগায় ঠোঁট ছোঁয়াতেই তৃষার নিঃশ্বাস কেঁপে উঠল।

বাইরে পাহাড়ের ভেজা কুয়াশা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ঘরের ভেতর দুই হৃদয়ের ভেতর জমে উঠছে ভালোবাসার মিশেলে তৈরিকৃত নতুন কুয়াশা, শব্দহীন, অদৃশ্য, তবুও যেন ভীষণ ঘনীভূত।

তৃষা হঠাৎ বলল, কণ্ঠে মৃদু অভিমান মিশে আছে, “আপনি কি সবসময় এভাবেই আমায় জড়াতে চান? না কি সত্যিই ভয় হয় হারানোর?”

প্রেম তার মুখের খুব কাছে ঝুঁকে এল। “আমি শুধু চাই, প্রতিটি সকাল তুমি আমার বুকে জেগে ওঠো। আমার একটাই ভয়, কোনো ভোরে তুমি যদি আমার পাশে না থাকো।”

তৃষা চোখ খুলে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে কোনো প্রতিবাদ নেই, শুধু অবলম্বনের আকাঙ্ক্ষা। প্রেম ধীরে ধীরে তাকে বুকে টেনে আনল। দু’জনের শরীরের ভেজা গন্ধ, উষ্ণ নিঃশ্বাস মিশে গেল। জানালার বাইরে রোদ বাড়ছে। কিন্তু ঘরের ভেতর তৈরি হয়েছে এক অন্যরকম ভোর—

যেখানে বৃষ্টির দুঃখ মিলিয়ে গিয়ে জায়গা নিয়েছে শুধু প্রেম আর তৃষার দমবন্ধ করা নৈকট্য।

নাস্তা সেরে বাইক নিয়ে দু’জনে হাজির হলো বাড়িতে। গেটের সামনে দাঁড়াতেই নাম ফলকের দিকে তাকাতে তৃষার চোখ বিস্ময়ে ভরে গেল। বাড়ির নাম নাম প্রিমরোজ। আবারও ঘুরে ফিরে সেই নাম! বাইক পার্কিং করেই তৃষা প্রেমকে পেছন থেকে ডাক দিলো। জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি করে বলুন তো আপনি কে?’ এই আঁধার, এই প্রিমরোজের সঙ্গে আপনার কি যোগসূত্র? প্রেম এক মুহূর্ত থমকে গিয়ে বলল, ‘প্রিমরোজ আমার পছন্দের ফুল, ব্যাস এইতো। এই যে সোনা জলদি প্যাকিং করো আজকে সাঙ্গু নদীর তীরে যাব কিন্তু। রাত হওয়ার আগে আবার নীলগিরিতে যেতে হবে। রিসোর্ট ঠিক করা আছে। মেঘের রাজ্যে হারাতে হবে না তোমাকে নিয়ে? নরম নরম মেঘ দেখিয়ে তোমায় গরম গরম আদর খাওয়াবো।’

‘মানে যত যা কিছুই বলেন না কেন ঘুরে ফিরে ঢলাঢলিতেই এসে আটকান।’

‘বউ শুনো প্রেম জায়গা বুঝে আটকায়। এই ধরো তোমাকে এখন আদর দিচ্ছে ওইসব আর এমনি এমনি না। বাচ্চার বাবা হওয়া লাগবে না? দেখবে এবার আগামী প্রজন্মের বাইকার নিয়ে যদি এবার বাড়ি ফিরে দাদুকে সারপ্রাইজ না করি?’

‘ আমাকেও তো মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ করতে পারেন?’

‘হুট করে যেদিন তুমি শুনবে, তোমার গাছে আমার ফল ধরেছে তখন এমনিতেই সারপ্রাইজ হয়ে যাবে। এখন জলদি ভেতরে আসো।’

‘ছিঃ কি লোকরে বাবা।’

‘বউ আমাদের মাঝে বাবাকে কেন ডাকছো? লজ্জা নেই হুহ! জানো না প্রেম নেওয়াজের লজ্জা তোমার ব্রেনের থেকে বেশি? ছিঃ বউ… নিন্দা জানাই… তবে তুমি ঠোঁটে চুমু খেলে ক্ষমা করে দিতে পারি। সিউর না কিন্তু চুমুতে কাজ না হলে দাবি বাড়িয়ে দেব।’

তৃষা একটা ঢোক গিলল। এটা তার স্বামী নাকি আসামী? আর লজ্জা তার ব্রেনের থেকে বেশি মানে? এই লোকের তো লজ্জাই নাই। আর মানে সে বুঝাতে চাইল তৃষার মাথায় ব্রেন নেই?

সাঙ্গু নদীর ধারে বিকেলের আলোটা আজকে একেবারে আলাদা। পাহাড় থেকে নামা হাওয়ার শীতলতা, জলে ভেসে আসা নৌকার ঘণ্টাধ্বনি আর সবুজে ভরা তীরের নিস্তব্ধতা প্রেম আর তৃষার মুহূর্তটাকে আরও ঘন করে তোলে। নদীর ওপর ঢেউ ভাঙার টুপটাপ শব্দে তাদের দু’জনের হৃদয়ের ধুকপুকানি মিলেমিশে একাকার হচ্ছে।

তৃষা নদীর দিকে তাকিয়ে আস্তে বলল, “জলটা কেমন যেন শান্ত দেখাচ্ছে আজ… অথচ আমার ভেতরটা একদম শান্ত নয় বুঝলেন তো?’

প্রেম তার হাতটা আলতো করে নিজের হাতে নিয়ে বলল, “শান্ত হবার দরকারও নেই। তুমি যদি অস্থির হও, আমি তো আছি তোমার অস্থিরতা সামলাতে।”

তৃষা একটু হেসে নদীর দিকে চেয়ে থাকল। চোখের কোণে আলো পড়ে চকচক করছে তার। “আপনি কি সত্যিই সবসময় এভাবেই থাকবেন? নদীর মতোই পাশে?”

প্রেম তার দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “সাঙ্গুর মতোই আমি তোমায় ঘিরে থাকব, পাহাড়ের মতোই শক্ত হয়ে দাঁড়াবো… তুমি চাইলে ঝড় হলেও আমি টলবো না। আচ্ছা আমি যদি নদীর মতো কখনো বেপরোয়া হয়ে ছুটে যাই, তুমি কি আমায় আঁকড়ে ধরবে?”

তৃষা মৃদু হাসল, তার হাতের মুঠোটা আরও শক্ত করল, “আমি শুধু আঁকড়ে ধরব না, আমি আপনার স্রোতে ভেসেও যাবো। হারিয়ে গেলেও আপনার ভেতরেই হারাবো।”

প্রেম তৃষার কপালে একটা চুমু দেয়। আসার সময় গিটারটা নিয়ে এসেছিল। গিটারটা হাতে নিতেই তৃষা বলল, ‘আমায় আপনি গিটার বাজানো শেখাবেন? শখ আছে।’

‘শেখালাম। তো বাইক তোমায় কে শিখিয়েছিল? কোন আপুর কাছ থেকে শিখেছিলে?’

তৃষা চুপসে যায়। প্রেম সেই চুপসে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে তড়ক গলায় হুট করে জিজ্ঞেস করল, ‘শালীর ঘরের বউ কোন শালায় তোরে বাইক চালানো শিখিয়েছে?’

‘মা…নে মেজো আপার জামাই।’

‘তোর মেজো আপা আবার শাশুড়ী কবে পয়দা করল?’

‘মানে চাচাতো বোন।’

‘যাই একবার শশুর বাড়ি তোমার প্রেয়ারের দুলাভাইয়ের ইয়ে কেটে তাকে লুলাভাই বানিয়ে দেব।’

‘আপনি হাত-পা কেটে দিবেন?’

‘কেন অন্য কিছু কাটা দরকার ছিল নাকি? প্রেম আবার ইনটেক জিনিসে হাত দেয়। কাটা জিনিস কেটে সময় নষ্ট করে লাভ আছে? ছ্যাহ!’

‘তাহলে আমার বোধ-হয় কপালটাই খারাপ।’

‘কেন রে বিটারহার্ট? তোমার জামাই আরো তিনটে বিয়ে করছে নাকি?’

‘আরে ধ্যাৎ ওইসব হবে কেন? জামাই তিনটে বিয়ে করার আগে তার মাথায় ঠাটা পড়ুক।’

‘ নাউজুবিল্লাহ।’

তৃষা মুখ বাঁকা করে বলে, ‘আমি ইনটেক পেলাম না গো প্রেম ভাই, কাটা ছেঁড়া মাল কপালে জুটল। অংকুর ভাইয়ের ফুটো জাঙ্গিয়ার মতো ফুটো কপাল হয়ে গেল।’

প্রেম একটা ঢোক গিলল কেবল। তার কথা ধরে তাকেই খোঁচা মারা? শালীর ঘরের বউ দেখি হেব্বি ডেঞ্জারাস!

বিকেলটা তখন আরো সুন্দর। তবে কি যে প্যাচপ্যাচে একটা গরম পড়েছে আজ। প্রেম একটু আগে গিটার নিয়ে একবার রেখে দিয়েছিল। এইবার আর রাখল না। তৃষাকে কোলের মাঝে বসাতেই তৃষা পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘কই বললেন না তো আপনি আসলে কে?’

প্রেম রহস্যময় হেসে গান ধরল,

~অনুরাগের স্পর্শ জুড়ে তুমি

কি করে বলো ভালো থাকি আমি?

একবার ছুঁয়ে দেখো আমায়

আঁধারের গান আমি, আঁধারে খুঁজে ফিরি তোমায়~

গান শেষে তৃষা মুগ্ধ হলো। ইশ যদি এই প্রম নেওয়াজ সত্যিকারের আঁধার হতো? ওই ব্যাটা আঁধার তৃষার পছন্দের সিঙ্গার। কত ইচ্ছে আছে সে কনসার্ট করলে তৃষা সামনে থেকে কনসার্ট দেখবে! শালা সব কিছুতে পানি ঢেলে তারিখ পিছিয়ে দিয়েছে। তাও ভালো বর মশাইয়েরও একই গলার স্বর, একই রকম গানের গলা। কি দারুণ গায়! আল্লাহ একে দিয়ে ওর শূন্যতা দূর করেছে। প্রেম নদীর ধারের সবুজ ঘাসের ওপর গিটারটা রেখে তৃষার কোলে মাথা রাখতেই রোদ এসে তার চোখে লাগে। তৃষা প্রেমের দিকে ঝুঁকতেই সেই রোদ মিলিয়ে যায়। হঠাৎ তৃষা আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রেম কে প্রশ্ন ছুঁড়ে, ‘শুনছেন প্রেম ভাই?’

‘জ্বি, শোনার অপেক্ষায়।’

‘আমি কাছে এলে?’

‘আমার কাছে সেটা হলো পৃথিবীর সব দুঃখ গলে যাওয়া।’

‘আমি দূরে গেলে?’

‘আমার কাছে সেটা হলো দীর্ঘ শীতের রাত। যা ফুরানোর অপেক্ষায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারি না।’

‘আমার হাসি?’

‘আমার কাছে সেটা হলো ঈদের চাঁদ, যাকে দেখার জন্য দীর্ঘ ত্রিশটা রোজা আমায় অপেক্ষায় রাখে।’

‘আর আমার অভিমান?’

‘আমার কাছে সেটা হলো বৃষ্টিভেজা জানালা—মুছে দিলে আবার ঝাপসা হয়।’

‘ আর চোখ?’

‘আমার কাছে সেটা হলো অনন্ত সমুদ্র—যতই ডুবি, ততই হারিয়ে যাই। বুঝলে? ‘

‘ আচ্ছা আমায় ছাড়া আপনার জীবন?’

‘আমার কাছে সেটা হলো বইহীন লাইব্রেরি—শুধু তাকের পর তাক, তবে নেই সেখানে কেনো বই, নেই কোনো গল্প। এবার বলো দেখি পাঠকের বই ছাড়া চলে?’

তৃষার চোখের কোণে জল। কালকে বিকেলে শিমলার সঙ্গে একবার কথা হয়েছিল। সব ঘটনা সে খুলে বলল। এই এক মাসে প্রেমের কি হয়েছিল? তৃষাকে ছাড়া এপাশে সে কেমন ছিল সব…..ইশ কত কষ্টই না হয়েছিল। বাইক এক্সিডেন্টের থেকে বড় ব্যথা হচ্ছে একজন প্রেশোনাল বাইকারের পা ভেঙে ঘরে বসে থাকা, তাও বাইক রাইড ছাড়া। তৃষা নিজেও বাইক চালায়, বোঝে সব। ওইদিন তৃষা প্রেমের বাবা-মা নিয়ে ওইসব যদি না বলত তবে প্রেম ওভার নেশা করতও না আর দূর্ঘটনাও ঘটত না। তবে অতীতে যা হওয়ার ছিল হয়েছে। এখন আর সে প্রেমকে হারাতে চায় না। কিন্তু প্রত্যুষের জীবনটা মাঝে আবার তার জন্য নষ্ট হলো। ছেলেটিকে বিয়ের আশা দিয়ে ধ্বংস করল। ওইদিন প্রত্যুষের সঙ্গে বিয়ের পিড়িতে না বসলে অভিমানী প্রেম কি ফিরে আসত? প্রেমকে ফিরিয়ে আনার জন্য তৃষার দ্বারা যা সম্ভব হয়েছে সে করেছে। কারণ সে জানত একমাত্র অংকুরই প্রেমের খবর জানে। তাই বিয়ের খবর অংকুরের কান অবধি গেলে অবশ্যই প্রেমের কান অবধিও অবশ্যই যাবে। আর লাইফে কিছু রিক্স না নিলেই হয়! তবুও মাঝে মাঝে একটা কথা ভেবে ভয় হয়, যদি ওইদিন প্রেম ফিরে না আসত? তাহলে আজ সত্যি ভাগ্যকে মেনে নিয়ে মিসেস দেওয়ান হতেই হতো তাকে।

নদী চারপাশের পাহাড়ি সবুজে সূর্যের শেষ আলো মেখে আছে তার গায়ে। নদীর ঢেউগুলো সোনালি ঝিলিক তুলছে। নদীর ধারে চাকমা মেয়েরা ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁড়ি-পাতিল ধুচ্ছে, কারো আবার কাপড় কাঁচার ব্যস্ততা। তারা গান গাইতে গাইতে কাজ করছে। পাহাড়ি টান মেশানো সেই গান নদীর হাওয়ার সঙ্গে মিলেমিশে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁকে প্রেম হেসে তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই জলটা আমায় ডাকছে রে তৃষা… একটু নামি না?”

তৃষা প্রথমে দ্বিধা করল, কিন্তু প্রেমের সেই ছেলেমানুষি হাসি দেখে না করতে পারল না। “ঠিক আছে, তবে সাবধানে”

প্রেম গায়ের থেকে শার্ট খুলতেই চাকমা মেয়ে গুলো চাকমা ভাষায় তার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে যেন ফিসফিস করে কি বলতে লাগল। ব্যাস কিছুক্ষণ ধরেই প্রেমকে নিয়ে তাদের ফুসফাস চলছিলোই। তৃষা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। তার স্বামীর দিকে নজর দেওয়া? শালার প্রেমের বাচ্চার কি কন্যা রাশি নাকি? মেয়ে মানুষ তাকে দেখলেই ঢিলে হয়ে যায়? প্রেম পানিতে নামতে যাবে তার আগেই তৃষার বুকের ভেতর হঠাৎ এক অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল। অস্বস্তি, খানিকটা রাগও। সে একটু জোরে ডেকে উঠল, “প্রেম! নামা লাগবে না। এদিকে আসুন বলছি জলদি।”

প্রেম চমকে তাকাল, নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসা তৃষার কণ্ঠে কেমন এক অদ্ভুত তাড়না ছিলো। “কী হলো? আমি তো শুধু…?”

তৃষা এবার দৃঢ় স্বরে বলল, “আমি কি বললাম শুনতে পাননি? কথা কানে না ঢুকলে বলুন, আমি ঢোকাতে জানি।’

‘ আসতাগফিরুল্লাহ! ওইসব তো পুরুষ মানুষের কাজ। মেয়ে মানুষ এমনিতেও কথা কানে শুনতে পায় না, তখন পুরুষ মানুষরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তাদের কানে কথা ঢুকায়। তাই বলছি ওইসব মেয়ে মানুষের কাজ না বউ।’ প্রেম আর কিছু না বলে তৃষার দিকে এগিয়ে এলো। তৃষা দ্রুত তার হাতে শার্টটা ধরিয়ে দিল।

” ওই মেয়ে গুলোকে দেখে আপনি ইচ্ছে করেই খালি গায়ে পানিতে নামতে চেয়েছেন তাই না?’

প্রেম তখনও মেয়েদের দিকে তাকায়নি। তৃষার কথা ধরে মেয়ে গুলোর দিকে তাকাতেই বলল, ‘আরে ওইসব চিংচাংয়ের প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই। আমি না তাকাতেই ওরা গলে যাচ্ছে৷ আর তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলে খোদা জানে কি হবে। দেখো বউ গলে যাওয়া জিনিস প্রেম গিলে না। আমার অন্য কোনো নারীর কোনো দরকার নেই। আমার আমি বলতে তুমি আছো তো? তাতেই প্রেম নেওয়াজের চলবে না বরং দৌড়াবে। ‘ প্রেম তৃষার হাত ধরে গিটার নিয়ে বাইকে উঠে বসল। বাইক ছাড়তেই তৃষাকে মেয়েগুলোকে পেছন ফিরে মিডেল ফিঙ্গার দেখিয়ে বলল, ‘আর কোনোদিন চাংচুংয়ের বাচ্চার তোরা আমার প্রেমের দিকে নজর দিলে তোদের মুখে গু ছুঁড়ে মারব। শালী থার্ড ক্লাস চুলকানির মলম।’

প্রেম হেলমেটের নিচ থেকে হাসল। পেছন থেকে তৃষার হাতটা টেনে বুকের কাছে এনে বলল, ‘ধরো শক্ত করে। আর আরো কাছে এগিয়ে বসো। নইলে সোনা চালানোর মতো ফিলিংস আসে না।’

চলবে?

(

#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_৩৬

নীলগিরির বুক চিরে ওঠা পাহাড়গুলোর পাশে দাঁড়িয়ে

রিসোর্টটি। রাতের আঁধার নামতেই জায়গাটা যেন অন্য এক জগতে ঢুকে যায়। চারদিক নিঝুম, শুধু দূরের ঝরনার ধ্বনি আর মাঝে মাঝে শোঁ শোঁ করে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি হাওয়ার শব্দ। রিসোর্টের বারান্দা থেকে তাকালেই চোখে পড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা কুয়াশা।

আজ আকাশে তারার অগণিত মেলা। অন্ধকারে জোনাকি জ্বলে উঠছে আভা ছড়িয়ে। চারপাশের গাছপালা রাতের আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে আছে নিরব প্রহরীর মতো। কাঠের তৈরি কটেজগুলো নরম আলোর হলুদাভ লণ্ঠনে ঝলমল করছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে উষ্ণতার আবহ। দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই রিসোর্ট থেকে মনে হয় পুরো পৃথিবীটা থমকে গেছে। শুধু নিস্তব্ধতা আর প্রকৃতির গোপন গুঞ্জন বাজছে কানে। রাত বাড়তে থাকলে এই পাহাড়ি হাওয়া আরও শীতল হয় । শরীরে কাঁপন ধরায়, অথচ সেই কাঁপুনি মন শান্ত করার মতো এক ধরণের প্রশান্তি নিয়ে আসে। রাত গাঢ় হয়েছে এখন। সেই সঙ্গে রিসোর্টের চারপাশে নীরবতার চাদর আরও ঘন হয়েছে। মাঝে মাঝে দূরের পাহাড়ি পথ ধরে হেডলাইটের ক্ষীণ আলো ভেসে আসছে, আবার মিলিয়ে যায় আঁকাবাঁকা আঁধারে। সেই ক্ষণিক আলোয় পাহাড়ের ছায়াগুলো আরো রহস্যময় হয়ে ওঠছে।

নীলগিরির বুক চিরে ওঠা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রেম ও তৃষা। ঠিক কিছুক্ষণ আগেই শিমলা আর অংকুর এসে পৌঁছেছে। এই দু’জনকে পাওয়া যায় না সহজে, সারাদিন তারা কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়, কেউই জানে না। আসার পরপরই প্রেম, অংকুরকে সঙ্গে করে অন্যদিকে চলে গেল। শিমলাকে ফেলে রেখে গেল তৃষার কাছে। দুই বান্ধবী পাশাপাশি বসে আকাশের কালো গামছার মতো চাদরে ভরা তারাদের দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ শিমলা ফিসফিস করে বলল, ‘তোর কত ভাগ্য! বাসার সবাই তোর আর প্রেম ভাইকে মেনে নেবে।’

তৃষা মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, গলায় অনিশ্চয়তা, ‘তোকে কে বলল? ফাউল কথা। আমাকে আমার পরিবার জীবনেও বাড়িতে জায়গা দিবে না। তবে তোর পরিবারের কথা বলতে পারছি না। আচ্ছা আসল ঘটনা কি বলতো? পালিয়ে চলে এলি কেন? বাসায় বলতেই তো পারতি অংকুরকে ভালোবাসিস। আমি না হয় কাউকে পছন্দ করতাম না বিধায় পালানোর সময় কিছু বলে আসতে পারিনি। তোকে তো বলেছিই, বাইক রাইড আমার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ? পাশাপাশি জগন্নাথে পড়াও। আমাকে আমার ভাগ্য এখানে টেনে এনেছে। এখন এটাই আমার ঠিকানা হয়ে গেছে। আসলে আমি বোধহয় কখনো প্রত্যুষ দেওয়ানকে চাই নি। সবসময় এই হারে বজ্জাত হাইব্রিড করলা প্রেম নেওয়াজকেই চেয়েছি নয়তো শেষে ঘুরে ফিরে তার প্রেমে কেন পড়লাম? যাক বাবা যা হয়েছে ভালো হয়েছে। তবে আমি এখনো অনেক কিছু জানি না। প্রেমের বাবা-মা কি করে মরল। লোকটা কি আগেও এমন শক্ত মনের ছিল নাকি পরিস্থিতি তাকে এত কঠোর হতে বাধ্য করেছে? আচ্ছা বাদ দে…তোর কথা বল।’

শিমলার চোখ ঝলমল করে উঠল, ‘আমার বলার মতো কোনো কথা নেই। কেবল আমি জানি অংকুর আমাকে কতটা ভালোবাসে। জোর পূর্বক বুড়ো লোকের সঙ্গে বিয়ের হাত থেকে সে বাঁচিয়েছে আমায়। আর তার জন্যই বাড়িতে হওয়া আমার ওপর মানসিক নির্চাতনের হাত থেকে আমি আজ রেহাই পেয়েছি। তো তোর না চিত্রা নামক কার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক? কথা বলিস না এখন?’

তৃষা মৃদু ভ্রুকুটি করল, ‘কথা কি আর বলব? বললেই তার ওই হ্যান্ডসাম স্বামীটা বলে আমি নাকি ছোটলোক। সামনা সামনি একদিন পাই ব্যাটাকে তখন বুঝাব এই তৃষা কি জিনিস।’

শিমলা হেসে উঠল, ‘তুই বুঝানোর আগেই যেন সে আবার না বুঝিয়ে দেয়। আচ্ছা নামটা জানি কি তার?’

তৃষা একপল থেমে জবাব দিলো, ‘ফারাজ এলাহী।’ বলতে না বলতেই হঠাৎ ফোনে একটা ভিডিও কল এলো। কলটা দেখে তৃষার মুখে খুশির সীমা রইল না। সে রিসিভ করে বলল, ‘আরে চিত্রা কি খবর তোমার? আমায় তো ভুলেই গেছো।’

চিত্রা সে হেসে বলল, ‘আসলে তেমন কিছু না। সংসার, সন্তান, স্বামী নিয়ে আজকাল একটু ব্যস্ত সময় কাটছে। তোমার কি অবস্থা?’

তৃষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব খুলে বলল। শুনে চিত্রা মুচকি হাসল, ‘আমার অবস্থা?’ এক এক করে সব কিছু চিত্রাকে খুলে বলতেই চিত্রা মুচকি হাসি দিলো। বলল, ‘তাও ভালো প্রেমকে তুমি আগে থেকে পছন্দ করতে। সুখেই আছো। আমার সঙ্গে যখন ফারাজের বিয়ে হলো! হায় আল্লাহ ওইসব দিন কি করে যে কাটিয়েছিলাম। তবে এখন আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া কারণ ওইসব খারাপ দিন না দেখলে আজকের ভালো দিন গুলো দেখতে পেতাম না। স্বামী হিসেবে ফারাজ এলাহী আমার কাছে শ্রেষ্ঠ।’

‘হু তোমার গল্প তো তুমি আগেও বলেছিলে। যত শুনি তত মুগ্ধ হই।’

চিত্রা হাসল, ‘তোমার গল্পও কম কোথায়? স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই রাইডার।’

‘আর তুমি? তুমিও তো…..’

‘ইশ……..’ ওইসব গল্প গোপন থাক। বলেই মুচকি হাসল চিত্রা। চেহারার লাবণ্য দিনকে দিন বেড়েই চলছে। সাধে কি তাকে তার স্বামীজান আগুন সুন্দরী বলে ডাকে? তৃষা কথা বলে রাখল। চিত্রা জানিয়েছে ফারাজের কক্সবাজারে কি একটা দরকারি কাজ আছে। এই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ আসবে। বউ ছাড়া ওই লোক কোথাও যায় না। অবশ্যই ইতালি থেকে গোটা পরিবার সহ আসবে। ভালোই হবে। এখান থেকে কক্সবাজার যেতে কি এমন সময় লাগবে? দেখা করতেই পারবে। কেমন যেন একটা ভালো-লাগা কাজ করছে। এই সুযোগে ফারাজ এলাহীর সঙ্গে প্রেম নেওয়াজের একটা পরিচয় পর্ব হয়ে যাবে। তৃষা উঠে দাঁড়াতেই পেছন থেকে প্রেম তার কোমর জড়িয়ে ধরল। সেই হাত সরাসরি পৌঁছে গেলো টিশার্ট ভেদ করে উষ্ণ কোমরের ভাঁজে। তৃষা নিজেকে ছাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আরে কি করছেন? শিমলা সামনে আছে দেখতে পারছেন না?’

‘তুমি পাশে থাকলে আমার অন্য কিছু আর দেখতে মন চায় না সোনা।’

‘উফ চুপ করেন।’

শিমলার এসব দেখে লজ্জা পাচ্ছে। সরে যাবে তার আগেই তাকে অন্ধকারে টেনে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরল অংকুর। গালে চুমু দিয়ে বলল, ‘চশমা সুন্দরী চলো রুমে চলো। ঘুম পাচ্ছে।’

শিমলা মুচকি হেসে বলল, ‘ঘুম পাচ্ছে সত্যি তো?’

অংকুর চতুর হেসে উত্তর দিলো, ‘ইশ কথা কম ভালোবাসা বেশি জানো না?’ বলেই সে হাত টেনে শিমলাকে রুমে নিয়ে গেল। তারা যেতেই প্রেম তৃষার ঠোঁটে জোর করে শক্ত চুমু দিয়ে বলল, ‘এবার চলো আমরাও যাই। নেওয়াজ বংশ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে না?’

প্রেম তৃষার চোখে একটা কাপড় বেঁধেছিল। রুমে এনে সেই কাপড় খুলতেই তৃষা রীতিমতো অবাক। রুমটা কি সুন্দর করে সাজানো। চারিদিক ফুলের গন্ধ ম-ম করছে। বিছানার ওপর সাদা চাদর টানটান করে বিছানো হয়েছে। বিছানার চারপাশে সাদা পাতলা পর্দা ক্যানোপি স্টাইল টানানো। ছাদের ঠিক মাঝ বরাবর ফুল দিয়ে তৈরি করা মোটা একটি আর্চ সাঁটানো রয়েছে। ফুলগুলোতে লাল, হলুদ, গোলাপি, সাদা রঙের মিশ্রণ। ফুলের মালা থেকে ঝুলে আছে কাঁচের লণ্ঠনের মতো ছোট ছোট ঝাড়বাতি, ভেতরে মোমবাতির হলুদ আলো জ্বলছে। এগুলোর নরম সোনালি আলো পুরো ঘরটিকে মায়াময় আবেশে ঢেকে দিয়েছে। ঘরের প্রতি কোণে সুগন্ধি মোমবাতির আলো জ্বলছে এবং ফুলের সাজে জায়গাটা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। পাশেই একটি আরামকেদারা। তাও মাধুরি মিশিয়ে সাজিয়ে তোলা। তৃষা অবাক হয়ে প্রেমের দিকে তাকাতেই প্রেম তাকে বলল, ‘ওই যে জামা রাখা আছে। তৈরি হয়ে আসো। আমি অপেক্ষায়।’

তৃষা কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেম পুনরায় বলল, ‘আজ আর কোনো কথা নয় সোনা। যাও। ‘ তৃষা কথা না বলে কাপড়ের ব্যাগটা তুলে নিলো। অতঃপর পোশাক বদলে আসতেই দেখল বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রেম নেওয়াজ। আলো-অন্ধকারের খেলা তার অবয়বটাকে আরও রহস্যময় করে তুলল। গায়ে সাদা ফুলহাতা শার্ট, বুকের উপর নিখুঁতভাবে মানিয়ে নেওয়া কালো ওয়েস্টকোট, গলায় আঁটসাঁট কালো টাই। অতীব ভদ্রলোকসুলভ সাজ। তবে তাকে অন্যদিন গুলোর থেকে আজকে অন্য রকম লাগছে। বলতে গেলে চোখ ফেরানো দায়। এই পুরুষকে অতীব ভদ্র সাজে যে এতটা সুন্দর লাগতে পারে তা ভাবনার বাইরে ছিল। তার লম্বা, সোজা গড়ন, প্রশস্ত কাঁধ আর ছিপছিপে শরীর তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বাম কব্জিতে ঝকমকে ঘড়ির আভিজাত্য, ডান হাতে ধরা একটি লাল গোলাপ। তৃষা আসতেই তার গাঢ় বাদামী চোখ গুলো একবার তাকে ওপর থেকে নিচ অবধি পরখ করল। nরাতের গভীরতার মতো এক কৃষ্ণাঙ্গিনী গাউ. বক্ষদেশের মধুর রেখা ধরে নেমে এসেছে সুচারু সুইটহার্ট নেকলাইন। গাউনের মসৃণ কালো কাপড়টি তার লাবণ্যময় দেহলতা বেয়ে নেমে এসে এক পাশ দিয়ে উঠেছে সাহসী চেরা, যা পদযুগলের ঈষৎ ঝলক দেখিয়ে রহস্যময় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তৃষার শরীরী গঠন যেন তক্ষশীলার ভাস্কর্য, প্রতিটি ভাঁজে অপূর্ব ছন্দ। কোমর থেকে বক্ররেখা নেমে এসেছে এক সুমিতিতে, যা নজর কাড়ে। সুদীর্ঘ, ঢেউ খেলানো কেশরাশি তার পিঠের উপর দিয়ে ছড়িয়ে আছে। যেন কালো ঝর্ণাধারা। মুখমণ্ডল প্রেমিকের স্পর্শে আবৃত হলেও,তার উজ্জ্বল ত্বক এবং সংযত দেহভঙ্গি সৌন্দর্য প্রকাশ করছে। তৃষার পরনের কালো গাউনে তার শরীরের প্রতিটি বাঁক স্পষ্ট। প্রেম ঢোক গিলল। তার কণ্ঠমণি ওপর-নিচ হতেই সে আর থমকে থাকতে পারল না। তৃষার অন্য হাতে উঁচু চোখা হিল জুতো। সে প্রেমের দিকে তাকিয়ে জুতার দিকে ইশারা করতেই প্রেম বাঁকা হেসে তাকে কাছে টেনে তার চুলে মুখ গুঁজে দিলো। নিশ্বাস তার বন্ধ হয়ে আসছে। এই চুলের গন্ধ তাকে মাতাল করে দিবে। উফ কন্ট্রোল! তবে প্রেম নেওয়াজের সঙ্গে কন্ট্রোল শব্দটা যায় না। প্রেম তার ঘাড়ে মুখ ঢুবিয়ে দিলো। তার সুদীর্ঘ চুল পিঠের উপর আলতোভাবে সরিয়ে দিলো। প্রেমের বাহুদ্বয় তৃষাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছে। প্রেমের ডান হাতটি আলতো করে তৃষার মুখ ছুঁয়ে আছে, তৃষার চোখ দুটি বন্ধ, সে প্রেমের স্পর্শে যেন সমস্ত ক্লান্তি ভুলে নিজেকে সমর্পণ করেছে।

প্রেম অত্যন্ত নিচু স্বরে ফিসফিস করল, “তৃষা তোমার প্রেমের তৃষা, তোমায় ছোঁয়ার তৃষায় আমি কিন্তু এইবার মরেই যাব।”

‘একটু হিসেব করে ভালোবাসুন প্রেম নেওয়াজ। এত ভালোবাসা দিলে আমি বেহায়া হয়ে যাব।’

‘যে সম্পর্ক হিসেব কষে চলে, সে তো ব্যবসা—ভালোবাসা নয়।’

‘প্রেম আমি না আপনাকে বরবাদ করতে চাই জানেন?’

‘আমি তো অলরেডি তোমার প্রেমে বরবাদ হয়ে গেছি।’ তৃষা মুচকি হাসল। নিজেকে ছাড়িয়ে জুতোর দিকে ইশারা করতেই প্রেম তৃষার দিকে তাকালো। তৃষা তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে কপাল থেকে আঙুল নিচে নামাতে নামাতে বুকের ওপর এসে থামল। বুকে একটা চুমু দিয়ে জুতো বাড়িয়ে দিতেই প্রেম চেয়ার টেনে তৃষাকে সেখানে বসিয়ে চেয়ারটা একেবারে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তৃষা তার উরুর ওপর পা রাখতেই প্রেম সেই পায়ে চুমু দিয়ে জুতো পড়িয়ে দেয়। অতঃপর ফিতা লাগানোর সময় প্রেমের স্পর্শ যেন বাড়ে। তৃষাকে নিজের কাছে টেনে আসার আগেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। তৃষা ছিটকে দূরে সরে যায়। একটা লাল চেরি মুখে দিয়ে প্রেমের দিকে তাকাতেই বলল, ‘এইবারের মতো ছাড়লাম কিন্তু একটু পর সোনা তোমায় এমন বাতাস দেব, বাতাসের ঠেলায় চোখে জল চলে আসবে।’

প্রেম চলে যেতেই তৃষা দরজা লাগিয়ে দেয়। ড্রয়ার থেকে জলদি একটা পুতুল বের করল। একটা পুরুষ পুতুল।পুতুলের মাথার চুলগুলো সোনালী রঙের। তৃষা সেই চুলের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর বলল, ‘উঁহু এই পুতুলকে কালো রঙের চুলেই ভালো মানাবে। তো পুতুল সোনা তোমার নতুন চুল চাই?’ বলেই তৃষা হাসল। অতঃপর প্রেমের ফোনটা টেবিলের ওপর থেকে হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। প্রেমের ছবিটির দিকে তাকিয়ে গুন-গুন করে গান ধরল,

~প্রেম আমার…..ওওওওও প্রেম আমার।~

চলমান……

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply