Golpo প্রণয়ের ব্যাকুলতা

প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩২


#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা

#সাদিয়া

#পর্ব_৩২

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

– আমি আপনাকে ভালোবাসি না।

– কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি।

– ফিরবো না আমি আর কখনও।

– আমি ফিরতে বাধ্য করবো।

– বড্ড বেশি কথা বলেন আপনি।

– কতদিন পর তোমাকে খুঁজে পেলাম বলো তো, কথা আপনা আপনি বেড়িয়ে যাচ্ছে।

উঠে দাঁড়ালো মৌমিতা, চিৎকার করে বলল – আমি কখনও ক্ষমা করবো না আপনাকে, কখনও না। সেদিন যদি আপনি আমাকে আটকে না রাখতেন তাহলে বোধহয় আমি শেষ বারের জন্য আমার বাবাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পেতাম। বাবা বলে ডাকতে পারতাম তাকে। পূরন করতে পারতাম তার শেষ ইচ্ছে।

কান্নায় ভেঙে পড়লো মৌমিতা। কতদিনের জমানো অভিমানের কথা আজ উগলে দিয়েছে সে। তাজ একটুও ভরকালো না । সে যেন আগে থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। সে এগিয়ে গেল মৌমিতাকে শান্তনা দিতে। তাজ ছোঁয়ার আগেই সরে গেল মৌমিতা। নিজের কান্না থামিয়ে চিৎকার করে বলল – ছোঁবেন না আমায়, আপনি ছোঁবেন না আমায়।

তাজ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। মৌমিতা নিজেকে শান্ত করে হাঁটা ধরলো সামনের দিকে। তাজ পিছু ডাকলো তার। মৌমিতা থমকে দাঁড়ালো তবে পিছু ফিরলো না। তাজ বলল – একটু জড়িয়ে ধরবে আমাকে?

মৌমিতা পিছু ফিরে তাকালো, একবার তাজের দিকে অগ্নী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার হাটা ধরলো। তাজও ছুটলো মৌমিতার পিছু পিছু। দৌড়ে গিয়ে মৌমিতার পথ আগলে দাঁড়ালো। মৌমিতা ভ্রু কুঁচকে শুধালো – সমস্যা কি?

– বারে তোমাকে নিয়ে এলাম আমি , তো পৌঁছে দেব না আবার?

– আমিই একাই চলে যেতে পারবো।

– সে আমি জানি তবুও আমার একটা কর্তব্য আছে না? দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আমার। তার উপর সুন্দরী। রাস্তায় যদি কেউ চুরি করে নিয়ে যায়।

মৌমিতা কটমট করে বলল – এতদিন যখন নেয়নি এখনও নিবে না।

– এতদিন তো তুমি এত সুন্দর ছিলে না। আমি দেখার পরই বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছো।

– যতসব ফালতু কথা।

– আই লাভ ইউ।

থতমত খেয়ে গেল মৌমিতা। কি কথার মধ্যে কি? তাজের এই এলোমেলো কথা বলার অভ্যাসটা আর গেলো না। তাজ মৌমিতার হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসালো। নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল তাজ। ছুটে চললো গন্তব্যের দিকে। গাড়িতে পিনপতন নীরবতা। অবশেষে নীরবতা ভেঙে কেশে উঠলো তাজ। গলা ঝেড়ে বলল – কিছু বলছো না যে?

– কি বলবো?

– বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছো তুমি।

– সময় মানুষকে চুপচাপ করিয়ে দেয়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাজ। মৌমিতার বাসার সামনে দাঁড় করালো গাড়িটা। মৌমিতা বিনা বাক্যে নেমে চলে গেল। যাওয়ার আগে তাজকে বিদায় জানালো না একটুও।‌ তাজ করুন চোখে মৌমিতার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

__________________________________

দুপুরের তপ্ত রৌদ্র। মাথার উপর খা খা জ্বলছে সূর্যটা। বৈশাখ মাসের তীব্র গরমে নাজেহাল প্রাকৃতি। তীব্র গরমকে মাথায় করেই ছুটে চলছে ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত মানবরা। ক্লাস শেষ করে মাত্রই বেড়িয়েছে মৌমিতা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ওরনা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ে যেতে নিলে এক শক্তপোক্ত পুরুষালী হাত আঁকড়ে ধরলো মৌমিতার কোমড়। নিজের মুখ থেকে ওরনা সরিয়ে উপরের দিকে তাকাতেই ভেসে উঠলো এক মায়াভরা ঘর্মাক্ত পুরুষালী মুখমন্ডল। মৌমিতা অবাক হয়ে দেখছে এই পুরুষকে। কি মায়া রয়েছে ঐ মুখটায় যেন সারাজীবন তাকিয়ে থাকা যায়। কপাল চুঁইয়ে চুঁইয়ে টপটপ করে ঘাম ঝড়ছে তাজের। ফর্সা মুখশ্রী তীব্র গরমে লাল হয়ে গেছে। গায়ে জড়ানো আকাশী রঙের শার্টটা গায়ে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। এই পুরুষকে কি সব রূপেই মোহনীয় লাগে নাকি শুধু ওর চোখেই মোহনীয় লাগে মাথায় ঢুকছে না মৌমিতার।মৌমিতা ধাতস্ত করলো নিজেকে। তাজকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। একবার তাজের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চললো সামনের দিকে ফার্মেসিতে যেতে হবে। আসার সময় দেখে এসেছে মায়ের প্রেসারের ঔষধটা শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। তাজ পথ আগলে দাঁড়ালো মৌমিতার, বলল – কোথায় যাচ্ছো? দেখতে পাচ্ছো না, আমার মতো একটা জলজ্যান্ত মানুষ তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে?

– কেন এসেছেন এখানে?

– আমি আসবো না তো কে আসবে?

– বাজে কথা বাদ দিয়ে বলুন কেন এসেছেন?

খপ করে মৌমিতার হাতটা ধরলো তাজ, বলল – চলো আমার সাথে।

– কোথায়?

তাজ দুষ্ট হেসে বলল – বাসর করতে।

মৌমিতা বড় বড় চোখ করে তাজের দিকে তাকালো। এই লোকের মাথা টাথা কি খারাপ হয়ে গেলো নাকি? এখন আর এই লোককে রাগতে তো দেখা যাচ্ছে না আগের মতো তবে লোকটার মুখে উদ্ভট মার্কা কথা যেন লেগেই আছে। সব সময় আজগুবি সব কথা বার্তা। তাজ মৌমিতাকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসালো। গাড়ি স্টার্ট করে দিল চোখের পলকেই। পথিমধ্যে মৌমিতা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে ” আমরা কোথায় যাচ্ছি ?” তাজ বারবারই বলেছে ” গেলেই দেখতে পাবে। বড় একটা শপিং মলের সামনে এনে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে তাজ। মৌমিতা ভ্রু কুঁচকে শুধালো – এখানে এসেছি কেন আমরা?

– বারে আমার শালাবাবুর বিয়ে বলা কথা সেখানে যেতে হবে না তাই শপিং করতে হবে না?

– শালা বাবু কে?

– কেন তোমার পাতানো বয়ফ্রেন্ড সাফওয়ান।

নড়েচড়ে বসলো মৌমিতা। তার মানে‌ এই বান্দা সাফওয়ানের পরিচয় জেনে গেছে। বড্ড ধুর্ত হয়ে গেছে লোকটা । তবুও কন্ঠে গভীরতা এটে বলল – ওর বিয়েতে আপনার যাওয়ার দরকার নেই।

– আমার শালাবাবু নিজে আমাকে দাওয়াত করেছে। বলেছে অপেক্ষা করবে আমার জন্য। পরে যদি আমার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বিয়েই না করে শালা বাবু। আমাকে যে যেতেই হবে।

তাজ একে একে শপিং করলো সবার জন্য। মৌমিতাকে পি পই করে বলে দিল এটা তোমার, এটা আমার একমাত্র শালা বাবুর , এটা আমার একমাত্র শ্বাশুরির। মৌমিতা নিল না কিছুই। গাড়ি থেকে বেড়িয়ে হনহন করে চলে গেল। তাজ জোরে নিঃশ্বাস নিল একটা। মৌমিতার বাসার দিকে তাকালো। সাহস করতে হবে তার। সাহস করলে বউ থাকবে না হয় বউ হারাতে হবে। শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মৌমিতার বাসার দিকে। দোতলা বিশিষ্ট একটা বাড়ি। এই বাড়িরই দোতালায় তিন রুম, কিচেন , ওয়াশ রুম নিয়ে থাকে মৌমিতারা। মৌমিতাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল তাজ। একটু জিরিয়ে সাহস সঞ্চয় করে দরজায় টোকা দিল বার কয়েক। ভিতর থেকে আওয়াজ এলো “আসছি”

মিনিট খানেক পর এক মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুলে দিল। গায়ে জড়ানো একটা আকাশী পাড়ের সাদা শাড়ি। শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় দেওয়া। ভদ্র কন্ঠে মহিলা বলল – কাকে চাই বাবা?

মহিলার চোখে মুখে একটা মা মা ভাব। বড্ড মায়া মারা মুখটা। এই বুঝি মৌমিতার মা। কিছুটা মিল রয়েছে মৌমিতা চেহারার আদলের সাথে। তাজ শান্ত কন্ঠে সালাম দিল , বলল – আসসালামুয়ালাইকুম, ভিতরে আসতে পারি?

মহিলা বড্ড সহজ সরল। না হয় এমন অপরিচিত একজনকে বাসার মধ্যে ঢুকতে দেয়। একটু সরে তাজকে ভিতরে ঢোকার জায়গা করে দিল ভদ্র মহিলা। ছোট্ট ফ্ল্যাটটা বেশ গোছানোভাবে সাজানো। অনেক দামী জিনিসপত্র দিয়ে ঘরটা সাজানো না হলেও মধ্যবিত্ত ধাঁচের মালামাল দিয়ে বেশ পরিপাটি ভাবে সাজানো বাসাটা। তাজ চোখ বুলিয়ে দেখে নিল বাসাটা। মাহিমও তখনই কেবল কলেজ থেকে ফিরেছে। বাড়ির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতেই হাক ছাড়লো – মা মা , পানি দেও। বাইরে কি গরম রে বাবা।

বাসার ভিতরে ঢুকে হঠাৎই পা জোড়া থমকে গেল মাহিমের। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সে তাজের দিকে। সামনের ব্যক্তিকে দেখে মোটেও চিনতে অসুবিধা হয়নি মাহিমের। তাজকে দেখে প্রচন্ড চমকে গেছে সে। এতদিন পর এভাবে মোটেও আশা করেনি তাজকে। তবে কি এতদিন পর তার বোনের জীবনে আবার বসন্তের ফুল ফুটলো? বোনের বিষন্ন মুখটা দেখে সে বারংবারই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছে তাজকে আবার তার বোনের কাছে এনে দিতে। বোন কখনও মুখ ফুটে কিছু না বললেও সে ভালোভাবেই তার বোনের মনে অবস্থা বুঝতে পেরেছে। তার বোনের বিষন্ন চেহারা দেখে কেঁদে উঠছে তার মনও। তবে বোনের সামনে কখনও সাহস অরে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি সে। আজ এতদিন পর হঠাৎ তাজকে দেখে অবাকের সাথে খুশিও হয়েছে ভীষন। অতিরিক্ত আনন্দে যেন বাকহারা হয়ে গেছে সে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে মাহিম হাসি হাসি মুখ করে বলল – কি বিবাহিত দুলাভাই কেমন আছেন?

একইসাথে মাহিমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তাজ এবং জাহানারা বেগম ( মৌমিতা ও মাহিমের মা ) । মাহিম বিবাহিত দুলাভাই কেন বলল? তবে কি সে তাজ আর মৌমিতার বিয়ে সম্পর্কে জানে? জাহানারা বেগম ভ্রু যুগল কুঁচকে রেখেই জিজ্ঞেস করল – এই ছেলেটাকে তুই চিনিস মাহিম?

– আহ চিনবো না? তোমার মেয়ের জামাই বরন করে ঘরে তুলেছো তো?

চমকে উঠলো জাহানারা বেগম। মৌমিতা আগেই তার বিয়ের কথা পরিবারকে জানিয়ে দিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর সবাই যখন চেপে ধরেছিল মৌমিতাকে বিয়ের জন্য। মৌমিতা তখন ভরা সমাজে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলেছিল তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তার জন্য এই সমাজ তার নামে কম কুৎসা রটায়নি। অনেকেই তিরস্কার করে বলেছিল , ” মেয়ে পড়তে পাঠিয়েছিলে ঢাকায় সে তো সেখানে নাগর জুটিয়ে এসেছে। আবার বলছে বিয়েও করেছে। ” কেউ কেউ আবার বলেছে ” আজকাল আবার বিয়ের দরকার হয় নাকি, কোথায় গিয়ে একসাথে থেকেছে টেকেছে এখন বলছে বিয়ে হয়ে গেছে । ” অনেকেই মৌমিতার চরিত্র নিয়ে বারংবার প্রশ্ন তুলেছিল। আত্মীয় স্বজন যে যেখান থেকে পেরেছে কথা শুনিয়ে গেছে। তবে মৌমিতা বলেনি কিছুই। সে প্রতিবাদ করেনি কারও কথার। বাবার মৃত্যুর পর মেয়েটা একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আর জাহানারা বেগম যেন মেয়ের কথায় দ্বিতীয় ধাক্কা খেয়েছিলেন তখন। স্বামীর মৃত্যুর পর পরই যখন জানতে পারেন মেয়ে তার ঢাকায় পড়তে গিয়ে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফিরেছে তখন যেন পাথর বনে গিয়েছিল সে। মেয়েকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল এই বিষয়ে কিছু মেয়ে শুধু বিয়ে করেছি ছাড়া কিছুই বলেনি কখনও। এই বিষয়ে সকল প্রশ্নে সবসময়ই নীরবতা পালন করেছে সে।

চলবে….

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply