প্রণয়েরব্যাকুলতা সাদিয়া পর্ব১১
- হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম, কে বলছেন?
তাজ শান্ত হলো না বরং অস্থির কন্ঠ শুধালো – কোথায় তুমি?
কন্ঠস্বর শুনে মানুষটাকে চিনতে বেগ পেতে হলো না মৌমিতার, শান্ত কন্ঠে বলল – আমি সিলেট এসেছি।
খট করে কেটে গেল কলটা। মৌমিতা হতবাক, কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করলো ওপাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। , হঠাৎ কলই বা দিল কেন আর এভাবে কিছু না বলে কেটেও বা দিল কেন? এই মানুষটাকে বোঝা বড় দায় হয়ে পড়েছে মৌমিতার।
বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে তাজ। রাগ লাগছে ভীষণ। মেয়েটা ওকে কিছু না বলেই চলে গেল। যাওয়ার আগে অন্তত একবার বলতে পারতো যে সিলেট যাচ্ছি। ওকে এভাবে অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়ে সে দিব্যি মা বাবার কাছে গেছে শান্তিতে থাকতে। আর কিছুক্ষণ লাইনে থাকলেই হয়তো রাগে অতিরিক্ত রিয়েকশন করে ফেলতো সে। তাই কলটাই কেটে দিল।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে দিশেহারা চারপাশ। মাথার উপর সূর্যি মামা খা খা করে জ্বলে যাচ্ছে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে এসেছে মৌমিতার। আজ প্রায় এক সপ্তাহ পর কলেজে এসেছে সে। গেট থেকে ঢুকেই নজর পড়লো কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচটায় বসে থাকা সুদর্শন যুবকটার দিকে। মুহুর্তেই প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যেতে শুরু করলো মৌমিতার মনের কুঠুরিতে। কত দিন পর কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখটা দেখছে সে। চোখ দুটো যেন এই মানুষটাকে দেখার তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছিল। ছুটে গেল তাজের কাছে। ছেলেটার মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। চোখের নিচে কালসেটে দাগ জমে গেছে। মনে হচ্ছে অনেক দিন ঠিক ভাবে ঘুমায় না সে। ধ্বক করে উঠলো মৌমিতার বুকটা। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে শুধালো – কেমন আছেন?
তাজ কোনো উত্তর দিল না। একবার ফিরেও তাকালো না মৌমিতার দিকে। হাতের বইটা বন্ধ করে হনহন করে হাঁটা ধরলো। ভরকে গেল মৌমিতার। এই বান্দার আবার কি হয়েছে? কথা বলছে না কেন? সিলেট থাকতে দুই দিন কল করেছে তাও রিসিভ করেননি এই লোক। মৌমিতাও বড় বড় পা ফেলে তাজের পিছু নিল।
লাইব্রেরীতে বসে বই পড়ছে তাজ। অবশ্য বইয়ের দিকে তার কোনো মনোযোগ নেই তার মনোযোগ মৌমিতার দিকে। শুধু বাহানা হিসেবে মুখের সামনে একটা বই ঝুলিয়ে রেখেছে। তাজের পাশেই বসে আছে মৌমিতা। হাত পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বিভিন্ন কথা বলছে। তাজ কোনো উত্তর দিচ্ছে না বই পড়ার ভান ধরে বসে আছে। বিরক্ত হচ্ছে মৌমিতা। রাগে কটমট করতে করতে তাজের হাত থেকে বইটা টেনে নিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল – সমস্যা কি আপনার? কথা বলছেন না কেন?
তাজ বিনা বাক্যে মৌমিতার হাত থেকে বইটা নেওয়ার চেষ্টা করলো। মৌমিতা বইটা ঘুড়িয়ে অন্য হাতে নিল। তাজ আবার মৌমিতার ঐ হাত থেকে বইটা নেওয়ার চেষ্টা করতেই মৌমিতা বইটা আবার অন্য হাতে নিয়ে নিল। তাজ শান্ত হয়ে বসলো, মৌমিতার দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়ালো , আবার হনহন করে হেঁটে বেড়িয়ে গেল লাইব্রেরী থেকে।
মৌমিতাও কম যায় কিসে। সে আজ তাজকে নিজের সাথে কথা বলিয়েই ছাড়বে। তাজ কথা বলবে ওর ঘাড়ও কথা বলবে। আর এটাও জেনে ছাড়বে সে কেন ওর সাথে এমন ব্যবহার করছে। মৌমিতা হাতের বইটা জায়গা মতো রেখে তাজের পিছু নিল।
রাদীফের অফিস রুমে তাজ ঢুকতেই তার পিছু পিছু ঢুকলো মৌমিতা। রাদীফ চেয়ারেই বসা ছিল। দুজনকে একসাথে দেখেই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল – তোমরা দুজন একসাথে এখানে?
তাজ গম্ভীর কন্ঠে বলল – তুমি রুম থেকে একটু বাইরে যাও তো কাকাই , যাওয়ার সময় অবশ্যই দরজাটা আটকে দিও।
- আমার রুমে ঢুকে আমাকেই বের করে দিচ্ছিস?
- বের হতে বলেছি তোমাকে।
তাজের চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস হলো না রাদীফের। ভদ্র শান্ত ছেলের মতো রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। রাদীফ বেড়িয়ে যেতেই মৌমিতাকে এক টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো তাজ। কিছু বলে ওঠার আগেই মৌমিতার ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁট জোড়া দিয়ে আঁকড়ে ধরলো তাজ। আকর্ষিক আক্রমণে হকচকিয়ে উঠলো মৌমিতা। অবাকের চড়ম পর্যায় পৌঁছে গেছে সে। চোখ দুটো অসম্ভব রকমের বড় হয়ে গেছে। হতভম্ব হয়ে গেছে মৌমিতা। কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই মস্তিষ্কে সাড়া দিচ্ছে না। আকর্ষিক ঘটনায় ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে। বাধা দেওয়ারও কোনো শক্তি এই মুহূর্তে তার মধ্যে নেই।
মিনিট পাঁচেক পর মৌমিতার কপালে কপাল ঠেকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে তাজ। আবেগী কন্ঠে বলল – এখন একটু শান্তি লাগছে। কেন আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলে তুমি? জানো কতটা অস্থির লাগছিল আমার। এই কয়টা দিন আমার ঠিকভাবে ঘুম হয়নি খাওয়া হয়নি শুধু তোমার অভাবে।
তাজের এত আবেগ মাখা কথার কোনোটাই মৌমিতার কর্নকুহরে পৌঁছাতে পারছে না। সে এখনও ঘোরের মধ্যে আছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কি থেকে কি হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই ঠোঁটে হাত পৌঁছে গেল তার। একটু আগে এই ঠোঁট জোড়াতেই স্পর্শ করেছে তাজের নরম উষ্ণ ঠোঁট জোড়া ভাবতেই শিউরে উঠছে মৌমিতা।
নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে আকাশটা । প্রাকৃতিতে আমবস্যা ছড়িয়ে পড়েছে আজ । দূর দূরান্তে কুকুরের ভয়ানক কান্না শোনা যাচ্ছে। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। হয়তো ঘুমিয়ে গেছে সবাই। এমন পরিবেশে থাকলে হয়তো যে কেউ ভয়ে শিউরে উঠতো। কিন্তু তাজের ভয় লাগছে না। সে এমন পরিবেশেই অভ্যস্ত । ছোট বেলা থেকেই একা একাই বড় হয়েছে সে। এখনও মনে পড়ে সেই কথা তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। অন্ধকার রুমটায় আটকে রেখে ছিল এক নিষ্ঠুর মানবী। ভয়ে মা মা করে চিৎকার করছিল সে। মনে হচ্ছিল অন্ধকার রুমে কিছু ভয়াবহ অবয়ব তাকে ঘিড়ে ধরেছে। তার কাছে আসছে। তাঁকে মারতে চাইলে। ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল সে কিন্তু তার কান্না সেই নিষ্ঠুর মানবীর মন গলাতে সক্ষম হয়নি। আস্তে আস্তে ভয়ে , দূর্বলতায় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তেও অস্ফুট স্বরে মুখ থেকে বেড়িছিলো মা। কিন্তু তার মা নামক মানবী তার দিকে ফিরেও তাকায়নি।
হঠাৎ কাঁধে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে অতীতের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো তাজ। পিছন ফিরে রাদীফকে দেখলো। শান্ত কন্ঠে শুধালো – এত রাতে তুমি এখানে?
- তোর কি মনে হচ্ছে না তুই একটু বেশিই এগিয়ে যাচ্ছিস?
- মানে?
- মানে মৌমিতার ব্যাপারটা বলছিলাম। তুই তোর নিজের সম্পর্কে সবটুকুই জানিস। কোনো কিছুই তোর অজানা নয়। তুই কি পারবি মেয়েটাকে সুখী রাখতে?
- কি বলতে চাইছো তুমি?
- তুই এতটাও অবুঝ নয় যে আমার কথার মানে তুই বুঝতে পারছিস না। আমি বলছি না মৌমিতাকে তুই ছেড়ে দে, ভুলে যা ওকে। আমি শুধু বলতে চাইছি তুই যেমন ওর প্রতি দুর্বল, তেমনি ও দিন দিন তোর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। আমি ওর হাব ভাবে সবটাই বুঝতে পারছি। যা করবি ভেবে চিন্তে করবি। আমি চাই তুই সুখী হ কিন্তু অন্য কাউকে কষ্ট দিয়ে নয়। মৌমিতা যথেষ্ঠ ভালো মেয়ে। আমি চাই না তোদের মধ্যাকার সম্পর্কটা অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর ও সবটা জানুক। তারপর কষ্ট পাক, আমি চাই না ও ওর কষ্টের জন্য তোকে দায়ী করুক। আশা করছি তুই সবটা বুঝতে পারছিস। আমি ওকে তোর সম্পর্কে কিছুই বলতে চাই না। আমি চাই তুই নিজে ওর কাছে তোর অতীত, বর্তমান সম্পর্কে বলবি। কাউকে অন্ধকারে রেখে সম্পর্ক শুরু করলে সেই সম্পর্কের পরিনতি কখনওই সুখকর হবে না। হয় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর না হয় ওকে সবটা জানা। তোর সাথে ও প্রণয়ের সম্পর্কে জড়ালে একদিন না একদিন ও সবটা জানতে পারবে আজকে ওকে সবটা সত্যি না জানালে সেদিন ও আজকের থেকে দিগুন কষ্ট পাবে।
তাজ অন্ধকার আকাশটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল – আমার জীবনটা এমন কেন কাকাই? আমার কি আর পাঁচটা মানুষের মতো সুখে থাকার একটুও অধিকার নেই। আমার কি অধিকার নেই কাউকে ভালোবাসার। এত অভিশপ্ত কেন আমার এই জীবনটা।
রাতের আঁধার কেটে সকাল নেমেছে। চারদিকে সূর্যের আলো ফুটে উঠেছে। গরমকাল , সূর্যটা যেন একটু বেশিই রেগে থাকে এই দিনে। চারদিকে ঘেমে নেয়ে একাকার মানুষ জন। প্রচন্ড গরমে বিরক্ত সবাই।
লাইব্রেরীতে বসে বইয়ে মুখ গুজে আছে তাজ। না সে বই পড়ছে না। বই সামনে রেখে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করছে। মনটা একবার বলছে মৌমিতাকে একবার জানা সবটা মানা না মানা সেটা পরের ব্যাপার। আবার বলছে না মৌমিতা সবটা জানতে পারলে তোকে ছেড়ে চলে যাবে , তুই আর কখনও তার দেখাও পাবি না। নিজের উপর নিজে ভীষণ বিরক্ত সে। অবশেষে নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়ালো সে। সিদ্ধান্ত নিল ভুলে যাবে মৌমিতাকে। তার অনিশ্চিত জীবনটার সাথে মৌমিতার জীবনটা জোড়া লাগানো মানে মৌমিতার জীবনটা নষ্ট করে দেওয়া। সে মৌমিতাকে ভালোবাসে। সে কখনই তার ভালোবাসার মানুষটার জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিতে পারে না। ভালোবাসা মানেই কি সবসময় পাওয়া না ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এমন কোনো সংবিধানে লেখা নেই। সে না হয় দূর থেকেই ভালোবেসে যাবে মৌমিতাকে। মৌমিতার ভালোর জন্য এইটুকুও যদি সে করতে না পারে তাহলে কিসের ভালোবাসলো সে। সে না হয় তার ভালোবাসার মানুষটার সুখের জন্য নিজের সুখটা ত্যাগ করেই দিলো।
চলবে….
পরের পর্বটি পেতে পেইজে ফলো দিয়ে সাথে থাকুন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ
Share On:
TAGS: প্রণয়ের ব্যাকুলতা, সাদিয়া
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩০
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৪
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৩
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৭
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৭
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৫
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১০
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা গল্পের লিংক
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৪