নিষিদ্ধ রংমহল
পর্ব ১ লেখনীতে, #আতিয়াআদিবা
গভীর রাতে জন্মদাত্রী মা কে পোশাকবিহীন, অর্ধনগ্ন অবস্থায় জমিদারের শয়নকক্ষ হতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখেছিলাম। তার পিছু একই গতিতে ছুটে আসছিল দুজন প্রহরী। মনের ভেতর অজানা ভয় জেঁকে বসেছিল সেদিন। মা কেন হন্যে হয়ে পালাতে চাইছেন? প্রহরী দুজনও কেন মায়ের দিকে হুংকার ছুঁড়ে দিচ্ছিল?
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হয়ে গেছে কিন্তু এর উত্তর আজও মেলে নি। আর দৃষ্টিগোচর হয় নি মায়ের সেই মমতাময়ী চাঁদ মুখখানাও। জমিদারবাড়ি থেকে জলজ্যান্ত একজন নারী উধাও হয়ে গেল। কেউ তার হদিস দিতে পারল না!
আজ জমিদারের শয়নকক্ষে আমার প্রবেশের অনুমতি অর্পণ করা হয়েছে।
আমি হেমাঙ্গিনী। বয়স মাত্র পনেরো। আমার সদ্য প্রস্ফুটিত দেহ কদিন আগেই জানান দিয়েছে বয়ঃসন্ধিকালের। সামান্য স্ফীত বুকও নজর কেড়েছে জমিদার নবাব সিকান্দার গজনবীর।
আজ রাতের মাহফিলে তিনি আমার নৃত্য দেখবেন। গীত শুনবেন। এরপর সাথে করে নিয়ে যাবেন তার শয়নকক্ষে। তিনি হবেন আমার প্রথম পুরুষ যে দেহের প্রতিটি অঙ্গ ছুঁয়ে দেখবেন। গন্ধ শুকবেন আমার কুমারিত্বের। আর আমি হব তার মাহফিলের সর্বকনিষ্ঠ বাঈজী এবং তার দাসী।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সুসজ্জিত করছি। আজ আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারীদের মাঝে একজন হিসেবে গড়ে নিতে হবে।
শুধুমাত্র দামী পোশাক আর ভারী গহনা পরলে হবে না। চোখে লাগাতে হবে কুচকুচে কালো কাজল। হরিণী চোখের প্রতিটি পলকে যেন ঠিকরে পড়ে আবেদনময়ী ভাব। লাল ওষ্ঠজোড়া দেখামাত্র যেন জমিদারের বুকে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তিনি যেন ডুবে যান কাম/লা/লসার প্রবল স্রোতে।
আজ মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। সেও আমার সামনে বসে ঠিক একইভাবে সাজত। মাহফিলের রাণী ছিলেন তিনি।
সেসময় মাহফিলে আমার প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। তবে মা যেদিন গীত, নৃত্য পরিবেশন করতেন, প্রহরীরাও প্রশংসায় বুক ভাসাতেন।
তিনি ছিলেন জমিদার সিকান্দার গজনবীর একজন খাস বাঈজি।
আজ মাহফিলে জমিদারের বড় পুত্র প্রথমবারের মত আসবেন। সে জমিদারি প্রথা গ্রহণ করার জন্য এখন উপযুক্ত। আগামী কয়েকদিনের মাঝেই নবাব সিকান্দার গজনবী তার দায়িত্ব বড় পুত্রের ওপর অর্পণ করবেন। ~
- কিরে হেমা, আভি ভি তাইয়ার নেহি হুয়া তু? হুজুর চলে আসার সময় হয়ে গেলো যে! আর কত ওয়াক্ত লাগবে?
হেমাঙ্গিনীর লিখার মাঝে ব্যাঘাত ঘটল।
জমিদারবাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ বাঈজী বিলকিস বানুর পদার্পণ হল তার কক্ষে। হেমাঙ্গিনী চটজলদি পুরনো ডায়রিটা বন্ধ করে ফেলল। দোয়াতে দ্রুত ময়ূরের পেখম দিয়ে তৈরি সুসজ্জিত কলমটি রেখে দিল।
বিলকিসের নিকট হতেই পঞ্চাদশী কণ্যা রপ্ত করেছে নৃত্যের সকল কলাকৌশল। বাকিরা উস্তাদনী বলে সম্বোধন করলেও, সম্পর্কের গভীরতার খাতিরে হেমাঙ্গিনী তাকে খালা বলে ডাকে। সে গালে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলল,
- আমি প্রায় তৈরি। শুধুমাত্র ডান পায়ে আলতা পরা বাকি, খালা।
বিলকিস হাসিমুখে এগিয়ে এলেন হেমাঙ্গিনীর পানে। বললেন,
- দে আমি পরিয়ে দেই।
হেমাঙ্গিনী ইতস্তত করে বলল,
- আমি পরে নিতে পারব, খালা। তোমার পরিয়ে দিতে হবে না।
- চুপ। বিলকুল চুপ। এত বাত যে কেন করিস তুই! দে পা এগিয়ে দে।
হেমাঙ্গিনী মুচকি হেসে পা এগিয়ে দিল। মনযোগ দিয়ে আলতা পরিয়ে দিতে দিতে বিলকিস বললেন,
- এই যে তুই চুপি চুপি ডায়রি লিখিস, এটা যদি জমিদার জানতে পারে তোর হাতজোড়া কেটে দিবে পাতা হে না তুঝে? এই তল্লাটে জমিদারের পরিবার ছাড়া আর কারো লেখাপড়া জানার অধিকার নেই।
হেমাঙ্গিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
- জানি, খালা। কিন্তু কি করব বল? লিখতে যে আমার ভীষণ ভালো লাগে!
বিলকিস পায়ে আলতা পরানো শেষ করে হেমাঙ্গিনীকে নিজের বুকে টেনে নিলেন। বললেন,
- দেখ বেটি! তোকে আমি আমার শিষ্য কম নিজের মেয়ে সামঝা বেশি। এসব লিখালিখি বাদ দে। জমিদারের খাস একবার হবি তো জিন্দেগী বান জায়ে গা। সামাঝ মে আয়া কুচ?
‘হুঁ’ – হেমাঙ্গিনী ছোট্ট করে আরোও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সহসা বিলকিস আঁৎকে উঠলেন। বললেন,
- এটা কি করেছিস রে? বুকের কাপড় এত ওপরে হলে চলে?
বিলকিস টান দিয়ে হেমাঙ্গিনীর ব্লাউজ নিচে নামিয়ে দিল। অর্ধেক বুক উন্মুক্ত হয়ে গেল হেমাঙ্গিনীর। সেদিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থেকে বিলকিস বললেন,
- ইয়ে হুই না বাত! কি যে সুন্দর লাগছে তোকে! একদম জান্নাতের হুর।
হেমাঙ্গিনী গালে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রাখল। মুখে কোনো কথা বলল না। তার নিজেকে শুধুমাত্র একটি ভোগের বস্তু বলে মনে হচ্ছে। এত সাজগোজ, চেহারায় আবেদনময়ী ভাব, শরীরের বিশেষ অঙ্গ প্রদর্শন – সব শুধুমাত্র জমিদারের মনরঞ্জনের জন্য। কিন্তু কেন? সে নারী হয়ে জন্মেছে তাই? নারী হয়ে জন্মানো কি অপরাধ?
- আজ ছোটে হুজুরও আসবে। পাতা হে না?
- শুনলাম। তার কাছে জামিদারি দায়িত্ব অর্পণ করবেন বড় হুজুর।
- ও তো হে! বড় হুজুরের বয়স হয়েছে। তুই তো সৌভাগ্যবতী রে, হেমা। বড় হুজুরের সেবা করার মকা মিলছে।
হেমাঙ্গিনী তাচ্ছিল্যভরে হাসল। বলল,
- নিজের যৌব/নভ/রা দেহ একজন বুড়োর হাতে তুলে দিতে হবে আর আমি সৌভাগ্যবতী?
হেমাঙ্গিনীর কথা শুনে বিলকিসের চক্ষু চড়কগাছ। তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হেমাঙ্গিনীর মুখ চেপে ধরলেন। বললেন,
- ক্যায়া বল রাহা হে এইসব? কেউ শুনলে জানে মেরে ফেলবে?
হেমাঙ্গিনী নিজেকে ছাড়িয়ে নিল বিলকিসের কাছ থেকে। বুক ভরে শ্বাস নিল। করুন চোখে তাকিয়ে বিলকিস বলল,
- এসব কথা আর কোনোদিনও বলবি না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি মাহফিলে আয়। ঠিক হ্যাঁ?
হেমাঙ্গিনী মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল।
জমিদার নবাব সিকান্দার গজনবীর বাড়ির রাতের মূল আকর্ষণ এবং ঐশ্বর্যের কেন্দ্রবিন্দু এই মাহফিল। জলসাঘরের জৌলুস সৌন্দর্যে অতিথিরা বরাবরই মুগ্ধ হোন।
এঘরের চতুর্দিকে যেন কৃত্রিম জ্যোৎস্নার রাজত্ব চলে গোটা রাত। বিশাল হলঘরের সিলিং থেকে একটি প্রকাণ্ড ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি ঝুলছে। তা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে প্রায় শ-খানিক মোমবাতির উজ্জ্বল লেলিহান শিখা।
ঘরের দুইপাশের দেয়ালে লাগানো সারি সারি লণ্ঠন। কারুকাজ খচিত বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নাগুলি থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে লন্ঠনের আলো। মেঝেতে পাতা আছে পারস্যদেশীয় দামী মখমলের কার্পেট।
একদম সোজা এগোলে হলঘরের শেষ মাথায় জমিদারের জন্য পাতা আছে বিশাল আরামদায়ক পালঙ্ক।
চারিদিকে অতিথিদের জন্য দামি গদি। প্রতিটি কোণা থেকে সুগন্ধি ধূপদানিতে বিদ্যমান চন্দন ও আতরের মৃদু সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে হলঘরে।
দেয়ালে রাজকীয় ভঙ্গিতে জায়গা করে নেওয়া জমিদার ও তাঁর পূর্বপুরুষদের বিশাল তৈলচিত্রগুলি যেন নীরবে এই গোপন আসরের সাক্ষী হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ঘরের এক কোণে তবলা এবং সেতার নিয়ে প্রস্তুত বাদকেরা। মাঝখানে উঁচু মঞ্চের মতো স্থান রয়েছে। সেখানেই আজ নৃত্য পরিবেশন করবে হেমাঙ্গিনী। এই মাহফিলের মূল আকর্ষণ আজ সে।
হেমাঙ্গিনী জলসাঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে উপস্থিত সকলে চমকে উঠল। তার রূপের আগুনে যেন দ্বিগুণ দীপ্তিময় হয়ে উঠল গোটা হলঘর। সকলের চোখ কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগল হেমাঙ্গিনীর মখমলের মত নবমুকুলিত দেহ।
অতিথি হিসেবে আসন গ্রহণ করা ইংরেজ প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও সন্তপর্ণে জিভ দিয়ে নিজেদের ওষ্ঠজোড়া ভিজিয়ে নিল। হেমাঙ্গিনীর শরীরের প্রতিটি ভাজ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকন করে ঢোক গিলল নিঃশব্দে। সে যেনো সুস্বাদু কোনো খাদ্যবস্তু!
হেমাঙ্গিনী আসন গ্রহণ করার সাথে সাথে হলঘরের দরজার সামনে একজন পাইক এসে দাঁড়ালেন। তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা দিলেন,
- হুঁশিয়ার! সিকান্দার গজনবী হুঁজুর তাশরিফ লাঁয়ে।
ঘোষণার সাথে সাথে গোটা হলঘর নীরব হয়ে গেল। উপস্থিত সকলের নিঃশ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শ্রবণগোচর হল না।
সকলে উঠে দাঁড়ালেন। শুধুমাত্র বিশেষ অতিথিরা নিজেদের আসনে ঠায় বসে রইলেন।
জমিদারের ব্যক্তিগত পাইকরা হলঘরের দুইপাশে সামরিক ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। রাজকীয় ভঙ্গিতে প্রবেশ করলেন জমিদার নবাব সিকান্দার গজনবী। তার প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে তাল মিলিয়ে প্রবেশ করলেন জমিদারের বড় পুত্র নবাব তাইমুর গজনবী।
সকলের দৃষ্টি নিবন্ধিত হল তাদের রাজকীয় পদধূলিতে।
পরবর্তী পর্ব কমেন্ট সেকশনে দেওয়া আছে। খুঁজে না পেলে কমেন্ট করুন আমি দিয়ে দিব দ্বিতীয় পর্ব কমেন্টের রিপ্লাই এ।
(চলবে…)
উপন্যাস: #নিষিদ্ধরংমহল পর্ব ১ লেখনীতে, #আতিয়াআদিবা
Share On:
TAGS: আতিয়া আদিবা, নিষিদ্ধ রংমহল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নিষিদ্ধ রংমহল গল্পের লিংক
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৩
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৯
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১০
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৫
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৩
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১৬
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৪
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ৭
-
নিষিদ্ধ রংমহল পর্ব ১১