নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀
পর্ব_১৮
বাঈজী মহলের কক্ষগুলোতে জ্বলছে শত শত মোমবাতি আর লণ্ঠন। মহলের বাতাস বেশ ভারী হয়ে আছে দামী আতর, চন্দন আর অগুরুর সুবাসে। আজ সেই বহু প্রতীক্ষিত মাহফিলের রাত্রি, যে রাত হয়ত এই মহলের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
বাঈজী মহলের অভ্যন্তরীণ ঘরগুলোতে এখন সাজ সাজ রব। প্রতিটি আয়নার সামনে এক একজন নর্তকী বসে নিজেদের রূপকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত। কোথাও ঝনঝন শব্দে ভারী অলঙ্কার পরিধানের প্রতিযোগিতা চলছে, কোথাও বা আবার ঘন কাজলের রেখায় চোখের ভাষা শানিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ব্যবহৃত প্রতিটি প্রসাধন যেন একেকটি রণসজ্জা। কারণ আজকের মাহফিল কেবলমাত্র মনোরঞ্জনের নয়, এর উর্ধ্বেও আজ হবে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই।
মহলের প্রধান কক্ষের বিশাল আয়নার সামনে বসে আছে সিমরান। আজকের রাত তার নিকট একচ্ছত্র আধিপত্যের রাত। সিমরানের পরনে রয়েছে টকটকে লাল রঙের ভারী জরির কাজ করা পোশাক। যার প্রতিটি সুতোয় ঝরছে আভিজাত্য। গলায় জমিদার সিকান্দার গজনবীর দেওয়া হীরক ও পান্না খচিত মালাটি প্রদীপের দপদপে আলোয় প্রতিনিয়ত জ্বলছে। এই মালাটি যেন সিমরানের জয়লাভের পূর্ব চিহ্ন।
সিমরানের দুই পাশে অবস্থান করছে তার দলের দুজন অনুগত বাঈজী। তারা তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। তার ঠোঁটের কোণে খেলা করছে এক পৈশাচিক তৃপ্তির হাসি।
সিমরান মনে মনে নিজের জয় নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দিহান নয়। তার অন্ধবিশ্বাস, আজ মাহফিলের সমাপ্তি ঘটবে হেমাঙ্গিনী আর বিলকিস বানুর পতনের মাধ্যমে। সে আয়নায় নিজের প্রতিফলন দেখে ফিসফিস করে বলল,
- আজকের পর হতে এই মহলে আর কোনো বিভাজন থাকবে না। বিলকিস বানুর সেই জরাজীর্ণ একঘেয়ে শিল্পচর্চা আর হেমাঙ্গিনীর অকালপক্ক দম্ভ, সব আজ এই ধুলোয় মিশিয়ে দেব। কাল ভোরে যখন সূর্য উঠবে, তখন গজনবী জমিদারবাড়ির বাইজী মহলে কেবলমাত্র সিমরানের রাজত্ব থাকবে।
সিমরানের দলের অন্য নর্তকীরাও আজ নিজেদের সাজে কোনো খামতি রাখেনি। তারা জানে, সিমরানের জয় মানে তাদেরও জয়। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসছে। যেন হেমাঙ্গিনীর বিদায়ি ঘণ্টা তাদেরও শ্রবণগোচর হচ্ছে।
অন্যদিকে, হেমাঙ্গিনীর কক্ষের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে কোনো কোলাহল নেই, নেই কোনো প্রসাধনের তীব্র গন্ধ। সেখানে বিরাজমান এক গভীর আধ্যাত্মিক নিস্তব্ধতা।
বিলকিস বানু তার চিরচেনা গাম্ভীর্য নিয়ে কক্ষের কোণে বসে ছিলেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হেমাঙ্গিনী। কিন্তু হেমাঙ্গিনীর রূপ আজ মহলের অন্যান্য বাঈজীদের চেয়ে একেবারে ভিন্ন।
হেমাঙ্গিনী আজ কোনো ভারী অলঙ্কার পরেনি। তার পরনে একটি সাধারণ কিন্তু আভিজাত্যপূর্ণ গাঢ় নীল রঙের লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গার পাড়ে কমলা এবং সামান্য রূপালি কাজের ছোঁয়া। তার চুলগুলো আজ কোনো জটিল বিনুনিতে বাঁধা নেই। বরং পিঠের ওপর অবিন্যস্তভাবে ছাড়া। শুধু কানের পাশে একটি সদ্য ফোটা কমলা রঙের বুনো ফুল গুঁজে নিয়েছে সে। চোখে অতি সামান্য কাজলের ছোঁয়া। ব্যস, এই ছিল তার আজকের সাজ।
বিলকিস বানু কুঞ্চিত ভ্রুঁ নিয়ে হেমাঙ্গিনীর পানে তাকালেন। তার চোখে একই সাথে খেলা করছে বিস্ময় আর শঙ্কা। তিনি ধীর স্বরে বললেন,
- বেটি, আজ মাহফিলে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের রাত্রি। রাজদরবারে প্রতিটি বাঈজী নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে সাজছে। আর তুই? এই সামান্য বেশে কিভাবে মাহফিলের সেই জৌলুস মোকাবেলা করবি? অন্তত গলায় জড়োয়া নবরত্নের হারটা পর, এটা তোর শ্রী বৃদ্ধি করবে!
হেমাঙ্গিনী বিলকিস বানুর দিকে তাকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে দৃঢ় এক হাসি হাসল। তার মাঝে কোনো অস্থিরতা ছিল না বরং এক অপ্রতিরোধ্য আত্মবিশ্বাসের মোহে আচ্ছন্ন ছিল।
সে বিনীতভাবে বলল,
- না, খালা। আজ নিজের সুসজ্জিত রূপ দেখানোর রাত নয়। আজ যোগ্যতা দিয়ে রূপের আলো চিরকালের জন্য নিভিয়ে দেওয়ার রাত। অলঙ্কার কেবল শরীরের জৌলুস বৃদ্ধি করে। তবে আত্মার দীপ্তি বৃদ্ধি করতে পারে না। আমি চাই না গজনবী মাহফিলের অতিথিরা আমার গয়নার কারুকাজ দেখুক। আমার মোহনীয় রূপ দেখুক।
আমি চাই তারা আমার প্রতিটি মুদ্রায় বাঈজীদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ দেখুক!
বিলকিস বানু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হেমাঙ্গিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করল,
- খালা, তোমার শিক্ষাই আমার প্রধান অলঙ্কার। আমি যদি আমার নৃত্য আর গীত দিয়ে আজ রাতে মাহফিলের প্রাণ কেড়ে নিতে না পারি, তবে সহস্র অলঙ্কারও আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। আজ হেমাঙ্গিনী সাজবে না। আজ হেমাঙ্গিনীর শিল্প ইতিহাস রচনা করবে।
বিলকিস বানু বুঝতে পারলেন, হেমাঙ্গিনীর অভ্যন্তরে আজ এক বিশাল আগ্নেয়গিরি শান্ত রূপে ঘাপটি মেরে আছে। যা মাহফিলের মঞ্চে এক নিদারুণ বিস্ফোরণ ঘটাবে। তিনি কেবল আশ্বস্ত হয়ে হেমাঙ্গিনীর মাথায় দোয়ার হাত রাখলেন।
মাহফিলের সময় ঘনিয়ে এলো। খাদেমরা এসে সংবাদ দিয়ে গেল। মাহফিল আমন্ত্রিত অতিথিদের আনাগোনায় পূর্ণ। বাঈজী মহলের দীর্ঘ কোরিডোর দিয়ে দলবেঁধে বাঈজীরা বড় হলঘরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল।
ঠিক মাঝপথের সেই প্রশস্ত বারান্দায় মুখোমুখি হয়ে গেল দুই দল। একদিকে সিমরান ও তার জমকালো বাঈজীর দল। অন্যদিকে বিলকিস বানু এবং তার পাশে একাকী নীল বসনা হেমাঙ্গিনী।
সিমরান হেমাঙ্গিনীর সাধারণ সাজ দেখে এক বিকট ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসল। তার চোখের দৃষ্টি হেমাঙ্গিনীকে আপাদমস্তক মেপে নিল। সে অত্যন্ত কটু স্বরে বলে উঠল,
- বাহ্! বাঈজী হেমাঙ্গিনীকে তো আজ বড়ই করুণ দেখাচ্ছে। লড়াই করতে এসে কি তবে আগেই হার স্বীকার করে নিলেন? নাকি সাজগোজ করার মতো সামান্য মনোবল জোটেনি?
সিমরানের দলের এক নর্তকী হাসতে হাসতে টিপ্পনি কাটল,
- উস্তাদনী, মনে হচ্ছে উনি আগেই রাজ্য ত্যাগের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। নিঃস্ব হয়ে, সর্বস্ব হারিয়ে তার এই যাত্রাকে আমরা সাধুবাদ জানাই!
হাসির রোল পড়ে গেল বাইজী মহলের বারান্দায়।
সিমরান এগিয়ে এসে বিলকিস বানুর চোখের সামনে নিজের হাতের দামী চুড়িগুলো ঝনঝন করে বাজালো। তারপর বিষাক্ত স্বরে বলল,
- আজকের এই রাতই আপনাদের শেষ রাত। মাহফিলের সর্বশেষ বাতিটি নেভানোর সাথে সাথেই আপনাদের বাঈজী মহল ত্যাগের নির্দেশ জারি করব। আমি ব্যক্তিগতভাবে জমিদারের কাছ থেকে সেই প্রতিশ্রুতি আদায় করেছি। আজ অন্তত মন দিয়ে এই গজনবী মহলের আতিথেয়তার স্বাদ নিন। কেননা, আগামীকাল থেকে আপনাদের ভাগ্য আর সহায় হবে না। ধুলোমাখা পথে রাত্রীযাপন করতে হবে।
বিলকিস বানুর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তার প্রবীণ সত্তা অপমানে রি রি করে উঠল। তিনি কঠোর কিছু বলতে মুখ খুলতেই হেমাঙ্গিনী তার হাত আলতো করে চেপে ধরল। চোখের ইশারায় বিলকিস বানুকে শান্ত থাকতে বলল।
হেমাঙ্গিনী এক কদম এগিয়ে এল সিমরানের পানে। তার নীল বসন আর সাধারণ সাজের আড়ালে তখন এক অদ্ভুত তেজ ফুটে উঠেছে।
সে অত্যন্ত নাটকীয়তার সাথে নম্র ভঙ্গিতে কুর্নিশ জানাল সিমরানকে।
ধীর লয়ে এবং সাবলীলভাবে বলল,
- উস্তাদনী সিমরান, আপনার এই আত্মবিশ্বাস আমায় মুগ্ধ করল। আপনি আজ যে জৌলুস ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তা সত্যিই চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছে। তবে মাহফিল বড় বিচিত্র স্থান তা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়? প্রদীপের নিচের সেই অন্ধকার সহসাই ঘনিয়ে আসে। তবে আপনার জন্য আমার নিরন্তর শুভ কামনা রইল।
হেমাঙ্গিনী একটু থামল। বুক ভরে শ্বাস নিল। তার ঠোঁটে লেগে আছে রহস্যময় হাসি। সে পুনরায় বলল,
- আপনি ঠিকই বলেছেন, আজ একটি বিশেষ রাত। তবে আজকের এই বিশেষ রাতে কে জয়লাভ করবে কিংবা কার পরাজয় নিশ্চিত, তা তো মাহফিলের আগত অতিথিবৃন্দ ঠিক করবে! আপাতত চলুন, গোটা মাহফিল আমাদের জন্য অপেক্ষমান। আমরা আমাদের শিল্প দিয়ে তাদের তৃপ্ত করি। জয়-পরাজয়ের হিসাব সময়ের ওপর তোলা থাক!
সিমরান হেমাঙ্গিনীর এহেন ব্যবহারে কিছুটা থতমত খেল। সে মনশ্চক্ষুতে দেখেছিল হেমাঙ্গিনীর ভয়ে কুঁকড়ে যাবার দৃশ্য। কিন্তু হেমাঙ্গিনীর চোখের এই স্থিরতা তাকে এক অজানা ভয়ের ইঙ্গিত দিল।
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে সিমরান তার আঁচল ঝটকিয়ে বলল,
- শুভ কামনা নিজের কাছেই রাখুন, বাঈজী হেমাঙ্গিনী। মাহফিলেই প্রমাণ হয়ে যাবে কার শিল্প শ্রেষ্ঠ!
সিমরান তার দল নিয়ে দ্রুত পায়ে বড় হলঘরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। বিলকিস বানু হেমাঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার মনে হলো, আজ রাতের এই লড়াই কেবল দুজন বাঈজীর মধ্যকার লড়াই নয়, এটি অহংকার বনাম সত্যের এক মহাকাব্যিক সংঘাত হতে চলেছে।
হেমাঙ্গিনী চোখজোড়া বুঁজল। তার সম্মুখে ভেসে উঠল নবাব তাইমুর গজনবীর সুদর্শন চেহারা। হেমাঙ্গিনী জানে, এই রাতের প্রতিটি মুদ্রা কেবল তার জয় নয়, বরং ভালোবাসার রাজকীয় অধিকার অর্জনের সিড়ি।
★★★
গজনবী মাহফিলের বড় হলঘরটি যেন আজ কোনো ঐন্দ্রজালিক নগরীর ন্যায় সেজেছে। বিশালাকার থামগুলোতে চন্দন আর আতর মিশ্রিত সুগন্ধি প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। যার ঘ্রাণে ভারী হয়ে আসছে নিশ্বাস।
ছাদ থেকে ঝুলে থাকা শত মোমের ঝাড়বাতিগুলো আজ যেন একেকটি নক্ষত্রপুঞ্জ। যাদের আলো হলঘরের মেঝেতে প্রতিফলিত হয়ে এক অপার্থিব মায়ার সৃষ্টি করেছে। মাসনদে আসীন জমিদার সিকান্দার গজনবী এবং তার বড়পুত্র তাইমুর গজনবী। দুজনেই এক অজানা ঝড়ের অপেক্ষায় স্থির।
আমন্ত্রিত অতিথিদের কোলাহলে মুখরিত গোটা মাহফিল আজ। ব্রিটিশ রাজপুরুষদের পরনে জাঁকজমকপূর্ণ সামরিক পোশাক। প্রতিবেশী জমিদারদের রেশমী পাগড়িতে মোড়ানো হীরা-মুক্তোর কলকা। সকলের দৃষ্টি স্থির মঞ্চের ওপর, যেখানে আজ নির্ধারিত হবে গজনবী রাজত্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পীর ভাগ্য। অথচ এবিষয়ে তারা অবগত নয়!
জমিদারের আদেশানুসারে হঠাৎ তবলার চাটি আর সারেঙ্গীর প্রথম সুরটি গুঞ্জরিত হল। মাহফিলে নেমে এল এক নিবিড় নিস্তব্ধতা।
মঞ্চের কেন্দ্রে ঝনঝন শব্দে আবির্ভূত হল সিমরান ও তার অনুগত বাঈজীর দল। সিমরানের প্রতিটি পদক্ষেপে আজ এক রাজকীয় দাপট। তার প্রতিটি মুদ্রায় মিশে আছে এক অদ্ভুত কাঠিন্য, যা কেবল দীর্ঘ সাধনার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং ক্ষমতার দম্ভ থেকেও উদ্ভূত।
সারেঙ্গীর সুর যখন দ্রুত হতে শুরু করল,
সিমরান তার নাচের প্রথম লয়টি ধরল।
তার নাচটি ছিল নিখুঁত জ্যামিতিক নকশার মতো। হাতের কাজ এবং পায়ের তালের মধ্যে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ছিল না। তবলার ‘ধেরে ধেরে ক্যেটে’ বোলের সাথে তার ঘুঙুরের শব্দ যখন পাল্লা দিয়ে বাজতে শুরু করল, তখন উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথিরা বিমোহিত হয়ে পড়লেন। এটি ছিল এক যান্ত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রদর্শন। সিমরান মঞ্চের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে যখন তার দ্রুতগামী ‘চক্কর’গুলো দিচ্ছিল, তখন তার ভারী রেশমী পোশাকটি মঞ্চের ওপর এক বিশাল বৃত্ত তৈরি করল।
প্রতিটি চক্করের শেষে যখন সিমরান হাত দুটি উপরের দিকে ছুঁড়ে স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, তখন উপস্থিত আগন্তুকরা আভিজাত্যের বিস্ময় প্রকাশ করতে করতে ব্যস্ত প্রায়!
এরপর সিমরানের দলের নর্তকীরা তাকে ঘিরে এক নিপুণ শৃঙ্খলাবদ্ধ ভঙ্গিমায় নৃত্য পরিবেশন করতে লাগল। তাদের সমবেত ঘুঙুরধ্বনি দরবার হলের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে এক কৃত্রিম উত্তেজনার সৃষ্টি করল। সিমরান বারবার অতিথিদের চোখের দিকে তাকিয়ে সম্মোহনী মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
ক্রমশ তার নৃত্যে প্রকাশ পেতে লাগল একক অধিকারের সুর। যেন এই মঞ্চকে সিমরান তার ব্যক্তিগত রাজত্ব বলে ঘোষণা করছে।
এই সুদীর্ঘ পরিবেশনায় সিমরান তার শারীরিক সক্ষমতা আর কৌশলের চরম সীমা স্পর্শ করল। সে যখন তবলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘ঝালা’র চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছাল, তখন আগত অতিথিদের মনে হল মঞ্চে যেন এক রক্তিম ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। এটি ছিল আভিজাত্য আর শক্তির এক প্রকাশ্য আস্ফালন।
সিমরান তার শেষ মুদ্রাটিতে মনোনিবেশ করল।তার মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ল তাচ্ছিল্যভরা হাসি। আঁড়চোখে হেমাঙ্গিনীর দিকে একবার তাকিয়ে, সেই হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে মঞ্চ ছাড়ল সে।
গোটা মাহফিল জাগ্রত হল ‘মারহাবা’ ধ্বনিতে।করতালিতে ফেটে পড়ল সকলে।
সিমরানের এই কোলাহলপূর্ণ বিদায়ের পর মাহফিলে পুনরায় এক রহস্যময় স্তব্ধতা নেমে এল। ঠিক সেই মুহূর্তে মঞ্চে ধীর পায়ে এগিয়ে এল নীল বসনা হেমাঙ্গিনী। সে তার স্থান পাকাপোক্ত করল ঠিক ঝাড়বাতিটির নিচে।
তার অলঙ্কারহীন এই মূর্তিকে দেখে মাহফিলের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ভ্রুঁ কুঞ্চিত হল।
তবে সারেঙ্গীর এক দীর্ঘ ও করুণ তারের সুরের মধ্য দিয়ে হেমাঙ্গিনী যখন তার প্রথম মুদ্রাটি ধরল, তখন যেন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় গোটা প্রেক্ষাপট বদলে গেল।
হেমাঙ্গিনী আজ কোনো ক্ষমতার প্রদর্শন করতে আসেনি। বরং সে এসেছে নিজেকে উৎসর্গ করতে। তার হাতের আঙুলগুলো যখন বাতাসের বুকে এক অদৃশ্য হাহাকারের নকশা আঁকছিল, তখন উপস্থিত অতিথিরা সেই নকশার প্রভাবে সম্মোহিত হয়ে পড়লেন।
শুরুতে হেমাঙ্গিনী কোনো দ্রুত লয় ব্যবহার করল না। বরং তার ধীরস্থির অবয়বে এক আধ্যাত্মিক সুষমা ফুটিয়ে তুলল।তবলার বোল যখন মাঝারি লয়ে পৌঁছল, তখন হেমাঙ্গিনীর নিখুঁত পায়ের কাজ শুরু হল। তার নূপুরধ্বনি থেকে নির্গত হতে লাগল এক অপার্থিব সুর।
সে মঞ্চের মসৃণ মেঝেতে বিদ্যুতের ন্যায় পিছলে গেল। সে থামল ঠিক জমিদারপুত্র তাইমুর গজনবীর সম্মুখভাগে। হেমাঙ্গিনীর এমন নৃত্যভঙ্গিতে আগত অতিথিদের নিশ্বাস যেন এক মুহূর্তের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেল।
হেমাঙ্গিনী আজ কোনো বাঈজী সুলভ চটুলতা দেখাল না। তার প্রতিটি আমোদ আর তৎকার ছিল তাইমুরের প্রতি এক নিবিড় প্রেমের অঙ্গীকার।
উপস্থিত ব্রিটিশ পুরুষেরা মদের পাত্র নামিয়ে রাখলেন। পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে রইলেন। চোখের পলক পড়ছিল না তাদের।
এক বৃদ্ধ জমিদার, যার কানে শত শত মাহফিলের সুর বেজেছে, তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
- এ তো নাচ নয়, এ তো এক বিরাহিণী আত্মার হাহাকার!
সকলের উন্মাদনা তখন চরম সীমায়। হেমাঙ্গিনী যখন তবলার তালের সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুত বেগে ঘুরতে শুরু করল, তখন তার নীল পোশাকটি মঞ্চের ওপর এক বিশাল নীল পদ্মের মতো ঘূর্ণায়মান হয়ে উঠল। এক টানা পঞ্চাশটি চক্কর দেওয়ার পর যখন সে স্থির হয়ে দাঁড়াল, তখন গোটা মাহফিল ফেটে পড়ল এক আকাশচুম্বী চিৎকারে,
- অপূর্ব! সুবহানআল্লাহ!
হেমাঙ্গিনীর চুলগুলো তখন অবিন্যস্ত হয়ে পিঠের ওপর খেলা করছিল, তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝাড়বাতির আলোয় হীরার মতো চমকাচ্ছিল।
কিন্তু হেমাঙ্গিনীর আসল জাদু লুকিয়ে ছিল তার দু-চোখের ইশারায়। সে যখন মঞ্চে নেচে বেড়াচ্ছিল, তার নজর মাহফিলের অতিথিদের ভিড় এড়িয়ে বারবার স্থির হচ্ছিল তাইমুরের ওপর।
সেই চাহনিতে ছিল একজন বেগমের অধিকারবোধ। হেমাঙ্গিনী যখন এক পায়ে দাঁড়িয়ে বৃত্তাকারে ঘুরছিল, তখন তার ওষ্ঠের কোণে এক মিষ্টি ও লাজুক হাসি ফুটে উঠল। যা ছিল শুধুমাত্র তাইমুরের জন্য। সেই হাসিটি এতই প্রগাঢ় ছিল যে তাইমুর গজনবী নিজেও সম্মোহিত হয়ে আসন থেকে সামান্য সামনে ঝুঁকে পড়লেন।
অতিথিদের মধ্যে তখন এক অভূতপূর্ব উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। তরুণ জমিদাররা উত্তেজনায় আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মোহর আর মূল্যবান রত্ন মঞ্চের ওপর বৃষ্টির মতো পড়তে শুরু করল। কিন্তু হেমাঙ্গিনীর সেদিকে কোনো ভ্রুঁক্ষেপ ছিল না। সে যেন দরবারের সমস্ত কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল তাইমুরের সাথে এক নিঃশব্দ কথোপকথনে মগ্ন।
নাচের দ্রুত লয় যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল,
তখন হেমাঙ্গিনীর নূপুরধ্বনি আর বাদ্যযন্ত্রের সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। সে তার নাচের তালের মাঝেই তাইমুরকে নিঃশব্দে বুঝিয়ে দিল,
- এই যে আমার ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল, সর্বাঙ্গের ক্লান্তি, আর আগত মেহমানদের বন্দনা, সবই আপনার চরণে নিবেদিত, হুজুর!
হেমাঙ্গিনীর প্রতিবাদের শিল্প আর প্রেমের এক অদ্ভুত রসায়ন সকলের মাঝে এক অভাবনীয় উচ্ছ্বাস তৈরি করল। রাজপুরুষেরা পর্যন্ত তাদের আভিজাত্যের খোলস ছেড়ে উচ্চস্বরে প্রশংসা করতে শুরু করলেন। দরবারের এক কোণে বসা প্রবীণ অমাত্যরা, যারা কেবল বাঈজীদের রূপের কাঙাল, তারাও আজ হেমাঙ্গিনীর শিল্পের কাছে মাথা নত করলেন।
সিমরান মঞ্চের আড়াল থেকে এই দৃশ্য দেখে নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারছিল না মোটেও। মুহুর্তের মাঝেই নিজের নিখুঁত কৌশল হেমাঙ্গিনীর এই অবাধ্য আবেগের কাছে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে দেখল সে। অতিথিদের এই নিয়ন্ত্রণহীন উচ্ছ্বাস আর তাইমুরের চোখের মুগ্ধতা, সিমরানকে এক গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে লাগল ক্রমশ। সিমরান বুঝতে পারল, এক পরাজিত সেনাপতির মতো নিজের পতন চাক্ষুষ করছে সে।
অবশ্যই ৪০০০ লাইক এবং ৬০০ কমেন্ট সম্পন্ন করবেন। টার্গেট পূরণ না হলে পরবর্তী পর্ব আসবে না।
উপন্যাসঃ #নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀
লেখনীতে, Atia Adiba – আতিয়া আদিবা
Share On:
TAGS: আতিয়া আদিবা, নিষিদ্ধ রংমহল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৪
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১২
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৭
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৭
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১১
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৬
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১০
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৬
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ২
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৪