#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা
#সাদিয়া
#পর্ব_৩৫
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
লাল, হলুদ, সবুজ কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে পুরো বাড়ি। আত্মীয় স্বজনে ভরপুর পুরো বাড়ি। এ যেন আত্মীয় স্বজনের মিলন মেলা। সিলেট থেকেও মৌমিতাদের সকল আত্মীয় স্বজন সাফওয়ানের বিয়ে উপলক্ষে পাড়ি জমিয়েছে যশোরে। মৌমিতারা একটু আগেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এসে পৌঁছেছে। তাদের বাসা সাফওয়ানদের বাসা থেকে এই মিনিট দশেকের দূরত্বে। জাহানারা বেগম তাজকে সবার কাছে মেয়ের জামাই হিসেবেই পরিচয় দিয়েছে। তবে কথায় ছাড় দেয়নি কেউই। কেউ কেউ বলেছে “মেয়ে তোমার এমন একটা কাজ করলো কিভাবে? ” কেউ কেউ বলেছে ” ছেলে তো দেখতে শুনতে ভালোই, এমন ছেলে তোমার মেয়ে হাতছাড়া করতে চায়নি তাই তো একা একা বিয়ে করে ফেলেছে, মেয়ে তোমার সেয়ানা আছে । ” কেউ কেউ মেয়ের চরিত্রে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করতেও ছাড় দেয়নি। তবে নিশ্চুপ ছিলেন জাহানারা বেগম। কারো কথার উত্তর দেননি তিনি। মেয়ে তো তার বড় কথা বলার মুখ রাখেননি। ভুল তো একটা করেছেই কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে। এখন হাজার কথা বললেও এদের মুখ তো বন্ধ করা যাবে না।
তাজ তার কথা রেখেছে। সে অনুষ্ঠানে আসা থেকে মৌমিতার সাথে চিপকে আছে। মৌমিতা ওয়াশ রুমে ঢুকলেও ওয়াশ রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সে। মৌমিতার তো এখন মনে হচ্ছে কেন সে এই বান্দাকে তার থেকে ১০ হাত দূরে থাকতে বলেছিল? দূরে থাকতে বলেছিল বলে এখন চিপকে আছে তার সাথে। অনুষ্ঠানে আসা আত্মীয় স্বজন কেমন ওদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে, কেউ কেউ আবার কানাকানি করছে। অসস্তি লাগছে মৌমিতার। আর তাজ ভাবলেশহীন। সে বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরতেই আপাতত স্বাচ্ছন্দ্যভোধ করছে।
আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। পূর্নিমা বোধহয় আজ। চাঁদের পাশে তার হাজারো সঙ্গী তাঁরা মিটিমিটি করে জ্বলছে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১১ টা বেজে গেছে। অনুষ্ঠান থেকে ফিরেই মৌমিতা ফ্রেশ হয়ে একপাশে মুখ করে শুয়ে পড়েছে। তাজও ফ্রেশ হয়ে এসে ধপ করে বসে পড়লো বিছানার একপাশে মাঝখানে কালকের মতো সেই পাঁচিল হিসেবে বড় কোলবালিশটা। তাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার মৌমিতার পিঠের দিকে তাকালো। হঠাৎই কোলবালিশটা ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। চট জলদি পিছন থেকে মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুইয়ে পড়লো সে। কেঁপে উঠলো মৌমিতা, আকর্ষিক ঘটনায় চমকেও গিয়েছে বকে। তাজ মৌমিতাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। একটু নড়তেও পারছে না মৌমিতা। সে বিরক্তিভরা কন্ঠ নিয়ে বলল – কি হচ্ছেটা কি? এভাবে জড়িয়ে ধরেছেন কেন?
– উমম কথা বলো না বউকে আদর করছি।
– ছাড়ুন আমাকে, ছাড়ুন।
– ছাড়ার জন্য তো ধরিনি।
– দেখুন ভালো হবে না কিন্তু।
– আমি এই মুহুর্তে কিছু দেখতে চাই না নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো না।
– আমাকে ছাড়বেন না কি?
– না ছাড়বো না।
– তাজ
– বলো বউ
– ছাড়ুন আমাকে।
– উহু
মৌমিতা তাজকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তাজ হঠাৎ আবেগী কন্ঠে বলে উঠলো – আমাকে মাফ করে দেওয়া যায় না মৌ? আমি তখন অসুস্থ ছিলাম, একটা ভুল করে ফেলেছি। আমার ভুলটা কি ক্ষমা করা যায় না? আমরা কি আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে পারি না?
– না আমি কখনও আপনাকে মাফ করতে পারবো না কখনও না, শুনেছেন আপনি?
– কেন পারবে না , আমি কি ক্ষমার এতটাই অযোগ্য? তুমি আমাকে কিসের শাস্তি দিচ্ছো? তোমার ভাষ্যমতে তুমি আমার জন্য, আমি আটকে রেখেছিলাম বলে তোমার বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে পারোনি , তোমার বাবাকে শেষবারের মতো বাবা বলে ডাকতে পারোনি। আমি তো তোমাকে আটকে রেখেছিলাম ঘন্টা দুই। আর তার আগে তোমাকে সিলেট থেকে কল করা হয়েছিল তোমার বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে , হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান। অর্থাৎ তোমাকে জানানোর তিন ঘন্টার মধ্যে? আচ্ছা তোমার মনে হয় তুমি এই তিন ঘন্টার মধ্যে ঢাকা থেকে সিলেট যেতে পারতে? আর গিয়ে তোমার বাবাকে জীবিত দেখতে পেতে? আমার বাসা থেকে স্টেশনে যেতেই তো তোমার ৩০ মিনিট লেগে যেত আর জ্যামে পড়লে কত ঘন্টা লাগতো হিসেব নেই। তবুও মানলাম আমি ভুল করেছি কিন্তু তখন আমি অসুস্থ ছিলাম। প্লিজ মাফ করে দেও না আমায়। তোমায় কতটা ভালোবাসি আমি তুমিও জানো। বিশ্বাস করো তোমাক ছাড়া এই দেড়টা বছরের একটা দিনও আমার ভালো কাটেনি। পাগলের মতো খুঁজেছি আমি তোমাকে কিন্তু কোথাও পাইনি। আজ যখন পেয়েছি কেন আমায় দূরে ঠেলে দিচ্ছো কেন এত কষ্ট দিচ্ছো আমায়? তারপরে আমাকে কষ্ট দিয়ে না হয় তুমি খুশি থাকতে সেই কষ্ট আমি হাসিমুখে মেনে নিতাম। কিন্তু আমাকে কষ্ট দিয়ে তো তুমি সুখী নেই তুমি নিজেও কষ্ট পাচ্ছো। ভিতরে ভিতরে ঘুমড়ে মরছো। তবে কেন এত দূরত্ব, কেন এত লুকোচুরি, কেন না ভালোবাসার অভিনয়?
একটু চুপ থাকলো মৌমিতা। মিনিট দুয়েকের মাথায়ই হু হু করে কেঁদে উঠলো। মৌমিতার কান্নার শব্দ ঝড় তুলেছে তাজের বুকে। অস্থির কন্ঠে তাজ শুধালো – কেঁদো না প্লিজ বউ। তোমার কান্না দেখতে আমি এতদিন পর তোমার কাছে ফিরে আসিনি।
মৌমিতা কিছু বলল না। চুপটি করে রইল তাজের বুকের ভিতরে।
____________________________________
দুপুরের তপ্ত রৌদ্র। সূর্যটা যেন আজ ক্ষেপে গেছে ভীষণ। নিজের তেজে জ্বালিয়ে দিচ্ছে প্রাকৃতি। তাজ অফিসে বসে কাজ করছে। এখানকার সব কাজ গুছিয়ে ঢাকায় ফিরতে হবে। গরমে গলার টাইটা ঢিলা করে দিয়েছে। শার্টের টপ বাটন দুটো খুলে রেখেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হঠাৎ কেবিনের দরজায় টোকা পড়লো। তাজ না দেখেই বলল – ভিতরে আসুন।
দরজা ঠেলে নয়নাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো হীরা বেগম। বেশ খুশি খুশি কন্ঠে বলল – কেমন আছো তাজ?
কন্ঠস্বর শুনে একবার মাথাটা উঁচু করে তাকালো তাজ । বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো হীরা বেগমের দিকে। মহিলা বদলায়নি মোটেও। যতো বুড়ো হচ্ছে মহিলার পোশাকের শ্রী যেন হারিয়ে যাচ্ছে। নয়নার দিকে একবার ফিরেও তাকালো না তাজ। মেয়েটা সব সময় তার শরীর প্রদর্শনে ব্যস্ত। আজও তাজকে ইমপ্রেস করতে ছোট টপস আর একটা হাঁটু অব্দি প্যান্ট পড়ে এসেছে। তবে তাজকে ইমপ্রেস তো দূরের কথা তাজ ফিরেও তাকালো না তার দিকে। তাজ মাথা নিচু করে কাজ করতে করতেই বলল – কি চাই?
অপমান বোধ করলো হীরা বেগম তবে গায়ে মাখলো না। তাজের সামনে চেয়ার টেনে নিজেও বসলো আর নয়নাকেও বসতে বলল। নয়না থমথমে মুখ করে বসে পড়লো হীরা বেগমের পাশে। হীরা বেগম বলল – তা তাজ বাবা কেমন আছো? লন্ডন থেকে কবে ফিরেছো? শুনলাম সুস্থ হয়ে গিয়েছো?
তাজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো হীরা বেগমের দিকে। কন্ঠে একটু তিরস্কার এনে বলল – তা এতদিন তো কোনো খোঁজ খবর ছিল না। বেঁচে আছি কি মরে গেছি জানার প্রয়োজনবোধ করেননি এখন কি তবে আমার সুস্থ্য হওয়ার খবর শুনে আমার সাথে ভাব জমাতে এসেছেন রাতে আপনার এই আদরের অর্ধ ন’গ্ন শরীর প্রদর্শনকারী ভাগ্নীকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিতে পারেন?
তেতে উঠল নয়না কিন্তু নয়নাকে চোখের ইশারা করে চুপ করিয়ে দিল হীরা বেগম অতঃপর নিজে বলল – এসব কেমন কথা তাজ আর তাছাড়া আমার ভাগ্নীকে তোমার গলায় ঝুলিয়ে দেবো কেন? ওই একমাত্র তোমার যোগ্য। আমি তো কত আগেই ভেবে রেখেছি ওকে তোমার সাথে বিয়ে দেবো। এ ব্যাপারে তোমার বাবার সাথেও কথা বলেছি।
– আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আমি বিবাহিত।
– ওটা কোনো বিয়ে? তাছাড়া আমি শুনেছি তোমার বউ তোমাকে একা ফেলে রেখে চলে গেছে। ফিরবে বলেও মনে হয় না।
– আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি আমার বউ আমার কাছেই আছে। আমরা একসাথেই এক বিছানায় থাকছি আর কিছু ভাঙ্গিয়ে বলতে হবে আপনাকে মিসেস সাদিক চৌধুরী?
হীরা বেগম থতমত খেয়ে গেল। সে মোটেই তাজের মুখ থেকে এমন কথা আশা করেনি। তাজ আগে যতই পাগলামী করুক , রেগে যাক কিন্তু কখনও এমন নির্লজ্জের মতো কথা বলেনি। কিন্তু হীরা বেগমও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। সে এখানে এসেছে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে তাতে তাজ কেমন বা কি ধরনের কথা বলল তার কিছুই আসে যায় না। হীরা বেগম বললেন – কি দেখেছো তুমি ঐ মিডেল ক্লাস মেয়েটির মধ্যে? না আছে রূপ না আছে টাকা। আমাদের নয়নাকে দেখো কি সুন্দর রূপ তার। তোমার সাথে ভালো মানাবে।
তাজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো হীরা বেগমের দিকে, উপহাস করে বলল – আপনাদের মতো অর্ধ ন’গ্ন মেয়ে মানুষের দিকে তাজ তাকায় না। তাজের রুচিবোধ এতটাও নিচু স্তরে নামেনি। এখন আপনার দিকে তাকাতে ও আমার কষ্ট হচ্ছে, ঘৃনা হচ্ছে তবুও তাকাতে হচ্ছে । মানুষের মুখ না দেখে আবার আমি কথা বলতে পারি না।
একটু থামুলো তাজ, গম্ভীর কন্ঠে বলল – সুস্থ্য হয়েছি এর মানে এই নয় পাগলামি ছেড়ে দিয়েছি। আগে পাগলামি করতাম অসুস্থতা আর এখন পাগলামি করি সুস্থভাবে, নিজের নিয়ন্ত্রণে। আমার বউয়ের সম্পর্কে আপনার মুখে যদি আর একটা কথা শুনি তাহলে আপনার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে আমার এক সেকেন্ড সময় লাগবে না।
– শোনো তাজ……
হীরা বেগমকে আর কিছু বলতে দিল না তাজ। বেশ শান্ত কন্ঠেই বলল – গেট আউট।
শান্ত কন্ঠের অপমান গায়ে লাগলো না হীরা বেগমের। সে আবার মুখ খুলে কিছু বলতে নিলেই তেতে উঠল তাজ। চিল্লিয়ে বলল – গেট আউট, গেট আউট ফ্রম হেয়ার। নিজে থেকে বের হবেন নাকি দাঁড়ওয়ান ডেকে বের করে দেব?
তবুও বসে রইলো হীরা বেগম। এই মহিলার চামড়া কি মানুষের চামড়া নাকি গন্ডারের চামড়া বেশ সন্দেহ হচ্ছে তাজের। না হয় এত অপমানের পরও কেউ এভাবে বসে থাকে কিভাবে? পাশের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো নয়না। দাঁত কিড়মিড় করে বলল – তোমার যদি আরও অপমানিত হওয়ার ইচ্ছে থাকলে তাহলে তুমি বসে থাকো মামনি আমি চলে গেলাম।
হীরা বেগমও উঠে দাঁড়ালেন। নয়নাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু নয়না বুঝলো না সে রাগে হনহন করে বেড়িয়ে গেল। হীরা বেগমও নয়নাকে বোঝাতে বোঝাতে তার পিছু পিছু বেড়িয়ে গেল। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল তাজ।
চলবে….
Share On:
TAGS: প্রণয়ের ব্যাকুলতা, সাদিয়া
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৮
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৯
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২০
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৮
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৬
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৭
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৪