নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀
পর্ব_১৪
পরের দিন সকালে গজনবী এস্টেটে বিরাজ করছিল এক ভিন্ন মেজাজ। অতি বিলাসবহুল বৈঠকখানাটি পুনরায় নতুন করে সাজানো হয়েছে। রুপোর কারুকাজ করা হুক্কাগুলো সেজেছে সুগন্ধি গোলাপজল দিয়ে। আর বারান্দার থোকায় থোকায় রাখা সুগন্ধি ধূপের ধোঁয়া তৈরি করেছে আভিজাত্যের এক ভারী আবহ।
বেলা দ্বিপ্রহরে জমিদারবাড়ির বৈঠকখানায় সমবেত হলেন এ অঞ্চলের সকল বিত্তশালী মহাজন এবং ব্যবসায়ীরা। তবে সিকান্দার গজনবীর তাদের সহিত আলোচনার মূল বিষয়বস্তু আজ বাণিজ্য ছিল না।
মোট পনেরোজন ধনাঢ্য ব্যক্তি গজনবী মহলের বৈঠকখানায় আসন গ্রহণ করেছেন। এদের অধিকাংশই এস্টেটের বড় কারবারী এবং সুদের মহাজন। খাজনার পাশাপাশি তাদের বিপুল পুঁজির ওপরও নির্ভর করে এই অঞ্চলের অর্থনীতি।
সকলেরই পরনে বহুমূল্য পাঞ্জাবি। হাতে রয়েছে ছড়ি। তবে তারাও কিঞ্চিৎ আঁচ করতে পেরেছেন, আজ তাদের আগমন শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে নয়। সিকান্দারের এই নিমন্ত্রণ পত্র যেন অন্য কোনো ঘটনার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তারা বসে আছেন মনের মাঝে এক চাপা উত্তেজনা নিয়ে।
নবাব সিকান্দার গজনবী বৈঠকখানায় প্রবেশ করা মাত্র সকলে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে ধীরেসুস্থে মাসনদের ওপর আয়েশ করে বসলেন। তাকে পুরোটা সময় অনুসরণ করলেন তাইমুর। তিনিও পিতার পাশে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিলেন।
একে একে সকল ব্যবসায়ী এবং মহাজনেরা সিকান্দার এবং তার বড় পুত্রের সামনে গিয়ে প্রথা অনুযায়ী কদমবুসি করলেন। পিতার মতন তাইমুরও তাদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন।
তিনি লক্ষ্য করলেন,
সকল ব্যবসায়ীদের চোখেমুখে বিরাজমান এক মিশ্র অনুভূতির ছাপ। তবে সকলের মাঝে যে বিষয়টির সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে তা হল ‘লোভ’। প্রবল ক্ষমতাধর জমিদারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবার লোভ। এই গল্পের পরের পর্ব লেখিকা ‘Atia Adiba – আতিয়া আদিবা’ এই পেইজে সন্ধ্যা ৬ টায় সবার আগে দেওয়া হবে।
সিকান্দার গজনবী তার শান্ত গলায় খানিকটা কর্তৃত্ব মিশিয়ে শুরু করলেন,
- আশা করি আপনারা সবাই জেনে গেছেন, গতকাল এ বাড়িতে নীলকুঠির প্রধান প্রতিনিধি মিস্টার রবিনসন এবং তার সহকারী রামকমল রায়ের পদধূলি পড়েছিল। তারা চেয়েছিলেন নীলচাষের মাধ্যমে আমাদের জমিতে আধিপত্য বিস্তার করতে। আমি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, গজনবী এস্টেট কারো ভাগীদারিত্বে বিশ্বাসী নয়। আমাদের জমিতে কী ফলবে, সে সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র আমাদেরই।
উপস্থিত সকলে উচ্চস্বরে সিকান্দারের দূরদর্শিতার প্রশংসা করলেন। রেশমের কারবারী, বসির উদ্দিন সামান্য ঝুঁকে মাথা নত করে বললেন,
- হুজুর, আপনি যা করেছেন, তা আমাদের মতো সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছে অভূতপূর্ব সাহস। আপনি আমাদের মান বাঁচিয়েছেন।
সিকান্দার সামান্য হাসলেন। তার হাসিতে ছিল তীক্ষ্ণ এবং নিরাবেগের ঝলক। তিনি বললেন,
- সাহস নয়, বসির। এটাই নীতি। এস্টেটের জৌলুস এবং তার অর্থনৈতিক প্রবাহ রক্ষা করাই আমার প্রথম ধর্ম। আর এই ধর্মের পথে বাধা সৃষ্টিকারী যে ই হোক না কেন, তাকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে।
সিকান্দার একটু থামলেন। কিছুক্ষণ দম নিলেন। তারপর বললেন,
- কিন্তু আমি জানি, শুধু নীলকরদের দূরে সরালেই চলবে না। এই এস্টেটের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হলে এর ক্ষমতার ভিত্তিকে আরও মজবুত করতে হবে। বিশেষ করে এই সময়ে।
উপস্তিত সকলে কৌতূহলী হয়ে একে অপরের দিকে তাকালেন। এইবার সিকান্দার তার প্রধান উদ্দেশ্যেকে সকলের সামনে উন্মুক্ত করে দিলেন।
তিনি তার বড় পুত্র তাইমুরের দিকে ইশারা করলেন।
- আপনারা সবাই নবাব তাইমুর গজনবীকে চেনেন। সে আমার রক্ত। এই বংশের যোগ্য উত্তরসূরি। সে শুধু আমার রক্তের উত্তরাধিকারী নয়, সে এই গজনবী এস্টেটের ভাবী জমিদার।
তাইমুর উঠে দাঁড়ালেন। সকলকে অভিবাদন জানালেন। তার চোখে জ্বলজ্বল করছিল তারুণ্য। তিনি ভাবলেন, হয়তো তার পিতা এবার তাকে নতুন কোনো বাণিজ্যিক চুক্তির দায়িত্ব দেবেন।
কিন্তু সিকান্দার যা বললেন, তা যেন তাইমুরের মাথায় পড়ল বজ্রপাতের ন্যায়। সিকান্দার কণ্ঠস্বর আরোও গম্ভীর করে বললেন,
- আমি বয়সের ভার অনুভব করছি। তাই স্থির করেছি, গজনবী এস্টেটের ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সমাগত। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে, এই এস্টেটকে সুরক্ষিত রাখা এবং এর ভিত্তি মজবুত করাও আমার দায়িত্ব। সিকান্দার গজনবী দায়িত্ব এড়ায় না।
তিনি তাইমুরের কাঁধে আলগোছে হাত রাখলেন। সেই হাত রাখার ভঙ্গিতে কোনো স্নেহ ছিল না। ছিল শুধুমাত্র নিখাদ কর্তৃত্বের প্রতীক।
- আজ আমি আপনাদের সকলের সামনে এক বিশেষ ঘোষণা করতে চাই। আমি স্থির করেছি, আগামী এক মাসের মাঝেই নবাব তাইমুর গজনবীর বিবাহের সকল প্রস্তুতি শুরু হবে। তার বিবাহ সম্পন্ন হলেই, আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে জমিদারের মর্যাদা দিব। এই এস্টেটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তুলে দেবো।
ব্যাবসায়ীদের মাঝে লুকানো চাপা উত্তেজনা এবার চেহারায় দৃশ্যমান হতে লাগল। সকলেই ভাবলেন, সিকান্দার হয়তো কোনো দূরবর্তী শক্তিশালী জমিদার কন্যাকে পুত্রবধূ করবেন। কিন্তু সিকান্দার এবার সরাসরি উপস্থিত ব্যক্তিদের দিকে তাকালেন। বললেন,
- আপনারা সবাই এই এস্টেটের স্তম্ভ। আপনারা আপনাদের জীবন দিয়ে এই এস্টেটের বাণিজ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আপনাদের অর্থই আমাদের রাজকোষকে পূর্ণ করে। তাই আমি বিশ্বাস করি, এই এস্টেটের ভবিষ্যতের বেগম সাহেবা বাইরে থেকে আসবে না।
সিকান্দার তার কণ্ঠস্বর সামান্য খাদে নামিয়ে বললেন,
- সে আসবে আপনাদের কোনো একজনের ঘর থেকে।
বৈঠকখানা জুড়ে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। পনেরো জন মহাজনের চোখ তখন চকচক করছে। তাদের কন্যাদের মধ্যে থেকে একজন হবেন গজনবী এস্টেটের ভাবী নবাব পত্নী!
এটি কেবলমাত্র সম্মানের বিষয় নয়, বরং এলাকার ক্ষমতা এবং অর্থের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ।
সিকান্দার তার কথা শেষ করলেন এই বলে,
- এখানে উপস্থিত আপনাদের সকলেরই বিবাহ উপযোগী কন্যাসন্তান রয়েছে। আমি চাই, নবাব তাইমুর গজনবীর ভাবী স্ত্রী হিসেবে সেই কন্যাকেই বেছে নেওয়া হোক, যে হবে অত্যন্ত সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং শুভ লক্ষণের প্রতীক। আমাদের বংশের জৌলুসকে যে আরও বৃদ্ধি করবে।
পিতার কথা শুনে তৎক্ষনাৎ তাইমুরের মনে হলো কেউ বোধহয় তার কানে গলিত সিসা ঢেলে দিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি সম্পূর্ণ হতবাক। তার হাত-পা শীতল হয়ে গেল। তার এত বড় একটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, তার সাথে পূর্বে আলাপ না করে, মতামতের তোয়াক্কা না করে ভরা মজলিসে এমনভাবে ঘোষণা করা হলো? বিষয়টি তাকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগল। যেন তিনি রক্তমাংসে গড়া কোনো মানুষ নন বরং এই এস্টেটের একটি রাজনৈতিক সরঞ্জাম মাত্র। এই গল্পের পরের পর্ব লেখিকা ‘Atia Adiba – আতিয়া আদিবা’ এই পেইজে সন্ধ্যা ৬ টায় সবার আগে দেওয়া হবে।
তাইমুরের চোখের সামনে তখন ভেসে বেড়াচ্ছে হেমাঙ্গিনীর বিষণ্ণ মুখটি।
হেমাঙ্গিনী!
মেয়েটি যে তার আত্মার গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। তাকে স্থানচ্যুত করলে যে হৃদস্পন্দন থেমে যাবে তার! মৃত্যু হবে অনুভূতির। দিশেহারা হয়ে যাবে তাইমুর।
তাইমুর নিজেকে অবুঝের মত বোঝাতে চাইলেন। এই ঘোষণা হয়ত তার পিতার কোনো রাজনৈতিক চাল। কিন্তু যে চূড়ান্ত দৃঢ়তা সিকান্দারের চোখে তাইমুর দেখেছেন, তা বারবার ঠুনকো করে দিচ্ছে সকল সম্ভাবনা।
তাইমুর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিত এ বিষয়ে সন্দিহান।
ভরা মজলিসে তার পিতাকে অসম্মান করবার মতন বেয়াদব তিনি নন। কাজেই মুখ ফুটে এই ঘোষণার বিরোধিতা করতে পারছেন না।
তাইমুর দেখলেন, উপস্থিত সকলে হাসিমুখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছেন। তাদের চোখে তখন খেলা করছে নানাবিধ স্বপ্ন এবং নতুন ক্ষমতার অঙ্ক।
তাইমুর যদি এখন মুখ খোলেন, তবে তিনি শুধু পিতার সম্মানকে ধূলিসাৎ করবেন না, হেমাঙ্গিনীর জীবনকেও বিপন্ন করবেন। তাইমুরের জীবন থেকে হেমাঙ্গিনীকে মুছে ফেলতে নবাব সিকান্দার গজনবী যেকোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। এ বিষয়ে তাইমুর জ্ঞাত।
কাজেই শক্ত হাতে তাইমুর তার মুঠি চেপে ধরলেন। দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে তার ভেতরের ঝড় সহ্য করতে লাগলেন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন –
না, আজ নয়। এই ভরা মজলিসে পিতাকে অসম্মান করা যাবে না। তাকে কৌশলী হতে হবে। তাকে আগে ক্ষমতা হাতে নিতে হবে, এরপর নিজের শর্তে বাঁচতে হবে।
সিকান্দার গজনবী বড়পুত্রের নীরবতা লক্ষ করলেন। বেশ সন্তুষ্ট হলেন। তিনি ভাবলেন, পুত্র তার ক্ষমতা ও দায়িত্বের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। তার মুখমন্ডলে এক মুহুর্তের জন্য ভেসে উঠল বিজয়ের হাসি।
সিকান্দার এবার বললেন,
- সুতরাং, আপনারা প্রস্তুত হোন। আপনাদের কন্যাদের পরিচয় এবং বংশমর্যাদা সম্পর্কে আমাকে অবগত করুন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আমি তাইমুরের ওপর চাপাবো না। আমিই বেছে নেব। কে হবে এই গজনবী এস্টেটের বেগম সাহেবা!
মহাজনরা উঠে দাঁড়িয়ে জমিদারকে কৃতজ্ঞতা জানালেন।
তাইমুর পাথরের মূর্তির ন্যায় বসে রইলেন। তার মুখ ফুটে কোনো শব্দ বেরুলো না। কেবল ভেতরে হন্যে হয়ে ছোটাছুটি করছিল হেমাঙ্গিনীর প্রতি তীব্র বন্য ভালোবাসা।
★★ ★★ ★★
আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিরাট মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হলো।
মহাজন এবং ব্যবসায়ীরা উৎফুল্ল চিত্তে ভোজন সারলেন। কারণ তারা জানতেন, এই ভোজন শুধু উদরপূর্তি নয় বরং ক্ষমতার সিড়ি আহরণের এক শুভ সূচনা। তারা খেতে খেতে সিকান্দারের প্রতি স্তুতি বর্ষণ করতে লাগলেন।
তবে তাইমুরের অবস্থা ছিল করুণ। তিনি পিতার পাশে উপবিষ্ট ছিলেন বটে, কিন্তু তার কণ্ঠনালী দিয়ে এক গ্রাস অন্নও প্রবেশ করছিল না। তার অভ্যন্তরে তখন চলছে এক ভয়ঙ্কর নৈতিক দ্বন্দ্ব।
একদিকে বংশের সম্মান, প্রথা ও এস্টেটের স্থিতিশীলতা আবার অন্যদিকে হৃদয়ের একান্ত অনুভূতি – হেমাঙ্গিনী।
তাইমুর অন্যমনস্ক হয়ে রূপার চামচ দিয়ে থালার খাবার নেড়ে যাচ্ছিলেন। তার মনে হচ্ছিল এই সকল খাদ্য বিষাক্ত। বৈঠকখানার পরিবেশ তার শ্বাস যেন রুদ্ধ করে রেখেছিল। তার কানে তখনো পিতার সেই ঘোষণা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
বিকেল নামল। মহাজনরা জমিদারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং তাইমুরকে আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন। বৈঠকখানার কক্ষ আবারও জনশূন্য হলো। খাদেমরা দ্রুত হাতে উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করতে লাগল।
সিকান্দার গজনবী পান চিবোতে চিবোতে তখনও মসনদে উপবিষ্ট। তিনি তাইমুরের দিকে তাকালেন। বললেন,
- আজকের এই সভা আমাদের এস্টেটের জন্য শুভ ছিল, তাইমুর।
তাইমুর স্থির হয়ে পিতার সম্মুখে দাঁড়ালেন। তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ, কিন্তু ঠোঁটের ডগায় ছিল কঠিন প্রশ্ন,
- পিতা, আপনাকে একটি প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি। এত বড় সিদ্ধান্ত, যা আমার সমগ্র জীবনের গতিপথ পাল্টাবে, আমার সহিত পূর্বে কোনো আলোচনা না করে কেন তা ঘোষণা করা হল?
সিকান্দার আলতো করে হাসলেন। শীতল সেই হাসি। বললেন,
- তোমার এই প্রশ্নটি আমি প্রত্যাশা করেছিলাম।তোমাকে আমি আমার এই আসনে বসাতে চাই, তাইমুর। কিন্তু তোমার হৃদয়ের দুর্বলতা আমার দৃষ্টি এড়ায় নি।
তাইমুর থতমত খেয়ে গেলেন। হৃদয়ের দুর্বলতা! তার অর্থ, পিতা সবই আঁচ করেছেন!
- তুমি হয়তো ভেবেছো, বিয়ে তোমার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু একজন ভাবী জমিদারের বিয়ে কখনো ব্যক্তিগত হতে পারে না, পুত্র!
সিকান্দার এবার তার পুত্রর পানে সামান্য ঝুঁকে আসলেন। নিমজ্জিত গলায় বললেন,
- কোনো বাঈজী জমিদার বাড়ির বেগম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, তাইমুর। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, তোমার মন উড়ে গিয়েছে ওই বাঈজী মহলের চন্দ্রকণ্যা হেমাঙ্গিনীর দিকে।
তাইমুরের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল মুহুর্তেই। তিনি পিতার দৃষ্টিতে কোনো সহানুভূতি খুঁজে পেলেন না। তাতে দৃশ্যমান কেবল অটল জমিদারী শাসন।
তবুও তাইমুর প্রতিবাদ করতে উদ্যত হলেন।
- পিতা!
- নিবৃত্ত হও, তাইমুর!
সিকান্দারের কণ্ঠস্বর গম্ভীর হয়ে থামিয়ে দিল তাকে। তিনি বললেন,
- তোমার যৌবনের এই চাঞ্চল্য আমি বুঝি। বাঈজীর নৃত্য-গীত, তাদের রূপ-যৌবন, সবই রাত্রিকালীন বিনোদনের উপকরণ মাত্র। গজনবী বংশের পুরুষের সহিত তাদের সম্পর্ক ওই শয়নকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তা কখনও দিবালোকে রাজকীয় মহলে আসতে পারে না, তাইমুর।
সিকান্দার মসনদের হাতলে জোর আঘাত করে বললেন,
- তাদের কাজ কেবলমাত্র পুরুষকে তৃপ্তি দেওয়া। কিন্তু তোমার ঘরের বেগম সাহেবা হবেন এই এস্টেটের বংশ মর্যদার প্রতীক, আমাদের কুলীন রক্তের ধারক। সে হবে এই মহলের রানী। তাইমুর, তুমি কি ভুলে গেছো গজনবী এস্টেটের প্রথা কী?
তাইমুর জানে, এই প্রথা কতটা নির্মম। কিন্তু তার চোখে তখনও ভালোবাসার জোয়ার। সে জোয়ারে গা ভাসিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন,
- যদি সে প্রথা পরিবর্তন করা হয়, পিতা? হেমাঙ্গিনী একজন অসাধারণ শিল্পী। যদি সে তার নৃত্য ও গীত পরিহার করে আমার বেগম হয়ে এই মহলে পদার্পণ করে, তাতে ক্ষতি কী?
তাইমুরের ব্যাকুল কণ্ঠে আর্জি করলেন।
সিকান্দার গজনবী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পুত্রের লোপ পাওয়া বুদ্ধি তাকে আহত করল। তিনি হতাশ গলায় বললেন,
- এই গজনবী বংশের মর্যদার ক্ষতি হবে, পুত্র। ক্ষতি হবে আমাদের ক্ষমতার মূল ভিত্তির। তুমি কি ভেবেছো যে মহাজনরা আজ তোমার বিয়েতে এত উৎফুল্ল, তারা একজন বাঈজীকে তোমার বেগম রূপে বরণ করবে?
করবে না। তারা অবশ্যই বিদ্রোহ করবে! তাদের কন্যাদের বাদ দিয়ে তুমি যদি কুলভ্রষ্টা এক নর্তকীকে আসনে বসাও, তবে তারা আমাদের রাজস্ব বন্ধ করে দিবে। তাদের অর্থও আমাদের রাজকোষ পূর্ণ করে। তা যদি বন্ধ হয়ে যায় তবে নীলকররা সুযোগ পাবে না? তোমার পিতার এতদিনের পরিশ্রম, এই এস্টেটের একচ্ছত্র আধিপত্য, মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে না?
সিকান্দার এবার উঠে দাঁড়ালেন এবং পুত্রের সামনে এগিয়ে এলেন। তার দুচোখে আগ্নি বর্ষন হচ্ছে। তিনি কঠোরভাবে বললেন,
- আমি তোমাকে জমিদারি দায়িত্ব দিতে চলেছি, পুত্র! তুমি আমাদের ভাবী জমিদার। আর তুমি তার বিনিময়ে একটি নিষিদ্ধ স্বপ্ন দেখছ? তোমার পূর্বপুরুষেরা তাদের শাসন রক্ষা করতে কত রক্তপাত করেছেন, জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, আর তুমি কিনা একটি নর্তকীর জন্য সেই সবকিছু জলাঞ্জলি দিতে উদ্যত হয়েছ?
তিনি আরোও যোগ করলেন,
- হেমাঙ্গিনী আমার গজনবী মহলের বিনোদনের পাত্রী। তোমার অনুরাগ হয়তো মহৎ, কিন্তু সেটা এই বংশের জন্য এক অভিশাপ, তাইমুর। কাজেই, এই অভিশাপ তুমি তোমার হৃদয়ে পুষতে পারো না। একজন বাঈজীকে এই মহলের বেগম করে আনতে পারো না। তাইমুর, আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি। তুমি সেই কন্যাকেই বিবাহ করবে, যাকে আমি বেছে নেব। যে আমাদের বংশের প্রতিপত্তিকে আরও সুদৃঢ় করবে। তোমার ব্যক্তিগত সুখের জন্য এই এস্টেটের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করতে আমি কোনোভাবেই দেব না। এটাই আমার শেষ কথা। এই গল্পের পরের পর্ব লেখিকা ‘Atia Adiba – আতিয়া আদিবা’ এই পেইজে সন্ধ্যা ৬ টায় সবার আগে দেওয়া হবে।
তাইমুর তার পিতার সামনে মাথা নত করলেন। তিনি জানেন, পিতার এই নির্দেশের বাইরে যাওয়া মানে শুধু তার পিতার অসন্তোষ কামানো নয়, বরং গজনবী এস্টেটের ভবিষ্যৎকে গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। তিনি নীরবতা অবলম্বন করলেন। কারণ আপাতত তার একমাত্র লক্ষ্য হলো, ক্ষমতা হাতে নেওয়া। এরপর তিনি হয়তো তার নিজের নিয়তি নিজেই রচনা করতে পারবেন। তবুও নিজের পবিত্র প্রেমকে বলি দিতে তিনি প্রস্তুত নন।
তিনি সিকান্দারের অনুমতি নিয়ে নীরবে বৈঠকখানা ছেড়ে চলে গেলেন।
অন্যদিকে, সিকান্দার গজনবী পুনরায় মসনদে গিয়ে বসলেন। তিনি নিশ্চিন্ত মনে ভাবলেন, তার পুত্রকে সঠিক পথে চালিত করেছেন। আর এখন তার দ্বিতীয় চিন্তা হল, কোন মহাজন কিংবা ব্যবসায়ীর কন্যা হবে তার বংশের উপযুক্ত
‘বেগম সাহেবা’!
৪০০০ লাইক এবং ৬০০ কমেন্টস সম্পন্ন করবেন, প্রতিদিন গল্প আসবে।
উপন্যাসঃ #নিষিদ্ধ_রংমহল
লেখনীতে, Atia Adiba – আতিয়া আদিবা
Share On:
TAGS: আতিয়া আদিবা, নিষিদ্ধ রংমহল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১১
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১২
-
নিষিদ্ধ রংমহল গল্পের লিংক
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ২
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৩
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৭
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৬
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৯
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৭
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৮