Golpo প্রণয়ের ব্যাকুলতা

প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২১


#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা

#সাদিয়া

#পর্ব_২১

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

রাদীফের এখন ইচ্ছে করছে কপাল চাপড়াতে। এমন বিয়ে পাগল ছেলে জীবনে ও দেখেনি। আগে তো ছিল বদমেজাজি, মানসিকভাবে বিক্ষীপ্ত এখন তার সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে বিয়ে পাগলা। এই ছেলেকে এখন কিভাবে বুজাবে রাদীফ। তবুও হার না মেনে সে বলল – এভাবে সবটা হয় না তাজ।

তাজও বুঝতে পারছে সবটা এভাবে হয় না‌। ওর বিবেক ওকে বাঁধা দিচ্ছে কিন্তু ওর মন , আবেগ ওকে বারবার বলছে তুই সুস্থ না তাজ, মৌমিতা তোকে যেকোনো সময় ছেড়ে যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা মৌমিতার বাবা মা যদি জানতে পারে তার মেয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষকে ভালোবাসে তারা কখনওই মেনে নিবে না। কোনো পিতা মাতাই কখনও তার সন্তানকে এমন একজন মানুষের হাতে তুলে দিবে না। সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে তাজ। চোখ দুটো লাল টকটকে বর্ন ধারন করেছে। না এবার ও আর মৌমিতার ক্ষতি করবে না, করতে পারবে না। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে হয়তো মৌমিতার কোনো ক্ষতি করে দিতে পারে। নিজের হাত নিজে কামড়ে ধরেছে তাজ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। হাতের উপর দাঁত বিঁধে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তাজের‌।

দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে মৌমিতার ভিতরটা। সে তাজের কষ্ট একদম সহ্য করতে পারে না। বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে মানুষটাকে। যখন সে তাজকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল তখন জানতো না তাজের অসুস্থতার কথা। কিন্তু এখন জানে। তাই বলে কি সে তাজকে ছেড়ে যাবে । না কখনও না‌। সত্যিকারে ভালোবাসা কোনো বাধা, বিপত্তি, রোগ বালাই মানে না। ভালোবাসা মানে কি ছেড়ে যাওয়া? না ভালোবাসা মানে থেকে যাওয়া। বিপদে আপদে ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকা, তার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখা। তাজকে সে কখনও ছেড়ে যাবে না।

মৌমিতা একবার তাজের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাদীফের দিকে তাকালো। শান্ত কন্ঠে বলল – তাকে আমার ভালোবাসা বিশ্বাস করাতে যদি বিয়ে করতে হয় তবে আমি বিয়ে করতেও রাজি।

রাদীফ, নীরা চকিত হয়ে মৌমিতার দিকে তাকালো। তাজও হাত থেকে দাঁত উঠিয়ে মৌমিতার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে ভেবেছিল মৌমিতা রাজি হবে না।

নীরা অবাকের সুরেই বলল – যা বলছিস ভেবে বলছিস তো আঙ্কেল আন্টির কথা একবার ভেবে দেখ।

– ভেবেছি অনেক। আমি ছেড়ে যাওয়ার জন্য ভালোবাসিনি যদিও সে আমাকে হয়তো বিশ্বাস করতে পারেনি। আর আমার বাবা মা তো আমি তাদের ভালোভাবেই চিনি এবং জানি তারা কোনো দিন আমার অমতে কিছুই করবে না। আমি যদি উনার সাথে সুখী থাকি তবে তারা সেটাই মেনে নিবেন। হ্যা তাদেরকে না জানিয়ে এতবড় একটা কাজ করেছি জানলে তারা একটু কষ্ট পাবে। একটু বলছি কেন অনেক বেশিই কষ্ট পাবে। কিন্তু আমার ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে আমি না হয় এই পথই বেছে নিলাম।

– তবুও তুমি আর একটু…….

হাত উঠিয়ে রাদীফকে থামিয়ে দিয়ে মৌমিতা শক্ত কন্ঠে বলল – আপনি এক্ষুনি কাজী ডাকুন। আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুত।

_______________________________________

আকাশ পরিষ্কার, শরৎ – এর খন্ড খন্ড মেঘ উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সূর্যের পাশে। হালকা মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে সাদা কাশফুলেরা। একটু পরই সন্ধ্যা নামবে। সূর্যের আলোকে বিদায় জানিয়ে জায়গা করে নিবে রাতের নিকষ কালো আঁধার। কাজী ডাকা হয়েছে। সন্ধ্যার পরেই বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। নীরা মৌমিতাকে লাল শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। শাড়িটা একটু আগেই তাজ এনে দিয়েছে মৌমিতার সাথে। হোক বিয়েটা সাদামাটাভাবে তাই বলে কি একদম কোনো সাজই থাকবে না। তাজও একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি হাঁকিয়েছে শরীরে। সাদা পাঞ্জাবিটা বেশ আঁটসাট বেঁধে রয়েছে তাজের শরীরে। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতা যুক্ত ফর্সা শরীরে বেশ মানিয়েছে সাদা রঙটা।

মৌমিতা কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ তাজ যা বলছে গম্ভীর মুখে তা করে নিচ্ছে। শাড়ি পড়ে হালকা সাজে বেড়িয়ে এলো মৌমিতা। তাজ অপলক দৃষ্টিতে মৌমিতার দিকে তাকিয়ে আছে। মৌমিতা একপলক তাজের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। এভাবে তাজকে আগে কখনও দেখা হয়নি। সাদায় যে মানুষটাকে এত মানায় জানা ছিল না তার। এই ভাবে আর কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকলে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক হতো মৌমিতার। তাছাড়া মৌমিতার মনে মনে যে অভিমানের পাহাড় জমে আছে। তার ভালোবাসাকে অবিশ্বাস করেছে তাজ। এত সহজে এই অভিমান পড়বে না। মৌমিতা তাজের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তাজের ভ্রু জুগল কুঁচকে এলো। মৌমিতা কি ওকে ইগনোর করছে? পাত্তা দিচ্ছে না? এই পোশাকে কি ওকে সুন্দর লাগছে না? তাজ ধীর পায়ে রাদীফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল – কাকাই আমাকে কেমন লাগছে?

রাদীফ ভ্রু কুঁচকে তাজের দিকে তাকিয়ে বলল – তুই কি মেয়ে? এই প্রশ্ন করে মেয়েরা‌ ছেলেদের তো সবকিছুতেই সুন্দর লাগে।

– আহ কাকাই বলো না আমাকে কি দেখতে খারাপ লাগছে? এ পোশাকে কি আমাকে অন্য দিনের মতো সুদর্শন লাগছে না?

রাদীফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাজকে পর্যবেক্ষণ করলো অতঃপর বলল – তোকে এই সাদা রঙে বেশ মানিয়েছে, একদম রাজপুত্রের মতো।

ঠোঁট উল্টে দিল তাজ, বাচ্চাদের মতো করে বলল – তাহলে বিয়ের আগেই বউ আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না কেন?

রাদীফ গোল গোল চোখে তাজের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলে কি এবার পুরো পাগল হয়ে গেছে। মৌমিতা আসার পর তো এই ছেলের মিনিটে মিনিটে এক এক রূপ বেড়িয়ে পড়ছে। মানসিকভাবে অসুস্থ, বিয়ে পাগলা, এখন বিয়ের আগেই বউ পাগলা যে কিনা নিজের হবু বউয়ের পাত্তা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

কাজী কবুল বলতে বললে মৌমিতা কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে কবুল বলে দিল। আর তাজ কন্ঠে কিছুটা আনন্দ নিয়েই কবুল বলল। বিয়ের সম্পন্ন। ” কবুল ” একটা শব্দের কতটা শক্তি। মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো আলাদা মানুষকে একসাথে জুড়ে দিতে পারে।

বিয়ের নেই কোনো জাঁকজমক। নেই কোনো লাইটিং, সাজানো। মানুষ বলতে হাতে গোনা সাত আটজন তাও রাদীফ আর তাজের পরিচিতি। একদম সাধারণ ভাবেই সম্পন্ন মৌমিতা তাজের বিয়ে।

ড্রইং রুমের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে নীরা। পড়নে হালকা পাতলা একটা শাড়ি। মৌমিতাকে শাড়ি পড়ানোর সময় অনেকটা জোর করেই নীরাকে শাড়িটা পড়িয়েছে সে। হাজার হলেও প্রান প্রিয় বান্ধবীর বিয়ে। হোক সেটা গোপনে বা জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। রাদীফ আস্তে গিয়ে দাঁড়ালো নীরার পাশে। ধীর কন্ঠে শুধালো – তোমার বান্ধবী তো বিয়েটা সেড়েই ফেলল এখন তুমি করছো কবে?

নীরা নিচের দিকে তাকিয়েই বলল – যেদিন মনের মতো ছেলে পাবো?

রাদীফ কিছুটা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল – তোমার কি বয়ফ্রেন্ড মানে প্রেমিক আছে?

– না নেই।

রাদীফ বোধহয় একটু খুশিই হলো, বলল – তা ভালো, বয়ফ্রেন্ড না থাকাই ভালো।

নীরা একটু উৎসুক দৃষ্টিতে রাদীফের দিকে তাকালো। রাদীফ কিছুটা ভরকে গেল। আমতা আমতা করে বলল – তোমাকে সুন্দর লাগছে।

লজ্জায় মিইয়ে গেল নীরা। আজ তার ভালো লাগার মানুষটা তাকে বলেছে তাঁকে সুন্দর লাগছে। তার মানে সে তার ভালোবাসার মানুষটার চোখে পড়েছে। অনেকটা অস্ফুট স্বরেই নীরা বলল – ধন্যবাদ আপনাকে।

বিয়ের পর্ব শেষ, খাওয়া দাওয়ার পর্বও শেষ করে সবাইকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন সমস্যাটা বেঁধেছে মৌমিতা আর তাজের ঘুমানো নিয়ে। নিয়ম মোতাবেক আজ তাজ আর মৌমিতার বাসর রাত । কিন্তু মৌমিতা তো বিয়ের পরপরই নীরাকে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছে। তবুও জোর করে তাকে রাখা হয়েছে। এই রাতে দুটো মেয়ে মানুষকে কিছুতেই একা ছাড়তে রাজি নয় তাজ আর রাদীফ‌। আর এখন মৌমিতা বলছে সে তাজের সাথে এক ঘরে থাকবে না। সে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে – বিয়ে করার বিয়ে বিয়ে করেছে কিন্তু বাবা মাকে না জানিয়ে সবটা ঠিকঠাক না করে সে কিছুতেই তাজের সাথে এক ঘরে থাকবে না।

তাজ প্রথমে বিষয়টা মেনে নিতে না চাইলেও পরবর্তীতে মেনে নিয়েছে। এমনি মৌমিতার উপর একটা চাপ সৃষ্টি করে বিয়ে করেছে। এখন সে কিছুতেই চায় না মৌমিতার অমতে নিজের কাছে আনতে। সে চায় মৌমিতা নিজে আসুক। ওকে ভালোবেসে আসুক।

ভোরের আলো ফুটেছে চারদিকে। সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে জানালার ফাঁক থেকে। পাখির কিচিরমিচির ধ্বনিতে ভরে গেছে প্রাকৃতি। মৌমিতার ঘুম ভেঙেছে আরও অনেক আগেই। মোট কথা তার কাল সারারাত ঠিক ভাবে ঘুমই হয়নি। বাবা মায়ের অগোচরে এত বড় একটা কঠিন কাজ করে ফেললো সে ভাবতেই যখন তখন কান্না পেয়ে যায়। বাবা মায়ের মুখ দুটো ভেসে উঠে চোখের সামনে। তারা জানলে ঠিক কতটা কষ্ট পাবে ভাবতে ভাবতেই গেছে সারারাত। ভোরের আলো ফুটতেই উঠে বসলো মৌমিতা। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে নীরাকে তাড়া দিল রেডি হতে। দুজন রেডি হয়ে নিচে নামতেই দেখা মিললো তাজ আর রাদীফের। তারা ড্রইং রুমের সোফায় বসে আরামে চা খাচ্ছে। রাদীফকে দেখেই এগিয়ে গেল মৌমিতা। শান্ত কন্ঠে বলল – স্যার আমরা এখন আসি। বাসায় ফিরবো ওখান থেকে কলেজে যাব।

পাশ থেকে চায়ের কাপটা হাত থেকে রেখে তাজ বলল – কোথায় যাবে তুমি? আমার বাড়িতে থাকবে না? বিয়ে হয়েছে আমাদের। আমারা এখন স্বামী স্ত্রী। আমার বাড়ি থাকতে তুমি অন্য কোথাও কেন থাকবে?

মৌমিতা বেশ শক্ত কন্ঠে বলল – স্যার উনাকে বলে দিন বিয়ে করার কথা ছিল বিয়ে করেছি। আর কিছু সম্ভব না আমার দ্বারা। আর তাছাড়া যে আমার ডালোবাসাকেই বিশ্বাস করে না তার সাথে তো এক বাড়িতে এক ছাদের তলায় কিছুতেই থাকবো না। আসছি স্যার কলেজে দেখা হবে‌ ।

নীরার হাত টেনে গটগট করে সদর দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেল মৌমিতা। তাজ অবাকের চোখে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ও সামনে থাকতেও রাদীফকে কেন বলল ওকে বলে দিতে। ও তো সব শুনতে পেয়েছে। তবে কি মৌমিতা ওর উপর রেগে আছে ওর সাথে কথা বলবে না সেই বিষয়ের ইঙ্গিতই দিয়ে গেল। তাজ মনে মনে আওড়ালো – কাল বিয়ে করলাম এর মধ্যেই বউ আমার সাথে কথা বলছে না, কি সাংঘাতিক।

( ” ভালোবাসা মানে কি ছেড়ে যাওয়া? না ভালোবাসা মানে থেকে যাওয়া। বিপদে আপদে ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকা, তার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখা। ” আজকের পর্বের মধ্যে আমি এই কথাটা বলেছিলাম , এই কথাটা সবার জন্য প্রযজ্য নয় । কিছু কিছু মানুষ আছে তাদের হাজার ভালোবাসলেও তাদের হবে না, তারা বাইরে মুখ দিবেই, তাদের ভালোবেসে জীবন দিয়ে দিবেন তবুও তারা অন্যের পিছনে ছুটবে। এই গুলারে লাথি মাইরা জীবন থেকে বাইর করে দেওয়াই শ্রেয় না হয় এই মানুষগুলোর বিষে বিষাক্ত হয়ে নিজেই কোনো একদিন হারিয়ে যাবেন। ভালোবাসা পবিত্র তবে সবাই ভালোবাসা নামক পবিত্র জিনিস পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। )

চলবে….

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply