#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা
#সাদিয়া
#পর্ব_২৮
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
– কোথায় যাচ্ছো তুমি?
– আমার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে তাজ। আমাকে এখনই যেতে হবে।
দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ধরলো মৌমিতা। পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো তাজ। বলল – কোথাও যাবে না তুমি।
চমকে উঠলো তাজ, চকিত দৃষ্টি অব্যাহত রেখেই বলল – কি বললে তুমি? আমার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে আর আমি যাবো না?
– মিথ্যা বলছো তুমি। কোনো এক্সিডেন্ট করেনি তোমার বাবা। অন্য কাউকে বিয়ে করবে তাই না? আমাকে ছেড়ে যেতে চাইতো তুমি? সেদিন তোমার মা বলেছিল তাই না। কোথাও যাবে না তুমি।
– এসব কি বলছো তুমি? তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
হিংস্র হয়ে উঠেছে তাজ। চোখ মুখে উপচে পড়া রাগ। চিৎকার করে বলল – মাথা আমার একদম ঠিক আছে তাই তো এই কথা বলছি আমি। কি ভেবেছো কিছু বুঝতে পারি না আমি?
হতভম্ব মৌমিতা। তাজ যে এমন কিছু করবে কখনও ভাবতেও পারেনি সে। তাজের মানসিক বিক্ষীপ্ততার জন্য হয়তো সে রেগে যেতে পারে। সাময়িক রাগ কন্ট্রোল করার জন্য হয়তো একটু খারাপ ব্যবহারও করতে পারে কিন্তু এমন অমানবিক, নির্দয়ের মতো আচরণ করবে কখনও কল্পনাও করতে পারেনি মৌমিতা। মৌমিতার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে, অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক কিন্তু তাজ যেতে দিবে না তাকে। কোনো সন্তান কি মেনে নিতে পারে এটা।
মৌমিতাকে টেনে হিচড়ে রুমের মধ্যে বন্ধী করে রাখলো তাজ। মৌমিতা সমানে দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে বলছে – আমাকে যেতে দেও তাজ। আমার বাবা খুব অসুস্থ। তুমি আমার সাথে এমনটা করতে পারো না।
মৌমিতার আর্তনাদ হয়তো পৌঁছাচ্ছে না তাজের কানে। সে খাবার টেবিলে চলে গেল সকালের নাস্তা ঘুচাতে। ডুকরে কেঁদে উঠলো মৌমিতা। কেঁদে কেঁদে বলল – তুমি আমার সাথে এমনটা করতে পারো না তাজ। এতটা পাষান তুমি হতে পারো না।
মৌমিতার আর্তনাদ শুনে ছুটে এলো রাদীফ। দৌড়ে গেল তাজের কাছে। অনুরোধ করে বলল – মেয়েটাকে যেতে দে ওর বাবা এক্সিডেন্ট করেছে।
তেতে উঠল তাজ, রাগী কন্ঠে বলল – আমার থেকে বেশি জানো তুমি? ওর বাবা কোনো এক্সিডেন্ট টেক্সিডেন্ট করেনি। ওসব সাজানো নাটক। অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিবে ওকে। আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে ও।
– তুই ভুল বুঝছিস তাজ। মৌ তোকে ছেড়ে যাবে না। ও তোকে ভালোবাসে।
– আমি কিছু শুনতে চাইছি না। আমি মৌকে কোথাও যেতে দেব না ব্যস শেষ।
রাদীফের হাজার অনুরোধও মন গলাতে পারেনি তাজের। কিছুক্ষণ পর থেমে গেল মৌমিতার আর্তনাদ। দরজা ধাক্কানোর শব্দ আর আসছে না। চারদিক কেমন নীরব হয়ে গেছে। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে হয়তো ক্লান্ত হয়ে দরজা ধাক্কানো বন্ধ করেছে সে। পাত্তা দিল না তাজ। নিজের কাজে নিজে মন দিল আবার।
ঘন্টাখানেক পর খাবার রেডি করে খাবার হাতে রুমে পৌঁছাল তাজ। দুজনের খাবার এনেছে সে। এখন প্রায় দুপুর। সকালে ঝামেলায় ঝামেলায় ব্রেকফাস্ট করা হয়নি কারোরই। এখন দুজনে মিলে একসাথে খাবে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই চমকে গেল তাজ। ভিতরে কেউ নেই। পুরো রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মৌমিতাকে পাওয়া গেল না। ওয়াশ রুমেও নেই সে। বন্ধ রুম থেকে উধাও হয়ে গেল নাকি মেয়েটা? তাজের কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। আচ্ছা বারান্দায় নেই তো মেয়েটা। দৌড়ে গেল বারান্দায়। বারান্দায় পৌঁছাতেই পা জোড়া থমকে গেল মৌমিতার। খোলা বারান্দায় লম্বা করে শাড়ি বাধা। তাজের আর বুঝতে বাকি নেই এখানে কি হয়েছে। মৌমিতা পালিয়েছে। এই শাড়ি বেয়ে নিচে নেমেই মৌমিতা পালিয়েছে। তাজ কেমন বুদ্ধিশুন্য হয়ে পড়েছে। দৌড়ে এলো রুমে। বিছানার এক কোনে ভাঁজ করা একটা কাগজ রাখা। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা তুলে নিল হাতে। কাগজের ভাঁজটা খুলে তাকাতেই যেন পুরো দুনিয়া থমকে গেল তার।
প্রিয়
ভালোবাসা নিবেন। আপনি বলে সম্বোধন করলাম কারন আজকের পর থেকে আর আপনার সাথে আমার তুমির সম্পর্কটা থাকবে না। আপনি মানসিক ভাবে বিক্ষীপ্ত, খারাপ যেমনই হোন না কেন আমি সব মেনে নিয়েছি। কারন ভালোবাসি আপনাকে। আপনার সব আবদার আমি মেনে নিয়েছি। আপনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন মেনে নিয়েছি আমি। আমি এতিম না তবুও বাবা মাকে না জানিয়ে তাদের ছাড়াই বিয়ে করে নিয়েছি আপনাকে। আপনি আমাকে এ বাড়িতে থাকতে বলেছেন মেনে নিয়েছি আমি। আপনার রুমে থাকতে বলেছেন মেনে নিয়েছি আমি। শেষ পর্যন্ত আপনি আমাকে আমার থেকে চেয়ে নিয়েছেন দিয়ে দিয়েছি আমি। সবকিছুর বিনিময়ে আপনি আমাকে শুধুমাত্র একটু বিশ্বাস করতে পারলেন না ? পারলেন না আমার ভালোবাসাকে বিশ্বাস করতে? আপনি আমার সাথে বারবার খারাপ ব্যবহার করেছেন মুখ বুজে সহ্য করেছি আমি। আমি বুঝেছি আপনাকে। সবসময় আপনার দিকটাই ভেবেছি আমি। সবকিছুকে ছাপিয়ে ভালোবেসেছি আপনাকে কিন্তু আপনি কি করলেন? সামান্য বিশ্বাসটুকু করতে পারলেন না আমাকে। আপনার সাথে আমার পরিচয় প্রায় এক বছর। সম্পূর্ণ এক বছর হয়নি তবুও ধরে নিলাম না হয় এক বছর হয়েছে। আর আমার বাবা। মা আমাকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে আজ ১৯ বছর। ভুলটা আমারই তাদের ১৯ বছরের ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে আপনার মাত্র এক বছরের ভালোবাসাকে আমি বড় করে দেখেছি। তাদের ভালোবাসার অমর্যাদা তো আমি সেদিনই করেছি যেদিন তাদের না জানিয়ে আপনাকে বিয়ে করেছিলাম আমি। কিন্তু আজ আমি আর পারলাম না। আমার বাবা এক্সিডেন্ট করেছে ওখানে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে আল আপনি আমাকে এখানে আটকে রেখেছে। আপনি একদিন আমায় বলেছিলেন না যদি কখনও আমার মনে হয় আপনার সাথে আমার থাকা সম্ভব না। সত্যিই আজ আমার মনে হচ্ছে আপনার মতো একজন মানুষের সাথে আমার থাকা সম্ভব নয়। তাই চলে যাচ্ছি আমি। ভালো থাকবেন আপনি। মানলাম আপনি মানসিক ভাবে সুস্থ নন। কিন্তু নিজের বেলায় তো সবটাই ভালো বুঝেন শুধু মাত্র আমার বেলায়ই আপনি অবুঝ। বিশ্বাস নেই আমার উপর। আমাদের বিয়েটা মৌখিকভাবে কবুল পড়ে হয়েছে কোনো ডকুমেন্ট নেই এই বিয়ের তাই ডিভোর্সেরও কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। আমি আর কখনও ফিরবো না। আজ আমি আমার ১৯ বছরের ভালোবাসাকেই বেছে নিলাম। ভালো থাকবেন আপনি। নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন। আমি আর ফিরবো না। সব ভালোবাসার শেষটা সুন্দর হয় না। আমাদের শেষটায় না হয় বিচ্ছেদই লেখা ছিল।
ইতি
আপনার হারানো
” কেউ “
চিৎকার করে বসে পড়লো তাজ। মাথা চেপে ধরলো সে। তাজের চিৎকার শুনে দৌড়ে এলো রাদীফ। জিজ্ঞেস করলো – কি হয়েছে?
হামলে পড়লো তাজ। ঝাপটে ধরলো রাদীফকে। অস্থির হয়ে বলল – আমার আমার মৌ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। চলে গেছে ও । কেন চলে গেল? বলেছে আর নাকি আমার কাছে ফিরবে না সে? আমি কিভাবে বাঁচবো ওকে ছাড়া? কিভাবে থাকবো আমি?
হঠাৎ ছেড়ে দিল রাদীফকে। ছুটে গেল রাস্তায় একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা নীরার বাসায় চলে গেল। নীরার বিল্ডিং – পুরুষ লোক এলাউ করে না। কিন্তু কোনো চিন্তা ভাবনা না করেই ঢুকে গেল তাজ। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল নীরা। দৌড়ে ঢুকে গেল রুমের মধ্যে। চারদিকে হন্যে হয়ে খুঁজে চিৎকার করে বলল – আমার মৌ কোথায়? কোথায় লুকিয়ে লুকিয়ে রেখেছো আমার মৌকে। আমি জানি এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে মৌ। মৌ কোথায় তুমি বেরিয়ে এসো। এমন লুকোচুরি খেলা কিন্তু আমার একদম ভালো লাগছে না। খুব অস্থির লাগছে আমার।
আকর্ষিক ঘটনায় হতবম্ব হয়ে গিয়েছিল নীরা। আর মৌ মানে মৌমিতা? সে কোথায়? সে এখানে আসবে কেন? নীরা অনেকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো – মৌমিতা তো আপনার ওখানে ছিল। এখানে আসবে কি করে?
রাদীফও ছুটে এসেছিল তাজেরই পিছু পিছু। যাই হোক না কেন, এমন সময়ে তাজকে একা ছাড়া একদম ঠিক হবে না। রাদীফ ঠান্ডা মাথায় ভাবলো সবটা। মৌমিতাকে অনেকবার কলও করেছিল কিন্তু বারবারই নাম্বার বন্ধ বলছে। কেউ যদি পালিয়ে যায় তাহলে কি সে নাম্বার খোলা রাখবে? অবশ্যই না, বন্ধই রাখবে। তবুও রাদীফ নিজের মনকে বোঝানোর জন্য বেশ কয়েকবার ট্রাই করেছিল মৌমিতার নাম্বারে। আর পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও রাদীফ মৌমিতাকে কোনো দোষ দিচ্ছে না। পিতা মাতার এমন ঘটনা শুনে কোনো সন্তানই চুপ করে বসে থাকতে পারে না। মৌমিতাও পারেনি। তার উপর তাকে তাজের ঘরবন্দি করে রাখা। এ ছাড়া তো মেয়েটার আর কোনো উপায় ছিল না। তবে যেভাবেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে মেয়েটাকে না হয় হয়তো তাজকে বাঁচানোই সম্ভব হবে না। রাদীফ ঠান্ডা মাথায় নীরাকে প্রশ্ন করলো – মৌমিতাদের বাসা সিলেটের ঠিক কোথায় বলতে পারো তুমি?
– ঠিক বলতে পারি না। শুনেছি ওদের নিজস্ব বাড়ি সিলেটে হলেও ওরা নিজেদের বাড়িতে থাকে না। ওর বাবার চাকরির সূত্রে পরিবারসহ সিলেটের অন্য অঞ্চলে থাকে। ওর বাবা চাকরির সূত্রে যেখানে থাকে ওখানকার ঠিকানা আছে আমার কাছে।
– ওটাই দেও। দেখি ওখানে গিয়ে পাই কিনা।
নীরার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তাজকে নিয়ে ঐদিন রাতের গাড়িতেই রওনা দিল সিলেটের উদ্দেশ্যে। সিলেটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর হয়ে গেছে। আর ঠিকানা খুঁজে বের করতে করতে সকাল ১০ টার বেশি বেজেছে।
একটা বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাদীফ আর তাজ। লোকজনের কাছে যতটুকু জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছে মৌমিতারা এই বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকতো। কাঁপা কাঁপা হাতে কলিং বেল চাপলো তাজ। এক মধ্যবয়সী বেশ স্বাস্থ্যবান মহিলা দরজা খুলে দিল। বলল – আপনারা কারা ঠিক চিনতে পারলাম না তো?
তাজ বলল – মৌ মানে মৌমিতারা আছে?
– মৌমিতা মানে তুমি মনীর সাহেবের মেয়ের কথা বলছো? ওরা তো নেই এখানে।
ব্যাকুল হয়ে পড়লো তাজ। রাদীফ শান্তনা দিল তাজকে। শান্ত কন্ঠে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল – কোথায় গেছে ওরা বলতে পারেন?
– ওদের দেশের বাড়িতে গিয়েছে। কখন মানুষের মৃত্যু আসে কেউ বলতে পারে না । এই তো পরশু মনির সাহেব একদম ঠিক ছিল। কাল সকালেই রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করলো। শেষ রক্ষা আর হলো না। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা গিয়েছেন। লোকটা বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন। মৌমিতাও এখানে ছিল না ঢাকায় পড়াশোনা করতো। বাবার মৃতদেহ দেখে মেয়ের সে কি আহাজারি। শুনেছি মেয়েও বাবার শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে তাকে।
– মৌমিতাদের দেশের বাড়ি কোথায় বলতে পারেন?
– তা তো জানি না। শুধু এইটুকু জানি ওদের বাড়ি সিলেটের সুনামগঞ্জে।
তাজ কেমন পাথর হয়ে গিয়েছে। কথা বলছে না কোনো। হয়তো নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে। তাজের বাহু ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলো রাদীফ, বলল – এখন সুনামগঞ্জ যেতে হবে।
মুখ খুললো তাজ। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। দুই হাতে মুখ চেপে বলল – আমি অন্যায় করেছি কাকাই। মৌ সত্যি বলেছিল, ওর বাবা এক্সিডেন্ট করেছিল। মারা গেছে ওর বাবা। আর আমি সবটা মিথ্যা মনে করে ওকে আটকে রেখেছিলাম। ও কি কোনোদিন ক্ষমা করবে আমাকে? কোথায় আমার মৌ? কোথায় আছে সে? কেমন আছে সে?
চলবে….
Share On:
TAGS: প্রণয়ের ব্যাকুলতা, সাদিয়া
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৬
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৯
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২০
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৪
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৪
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৯
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৬
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৫