Golpo romantic golpo নিষিদ্ধ রংমহল

নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১২


নিষিদ্ধ_রংমহল 🥀

পর্ব_১২

​যে আসনে শুধুমাত্র বিলকিস বানু দীর্ঘদিন রাজ করেছেন, সেই মসনদ দখল করে বসে আছে নতুন ক্ষমতাপ্রাপ্ত উস্তাদনী, সিমরান। সেদিন থেকে তার চোখে শুধুমাত্র অহংকারের শীতল ঔদ্ধত্যের দেখা মিলছে। তার ঠিক সামনে মেঝেতে, অপমানের ভারে নতমুখে বসে আছেন বিলকিস বানু। তার মুখের প্রতিটি রেখায় যেন জীবনের সমস্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে।

​সিমরান এক হাতে একটি রুপার পানপাত্র দোলাতে দোলাতে, বিলকিস বানুর দিকে তাকালো। কণ্ঠস্বরে বিরক্তি আর কর্তৃত্বের এক শীতল মিশ্রণ নিয়ে বলল,

​- কী হলো বিলকিস সাহেবা? এভাবে বসে আছেন কেন? একটু মাথা টিপে দিতে বললাম! এই যৎসামান্য সেবাটুকু করতে এত সময় নেবেন?

​বিলকিস বানু ধীরে ধীরে শ্বাস নিলেন। তার সারা জীবনের সম্মান, শিল্পের মর্যাদা সব যেন এই মুহূর্তে চূর্ণ করে দেওয়া হচ্ছে। তবুও তিনি নিজেকে শান্ত রাখার শেষ চেষ্টা করলেন। স্থির কণ্ঠে বললেন,

​- উস্তাদনী, এত বছর আমার পায়ে কেবলমাত্র নুপূর আর হাতে বেজেছে তানপুরা। দাসীর কাজ করার অভ্যাস আমার নেই। আপনি এই বাঈজী মহলের রাণী। আপনার সেবার জন্য তো দাস-দাসীর অভাব নেই। আমি…

কথার সমাপ্তি ঘটানো হল না বিলকিস বানুর। তার আগেই ​সিমরান খিলখিল করে হেসে উঠল। সে হাসি ভর্তি উপহাস আর তাচ্ছিল্য।

​- আহা! বিলকিস সাহেবা, এই মহলে কে দাসী আর কে উস্তাদনী, সে হিসেবটা না হয় আমাকে কষতে দিন? শুনুন, এ মহলের দাসীরা অতি অল্পবয়স্কা। তারা আপনার মতো অভিজ্ঞ নয়। আপনি দীর্ঘ জীবন পার করা একজন মানুষ। আপনি যখন আমার সামান্য সেবা করবেন, তার মূল্যটাই হবে আলাদা! তাছাড়া মহলের উস্তাদনীর সেবার সুযোগ পাওয়াও তো সৌভাগ্যের বিষয়।

সিমরান ​পানপাত্রটি বিলকিস বানুর দিকে এগিয়ে দিল। বলল,

  • নিন, আগে এই পাত্রটি সরিয়ে ওই টেবিলের ওপর রাখুন। তারপর আমার মাথা টিপে দিন। সন্ধ্যা থেকে মহলে ঘুঙুরের শব্দ বাজছে। এছাড়াও সব সামলে ভীষণ মাথা ধরেছে আমার। আপনার প্রবীণ হাতে তেল মালিশ পেলে মাথাব্যথা কিছুটা লাঘব হবে। আরাম লাগবে। জলদি করুন!

​বিলকিস বানুর চোখ রাগে জ্বলে উঠল। বয়স কত হবে সিমরানের? চব্বিশ কিংবা পঁচিশ? তার বয়সের তুলনায় সে নিতান্তই ছোট। অথচ সে কিনা সরাসরি তার সম্মানে আঘাত হানছে! তবুও এই মুহূর্তে তার কথা অমান্য করার কোনো উপায় নেই।

বিলকিস ধীরে ধীরে পানপাত্রটি হাতে নিলেন। সরিয়ে টেবিলের একপাশে রাখলেন। ক্ষণিককাল সময় নিলেন, এরপর সিমরানের মাথার কাছে গিয়ে বসলেন। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু সেই কম্পন তিনি দমন করলেন।

​সিমরান চোখ বন্ধ করে আরামের ভান করল।

  • দারুন আরাম লাগছে, বিলকিস সাহেবা! যদিও মনে হচ্ছে আপনি আমার ওপর কিছুটা রাগণ্বিত। তবে সমস্যা নেই। আপনার রাগ আর ক্ষোভের উত্তাপটা আমার মাথার রগে রগে প্রবেশ করুক। সেই উত্তাপ আমাকে মনে করিয়ে দেবে আমার বর্তমান অবস্থান। ক’দিন আগে আমি কোথায় ছিলাম আর এখন কোথায় এসে পৌঁছেছি!

​বিলকিস বানু সিমরানের করা সমস্ত অপমান নীরবে হজম করলেন। টু শব্দটি পর্যন্ত করলেন না। তবে তার মস্তিষ্ক নীরব রইল না। প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ সেথায় জ্বলতে শুরু করেছে।

​খানিকক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর সিমরান সহসা চোখ মেলল। তার কণ্ঠস্বর মুহূর্তেই শীতল এবং কঠিন হয়ে উঠল।

​- শুনুন বিলকিস সাহেবা, আপনাকে আমার কিছু কথা বলার আছে। অতি জরুরি কথা।

​বিলকিস বানুর হাত থেমে গেল। তিনি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সিমরানের দিকে তাকালেন।

​- আপনার আঙ্গুলের জাদুটা মাহফিলে নয় বরং আমার মাথাতেই এখন থেকে বেশি প্রয়োজন হবে। তাই আজ থেকে, এই মহলের কোনো মাহফিলে বা জলসায় আপনার এবং আপনার প্রাণপ্রিয় শিষ্যা হেমাঙ্গিনীর আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

সিমরান কণ্ঠে পাথরের মতো কঠোরতা মিশিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে ঘোষণাটি করল।

​- আপনি এসব কী বলছেন?

বিলকিস বানু বিস্ময় ও ক্রোধে আসন ছেড়ে প্রায় উঠে দাঁড়ালেন।

  • ভুলে যাবেন না উস্তাদনী, এই বাঈজী মহলের অর্ধেক রীতিনীতি, অর্ধেক ইতিহাস আমার শিল্পে গাঁথা! আর হেমাঙ্গিনী, তার তো সবেমাত্র অভিষেক ঘটেছে। তার যাত্রা কেবল শুরু হল। তাকে কিভাবে….

​সিমরান তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল তীব্র ব্যঙ্গাত্মক হাসিতে।

  • থামুন, থামুন! আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন এই মহলের নতুন উস্তাদনী আমি। আমার উচ্চারিত প্রতিটি কথাই শেষ কথা। আর হ্যাঁ, হেমাঙ্গিনীর কথা বলছিলেন তাই না? কী এমন আহামরি বাঈজী সে? তার মাঝে তো কোনো ভিন্নতা নেই!নৃত্যে কোনো আবেগ নেই। সেই কৌশল নেই যা এই মহলের পৃষ্ঠপোষকদের মুগ্ধ করতে পারে। তার শিল্প বড়ই একঘেয়ে, বিলকিস বানু। ঠিক আপনার মত।

​সিমরান সামান্য ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

  • সত্যি বলতে, হেমাঙ্গিনীকে দেখে মনে হয় না, সে আমার জটিল নৃত্যশৈলী বা সূক্ষ্ম কৌশলগুলো রপ্ত করতে পারবে। আপনাদের সেই পুরনো দিনের ধীরগতির, সাদামাটা নাচের দিন এখন শেষ, বিলকিস সাহেবা। এখন দ্রুততা, নতুনত্ব আর শরীরী ভাষা চাই! আপনাদের দুজনকে আর আমার প্রয়োজন নেই। যান, বিশ্রাম করুন। অবসর নিন। চিরদিনের জন্য। মাঝেমধ্যে আমার সেবাযত্ন করবেন এতটুকুই। আপনাদের দুজনের জন্যই আমার দরবার বন্ধ।

দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ সমস্ত অপমান নীরবে গায়ে মাখছিল, হেমাঙ্গিনী। নিজেকে সামলে রেখেছিল অতি কষ্টে। এবার নিজেকে সংযত রাখতে ব্যর্থ হল সে। তড়িৎ গতিতে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। তার চোখজোড়া সরাসরি নিবদ্ধ হল সিমরানের ওপর।

  • আপনার কথাগুলো শেষ হয়েছে, উস্তাদনী সিমরান? নাকি আরও কিছু বাকি আছে, যা আমাকে শুনতে হবে?

রাগে ফুঁসে উঠল হেমাঙ্গিনী। ​সিমরান প্রত্যুত্তরে হাসল। সে হাসিতে কোনো আতিথেয়তা ছিল না, ছিল কেবল শ্লেষ।

  • হেমাঙ্গিনী! আপনার আগমনের সময়ে একেবারে নিখুঁত। আমি তো সদ্য আপনার বিদায়-বার্তাটিই পরিবেশন করলাম। তবে আপনার উচিত হয় নি দরজার আড়ালে আড়ি পেতে কথা শোনা। শুনেছি, শিল্পীরা নাকি চোরের মতো কাজ করেন না! তবে আপনার মাঝে এমন আচরণ কেন? উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন নাকি?

হেমাঙ্গিনীও ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হাসল। সেও একই সুরে বলল,

​- শিল্পীরা ছলনা করেন না। প্রশ্ন থেকেই যায়, আপনি এ কাজে এত পারদর্শী হলেন কিভাবে?

সিমরান এবার ফোঁস করে উঠল। কঠিন গলায় জানতে চাইল,

  • কি বলতে চাইছেন আপনি? আমি ছলনাময়ী?

হেমাঙ্গিনী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই​বিলকিস বানু দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিলেন। তার গলায় ফিরে এলো প্রবীণ গুরুর তেজ।

  • উস্তাদনী, আপনি ভুল ভাবছেন। হেমাঙ্গিনীকে আপনি কম প্রতিভাবান বলছেন? আপনি নিজেও জানেন এ মিথ্যা। হেমাঙ্গিনী এই মহলের সবচেয়ে তুখোড় শিল্পী। তার নাচ এবং গানে যে গভীরতা মিশে আছে, যে আবেগ আছে, তা চিরস্থায়ী। আপনি হেমাঙ্গিনীকে সরাতে চাইছেন কারণ আপনি ভয় পেয়েছেন।
  • আমি ভয় পেয়েছি? আমি?
    বিস্ময়ে ফেটে পড়ল সিমরান।

বিলকিস বানু দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিলেন,

  • জ্বি। ভয় পেয়েছেন। কারণ আপনি জানেন, আজ হোক বা কাল, মাহফিলের অতিথিরা হেমাঙ্গিনীর শিল্পকেই বেশি ভালোবাসবে। কদর করবে। আপনি নিজের দল নিয়ে এ মহলে টিকে থাকার জন্য হেমাঙ্গিনীকে তাড়াতে চাইছেন।

​কক্ষটিতে পিনপতন নীরবতা নেমে এল। প্রথমাবস্থায়, সিমরানের মুখ রাগে লালবর্ণ ধারন করল। কিন্তু দ্রুত সে নিজেকে সামলে নিল। তার মুখের সেই রাগ রূপান্তরিত হলো এক ভয়ংকর, তীক্ষ্ণ উপহাসে। ভয়াবহ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সিমরান।

ক্ষণিককাল পর ​হাসি থামিয়ে, সিমরান বিলকিসের চোখে চোখ রাখল। শুধালো,

  • তাই নাকি? ভয়? আর আমি? হা-হা-হা! বিলকিস বানু, তোমার এই দুর্বল নির্নয় শুনে হাসি পেল। আমি ভয় পেলে এমন সরাসরি বিতাড়নের ঘোষণা দিতাম না।

​সিমরান তার আসন থেকে বজ্র গতিতে উঠে দাঁড়াল। সামান্য এগিয়ে এসে হেমাঙ্গিনী ও বিলকিস বানুর ঠিক মাঝখানে থামল।
তার চোখে এখন স্পষ্ট সংপ্রশ্ন।

​- বেশ! যদি এটাই আপনাদের ধারণা হয়, আপনারা যদি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে তোমাদের শিল্পই সেরা। তবে একটা দ্বন্দ হয়ে যাক? একটা প্রতিযোগিতা হোক! শিল্পে আর কলার বিচার হোক।

​হেমাঙ্গিনী ভ্রুঁ কুঁচকালো। আগ্রহ লুকিয়ে জানতে চাইল,

  • কীসের প্রতিযোগিতা?

​- আগামী বৃহস্পতিবার রাতে, গজনবী মাহফিলে!

সিমরান ঘোষণা করল।

  • যেহেতু স্বয়ং জমিদার, তার পুত্র এবং অন্যান্য সম্ভ্রান্ত অতিথিরা উপস্থিত থাকবেন। তাদের সামনেই হবে বিচার।

​সিমরান হাত দুটি প্রসারিত করল। নাটকীয় ভঙ্গি করে বলল,

  • একদিকে থাকব আমি আর আমার দল। আর অন্যদিকে থাকবেন আপনি আর বিলকিস বানু। দেখা যাক! অতিথিরা কাদের পরিবেশনায় বেশি মুগ্ধ হোন। তাদের মুগ্ধতা বিচার করবে এই প্রতিযোগিতার ফলাফল। আর যদি আপনারা জিতেন…

​বিলকিস বানুর কপালে ভাজ পড়ল। তিনি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন,

  • তবে? কি হবে?

​সিমরান চোখের পলক না ফেলে জবাব দিল,

  • তবে আমি স্বেচ্ছায় এই উস্তাদনীর পদ, এই মহলের চাবি আপনাকে ফিরিয়ে দেব! আপনার কর্তৃত্ব আপনি পুনরায় হাসিল করবেন। আমি স্বেচ্ছায় নিজেকে এক কোণে সরিয়ে নেব। আপনাদের শিল্পের মহত্ত্বের সামনে আমার হার স্বীকার করব।

​সিমরানের কণ্ঠস্বর এবার সামান্য খাদে নেমে গেল। সে বলল,

  • কিন্তু যদি আমি জিতি..

​সে ঝুঁকে হেমাঙ্গিনীর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল।

  • তবে এই মহল থেকে আপনাদের স্বেচ্ছায় চলে যেতে হবে। আপনাদের শিল্প, আপনাদের নাম সব আমি চিরতরে মুছে দেব!

​হেমাঙ্গিনী এক মুহূর্তও না ভেবে মাথা উঁচু করে বলল,

  • আপনার এই দ্বৈরথ আমরা গ্রহণ করছি, উস্তাদনী। আপনি আপনার দল নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন।

​সিমরান বিজয়ের হাসি হেসে ফিরে গেলেন তার আসনে। বললেন,

  • সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার রাতে নেওয়া যাবে, হেমাঙ্গিনী। আপনারা আপাতত নিজেদের একঘেয়ে শিল্পচর্চা শুরু করুন? হাতে মাত্র তিন রাত সময় রয়েছে।

​হেমাঙ্গিনী ও বিলকিস বানু একে অপরের দিকে তাকালেন। তাদের চোখমুখে ফুটে উঠেছে এক যুদ্ধের অঙ্গীকার। অপমানের বদলা নেবার ভার কাধে নিয়ে দুজন-ই প্রস্তুত হলো এক চূড়ান্ত সংঘাতের জন্য।

★★★ ★★★ ★★★

জমিদার সিকান্দার গজনভীর নহবতখানা সংলগ্ন বারোয়ারি বৈঠকখানা তখন এক রাজকীয় ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল করছিল। প্রকোষ্ঠের প্রতিটি কোণে যেন গজনবী বংশের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আর অবিচল ক্ষমতার প্রতিধ্বনি। মার্বেলে মোড়া মেঝে, পারস্য দেশীয় কার্পেট এবং সুউচ্চ ছাদ থেকে ঝোলানো ক্রিস্টালের ঝাড়লণ্ঠনগুলো দুপুরের কড়া রোদকেও বশীভূত করে রেখেছিল। সৃষ্টি করছিল আভিজাত্যপূর্ণ আলো।

মসনদে আসীন জমিদার সিকান্দার গজনবী। আজ তার পরনে দামি মসলিন। চোখে মুখে কঠোরতা বিরাজমান। তার ঠিক ডান পাশে বসে আছে তাইমুর

​আজকের এই সাক্ষাতের গুরুত্ব বুঝতে পেরেই নীলকুঠির প্রধান প্রতিনিধি মিস্টার রবিনসন এবং তার চতুর বাঙালি সহকারী রামকমল রায় এসেছেন। রবিনসনের দীর্ঘ, অনমনীয় ককেশীয় গড়ন এবং তাঁর তীক্ষ্ণ নীল চোখের শীতল ঔদ্ধত্য যেন প্রকাশ করতে চাইছিল তার ক্ষমতা।

তিনি নিজেকে এই অঞ্চলের প্রকৃত ক্ষমতাধর হিসেবে দেখেন। রামকমল রায়, বাঙালি হলেও প্রভুর প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল দেখার মতন।

​সিকান্দার সৌজন্যমূলকভাবে রুপোর পাত্রে শীতল শরবত পরিবেশন করলেন। যদিও রবিনসন তাতে মনোযোগ দিলেন না। তার হাতে ছিল চামড়ায় মোড়া একটি মানচিত্র।

​রবিনসন ইংরেজিতে শুরু করলেন,

  • মিস্টার গজনবী, আমরা আপনাকে স্বাগত জানাই। আমাদের আগমন সম্পূর্ণভাবে বাণিজ্যিক এবং উন্নয়নের উদ্দেশ্যে। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, ১৮৪০ সালের পর নীলচাষ এখন বাংলা এবং বিহারের অর্থনীতির অক্ষদণ্ড। গঙ্গা অববাহিকার উর্বর ভূমিতে আমাদের বিনিয়োগের ফলে গোটা অঞ্চলের উন্নতি হচ্ছে।

​দেওয়ান রামকমল মৃদু স্বরে যোগ করলেন,

  • হুজুর, ইংরেজ সাহেব বলতে চাইছেন যে, আপনার এস্টেটের চারপাশের প্রতিটি তালুক এবং মহাল এ নীল বোনা শুরু হয়ে গেছে। পাবনা, নদীয়া, যশোহর যেদিকেই চোখ মেলবেন সর্বত্রই নীলকরদের কুঠি স্থাপিত।

‘মানচিত্রট দেখুন, মিস্টার গজনবী’ –
রবিনসন মানচিত্রটি মেলে ধরলেন।

  • আপনার গজনবী এস্টেটটি যেন এক বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড। আমরা চাই, এই বিচ্ছিন্নতা দূর হোক। আমাদের বিশ্বাস এই অংশীদারিত্ব আপনার দরবারের জৌলুস এবং প্রভাব বহুগুণ বাড়াবে।

​রাজস্বের প্রশ্ন এবং অধিকারের দ্বন্দ্ব জাগ্রত হল সিকান্দারের মনে। তিনি ধীরে ধীরে পানপাত্রটি টেবিলের ওপর রাখলেন। সেই মৃদু শব্দ যেন কক্ষের নীরবতাকে আরও ভারী করে তুলল মুহুর্তেই। কণ্ঠে দৃঢ়তা রেখে সিকান্দার বললেন,

  • জনাব, নজরানা কিংবা দাদনের লোভ এই গজনবী বংশকে প্রলুব্ধ করতে পারে নি কোনোদিন। আমার জৌলুস এবং আমার রাজকোষের স্থায়িত্ব পুরোপুরিভাবে নির্ভর করে আমার প্রজার খাদ্যশস্যের প্রাচুর্য এর ওপর। বলুন তো, আমার প্রজা যদি দুবেলা খেতে না পায়, তবে তারা আমার খাজনা পরিশোধ করবে কী দিয়ে?

​তাইমুরও চুপ করে বসে রইলেন না। তারুণ্যের তীব্রতা এবং স্পষ্টবাদীতা মিশিয়ে নিজের বক্তব্য রাখলেন,

​- পিতা, ঠিক বলেছেন। মিস্টার রবিনসন, আমাদের এস্টেটের রাজস্ব নির্দিষ্ট সময়ে, পূর্ণাঙ্গ রূপে আদায় হয়। এ বিষয় নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়? এর একমাত্র কারণ হলো আমাদের প্রজা কৃষকেরা তাদের জমিতে ধান, গম ও অন্যান্য শস্য ফলাতে পারে।

বাংলার জমিদারী প্রথার মূল ভিত্তিই হলো এই রাজস্ব ব্যবস্থা। নীলচাষ শুরু হলে, কৃষকেরা তাদের খাদ্যশস্যের জমিতে নীল ফলাতে বাধ্য হবে। ফলস্বরূপ খাদ্যসংকট তৈরি হবে। তারা খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হবে। এই ব্যবস্থা কি আমাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল নয়?

​রবিনসন তাইমুরের এই সরাসরি হস্তক্ষেপে সামান্য বিরক্ত হলেন। তাকে কম বয়সী এবং অভিজ্ঞতাহীন মনে করলেন। বিষয়টি তার কথার মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

  • আপনি ব্যবসার জটিলতা বুঝতে পারছেন না। আমরা অবশ্যই তাদের অতিরিক্ত অর্থ দেব। তাছাড়া নীলচাষ খাদ্যশস্যের চেয়েও ঢের বেশি লাভজনক। আপনি কেন তুচ্ছ রাজস্ব নিয়ে এত চিন্তিত?

​তাইমুর হাসলেন। কিন্তু সেই হাসি ছিল তীব্র ব্যঙ্গাত্মক।

​- তুচ্ছ রাজস্ব? মিস্টার রবিনসন, আমার বাবার জৌলুস এই রাজস্বের উপর নির্ভরশীল। আর আপনাদের সেই ‘অতিরিক্ত অর্থ’ হল দাদনের ফাঁদ! আপনারা দাদন দেন, কিন্তু উচ্চ হারে সুদ বসান। একবার নীলচাষ শুরু হলে সেই কৃষক বংশানুক্রমে আপনাদের দাসে পরিণত হয়। এ বিষয়ে আমি জ্ঞাত। আপনারা তাদের খাদ্যশস্যের জমিতে জোর করে নীল চাষ করান। যেহেতু অতি শীঘ্রই এই এস্টেটের দায়িত্ব আমার নিতে হবে, কাজেই উক্ত জুলুমের পথ আমি উন্মুক্ত করতে পারি না।
৪০০০ লাইক এবং ৫০০ কমেন্ট সম্পন্ন করবেন। নাহয় ধরে নিব গল্প সবার কাছে পৌঁছায় নি এবং পরের পর্ব দেরি করে আসবে। কাজেই অনুগ্রহ করে এক্টিভ হবে কমেন্টে।

উপন্যাসঃ #নিষিদ্ধ_রংমহল
লেখনীতে, Atia Adiba – আতিয়া আদিবা

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply