Golpo প্রণয়ের ব্যাকুলতা

প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৬


#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা

#সাদিয়া

#পর্ব_১৬

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

মৌমিতা ভয় পেয়েছে ভীষণ। কোনো রকম উঠে রাদীফের টেবিলে রাখা পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাদীফ। কোনো রকম তাজকে টেনে হিচড়ে পাশেই সোফায় শুইয়ে দিল। অতঃপর শান্ত কন্ঠে বলল – আমার তোমাকে তাজের সম্পর্কে কিছু বলার আছে। আমি তাজকে অনেক আগেই তোমাকে সবটা বলে দিতে বলেছিলাম কিন্তু ও বলতে পারেনি বা তুমি হয়তো শুনতে চাওনি।

ভ্রু কুঁচকে এলো মৌমিতার। কি এমন কথা যা রাদীফ তাজকে বলতে বলেছে কিন্তু তাজ বলতে পারেনি।

একটু থেমে রাদীফ বলল – তাজ ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত।

অবাক হলো মৌমিতা, অবাক স্বরেই বলল – ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার?

– হ্যা, এটি এক প্রকার আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী সমস্যা। যার ফলে কোনো সঙ্গত কারন ছাড়াই রোগী প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়ে। তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। পরিস্থিতির গভীরতার সাথে তাদের রাগ বা ক্রোধের মাত্রার সমতা থাকে না। তাদের রাগ হঠাৎই আক্রমণমুখী বা মারমুখী হয়ে ওঠে। রোগী নিজেও বুঝতে পারে সে রেগে যাচ্ছে অন্যায় করছে কিন্তু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার পর সে তার নিজের ভুল বুঝতে পারে, হতাশা, অনুশোচনা, বিব্রত বোধ তাকে ঘিরে ধরে। তাজ তোমাকে ভালোবাসে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু ও ভয় পায় যদি ওর সম্পর্কে সবটা জেনে ওকে তুমি মেনে না নেও। ওর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ও যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে দেয়। ও তোমার কোনো কষ্টের কারন হতে চায় না তাই নিজেকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি সময়ের সাথে সাথে ও বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিল ও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। ওর বেঁচে থাকার জন্য তোমাকে ওর ভীষণ প্রয়োজন। যখন থেকে ও জানতে পেরেছে তুমিও ওকে ভালোবাসো ও আর নিজেকে তোমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি।

মৌমিতা এতক্ষন হতবাক হয়ে রাদীফের কথা শুনছিল। মানুষটা যে এমন কিছুর ভিতর থেকে যাচ্ছে ভাবেও পারেনি মৌমিতা।

রাদীফ একটু থামলো ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বলা শুরু করলো – তাজ তখন খুব ছোট। বড়জোর পাঁচ বছর হবে । কেবলই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ওর মা ওকে প্রতি দিন স্কুলে নিয়ে যেত আবার নিয়ে আসতো। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার ওপারে বেলুন দেখে বেলুনের বায়না ধরেছিল মায়ের কাছে। ওর মা ওকে রাস্তার এপার রেখেই পা বাড়িয়েছিল বেলুন আনতে। রাস্তার মাঝ বরাবর যেতেই এক রাক্ষুসে ট্রাক এসে ধাক্কা মেরে দিল । মাথাটা থেঁতলে ঘিলু বেরিয়ে এসেছিল। বিভৎস সেই ঘটনা পুরোটাই ঘটেছিল তাজের সামনে। তাজের ছোট্ট মস্তিষ্ক ধারন করতে পারেনি মায়ের এমন মৃত্যু। জ্ঞান হারিয়েছিল তাজ। জ্ঞান ফেরার পর থেকে কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল তাজ। ধীরে ধীরে তাজের শরীরের অবনতি হচ্ছিল। ঘুমের মধ্যেও মা মা বলে চিৎকার করে উঠতো। প্রায়ই চিৎকার করে জ্ঞান হারাতো। তাজের অবস্থা দেখে সবাই তাজের বাবাকে আবার বিয়ে করালো। তাদের জন্য নিয়ে এলো নতুন মা। প্রথম প্রথম সবটা ঠিক থাকলেও আস্তে আস্তে তাজের সৎ মা তার নিজের স্বরূপে ফিরে আসতে লাগলো। তাজের বাবা ব্যবসার কাজে বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকতো। তাজের সৎ মা মিসেস হীরা সব সময় মেতে থাকতো লেট নাইট পার্টি , বন্ধু বান্ধব, ড্রিংকস নিয়ে। আর ছোট্ট তাজ রোজ মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তো। একদিন মিসেস হীরা যখন বাড়ি ফিরেছিল অনেক রাতে সেদিন রাতে তাজ জেগেই ছিল। মিসেস হীরাকে দেখে দৌড়ে গিয়েছিল তার কাছে বলেছিল – মা তুমি এত রাত করে বাড়ি ফেরো কেন? আমার একা একা খুব ভয় লাগে।

এইটুকু কথা বলার অপরাধে তাজকে দুটো থাপ্পর মেরে অন্ধকার এক রুমে আটকে রেখেছিল সারারাত। তাজ সেদিন চিৎকার করে বলেছিল ” মা আমার ভয় লাগছে , আমাকে বাইরে বের করো। অন্ধকারে ভয় লাগে আমার। ” কিন্তু তাজের চিৎকার মিসেস হীরার হৃদয় গলাতে পারেনি। আস্তে আস্তে তাজের উপর মিসেস হীরার অত্যাচার বাড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে তাজের মস্তিষ্ক বিক্ষীপ্ত হতে শুরু করেছিল। তাজের মানসিক সমস্যা তীব্র আকার ধারন করছিল ধীরে ধীরে। ত

তখন তাজের বয়স ১১ । ক্লাস সিক্সে উঠেছে। তাজকে নিজের জুতো মুছতে বলেছিল মিসেস হীরা কিন্তু তাজ মুছেনি। সেই অপরাধে সারাদিন খেতে দেয়নি তাজকে। পেটের ক্ষুধা সহ্য না করতে পেরে নিজের ঘর থেকেই খাবার খেয়েছিল তাজ। মিসেস হীরা জানতে পেরে ইচ্ছে মতো মেরেছিল ওকে। শেষে তাজ আর সহ্য করতে না পেরে মিসেস হীরার হাত কামড়ে দেয়। তাজের বাবা বাড়ি ফিরলেই তাজের সম্পর্কে বানিয়ে বানি বলে মিসেস হীরা। নিজের হাত দেখায় , মিসেস হীরার হাতে কামড়ের দাগ দেখেই রেগে যায় তাজের বাবা। কোমড়ের বেল্ট খুলে ইচ্ছে মতো তাজকে মেরে হোস্টেলে দিয়ে আসে।

হোস্টেলের অপরিচিত মানুষ, অপরিচিত জায়গায় মানিয়ে নিতে পারেনি তাজ। সারাদিন রুমে বসে কাঁদতো । হোস্টেলের সবল ছেলেরা এসে তিরস্কার করতো তাজকে। আস্তে আস্তে তাজ ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। একদিন যখন হোস্টেলের একটা ছেলে ওকে বিরক্ত করছিল হঠাৎই তাজ হিংস্র রূপ ধারন করে। ঐ ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে দেয়। হোস্টেল কতৃপক্ষ তাজের বাবাকে খবর দিয়ে তাজকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। কারন তাজ শুধু ঐ পর্যন্তই থেমে থাকেনি হুটহাট রেগে ভাঙচুর চালাতো হোস্টেলে কেউ ওকে থামাতে এলে তাকে মেরে রক্তাক্ত করে দিত।

বাড়িতে আনার পর তাজ যেন আরও ভয়ংকর রূপ ধারন করে তাজের বাবা বা মিসেস হীরাকে একদম সহ্য করতে পারতো না তাজ। মিসেস হীরাও পেল সুযোগ। তাজকে সবার সামনে পাগল প্রমানিত করে, পাঠিয়ে দেয় মেন্টাল হসপিটালে। তাজের বাবার অগোচরে তাজের সৎ মায়ের প্রচেষ্টা চলে মানসিক হাসপাতালে তাজকে সত্যি সত্যি পাগল বানানো।

তাজ আমার আপন ভাইয়ের ছেলে নয়। আমি তাজের বাবার কাকাতো ভাই। আমায় বয়স তখন বিশ আর তাজের বয়স ১৫। আমার তখন যথেষ্ঠ বুঝশক্তি হয়েছে। আমি মিসেস হীরার সব চক্রান্ত ধরতে পেরে তাজের বাবাকে জানাই। তার সহযোগীতায় তাজকে মেন্টাল হসপিটাল থেকে এখানে নিয়ে আসি। ডাক্তার দেখাই নিয়মিত থেরাপি দেই । তাজ এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। কিন্তু সম্পূর্ন সুস্থ নয়।

ধীরে ধীরে সুস্থ হবে আবার হয়তো কখনও সুস্থ নাও হতে পারে। আমি তোমাকে সবটাই বললাম বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত। তবে একটা কথা যদি মনে করো তাজের সাথে থাকা তোমার সম্ভব নয় তাহলে দূরে কোথাও চলে যাও। কারন ওর সামনা সামনি থাকলে ও কখনও তোমাকে ছেড়ে যেতে দিবে না। জোর করে হলেও নিজের কাছে রাখবে।

চোখ মুছলো মৌমিতা। একবার তাজের মুখের দিকে তাকালো। মানুষটা ছোট থেকে কত কি সহ্য করে বড় হয়েছে। হাত রাখলো তাজের মাথায়। শান্ত কন্ঠে বলল – ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য তো ভালোবাসি নি।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর ঘুম ভাঙলো তাজের। তাজের মাথার কাছেই বসে আছে মৌমিতা। চট করে উঠে বসলো তাজ। শক্ত করে জড়িয়ে নিল মৌমিতাকে। অপরাধীর সুরে বলল – আমি তোমাকে মেরেছি? ব্যথা লেগেছে তোমার? প্লিজ মাফ করে দেও আমাকে।

মৌমিতাও জড়িয়ে নিল তাজকে, পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল – উঁহু আমার একটুও ব্যথা লাগেনি।

মৌমিতাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো তাজ। মৌমিতার গলায় হাত রেখে বলল – গলাটা লাল হয়ে আছে। আমাকে মাফ করে দেও প্লিজ আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।

– বুঝেছি তো এমন করছেন কেন? চলুন বাসায় যাবেন।

তাজও বাধ্য ছেলের মতো উঠে দাঁড়ালো। মৌমিতার হাত ধরে বলল – চলো।

________________________________

আষাঢ় মাস হলেও আজ আকাশে তেমন মেঘ নেই। সূর্য চড়ে আছে মাথার উপরে। কলেজ বাদ দিয়ে পার্কে বসে আছে তাজ আর মৌমিতা। তাজের ইচ্ছে সে আজ মৌমিতার সাথে ডেটে যাবে। মৌমিতা অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু তাজ নাছোড়বান্দা সে আজ যাবে মানে যাবেই‌। জীবনের প্রথম প্রেম। কেমন একটা অন্যরকম অনুভূতি। মুহুর্তেই যেন কিশোর বানিয়ে দিয়েছে তাজকে। কিশোর কিশোরীদের প্রেমের মতো সেও পার্কে যাবে, ঘুরতে যাবে, রাস্তায় প্রেমিকার হাত ধরে হাঁটবে, পার্কের বেঞ্চিতে বসে বসে প্রেমিকার কাঁধ মাথা রাখবে আরও কত আবদার তার। মৌমিতা যে এগুলো চায় না তা কিন্তু নয় সেও এমনটাই চায় , খুব করে চায়। সে ভালোবাসে তাজকে, তাজের পাগলামীগুলো। কিন্তু এই আষাঢ় মাসে ডেটে আসার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না মৌমিতার। কখন বৃষ্টি নামবে , ডেকের কপালে বাঁশ। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল এর মধ্যেই ঝপ করে নামলো আষাঢ়ের বর্ষন। কপাল কুঁচকে আকাশের দিকে তাকালো মৌমিতা। তাজ মৌমিতার হাতটা ধরে টেনে দৌড়ে একটা গাছের নিচে নিয়ে দাঁড়ালো।

বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই বৃষ্টি। মৌমিতা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল – দেখেছেন এই জন্যই আমি এই আষাঢ় মাসে ডেটে আসতে চাইনি।

– বৃষ্টির মধ্যেও ডেটে আলাদা একটা অনুভুতি, তুমি বুঝবে কি?

– হ্যা তাই তো আমি কি বুঝবো। আমি তো কিছুই বুঝি না।

– এই তুমি কি রাগ করলে ? আমি মজা করেছি।

মৌমিতা গাল ফুলিয়ে বলল – না আমি রাগ করিনি।

– কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখছি তুমি রেগে আছো।

– আপনি ভুল দেখছেন।

– তাহলে আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরো‌ ।

– না

– আচ্ছা কি করেছি আমি রাগ কেন করেছো?

– সব কথা আমাকে কেন বলে দিতে হবে?

– আহা না বললে আমি বুঝবো কি করে?

– আপনি আমাকে এখনও একবারও ভালোবাসি বলেননি, প্রপোজও করেননি আর আমি একসেপ্টও করিনি তাহলে আমরা প্রেমিক প্রেমিকা কি করে হলাম?

মৃদু হাসলো তাজ, মৌমিতার নাক টেনে বলল – এই জন্য তুমি গাল ফুলিয়ে রেখেছো?

মৌমিতা কিছু বলল না শুধু গাল ফুলিয়ে রাখলো।

চলবে….

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply