Golpo romantic golpo প্রেমতৃষ্ণা

প্রেমতৃষা পর্ব ২৫+২৬


#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_২৫

ফজরের আজানের প্রতিধ্বনি বদ্ধ ঘরের চারপাশে গুঞ্জর করছে। কালো হুডি পরা মানুষটি সোফায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। সামনের টেবিলে রাখা গাঢ়, টকটকে লাল গোলাপের গুচ্ছ যেন রুমের অন্ধকারে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। লোকটি নাকের কাছে গোলাপের ঘ্রাণ টেনে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মুখোশটি টেবিলের ওপর রেখে সে ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে পুরো ঘরে ছড়িয়ে দিল। পাপড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে হেসে উঠল।

ফোন থেকে বাজছে গান। লোকটি সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাইতে লাগল,

~তুমি ছাড়া আজ একা এ মন

স্বপ্নের লাশঘর

ভেঙ্গে যাওয়া এই বুকের পাঁজর

ধু ধু মরু প্রান্তর

তবু প্রেম এসে ভালোবেসে

আজও দেখা দিয়ে যায়

যেই ছুঁতে যাই, আমি হাত বাড়াই

কেন দূরে সরে যায়?

প্রেম আমার

ও প্রেম আমার…~

গান গাইতে গাইতে সে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে সব জামাকাপড় খুলে ফ্রিজ থেকে বিরাট বরফের চাকা বাথটবের ঠাণ্ডা জলে রাখল। গোলাপের পাপড়িগুলোও সেই জলে বিছিয়ে দিল। তারপর ছুরি হাতে বাথটবে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শান্তি যেন এখনও তার কাছে আসে না। অনিশ্চিত ও বিক্ষিপ্ত মানসিকতায় সে হাতের ওপর ছুড়ি চালাল। রক্ত মিশে গেল বরফের জলে। তৃপ্তি যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠল। একই গান বারবার বাজছে। বাথরুমের দেয়ালে ঝুলানো অসংখ্য ছবি। সবই মেয়েদের ছবি। পাশের দেয়াল থেকে একটি ছবি টেনে হাতে নিয়ে সে হেসে বলল,

“তুমি আমায় কেন ছেড়ে চলে গেলে? দেখো, তুমি চলে গেছো বলেই তোমার মতো সব মেয়েদেরকে আমি নিজ হাতেই ‘সাফাই’ করি। ওরাও যে তোমার মতোই কাউকে ভালোবেসে অন্য কারো সঙ্গে ঘর বাঁধেছে, ওদেরও তো শাস্তি প্রাপ্য।” বলেই সে হেসে উঠল। কিন্তু হাসি যেন তার হৃদয়ের ভাঙা টুকরোগুলোকে আরও প্রকটভাবে প্রকাশ করল। চোখের কোণে অল্প অশ্রু ঝরে তার। যা হাসি ও দুঃখের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ হয়ে তার মুখের রেখা মিহি করে দিল। হাসি আর কান্না দুটি অনুভূতি একত্র হয়ে তার জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেছে। তার প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি কম্পন, অতীতের দীর্ঘ একাকীত্বের গল্প বলছে।মহঠাৎ সে অনুভব করল, তার ঠিক পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই চোখ স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হলো। মেয়েটি ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত রাখল, কোমলভাবে কপালে ঝুঁকে চুমু দিল।

ছেলেটি চোখ বন্ধ রেখেই তার মাথার পেছনে হাত রাখল। ধীরে ধীরে মেয়েটি তার সামনের দিকে চলে এলো। চোখ খোলার সঙ্গে ঠোঁটের কোণে মৃদু মুচকি হাসি ফুটল।

মেয়েটি হেসে বলল,

“তুমি আমাকে কতখানি মিস করেছো?”

ছেলেটি গভীর কণ্ঠে উত্তর দিল,

“যতখানি মিস করা উচিত।”

শব্দগুলো ঘরে প্রতিধ্বনি করল, এবং সেই প্রতিধ্বনি তাদের মধ্যে অদৃশ্যভাবে একটি বন্ধন রচনা করল।

তারপর ছেলেটি মেয়েটিকে বাথটবের মধ্যখানে বসিয়ে ফিসফিস করল,

“মাই ব্লাডরুট কাম।”

মেয়েটি ধীরে তার কাছে এগোলে, তাদের ঠোঁট একে অপরকে স্পর্শ করল। ঠোঁটের স্পর্শে স্নায়ু ছুঁয়ে গেল, হৃদয় গাঢ়ভাবে কম্পিত হলো। হাতের স্পর্শ, নিঃশ্বাসের মিলন, চোখের দৃষ্টি সব মিলিয়ে ঘরে অদ্ভুত আবেশের ছায়া নেমে আসে। ছেলে তার হাতে মেয়েটিকে ধরল, তার গাঢ় চোখের গভীরতায় মেয়েটি হারিয়ে গেল। তাদের শরীর, হৃদয়, মন সব মিলিয়ে এক অনন্ত সংযোগে পরিণত হলো।

যুবরাজের প্রথম দেখায় ওই রাজনীতিবিধের মেয়েকে পছন্দ হয়ে যায়। দেরি না করে সেই রাতেই কাজি ডেকে এনে বিয়ের কাজটা জলদি সারল সে। আগের বার একজন ঠ্যাঙ্গা দেখিয়ে গেছে। বউকে বিয়ের পর জেনেছে এই মেয়ে নাকি আগের থেকেই যুবরাজকে পছন্দ করত। মানে কি আর বলবে? একেবারে লটারি পাওয়ার মতো খুশি হয়েছিল সেই কথা শুনে। এখন সুখে শান্তিতে সংসার করে তৃষাকেও দেখিয়ে দেবে কোন সোনা সে হাত ছাড়া করেছে। সকাল সকাল তৃষার বাব-মা যুবরাজের কাছে এসেছিল। মেয়ের বিষয়ে সাহায্য চেয়েছে। যুবরাজের ইচ্ছে হচ্ছিলো না। তবুও বলল, ‘দেখব।’

বাসায় আসার পর থেকে তৃষার মনটা ছটফট করছে। কিছুই আর তার ভালো লাগছে না। এখন কাউকেও আর ভালো লাগছে না। কারো কথা মনে করতেও ইচ্ছে করছে না। চোখের সামনে বার বার শতবার একটি মুখই ভাসছে। রাতে বলা প্রতিটি কথা কানে কেউ যেন ফিসফিস করে আওরাচ্ছে। এভাবে কি ভালো থাকা যায়? মন বলছে প্রেম ভাইয়ের মধ্যেও অন্য রকম কিছু একটা আছে। মন কেন বার বার চুম্বকের মতো প্রেম নেওয়াজের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? এসব কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। একেবারেই ঠিক হচ্ছে না। বাসায় আসার পর সারাটা দিন কেমন যেন মনটা ব্যাকুল ব্যাকুল লেগেছে। কি নেই কি নেই এমন একটা মনে হচ্ছে। যখন মনকে জিজ্ঞেস করল, মন বলল প্রেম ভাই নেই। ধ্যাৎ এমন তো কখনো কারো জন্য অনুভব হয়নি। এখানে এসেছে ঠিক করে পড়ালেখা করতে। কিন্তু ওই পড়ালেখা বাঁধে সব হচ্ছে। যা না হওয়া উচিত সেই সকল কিছু হচ্ছে। রুমের মধ্যে অনেক ক্ষণ এভাবে বসে ছটফট করে অবশেষে তৃষা না পেরে সুন্দর করে তৈরি হলো। সুন্দর একটা জামা পরে সাজল। ওই যে গত রাতের প্রেম ভাই তাকে একটা জামা দিয়েছিল না? সেথায় এখনো তার পারফিউমের গন্ধ লেগে আছে। তৃষা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকলো। তারপর জামা রেখে এক পা দুই পা করে নিচে নেমে হাঁটা শুরু করল প্রেম নেওয়াজের হাউজ ওফ লাভের দিকে। এই লোকের বাড়ি নাম এমন, নিজের নামটাও এমন। তাও বলবে ভেতরে নাকি প্রেম-ভালোবাসা নেই। ওইসব নিয়ে নাকি তার কোনো ধারণা নেই। তৃষা প্রেমের বাড়ির কাছে যায়। দরজাটা খোলাই। টুকটুক করে ভেতরে প্রবেশ করে সিড়ি বেয়ে দোতলায় প্রেমের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল তৃষা। দরজায় তো পাসওয়ার্ড মারা থাকে। আজকেও কি আছে? আল্লাহর নামে দরজা খুলতেই তৃষা চিৎকার করে উঠে।

“আল্লাহ প্রেম ভাই আপনার লজ্জা নেই।”

প্রেম জলদি প্যান্টটা উপরে তুলে ভাবলেশহীন ভাবে বলে, ” কারো রুমে আসলে নক করতে হয়। এখন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে কেমন মজা লাগল?”

“কি যে বলেন প্রেম ভাই? দেখার আর সুযোগ কই পেলাম? নিচে তো ব্রান্ডের জিনিস পড়েছেন।’

‘কেন তুমি পড়বে নাকি? চাইলে ট্রাই করতে পারো সোনা।’

‘না জানু তোমারটা তুমিই পড়ো। তুমি পড়বে আর আমি সেই দৃশ্য দেখব তাতেই আমার চলবে।’

প্রেম ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই তৃষা চুপসে যায়। তৃষা পারফিউমের বোতলে হাত দিতেই প্রেম বলে উঠল, ‘ এক লাখ বিশ ওইটা। আগামী পাঁচ বছর নেওয়াজ বাড়িতে কামের ব্যাটির সকল কাজ করলেও তো ওই টাকা উসুল হবে না।’

‘এত বড় অপমান না করলেও পারতেন।’

‘প্রেম নেওয়াজের আবার ছোট জিনিসে পোষায় না।’

তৃষা লজ্জায় মুখে হাত দিতেই প্রেম মুখটা কুঁচকে বলল, ‘তৃষা শরীর সুস্থ আছে? চলো ডাক্তারের কাছে যাই।’

‘মনের অসুখ ডাক্তারের ঔষধে ভালো হয় না গো প্রেম ভাই।’

‘তাহলে ঝাড়ু এনে দেই দু’টো বারি।’

‘প্রেম ভাই!’

‘বলো সোনা…..’

‘আচ্ছা আমি এখন আসি। অনেক কাজ আছে।’

তৃষা মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতে নিয়ে মনে মনে সুধায়, ‘একবার জিজ্ঞেস করুন কোথায় যাচ্ছি। থামতে বলুন প্রেম ভাই।’ তৃষা যাওয়ার জন্য ঘুরতেই প্রেম পেছন থেকে তার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে আনতেই তৃষা প্রেমের চোখে চোখ রাখল। কেমন জানি অন্য রকম অনুভূতি হলো তার। প্রেম তৃষার চুলে হাত বুলিয়ে নাকের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে গন্ধ শুকলো। তারপর বলল, ‘কোথাও যাওয়া হচ্ছে?’

‘জাহান্নামে। ‘

‘ওখানে তোমায় একা ছাড়ি কি করে?’

‘তাহলে চলুন।’

‘ঠিকানা প্লিজ।’

‘বাংলাবাজার বইয়ের দোকানে।’

‘বই কিনতে যাবে? আমার কাছে সব বই তো আছে। এখান থেকে নিয়েই পড়তে পারো।’

‘উপন্যাসের বইয়ের কথা বলছিলাম।’

‘টাকা আছে? আচ্ছা টাকা লাগবে না। প্রেম নেওয়াজ তো নিজেই একটা টাকার গোডাউন। সেই না হয় তোমার সঙ্গে যাবে।’

‘আপনি যাচ্ছেন।’

‘যাই যদি কারো উপকারে আসতে পারি। তবে বদলে কি দিবে?’

‘যা আপনার খুব দরকার।’

‘কি দরকার?’ প্রেম আরো কিছু বলার আগেই তৃষা পা উঁচু করে প্রেমের শার্টের কলার টেনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ঠোঁটে মুহূর্তেই একে দেয় ভালোবাসার পরশ। ভালোবাসার উষ্ণতায় হারিয়ে যায় সে। প্রেমও তাকে শক্ত করে চেপে ধরে। কোমরে হাত রেখে টেনে জড়িয়ে নেয় বুকে।

‘এই আমার কি দরকার বিটারহার্ট?’ তৃষার মুখের সামনে প্রেম তুরি বাজাতেই হুঁশ ফিরল তার।

‘এই মেয়ে মুখে কয় কেজি লাল রঙ লাগিয়েছো? নিশ্চিত কম দামি বেজাল প্রোডাক্ট। নইলে মুখ এমন লাল হচ্ছে কেন হঠাৎ? ‘ তৃষা ভালো করে প্রেমকে দেখল। তার মানে কিছুই হয় নি তাদের মাঝে? ছ্যাহ কি বাজে কল্পনা ছিল। প্রেম ভাই জানলে কি হবে? কি লজ্জা কি লজ্জা!

চলবে?

#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_২৬

বাংলাবাজার। বইয়ের অদ্ভুত নগরকেন্দ্র। যেখানে বইয়ের পাহাড় মানুষ-গড়া নগরের কোলাহলকে ম্লান করে দেয়। সরু গলিপথগুলোতে ধূলিমলিন কাঠের তাক গিজগিজ করে বইয়ে ঠাসা। যেন শতাব্দীর জ্ঞানভাণ্ডার একত্রিত হয়ে এখানে বসত গেড়েছে। দোকানের সাইনবোর্ডগুলো বিবর্ণ, তবু অক্ষরগুলোয় লেগে আছে অমোঘ টান। কালির গন্ধ আর মলাটের গন্ধে ভরে উঠেছে বাতাস। বই বিক্রেতারা সিংহাসনবিহীন রাজা। এই যে তাঁদের কণ্ঠে বাজে দরকষাকষির সুর, পাঠকজনেরা যেন ধন-শিকারি, খুঁজে বেড়াচ্ছে হারানো কোনো মহাগ্রন্থ বা দুর্লভ সংস্করণ এসব তো কোনো রুপকথার থেকে কম যায় না। দিনের প্রখর রোদে ধাতব ছাদের নীচে উষ্ণতা জমে ওঠেছে। তৃষা বই দেখছে। দাম দরকষাকষি করছে। প্রেম তাকিয়ে আছে তার দিকে। কে ভাবছে কে জানে? কিন্তু তৃষার এখন সেই সব দেখার সময় নেই। প্রেম ভাই বলেছে বই কিনে দিবে। টাকা তো আর তার পকেট থেকে যাচ্ছে না। যাচ্ছে প্রেম নেওয়াজের পকেট থেকে। তৃষার তাতে কি? তবে একটু পর পর আবার অনেক কিছু মনে হচ্ছে। এই যেমন প্রেম ভাইয়ের টাকা ইন ফিউচার তো তারও টাকা হতে পারে। হতে পারবে এটা ঠিক হবে হওয়ার রাস্তাটা বড্ড বেশি কঠিন। যেই শক্ত মনের মানুষ! তৃষা এক হাতে নীল শাড়ির আঁচল সামলে, অন্য হাতে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। দোকানির সাথে দরকষাকষিতে তার কণ্ঠ দৃঢ়,

“না ভাই, এই দামে বই বিক্রি চলবে না। দেখেন না মলাট তো প্রায় ছিঁড়েই গেছে।”

প্রেম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য হাসি। দোকানি বিরক্ত হয়ে তাকায়, কিন্তু শেষমেশ কিছুটা কম দামেই বইটা এগিয়ে দেয়। তৃষা বইটা হাতে নিয়ে ফিসফিস করল,”প্রেম ভাই, জানেন? বই কেনা আসলে প্রেমের মতো। দরকষাকষি আছে, জেদ আছে, শেষে যদি মনের মতো পাওয়া যায়, তাহলে আনন্দের শেষ নেই।”

প্রেম তাকিয়ে থাকে তার চোখে। “কিন্তু সব প্রেমের দাম দেওয়া যায়? কিছু তো এমন আছে, যেটার দাম চুকানো অসম্ভব।”

তৃষা হেসে ওঠে, বইটা বুকের কাছে টেনে ধরল, “আপনি বলতে চাইছেন, কিছু বই বা কিছু মানুষ অমূল্য?”

“হুম। কিছু বই যেমন বারবার পড়লেও পুরোনো লাগে না, কিছু মানুষও আছে যাদের কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে প্রতিদিন। বার বার, শতবার। তারা কখনো পুরোনো হয় না।”

তৃষার হাত কেঁপে ওঠে বইয়ের পাতায়। সে চোখ সরিয়ে তাকায় মলাটের দিকে। “তাহলে কি আমি এমন একটা বই খুঁজছি? যেটা প্রতিদিন পড়লেও মনে হবে নতুন?”

প্রেম কাছে এসে দাঁড়ায়, কণ্ঠ নরম হয়। “তুমি শুধু বই খুঁজো না, সঙ্গে খুঁজো একটা গল্প। এই ধরো যেমন মানুষ পেলেই হয় না। মানুষটার থাকতে হয় একটা মন। সুন্দর মন না হলে সুন্দর চেহারা, সুন্দর মানুষের কোনো মূল্য আছে? বই ও ঠিক তেমন। মলাট কিংবা প্রচ্ছেদ সুন্দর হলেই যে বইয়ের গল্প সুন্দর হবে তেমনটা নয়।”

তৃষা ঠোঁট চেপে হাসে।” জানেন কি গল্পের নায়িকা হওয়া এত সহজ না, প্রেম ভাই। বইয়ে যত সহজ লাগে, বাস্তবে রাস্তাটা অনেক কঠিন।”

“তবু না পড়া যায়, না ফেলে দেওয়া যায়।”

তাদের চোখ এক মুহূর্তের জন্য আটকে যায়। বাংলাবাজারের মতো শহরে হঠাৎ নেমে আসে প্রবল বৃষ্টি। গলির সরু পথগুলো মুহূর্তেই কাদামাটির স্রোতে ভরে উঠল। ধুলোমলিন কাঠের তাক, বিবর্ণ সাইনবোর্ড, আর বইয়ের দোকানগুলোর সামনে দ্রুত টাঙানো হচ্ছে নীল-সবুজ ত্রিপল। বিক্রেতাদের চিৎকারে ভরে গেল চারদিক, “এই দিকটা ঢাকো, বই ভিজে যাবে!”

তবু বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ সব কোলাহল ঢেকে দিল। টিনের চালায় পড়া ফোঁটার আওয়াজ যেন অসংখ্য ঢোল একসাথে বাজছে। বাতাসে মিশে গেল ভেজা কাগজের গন্ধ। কালির সাথে মিশ্রিত এক অদ্ভুত মাদকতা। রাস্তার কোণে জমে উঠল পানির ছোট ছোট গর্ত, যেখান দিয়ে ছুটে চলল কাগজের টুকরো, পুরনো পোস্টার, ভিজে যাওয়া বুকলেট। চারদিকে ছাতা নিয়ে হুড়োহুড়ি, কেউবা ছুটে যাচ্ছে দোকানের ভেতর, কেউবা ভিজে যাওয়াকে মেনে নিয়েছে অবধারিত নিয়তির মতো।

আকাশ ঝুলে আছে নেমে আসা মেঘের ভারে, কোথাও বিদ্যুতের ঝলকানি, কোথাও বজ্রের গর্জন। অথচ সেই ভিজে যাওয়া বাংলাবাজার যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দোকানের ছাউনির নিচে এতক্ষণ তৃষা আর প্রেম দাঁড়িয়ে ছিল। মনটা ভীষণ খুশি। আপাতত উইশলিস্টে ২৭৮ টা বই জমা করেছিল। সব গুলো প্রেম ভাই তাকে তাকে এমনি গিফট হিসেবে দিবে বলেছে। বইয়ের দাম দেওয়া শেষ। তবে বাসায় নিয়ে যাওয়ার অবস্থায় নেই। শেষে প্রেম বাড়ির ঠিকানা দিলো। হোম ডেলিভারি হবে। পরবর্তীতে এক হাজারের যেন বইয়ের লিস্ট ছাড়া তৃষা এখানে আসে না তাও খুব করে শাসিয়ে বলল প্রেম ভাই। ছাউনির নিচে তৃষা বার বার হাত ছুঁয়ে বৃষ্টির স্পর্শতায় ডুবে যাচ্ছিলো। শেষে না পেরে প্রেম কে বলল, ‘একটা অনুরোধ রাখবেন কি?’

‘শুনি।’

‘বৃষ্টি পড়ছে প্রেম ভাই।’

‘কেন তুমি কি চাও বৃষ্টির বদলে হিসু পড়ুক?’

‘আরে তা কোথায় বললাম। এই প্রেম ভাই চলুন না ভিজি। আপনার সমস্যা হলে বলুন। আমি একাই ভিজব।’

‘গায়ে এক ফোঁটা পানি তো লাগুক একবার ম্যাডাম আপনার।’

‘স্যার দয়া করে এত কঠোর হবেন না।’

প্রেম তৃষার মুখের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে শেষে বলল, ‘আচ্ছা ভিজো। কিন্তু শরীর যেন না ভিজে।’

‘মানে কি? আমি ভিজলে শরীর কি না ভিজে থাকবে নাকি?’

‘শাড়ি ভালো পড়েছো কিন্তু ভিজে গেলে তো গায়ের সঙ্গে লেগে যাবে। পুরুষ মানুষের নজর কেমন আইডিয়া আছে?’

‘আপনিও তো পুরুষ মানুষ।’

‘আমি আর আর দশটা পুরুষ এক হলাম কি? সবার সব জায়গায়, সব কিছুতে অধিকার খাটেনা। আর তুমি হচ্ছো তোমার ফিউচার স্বামীর সম্পদ। তোমার শরীর কেন অন্য পুরুষ দেখবে?’

‘আপনি যে দেখছেন।’

‘আমি যে অন্য পুরুষ নই বোকা মেয়ে। আমি তো তোর ব্যক্তিগত পুরুষ।’ ধীরে বলল প্রেম। তৃষা সেই কথা বুঝতে পারল না। বলল, ‘কিছু বললেন নাকি? মনে মনে গালি দিচ্ছেন না তো আবার?’

‘যাও ভিজো গিয়ে।’ বলেই প্রেম ওপরের শার্টটা খুলে রাখতেই তৃষা বলল, ‘নেংটু হচ্ছেন কেন?’

‘আরে শার্টটা ভিজলে সমস্যা।’

‘কিসের?’

‘তোমার তো গা ভিজে যাবে। ভিজা যা নিয়ে মানুষ দেখিয়ে তো বাড়ি নিয়ে যেতে পারি না? শার্টটা পরে গায়ে জড়িয়ে নিবে।’

তৃষার ভেতরে কেমন অনুভূতি হচ্ছে তা সে নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারবে না। এই লোকটা বদ থেকে ভালো কি করে হয়ে যাচ্ছে। আর তৃষা কেন বার বার তার মোহে অন্ধ হচ্ছে। তৃষা আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, “জানেন প্রেম ভাই, বৃষ্টি আমার কাছে সবসময় একধরনের মায়া। কি মনে হয় জানেন? মনে হয় আকাশ মানুষকে ছুঁয়ে দিতে চায়, কিন্তু পারে না, তাই অশ্রুর মতো ঝরে পড়ে।”

প্রেম হেসে বলল, “তবে আমার কাছে বৃষ্টি মানে স্মৃতি। যতবার ভিজি, ততবার মনে হয় আগের কোনো দিন আবার ফিরে এসেছে।”

“হয়তো এ কারণেই মানুষ বৃষ্টিকে এত ভালোবাসে। এতে যেমন ভিজে যাওয়া আছে, তেমনি হারানো দিনের গন্ধও আছে।”

প্রেম চোখ নামিয়ে, “তুমি কি জানো ভালোবাসাও অনেকটা বৃষ্টির মতো? যতই আটকাতে চাই, ততই ছুঁয়ে যায়।”

তৃষা মৃদু কাঁপা গলায় বলল, “কিন্তু প্রেম ভাই, বৃষ্টি তো সবসময় শান্তি আনে না। কখনো সে ঝড় হয়ে আসে, ভেঙে দেয় আশ্রয়। ঠিক ভালোবাসার মতো… যা আনন্দও দিতে পারে, আবার বিচ্ছেদের কষ্টও।”

প্রেম তৃষার দিকে গভীর দৃষ্টিতে বলল,”হয়তো ভালোবাসার আসল সৌন্দর্যই এখানেই—তার ভেতরে আনন্দও আছে, কষ্টও আছে। যেমন কোনো গল্প শেষ হয়ে গেলেও তার স্মৃতি বেঁচে থাকে।”

“তাহলে… যদি কোনোদিন এসব গল্প যদি শেষ হয়ে যায়?”

প্রেমের চোখে বৃষ্টির ফোঁটা আর না-বলা কথার মিশ্রণ, “শেষ হলেও গল্পটা মুছে যাবে না, তৃষা। তখনও মায়া থাকবে, স্মৃতি থাকবে… আর হয়তো বৃষ্টির মতোই ভালোবাসা ফিরে আসবে অন্য কোনো রূপে।”

তৃষা তখনো দাঁড়িয়ে আছে ভিজে যাওয়া রাস্তায়। নীল শাড়ি ভিজে গা বেয়ে ঝরে পড়ছে ফোঁটাগুলো। প্রেম তার পাশে। দু’জনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চারপাশে বইয়ের দোকানদাররা ছুটছে। হঠাৎ প্রেমে টেনে তৃষাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতেই তৃষার বুকটা কেমন ভার হয়ে গেল। তৃষা আশপাশে কেউ আছে নাকি দেখার জন্য এপাশ-ওপাশে তাকাতেই প্রেম তার থুতনি ধরে তাকে নিজের দিকে ফেরালো। তৃষার শ্বাস-প্রশ্বাস যেন আরো তীব্র হয়ে উঠল। শরীরে সৃষ্টি হলো একটা ভয়ানক শিহরণ। প্রেম তার কোমরে হাত রাখতেই যেন শিহরণ হলো আরো তীব্র। আশপাশে তখন কোনো মানুষ নেই। ফাঁকা বাংলাবাজার। দূর থেকে ভেজা বুড়িগঙ্গার কালো জলের ওই কেমন যেন একটা গন্ধ এসে শহরকে অন্যরকম সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলেছে। প্রেম তৃষার চোখে চোখ রেখে বলল,”আমি মানুষটা জানি না কি করে ভালোবাসতে হয়। তবে এই টুকু বলতে পারব যেই জিনিস অন্যের মনের শান্তি নিবারণ করে তাতে আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ জন্মায় না। ওই জিনিসের প্রতি তখন আমার তীব্র ঘৃণার জন্ম হয়। হিমালয় পাহাড়ের কথা শুনেছো না? তার থেকেও উঁচু সেই আমার সেই ঘৃণার পাহাড়।”

তৃষা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, নীল শাড়ির আঁচল বুকের সাথে লেপ্টে আছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন আর গায়ের উপর পড়ছে না, পড়ছে কেবল ভেতরের অস্থিরতার উপর। প্রেমের চোখের দিকে তাকিয়ে সে মুহূর্তে মনে হলো। এই দৃষ্টি ভেদ করে ফেলবে তাকে। তৃষা কাঁপা গলায় বলল,“প্রেম ভাই… আপনি জানেন না আপনার কথা আমার বুকের ভেতর কীভাবে ঢেউ তুলছে। ঘৃণার পাহাড়ের কথা বলছেন? ভালোবাসার মানুষকে ঘৃণা করা যায় বলুন তো? আচ্ছা প্রেম ভাই ভালোবাসা কি দেনাপাওনার মতো?

প্রেম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ভেজা রাস্তায় তাদের দুজনের নিঃশ্বাস যেন বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে।

“ভালোবাসা যদি শুধু পাওয়া আর দেওয়ার হিসাব হয়, তবে সেটা ব্যবসা হয়ে যাবে। দু’টো ভিন্ন শব্দকে এক করলে নতুন শব্দ জন্মায় তবে দু’টো শব্দ একে অন্যের সঙ্গে মিলতে পারে না।’

তৃষা চোখ নামিয়ে ফেলে, আঙুল দিয়ে ভিজে আঁচল মুঠো করে ধরে। প্রেম তার থুতনিটা ধরে আরো কাছে টেনে নেয়। কানের কাছে সুধায়,

“বৃষ্টির ফোঁটায় কাঁপে প্রেয়শীর ঠোঁট, হৃদয়ে জমে প্রেমময় কথা।

যে সে বুঝে না আমায়, বুঝেনা ভালোবাসা

তাকে বোঝাই কেমন করে আমার লুকোনো সকল

ব্যকুলতা?”

তৃষা অস্থির হয়ে যায়, বুক ধড়ফড় করে ওঠে। হঠাৎ সে মুখ ফুসকে বলল,

“তাহলে কেন এড়িয়ে যাচ্ছেন? কেন বলছেন না যে আপনি আমায় চান? আমি তো অন্ধকারে ভিজে যাওয়া বইয়ের মতো আপনার অপেক্ষায় আছি। কাগজ যেমন শব্দ খোঁজে, আমিও তেমন আপনার হৃদয়ের শব্দ খুঁজচ্ছি।”

প্রেম নিঃশ্বাস ফেলে, কপাল ঠেকিয়ে দেয় তৃষার কপালে। “ কেউ একজন বলেছিল চাওয়া মানে নাকি হারানো তাই আমি চাইতে ভয় পাই।

বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এবার আরো জোরে ঝরতে থাকে। ফাঁকা বাংলাবাজার, দোকানের সাইনবোর্ডগুলো কাঁপতে কাঁপতে টপটপ করে পানি ফেলছে। দূরের কালো বুড়িগঙ্গার গন্ধ আরও তীব্র হয়ে আসছে।

তৃষার শ্বাস কাঁপছে। প্রেমের আঙুল এবার তৃষার ভিজে গাল বেয়ে নেমে আসে। প্রেম পুনরায় বল, “হারিয়ে যাওয়ার ভয়টাই আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আমি ভাঙতে ভালোবাসি, ধ্বংস করতে ভালোবাসি। আর তুমি কিনা চাইছো ধ্বংসকারীর ভাঙন জুড়ে দিতে?

তৃষা থরথর করে কেঁপে ওঠে, তারপর ভেজা চোখ তুলে তাকায়। ‘ দুই একটা চাওয়ায় কোনো ক্ষতি দেখছি না।’

প্রেম হঠাৎ তাকে আরো শক্ত করে নিজের বুকে টেনে নেয়। চারপাশে তখন শুধু ঝরঝর বৃষ্টি আর শূন্য রাস্তা। শহর থমকে আছে, কিন্তু তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠছে। ‘ হঠাৎ প্রেম তৃষার হাতে হাত রেখে চোখ চোখ রেখে গলা ছেড়ে নেশালো কণ্ঠে গান ধরে,

~চোখে চোখে চেয়ে থাকা

কবে হবে বলো কথা বলা

আবেগী মন বাঁধা মানে না

তুমি ছাড়া কিছু চায় না……

কি নেশা ছড়ালে? কি মায়ায় জড়ালে?

রাতেরই এ আঁধারে

অজানা ছোঁয়া

মায়াবী চোখে কি মায়া

যেন গোধূলি আবীর মাখা

কি নেশা ছড়ালে!

কি মায়ায় জড়ালে?

কি নেশা ছড়ালে!

কি মায়ায় জড়ালে?~

প্রেম হঠাৎ থমকে গিয়ে নিজের সবটা উজার করে দু’টো ওষ্ঠ একে অন্যের মাঝে হারিয়ে গেল। মিলিয়ে গেলো দু’টো বিপরীত টেউ একে অন্যের সঙ্গে। হারিয়ে গেল দু’টো আত্মা শত ভিন্নতাতেও একত্র হয়ে।

চলবে?

(আজকে রিচেক দেওয়া হয়নি। বানান ভুল অনেক থাকতে পারে। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

পড়ুন ই-বই “চন্দ্রগ্রহণ”

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply