নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀
পর্ব_৭
রৌপ্যপাত্রে বাসমতি চালের পোলাও, আর কংসের বাটিতে খাসির রেজালা থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তবুও সিকান্দার গজনবীর খাসমহলের আবহাওয়া আজ বরফের মতো শীতল। যেনো হিমালয়ের ওপর থেকে ভেসে আসা উত্তরের হাওয়া এসে জড়ো হয়েছে এই কামরায়।
এই শীতলতার মাঝেও দুই জমিদারের চোখের চাউনিতে যে অনল খেলা করছে তার উত্তাপ যেন এক নিমিষেই হিমালয়ের বরফ গলিয়ে দিতে সক্ষম।
বিশাল মেহগনি কাঠের টেবিলের এক প্রান্তে বসে আছেন জমিদার নবাব সিকান্দার গজনবী। তার ঠিক মুখোমুখি অবস্থান করছেন ঈশা খাঁ।
ঈশা খাঁ- র শরীরী ভাষায় বাঘের মতো ক্ষিপ্রতা লক্ষ্যনীয়। তিনি স্থির ভাবে বসে আছেন ঠিকই তবে মনে হচ্ছে সুযোগ পেলে যেকোনো মুহূর্তে শিকারের ওপর অর্থাৎ সিকান্দারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
খাবারের প্লেটগুলো সাজিয়ে রেখে গেল খাদেমরা। ঈশা খাঁ নীরবতা ভাঙলেন। ভারী কণ্ঠের সাথে কঠোরতা মিশিয়ে বললেন,
- সিকান্দার সাহেব, আপনার বাবুর্চিরা রন্ধনশিল্পে বেশ ভালো। কিন্তু আফসোস, আপনার বড় পুত্রর আদব কায়দার বিষয়ে একই কথা বলতে পারছি না।
সিকান্দার গজনবী অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে ঈশা খাঁ এর গেলাসে শরবত ঢেলে দিলেন। তার গালের কোণে দৃশ্যমান এক চিলতে হাসি। যদিও উক্ত পরিস্থিতির সাথে এ হাসি বড্ড বেমানান। তিনি শান্ত গলায় বললেন,
- আমাদের বংশে আদব আছে বলেই তো মেহমানকে মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াত দিয়েছি খাঁ সাহেব। পেটে ক্ষুধা থাকলে কিন্তু মাথায় রাগ বেশি চড়ে। অনুগ্রহপূর্বক আগে কিছু মুখে তুলুন।
ঈশা খাঁ টেবিলের ওপর রাখা ছুরিটা হাতে তুলে নিলেন। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ছুরিটা দিয়ে খেলা করতে লাগলেন। ধাতব বস্তুটির শব্দে কামরার পরিবেশ যেন আরোও থমথমে হয়ে উঠল। সামান্য বাঁকা হাসি গালে ঝুলিয়ে তিনি বললেন,
- আমার তলোয়ারটা আজ বড্ড ক্ষুধার্ত, সিকান্দার সাহেব। আমার বাল্যকালের ঘনিষ্ঠ আলী হোসেন আজ শয্যাশায়ী। তার এই অবস্থার কারণ আপনার গুণধর পুত্র তাইমুর গজনবী। আপনার বাড়ির অন্ন আমি মুখে কি করে তুলি বলুন?
সামান্য একজন নর্তকী, একজন বাঈজীর দিকে হাত বাড়ানোর অপরাধে জমিদারের অতিথির হাত কেটে নেওয়া! এ কেমন বিচার, সিকান্দার সাহেব? নাকি গজনবী এস্টেটে এখন বাঈজীদের ইজ্জত মেহমানের প্রাণের চেয়েও দামি?
সিকান্দার সরাসরি ঈশা খাঁর চোখের দিকে তাকালেন। তার চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। নেই কোনো অনুশোচনা। বরং তিনি কৌতুক করে বললেন,
- খাঁ সাহেব, আপনি ভুল করছেন। উপবাস তো এর সমাধান হতে পারে না! তাছাড়া আপনার বন্ধু আমার অতিথি ছিলেন সত্য। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন সে মুহুর্তে তার অবস্থান ছিল গজনবীর মাহফিলে। কোনো সস্তা সরাইখানায় নয়!
হেমাঙ্গিনী আমার মহলের আশ্রিতা। আমার মাহফিলের নতুন শোভা। তার অনুমতি ছাড়া শরীরে স্পর্শ করা মানে তাদের অসম্মান করা।বাঈজীরা আমার খান্দানের অংশ। আমার মাহফিলের সৌন্দর্য।
আমার বড়পুত্র, এ অঞ্চলের ভাবি জমিদার নবাব তাইমুর গজনবী রক্তপিপাসু নয়। সে শুধু আমার মহলের আশ্রিতাদের সম্মান রক্ষা করেছে। এই গল্পের লেখিকা ‘Atia Adiba – আতিয়া আদিবা’ পেইজে প্রতিদিন বিকাল ৫ টায় নতুন পর্ব দেওয়া হয়।
ঈশা খাঁ এবার রাগে ফুঁসতে লাগলেন। টেবিলের ওপর সজোরে এক হাত চাপড়ালেন। ঝনঝন করে উঠল রূপার বাসনগুলো।
- সম্মান রক্ষার দোহাই দিয়ে আপনি আমার বন্ধুর পঙ্গুত্বকে জায়েজ করার চেষ্টা করছেন? শুনুন, আমি এসেছি রক্তের বদলা নিতে। রক্তের বদলা রক্ত দিয়েই শোধ হয়, তা বোধহয় আপনার অজানা নয়? এটাই দস্তুর। হয় আপনার ছেলেকে আমার হাতে তুলে দিন, অথবা প্রস্তুত হোন। আমার কামানের মুখ আপনার এই বিশাল মহলের দিকে ঘুরতে বেশিক্ষণ লাগবে না, জনাব!
গজনবী মহলের পরিস্থিতি এখন ভীষণ উত্তপ্ত।রক্ষীরা দরজায় হাতল চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারা পেলেই কোষমুক্ত হবে তলোয়ার।
কিন্তু সিকান্দার গজনবী অদ্ভুতভাবে শান্ত। তিনি নিজ হাতে বাটি থেকে বিশাল এক টুকরো হরিণের মাংস ঈশা খাঁর প্লেটে তুলে দিলেন। মুখের দীপ্তি বজায় রেখে বললেন,
- যুদ্ধ তো চাইলে করাই যায় খাঁ সাহেব। আপনার কামানের গর্জনে আমার এই মহল হয়ত ধুলোয় মিশে যাবে। আবার আপনার জমিও হয়ত আমার অশ্বারোহীরা দখল করে নেবে! কিন্তু তাতে লাভ হবে কাদের? ইংরেজ বনিকদের! তারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবে। তার চেয়ে বরং আপনি ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। অনুগ্রহ করে আহার শুরু করুন।
এবার সিকান্দার সামান্য ঝুঁকে এলেন ঈশা খাঁ এর সামনে। অতি নিমজ্জিত স্বরে বললেন,
- একজন লম্পট বন্ধুর জন্য কি আপনি দুটি বিশাল এস্টেটের হাজার হাজার প্রজার সর্বনাশ ডেকে আনবেন, খাঁ সাহেব? নাকি আলী হোসেনের চিকিৎসার সমস্ত ভার এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমার উত্তরের আমবাগানটি গ্রহণ করে বন্ধুত্বের হাত বাড়াবেন?
ঈশা খাঁ মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সিকান্দার খুব কৌশলে তাঁকে প্যাঁচে ফেলেছেন। এখন যদি বন্ধুত্বকে গ্রহণ না করে তিনি আক্রমণ কে বেছে নেন তবে তার পরিচিতি মিলবে ‘নেমকহারাম’ হিসেবে। আবার আপোষ করলে বন্ধুর প্রতি ঘটে যাওয়া গর্হিত অপরাধের প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।
ঈশা খাঁ দাঁতে দাঁত চেপে মাংসের টুকরোটি মুখে পুরলেন। আলগোছে চিবুতে চিবুতে বললেন,
- সিকান্দার সাহেব, আপনার জিহ্বা তলোয়ারের চেয়েও ধারালো। আজ আমি আপনার অন্ন গ্রহণ করলাম, তাই তলোয়ার নিজ কোষেই রইল। কিন্তু মনে রাখবেন, এই ঋণ কিন্তু শোধ হবে। উত্তরের আমবাগান আমি নেব, আলীর চিকিৎসার জন্য। তবে এই অপমানের দাগ অতি সহজে মুছবে না।
নবাব সিকান্দার গজনবী তৃপ্তির হাসি হাসলেন। তিনি জানেন আসন্ন বিপদ কেটে গিয়েছে। উচ্ছ্বাসিত স্বরে গ্লাস উঁচিয়ে তিনি বললেন,
- ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে তোলা থাক। রেজালাটা জুড়িয়ে যাচ্ছে খাঁ সাহেব। আপাতত, এর স্বাদ নিন।
ঈশা খাঁ আহার সম্পন্ন করলেন। তবে তার চোখে লেগে ছিল অসমাপ্তির গল্প।
খাওয়ার পর্ব চুকতে না চুকতেই সিকান্দার গজনবী তার শেষ চাল চাললেন। তার ঠোঁটের কোণে ফিরে এলো রহস্যময় হাসি। তিনি জানতেন শিকারের সামনে টোপ ফেলার এখনই মোক্ষম সময়!
সিকান্দার পানের বাটাটা ঈশা খাঁ – এর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
- তবে খাঁ সাহেব, দান খয়রাত তো ভিক্ষুক কিংবা ফকির মিসকিনরা গ্রহণ করে। আপনি বীর জমিদার। নাম ঈশা খাঁ! বারো ভূঁইয়াদের সমতুল্য আপনার তেজ। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর চিকিৎসার ভার না হয় আমি নিলাম। তবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ওই উত্তরের আমবাগানটি এমনি এমনি দিয়ে দিলে কি আপনার শানে মানাবে? মানুষ বলে বেড়াবে, ঈশা খাঁ গজনবীদের দয়ায় জমি বাড়িয়েছেন। বিষয়টি কি মর্যাদাহানিকর নয়?
ঈশা খাঁ পানের খিলিটা হাতে নিয়ে সামান্য থমকে গেলেন। সিকান্দারের খোঁচাটি তার পৌরুষে আঘাত হানল। তিনি কুঞ্চিত ভ্রুঁ নিয়ে তাকালেন সিকান্দারের মুখপানে। শুধালেন,
- কী বলতে চান স্পষ্টভাবে বলুন।
সিকান্দার আয়েশ করে নিজের পানে জর্দা মেশাতে মেশাতে বললেন,
- সামনেই পূর্ণিমা। আপনি তো জানেন প্রতিবছর আমাদের গজনবী এস্টেটের সীমানায় এক বিশাল অশ্বদৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। শুনেছি, ঘোড়ার লাগাম ধরলে আপনাকে দেখে নাকি বাতাসেরও ঈর্ষা হয়? এ তল্লাটে আপনার অশ্বচালনার দক্ষতা নিয়ে তো কেউ প্রশ্ন করার সাহস রাখে না।
সিকান্দার একটু থামলেন। মুখে পান পুরে ঈশা খাঁ-এর চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলেন। ঈশা খাঁ এর চোখেমুখে কৌতূহলের ঝিলিক। ধূর্ত সিকান্দার ফের বলতে শুরু করলেন,
- আমার প্রস্তাব হলো এই অশ্বদৌড়ে আপনাকে অংশ নিতে হবে। যদি আপনি প্রথম স্থান অধিকার করতে পারেন, তবেই উত্তরের আমবাগান আপনার। আর তার সাথে…
সিকান্দার সজোরে হাত তালি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন ভৃত্য প্রবেশ করল কক্ষে। হাতে মখমলের কাপড়ে মোড়ানো অতি দীর্ঘ একটি বস্তু।
সিকান্দার সেই বস্তুর ওপর থেকে কাপড়টি সরাতেই চকচক করে উঠল হীরা-পান্না খচিত খাপের একটি তলোয়ার। সিকান্দার গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন,
- এই দেখুন, পারস্যের সম্রাট নাদির শাহের সেনাপতির ব্যবহৃত ‘শামশির’। এটি আমার পূর্বপুরুষদের সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে দামি রত্ন। যদি আপনি প্রথম স্থান অধিকার করেন তবে আমবাগানের দলিলের সাথে এই ঐতিহাসিক তলোয়ারটিও শুধুমাত্র আপনার হবে। বলুন খাঁ সাহেব! এমন নজিরবিহীন পুরস্কার কি আপনার যোগ্য নয়?
ঈশা খাঁ তলোয়ারটির দিকে তাকালেন। তার অক্ষিজোড়ায় খেলা করতে লাগল লোভ এবং জেদ। তিনি জানেন সিকান্দার অতি ধূর্ত একজন জমিদার। এসবই সংঘাত এড়িয়ে যাবার ছলচাতুরী।
কিন্তু এমন সংপ্রশ্ন তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন কিভাবে? ঈশা খাঁ এর প্রতিটি শিরায় উপশিরায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল মুহুর্তেই। এছাড়া ঘোড়ার পিঠে তিনি অপরাজেয়। নিজের দক্ষতার ওপর এই অন্ধ বিশ্বাস তার অহংকারের অন্যতম শিকড়।
ঈশা খাঁ টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আত্মবিশ্বাসের সহিত মুচকি হেসে বললেন,
- আপনি অতি চতুর একজন মানুষ, জমিদার সাহেব! আপনি জানতেন আমি এই বাজি ফেরাতে পারব না। বেশ! এই বাজি আমি গ্রহণ করলাম। প্রস্তুত রাখবেন আপনার আমবাগানের দলিল আর ওই পারস্যের শামশির। পূর্ণিমার আলোয় গজনবীর মাঠ দেখবে, ঈশা খাঁ শুধু তলোয়ারেই নয়, লাগাম হাতেও কতটা ভয়ানক!
সিকান্দার নিজেও উঠে দাঁড়ালেন। মাথা নত করে অভিবাদন জানালেন। শ্রদ্ধার সুরে বললেন,
- আপনার সাহস অতি প্রশংসনীয়। তবে মনে রাখবেন, গজনবীর ঘোড়ারাও কিন্তু কম যায় না।
- চলি, সিকান্দার সাহেব। মধ্যাহ্নভোজের জন্য ধন্যবাদ!
ঈশা খাঁ সদম্ভে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার ভারী পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার পর সিকান্দার গজনবী নিজের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। তার চোখের সেই কৌতুক মিলিয়ে গেল। সেখানে খেলা করতে লাগল দক্ষ শিকারির চোখের তীক্ষ্ণতা।
পাশ থেকে দাউদ বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠল,
- হুজুর, মাফ করবেন। তবে ঈশা খাঁ তুখোড় অশ্বারোহী। উনি জিতলে তো সর্বনাশ! আমবাগান আর ওই অমূল্য তলোয়ার, দুটোই হাতছাড়া হবে!
সিকান্দার শান্ত গলায় বললেন,
- দাউদ, আমি জানি ঈশা খাঁ তুখোড় অশ্বরোহী। কিন্তু তুমি তাইমুরের দক্ষতাকে প্রশ্ন করো না!
ঈশা খাঁ কে বাজির নেশায় বুঁদ করে রাখাটাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য। নেশাগ্রস্ত মানুষ আর অন্ধ মানুষের মাঝে কোনো তফাৎ থাকে না। পূর্ণিমার রাত আসতে দাও। তখন দেখা যাবে কার ঘোড়া আগে দৌড়ায়, আর কার ঘোড়া হোঁচট খায়।
সিকান্দারের উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। সেই হাসি দেখে দরদর করে ঘামতে লাগল দাউদ। এই গল্পের লেখিকা ‘Atia Adiba – আতিয়া আদিবা’ পেইজে প্রতিদিন বিকাল ৫ টায় নতুন পর্ব দেওয়া হয়।
★★ ★★ ★★ ★★
গজনবীর মাহফিলে আজ যেন নব জৌলুসের বান এসেছে। শত শত মোমবাতি আর পারস্য থেকে আনা নতুন বেলোয়ারি ঝাড়বাতির আলোয় শ্বেতপাথরের মেঝেতে খেলা করছে রামধনু। মাহফিলের বাতাসে ভাসছে দামি কস্তূরী আতরের সুঘ্রাণ আর সদ্য ফোটা গোলাপের মদির সুবাস।সেই সুবাস যেন বয়ে বেড়াচ্ছে আসন্ন এক অজানা নাটকের উত্তেজনা।
হলঘরের পেছনের রয়েছে ছোট্ট আরেকটি কক্ষ। সে কক্ষের পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল হেমাঙ্গিনী। আজ নিজেকে বারবার দর্পনে দেখছিল সে। তার পরনে গাঢ় নীল রঙের বেনারসি ঘাঘরা। তাতে মিশে আছে সোনালি সুতোর নিপুণ কারুকাজ। সে কারুকাজ যেন আকাশের লক্ষ তারকারাজির অস্তিত্ব বহন করছে।
গলায় জড়ানো হীরা আর পান্নার ভারী গয়না প্রতিনিয়ত তার ফর্সা ত্বকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। তবে তার অলংকারও চোখের দীপ্তির সাথে পাল্লা দিতে পারছে না। হেমাঙ্গিনী আজ গতরাতের সেই গোপন শিল্প, মা সরলতার সেই বিশেষ নৃত্য মাহফিলে প্রথমবারের মত প্রদর্শন করবে। তার বিশ্বাস, এই নাচের জাদুতে সে তাইমুরকে বাঁধবে চিরতরে। পৃথিবীর কোনো শক্তি সেই বাঁধন ছিন্ন করতে পারবে না।
পাশ থেকে বিলকিস বানুর গর্বের সহিত হেমাঙ্গিনীর চিবুক আলতো করে ছুঁলেন। উর্দু মিশিয়ে বললেন,
- তৈরি থাক, বেটি। আজ তোর মায়ের রূহ যেন তোর মাঝে ভর করে! মাহফিলের প্রতিটি অতিথি যেন টের পান আসল নর্তকী কাকে বলে!
যদিও মাহফিলের পরিবেশ আজ কিছুটা ভিন্ন। মূল মসনদে জমিদার সিকান্দার গজনবী বসে আছেন রাজকীয় ভঙ্গিমায়। তার হাতে সেই সোনার আস্তরণে মোড়ানো হুঁকোর নল। পাশে বসে আছেন পুত্র তাইমুর।
তাইমুরের চোখ আজ সেদিনের মত শান্ত নয়। কিছুটা চঞ্চল। বারবার আনমনা হয়ে এদিক সেদিক খুঁজছেন তার হৃদয়ের নারীকে। তার এই চঞ্চলতা, অধীর আগ্রহ কেবলমাত্র হেমাঙ্গিনীর জন্য।
এমন সময় তবলার বোল থামিয়ে, সিকান্দারের ইশারায় দাউদ এগিয়ে এসে ঘোষণা করল,
- আজকের মাহফিলে আমাদের বিশেষ আয়োজন। সুদূর দিল্লি থেকে আগত, রূপ ও গুণের এক অনন্য সংমিশ্রণ বাঈজী সিমরান!
করতালিতে মুখরিত হল গোটা হলঘর। তাইমুরের ভ্রুঁ সামান্য কুঞ্চিত হয়ে পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গেল। এই মাহফিলের নিয়ম কানুন সম্পর্কে সে এখনো সম্পূর্ণ অবগত নয়। হয়ত বাঈজীদের নতুন মুখ মাহফিলে তুলে ধরাও আভিজাত্যের প্রতিক!
মহলের প্রধান দরজা দিয়ে সিমরান প্রবেশ করতেই উপস্থিত সকলের চোখের চুম্বকের মত আটকে গেল।
সিমরানের রূপ যেন আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা।গায়ের রং জ্বলজ্বল করছে কাঁচা সোনার মতো। পরনে টুকটুকে লাল পেশোয়াজ। তার হাঁটার প্রতিটি ছন্দে ছড়িয়ে পড়ছিল মাদকতা। প্রতিটি নিক্বণ যেন উপস্থিত পুরুষদের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন।
সিমরান যখন মঞ্চের মাঝখানে এসে কুর্নিশ করল, তার চোখের চাহনিতে শীতল স্রোত বয়ে গেল সকলের বুকে। এ চাহনির বিপরীতে যেন পলক ফেলাও নিষিদ্ধ! অপরাধ!
জমিদারপুত্র তাইমুর এতক্ষণ কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলেন। তিনিও সোজা হয়ে বসলেন। সিমরানের সৌন্দর্য অস্বীকার করার সাধ্য কোনো পুরুষের নেই। তাইমুর একজন বুঝদার মানুষ। সৌন্দর্যের কদর সে বোঝে। মৃদু মাথা নেড়ে সিমরানের উপস্থিতির প্রশংসা করতে পিছু হটলেন না ভাবি জমিদার।
তবে তার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল না। সেই ধড়ফড়ানি একমাত্র হেমাঙ্গিনীর জন্য বরাদ্দ। কাজেই অক্ষিজোড়া সিমরানের ওপর নিবদ্ধ থাকলেও, মন পড়ে রইল হেমাঙ্গিনীর আগমনের অপেক্ষায়।
যন্ত্রসংগীতের মূর্ছনা শুরু হলো। সেতার আর সারেঙ্গীর যুগলবন্দীতে সিমরান তার নৃত্য শুরু করল। প্রথম কয়েক মুহূর্ত সব ঠিক ছিল। চিরাচরিত কত্থক আর মুজরার মিশেল।
সহসা সিমরান তার হাত দুটি মাথার ওপর তুলল। তার শরীরের মোচড় এবং চোখের ভাষায় ফুটে উঠল এক অদ্ভুত ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
যেন গোটা পৃথিবীকে সে হাতের মুঠোয় পুরে নিচ্ছে! তার মুখভঙ্গিতে প্রকাশ পেল সেই চিরচেনা অহংকার, যে অহংকার গতকাল রাতে বিলকিস পুরে দিয়েছিলেন হেমাঙ্গিনীর নতুন নৃত্যকলায়।
পর্দার আড়াল হতে বিলকিস বানু সবটা দেখলেন। তার হাত থেকে পানের ডাবরটা মুহুর্তেই খসে পড়ল। ঝনঝন শব্দে গড়াগড়ি খেতে লাগল মেঝেতে। সেই শব্দ ঢাকা পড়ে গেল বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনিতে।
বিলকিস বানু পাথরের মূর্তির মতো জমে গেলেন। তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম! তিনি অস্ফুটে, কাঁপা গলায় বলে উঠলেন,
- ইয়া খোদা! এ কিভাবে সম্ভব? এতো সরলতার গোপন নৃত্যবিন্যাস। সরলতার আমানত। এই বাঈজী নৃত্যের গোপন ভঙ্গি শিখল কই থেকে?
হেমাঙ্গিনীও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সিমরান ঠিক একই লয়ে, সেই ছন্দে পা ফেলছে যে ছন্দ গতরাতে সে বহু সাধনায় আয়ত্ত করেছে।
সিমরানের প্রতিটি মুদ্রায় সরলতার ছায়া লেপ্টে ছিল। হেমাঙ্গিনীর মনে হলো, তার পায়ের নিচ থেকে ক্রমশ মাটি সরে যাচ্ছে।
যে নৃত্য অস্ত্র উত্তরাধিকারী সূত্রে শুধুমাত্র তার জানার কথা, যে নৃত্য অস্ত্র দিয়ে সে তাইমুরের মনকে চিরকাল নিজের প্রতি আবদ্ধ করবে বলে ভেবেছিল, সে নৃত্য সম্পর্কে সিমরান জ্ঞাত হল কিভাবে?
হেমাঙ্গিনীর মনে হল সব যেন তার দু চোখের সামনে লুট হয়ে যাচ্ছে। এক অদৃশ্য হাহাকার দলা পাকিয়ে উঠল গলার কাছে।
মঞ্চে তখন সিমরান নাচের শেষ ভঙ্গিটিতে চলে এসেছে। প্রত্যাখ্যান এবং বিদ্রোহ। সে তড়িৎগতিতে শরীর টিকে ঘুরিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।
তার হাতজোড়া এমনভাবে নিক্ষিপ্ত হলো যেন সে সমস্ত জগতের প্রেমকে অস্বীকার করছে।চোখেমুখে ফুটে উঠল তীব্র অবজ্ঞা এবং স্বাধীনতা জয়ের স্বাদ।
পুরো মাহফিলে তখন বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। আচমকা গোটা হলঘর মুখরিত হয়ে পড়ল দীর্ঘ করতালিতে।
নবাব সিকান্দার গজনবীও উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন। বললেন,
- বাহ! বাহ! সুবহানাল্লাহ! কি সুন্দর! মনমুগ্ধকর নৃত্য পরিবেশনা!
সিকান্দারের চোখজোড়া চকচক করতে লাগল। যেন তিনি কোনো অমূল্য রত্ন খুঁজে পেয়েছেন।
তাইমুরও মুচকি হেসে হাততালি দিলেন। সিমরানের দক্ষতা অসাধারণ তা অস্বীকার করবার মত নয়।
তবে তার চোখজোড়া আটকে গেল পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা হেমাঙ্গিনীর পানে। তাইমুর স্পষ্ট দেখতে পেলেন হেমাঙ্গিনীর দেহ কাঁপছে। তার চোখে জল!
প্রেমিক পুরুষের মন বড় সজাগ হয়। সিমরানের এই আগ্রাসী সৌন্দর্য আর দক্ষতায় হেমাঙ্গিনী নিজেকে তুচ্ছ ভাবছে কি না এই আশঙ্কা তাইমুরকে অস্থির করে তুলল। সিমরানের রূপের আগুনের চেয়ে যে হেমাঙ্গিনীর চোখের জলের দাম তার কাছে ঢের বেশি!
নৃত্য শেষে সিমরান হাঁপাতে হাঁপাতে কুর্নিশ করল। তার ফর্সা কপালে ঘামের বিন্দুগুলো মুক্তোর মতো চিকচিক করতে লাগল। সেই ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল ছুঁয়ে দেখবার তীব্র বাসনার উদ্বেগ হল সিকান্দারের মনের গহীনে। তিনি দাউদকে ডাকলেন। গলার স্বর নিচু রেখে ভারী গলায় বললেন,
- দাউদ, বাঈজী সিমরান শুধু নৃত্যপটিয়সী নয়, তার মাঝে আমি এক বন্য হরিণীর তেজ দেখতে পেয়েছি। আজ রাত আমি তার সান্নিধ্যে কাটাতে চাই। তাকে আমার খাস কামরায় পাঠানোর ব্যবস্থা করো। তবে…
সিকান্দার একটু থামলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
- মনে রেখো কোনো জবরদস্তি নয়। তার যদি আপত্তি না থাকে, তবেই। তাকে এটাও জানিও, সিকান্দার গজনবীর শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার উপহার হিসেবে সে যা চাইবে তাই পাবে। এক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য নেই আমার।
দাউদ মাথা নিচু করে বলল,
- জি হুজুর, এখনই ব্যবস্থা করছি।
সিমরানের পর অন্য বাঈজীরা মাহফিল জমাতে ব্যর্থ হলেন। কাজেই মধ্যরাতে মাহফিল শেষ হয়ে গেল।
তাইমুর নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হলঘর ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত আগত অতিথিদের মুখে শুধুমাত্র সিমরানের প্রশংসাই শ্রবণগোচর হল তার।
- এমন পরিবেশনা তো আগে এ তল্লাটে দেখিনি!
- গজনবী মাহফিলের ভাগ্য খুলে গেল!
তাইমুর ম্লান হাসলেন। আগত অতিথিদের তার ভীষণ বলতে ইচ্ছা করছে,
নিঃসন্দেহে চমৎকার নৃত্য। সিমরান আগুনের মতো তপ্ত এবং দীপ্তিময়। তবে মনে রাখবেন, আগুন কেবল পোড়াতে জানে। এই গল্পের লেখিকা ‘Atia Adiba – আতিয়া আদিবা’ পেইজে প্রতিদিন বিকাল ৫ টায় নতুন পর্ব দেওয়া হয়।
কথাগুলো বলার অদম্য ইচ্ছে মনে পুষে রেখে দ্রুত পা বাড়ালেন তাইমুর। উদ্দেশ্য নিজের বিলাসবহুল কক্ষ নয়। বাঈজী মহল। হেমাঙ্গিনীকে হলঘর ছেড়ে ছুটে বেড়িয়ে যেতে দেখেছেন তিনি।
নবাব তাইমুর গজনবী দ্রুত পায়ে হেঁটে চললেন বাঈজী মহলের দিকে। প্রহরীরা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে রইল। ছোট হুজুরের মেজাজ সম্পর্কে তারা অবগত।
তাইমুরের চোয়াল ইস্পাতের মত শক্ত। তার মনের ভেতর চলছে তোলপাড়। হেমাঙ্গিনী বোধহয় নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী আর ব্যর্থ নারী ভাবছে। আজ রাতেই হেমাঙ্গিনীর এই ভুল ভাঙাতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, সিমরান হয়তো আগুনের ফুলকি। কিন্তু হেমাঙ্গিনী হলো স্নিগ্ধ জোনাকি। আগুন নিজে জ্বলতে পারে না। জোনাকিরা পারে।
তাইমুর গজনবী আগুনের তাপে পুড়তে চান না। তিনি চান জোনাকির আলোয় আমৃত্যু পথ চলতে।
৪০০ কমেন্ট এবং ২৫০০ লাইক সম্পন্ন হলে আগামীকাল বিকাল ৫ টায় ৮ম পর্ব আসবে। লাইক, কমেন্ট এবং পেইজ ফলো করুন।
উপন্যাসঃ #নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀
লেখিকাঃ Atia Adiba – আতিয়া আদিবা
Share On:
TAGS: আতিয়া আদিবা, নিষিদ্ধ রংমহল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৪
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৬
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৫
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৩
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৭
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১২
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৪
-
নিষিদ্ধ রংমহল গল্পের লিংক
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ২