Golpo romantic golpo প্রেমতৃষ্ণা

প্রেমতৃষা পর্ব ২৩+২৪


#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_২৩

জিনজিরার নেওয়াজ কুঠিরের ছাদে দাঁড়ালে বোঝা যায়, এই পুরোনো দালানের প্রতিটি ইট শত বছরের কাহিনি বয়ে বেড়াচ্ছে। ইটের গায়ে শ্যাওলা, কোথাও কোথাও পুরোনো রেলিংয়ে মরচে ধরেছে, তবু তার মধ্যেই রাজকীয়তার ছাপ। চারদিক জুড়ে বুড়িগঙ্গার বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বিকেলের আলো ধীরে ধীরে নরম হয়ে এসেছে। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, তার লালচে আভা মিশে গেছে আকাশের বেগুনি আর নীলের সাথে। দূরে নদীর ওপারে ছায়া নেমে আসছে, পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ঘরে ফিরছে। এই ছাদের কার্নিশেই বসে আছে তৃষা আর প্রেমা। নিচে তাকালে দেখা যায়, সরু গলিঘুঁজি, টিনের চাল, আর ধোঁয়া ওঠা চায়ের দোকান। ওপরে কিন্তু অন্য জগৎ। একটা শান্ত, স্নিগ্ধ, গভীর আবহ।

তৃষার খোলা চুল বাতাসের সঙ্গে দোল খাচ্ছে। প্রেমা তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচ দিবে প্রেমা। তৃষাকে বলার পর সে সাহায্য করবে বলেছে। ছাদে নাচের অনুশীলন করেছে একটু আগেও। এখন একটু বিরতি। দু’জনেই মোটামুটি ক্লান্ত। আজকে প্রেমা বড়দের মতো কথা বলছে। সদ্য শেষ করা কোরিয়ান ড্রামার এমন হৃদয় বিদারক সমাপ্তি তার মেনে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। প্রেমা তৃষাকে বলল, ” দেখো, সূর্যটা কেমন ডুবে যাচ্ছে। সূর্য ঠিক ভালোবাসার মতোন। কখনো আলো দিয়ে যায়, উষ্ণতা দিয়ে যায়, তারপর হারিয়ে যায় অন্ধকারের ভেতর।”

‘কিন্তু তুমি কি খেয়াল করছো না, সূর্য ডুবলেও আবার ভোরে ফিরে আসে? ভালোবাসাও তাই… হারালেও ফের জন্ম নেয়। হয়তো অন্য রূপে, অন্য মানুষের মাঝে।”

প্রেমা কিছুটা থেমে, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ” তাহলে কি তুমি বলতে চাইছো ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না?”

“হয় না। মানুষ শেষ হয়, সম্পর্ক শেষ হয়, সময়ও বদলায়, কিন্তু ভালোবাসার ওই অনুভূতি… সেটা থেকে যায়, একধরনের অমর হয়ে। যেমন এই কুঠিরটা—জরাজীর্ণ হলেও কত যুগের গল্প বাঁচিয়ে রেখেছে।”

প্রেমা মৃদু কণ্ঠে বলল, “কখনো কখনো মনে হয়, ভালোবাসা মানেই কেবল ব্যথা। যতটুকু পাই, তার চেয়ে বেশি হারাই।”

তৃষা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ না। ভালোবাসা মানেই দেওয়া। ব্যথাটা আসে কারণ আমরা প্রতিদান চাই, আমরা চাই সেটা আমাদের মতো করেই টিকে থাকুক। কিন্তু ভালোবাসা তো স্বাধীন… ওকে বাঁধা যায় না।”

প্রেমা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি মনে করো কেউ আমাকে ঠিক ততটাই ভালোবাসতে পারে, যতটা আমি পারি?”

তৃষা কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ আকাশের দিকে তুলে জবাব দিলো, “হয়তো না। আবার হয়তো হ্যাঁ। ভালোবাসার হিসাব হয় না, প্রেমা। তুমি যতটা দিবে, সেটা তোমার। কেউ যদি কম দেয়, সেটা তার। কিন্তু ভালোবাসার সত্যিটা হলো, যতটুকুই হোক, যদি তা সত্যি হয়, তাহলে সেটাই যথেষ্ট।”

“তাহলে তুমি বলছো অসম্পূর্ণ ভালোবাসাই পূর্ণ?”

“হয়তো। যেমন এই আকাশটা। পুরোটা দেখা যায় না কখনো, তবু আমরা তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। ভালোবাসাও তেমনই, প্রেমা… অসম্পূর্ণতার ভেতরেই পূর্ণতা লুকিয়ে থাকে।”

হাওয়া আরও জোরে বয়ে যায়, তাদের দুজনার চুল দুলে ওঠে। ছাদের বাতাস তখন একটু শীতল হয়ে এসেছে। সূর্য প্রায় অস্ত গেছে। বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে ঘন অন্ধকার ধীরে ধীরে ভেসে আসছে। প্রেমা তখনো কার্নিশে বসে আঙুল দিয়ে শ্যাওলা ধরা ইট খুঁটছে। তৃষার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ নরম স্বরে বলল, “একটা প্রশ্ন করব?”

“করো, শুনছি।”

“তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? মানে, কারো জন্য কখনো বুক ধড়ফড় করেছে? কারো নাম শুনলেই চোখ ঝলমল করে উঠেছে?”

তৃষা মুহূর্তেই থমকে যায়, তারপর চোখ সরিয়ে নেয়, “এইসব প্রশ্ন কেন হঠাৎ? ভালোবাসা… মানে… সেটা তো সহজে বলা যায় না।”

প্রেমা হাসি চেপে রেখে বলল, “কেন? ভালোবাসা তো একটা সত্যি অনুভূতি। সত্যিটা লুকিয়ে রাখলে তো সেটা মরেও যেতে পারে। বলো আছে কি তোমার জীবনে কেউ?”

তৃষা গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “আছে কি নেই… সেটা বলা মুশকিল। কখনো মনে হয় আছে, আবার কখনো মনে হয় শুধু কল্পনা। আমি ভয় পাই, যদি বলে দিই, হয়তো হারিয়ে ফেলব।”

প্রেমা কাছাকাছি সরে এসে বলল, “ভালোবাসা বলে ফেলার জন্য নয়, বেঁচে থাকার জন্য। তুমি যদি চুপ করে থাকো, তোমার অনুভূতি কি মরে যাবে না? তুমি কি চাইবে ভালোবাসা তোমাকে কষ্ট দিক, অথচ যার জন্য, সে কিছুই না জানুক?”

তৃষা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কিছু ভালোবাসা আছে, যেগুলো বলা যায় না। বলা মানেই ভেঙে যাবে।”

প্রেমা চোখ স্থির করল, “তা হলে কি তুমি নিজের ভেতরটা কবর দিতে চাও? তুমি কি মনে করো ভালোবাসা লুকিয়ে রাখা মানেই সেটা রক্ষা করা?”

তৃষা একটু থেমে, হালকা অভিমান নিয়ে বলল, “হয়তো। হয়তো কিছু ভালোবাসা প্রকাশ না করলেই সে বেশি সুন্দর থাকে। বলা মাত্রই তার জাদু ফুরিয়ে যায়।”

প্রেমা মৃদু হেসে বলল, “তুমি ভুল করছো গো। ভালোবাসা প্রকাশ করলে তা ভাঙে না, বরং আরও শক্ত হয়। ভালোবাসা হলো নদীর মতো। যতই আটকে রাখো না কেন, সে পথ খুঁজে নেবে। তবে তুমি যদি ভেতরে ভেতরে চাপা দাও, একদিন তোমার ভেতরেই বন্যা হবে। তলিয়ে যাবে তুমি, ডুবে মরবে।”

তৃষা কিছুক্ষণ নীরব থাকে। বাতাসে তার চুল উড়ছে। প্রেমা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীর কণ্ঠ বলে, “আপু বাকি নাচটা।”

“ওহ হ্যাঁ। আসো শিখিয়ে দেই।”

নেওয়াজ কুঠিরের ছাদে বাতাস তখন কিছুটা ঠাণ্ডা। পশ্চিম আকাশে রোদ প্রায় নিভে এসেছে, আকাশের গায়ে মিশে আছে কমলা, বেগুনি আর সোনালি রেখা।কার্নিশের কাছে দু’টো লণ্ঠন টিমটিম করছে। তৃষা আর প্রেমা দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে। নাচের শেষ অনুশীলন শুরু করার জন্য তৃষা এক হাত তুলে ধরল, আঙুলের ভঙ্গিতে গল্প আঁকতে লাগল।

তৃষা নরম কণ্ঠে বলল, “দেখো প্রেমা, হাতের মুদ্রাটা এভাবে তুলবে। কাঁধ সোজা, চোখ সামনের দিকে… নাচ মানেই শুধু শরীর না, মনে মনে একটা আবেশ তৈরি করা।”

সে একপাশে ঘুরে দাঁড়াল, পায়ের তালু ধীরে ধীরে মেঝেতে ঠুকে দিল। কানের পাশে দুল ঝিকমিক করল, চুল উড়ে এসে গাল ছুঁয়ে গেল। প্রেমা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তৃষার গায়ে কালো রঙের শাড়ি। গাঢ় কালো। যেন আকাশের অন্ধকারকে টেনে এনেছে তার চারপাশে। শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে। কখনো তার কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছে, কখনো পেছনে ভেসে উঠছে। কোমরে শাড়ির ভাঁজ এমনভাবে পড়েছে যে তার সরু দেহরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কার্নিশের আলোয় তৃষার সেই সরু কোমর এক মুহূর্তে যেন চোখ আটকে রাখছে। প্রেমাটাকেও লাল শাড়িটিতে দারুণ লাগছে। নাচের সময় তো শাড়িই পড়তে হবে। তাই শাড়ি পড়ে আগেই অনুশীলন করলে স্টেজে নাচতে কোনো সমস্যা হবে না।

কিন্তু পাশের ছাদে অন্য চিত্র। সেখানে পাঁচ-ছয়জন ছেলে জুয়ার তাস মেলে বসে আছে। ঠোঁটে বিড়ির ধোঁয়া, পাশে রাখা টিনের মগে চা আর চুরুট। খেলা থেমে থেমে তাদের চোখ গিয়ে পড়ছে নেওয়াজ কুঠিরের ছাদের দিকে। একজন ছেলে গলায় হাসি চাপতে না পেরে বলল, “আরে দেখ দেখ… দুইজন হুরপরি নাচছে। কি যুগ এলোরে টাকা না বিলিয়েই নাচ দেখা যায়। কত্তো ভঙ্গি করে!”

অন্যজন বলল, “ওই কালো শাড়িওয়ালীটা একেবারে বাজিমাত! শরীরের বাঁক দেখেছিস? সোনার মতো জ্বলতেছে।”

তৃতীয়জনও হেসে বলল, “ওইটারে যদি একদিন কাছে পাই… নাচ কারে কয় দেখাইতাম।”

তাদের অশ্লীল হাসি ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসের সঙ্গে। ধোঁয়ার সাথে মিশে যাচ্ছে সেই শব্দ। সকলের দৃষ্টি তৃষার সরু কোমটার দিকে। শাড়ি ভেদ করা সেই পেটদেশের পদ্মকোষের দিকে। তারা তৃষা-প্রেমার শরীর নিয়ে বাজে মন্তব্যে মেতে ওঠে। তৃষা-প্রেমা তখন নাচের অনুশীলনও ব্যস্ত। ফোনে গান বাজছে তো আশপাশে কি হচ্ছে খবর নেই। ঠিক তখনই ছাদের দরজা খুলে একটা ঝাপসা আলো ভেসে এল। হাতে ঘুড়ির রিল নিয়ে উপরে উঠে এল প্রেম নেওয়াজ আর তার বেস্ট ফ্রেন্ড অংকুর। দু’জনের কাঁধে ঘুড়ির লাঠি, বাতাসে ওড়ানো সুতোয় আঙুলে কাটা দাগ। প্রেমের চোখ পেছন থেকে তৃষার কোমরের ওপর যায়। কেবল যায় না বরং কানে আসে পাশের ছাদের ছেলেগুলোর বিশ্রী সব কথা। প্রেম একটা ঢোক গিলে।ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের ছাদের দিকে তাকায়। চোখ মুহূর্তেই কঠিন হয়ে যায়। ছেলেগুলো তখনো হাসছে, কিন্তু প্রেম নেওয়াজের দৃষ্টি পড়তেই অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে। তৃষা আর প্রেমা তখনো খেয়াল করেনি প্রেমকে। হঠাৎ প্রেম এগিয়ে এসে ফোনের গানটা বন্ধ করে গর্জে উঠল, ‘তোর ম্যাডামকে নিয়ে ঘরে যাহ প্রেমা।”

তৃষা চমকে উঠে পেছনে ফিরতেই প্রেমকে দেখল। কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেম পুনরায় বলল,” প্রেমা! কানে কথা ঢুকে না?”

প্রেমা জলদি তৃষাকে বলল,”আপু জলদি চলো।”

দুজনে নিচে নামতেই ছেলেগুলোও ভয়ে চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নিলো। যেন তারা কিছুই করেনি। প্রেম সম্পর্কে তাদের আইডিয়া আছে। কিন্তু হুট করে যে সে এখানে চলে আসবে তা কেমন করে বুজবে? প্রেম সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে অংকুরের পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বলল, ‘পাশের বাড়ির জুয়াখোরদের সঙ্গে একটু চা-নাস্তার ব্যবস্থা কর তো ভাই।’

তখন সন্ধ্যা। আকাশটা আজকে অন্যরকম সুন্দর। তৃষা রুমে এসে মুখটা ভালো করে দেখে নিলো। ভয় করছে তার। নিজের জন্য তো করছেই সঙ্গে ওই ছেলে গুলোর জন্যও। প্রেম লোকটা আসলেই সাইকো আর জঘন্য ধরনের একজন মানুষ। নেশা করে, মারামারি করে। নিজের যা ইচ্ছে করে। এমন ছেলে কল্পনায় মানায়। সিনেমা, উপন্যাসেই ঠিক আছে। বাস্তবে এদের সঙ্গে অন্তত পক্ষে বসবাস করা যায় না। এই যে প্রেম নামক ব্যক্তিকে নিয়ে যদি একটা গল্প লেখা হতো তাহলে তার জন্য মেয়েলোক এতক্ষণে দেওয়ানা হয়ে যেত। তবে বাস্তব রূপে ওদের ধরে যদি প্রেম ডিম থেরাপি দিতো, জোর করে সবটা হাসিল করে নিতো। ক্ষতর জায়গায় ক্ষত দিতো। সিগারেট দিয়ে কাটা যায়গাটা পুড়িয়ে দিতো বুঝত প্রেম নেওয়াজের উন্মাদনা কতখানি ভয়ঙ্কর! তবুও সমস্যা একটা আছেই। তুই উন্মাদ থাকবি উন্মাদের মতো। তুই কেন এত হ্যান্ডসাম হবি? তোর থাকবে ভুড়ি তোর কেন সিক্সপ্যাক থাকবে? তুই কেন এত গুনি হবি? পাবলিক ভার্সিটিতে কেন পড়বি? এত বড়লোক কেন হবি? এমন উন্মাদ হলে মেয়ে মানুষের চরিত্র তো নয়ছয় হবে। তখন সব দোষ মেয়ে মানুষের। তৃষার মাথাটাই গরম হয়ে গেল। হঠাৎ দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। প্রেম ভাই নাকি? সে এত সুন্দর করে নক করার মানুষ? সে তো দরজা ভেঙে এসে গালে দু’টো চড় বসিয়ে বলবে, ‘হাই বিটরহার্ট চড়টা খুব আস্তে হয়ে গেল নাকি? আরো দু’টো কষে দেই?’ তৃষা ভেতরে আসতে বললেই প্রত্যুষ তার রুমের মধ্যে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে বলল, ‘ওমা কোথাও যাওয়া হচ্ছে নাকি? তোমায় তো দারুণ লাগছে।’ তৃষার কেন জানি আজকে আর লজ্জা লজ্জা পেল না। মনটা আজকাল কেমন যেন উশখুশ করে। মনের বোধ-হয় অসুখ করেছে।

“চলো বাইরে ঘুরতে যাই।”

‘এখন?”

‘হ্যাঁ কেন তুমি ব্যস্ত নাকি?”

‘না তো।”

“তাহলে চলো। শাড়িটা বদলাবে না। এটায় তোমায় কিন্তু দারুণ লাগছে।”

তৃষা কিছু বলল না। যেতে ইচ্ছে করছে না তবুও রাজি হয়ে গেল। নইলে মহাজন যদি মুখ বেজার করে? পুরুষ মানুষের মন তো! বোঝা দায়।

গেটের বাইরে তখন তৃষা প্রত্যুষের সঙ্গে করে বাইরে যাচ্ছিলো। তখন বিষয়টা মোখলেস প্রমাণ হিসেবে কয়টা ছবি তুলে রাখে। নইলে হেতিজাকে বলবে কি করে এদের বিয়ে করিয়ে দেওয়া উচিত জলদি। যাক ভেবেছিল বাড়ির ছেলের বউ খুঁজতে কষ্ট হবে। না একজনের সঙ্গী সে নিজেই খুঁজে নিয়েছে। এখন বাকি এই বাড়ির আসল বংশধর। সেই রোমিওর গলায় বউ নামক গোবরের মালাটা পরিয়ে দিতে পারলেই মোখলেসের বড় একটা দায়িত্ব শেষ হবে। ওদিকে দেখো তার বউ নার্গিস রেখে গেছে বাঁদর একটা ছেলেকে। কোথায় থাকে, কি করে আল্লাহ জানে। একেও এইবার একটা বিয়ে না করালেই নয়। এমন অকামের ছেলে না থেকে বউ নার্গিস থাকলে দু’জনে মিলে রাতে লুকোচুরি তো অন্তত খেলতে পারত। বউ ছাড়া বেঁচে থাকার কষ্ট কেবল পুরুষ মানুষই জানে। জুটিহীনা করে খোদা এই মনে এত রসকষ না দিলেও তো পারত। ছ্যাহ!

সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে হালকা কমলা আভা মিলিয়ে গিয়ে গাঢ় নীল অন্ধকার নেমে আসছে। পুরান ঢাকার সরু গলিগুলোতে লণ্ঠনের আলো। সাইনবোর্ডের ঝিকিমিকি বাতি, আর চায়ের দোকান থেকে ভেসে আসা ধোঁয়া মিলেমিশে এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছে। প্রত্যুষ আর তৃষা হাঁটছে শাঁখারীবাজারের গলি ধরে। চারদিকে কোলাহল, ছোট ছোট দোকানের ভিড়, মিষ্টির গন্ধ, আর পথের ধারে ভাজা-বোন্দার শব্দ।

তৃষা এদিকসেদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, “পুরান ঢাকা একেবারে ছবির মতো লাগে। কত ভিড়, কত আলো। যদিও আমাদের চট্টগ্রাম কম কিসে?

প্রত্যুষ মৃদু গলায় বলল, হ্যাঁ, কিন্তু ভিড়ের ভেতরে কত মানুষ আছে যারা আসলে বাঁচতে পারছে না? কারও স্বপ্ন গলির মতো সরু হয়ে যাচ্ছে, কারও জীবন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।”

তৃষা একটু থেমে যায়। তার চোখ চকচক করে উঠছে সিক কাবাবের দোকানের আগুনের আলোয়। তৃষা উচ্ছ্বসিতভাবে বলল, চলুন, কাবাব খাই। এত গন্ধ পেয়ে না খেলে অন্যায় হবে।

প্রত্যুষ হেসে বলল, “ঠিক আছে।”

তারা এক প্লেট সিক কাবাব আর এক প্লেট শামী কাবাব নিয়ে রাস্তার পাশেই বসে পড়ল। চারপাশে হৈ-চৈ, কেউ দরাদরি করছে, কেউ আবার মশলা মাখছে।

তৃষা কাবাবের টুকরো মুখে দিতেই স্বাদে চোখ দু’টো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে এলো “আহা! দারুণ স্বাদ।”

প্রত্যুষ চোখ মেলে তাকিয়ে বলল, “স্বাদ আছে, কিন্তু দেখো, আগুনে ঝলসাতে ঝলসাতে কাবাবের ভেতরেও দাগ পড়ে গেছে। ঠিক কিছু মানুষের জীবনের মতো, বাইরে রঙিন, ভেতরে পোড়া দাগ।

তৃষা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর হাসির ভান করে বলল, আপনি না থাকলে, হয়তো আমি এসব গভীর কথা ভাবতাম না। আমি শুধু এই আলো-ঝলমল করা পুরান ঢাকাটাকেই তখন উপভোগ করতাম।

প্রত্যুষ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আলোর আসল সৌন্দর্য তখনই বোঝা যায়, যখন কেউ অন্ধকার দেখে আসে।”

খাওয়া শেষে তারা রিকশা নিয়ে সদরঘাটে যায়। নদীর ধারে বসে দু’জনেই হাওয়ায় চুল উড়িয়ে দেয়। দূরে লঞ্চের সাইরেন বাজে, আলো পানিতে প্রতিফলিত হয়।

তৃষা নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, ” নদীটা অন্তত বিচার করে না। শুধু বয়ে চলে।”

প্রত্যুষ চোখ মেলে বলল, “ঠিক বলেছ। জীবনকেও নদীর মতো হতে হয় জানো? নানারকম কোলাহল, দুঃখ, সুখ বয়ে নিয়ে যাওয়া, থেমে না থাকা কত মিল বলো?”

তৃষা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “তাহলে আজ আমরা জীবনটাকে একটু হলেও নদীর মতো করে উপভোগ করলাম, তাই না?”

প্রত্যুষ মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ, তবে মনে রেখো—নদীরও গন্তব্য আছে, সমুদ্র। আর আমাদেরও। শুধু পথটা আমরা কেউ জানি না। খুঁজলেই হয়তো পাওয়া যাবে।”

তৃষা বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সারে দশটার কাছাকাছি আনুমানিক বেজে যায়। প্রত্যুষের আজকে নাইট শিফট আছে। সে বাড়ির গেটের কাছে তৃষাকে নামিয়ে বিদায় দিয়ে সরাসরি কাজে চলে যায়। গাড়ি চোখের সামনে থেকে যাওয়া পর্যন্ত তৃষা দাঁড়িয়ে থাকে। প্রত্যুষ চলে গেলে সে পেছন ফিরতেই আচমকা একটা প্রস্তুর বুকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো প্রেম নেওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে। কি মাতাল করা তার চাহনি। কি তার সুঠাম দেহ। বাদামী রঙের চোখ দু’টো গায়েল করার মতো। উজ্জ্বল শ্যামর্বণের পুরুষটা একটু কম আকর্ষনীয় হলেও পারত। প্রেম তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার ওয়াটার প্রুফ লিপস্টিকটা খেয়েছে কে?’

‘আমিই আর কে?’

‘অন্যকেউ। ‘

‘সরুন রুমে যাব। ঘুম পাচ্ছে আমার।’ তৃষার কানে তখন এয়ারপডস। সে গান শুনছে। প্রেম ভ্রু কুঁচকে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সারাদিন গান শুনো। খেয়ে কাজ নেই? দেখি কি এমন গান শুনো।’ প্রেম জোর করে টেনে এয়ারপডস খুলে নিজের কানের কাছে ধরতেই কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। পরক্ষণেই এয়ারপডস তৃষার কানে লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই গান সবসময় শুনো নাকি?’

‘এই গানই কেন শুনব? আঁধারের গাওয়া আরো অনেক গান আছে। ওর সোলো ব্রান্ড প্রিজরোজের নাম শুনেন নি?’

‘শুনিনি।’

‘প্রাচীন কালের মানুষ দেখি।’

‘তুমি আমার রুমে যাও। আমি দুই মিনিটের মধ্যে আসছি।’

‘আপনার রুমে কেন যাব? আমার কি থাকার মতো জায়গার এতই অভাব পরছে?’

তৃষা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেম তার দিকে সরু চোখে একবার তাকায়। সেই চাহনি দেখে তৃষা বলল, ‘আরে বাবা চোখ রাঙান কেনো? আমাদের মনে হয় চোখ নাই? আচ্ছা ঢং করবেন না। যাচ্ছি তো।’ মনে মনে তৃষা দোয়া ইউনূস পড়তে লাগল। না জানি কপালে কোন শনি ঘুরছে। তৃষা যেতেই প্রেম ফোনটা বের করে অংকুরকে একটা কল করে বলল, ‘তৃষা নুজায়াতের সম্পর্কে ডিটেইলস চাই আমার বুজলি? রাতের মধ্যেই জোগাড় করে দিবি। ‘ বলেই ফোনটা রেখে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল। রুমে গিয়ে দেখল তৃষা নিচ তলায় নেই। মানে কি? এই তৃষা আজকাল বেশিই কথার অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে না? প্রেম এসব আচরণ একেবারেই অপছন্দ করে। সে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যেতেই দেখল তৃষা কর্নারের রুমের দরজা ধরে টানাটানি করছে। বিরক্ত হলো প্রেম। তার ঘরে তৃষাকে সে আসতে দিয়েছে এটাই তো অনেক। এমন হাতাহাতি তো পছন্দ হচ্ছে না। সে তৃষাকে টেনে নিজের কাছে এনে বলল, ‘এটা আমার বাড়ি। তোমার ভাতারের না। তাই এখানে ভদ্র মানুষের মতো শান্তশিষ্ট ভাবে থাকবে।’

‘নিজে তো অভদ্র একটা! বলেই তৃষা নিজের মুখ নিচে চেপে ধরল। মুখ ফসকে খালি ভুলভাল বের হয়।

“যাও রুমে যাও আমার। অভদ্রতার সঙ্গে পরিচয় করাবো তোমায়।” তৃষা মুখ ভেংচি কেটে ভেতরে চলে যায়। প্রেম দরজার হাতল ধরে টানতেই দেখল তালা মারা। পাসওয়ার্ড দেওয়া। বদ্ধ দরজার আড়ালে যা আছে তা আড়ালেই থাক।

প্রেম রুমের কাছে আসতেই দেখল তৃষা একটার পর একটা পাসওয়ার্ড দিয়েই যাচ্ছে তার বেডরুমের লকে। প্রেম আসতেই বলল, ‘হ্যা গো প্রেম ভাই আপনি অনেক বড়লোক তাই না? রুমে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন?’

‘তো তোমার মতো ফকিন্নি নাকি? যাও উল্টো ঘুরো। পাসওয়ার্ড দেখে যদি চোর রুমে ঢুকে কিছু চুরি করে নিয়ে যায়? তার চেয়েও বড় কথা প্রেম নেওয়াজের বেড রুমে চাইলেই সবার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়না।’

‘তাহলে আমাকে কেন আনলেন?’

‘উফফ সোনা বেশি বকো তুমি।’ তৃষা উল্টো দিকে ঘুরতেই প্রেম দরজা খুলল। ভেতরে ঢুকে তৃষা তো অবাক। এত ইউনিক ডেকোরেশন। আর এত বিরাট রুম। তার ঘরটা যেন বিশাল অন্দরমহল। প্রচলিত শোবার ঘরের চাইতেও অনেক বড়, প্রশস্ত। পুরো ঘরজুড়ে কালো রঙের আধিপত্য। দেয়ালে গাঢ় কালো ওয়ালপেপার, যার উপর ঝলমলে সোনালি কারুকাজ আঁকা। মেঝেতে গাঢ় কাঠের ফ্লোরিং, তার উপর বিশাল এক কালো কার্পেট বিছানো, যেখানে পা দিলেই নরমে ডুবে যাওয়া নিশ্চিত। ঘরের মাঝখানে রাখা একটি কিং-সাইজ খাট। কালো পালিশ করা কাঠের তৈরি, মাথার দিকটা উঁচু। চামড়ার কারুকাজ করা। খাটের পাশের জানালার গায়ে ঝুলছে গাঢ় ধূসর সিল্কের পর্দা। খাটের পাশে লম্বা নাইটল্যাম্প, নরম হলুদ আলো ছড়িয়ে ঘরটাকে অর্ধেক অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছে।

ঘরের ভেতরেই আরেকটা বিশেষ এডজাস্ট রুম যাকে ওয়াক-ইন ক্লোজেট বলে। ওটা যেন আলাদা এক জগৎ। সেখানকার সব আলমারি, তাক আর হ্যাঙ্গার কালো কাঠের তৈরি। সুশৃঙ্খলভাবে ঝুলছে তার অসংখ্য জামা-কাপড়, জুতা৷ আশি পার্সেন্ট পোশাকও কালো রঙের। ঘরের এক পাশে কালো পালিশ করা বুকশেলফে সাজানো বই আর কিছু বিরল সিগনেচার আইটেম। প্রাচীন ঘড়ি, শো-পিস আর পুরোনো জিনিসপত্র। অন্য পাশে গাঢ় ধূসর৷ কালো সোফাসেট। মাঝখানে কাচের টেবিলের উপর কালো ক্রিস্টালের ফুলদানিতে নীল প্রিমরোজ ফুল সাজানো। তৃষাকে খাটের ওপর বসিয়ে দেখে প্রেম সাওয়ার নিতে গেল। তৃষা একটু বেশিই অবাক। কারণ আজকের মতো ভন্ডামি আর পাপ সে বিগত এত দিনে কখনোই করেনি। তবে আজকে প্রেম ভাই তাকে বকছেও না মারছেও না। আল্লাহ জ্বীনে ধরল না তো? কবিরাজ কিংবা হুজুরকে ডেকে আনবে কি? তৃষা নিজের পরিহিত কালো রঙের শাড়িটির দিকে তাকালো। এই ঘরের একটা অংশ মনে হচ্ছে এখন তাকেও। বেশ কিছুক্ষণ সময় দিয়ে প্রেম গোসল খানা থেকে বের হলো। কালো রঙের একটা তোয়ালে প্যাচানো তার নিচে। সুঠাম দেহের ভাঁজ গলে ভেজা চুল থেকে টুপটাপ করে জল বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। প্রেম বিছানার দিকে তাকালো। তৃষা সেখানে গুটিগুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। পেটের কাছ থেকে শাড়ি সরে গেছে। প্রেম তৃষার নাভি কঞ্জের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর এক পা দুই পা করে এগিয়ে এসে ঠিক তৃষার সামনে এলো। ড্রয়ার থেকে একটা ইনজেকশন বের করে নিজের হাতে পুশ করল কোনো ভয় দ্বিধাহীনভাবে। এই মেয়ের কাছে গেলে এলার্জির পরিমানটা আরো বেগ পায়। এলার্জির ইনজেকশন তো এখন মাস্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেম তৃষার নাভির দিকে তাকিয়ে মনে মনে সুধালো, ‘আমি যা ছুঁই একবার তাতে অন্যকারো স্পর্শ তো দূরে থাক দৃষ্টিও আমার সহ্য হয় না। তুমি তৃষা বার বার ওই ভুলগুলো করো যা আমার অপছন্দ।’ বলেই সে ড্রয়ার থেকে সরু ছোট্ট এন্টিকাটার টি বের করে তৃষার পেট বরাবর ধরে। মুচকি হেসে একটা মৃদু টান দিতেই ব্যথায় ঘুম ভেঙে চিৎকার করতেই প্রেম চোখ গরম করে মুখ চেপে ধরে তার। সামান্য একটু খানিই কেটেছে। তাতেই গরম রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তৃষার চোখের অশ্রু টলটল করছে। সে আর্তনাদ করেও করতে পারছে না। মুখটা যে চেপে ধরেছে পুরষালী সকল শক্তি খাটিয়ে এই প্রেম নেওয়াজ। প্রেম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে তৃষাকে বলল,’তোকে না বলেছিলাম আমার স্পর্শ করা জিনিসে কারো দৃষ্টি আমার পছন্দ না? সেখানে আরেক বাড়ির পুরুষ তোর শরীর দেখে গায়ের জ্বালা কেমন করে মিটায় রে? আর প্রত্যুষের সঙ্গে তোর এত কিসের ঘষাঘষি? ওহ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার, সাদা চামড়া তাই তোর খুব ভালো লাগে? তো ওকে খুশি করে আজকে কত কামালি জানোয়ার? তোর মশারীর মতো শাড়ি পড়ে রংডং করা তাই না? তুই তৃষা প্রেমকে দেখেছিস তার ডার্ক সাইড এখনো দেখা বাকি। প্রেমের জীবনে দুইটা দরজা। যেখানে আছিস সেখানেই ভালোয় ভালোয় থাক। বদ্ধ দরজার ওপারে গেলে মৃত্যু তোর নিশ্চিত। মরণ কাছে আসলে ফিরে যাবে না। মৃত্যু ভাববেও না তুই কে, অপরাধের পাল্লা কতখানি ভারী। মাইন্ড ইট।”

চলবে?

(৩k+ শব্দের একটা পর্ব। চাইলেই অর্ধেক করে দুই দিন দিতে পারতাম। কিন্তু দিলাম না। রেসপন্স করবেন অবশ্যই।)

#প্রেমতৃষা

#ইশরাত_জাহান_জেরিন

#পর্ব_২৪

কাটা স্থানটিকে ডিসইনফেকশন করে প্রেম তৃষার সামনেই বসল। চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, ‘অভ্যাস করে নাও আমাকে।’

‘আপনি আমার সঙ্গে কেন এমন করেন?’

প্রেম চুপ করে রয়। উত্তর আছে কি তার কাছে?সে কথা না বাড়িয়ে এডজাস্ট রুমে গিয়ে জামা বদলে আসে। ভেতরে সাদা একটা টিশার্ট উপরে লেদারের জেকেট। দারুণ লাগছে তাকে। প্রেম তৈরি হয়ে পারফিউমটা লাগাতেই ঘর একেবারে সুগন্ধে তলিয়ে যায়। তৃষা চোখ মুছে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসতেই প্রেম তার মুখের ওপর একটা জামা ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘এটা পড়ে আসো।’

‘আপনার কত নাম্বার প্রেমিকার জামা এনে আমাকে দিচ্ছেন?’

প্রেম তাকাতেই তৃষা চুপসে যায়। প্রেম বলল, ‘জামা বদলে ফেলো।’

‘আপনি যান।’

‘আমার ঘর আমি এখানেই থাকব।’

‘কিন্তু!’

‘কিন্তু শুনতে চেয়েছি?’

তৃষা মনে মনে প্রেমকে হাজারটা বাঙাল গালি দিয়ে বলল, ‘আস্ত তেঁদড় একটা।’

তৃষা বাধ্য হয়ে ওয়াশরুম থেকে বদলে এলো। এডজাস্ট রুমেও প্রেম তাকে যেতে দেয়নি। বলে কিনা সেখানে দামি দামি জিনিস আছে। ওখানে তোমার মতো ব্যাকটেরিয়া গেলে যদি মহামারী হয়? কত বড় অপমান। তবে আজকে কেন জানি প্রেম নেওয়াজকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে না। কেন? কেন? বার বার এই প্রশ্নটা মনকে করেও কোনো মোক্ষম জবাব তৃষা পেল না। আচ্ছা এই মানুষটা কি কেবল খারাপের চক্রে আবদ্ধ? ভালো নামক একটি শব্দও কি তার ঝুলিতে নেই? আসলে বাবা-মা মৃত। একা মানুষ হয়েছে আর কতই বা ভালো হবে? প্রেম বাইরে থেকে তৃষাকে তাগাদা দেয়।

‘এই মেয়ে এত সময় লাগে? জামা বদলাতে মেয়ে মানুষের এত সময় লাগে নাকি? নদী সাঁতরে ইন্ডিয়ায় যেতেও তো এত সময় লাগার কথা না।’

তৃষা বাইরে আসতেই প্রেম তাকে দেখে এক মুহূর্তে থমকে গিয়ে পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নেয়। তৃষা প্রেমকে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রেম ভাই, আমায় কেমন লাগছে?’

প্রেম পাত্তা না দিয়ে ব্রেসলাইটটা ঠিক করতে করতে বলল,’একেবারে শয়তানের মাসতুতো বোন লাগছে।’

তৃষা আয়নায় দেখল। কালো রঙের এই মিনি টপস আর পোলো জিন্সে তো তাকে হেব্বি লাগছে মাইরি। প্রেম ভাইয়ের রুচি ভালো না। তাইতো পঁচা কথা বলে। সুন্দরী মেয়েকে পঁচা কথা বলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যদি আইনী কোনো ব্যবস্থা থাকত তাহলে প্রেম ভাই এতক্ষণে জেলে চাক্কি পিসিং পিসিং করত। হুহ!

‘যাও গিয়ে বাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াও। আমি এক মিনিটে আসছি।’

‘আমি বাসায় যেতে পারব।’

‘বাসায় যেতে বলেছি? বাইরে যাব।’

‘ঘুরতে যাব?’

‘ না মরতে।’

‘উফ প্রেম ভাই আপনি কত টক্সিক।’

‘তোর টক্সিকের মাইরে বাপ। নিচে যাহ। ‘

যাওয়ার সময় তৃষা বলতে বলতে গেল,”শালায় খালি চিল্লায়।’ পেছন থেকে প্রেম ভাইয়ের জবাব এলো,” না শালী তোমায় খালি চুম্মাবো। যাহ জলদি এইখান থেকে ফকিন্নি।’

প্রেম বাইক স্টার্ট করতেই তৃষা পেছনে বসল। কাঁধে হাত রাখবে ভাবতে না ভাবতেই প্রেম এমন জোরে বাইক স্টার্ট দেয় হাত কেন পুরো শরীর হেলে পরে প্রেমের ওপর। বাইক গেইট থেকে বের হতেই ব্যালকনি থেকে সেদিকে নজর গেল মোখলেসের। মাথায় তো তার পুরাই বাঁশ। না মানে তখন একটার সঙ্গে এখন আরেকটার সঙ্গে? কেমনে কি? শেষে কি দুই ছেলের এক বউ হবে নাকি?

পুরান ঢাকার নিষিদ্ধ বারের জগতটা সবসময়ই এক রহস্যে ঢাকা, যা দিনের আলোতে কেউ দেখে না কেবল রাতের আঁধারেই তার পর্দা উঠে যায়। বারটির বাইরের দিকটা হয়তো ভগ্নদশাগ্রস্ত কোনো পুরনো হাভেলি কিংবা ব্যবসায়িক গুদামঘর মনে হবে। ধূসর দেয়ালে খসে পড়া চুন, লোহার মোটা দরজা, বাইরে টাঙানো একটা মলিন বাতি। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই অন্য এক জগত। দেয়ালজুড়ে সোনালি আর লাল ভেলভেট কাপড় ঝুলছে, যেগুলোকে নরম আলোয় সাজানো ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি আভা দিচ্ছে। মেঝেতে মোটা কার্পেট, যাতে পা রাখলেই শব্দ হারিয়ে যায়। চারদিকে কাঠের টেবিল, যার ওপর সাজানো রঙিন বোতল, কাচের গ্লাস আর বিদেশি মদের ঝাঁক ঝমক। আজকে এখানে কেবল সামান্য কিছু ভিআইপি মানুষজন এসেছে। আজকের পরিবেশ একেবারে শান্ত। ভিআইপিদের প্রবেশের জন্য আলাদা মেম্বারশিপ আছে। প্রেম তৃষাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তৃষার রেফারেন্সের দরকার পরেনি। কারন এই বারের পেছনে তার ইনভেস্টমেন আছে। বারের এক পাশে আস্তে বাজছে স্যাক্সোফোনের সুর। অন্য কোণে কোনো বিদেশি গানের হালকা রিমিক্স। সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে সুগন্ধি ধোঁয়া, যা হুক্কা আর সুগন্ধি মোমবাতির মিশ্রণে তৈরি। দেয়ালের পাশে আধো-আলোয় বসে আছে কৃত্রিম হাসি দেওয়া মেয়েরা। কেউ লাল পোশাকে, কেউ সোনালি গাউনে, আবার কেউ চোখে ভারী কাজল এঁকে দৃষ্টি দিয়ে আকর্ষণ করছে। তাদের হাসি আর দৃষ্টি ভেতরের পরিবেশকে আরও বিভ্রান্তিকর করে তুলেছে।মধ্যিখানে রয়েছে নাচের মঞ্চ। নরম নীল আর বেগুনি আলোয় মঞ্চটা যেন সোনালি স্বপ্নের মতো ঝলমল করছে। গ্লাসে ভেসে ওঠা বুদবুদ, অচেনা মানুষের গলা মিশে যাওয়া, আর ঘরে ভাসমান সুর সব মিলিয়ে মনে হয়, এই বারের ভেতরে ঢুকে বাইরে ফেরা মানেই এক স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠা। এমন এক জগৎ, যেখানে নৈতিকতা নেই, ভয় নেই, কেবল রঙ, আলো, সুর আর অন্ধকারের মাদকতা। এই নিষিদ্ধ বার আসলে সমাজের চোখে আড়াল, কিন্তু বহু ধনীর দুলাল, গুন্ডা, কিংবা ক্ষমতার ছায়ায় থাকা লোকজন রাতের পর রাত এখানে নিজেদের মুখোশ খুলে রাখে। কারও হাতে নারী, কারও হাতে মাদক, আর সবার হাতে লোভ। প্রেম তৃষাকে নিয়ে যখন এখানে ঢুকে, তখন তৃষার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। প্রেম শক্ত করে তৃষার হাতটা ধরে রেখেছে। এমন ভাবে ধরে রেখেছে কেন? কষ্ট দেওয়ার জন্য নাকি হারিয়ে ফেলার ভয়? তৃষা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর বার বার জিজ্ঞেস করছে, ‘চলুন না প্রেম ভাই আমরা এখানে কেন এসেছি। এখানে তো ভালো ছেলে-মেয়েরা আসে না।’

‘তো তুমি কি ভালো মেয়ে নাকি?’

তৃষা জবাব দেয় না। প্রেম তাকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। ইরিনের ট্যাটুঘরে প্রবেশ করতেই ইরিন অনেকটা পরিমাণ খুশি হয়ে যায়। যাবে না কেন? প্রেম তার কাছে জন্মদিন ছাড়া কখনো আসে না। আজ প্রথম এসেছে। খুশি তো হওয়ার কথাই। তবে পরক্ষণেই প্রেমের পাশে অচেনা একটা মেয়েকে দেখে বেশ অবাক হয়। প্রশ্ন জাগে তার মনে। তবে ইরিনকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রেম তাকে বলল, ‘ট্যাটু করব। মেশিনটা দাও তো।’

‘তুমি করবে? আর এই মেয়ে কি হয়?’

প্রেম তৃষার দিকে তাকালো। কি হয় তৃষা তার? কি বলবে? সে প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘কিছু না।’

‘ট্যাটু তুমি করবে?’

‘কৈফিয়ত শুনতে আসি নি।’

ইরিন কথা না বাড়িয়ে মেশিনটা প্রেমের হাতে তুলে দেয়। তৃষা একবার ইরিনের দিকে তাকায়। সারা গায়ে ট্যাটু করা। ছোটখাটো একটা পোশাক পরেছে। ঠোঁটে, ভ্রুতে পিয়ার্সিং করা। নাকের মাঝে একটা নথ। চুলগুলো দেখে কেমন বেগুনি আর সবুজের মিশেলে রঙ করা। ডাইনী ডাইনী এটা ভাব আছে বলতে গেলে। ইরিন একবার তৃষার দিকে তাকালো। এক লহমায় আবার চোখ সরিয়ে নিলো। প্রেম তৃষাকে বিউটি চেয়ারে শুয়ে পড়তে বলল। তাতে তৃষার মাথা বরাবরের মতোই বিগড়ে গেল। ওমা বাসায় কি খাটের অভাব ছিল যে এমন জায়গায় এসে এখন বিউটি চেয়ারে শুয়ে পড়তে বলছে। ইরিনের থেকে মেশিনটা হাতে নিয়ে বলল, ‘তুমি বের হও। আমার কাজ শেষ হলে আমি আসব।’

তৃষা তখনো বুঝতে পারছে না কি করবে। এই প্রেমের উদ্দেশ্য কি। ইরিন মনটা খারাপ করে দরজা লাগিয়ে চলে যেতেই প্রেম ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘ধাক্কা দিয়ে শোয়ানোর আগে শুয়ে পড়ো সোনা।’

‘ছি কী অশ্লীল!’

‘তোর নানায় অশ্লীল।’

‘ তো আসেন চাকু দিয়ে নাড়ি-ভুড়ি আপনার ফাটিয়ে দেই তারপর কবরে নানার সঙ্গে গিয়ে মিলে অশ্লীলতা করবেন।’

প্রেম রাগান্বিত দৃষ্টিতে তৃষার দিকে তাকাতেই সে চুপসে যায়। বিউটি চেয়ারে গিয়ে শুঁতেই চেয়ার টেনে প্রেম তার পাশে বসল। চুইঙ্গাম চিবাতে চিবোতে তৃষার গায়ে হাত দিতেই তৃষা ক্ষেপে বলল, ‘আপনার নামে মামলা দিব প্রেম।’

‘আমি হামলা করার আগেই মুখটা বন্ধ করা চাই।’

প্রেম তৃষার টপসটা উপরের দিকে উঠাতেই ফকফকা পেটটা উন্মুক্ত হলো। তৃষার কান্না চলে আসছে। এই নোংরা লোক তার সঙ্গে সবসময় এমন নোংরামি করে। শালার ব্যাটা ভালোও বাসে না আবার দূরেও যায় না। প্রেম তৃষার পেটের দিকে তাকাতেই তৃষা মাথা উঁচু করে বলল, ‘প্রেম ভাই আপনিও জামা খুলেন। আমিও আপনার পেট দেখব।’

‘সরাসরি বললেই তো পারো, আপনার শরীর দেখলে আমার মনের অবস্থা নাজেহাল হয়। আরেকটু দেখিয়ে আমার মনের বরফটা পুরোপুরি গলিয়ে দেন না।’

‘আচ্ছা ভাইয়া।’

‘এই তুই আমাকে ভাই ডাকবি না। তোর আমার বোন হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই। প্রেমের বোন নেই আর থাকবেও না। মাইন্ড ইট।’

‘তো কি ভাতার ডাকব?’

‘তৃষা!

তৃষা চুপ করে গেল। তবে প্রেম মেশিনটা হাতে নিতেই সে চেঁচিয়ে বলল, ‘ভাতার তুমি আমায় পেটটা ফুটো করে দিও না। ইয়ে মানে প্রেম খালু।’

‘প্রেম ডাকেন জাস্ট। আমার বয়স এতও না যে আপনার মেমসাহেব আমাকে খালু ডাকতে হবে।’

প্রেম শেষবার তৃষার পেটের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একটু কষ্ট হবে। ব্যথাও পাবে। কিন্তু থামব না আমি। যদি খুব বেশি কষ্ট হয় তাহলে আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরো বিটারহার্ট।’

‘আমি ট্যাটু করব না।’

‘করবে কি করবে না শুনতে চাই নি।’ বলেই প্রেম পেটের ক্ষতর দিকে চাইল। আলতো করে ছুঁতেই ব্যথায় তৃষা চোখ বুঁজে নিতেই প্রেম তাকে বলল, ‘উঠে বসো। আর বসে চুল গুলো সুন্দর করে সামনের দিকে নাও। ফাস্ট।’

তৃষা তাই করল। প্রেম তার ঘাড়ের মধ্যে ছোট্ট করে বাটারফ্লাই প্রজাপ্রতির ট্যাটু করে দেয়। করার সময় তৃষা ব্যথায় প্রেমের বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল। প্রেম হাতের দিকে তাকিয়ে বাঁধা দেয় না বরং তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা প্রতিফলিত হচ্ছে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তৃষা বার বার ঘাড়ের কাছের বাটারফ্লাই ট্যাটু দেখার চেষ্টা করছে। যখন ভালো করে দেখতে পেল তখন নিজেই অবাক হলো। না ভালোই তো দেখতে হয়েছে। নিজেকে বড়লোক বড়লোক লাগছে। মনে হচ্ছে সে একটা ফুল আর তাই তার ওপর প্রজাপতি এসে বসেছে। কাজ শেষে প্রেম তৃষাকে নিয়ে নিচে এলো। প্রেমের হঠাৎ জরুরী একটা কল আসে। সে সাইডে গিয়ে অংকুরের ফোনটা তুলেই বলল, ‘কিরে কোনো সমস্যা?’

‘আরে ভাই তোর বাইক রেইস আছে তুই কই?’

‘মানে কি? ক্যান্সেল করতে বলেছিলাম না?’

‘বাজি ধরে ফেলেছি। কিছু করার নেই।’

প্রেম ফোনটা কেটে দেয়। তৃষার কাছে এসে তার মুখটার দিকে তাকায়। সে প্রেমকে বলল, ‘ঘাড় লাল হয়ে গেছে।’

‘ঠিক হয়ে যাবে সোনা। মলম লাগিয়ে দেব।’

তৃষা অবাক হয়ে রইল। প্রেম ভাই এত ভালো করে কথা বলছে? তাও আবার তার সঙ্গে? আসলে প্রেম ভাইয়ের কি দুইটা রূপ? এই ভালো এই খারাপ সে? মানুষ টাকে তৃষা এখনো চিনতে পারছে না। এই বহুরুপী মানুষটাকে আজকাল একটু বেশিই জানতে ইচ্ছে করছে। প্রেম ইরিনকে রুমে ডেকে আনে। যাওয়ার সময় বলে যায়, ‘তৃষাকে রেখে গেলাম তোমার কাছে। ওর যদি কোনো ক্ষতি তো পরের জানাযা টা আমি তোমার পড়ব।’ ইরিন কেবল অবাক হচ্ছে। কিন্তু তার বিষয়টি বুঝতে বাকি রইল না। এত বছর ধরে সে অপেক্ষা করল আর শেষে কোথাকার একটা মেয়ের জন্য তার জানাযা পড়াবে বলছে প্রেম? প্রেমের কি হলো? প্রেম কিছুতেই সে ব্যতিত কারো প্রেমে পড়তে পারে না। তৃষা তখনো চরম খুশি। এসব সে কখনো দেখেনি। প্রেম তাকে এখানে রেখে যায়। যাওয়ার সময় বলে, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমায় এসে নিয়ে যাব। ভালোভাবে থাকবে কিন্তু। এসে যেন কোনো রিপোর্ট না শুনি।’ ইসস তৃষা কি বাচ্চা মেয়ে নাকি? যে তাকে এভাবে বলবে? কি ঢং করে প্রেম ভাই। যাক ভালোই হয়েছে। এখন একা একা বড়লোকি কারবার করে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলবে এই তৃষা নুজায়াত। তৃষা দৌড়ে গিয়ে আগেই দু’টো হুইস্কির বোতল বোগলের তোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে। ইরিন তাকে বলে, ‘তুমি নেশাও করো?’

‘না প্রেম ভাই করে। তার জন্যই নিয়েছি। সে আসলে তাকে দেব।’

‘বাহ এত ভালোবাসা?’

তৃষা বুঝতে পারছে না কি বলবে। আসলেই কি এত ভালোবাসা? সে ভালোবাসে প্রেম ভাইকে? কই না তো! তবে প্রেম নামটা শুনলে বুক ধুকপুক অবশ্যই করে।

‘কত দিন ধরে তোমাদের সম্পর্ক?’

তৃষার বুঝতে বাকি রইল না এই ইরিন নামক মেয়েটা যে প্রেম ভাইকে পছন্দ করে। তাই তৃষার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চেপে বসল। সে মুচকি হেসে মেয়েটিকে বলল, ‘কেন আমার প্রেম সোনাপাখি তোমায় এসব বলে নি?’

ইরিনের ভীষণ রাগ হলো। সে আর কথা বলল না। রুম থেকে বের হতেই তৃষা সুযোগ পেয়ে মদের বোতল গুলো খুলে গটগট করে পান করল। প্রেম ভাই খাবে এসব তাই আগে চেক দেওয়া আবশ্যক। যদি খেয়ে তার শরীর খারাপ হয়? কিংবা পেট ছুটে? তবে খেতে খেতে যে কবে পুরোটা শেষ করে চোখের সামনে সর্ষেফুল দেখল তা খোদাই ভালো বলতে পারবেন। তৃষার তখনো হুশ নেই। সে মাতাল হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। কেউ একজন গালে হাত রাখতেই নেশাগ্রস্ত তৃষা বলল, ‘প্রেম ভাই আপনি এসেছেন।’

ওপাশ থেকে জবাব এলো না। তবে কেউ একজন বাজে ভাবে তার স্পর্শকাতর স্থানে হাত ছোঁয়াতে তৃষা এবার চোখ মেলে তাকালো। ঝাপসা চোখে দেখল সামনে প্রেম নয় অন্য কেউ। এই লোককে সে চিনে না। সে দাঁত বিকশিত করে তৃষাকে দেখে হেসে বলল, ‘খারাপ লাগছে তোমার? চলো আমি সেবা দিয়ে ভালো করে দেই।’ তৃষা পেছনোর আগেই সে তৃষার গলার টুঁটি চেপে ধরল। চোখ মুখ উল্টে আসছে তৃষার।

‘যাও কই বেবি। আমাদের শরীরেরও তো অনেক চাওয়া-পাওয়া আছে?’

ছেলেটি তৃষার গায়ে হাত দিতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন এসে তার শার্ট ধরে টেনে তাকে তৃষার ওপর থেকে সরায়। পেছন ফিরতেই ছেলেটি আবিষ্কার করল প্রেম নেওয়াজকে। ছেলেটি কথা বলার সুযোগ পেল না৷ তার আগেই একের পর এক ঘুষি তার মুখের ওপর লেপ্টে দিলো। তৃষার তখনো মাথা কাজ করছে না। চোখের সামনে একটা ছেলে কি ভয়ানক ভাবে মার খাচ্ছে। কিন্তু সে মার খাওয়ারই যোগ্য। প্রেম আধমরা ছেলেটিকে ঠিক করে বসিয়ে তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তৃষা জাস্ট কিল হিম।’

তৃষা সাহস পেল। এবার বুক ভরা সাহস নিয়ে উঠে সে ওই ছেলের জায়গা মতো একটা মারতেই ছেলেটির

আর্তনাদ কে শুনে। প্রেমের সেই চিৎকার বিরক্তকর লাগছে। তাই মুখটাও সে চেপে রাখল। কাজ শেষ হতেই তৃষা বলল,’ এবার ছেড়ে দিন। মরে যাবে।’

‘ওর তো মরে যাওয়াই উচিত। ওর কত বড় সাহস তোমার গায়ে হাত দিতে যায়? হাত যদি কেটে কাঁধে না ঝুলাই!’

তৃষা প্রেমের হাত ধরে অনুরোধ করতেই প্রেম তৃষার দিকে তাকালো। প্রেম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ছেলেটি কোনোমতে উঠে সেখান থেকে যেতেই দরজার সমানে ইরিন এসে দাঁড়ালো। পরিস্থিতি দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে?’

প্রেমের শরীর ঘেমে একাকার। লেদার জেকেট খুলে ফেলেছে। এক মুহূর্ত স্থির থেকে বাজপাখির মতো দ্রুতবেগে সে উঠে গিয়ে ইরিনের গলা চেপে ধরল। তৃষার এখন সত্যি ভয় করছে। ইরিনের গলা চেপে ধরে সে বলল, ‘কি হয়েছে শালী তুই জানিস না? তোকে বলেছিলাম না তৃষার দিকে নজর রাখতে?’

তৃষা উঠে এসে প্রেমের হাত ধরে বলল, ‘ছেড়ে দেন প্রেম ভাই। ছাড়ুন।’

প্রেম ইরিনকে ছেড়ে দিতেই সে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। একটু আগে ইচ্ছে করেই ওই ছেলেটিকে তৃষার রুমে পাঠিয়েছিল তৃষাকে বদনাম করার জন্য প্রেমের চোখে। কিন্তু! কি থেকে কি হয়ে গেল। প্রেম তৃষার কথায় ইরিনের গলা ছেড়ে দিতেই সে নিজেকে সামলাতে না পেরে পরে গেল। ইরিন প্রেমের এই আচরণে অবাক হয়নি। অবাক হয়েছে প্রেম তৃষার কথা শুনে তার গলা ছেড়ে দিয়েছে এই কারণে। কি করে সম্ভব এটা? তৃষা আহামরি সুন্দর না। আর পাঁচটা মেয়ের মতোই। তাহলে কেন প্রেম তৃষার কথা শুনলো? কেন? প্রেমের মুডটা হ্যাপি ছিল। এখানে এসে সব শেস। বাইক রেসে আজকেও সে জিতেছিল। কিন্তু এখানকার কান্ড দেখে সব নষ্ট হয়ে গেল। তৃষা তখনো চলার অবস্থায় নেই। প্রেম তৃষার হাতে তার লেদার জেকেটটা দিয়ে তাকে আচমকা কোলে তুলে বলল,’ জ্যাকেটটা বুকের ওপর নাও। শরীর বেশি খারাপ লাগছে?’

‘প্রেম ভাই বমি আসছে আমার? আমাকে নামিয়ে দেন। আপনার গায়ে বমি করে দেব।’

‘আমার আপত্তি নেই। একবার কেন? যতবার ইচ্ছে বমি করতে পারো। আমি ম্যানেজ করে নিব। আগে তোমার ঠিক হওয়া প্রয়োজন। কেন যে এসব খেতে গেলে।’

তৃষা কিছু বলল না। বলতে সে অনেক কিছুই চায়। বলতে আর পারছে কই? প্রেমের বুকে মুখটা গুঁজে দিলো। ক্লান্ত সে। শরীর ভালো লাগছে না এটাই বোঝাতে চাইছে।

নদী আর ভালোবাসার মধ্যে কত গভীর মিল। নদীর কালো জল যেমন বুকের ভেতর কত কিছু লুকিয়ে রাখে, তলদেশ দেখা যায় না, তেমনি ভালোবাসাও ভেতরে ভেতরে বহন করে আনন্দের পাশাপাশি ভয়, কষ্ট আর ভাঙনের আশঙ্কা। কেউ নদীর কালো জলে তাকিয়ে হারিয়ে যায়, আবার কেউ ভয় পায় ডুবে যাওয়ার। ভালোবাসার ক্ষেত্রেও তাই, কেউ ডুবে গিয়ে খুঁজে পায় নিজের অস্তিত্ব, আর কেউ ডুবে গিয়ে ভেঙে যায় একেবারে। শেষমেষ নদী যেমন বয়ে চলে থেমে থাকে না, ভালোবাসাও তেমনই, ভাঙন, ব্যথা, আনন্দ, সব পেরিয়ে সে চলতেই থাকে। এটাই তো ভালোবাসার ধর্ম।

লঞ্চের ছাদে রাতের আবহাওয়াটা অন্যরকম হয়ে উঠেছে। চারপাশে অন্ধকার নদী। শুধু ঢেউয়ের টুপটাপ শব্দ আর মাঝেমধ্যে দূরে জেলেদের হুঁশিয়ারি ডাক ভেসে আসে। আকাশ জুড়ে ছড়ানো তারা, মাঝে মাঝে মেঘ সরে গিয়ে ফর্সা চাঁদের আলো নদীর বুক জুড়ে রূপালি ঝিকিমিকি ছড়িয়ে দেয়। ছাদের চারপাশে টিউবলাইটের ক্ষীণ আলো, তবে সেই আলো যেনো রাতের ঘোর কাটাতে পারে না বরং অন্ধকারকেই আরো রহস্যময় করে তোলে। মৃদু বাতাসে তৃষার চুল উড়ছে। প্রেম নীরবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দু’জনের চোখের ভাষায় যেন হাজারো অজানা কথা, অথচ ঠোঁট দুটো নীরব। তৃষার শরীরটা এখন ভালো লাগছে। বমি করার পর হালকা হয়েছে। যদিও বমি প্রেমের গায়ে করেনি। বাতাসে ভিজে নদীর কাঁচা গন্ধ। তাদের গায়ে ঠান্ডা শীতল হাওয়া এসে লাগছে। প্রেমের জেকেটটা তৃষার গায়ে জড়ানো। দূরে কোথাও লঞ্চের সাইরেনের হালকা আওয়াজ ভেসে এসে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে নদীর নিস্তব্ধতায়। তৃষা সেদিকে তাকিয়ে আছে। প্রেম ভাই বলল বলেই এই রাতের বেলা লঞ্চ ভ্রমণ। ভোরে আবার লঞ্চ ফিরে আসবে। তারাও তখন বাড়ি ফিরবে। রাতটা আজকে এভাবেই নদীর দিকে চেয়ে চেয়ে কেটে যাবে। ভালোই লাগছে তৃষার। তৃষা হাতের আঙুল দিয়ে ছাদের রেলিং আড়কে ধরে মৃদুস্বরে বলল,

“প্রেম ভাই, এই নদীর দিকে তাকালে মনে হয় সবকিছুই গভীর আর সীমাহীন। আচ্ছা মানুষের জীবন, ভালোবাসা—সবকিছুই কি এমন অনন্ত আর রহস্যময়?”

প্রেম চোখ রাখল নদীর জলের দিকে, বলল,”নদীর মতো মানুষের জীবনও বয়ে চলে। স্রোত থামে না। ভালোবাসা যদি থাকে, সেটাও বয়ে চলে, ভাঙন আসে তবুও থেমে থাকে না।”

তৃষা হালকা হাসি বলল, “তবু মনে হয় ভালোবাসা নদীর কালো জলের মতোই ভয়ংকর। বাইরে থেকে শান্ত, কিন্তু ভেতরে তল খুঁজে পাওয়া যায় না।”

“ভালোবাসা ভয়ংকর হতে পারে তখনই, যখন তাতে মায়া থাকে না। সত্যি ভালোবাসা আসলে ভয় নয়, নিশ্চয়তা দেয়। কাফনের কাপড়ের মতো জড়িয়ে ধরে।”

তৃষা চমকে তাকায় “কাফনের কাপড়ের মতো?”

“হ্যাঁ। মানুষ মরলে তাকে শেষবার ওই কাফনের কাপড়ই জড়িয়ে রাখে। পৃথিবীর কোনো সম্পর্ক, কোনো সম্পদ, কোনো অর্জন সঙ্গে যায় না। শুধু সেই সাদা কাপড়।”

“তাহলে আপনি কেমন ভালোবাসা চান?

প্রেম কেমন ভালোবাসা চায়? খুব কঠিন প্রশ্ন। সে নদীর জলের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো, ” আমি চাই আমার ভালোবাসা ওই কাফনের কাপড়ের মতোই হোক। শেষ পর্যন্ত তার মায়া আমার প্রেয়শীর হৃদয় জড়িয়ে রাখুক।”

‘সেই হবু প্রেয়শী যদি কখনো এমন প্রশ্ন করে আপনি কি বলবেন তখন?’

প্রেম তৃষার চোখে চোখ রাখল, বলল, “ভালোবাসলে কাফনের কাপড়ের মতো জড়িয়ে ভালোবাসো। এমন ভালোবাসা, যা শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বিচ্ছেদ নেই। কারণ মানুষ যখন মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে যায়, তখন তার সঙ্গে আর কিছুই যায় না, থাকে না। থাকে শুধু কাফনের সেই সাদা কাপড়টুকু। তাই প্রেয়শীকে বারে বার বলল, হাজারবার বলল,”থেকে যাও ঠিক তেমন ভাবেই যেমন ভাবে মৃত্যুর পরও মানুষের শরীরে কাফনের কাপড় জড়িয়ে থাকে।”

তৃষা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করল, “কিন্তু জীবনে তো শুধু ভালোবাসা দিয়ে টিকে থাকে না, প্রেম ভাই। বাস্তবতার ভাঙনও আছে। ক্ষুধা আছে, ভয় আছে, অনিশ্চয়তা আছে। নদী যেমন ভাঙে ঘরবাড়ি, ভালোবাসা কি তেমন ভাঙতে পারে না?”

প্রেম আচমকা তৃষার হাত ধরে বলল, “বাস্তবতা তো আছেই। কিন্তু আমি মনে করি, ভাঙনের পরেও যদি দু’জন একসঙ্গে দাঁড়াতে পারে, সেই ভালোবাসাই আসল। নদী এক পাড় ভেঙে কিন্তু অন্যপাড় ঘরে।”

তৃষা হাত ছাড়িয়ে নেয়। তারপর মিহি গলায় বলে, “আপনি সবকিছুকে আশার চোখে দেখেন। আমি পারি না। আমার কাছে ভালোবাসা অনেক সময় শূন্যতার মতো মনে হয়। যেখানে যতদূর যাই, শেষ নেই।”

প্রেম ধীরে ধীরে বলল, “শেষ থাকলেই তো আর মানুষ ভয় পেত না, তৃষা। ভালোবাসার সৌন্দর্য তার সীমাহীনতায়। হয়তো তল পাওয়া যায় না, কিন্তু সেই গভীরতাই তো আমাদের ডেকে রাখে।”

তৃষা চোখ তুলে তারার দিকে তাকায়, “তবু আমি ভাবি, যদি একদিন সবকিছু ভেঙে যায়? মানুষ কি তখনো একই ছাদের নিচে দাঁড়াতে পারে?”

“ভালোবাসা ভেঙে গেলে মানুষ বাঁচে না, শুধু বেঁচে থাকার ভান করে। মুখে ভালোবাসি বললে তা টিকে থাকে না। ভালোবাসতে গেলে অনেক সাহসের প্রয়োজন। লড়াই না করে এক তীরে দাঁড়িয়ে অপর তীরে চেয়ে থাকলে ভালোবাসায় তো ভাঙন ধরবেই। দেখো এসব প্রেম ভালোবাসা নিয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। মনে যা আসছে তাই বলছি, মন বলছে আমি ভুল বলছি না।”

তৃষা হালকা কাঁপা গলায় বলল,” তাহলে আপনি বলতে চাইছেন ভালোবাসা একপ্রকার প্রতিজ্ঞা?”

“হ্যাঁ। প্রতিজ্ঞা, সমর্পণ আর অবিচ্ছেদ্য বাঁধন। যেমন নদীকে তার স্রোত থেকে আলাদা করা যায় না, তেমনি ভালোবাসাকে তার সমর্পণ ছাড়া কল্পনা করা যায় না।”

তৃষা চোখ ভিজে আসে। কেন আসছে সে জানে না। তবুও…. সে বুঝতে দেয় না। তবে মনটা কেমন যেন করছে। এই মানুষটা নাকি ভালোবাসতে জানে না। হিংস্রতায় গড়া। তবে তৃষা আজকে বারংবার একটা যত্নশীল মানুষকে আবিষ্কার করছে। আচ্ছা এমন তো নয় তার খারাপ আচরণের পেছনে ভয়াবহ কোনো অতীত আছে? তৃষার তখন ঠাণ্ডা লাগছে। প্রেম তাকে বলল, ” কিছু চাই তোমার? ঠিক আছো?

“আমি ঠিক আছি। আমার কিছু চাই না।”

‘কিন্তু আমার তো তোমাকে চাই।’ মৃদু স্বরে বলল প্রেম।

‘কিছু বললেন নাকি?’

‘উঁহু। এখানে অনেক ঠাণ্ডা তাই না? তোমার কষ্ট হচ্ছে? চলো কেবিনে যাই।’

‘না না এখানে থেকে এই ঠাণ্ডার মধ্যে আমি বরবাদ করব প্রেম ভাই।’

‘আমি তো অলরেডি তোমার তোরে বরবাদ হয়ে গেছি।’

‘মানে?’

প্রেম তৃষার হাতটা টেনে ধরে চলতে চলতে বলল, ‘যেই হারে বিচ্চু মেয়ে তুমি আমায় জ্বালাচ্ছো প্রশ্ন করে করে বরবাদ না হয়ে উপায় কই? চলো নিচে চলো।’

তৃষা মুখটা ভেংচি কাটল। জবাব দিলো না। কেবল তালে তাল মিলিয়ে তার এই হারে বজ্জাত প্রেম ভাইয়ের সঙ্গে হাঁটা ধরল।

চলবে?

(কত বড় পর্ব দিছি। আর রোজ দেই। আপনাদের তো আমাকে নিয়ে গর্ব করা উচিত😏 কিন্তু আপনারা তো চুপিচুপি খালি গল্প পড়ে পালাই পালাই খেলেন ছ্যাহ!)

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply