Golpo প্রণয়ের ব্যাকুলতা

প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৪


#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা

#সাদিয়া

#পর্ব_২৪

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

কোথাও সুখের ছোঁয়া, কোথাও দুঃখ। ব্যস্তময় হাসপাতাল। কেউ প্রিয় মানুষদের সুস্থ করে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ছে আবার কেউ প্রিয় মানুষকে হারানোর বেদনায় কান্নায় ভেঙে পড়ছে। ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে মৌমিতার মন। অজানা ভয় যেন ঘিরে রেখেছে তাকে তবে কি তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে তাজ। কেন এমন হলো? সবটা ওর জন্যই হয়েছে। ওর জন্যই তাজ আজ এতটা কষ্ট পাচ্ছে, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে । না ও আইসক্রিম খেতে চাইতো আর না এমনটা হতো। নিজের উপর নিজের ভীষণ রাগ লাগছে মৌমিতার। পাগলের মতো বিলাপ করে যাচ্ছে সেই কখন থেকে। একটু পর পর ডুকরে কেঁদে উঠছে। পাশে দাঁড়িয়ে নীরা তাকে শান্তনা দিচ্ছে।

করিডোরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে রাদীফ। তাজকে নিয়ে হাসপাতালে আসার পরই ডাক্তাররা তাকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেছে। টানা তিন ঘন্টা হয়ে গেছে এখনও অপারেশন চলছে। হঠাৎ একজন নার্স বেরুতেই রাদীফ অস্থির হয়ে জানতে চাইলো তাজের অবস্থা। নার্সটি কিছুই বলল না দ্রুত প্রস্থান করলো সেখান থেকে , মিনিট পাঁচেক পর কিছু একটা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আবার ঢুকে পড়লো অপারেশন থিয়েটারে। তার মিনিট দশেক পরই এক ডাক্তার বেরিয়ে এলো। মধ্যবয়সী পুরুষ ডাক্তার। চোখে চশমা। মাক্স আর অপারেশনের পোশাকে পুরো শরীর ঢাকা। রাদীফ আবার হামলে পড়লো , অস্থির হয়ে শুধালো – তাজের কি অবস্থা?

ডাক্তার মুখের মাক্সটা একটু টেনে বলল – ডোন্ট ওয়ারি, পেশেন্ট এখন আউট অফ ডেঞ্জার। মাথায় তেমন গুরুতর আঘাত না লাগায় অল্পতে পাড় পেয়েছে তবে ডান হাতটা ভেঙ্গেছে। আর চোট পেয়েছে অনেক জায়গায় সে চোটগুলোও গুরুতর নয়। ব্লাড লেগেছিল ভাগ্য অত্যন্ত ভালো থাকায় ব্লাড ব্যাংকেই ব্লাড পাওয়া গেছে। পেশেন্টকে একটু পর কেবিনে শিফট করা হবে। চিন্তা করবে না।

– ধন্যবাদ ডাক্তার শায়িখ।

– ধন্যবাদ দিতে হবে না বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। উনি বাঁচিয়েছেন তাজকে না হয় যেভাবে এক্সিডেন্ট করেছে তাতে বাঁচার কথা নয়। এনি ওয়ে , সাদিককে জানিয়েছো তাজের এক্সিডেন্টের কথা?

– না উনি দেশের বাইরে তাছাড়া উনাকে জানানো আর না জানানো সমান কথা।

ডাক্তার শায়িখ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অতঃপর রাদীফকে বলল – তুমি একটু আমার কেবিনে এসো। তোমার সাথে কিছু কথা বলার আছে।

ডাক্তার শায়িখ চলে যেতেই নীরা প্রশ্ন করলো – ডাক্তার কি আপনাদের পূর্ব পরিচিত?

– হু তাজের বাবার বন্ধু।

এই টুকু বলেই ডাক্তার শায়িখের পিছু পিছু হাঁটা ধরলো সে। মৌমিতা উঠে দাঁড়ালো। শরীর এখনও রক্তমাখা পোশাকে আচ্ছাদিত। তাজকে নিয়ে হাসপাতালে আসার পর এক বিন্দুও নড়েনি এখান থেকে। অপারেশন রুমে উঁকি ঝুঁকি মেরে তাজকে এক নজর দেখার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে সে। টেনে নিয়ে এলো নীরা। শান্ত কন্ঠে বলল – চল পোশাক বদলাবি। পুরো শরীরে রক্তে মাখামাখি।

মৌমিতা থমথমে গলায় উত্তর দিল – আমি কোথাও যাবো না। তাজের কাছেই থাকবো আমি।

– শুনলি না তাজকে একটু পর কেবিনে দিবে। এভাবে রক্ত মাখা পোশাকে কিন্তু তোকে কেউ কেবিনে ঢুকতে দিবে না। চল ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে আসবি।

টনক নড়লো মৌমিতার। উঠে দাঁড়ালো সে। যাওয়ার আগে এক পলক তাকালো অপারেশন রুমের দিকে , বিষন্ন মনে আবার পা বাড়ালো সামনের দিকে।

_______________________________

কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে তাজের। টানা ৮ ঘন্টা পর তার জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফেরার কথা শুনেই এক প্রকার দৌড়ে ছুটে গেছে তাজের কাছে মৌমিতা। ছেলেটার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে বর্ন ধারন করেছে। এক হাত সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে গলায় জুলানো। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে প্যাচানো।মুখের উপর ছোট খাট কাটা ছেঁড়ার দাগ। শরীরে হাসপাতালের জামা কাপড়। মৌমিতার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাজকে। হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলো। ভরকে গেল তাজ। সাথে ব্যথাও পাচ্ছে খুব। শরীরে এক্সিডেন্টের অসংখ্য কাটা ছেড়া রয়েছে। তার উপর মৌমিতার এভাবে জাপটে ধরা। তবে এই ব্যথার চেয়ে মৌমিতার এমন অস্থিরতা দেখে কেমন যেন সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে তাজের। আস্তে ধীরে মৌমিতার মাথায় হাত রাখলো সে, ধীর কন্ঠে বলল – কি করছো এভাবে কেউ কাঁদে? কাঁদলে তোমাকে কিন্তু ভীষন বিশ্রী লাগে মৌ।

মৌমিতা মাথা তুললো তাজের বুক থেকে। নাক টেনে টেনে বলল – সব সময় শুধু বাজে কথা। জানেন আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই বুঝি আপনাকে হারিয়ে ফেললাম আমি।

মুচকি হাসলো তাজ। মৌমিতা কপট রাগ দেখিয়ে শুধালো – আপনি হাসছেন? আর আমি আর একটু হলেই আপনার চিন্তায় শেষ হতে বসেছিলাম।

– ইসসসস শেষ হওয়া এত সহজ নাকি? এই পৃথিবীর বুকে তাজের নিঃশ্বাস যতদিন চলবে ততদিন তার মৌয়ের কিছুই হতে পারে না।

– আসছে যতিশী।

– তা ঠিক তবে আমার একটাই কষ্ট।

– কি?

– আমার আইসক্রিম দুটো ঐ বজ্জাত লোকগুলো পাড়িয়ে থেতলে দিয়েছে। আমি জ্ঞান হারানোর আগে দেখেছি ‌।

অবাক হলো মৌমিতা। এতবড় একটা এক্সিডেন্ট করেও এই লোক কিনা আইসক্রিম দেখছিল। আইসক্রিম কে পাড়ালো আর কি করলো এই লোকের খেয়াল ছিল সেদিকে।

জ্ঞান ফেরার পর থেকে আইসক্রিম আইসক্রিম করে সবাইকে জ্বালিয়ে মারছে তাজ। মৌমিতা বিরক্ত হচ্ছে এবার। ডাক্তার সাফ সাফ বারন করে দিয়েছে এই অবস্থায় তাজকে যেন আইসক্রিম দেওয়া না হয়‌। আর তাজও নাছোড়বান্দা সে এই হাসপাতালেই মৌমিতার সাথে বসে বসে আইসক্রিম খাবে। হাতে হাত রেখে মৌমিতা সাথে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে আইসক্রিম খেতে পারেনি তাতে কি হয়েছে সে এখন হাসপাতালে বসে বসে আইসক্রিম খাবে। আগে তো এই লোকের মাথার একটা তার ছেড়া ছিল এখন এক্সিডেন্টে এই লোকের মাথার সব কয়টা তার ছিঁড়ে গেছে নাকি ভেবে পায় না মৌমিতা । কিন্তু ডাক্তার তো বলল ওর মাথায় নাকি আঘাত লাগেনি। ডাক্তার কি তবে ওর মাথার আঘাত ধরতে পারেনি? এই মুহূর্তে মৌমিতার মনে হচ্ছে এই লোক বেহুঁশ অবস্থায়ই ভালো ছিল। কেন যে কান্না কাটি করে এর জ্ঞান ফিরাতে গেল। এখন যদি ওর সাধ্য হতো তাহলে মাথায় একটা বারি মেরে আবার অজ্ঞান করে রাখতো।

এক হাত তো ভাঙা আরেক হাত দিয়ে মৌমিতার হাত চেপে ধরেছে তাজ। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে দিয়ে বলল – দু’টো আইসক্রিম এনে দেও না বউ।

– ডাক্তার বারন করেছে।

– ডাক্তারের সব কথা কি শুনতে হয় বউ, দেও না এনে।

মৌমিতা বিরক্তি কন্ঠে অনেকটা মুখ ফসকেই বলে উঠলো – তাজ….

কেঁপে উঠলো তাজ। থমকে গেল যেন। ও কি কানে ভুল শুনেছে? মৌমিতা ওকে নাম ধরে ডাকলো যেন। হ্যা তাই তো। হঠাৎই যেন ওর নামটা ওর কাছে ভীষণ সুন্দর মনে হলো। মৌমিতা ডেকেছে বলে? অধর প্রশস্ত করে হাসলো তাজ, হাসি হাসি মুখে বলল – কি বললে আরেকবার বলো তো। তুমি আমার নাম ধরে ডেকেছো?

থতমত খেয়ে গেল মৌমিতা। কখন যে তাজের নাম ধরে ডেকে ফেলেছে নিজেই বুঝতে পারেনি। লজ্জায় মিইয়ে গেল সে। আমতা আমতা করে বলল – ককককই না তো।

– আমি স্পষ্ট শুনলাম। আবার একবার ডাকো না বউ।

মৌমিতা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে।‌ তাজের নাম ধরে ডাকতে লজ্জা লাগছে তার। তাজ আবার বলল – প্লিজ ডাকো না আমার নাম ধরে। তোমার কন্ঠে আমার নামটা যে বড্ড মিষ্টি শোনায় বউ।

চোখ দুটো বন্ধ করে নিল মৌমিতা। জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল – তাজ….

– আমার নাম ধরে ডাকার জন্য যাও আইসক্রিম খাওয়া বাদ দিলাম‌। তবে এখন থেকে তোমাকে আমার নাম ধরেই ডাকতে হবে আর সাথে তুমি তুমি করেও বলতে হবে।

চোখ ছোট ছোট করে তাকালো মৌমিতা, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল – পারবো না আমি।

– তাহলে এই অবস্থায় আমিও আইসক্রিম খাবো।

– মোটেই না।

– আমি যা বলেছি তা না করলে তখনই দেখা যাবে।

– থ্রেট করছেন আমাকে?

– তুমি যদি তাই মনে করো তাহলে তাই। এখন কথা না বারিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরো।

তাজ এক হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মৌমিতা চারদিকে তাকিয়ে বলল – এটা হাসপাতাল।

তাজ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল – তো ? আমার বউ আমাকে জড়িয়ে ধরবে তাতে কার বাপের কি?

মৌমিতা উসখুশ করছে। লজ্জা লজ্জা লাগছে। হাসপাতালে এতগুলো মানুষের সামনে কিভাবে তাজকে জড়িয়ে ধরবে। এমনি মানুষগুলো কেমন যেন ওদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তাজ পর্যবেক্ষণ করলো মৌমিতাকে । এই মেয়ের যা হাব ভাব তাতে আজ ওকে জড়িয়ে ধরতে পারবে বলে মনে হয় না। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো তাজ। পায়ে টান পড়তেই ” আহ ” করে ব্যথাতুর আর্তনাদ করলো সে। অস্থির হয়ে পড়লো মৌমিতা। দ্রুত এগিয়ে এসে বিছানায় বসালো তাজকে। অস্থির কন্ঠেই শুধালো – সমস্যা কি উঠছিলেন কেন? আপনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন।

– বউ যদি জড়িয়ে না ধরে তাহলে আমাকে উঠেই তো বউকে জড়িয়ে ধরতে হবে তাই না?

হতভম্ব মৌমিতা। এই লোক এই জন্য বিছানা ছেড়ে এই শরীরে উঠে আসছিল। এই লোকের তো লজ্জা শরম নেই সাথে সাথে মৌমিতার লজ্জাকেও নিলামে উঠানোর ধান্ধা। কিন্তু আর কোনো উপায়ও নেই। মৌমিতা জড়িয়ে না ধরলে তাজ উঠে জড়িয়ে ধরবে। আর কোনো উপায় না পেয়ে হাসপাতালে সবার সামনেই তাজকে জড়িয়ে ধরতে হলো মৌমিতাকে। তাজের ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। তাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল – তোমাকে জড়িয়ে ধরলেই আমার সব কষ্ট শান্তি হয়ে যায়।

চলবে….

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply