#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা
#সাদিয়া
#পর্ব_৩৮
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
ঘুম ভেঙেছে মৌমিতার। ফুটফুটে আলো ফুটেছে চারদিকে। সূর্য উঠে গেছে তবে এখনও সম্পূর্ন তেজ নিয়ে জ্বলে ওঠেনি। ৭ টা বেজে গেছে, আটটায় তাজের অফিস। মৌমিতা সেই কখন থেকে তাজকে ডেকে চলেছে তাজের কোনো হুঁশ নেই। সে যে সারারাত না ঘুমিয়ে বউ পাহারা দিয়েছে তা তো জানা নেই মৌমিতার। মৌমিতা আবার ডেকে তুলল তাজকে। তাজ ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলল – আমি অফিসে যাব না আজ।
কথা শেষ করার আগেই আবার শুয়ে পড়লো তাজ। মৌমিতা টেনে তুললো তাজকে ঠেলেঠুলে পাঠালো ওয়াশ রুমে ফ্রেশ হতে। তাজ সেই যে ওয়াশ রুমে ঢুকেছে বের হওয়ার কোনো নাম গন্ধ নেই। এই বান্দা কি আবার ওয়াশ রুমেই ঘুমিয়ে গেছে নাকি? মৌমিতা পায়চারি করছে ওয়াশ রুমের সামনে আর একটু পর পর তাজকে বেরুতে বলছে। তাজও একটু পর পর উত্তর দিচ্ছে – এই তো বেরুচ্ছি।
কিন্তু তাজের ওয়াশ রুম থেকে বের হওয়ার কোনো নাম গন্ধ নেই। মেজাজ গরম হচ্ছে মৌমিতার। ওয়াশ রুমের দরজায় এলোপাথাড়ি ধাক্কা মারতে শুরু করলো সে। নাহ আর ওয়াশ রুমে বসে থাকা যাচ্ছে না। তাজ বেড়িয়ে এলো ওয়াশ রুমে থেকে। মৌমিতা কটমট করে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। তাজ হঠাৎ পেট চেপে বসে পড়লো নিচে, টেনে টেনে বলল – পেট খারাপ হয়েছে, বোধহয় ডা’য়’রি’য়া হয়েছে আমার।
অস্থির হয়ে পড়লো মৌমিতা, ব্যগ্র কন্ঠে বলল – বেশি কষ্ট হচ্ছে তোমার? আমি এখনই ঔষধ নিয়ে আসছি।
– না না তোমার এত কষ্ট করতে হবে না। তুমি কাকাইকে বলে দেও আজ একটু অফিসটা সামলে নিতে। আমি বোধহয় আজ আর অফিসে যেতে পারবো না।
মৌমিতা বুঝতে পারলো তাজের চাল। এই লোকের ডা’য়’রি’য়া ফায়রিয়া কিছুই হয়নি এটা শুধু অফিসে না যাওয়ার বাহানা। লোকটার দিন দিন বয়স বাড়ছে আর বাচ্চাদের মতো হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা এমন বাহানা করে স্কুলে না যাওয়ার জন্য আর এই লোক করছে অফিসে না যাওয়ার জন্য।
মৌমিতা বুকে হাত বেঁধে বলল – ওহ এই ব্যাপার তাহলে অফিসে না যাওয়ার পেট খারাপ হয়েছে আজ?
ধরা পড়ে যাওয়ায় থতমত খেল তাজ। আমতা আমতা করে বলল – একদম না , সত্যিই পেট খারাপ আমার।
মৌমিতা ঔষধ ধরলো তাজের সামনে, বলল – পেট খারাপের ঔষধ খেয়ে নিন।
এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে তাজ। তার তো কোনো পেট খারাপ হয়নি শুধু শুধু ঔষধ খেয়ে যদি আবার হিতে বিপরীত হয়ে যায়। মিথ্যে বলে ভালো ফাঁসা ফেঁসে গেছে তাজ। এখন নিজের কথা ফিরিয়েও নিতে পারছে না। তাজ মৌমিতার হাতটা ধরে নিজের পাশে বসালো, বলল – এখানে বসো জরুরি কথা আছে তোমার সাথে।
ভ্রু কুঁচকে এলো মৌমিতার, সন্দিহান কন্ঠে বলল – কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছো তুমি?
– মোটেই না তোমার সাথে আমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।
– কি কথা?
– তোমার ফ্রেন্ড আছে না নীরা।
– হুম তো
– ওর সাথে কাকাইয়ের ভালো মানাবে। না মানে বলছিলাম কাকাইয়ের সাথে ওর বিয়ে দিলে কেমন হয়? আমার থেকে কাকাই পাঁচ বছরের বড় আমি বিয়ে করে ঘর সংসার করছি আর কাকাই এখনও পিওর সিঙ্গেল কাকাইকে দিয়ে কোনো কাজ হবে না এখন যা করার আমাকেই করতে হবে। আর তাছাড়া তোমার বান্ধবীকে দেখেও মনে হয়েছে সে কাকাইকে পছন্দ করে। আর কাকাইও মনে হয় তোমার বান্ধবীর প্রতি একটু আধটু দূর্বল।
মৌমিতা আগে থেকেই জানে নীরার মনের কথা। সে বেশ খুশিই হয়েছে এই প্রস্তবে। তার উপর রাদীফের সাথে বিয়ে হলে নীরাও এই বাড়িতে চলে আসবে। দুই বান্ধবী বেশ একসাথে থাকতে পারবে। মৌমিতা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল – আমি আজই নীরার সাথে কথা বলবো। ও নিশ্চই রাজী হবে।
সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো তাজ। এবারের মতো মৌমিতার হাত থেকে বেঁচে গেছে।
____________________________________
কেটে গেল প্রায় তিন মাস। সময় বদলে গেছে , এই তিন মাসে পুরোপুরি সহজ হয়ে গেছে তাজ আর মৌমিতার সম্পর্ক। দুজন এখন চোখে হারায় একে অপরকে। রাদীফের সাথে নীরার বিয়ে ঠিক হয়ে হয়েছে এই তো কয়েকদিন পরই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হয়েছে। মাহিমকে এখানের কলেজে ট্রান্সফার করা হয়েছে। সব ঠিকঠাকই চলছিল। হঠাৎই একদিন খবর এলো সাদিক চৌধুরী হার্ট অ্যাটাক করেছে, অবস্থা আশঙ্কাজনক। সন্তানের সাথে পিতা মাতার যতই মান অভিমান থাকুক না কেন কোনো সন্তানই তার বাবার এমন অবস্থা শুনে দূরে থাকতে পারবে না। তাজও পারেনি। সব মান অভিমান ভুলে ছুটে গিয়েছে বাবার কাছে। তাজের সাথে মৌমিতা, রাদীফ, জাহানারা বেগম আর মাহিমও ছুটে এসেছে। সাদিক চৌধুরীর সাথে জাহানারা বেগমের দেখা হয়েছিল সে যেদিন তাজের বাড়িতে গিয়েছিল মৌমিতাকে দেখতে। তার কাছে সাদিক চৌধুরীকে মোটেই খারাপ মনে হয়নি। হয়তো পরিস্থিতি তাকে খারাপ বানিয়েছিল। সবাই হাসপাতালে পৌঁছাতেই দেখা মিলল হীরা বেগম আর তার মেয়ের। সাদিক চৌধুরী অপারেশন থিয়েটারে। এর আগে মৌমিতার সাথে হীরা বেগমের মেয়ের দেখা হয়নি কখনও। মেয়েটা ভীষণ সুন্দর হয়েছে নাম আফিয়া। মেয়েটা বড়জোর নবম দশম শ্রেণীর ছাত্রী। যথেষ্ট নম্র ভদ্র মার্জিত সুশীল তার ব্যবহার। মেয়েটি সম্পূর্ণ হীরা বেগমের বিপরীত। হাসপাতালে মৌমিতার সাথে অনেকক্ষণ ছিল আফিয়া। মৌমিতার একটু সময়ের জন্যও মনে হয়নি আফিয়া তার অচেনা বা আজ প্রথম পরিচয় হয়েছে। মৌমিতার সাথে আফিয়ার ভাব জমে গেছে বেশ।
সূর্যের আলোকে বিদায় দিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে মাত্রই। ধরনীর বুকে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। পাখিরা তাদের নীড়ে ফিরছে উড়ে উড়ে। সাদিক চৌধুরীকে কিছুক্ষণ আগেই কেবিনে দেওয়া হয়েছে হুশ ফেরেনি এখনও। জাহানারা বেগমকে মাহিমকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আগেই। তাজ আর রাদীফ গিয়েছে মসজিদে নামাজ পড়তে। মৌমিতা হাসপাতালের একটা ফাঁকা কক্ষে আদায় করে নিয়েছে মাগরিবের সালাত।
নামাজ শেষে মৌমিতা উঠে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে তাকাতেই চোখে পড়লো হীরা বেগমকে। কেমন হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মৌমিতা পাত্তা দিল না সেদিকে। হীরা বেগমের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই গর্জে উঠলো হীরা বেগম। মৌমিতাকে একটা ধাক্কা মারলো দেওয়ালের সাথে, মৌমিতা ছিটকে পড়লো। কপালের ক্ষানিকটা কেটে গেছে দেয়ালে লেগে। রক্ত পড়ছে গড়িয়ে গড়িয়ে। রাগ কমলো না হীরা বেগমের। রাগে গজগজ করতে করতে মৌমিতাকে টেনে তুললো। গলা টিপে ধরলো মৌমিতার। মৌমিতাও পারতো হীরা বেগমকে পাল্টা আক্রমণ করতে কিন্তু তা সে করেনি। তার বাবা মা তাকে এই শিক্ষা দেয়নি। সৎ হোক তবুও সে মৌমিতার শ্বাশুরি তো, গুরুজন তার। হীরা বেগম খারাপ হতে পারে তাই বলে কি মৌমিতাও খারাপ হবে তাহলে হীরা বেগমের সাথে তার পার্থক্য রইলো কি? মৌমিতা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো তবে পারলো না। হীরা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বলল – তোকে আজ আমি মেরেই ফেলবো। তোর জন্য আজ আমার সংসারে এত অশান্তি। না তুই আসতি আর না এতকিছু হতো। তুই না আসলে ঐ অসুস্থ তাজের সাথে আমি আমার ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে দিয়ে সব সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পারতাম। তুই এসেই আমার সব প্ল্যানে পানি ঢেলে দিলি।
চোখ উল্টে দিয়েছে মৌমিতা। গলা থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়ছে। কপালে রক্ত শুকিয়ে আছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্বরন করছে সে। সৃষ্টিকর্তা বুঝি শুনলো তার কথা। ঐ রুমের সামনে থেকেই এক নার্স যাচ্ছিলো। রুমের মধ্যে ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনে ভিতরে উঁকি দিল সে। ভিতরের দৃশ্য চোখে পড়তেই চক্ষু চড়কগাছ। দৌড়ে ভিতরে ঢুকে গেল। হীরা বেগমের হাত থেকে মৌমিতাকে ছাড়িয়ে নিল সে। এত ধকল হয়তো সইতে পারেনি মৌমিতা। জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছে মেঝেতে। হীরা বেগম ভয় পেয়ে গেলেন। দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলেন তবে পারলেন না। নার্স মহিলা নেহাত ভীষণ বিচক্ষণ ছিলেন। সে আটকে রাখলো হীরা বেগমকে। একজন ওয়ার্ড বয়কে ডেকে মৌমিতাকে পাঠালো ডাক্তারের কেবিনে।
প্রায় মিনিট তিরিশের পর ফিরে এলো তাজ আর রাদীফ। এসেই খোঁজ করলো মৌমিতার তবে পেল না। ফোন লাগালো মৌমিতার ফোনে কল ধরলো এক অপরিচিত মহিলা। মৌমিতার ফোনটা ঐ নার্স মহিলার কাছেই ছিল। মৌমিতার জ্ঞান এখনও ফেরেনি তাকে সেলাইন লাগানো হয়েছে। নার্স মহিলার কথা শুনেই তাজ ছুটে গেল মৌমিতার কাছে। মৌমিতার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো একবার অতঃপর নার্স মহিলার দিকে তাকালো, জিজ্ঞেস করলো – কি হয়েছে ওর?
নার্স মহিলা খুলে বলল সব। লাল হয়ে উঠলো তাজের চোখ দুটো। চোখে মুখে ফুটে উঠলো হিংস্রতা। সে সব সহ্য করতে পারে কিন্তু মৌমিতার এক বিন্দু কষ্টও নয় সেখানে হীরা বেগম নাকি মৌমিতাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। ইচ্ছে তো করছে হীরা বেগমকে এখনই মাটিতে পুঁতে ফেলতে। ঘৃনায় নাক মুখ কুঁচকে এলো রাদীফের, বলল – ঐ মহিলা খারাপ জানতাম কিন্তু এতটা খারাপ হবে ভাবিনি কখনও। সম্পত্তির লোভ তাকে এতটা নিচে নামিয়েছে ?
তাজ রুম থেকে বের হওয়ার আগেই আরেকজন নার্স রুমে ঢুকলো, ভদ্রভাবে বলল – এই রোগীর বাড়ির লোক আছে কে? ডাক্তার শিরিন তাকে একবার দেখা করতে বলেছে।
তাজ হীরা বেগমের কাছে যেতে চাইলেও এবার মত পরিবর্তন করলো আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। আর ডাক্তারই বা এভাবে তলব করলো কেন কি বলবেন? খারাপ কিছু না তো? তাজের বুকটা কেঁপে উঠলো। লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটে গেল ডাক্তার শিরিনের কেবিনে। ডাক্তার শিরিন তখন কারো রিপোর্ট দেখছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মধ্যবয়সী একজন মহিলা। চোখে মুখে কেমন গম্ভীরতার ছাপ। সাদা এপ্রোনে আবৃত শরীর। তাজ কেবিনের দরজায় একটা টোকা দিয়ে বলল – আসবো?
মাথা তুলে ডাকালো ডাক্তার শিরিন, বলল – আসুন।
তাজ ও রাদীফ ঢুকে পড়লো কেবিনে। ডাক্তার শিরিনের আদেশে বসে পড়লো দুজনেই। অতঃপর ডাক্তার শিরিন শান্ত কন্ঠেই বলল – আপনাদের মধ্যে মিসেস মৌমিতার হাসবেন্ড কে?
তাজ অশান্ত হয়ে বলল – আমি।
চলবে….
Share On:
TAGS: প্রণয়ের ব্যাকুলতা, সাদিয়া
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৯
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৬
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৯
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৫
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৩
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৬