প্রণয়েরব্যাকুলতা
সাদিয়া
পর্ব১৪
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
বর্ষাকাল, চারদিকে কাদামাটির ছড়াছড়ি। শহরের রাস্তা তাতে কি এখানে ভাঙা তো ওখানে ভাঙা পানি জমে রয়েছে। কলেজের ভিতরটাতেও কেমন কর্দমাক্ত স্যাত স্যাতে। বৃষ্টি ভালো লাগলেও বর্ষাকাল একদম ভালো লাগে না মৌমিতার। সারাদিন কেমন লাগাতার চলতে থাকে প্রবল বেগে বর্ষন। কাঁদার মধ্যে পা উঁচু করে করে হাঁটছে মৌমিতা। হঠাৎ একপা উঁচু করতে গিয়ে অন্য পা পিছলে কাদার মধ্যে ধপাস করে পড়ে গেল সে। সারা গায়ে কাঁদায় মাখামাখি। ইচ্ছে করছে এখন জোরে কেঁদে দিতে কিন্তু তাও পারছে না। এত বড় মেয়ে কিনা আছাড় খেয়ে বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। এর থেকে লজ্জাজনক পরিস্থিতি আর হতে পারে না।
হঠাৎ কারো অট্টহাসির শব্দে পিছন ফিরে তাকালো মৌমিতা। এক উজ্জ্বল শ্যামবর্না পুরুষ ওর দিকেই তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। মৌমিতা কটমট করে ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটা কোনো মতে নিজের হাসি সংযত করে হাত বাড়িয়ে দিল মৌমিতার দিকে। মৌমিতা একবার ছেলেটার হাতের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিজে ওঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না, আরও বাজে ভাবে পড়ে গেল। ছেলেটা আবার হেসে উঠে বলল – হাতটা ধরুন মিস। আমি কোনো বাঘ ভাল্লুক নই যে আপনি আমার হাত ধরলে আমি আপনার হাতটা খেয়ে ফেলবো।
মৌমিতা ছোট ছোট চোখ করে ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটাও মৌমিতার মতো করেই ছোট ছোট চোখ করে বলল – আমি জানি আমি সুন্দর, তাই বলে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে না, আমার ভীষণ লজ্জা লাগে?
মৌমিতা কথা বলল না। বিনা বাক্যে ছেলেটার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। নিজের দিকে তাকিয়ে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। আজ আর ক্লাস করা হবে না। কাঁদায় গায়ের জামাটা বিশ্রীভাবে মেখে গেছে। মেজাজটাই চটে গেল। এখানেও এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না লোকজন তাকিয়ে আছে। দ্রুত বাসায় ফিরতে হবে। নিজের ভাবনার মধ্যেই মৌমিতা হাঁটা ধরলো। কিন্তু তখনই তাকে বাধা প্রদান করলো এক শক্ত পুরুষালী কন্ঠস্বর। পিছন ঘুরে দেখে সেই ছেলেটি। ছেলেটি ভারী গলায় বলল – আপনি তো ভারী অকৃতজ্ঞ মানুষ। কেউ সাহায্য করলে তাকে যে অন্তত একটা ধন্যবাদ দিতে হয় তাও বুঝি জানা নেই আপনার।
- আমি সবাইকে ধন্যবাদ দেইনা। আপনি আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে প্রথমে হেসে মজা লুটেছেন অতঃপর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সুতরাং দুটো ঘটনায় একটা অপরটার সাথে শোধবোধ হয়ে গেছে তাই আপনাকে আমি ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছি না।
মৌমিতা চলে গেল। ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে মৌমিতার দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলে গেল মেয়েটা সবটাই ওর মাথার উপর দিয়ে গেছে। একটা ধন্যবাদ চেয়ে কি সে ভুল করে ফেললো নাকি। মাথা চুলকে পিছন ফিরে তাকাতেই থতমত খেয়ে গেল ছেলেটা। তার সামনেই এক যুবক অগ্নী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই আগুন লাগিয়ে দিবে তার শরীরে, পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে । ভরকে গেল ছেলেটা। একটা মেকি হাসি দিয়ে এক প্রকার দৌড়ে পালালো সেখান থেকে।
মৌমিতার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাজ। লাগাতার কল করে যাচ্ছে মৌমিতার কোনো হেলদোল নেই। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাজের। এত ইগনোর? মানছে ও ভুল করেছে, ভুল না অন্যায় করেছে । তাই বলে ওর কোনো কথাই শুনবে না? অনন্ত একবার ওর কথাগুলো শুনতে তো পারে, তারপর না হয় যা করার করবে। এবার রেগেমেগে মৌমিতাকে একটা মেসেজ করলো তাজ ।
” এই মুহূর্তে বাসার বাইরে আসবে। আমি যদি একবার বাসার ভিতরে চলে আসি তাহলে বিষয়টা তোমার জন্যই ভালো হবে না। “
এতক্ষন কোনো হেলদোল না দেখালেও এবার বাসা থেকে সুড়সুড় করে বেড়িয়ে এলো মৌমিতা। বাড়িওয়ালী প্রচন্ড কড়া। কোনো ছেলের বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ। এখন যদি তাজ কোনোভাবে বাড়ির ভিতরে চলে আসে তাহলে কালই বাড়ি ছাড়া করবে বাড়িওয়ালী।
মৌমিতাকে দেখেই হাসি ফুটে উঠল তাজের ঠোঁটে। অবশেষে ম্যাডাম তাহলে নিজের আস্তানা ছেড়ে বেড়িয়েছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল মৌমিতার দিকে। মৌমিতা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো, গম্ভীর কন্ঠে বলল – কি চাই?
- তোমাকে।
- আমাকে পাওয়া আর সম্ভব নয়।
- তুই চাইলে সব সম্ভব।
- যাকে ভালোবাসেন না তার সাথে সম্ভব অসম্ভবের কোনো প্রশ্নই আসে না।
- স্যরি মৌমিতা। মানছি আমি সেদিন অন্যায় করেছি কিন্তু…….
আর কিছু বলতে পারলো না তাজ। তার আগেই এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেল। ধপ ধপ করে তাজের রাগ মাথায় উঠে গেল। কোথা থেকে একটা ছেলে এসে হুট করেই মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরেছে। মেজাজটাই বিগড়ে গেল তাজের। এই ছেলেটা আবার কে? যেদিন থেকে মৌমিতার সাথে ওর ঝামেলা হয়েছে সেদিন থেকে একটার পর একটা ছেলে এসেই যাচ্ছে শুধু ওর আগুন লাগা সংসারে আরও আগুন লাগাতে। কই এর আগে তো কোনো ছেলেকে মৌমিতার আশেপাশে দেখেনি। এখন এই আবর্জনা গুলোর উদয় কোথা থেকে হচ্ছে? এই উটকো মা’ল’টা আবার কে? দেখতে তো মনে হচ্ছে বাচ্চা ছেলে। ছিপছিপে শরীরের গড়ন কিন্তু লম্বা প্রায় তাজের সমানই। চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে নবম দশম শ্রেণীর ছাত্র। না না আজকাল কারো চেহারা দেখে বয়স বোঝা যায় না। অনার্সে পড়ুয়া অনেক ছেলেমেয়েকে দেখলে তো মনেই হয় না অনার্সে পড়ে। মনে হয় নবম দশম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রী তারা।
ছেলেটা এখনও মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। তাজের রাগের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। হাতটা শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করেছে ছেলেটাকে একটা ঘুষি দিয়ে গাল ফাটিয়ে দিবে। কত বড় সাহস ওর সামনে ওর সম্পত্তির দিকেই হাত বাড়িয়েছে, ওর মৌকে ছুঁয়েছে। হাতটা তুলে ঘুষি দিতে যাবে তখনই মুখ খুলল মৌমিতা – তুই হঠাৎ এখানে? মা বাবা ঠিক আছে তো?
ছেলেটা মৌমিতাকে ছেড়ে দাঁড়ালো, মাথা নিচু করে বলল – আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি ।
মৌমিতা হতবাক স্বরে বলল – কিইইইই? মাথা খারাপ হয়ে গেছে মাহিম তোর? তুই বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা এসেছিস?
- হুম কি করবো। মা সারাদিন শুধু পড়াশোনা নিয়ে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে। কতবার বলবো যে আমার পড়া লেখা ভালো লাগে না। এর থেকে এক বিয়ে করিয়ে দিক বউ নিয়ে একটু শান্তিতে ঘর সংসার করি।
মৌমিতা মাহিমের কান টেনে ধরে বলল – তবে রে, বিয়ে করবি? এই তোর বয়স কত?
- কান ছাড় আগে লাগছে আমার। এই যে ভাইয়া আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? দেখতে পাচ্ছেন না এই বজ্জাত মহিলা আমার মতো একটা নিরীহ একটা বাচ্চার কানের উপর কি পরিমান অত্যাচার চালাচ্ছে।
- কি বললি আমি বজ্জাত মহিলা।
তাজ এতক্ষন নির্বাক দর্শকের মতো শুধু এদের দেখছিল। কে এই ছেলেটা ? তবে এটা বুঝতে পারছে এর সাথে মৌমিতার কোনো সম্পর্ক আছে। মাহিম আবার চেঁচিয়ে উঠলো – এই যে ভাইয়া এভাবে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে আমাকে বাঁচান ।
এবার তাজ নীরবতা ভাঙলো। শান্ত কন্ঠে বলল – ওকে ছেড়ে দেও মৌ।
মাহিম চোখ ছোট ছোট করে তাজের দিকে তাকালো, ঠোঁট কামড়ে বলল – মৌ, মৌমিতা থেকে মৌ। বাহ ভালোই তো এগিয়েছিস । কান ছাড় না হলে এখনই বাবাকে কল করে বলবো তোমার মেয়ে এখানে পড়াশোনা ছেড়ে প্রেম করছে।
কান ছেড়ে দিল মৌমিতা তবে রুক্ষ কন্ঠে বলল – আমি উনার সাথে প্রেম করছি না। উনি আমার একজন সিনিয়র ভাই মাত্র।
চোখ মুখ কুঁচকে এলো তাজের, অবাক স্বরে বলল – সিনিয়র ভাই?
মাহিম কান ডলতে ডলতে বলল – আপনি একদম চিন্তা করবেন না ভাইয়া। এই ভাইয়া থেকেই ছাইয়া হয়।
চোখ পিটপিট করে তাকালো তাজ, নম্র কন্ঠে শুধালো – তুমি কে? মৌয়ের কি হও?
- আমি মাহিম। এই মৌমিতা নামক পেত্মীর একমাত্র ছোট ভাই।
তাজ এক গাল হেসে বলল – ওহ তুমিই আমার একমাত্র শালা।
মৌমিতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, বলল – কিসের শালা?
- বারে তোমার ভাই তো আমার শালাই।
মাহিম চোখ গোলগোল করে বলল – আপনারা বিয়ে করে ফেলেছেন?
- না শাহাবাবু ওটা এখনও বাকি আছে আপতত এই মৌ নামক মেয়েটি আমার অবিবাহিত বউ।
- ওহ তার মানে আপনি আমার অবিবাহিত দুলাভাই।
- কি সব আজে বাজে বকছিস? আর তুই যেখান থেকে এসেছিস সেখানে চলে যা। আমার বাসায় তোর কোনো জায়গা নেই।
মাহিম কাঁদো কাঁদো হয়ে মৌমিতার দিকে তাকালো, বলল – প্লিজ আপু, তুই আমার লক্ষী বোন, এমন করিস না।
- এসব বলে কোনো কাজ হবে না। কোন আক্কেলে তুই বাড়ি থেকে পালিয়েছিস ? আর তা ছাড়া আমার বিল্ডিংয়ে পুরুষ মানুষ এলাউ করে না।
তাজ এসে মাহিমের কাঁধে হাত রেখে বলল – তুমি বরং আমার সাথে চলো শালাবাবু। তুমি আমার বাড়িতে থাকবে। তোমার বোন এখন বাদ।
- সত্যি বলছেন অবিবাহিত দুলাভাই?
- একদম। তুমি আমার বাড়িতে চল যতদিন ইচ্ছে থাকবে খাবে ঘুমাবে।
মৌমিতা শাসনের সুরে বলল – তুই কোথাও যাবি না। আমি বাবা মাকে কল করছি, উনারা আসলে উনাদের সাথে বাড়িতে ফিরবি তুই।
- সে আমি কয়টা দিন পর এমনিতেও ফিরবো। এই কয়দিন একটু দুলাভাইয়ের বাড়িতে চিল করে নেই।
মাহিমের হাত ধরলো তাজ, মৌমিতার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল – চলো তো শালা বাবু, কতদূর থেকে এসেছো নিশ্চই ক্লান্ত তুমি। আমার বাড়িতে গিয়ে রেস্ট করবে ।
- হ্যা হ্যা চলো।
গাড়িতে উঠে বসলো মাহিম। পাশে বসলো তাজ। মৌমিতা কতবার করে মাহিমকে যেতে বারন করছে মাহিম কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। বাঁকা হাসলো তাজ, মনে মনে বলল – এখন তো তোমাকে আমার কাছে আসতেই হবে মৌ। আমার টানে না আসো ভাইয়ের টানে তো আসতে হবে। কথায় আছে কান টানলে মাথা আসে আর এখানে ভাই টানলে বোন আসবে।
চলবে….
পরের পর্বটি পেতে পেইজে ফলো দিয়ে সাথে থাকুন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ
Share On:
TAGS: প্রণয়ের ব্যাকুলতা, সাদিয়া
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৪
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৭
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৩
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৬
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৫
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৫
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩