নির্লজ্জ_ভালোবাসা
লেখিকাসুমিচোধুরী
পর্ব ৪৯ (❌কপি করা নিষিদ্ধ❌)
রৌদ্র, তুরা, আয়ান এবং তিথি তাদের বিয়ে পড়ানো অবশেষে শেষ হলো কাজী সাহেব হাত তুলে মোনাজাত ধরলেন। ড্রয়িংরুম জুড়ে এক পবিত্র নীরবতা। সবাই চোখ বন্ধ করে নবদম্পতিদের সুখের জন্য দোয়া করছে। কিন্তু শিহাবের অবস্থা অন্যরকম। সে মোনাজাতে হাত তুললেও তার চোখজোড়া স্থির হয়ে আছে তুরার দিকে।তুরার মাথার লাল পাতলা ঘোমটার আড়াল দিয়ে তার স্নিগ্ধ মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছে। শিহাব একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বলতে লাগল।
“আজ তুমি অন্য কারও, আলো হয়ে অন্য ঘরে, তবুও জানিও, এই মনটা তোমারই নাম ধরে। তোমার চোখের ওই কাজল-রেখা, আমার স্বপ্নে আঁকা ছিল, আজ সেই স্বপ্নে অন্য রঙ, সে রঙ তোমায় রাঙিয়ে দিল। বিয়ে তো শুধু সাতপাকে নয়, বিয়ে তো হয় দুটো মনে। আমার মনের শূন্য খাঁচা, তবুও বাঁচে তোমার সনে। তুমি চেয়েছো যাকে, সে যেন হয় তোমার সুখের কারণ।”
শিহাব আরও একটু আবেগপ্রবণ হয়ে মনে মনে বলতে লাগল।
“আমার ভালোবাসা আজ নীরব, শুধু তোমার জন্য সম্পূর্ণ। চলে গেলে দূরে, তুমি নিলে নতুন ঠিকানার খোঁজ, আমার হৃদয়ে স্মৃতিরা থাক, গুনবে রাতের প্রহর রোজ। আমি দেখব শুধু দূর থেকে, হাসছো তুমি কত সুখে, আমার কষ্ট চাপা থাক, না আসুক তোমার মুখে। জেনে রেখো, কিছু প্রেম থাকে শুধু দেওয়ারই মানে, ভালোবাসার পথ ধরে চলে, হিসেব রাখে না কোনো গানে। তুমি শুধু ভালো থেকো প্রিয়, এটাই আমার প্রার্থনা, আমার চোখে জল এলেও তোমার মুখে থাকুক হাসির সোনা।”
কথাগুলো বলেই শিহাব এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, যেন ওই একটি প্রশ্বাসের সাথে সে বুকের ভেতর জমা হওয়া সমস্ত আর্তনাদ আর না-বলা কথাগুলো বাতাসের সাথে মিশিয়ে দিল। মোনাজাত শেষ হতেই বাড়ির পরিবেশ আবেগঘন হয়ে উঠল। রৌদ্র, তুরা, আয়ান এবং তিথি একে একে বড়দের সালাম করে দোয়া নিতে শুরু করল।
আশিক খান এগিয়ে এসে অত্যন্ত যত্ন করে তুরার হাতটা রৌদ্রের হাতের ওপর রাখলেন। তার কণ্ঠস্বর তখন কান্নায় বুজে আসছিল। তিনি রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন।
“রৌদ্র, তুই আমার নিজের ভাতিজা, খুব কাছের রক্তের মানুষ। আমি জানি তুই আমার কলিজার টুকরো মেয়েটাকে কখনো কষ্ট দিবি না। তবুও বাবা হিসেবে মনটা মানছে না বলেই আজ সবার সামনে একটা বার বলছি আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আজ তোর হাতে সঁপে দিলাম। আমার মেয়েটা দেখতে দেখতেই যেন বড় হয়ে গেল, একটা সংসার সামলাতে ঠিক কী কী লাগে তা হয়তো ও এখনো পুরোপুরি শিখে উঠতে পারেনি। যদি কখনো তোর মনে হয় ওকে আর ভালো লাগছে না, তবে কোনো তিক্ততা বাড়াস না বাপ শুধু চোখ বন্ধ করে ওকে আমার হাতে ফিরিয়ে দিস। এক ফোঁটা অভিযোগ ছাড়াই আমি আমার কলিজার টুকরোটাকে আবার নিজের বুকে আগলে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।”
রৌদ্র মুহূর্তেই তুরার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরল। আশিক খানের চোখে চোখ রেখে সে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে শান্ত স্বরে বলল।
“কাকা, এই হাত আমি আজ সবার সামনে সাক্ষ্য রেখে ধরেছি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ আছে আর বুকে নিশ্বাস বইছে, আমি তুরাকে ছেড়ে যাব না। আমার এই ভালোবাসার বন্ধনে থেকে আমি ওকে এক তিল পরিমাণ কষ্টও পেতে দেব না। আমি আমার জীবনের সমস্ত সুখ আর শক্তি দিয়ে ওকে আগলে রাখব। কাকা,তুমি তোমার এই ছেলের ওপর পূর্ণ ভরসা রাখতে পারো।”
আশিক খানের চোখ থেকে অশ্র গড়িয়ে পড়ল। আশিক খানের বাঁধভাঙা চোখের জল দেখে তুরা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে তার বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আশিক খানও তার কলিজার টুকরোকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। ড্রয়িংরুমের উৎসবের আমেজ মুহূর্তেই এক বিষণ্ণ আর গম্ভীর রূপ নিল। এই যে এক অদ্ভুত হাহাকার, এটা শুধু একজন বাবা আর মেয়ের পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব।
হয়তো অনেক পাঠিকার মনে প্রশ্ন জাগছে তুরার বিয়ে তো একই বাড়িতে হয়েছে, সারাক্ষণ তো বাবার চোখের সামনেই থাকবে, তাহলে এত কান্নাকাটির কী আছে? কিন্তু সত্যিটা হলো, বিয়ের পর একটা মেয়ের পৃথিবী রাতারাতি বদলে যায়। সে যতই কাছে থাকুক না কেন, সামাজিক আর ধর্মীয়ভাবে সে তখন অন্য একটি পরিবারের অংশ হয়ে যায়, অন্যের আমানত হয়ে যায়।
এতটা বছর যে মেয়েটি আশিক খানের আঙুল ধরে বড় হয়েছে, যার প্রতিটি আবদার আর জেদ মেটানোই ছিল বাবার ধ্যান-জ্ঞান, সেই তুরা আজ থেকে রৌদ্রের হয়ে গেল। এখন থেকে তুরার ভালো-মন্দ, সুবিধা অসুবিধা কিংবা যেকোনো সিদ্ধান্তের ওপর প্রথম অধিকার আর বাবা আশিক খানের রইল না সেই অধিকার এখন অর্পিত হলো তার স্বামী আব্রাহাম খান রৌদ্রের ওপর। বাবার ঘর থেকে বিদায় নিয়ে তুরা আজ থেকে তার নিজের একটি নতুন ঘর আর নতুন সংসারের পথে পা বাড়াল।
আশিক খান এবার তিথির হাতটা পরম মমতায় আয়ানের হাতের ওপর রাখলেন। তার চোখের পানি তখনো শুকায়নি, বরং কণ্ঠস্বর আরও ভারি হয়ে এল। তিনি আয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে আবেগমথিত স্বরে বললেন।
“আয়ান, আমার ভাগ্য যে আমি আমার দুই মেয়েকেই একই বাড়িতে আর আমার দুই আদরের ভাতিজার হাতে তুলে দিতে পারলাম। তোকে তো নতুন করে কিছু বলার নেই বাবা, আমি জানি তিথির সাথে তোর ছোটবেলা থেকেই কুকুর-বেড়াল লড়াই লেগেই থাকে। সারাক্ষণ ঝগড়া আর কাটাকাটি চলত তোদের মধ্যে। কিন্তু বাবা, এখন থেকে সেই ঝগড়াগুলোকে এক অদ্ভুত ভালোবাসায় বদলে নিস। এমন ঝগড়া করিস যার শেষে দুজনেই মনে মনে আফসোস করবি যে কেন ঝগড়াটা করলাম, হয়তো সব দোষ আমারই ছিল। সেই ঝগড়া অন্তত করিস না যার পর মনে হবে সব ভুল ওর, আর ওর জন্যই আজ সব শেষ হয়ে গেল। যদি একবার এমনটা মনে হয়, তবে সম্পর্কটা বিষিয়ে যাবে বাবা।”
তিনি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।
“আমার এই মেয়েটাকেও আজ তোর হাতে সঁপে দিলাম। দেখিস ও যেন কষ্ট না পায়। জীবনের কোনো পর্যায়ে যদি কখনো ওকে তোর কাছে বোঝা মনে হয়, তবে কোনো দয়া দেখাস না বাবা স্রেফ চুপচাপ আমার হাতে ওকে ফিরিয়ে দিস। আমি এক ফোঁটা অভিযোগ ছাড়াই আমার কলিজার টুকরোটাকে আবার নিজের বুকে আগলে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।”
আয়ানের মতো চঞ্চল আর দুষ্টু ছেলেটাও এবার কেমন যেন থমকে গেল। সে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আশিক খানের দিকে তাকাল। তিথির হাতের ওপর নিজের হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে সে নিচু কিন্তু বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল।
“চাচা, আজকের পর থেকে তিথি শুধু তোমার মেয়ে না, ও আমারও সবটুকু এক পেত্নি ডাইনি রাক্ষসী বউ । তুমি যে ঝগড়ার কথা বললে সেই ঝগড়া হয়তো হবে ধামাকা, কিন্তু কথা দিচ্ছি সেই ঝগড়ার শেষ হবে কোনো এক হাসিতে বা একরাশ ভালোবাসায়।ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা তো স্বপ্নেও ভাববে না চাচা কারণ আয়ান যেটা একবার নিজের করে নেয়, সেটা পাতিহাঁসের মতো প্যাক প্যাক করলেও সেই শব্দ কান ধরে শোনা অজম করে নেওয়া জীবনের বিনিময়ে হলেও আগলে রাখার ক্ষমতা এই আয়ানের আছে।”
আয়ানের ওই এমন কথা শুনে পুরো হল রুমে হাসির রোল পড়ে গেল। বড়রা তো হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছেন। কিন্তু তিথির অবস্থা তখন দেখার মতো! লজ্জায় আর রাগে তার ফর্সা মুখটা একদম টকটকে লাল হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে রাগে কান দিয়ে সত্যি সত্যিই ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এত লোকের সামনে আয়ান তাকে পেত্নি রাক্ষসী ‘আর ‘ডাইনি’বলল!
মুহূর্তের মধ্যে তিথির কান্নার বাষ্প উবে গিয়ে সেখানে চণ্ডী রূপ ধারণ করল। সে এক ঝটকায় আয়ানের চুল শক্ত করে খামছে ধরল। আয়ান “ওরে বাবা রে, মরে গেলাম রে” বলে চিৎকার করে উঠলেও তিথি ছাড়ার পাত্রী নয়। সে আয়ানের চুল ধরে টানতে টানতে ড্রয়িংরুমের মাঝখানে নিয়ে এল এবং আয়ানের বাবা আরিফুল খানের দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলতে শুরু করল।
“বুঝতে পারছি কাকা,তোমার এই গুণধর ছেলেকে তুমি মানুষ করতে গিয়ে ভুলে হয়তো কোনো সার্কাসের বাঁদরের ট্রেনিং দিয়ে ফেলেছ! এর মুখের কথা তো ডাসবিনের পচা আবর্জনার চেয়েও বেশি দুর্গন্ধ ছড়ায়। তুমি একদম চিন্তা করবেন না কাকা, আজ থেকে এই আয়ানের বাচ্চাটাকে সোজা করার দায়িত্ব আমার। একে এমন ডলা দেব যে, কাল থেকে আয়নায় নিজের মুখ দেখলে ও নিজেই নিজেকে ‘স্যার’ বলে সালাম দেবে!”
তিথি আয়ানের চুলে আরেকটা জোরেশোরে টান দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আরও যোগ করল।
“আপনারা যারা হাসছেন তারা সাক্ষী থেকেন, আজ থেকে এই আয়ান খানের মুখে লাগাম না, আমি ডাইরেক্ট তালা ঝুলিয়ে দেব। আর যদি বেশি ত্যাড়াবেঁকা করে, তবে বাসর ঘরে ওকে দিয়ে লেহেঙ্গার কুঁচি ভাঁজ করাব আর সারা রাত এক পায়ে দাঁড়িয়ে কান ধরিয়ে রাখব। শয়তানি করার জন্য ও যদি শয়তানের হেড অফিস হয়, তবে আমি হচ্ছি সেই অফিসের বস! দেখবে কাকা, কয়েকদিনের মধ্যে তোমার ছেলে ‘কুঁই কুঁই’ করে কাঠবিড়ালির মতো আমার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করবে!”
তিথির এই রণমূর্তি আর মারাত্মক সব হুমকি শুনে ড্রয়িংরুমের হাসির তোড় আরও দশ গুণ বেড়ে গেল। আয়ান কোনোমতে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করতে করতে বলল।
“আরে বাবা দেখছে? বাঘিনী তো এখনই থাবা বসানো শুরু করেছে! আমার মনে হয় বাসর ঘরে যাওয়ার আগে আমাকে একটা হেলমেট আর বডি আর্মার কিনে দেও, নাহলে তোমার ছেলে কাল সকালে আস্ত ফিরবে কিনা সন্দেহ আছে!”
কথাটা শেষ করেই আয়ান চিতার মতো ক্ষিপ্রতায় এক ঝটকায় নিজের মাথা সরিয়ে নিল। তিথি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আয়ান তার দুই কবজি নিজের এক হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে ফেলল। ভিড়ের মাঝে সবাই যখন হাসাহাসিতে ব্যস্ত, তখন আয়ান তিথিকে নিজের দিকে টেনে একদম বুকের কাছে নিয়ে এল।তিথি থতমত খেয়ে গেল। আয়ান এবার নিচু হয়ে তিথির কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে গেল। তার তপ্ত নিঃশ্বাস তিথির কানে লাগতেই তিথির সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। আয়ান অত্যন্ত ধীরস্থির আর রহস্যময় এক নেশাময় কন্ঠে ফিসফিসানি স্বরে বলল।
“এখন তো সবার সামনে অনেক বাহাদুরি দেখাচ্ছিস, টেনে নে চুল যতো পারিস! মনে রাখিস, এই অপমানের শোধ কিন্তু আমি আজ রাতেই তুলব। তখন পরিস্থিতি এমন হবে যে, আমার চুল হয়তো তোকে ধরতেই হবে, তবে সেটা রাগের মাথায় নয়, অন্য কোনো এক কারণে! বুঝেছিস মিসেস আয়ান খান? বাসর ঘরের দরজাটা একবার বন্ধ হতে দে বউ, তারপর দেখবি এই শয়তানটা আসলে কতটা ভয়ংকর হতে পারে!”
কথাটা শেষ করে আয়ান তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা আর বিজয়ী হাসি দিল। তিথির গাল দুটো মুহূর্তের মধ্যে লাল হয়ে উঠল। সে রাগে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু আয়ানের ওই গভীর চোখের চাউনি আর রহস্যময় কথার মানে বুঝে তার মুখ দিয়ে কোনো কথা সরল না। সে শুধু বড় বড় চোখ করে আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল।
রানিং…!
Share On:
TAGS: নির্লজ্জ ভালোবাসা, প্রিঁয়ঁসেঁনীঁ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৬
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৩
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৭
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩৬
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৩৪
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৭
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫০
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪১
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫৮
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪