Golpo romantic golpo প্রেমতৃষ্ণা

প্রেমতৃষা পর্ব ২৭


#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_২৭ (প্রথমাংশ)

ভালোবাসা আর জ্বর হচ্ছে একে অপরের পরিপূরক। যেমন হঠাৎ শরীরে জ্বর আসে, তেমনি হঠাৎই ভালোবাসা এসে মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। জ্বরে যেমন শরীর কাঁপে, তেমনি ভালোবাসায় মন কেঁপে ওঠে, অস্থিরতা আসে। জ্বরে যেমন ক্ষুধা, ঘুম উড়ে যায় তেমনই এই ভালোবাসাও কিন্তু কখনো কখনো ঘুম,ক্ষুধা সব কেড়ে নেয়। আবার এই জ্বর ধীরে ধীরে কমেও যায় বা সারে, ভালোবাসাও সময়ের সাথে হয় কখনো বা গভীর হয়, নয়তো মিলিয়ে যায়।

এই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরটা অবশেষে চলেই এলো। মুখটা ফুলে কদুর ন্যায় হয়ে গেছে। কম্বলের নিচে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে তৃষা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। শরীরটা কেমন ব্যথা করছে। ভালো লাগছে না কিছু। প্রেম ভাই যে তাকে এত মিষ্টি একটা চুমু দিলো তা নিয়ে যে তৃষা একটু মনে মনে ফূর্তি করবে তারও উপায় কই? এখন তো শরীর নিয়ে নড়তে চড়তেই পারছে না। ইশ প্রেম ভাইয়ের কথা না শুনে সে তিরিং বিরিং করে কেন যে ভিজতে গেল? এখন জ্বরকে তো আর বারণ করে বলা যায় না, ওগো জ্বর তুমি এখন এসো না। প্রেম ভাই মাত্রই আমায় একটা চুমু দিলো। সেঞ্চুরি করার আগে তুমি আমার কাছে আর এসো না। আমি আবার হেব্বি লয়াল মেয়ে। শোয়া থেকে উঠলেই মাথাটা চক্কর দেয় বিধায় শুয়েই দিন কাটালো। হেতিজা এসে মাঝে কয়েকবার দেখে গেছেন। আজকাল তৃষার একটু বেশিই খেয়াল রাখা তার হয়ে যাচ্ছে না? প্রেমা একটু আগেই এসেছিলো। প্রতিবারের মতো এইবারও এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তৃষা আপু বলো না কি করলে প্রেম ভাই গলে যাবে।’

আশ্চর্য প্রেম ভাই কি কোনো বরফ নাকি? যে গলে যাবে। আর ওই বান্দা তৃষা বুক দিয়েছে ওইখানে অন্য কারো নজর মোটেও চলবে না। প্রেম ভাইয়ের প্রেমে পড়ে এখন তৃষা তারই নীতিমালা অনুসরণ করা ধরেছে। যেটা তার সেটা কেবলই তার। কেউ প্রেম ভাইয়ের দিকে নজর দিলে তার সঙ্গে তৃষার তর্ক করার সময় নেই। ওই চোখ দু’টো তুলে পথশিশুকে দান করে দিবে। যেই চোখ তার প্রেম নেওয়াজের দিকে তাকায়, দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দুনিয়া দেখার কোনো অধিকার অন্তত পক্ষে তৃষা রাখবে না। প্রেম ভাই তৃষাকে নাম্বার দেয়নি নিজের। তৃষা ফেসবুক ঘাটাঘাটি করে প্রেম নেওয়াজ লিখে সার্চ করেও কিছু পেলো না। তারপর ভাবল ইন্সটাগ্রামে যাওয়া যাক। ওমা হঠাৎ করে মাথাটা এত বাজে ভাবে ঝাঁকুনি দিলো। শেষে ফোনটা রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না। হঠাৎ বারান্দায় কিছু একটা শব্দ হলো। ঘরের লাইটটা তখন অন করাই ছিলো। তৃষা ভয়ে বারান্দার দিকে তাকালো। হঠাৎ বারান্দার পর্দা ভেদ করে প্রেম বেরিয়ে এলো। তৃষা অবাক হলো। ভাঙা গলায় প্রেমকে বলল,’আরে প্রেম ভাই আপনি ওদিক দিয়ে আসতে গেলেন কেন? রুমের তো একটা দরজা আছে তাই না? হাত-পা যদি ভেঙে যায়? তখন কি হবে?’ তৃষা ওঠার চেষ্টা করতেই প্রেম বলল, ‘যেখানে আছো সেখানেই থাকো। নড়তে বলেছি কি?

তৃষা নড়ল না। তবে একটু অবাক হলো। ওই যে কালকের ওই সফট রোমান্সের প্রেম ভাইটা গেল কই? না থাক সাইকো প্রেম ভাইকেও তো কড়া লাগে একেবারে। প্রেম তৃষার পাশে বসল। হাতের উল্টো পিঠটা তৃষার কপালে ঠেকিয়ে দেখল ভালোই জ্বর এসেছে। প্রেম তৃষাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মেডিসিন নিয়েছো?’

‘ইয়ে মানে আমাদের মাঝে তো কিছু হলোই না। ওইসবের কি দরকার?’

প্রেম তৃষার দিকে ক্ষিপ্ত নয়নে তাকাতেই তৃষা মুহূর্তে বলে উঠল, ‘নিয়েছি তো। নাপা খেয়েছি।’

‘নাপা কিনে পয়সা লস না করে যাও গিয়ে একটা ব্রেন কিনো নিজের জন্য। জ্বর হলে ওই সরাসরি নাপাই কেন খেতে হবে?’

তৃষা চুপ করে নিচের দিকে তাকাতেই প্রেম উঠে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, ‘গোসল করেছো?’

‘ও মাগো ওইসব বিলাসিতা। জ্বর এসেছে আমার। কত অসুস্থ আমি দেখতে পাচ্ছেন না?’

‘ইচ্ছে নেই দেখার। বলেই প্রেম তৃষাকে আচমকা কোলে তুলতেই তৃষা চিৎকার করে উঠল। প্রেম বিরক্তি নিয়ে তৃষার দিকে তাকাতেই সে পুনরায় চুপ হয়ে গেল। প্রেম তাকে শক্ত করে কোলে তুলে নিয়ে গোসল খানায় গিয়ে ঝরনা ছাড়তেই তৃষা দৌড়ে পালাতে নিলো। প্রেম শক্ত করে হাতটা চেপে ধরে টেনে তাকে ঝরনার কাছে দাঁড় করাতেই পানির স্পর্শে শরীর পুরো ভিজে যায় তার। প্রেম এমন ভাবে হাতটা ধরে রেখেছে কোথাও যেতেও পারছে না। নড়চড় তো দূরের কথা। তৃষা পুনরায় নড়ার চেষ্টা করতেই প্রেম তার মুখটা চেপে ধরে বলল, ‘এমন ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছো কেন?

‘আপনি বের হন প্রেম ভাই। আমার লজ্জা করছে।’

‘নেভার। এটা আমার বাড়ি, আমার যখন যেখানে মন চায় যেতে পারি, থাকতে পারি।’

‘তাই বলে একটা মেয়ের সঙ্গে ওয়াশরুমে?’

‘দরকার হলে আরো অনেক জায়গায় যাব। বাই দ্য ওয়ে ফোন থেকে অন্য ছেলেদের নাম্বার ডিলিট হয়েছে।’

‘সব করে দিয়েছি।’

‘শুনেছি কার সঙ্গে ফেসবুকে এড আছো?’

‘কার সঙ্গে?’

‘প্রত্যুষ! ওর সঙ্গে কেন এড থাকবে?’

‘কিন্তু সে তো আপনার ভাই লাগে। সমস্যা কি?’

‘ভাই হোক তাতে কি? বলেছিলাম তো আমি ছাড়া কোনো আউট ছেলে ভার্চুয়াল হোক আর রিয়েলিটি হোক কোথাও যায়গা পাবে না।’

‘আপনি আমায় ভালোবাসেন? কতখানি ভালোবাসেন?’

‘কেন বললে টাকা পয়সা দিবে নাকি? আচ্ছা কত দিতে পারবে? তাহলে ভেবে দেখব, বলা ঠিক হবে কি না?’

‘প্রেমিকরা রোমান্টিক হয় প্রেম ভাই। সব সময় এত তেতো কথা না বললেই কি নয়? ভালো লাগে না হুহ!’

‘কি করলে ভালো লাগবে ম্যাডাম? একটা কষে চড় লাগাই? জ্বরের সঙ্গে রোমান্টিকতার ভূতও পালাবে।’

‘আপনি তো দেখছি অনেক আনরোমান্টিক!’

‘হাসপাতালে বুকিং করে রেখো। কারন প্রেম, প্রেম শুরু করলে এমন মুখ চলা তো দূরে থাক, পা চলার শক্তিও পাবে না।’

প্রেম গায়ের টিশার্ট খুলতেই তৃষার চোখ ছানাবড়া। প্রেম ভাই কিসব দেখাচ্ছে? হেরেজমেন্ট করছে দেখি! ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে চুলে হাত বুলায় নিজের। শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো চকচক করছে। তাতে যেন আকর্ষণীয় একটু বেশিই লাগছে। তৃষা প্রেমের সিক্স প্যাকে হাত রাখতে গেলেই প্রেম খানিকটা দূরে সরে যেয়ে বলল, ‘আরে কন্ট্রোল। আমার লজ্জা বলেও তো কিছু একটা আছে?

‘তাহলে নেংটু হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’ প্রেম তৃষার দিকে তাকিয়ে প্যান্টে হাত দিতেই তৃষা চেঁচিয়ে উঠল। তা দেখে প্রেমকে বলল,’ কি হয়েছে? এসব খুলছেন কেন?’

‘নেংটু বললে কেন? দাগ যেহেতু লাগিয়েই দিয়েছো তবে দাগটা ভালো করেই লাগুক। খোলাখুলির অপবাদ তো লেগেই গেছে। আর প্যান্ট পরেই বা কি হবে?’

তৃষা দাঁত কেলিয়ে নখ কামড়ে বলল, ‘তাহলে দেখি একটু ইয়ে মানে।’

‘আয় দেখাচ্ছি। চোখ দু’টো তুলে একেবারে দেখাবো। ছেলে দেখলেই ইয়ে দেখতে মন চায় খুব সোনা।’

প্রেম ভাই মনের মধ্যে কারফিউ জারি করেছে। এখানে তাকে ছাড়া আর কাউকে জায়গা দিলে পাপ হবে। তৃষা প্রত্যুষকে সব জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এবার প্রেম ভাই এসে জিজ্ঞেস করলে তৃষা বলা ছেড়ে গান ধরল, ‘প্রত্যুষ ভাই আমার ফেসবুকেও নাই

সে আমার ইবুকেও নাই

তাকে আজ পার্মানেন্টলি ডিলিট করতে চাই’

এই প্রেম ভাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখে ঘুম চলে এলো। ভোরের দিকে প্রেম ভাই বারান্দা দিয়ে চলে গেল। তবুও বাতাসে রেখে গেলো তার ধোঁয়াসা স্মৃতি। ইশ লোকটা এত কড়া না হলেও পারত। এখন দেখো একটু পর স্বপ্নে এসেও জ্বালাতন করবে ড্যাম সিউর।

তখন সকাল। তৃষার গায়ে জ্বর জ্বর ভাবটা আর নেই। সবই কবিরাজ প্রেম বাবার কেরামতি। তৃষা তৈরি হয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রেম বের হলেই তার বাইকের পেছনে চেপে বসবে। এক ঘণ্টা আগে বের হয়েছে। না জানি আবার এই লোক কখন হাওয়া হয়ে যায়। বলা তো যায় না। তৃষা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ফোন টিপায় ব্যস্ত। হঠাৎ প্রত্যুষ গাড়ির কাছে যেতে নিয়ে চোখ যায় তার দিকে। কি একটা ভেবে সে এগিয়ে আসে তৃষার দিকে। তৃষার সামনে গিয়ে বলল, ‘এই তৃষা শুনো।’

তৃষা চোখ তুলে চেয়ে দেখল প্রত্যুষকে। আনইজি লাগছে তার। তার ওপর প্রেম ভাই পইপই করে বলে দিয়েছিলো কথার অবাধ্য ব্যক্তিকে যে চরম ঘৃণা করে। তাই সে যেহেতু প্রত্যুষের সঙ্গেও কথা বলতে নিষেধ করেছে তাহলে এখন এটাও করা যাবে না। যাবে না মানে একেবারেই যাবে না। প্রত্যুষ কিছু বলতে চাওয়ার আগেই তৃষা তাকে বলল, ‘প্লিজ আমাকে এভাবে ইগনোর করো না। আজকাল অনেক বেশি ইগনোর করছ। কেন করছ জানতে চাইব না। তবে প্লিজ এমনটা করো না। আমিও মানুষ বুঝলে? আমার কি ভুল হয়েছে বলো?’

‘আমি কখন বললাম ভুল হয়েছে? আচ্ছা আমার ভার্সিটি আছে। আমি যাই কেমন?’

তৃষা যেতেই প্রত্যুষ তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো। তৃষা একবার হাতের দিকে তাকালো। হাত ধরেছে এটার জন্য না বরং প্রেম ভাই জানতে পারলে মিসাইল তার পেছন দিয়ে দিবে এই ভয়ে। তৃষা হাত ছাড়িয়ে নিতেই প্রত্যুষ একটু অবাক হলো। কিন্তু ব্যাপার না। মেয়ে মানুষ, অস্বস্তি বোধ হতেই পারে। পুনরায় প্রত্যুষ তাকে বলল, ‘আমার তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

‘কিন্তু এখন?’

‘হুম। তুমি চাইলে এখানে দাঁড়িয়েই বলতে পারি। আর নয়তো এই যে একটু সামনে গিয়ে কফিশপে বসব। কথা বলব আর চলে আসব।’

‘কত সময় লাগবে?’ দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করল তৃষা।

‘১০ মিনিট জাস্ট। এখানেই বলতে পারি কিন্তু।’

তৃষা একবার প্রেমের আসার পথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ না এখানে ঝামেলা করার দরকার নেই। চলুন।’

তৃষা যেতেই ল্যাপটপটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলল প্রেম। কেন ফেলল মন জানে কিন্তু মুখে বলতে ইচ্ছে করছে না। এই বাড়িতে যতগুলো সিসিটিভি ক্যামেরা আছে সবই প্রেমের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে। কোথায় কি হচ্ছে প্রেমের জানা বাকি নেই। হ্যাঁ হিডেন ক্যামেরা গুলোও সে নিয়ন্ত্রণ করে। তার স্টাডি রুমে বিরাট মনিটর। সারাদিনই চলতে থাকে। সকাল সকাল কি ভেবে আজকে সেখানে গেল। তারপর তৃষা প্রথমে তার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে তো ভালোই লেগেছিলো। কিন্তু তারপর……হায় তৃষা তুমি কি জানো? প্রেমের কথা অবাধ্য হওয়া মানে তার চোখে চোখ রেখে হৃদয়ে আঘাত করা? প্রেম ভুলের শাস্তি দেয়। চরম ভাবেই দেয়। আর যেখানে কথার মূল্য নেই সেখানে সম্পর্কের মূল্যও থাকে না।

বাইক স্টেন্ডে দাঁড়িয়ে আছে তৃষা। বাসায় গিয়েছিলো দারোয়ান বলল প্রেম ভাই নাকি আরো অনেক আগেই বের হয়ে গেছে বাসা থেকে। তবে তৃষা তো ঠিক সময়েই অপেক্ষা করেছিলো। হঠাৎ দেখল সাদা একটা বাইক নিয়ে প্রেম ভাই এদিকেই আসছে। তৃষার খুশির সীমা রইল না। সে দাঁড়িয়ে রইলো। তবে একটুর জন্য না সরলে মনে হচ্ছিলো প্রেম ভাই তার ওপরই বাইক উঠিয়ে দিবে। হেলমেটটা খুলতেই তৃষা তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আরে প্রেম ভাই! আপনার না কালো বাইক ছিলো? এমন সাদা রঙ হলো কেমন করে? ফেয়ার এন্ড লাভলি লাগিয়েছিলেন নাকি?’

প্রেম কোনো জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যেতেই তৃষার এবার রাগ হলো। সে সামনে দাঁড়িয়ে প্রেমের হাত ধরতেই প্রেম একবার তার হাতের দিকে তাকালো। তারপর তড়াক কণ্ঠে বলল, ‘হাত ছেড়ে সামনে থেকে সর।’

‘আপনি না আমায় ভালোবাসেন তাহলে এমন করছেন কেন?’

প্রেমের এবার রাগ উঠে যায়। সে তৃষার হাত শক্ত করে ধরে তাকে খোলা আঙ্গিনায় নিয়ে গিয়ে বলল,’তুই কি চাচ্ছিস আমার থেকে? আমার সঙ্গে শোয়ার ইচ্ছে নাকি অন্য কারো সঙ্গেও? ‘

ধমকে ধমকে কথাগুলো বলল তৃষাকে প্রেম। সবাই তাকিয়ে আছে। তবে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। তৃষা বুঝতে পারছে না তার প্রেম ভাইয়ের হঠাৎ হলো কি?

‘প…প্রেম ভাই!’ তৃষা কাঁপা গলায় বলতেই প্রেম চুপ হয়ে গেল। আর একটা কথাও বলল না। তৃষার হাতটা ঝারি মেরে পাশ কাটিয়ে চলে গেল বাইকটা নিয়ে। এত এত মানুষের ভিড়ে তাকে ফেলে রেখে চলে গেল। তৃষার চোখে তখন জল। উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না সে। কেবল এত এত মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে সবটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রেম ভাই এমন করল কেন? তাহলে কি সে তার বিটারহার্টকে ভালোইবাসে না? ওই চুমু? ওই ছোঁয়া, ওই সুন্দর কথা গুলো কি তৃষার জেগে দেখা স্বপ্ন ছিলো?

চলবে?

#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_২৭ ( বর্ধিতাংশ)

আমি আপনারে এমন কইরা হারাইছি, যেমন কইরা শুকনা পাতায় হাওয়ার ঝাপটা আইসা এক নিমিষে উড়াইয়া নেয় দিগন্তের অজানায়। যেমন কইরা রাতের আঁধারে বাতি নিইভা গেলে ঘর অন্ধকারে ডুইবা যায়। আপনি এমন কইরা এই অন্তরে আগুন ধরাইছেন যেমন কইরা খরার তাপে মাঠের ফসল শুকাইয়া যায়, মাটিতে ধুলা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। যেমন কইরা ঝড়ের রাতে বৈঠা ছাড়া নৌকা স্রোতে তলাইয়া যায়। যেমন কইরা মরুভূমির বালু ঝড়ে চোখ-মুখ ঢাইকা দেয়, নিঃশ্বাস পর্যন্ত আটকাইয়া যায়। আপনি আমারে এমন কইরা ফাঁকা কইরা দিলেন, যেমন কইরা মাঘ মাসে খেতের ধান ঠান্ডায় শুকাইয়া সাদা খড় হয়ে যায়। এমন কইরা শূন্য কইরা দিলেন, যেমন কইরা গোরস্থানের মাটিতে নাম লেখা থাকার পরেও সবাই একা রইয়া যায়।

এমন কইরা শেষ করলেন, যেমন কইরা শীতের ভোরে হঠাৎ কুয়াশা নাইমা আইসা পথঘাট ঢাইকা ফেলে, মানুষ পথের দিশা হারায়। এমন কইরা আমারে আপনে ভাঙলেন, যেমন কইরা বর্ষার নদী হঠাৎ বাঁধ ভাঙা স্রোতে জমির সব ফসল ভাসাইয়া নিয়ে যায়। এমন কইরা পোড়াইলেন যেমন কইরা বিদ্যুৎতের শর্টসার্কিটে দোকান ঘর পুড়লে মানুষ বুক চাপড়ায়া শুধু তাকাইয়া নিজের ধ্বংস দেখে। শেষে সব হারানোর পর মানুষ যেমন চুপ কইরা দাঁড়ায়, বুকের ভেতর কান্না ভাতের বলকের মতো উতরাইয়া পড়লেও মুখ থ্যাইকা শব্দ বাইর হয় না। আমি ঠিক তেমন চুপ কইরা গেলাম। আমার ভিতরে ভিতরে আগুন জ্বলে, কিন্তু সেই আগুন নিভানোর পানি আপনি নষ্ট কইরা দিলেন। তবুও হারানোর বেদনা নিয়াও কইবার চাই আমি আপনারে ভালোবাসি। আপনারে না পাইয়াও ভালোবাসি, হারাইয়াও ভালোবাসি, ধ্বংস হইয়াও ভালোবাসি। আপনি পুড়াইলে আমি পুইড়াও আপনারে ভালোবাসি।

এই টুকু লিখেই হাতের কলমটা থামিয়ে দিলো তৃষা। আজকে তিনদিন হলো প্রেম তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। যেই প্রেম নিজে গিয়ে তৃষাকে ক্লাস রুম থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করত তার জন্য এখন তৃষা ছুটির পরও একইভাবে অপেক্ষা করে। সময় ফুরায় তবে অপেক্ষা যে আর ফুরায় না। তৃষা এখনো বুঝতে পারছে না তার অপরাধ কি? প্রেম ভাই মুখে ভালোবাসি না বললেও তো ভালোবাসত। এই যুগের মেয়ে তৃষা। দুধ-ভাত খায় না। সবই জানা আছে। ক দিয়ে যে মানুষ কলকাতা ঝোঝায় অন্তত তা জানতে বাকি নেই। ওই লোকটা তাকে ভালোবাসে। মুখে ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয় না। ওইটা মানুষের কর্মে ফুটে ওঠে। তাহলে কি হলো হঠাৎ করে? সব তো ঠিকই ছিলো। মনে হলো একটা কলি ফুটার আগেই কেউ ইচ্ছে করে ছিঁড়ে ফেলেছে। এই তিনটে দিন প্রেম ভাইয়ের থেকে দূরে থেকে মনে হয়েছে দুনিয়াটা ফাঁকা। চারপাশে কিছু একটা নেই। তৃষার একবার শ্বাস কষ্ট উঠেছিল। সেইবার শ্বাস নিতে একপ্রকার কষ্টই হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিলো এই তো মারা যাবে। গত তিন দিন তৃষার ঠিক ওই অনুভূতিটাই হয়েছে। এখনো মনে হচ্ছে মৃত্যুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে। দরজাটা একটু একটু করে খুলছে। তৃষা সারা রাত জেগে কেঁদে কেটে শেষে চোখের নীচটায় কালো করে ঠিক করল অনেক হয়েছে। আজকে সারা রাত ভিখারির মতো প্রেম ভাইয়ের দুয়ারে বসে থাকবে। প্রেম ভাইয়ের তো উচিত অংকুর ভাইয়ের ঠ্যাং তো বিশেষ পানি খাওয়া। এই যে শিমলার সঙ্গে ক’দিন হলো তার প্রেম হয়েছে এখনই তাঁদের প্রেম একেবারে জমে ক্ষীর। শিমলার মনে হয় বাসা থেকে ছেলে দেখছে। বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। বেশি তিরিং বিরিং করলে যে কোনো মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে পালাবে দু’জন। আর প্রেম ভাইকে দেখো প্রেম করা তো দূরে থাক এখন যেমন ভাব দেখাচ্ছে মানুষ তো তার কিং কোবরা এক্সের সঙ্গেও এমন আচরণ করে না। তৃষা রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির কাছ দিয়ে নামতেই সিদ্দিক নেওয়াজ আর মোখলেসকে দেখতে পেলো। চিন্তিত মনে হচ্ছে সিদ্দিক নেওয়াজকে। তৃষা একবার জিজ্ঞেস করবে ঠিক করেও করল না। শেষে বাইরে এসে সরাসরি প্রেম নেওয়াজের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। বাড়ির চারপাশে গাছগাছালি। ডান পাশে একটা ফুলের বাগান। সেথায় হরেক রকমই ফুল আছে। তবে যেই ফুলটা বাগানের মূল আর্কষণ তা হচ্ছে প্রিমরোজ। এই প্রিমরোজ নামটা শুনলেই একটা মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। সেই প্রিমরোজ ব্র্যান্ডের আঁধার। আঁধার বলেই হয়তো তাকে কেউ দেখেনি। তবে তার গলার স্বরটা একজন মানুষের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে। মাঝে মাঝে অবাক লাগে। দু’জন মানুষ কি কোনো ভাবে আবার এক জনই নয় তো?

সেদিন লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেম ভাইয়ের মেইন ডোরের পাসওয়ার্ডটা দেখেছিলো তৃষা। ওইটা কতবার টিপাটিপি করে এপ্লাই করল তৃষা তবে কাজে দিলো না। গোলামের পুতে পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেছে। ইশ ঢং দেখলে বাঁচি না। ঘরে ঢাললে বাইরে পরে শালার। পাসওয়ার্ড লক লাগাতে হবে। তালা হলে না হয় ভেঙে ঘরে ঢুকে ওই হারে বজ্জাতের চকলেট আর স্ট্রোবেরি গুলো সব চুরি করত। তখন দেখা যেত কি খায় সে! তৃষা কোনো উপায় না পেয়ে ঠিক করল আজকে সারা রাত দরজার সামনেই অপেক্ষা করবে সে। একসময় না এক সময় তো আসবেই ওই লোক। এবার তার ব্রান্ডের জিনিসে বিলাই চিমটি ঘষে দিবে কিংবা ভেতরে কিছু একটা ছেড়ে দিবে। এখন তৃষা তো প্রেম নেওয়াজের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারল না না হয় ওই পোকামাকড়ই দেখুক। ওদের ও তো পোকাধিকার আছে।

রাত তখন অনেক। তৃষা দরজার সামনে অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে যখন ঘুমটা ভাঙল তখন নিজেকে আবিষ্কার করল নরম বিছানায়। এই বিছানাটা একটু বেশিই শফট। তৃষা হাই তুলে চুল চুলকাতে চুলকাতে হঠাৎ আবিষ্কার করল কাউচের মধ্যে উপুড় হয়ে খালি গায়ে শুয়ে আছে প্রেম ভাই। ওমা সকাল সকাল এমন অতি লোভনীয় দৃশ্য না দেখলেই কি হতো না? এই যৌবন বয়সে যৌবন সামলাতেও তো তৃষার কষ্ট হয় খুব। তবে হঠাৎ তৃষার মনে পড়ে গেল গত তিন দিনের কথা। তার বুকটা কেমন ভার হয়ে এলো। হঠাৎ দেখল প্রেমের পিঠে কিসের যেন দাগ। তা দেখে তৃষার বুকটা আরো ভারি হয়ে উঠল। সে প্রেমের কাছে গিয়ে পিঠে হাত ছোঁয়াতে যাবে তার আগেই হঠাৎ চারপাশে একবার তাকালো। এত এত মদের বোতল চারপাশে। সিগারেটের ছাই, সিগারেটের বাট পড়ে আছে। তৃষা সাহস করে একবার প্রেমের পিঠে হাত রেখে প্রেমকে মৃদু গলায় ডাক দিলো,’ এই প্রেম ভাই! শুনছেন। সকাল হয়েছে। উঠবেন না?’

পরপর কয়েকবার ডাকার পর যখন কাজ হলো না তখন কাছে এসে শ্বাস চলছে কিনা চেক করতেই হঠাৎ প্রেম থাবা দিয়ে তার হাতটা ধরতেই তৃষা ব্যথায় বলে উঠল, ‘প্রেম ভাই কি করছেন? হাতটা ছাড়ুন বলছি। একটু আসতে ধরলে কি হয়?’

প্রেমের চোখ দু’টো কেমন লাল হয়ে আছে। শরীর যে তার ঠিক নেই খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তৃষা। কেমন যেন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে একটা অচেনা মানুষ তার সামনে উপস্থিত। এটা সেই মানুষ না যাকে সে চিনে। প্রেম উঠে বসল। তারপর তৃষাকে ঝারি মেরে বলল,’ এখনো যাসনি কেন?’

‘আগে বলুন আপনার কি হয়েছে? আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন? আমার অপরাধ কি?’

‘তোর অপরাধ কি সেটা তুই তোর বিবেককে জিজ্ঞেস কর। যাহ বের হ আমার ঘর থেকে। আউট! ‘

‘প…প্রেম ভাই। আপনি তো আমায় ভালোবাসেন। এত নিষ্ঠুর কেন হচ্ছেন? একটু রহম করেন। আমার কি পরিমান কষ্ট হয়েছে যদি আপনাকে বোঝাতে পারতাম!’

প্রেম এবার তৃষার মুখটা চেপে ধরে তাকে ঠেসে ধরল দেয়ারে। তারপর উঁচু গলায় বলল, ‘তোকে একবারও বলেছি ভালোবাসি আমি? আলু আমার পছন্দ না। কারণ কি জানিস? আলু সব তরকারিতে মিশে যায়। তুই হচ্ছিস ওই রকম মানুষ। সবার সঙ্গে মিশে যাস বলেই তোকে জাস্ট ঘৃণা করি। দেখ তোর আর আমার রাস্তা আলাদা। আমরা হলাম দুই পৃথিবী।’ প্রেম তৃষার মুখটা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘যদি তোর এক বাপ হয় তাহলে আর কখনো আমার সামনে আসবি না।’ প্রেম ছাড়তেই তৃষা প্রেমের গালে আচমকা চড় বসিয়ে দেয়। প্রেম কয়েক মুহূর্ত কেবল স্তব্ধ হয়ে রইলো। তবুও কিছু বলে না। চুপ করে রইল। হঠাৎ তৃষা তাকে ধাক্কা দিয়ে কেঁদে উঠল। প্রচন্ড রাগ নিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তুমি নেশা করো তবুও তোমাকে আমি মেনে নিয়েছি, তুমি রাতভোর বাইরে আড্ডা দেও তবুও তোমাকে আমি ভালোবেসেছি, তুমি আমাকে মারো, বকো তবুও তোমাকে আমি কিচ্ছু বলি না। তোমার যখন যা মন চায় করো আমার সঙ্গে, তোমার সব ভুল তবুও আমি মেনে নিয়েছি। আরে ব্যাটা আমার ভালোবাসা তোমার কাছে তামাশা লাগে? তামাশা? তোমার সঙ্গে ভালোবাসার খেলা খেলছি? আমি পুতুল? আমার সঙ্গে যখন যা মন চায় করবে। অধিকার খাটাবে আবার বলবি ভালোবাসি না? আসল কথা কি জানো? তোমার তো বাবা-মা নেই। জন্মের ঠিক ঠিকানা আছে তো? কারণ কোনো ভালো ঘরের ছেলে এমন হতে পারে না। তাই তো মানুষ বলে বাবা-মা ছাড়া সন্তান কখনো ভালো হয় ন….’ তৃষা পুরোটা শেষ করার আগেই প্রেম কষিয়ে চড় বসালো তৃষার গালে। শক্তি দিয়ে গলা চেপে ধরে ধমকে বলল, ‘শেষ তৃষা সব কিছু শেষ। আজকে থেকে প্রেম তৃষা নামক কাউকে চিনে না। এই বাড়িতে হয় তুই থাকবি নয়তো আমি। তুই প্রেমকে এখনো চিনিসনি। এখন চিনবি। হয় তুই ধ্বংস হবি নয়তো আমি। আমার মারতে একটুও হাত কাঁপবে না। খুন করে এই বাড়ির মাঝেই কবর খুঁড়ব খোদার কসম।’

চলবে?

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply