নির্লজ্জ_ভালোবাসা
লেখিকাসুমিচোধুরী
পর্ব ৪৮ (❌কপি করা নিষিদ্ধ❌)
সকালবেলা তিথির ঘুমটা যখন ভাঙল, তার মনে হলো সারা শরীরে বিশালাকার এক সাপ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। নড়াচড়া করার কোনো উপায় নেই। ঘুমের ঘোর কাটতেই সে বুঝতে পারল, তার মাথাটা বালিশে নয়, বরং কারো শক্ত এক পাথরের মতো বুকে রাখা। তিথি ভীষণ চমকে উঠে কোনোমতে নিজের ঘাড়টা একটু উঁচিয়ে ওপরের দিকে তাকাল এবং যা দেখল, তাতে তার হৃদপিণ্ড যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল!
সে আয়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে, আর আয়ান তাকে আগলে ধরে গভীর ঘুমে মগ্ন। তিথি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে বার বার চোখের পলক ফেলে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করল এটা কি কোনো বিভীষিকা নাকি মধুর কোনো স্বপ্ন? ধন্দ কাটাতে সে নিজের হাতে সজোরে একটা চিমটি কাটল। ব্যথায় ককিয়ে উঠল সে, কিন্তু আয়ান তার চোখের সামনেই রইল। তার মানে এটা স্বপ্ন নয়, ঘোর বাস্তব!
তিথির অবাক হওয়ার সীমা যেন আকাশ ছাড়িয়ে গেল। আয়ান তাকে আজ তার ঘরে, তার বিছানায় এভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে! এটা কীভাবে সম্ভব? ভাবতেই তিথির ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। সে ছটফট করে আয়ানকে সজোরে ধাক্কা দিতে শুরু করল। কিন্তু আয়ান ঘুমের ঘোরেও এতটাই শক্ত করে তাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে যে, তিথি এক চুল পরিমাণও সরতে পারছে না।
আয়ানের শরীরের ভার আর সেই নিবিড় আলিঙ্গনে তিথির দম যেন আটকে আসছে। সে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠল। কোনো উপায় না দেখে সে এবার নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে ডাকল।
“আয়ান ভাইইইইইইইয়া।”
তিথির গগনবিদারী চিৎকারে আয়ান ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। ঘুমের আমেজ এক নিমিষেই কর্পূরের মতো উড়ে গিয়ে সেখানে জমা হলো রাজ্যের বিরক্তি। সে দুই হাত দিয়ে নিজের কান চেপে ধরে চোখ মুখ কুঁচকে চিৎকার করে উঠল।
“শা*লী রাক্ষসী রেএএএ! কানের পর্দা কি আজ ফাটিয়েই ফেলবি? সকাল সকাল এইভাবে পাতিহাঁসের মতো প্যাকপ্যাক করে মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছিস কেন।”
তিথি তখন রাগে একদম অগ্নিশর্মা। সে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল।
“তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও! তুমি আমার রুমে কী করছো? আর তার চেয়েও বড় কথা, তুমি আমার রুমে ঢুকলে কীভাবে? আমি তো নিজের হাতে দরজা লক করে ঘুমিয়েছিলাম। তবে কি তুমি দেয়াল টপকে এসেছো?”
তিথির এমন হার না মানা জেরার মুখে আয়ান একদম নির্বিকার। সে একটা হাই তুলে তুড়ি বাজিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর অত্যন্ত অবজ্ঞার স্বরে বাঁকা হেসে বলল।
“তোর ওই পচা গোবর ভরা বুয়া মাথা দিয়ে এসব লজিক ঢুকবে না রে তিথি।”
তিথি রাগে গজগজ করতে করতে দুহাত কোমরে রেখে আয়ানের দিকে এক পা এগিয়ে এলো। তার বুকের ভেতরটা অপমানে ধকধক করে জ্বলছে। দাঁত কিড়মিড় করে সে গলার সবটুকু জোর দিয়ে আবারও প্রশ্ন করল।
“ন্যাকামি একদম করবা না আয়ান ভাইয়া! একদম সোজাসুজি উত্তর দাও, তুমি মাঝরাতে আমার রুমে চোরের মতো এসেছো তাই না? তোমার নিজের রুম কি হারিয়ে গিয়েছিল নাকি অন্য কোথাও জায়গা হয়নি?”
আয়ান এবার বিছানায় আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসল। তার চোখেমুখে সেই চিরচেনা শয়তানি হাসিটা আরও গাঢ় হলো। সে বেশ নাটকীয় ঢঙে নিজের চুলগুলো একবার হাত দিয়ে সেট করে নিয়ে বলল।
“আহ্! কী আর বলি সেই দুঃখের কথা। অনেক বড় বড় প্ল্যান নিয়ে এসেছিলাম রে। ভেবেছিলাম মাঝরাতেই একটা ছক্কা হাঁকিয়ে দেব, কিন্তু এসে দেখি উইকেট তো দূরের কথা, মাঠের পিচই ভিজে একদম কাদা হয়ে আছে। কানা মারার মতো চালও খুঁজে পেলাম না। তাই ভাবলাম, মাঝপথে ফিরে যাওয়ার চেয়ে এই আরামদায়ক বিছানায় চুপচাপ শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।”
কথাটা বলেই আয়ান আড়চোখে তিথির সেই লাল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকাল। তিথি অবাক হয়ে তার এই বাঁকা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছে। আয়ান এবার আচমকা বিছানা থেকে একটু ঝুঁকে তিথির একদম কাছে চলে এল। তার তপ্ত নিশ্বাস তিথির কপালে আছড়ে পড়ছে। দুষ্টু হেসে সে গলার স্বর নিচু করে যোগ করল।
“যাই হোক, এখন তোকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ফ্রেশ আর চনমনে আছিস, শরীরেও বেশ জোর ফিরেছে। তাহলে আর দেরি কেন? সুযোগ যখন পেয়েই গেছি, এদিকে একটু আয়, একটা জুতসই ছক্কা মেরেই দিই আজ!”
আয়ানের এই স্লেশমাখা কথা আর চোখের চাউনি দেখে তিথি এবার আক্ষরিক অর্থেই থমকে গেল। তার সারা শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না আয়ান কি শুধুই মজা করছে নাকি তার মনে অন্য কোনো মতলব আছে। রাগে আর এক অজানা লজ্জায় তার কান দুটো যেন আগুনের মতো গরম হয়ে ওঠছে।তিথি রাগে ফেটে পড়ে চিৎকার করে বলল।
“কী কী বলছো তুমি এসব? আর তুমি আমার এত কাছে আসছো কেন? একটা পুরুষ হয়ে কোনো নারীর এত কাছাকাছি আসতে তোমার কি একটুও লজ্জা করে না?”
আয়ান এবার বিন্দুমাত্র পিছু হটল না, বরং একদম তিথির গায়ের ওপর ঝুঁকে এল। তার চোখের চাউনি তপ্ত আর গম্ভীর। সে ফিসফিস করে অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল।
“না, লজ্জা করে না। লজ্জা তো সেদিন রাতেই বিসর্জন দিয়েছি যেদিন তোর এই শরীরটা আমার সাথে মিশিয়ে নিয়েছি। আর কী বললি তুই? আমি পুরুষ আর তুই মেয়ে? বারবার ভুলে যাস কেন যে আমি তোর লিগ্যাল হাজব্যান্ড! আজকে আমাদের নতুন করে বিয়ের অনুষ্ঠান আর আজকেই আমাদের বাসর। এখন থেকে তুই আমার ঘরেই থাকবি, আমার চোখের সামনে।”
তিথির পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। আয়ানের মুখে এসব কথা শুনে সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। যে মানুষটা একদিন বুক ঠুকে বলেছিল সে তাকে কোনোদিন স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে না, আজ সেই মানুষটাই এমন অধিকার নিয়ে কথা বলছে! তবে কি আয়ান শুধু তার শরীরের লোভে এই অভিনয় করছে? কথাটা মাথায় আসতেই তিথির পুরো মনটা একরাশ ঘিণায় ভরে উঠল। সে অত্যন্ত অবজ্ঞার সাথে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল।
“ছিঃ ভাইয়া ছিঃ! আর কতবার নিজেকে এভাবে নিচে নামাবে? আমার শরীরের ইজ্জত তো তুমি সেদিন রাতেই কেড়ে নিয়েছো। আর কী বাকি আছে তোমার নিতে? নাকি প্রতিদিন সেই বিভীষিকাময় রাতের মতো আমাকে স্রেফ ভোগ করতে চাও?”
তিথির অভিযোগ শুনে আয়ানের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বাঁকা আর অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠল। তিথি যে এখনো তাকে আদ্যোপান্ত ভুল বুঝে বসে আছে, সেটা আয়ানের বুঝতে বাকি রইল না। আয়ান বাঘের মতো ধীর পায়ে তিথির দিকে এগোতে শুরু করল। তিথিও এক অজানা ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে এক পা এক পা করে পিছাতে লাগল। আয়ান এগোতে এগোতে শান্ত কিন্তু গভীর স্বরে বলল।
“তোর কি আসলেই এটাই মনে হয় যে আমি শুধু তোর শরীর ভোগ করার জন্যই এসব বলছি? আমার কি এতটাই অভাব পড়েছে?”
তিথি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পর্যন্ত পিছাতে পিছাতে রুদ্ধশ্বাসে বলল।
“তা নয়তো কী? তুমিই তো সেদিন বুক ফুলিয়ে বলেছিলে আমাকে কোনোদিন বউ হিসেবে মানবে না। তবে আজ কেন আবার মিথ্যে অধিকার নিয়ে আমার শয়নকক্ষে এসে দাঁড়িয়েছো?”
মুহূর্তের মধ্যে আয়ানের চেহারার শান্ত ভঙ্গিটা বদলে গেল। সে এক ঝটকায় তিথির দুই হাত দেয়ালের সাথে সজোরে চেপে ধরল, যেন কোনো বন্দি পাখিকে খাঁচায় আটকালো। তার চোখ দুটো এখন রাগে আর এক তীব্র নেশায় লাল টকটকা হয়ে উঠেছে। তিথির একদম চোখের মনিতে চোখ রেখে সে গর্জে উঠল।
“তোর এই প্রশ্নটা আমারও রে তিথি! যাকে আমি সহ্য করতে পারি না, তার কাছে আসার জন্য কাল সারাটা রাত আমি কেন এমন ছটফট করলাম? যাকে মানি না বলে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম, তার ওপর কেন আজ আমার রক্তে রক্তে অধিকারের নেশা চড়েছে? তার সবকিছুর মূলে তো তুই! কী এক জাদুকরী নেশায় আমায় ডুবিয়ে দিয়েছিস যে এই অবাধ্য মনটা সব শাসন ভেঙে বারবার তোর কাছেই আছড়ে পড়তে চায়!”
বলতে বলতেই আয়ান নিজের মুখটা তিথির একদম ঠোঁটের কাছে নিয়ে এল। তপ্ত আর ভারী নিশ্বাসের ঝাপটায় তিথির জ্ঞান হারানোর উপক্রম। আয়ান ঘোরের মাথায় ফিসফিস করে বলল।
“একবার যখন আমায় পাগল করেছিস, এখন এই পাগলটাকেই তোকে সারাজীবন সামলাতে হবে। এই পাগলের বুনো আদর তোকে সইতে হবে, আমার পাগলামি আর আমার তীব্র ভালোবাসা সবটুকু এখন থেকে তোর ভাগ্যে লেখা। হ্যাভ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?”
তিথি অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। আয়ান কি সত্যিই কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলল? তার পুরো শরীর এখন থরথর করে কাঁপছে, হৃৎপিণ্ডটা যেন বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আয়ানের উত্তপ্ত নিশ্বাস সরাসরি তার ঠোঁটে আছড়ে পড়ছে। তিথি কোনোমতে তোতলামি করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে চাইল।
“আ… আ… আয়ান ভাইয়া তুমি কি… তুমি কি পাগ…!”
বাকিটুকু আর শেষ করতে পারল না। তিথির সেই গোলাপের পাপড়ির মতো লালচে আর কাঁপতে থাকা ঠোঁট দুটো দেখে আয়ানের ভেতরের সবটুকু সংযম এক পলকে ধসে পড়ল। সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এক ঝটকায় তিথির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। এক আদিম, তৃষ্ণার্ত আর গভীর চুম্বনে সে তিথির কণ্ঠস্বরকে চিরতরে রুদ্ধ করে দিল।
বাথরুমের দরজার ওপাশে শিহাব একদম পাথরের মতো সেঁটে আছে। আরশি বাইরে থেকে বারবার নক করছে, কিন্তু শিহাবের সাড়াশব্দ নেই। তার ভয়টা ঠিক জায়গায় ডাক্তার কড়া করে বলে দিয়েছেন, প্রতিদিন সকালে হাতের পুরনো ব্যান্ডেজ খুলে স্যাভলন দিয়ে ক্ষতটা পরিষ্কার করে নতুন মলম লাগাতে হবে। আর এই স্যাভলনের জ্বালা সহ্য করার চেয়ে শিহাবের কাছে বাথরুমে বন্দি থাকা ঢের ভালো।
সকাল থেকে শিহাবের মা মিনহা চৌধুরী আর আরশি পালাক্রমে দরজায় কড়া নেড়ে নেড়ে ক্লান্ত। কিন্তু শিহাব নাছোড়বান্দা। আরশির এখন রাগের চেয়ে হাসিই বেশি পাচ্ছে। বাইরে থেকে সে কল্পনা করতে পারছে, বিশাল দেহের এই মানুষটা ভেতরে নিশ্চয়ই কুঁকড়ে আছে শুধু একটুখানি ওষুধের ভয়ে।
আরশি এবার দরজার একদম কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বেশ কৌতুকের সুরে বলতে শুরু করল।
“শুনুন শিহাব, আপনি যদি এখনই দরজা না খোলেন, তবে আমি কিন্তু আপনাকে আস্ত একটা টিকটিকির সাথে তুলনা করতে শুরু করব! না না, টিকটিকি না, তার চেয়ে বরং কাঠবিড়ালি বলাই ভালো যাকে ধরার আগেই ভয়ে লেজ তুলে ভোঁ দৌড় দেয়। এত বড় মানুষ হয়ে যদি একটা ওষুধের ভয়ে এমন লুকোচুরি খেলেন, তবে লোকে শুনলে হাসবে কিন্তু!”
মিনহা চৌধুরী পাশ থেকে হতাশ হয়ে বললেন।
“দেখলে আরশি, ছেলেটা বড় হলো ঠিকই, কিন্তু সেই ছোটবেলার মতো ইনজেকশন আর ওষুধের ভয়টা আজও গেল না।”
আরশি দরজায় আবার জোরে একটা টোকা দিয়ে বলল।
“শিহাব আপনি কি বেরোবেন,নাকি আমি ওই কাঠবিড়ালির মতো আপনাকে ধরার জন্য বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে উঁকি দেব?পাঁচ সেকেন্ড সময় দিলাম,এক,দুই,তিন,চার,পাঁ..!
আরশির পাঁচ পর্যন্ত গোনার আগেই দরজার ওপাশ থেকে শিহাবের করুণ আর্তনাদ ভেসে এল। শিহাব কোনোমতে গলার স্বর খাঁকারি দিয়ে নিজেকে একটু গম্ভীর করার চেষ্টা করে বলল।
“শোনো আরশি, তুমি আমায় কাঠবিড়ালি বা টিকটিকি বলে ছোট করার চেষ্টা কোরো না! আমি তো আসলে তোমার আর মায়ের কথা ভেবেই ভেতরে বসে আছি। বাইরে বেরোলে তোমরা ওই ভয়ংকর স্যাভলন আর মলম নিয়ে আমার ওপর যে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালাবে, তাতে আমার আর্তচিৎকারে পাড়া প্রতিবেশী ভাববে এ বাড়িতে হয়তো ডাইনোসর ঢুকেছে! আমি কি চাইব সকাল সকাল তোমাদের নামে এলাকায় বদনাম ছড়াক? আমি তো স্রেফ জনস্বার্থে নিজেকে গৃহবন্দি করে রেখেছি!”
একটু থেমে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে সে আবার যোগ করল।
“আর তুমি যে পাঁচ পর্যন্ত গুনছ? আমি ভেতরে অলরেডি ১০৮ বার ‘আয়তুল কুরসি’ পড়ে ফেলেছি যাতে ওই মলমের টিউবটা আপনাআপনি গায়েব হয়ে যায়। অলৌকিক কিছু ঘটার আগ পর্যন্ত আমি এই দুর্গের পতন হতে দিচ্ছি না, বুঝেছ?”
শিহাবের এমন অদ্ভুত যুক্তির কথা শুনে মিনহা চৌধুরী কপালে হাত চাপড়ে আক্ষেপ করতে লাগলেন। বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলেন, “হে আল্লাহ! লোকে শুনলে তো আমার ছেলেকে পাগল বলবে, আর ওদিকে ও ওষুধের ভয়ে রীতিমতো ইতিহাস রচনা করে ফেলছে!”
আরশি ওদিকে নিজের হাসি সামলাতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে। তার অবস্থা এমন যে, কোনোমতে ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে রেখেছে। শিহাবের এই ‘ডাইনোসর আর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ তত্ত্ব শুনে সে যদি এখন একবার হাসতে শুরু করে, তবে আর থামানো যাবে না। কিন্তু মিনহা চৌধুরী সামনে থাকায় সে খুব গম্ভীর হওয়ার ভান করে দাঁড়িয়ে রইল।
মিনহা চৌধুরী হাল ছেড়ে দিয়ে আরশির কাঁধে হাত রেখে নিচু স্বরে বললেন।
“শোনো মা, ওকে এখন জোর করে বের করা যাবে না। ওই যে ভেতরে সেঁধিয়েছে, এখন সহজে বেরোবে না। ওকে আমি ছোটবেলায় একটা ট্যাবলেট পর্যন্ত খাওয়াতে পারিনি। এক কাজ কোরো, এখন থাক। ও যখন রাতে অঘোরে ঘুমাবে, তখন তুমি আস্তে করে ওর ব্যান্ডেজটা খুলে জায়গাটা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিও। সকালে না হলেও রাতে দিলেও চলবে। অন্তত ঘুমিয়ে থাকলে তো আর ডাইনোসরের মতো চিৎকার করবে না!”
আরশি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মিনহা চৌধুরী বিরক্তিতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আরশি এবার দরজার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। মনে মনে ভাবল, “দাঁড়ান মিস্টার ডাইনোসর! রাতে তো আপনার ঘুম আমিই কাড়ব।”
মিনিট খানেক পর বাথরুমের ভেতর থেকে একদম ফিসফিসানি স্বরে শিহাব জিজ্ঞেস করল।
“আরশি? মা কি চলে গেছে? নাকি এখনো ওই বিষাক্ত স্যাভলন আর আগুনের মতো মলম নিয়ে দরজার আড়ালে ওঁত পেতে আছে?”
আরশি মুখ টিপে হাসি চেপে রেখে অত্যন্ত গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলল।
“হুম, মা চলে গেছে। আপনি এবার নিরাপদ, বের হয়ে আসতে পারেন।”
আরশির কথা শোনা মাত্রই বাথরুমের দরজাটা ইঞ্চিখানেক ফাঁক হলো। শিহাব সতর্ক চোখে চোরের মতো এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে নিশ্চিত হলো যে তার মা সত্যি সত্যিই সেই ‘ভয়ংকর’ ওষুধের ডিব্বা নিয়ে বিদায় হয়েছেন। নিশ্চিত হতেই সে বুক টান করে বেরিয়ে এল এবং এমনভাবে কয়েকটা লম্বা লম্বা শ্বাস নিল যেন এইমাত্র ফাঁসির দড়ি থেকে বেঁচে ফিরল।
শিহাব কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে আকাশের দিকে দুহাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে বলল।
“আলহামদুলিল্লাহ! যাক, আজকের মতো ওই বিষাক্ত মলম আর আগুনের গোলা স্যাভলন থেকে বেঁচে ফিরলাম। আল্লাহ সত্যিই আমার পাশে ছিলেন। হে মাবুদ, এভাবেই তোমার এই বান্দাকে সবসময় বিপদ থেকে রক্ষা করো, বিশেষ করে ওই মলম আর আগুনের গোলা স্যাভলন থেকে!”
আরশি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শিহাবের এই নাটকীয়তা দেখছিল। শিহাবের আধো-কান্না আর আধো-করুণ চেহারা দেখে সে আর হাসি চেপে রাখতে পারল না। এবার সে শব্দ করে হেসে ফেলল।
ধীরে ধীরে দুপুর গড়িয়ে বিয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ ঘনিয়ে এল। পুরো বাড়িতে এখন উৎসবের সাজ সাজ রব। তুরা আর তিথিকে সাজানো হয়েছে হুবহু একরকম রাজকীয় লেহেঙ্গায়। ভারী কাজ করা লেহেঙ্গা, জমকালো গয়না আর নিখুঁত সাজে দুজনকে যেন অপার্থিব সুন্দর লাগছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের দেখে নিজেরাই যেন চিনতে পারছে না।
ওদিকে রৌদ্র আর আয়ানও আজ কারও চেয়ে কম নয়। দুজনেই পরেছে একই রঙের ডিজাইনার শেরওয়ানি। লম্বা সুঠাম দেহের অধিকারী দুই যুবককে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো রূপকথার রাজ্যের দুই প্রতাপশালী রাজপুত্র। তাদের আভিজাত্য আর ব্যক্তিত্বে চারপাশটা যেন ঝলমল করছে।
বাড়িতে এখন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। বিশাল বিশাল বক্স বসানো হয়েছে, যেখান থেকে জনপ্রিয় সব বিয়ের গান বাজছে। পাড়ার ছেলেপিলেরা সেই গানের তালে তালে তাল মিলিয়ে মেতে উঠেছে পাগলাটে নাচে। রঙিন আলোকসজ্জা, ফুলের সুবাস আর মেহমানদের হাসাহাসিতে বাড়ির প্রতিটি কোণ যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
রানিং…!
Share On:
TAGS: নির্লজ্জ ভালোবাসা, প্রিঁয়ঁসেঁনীঁ
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১৭
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪০
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫০
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৫৫
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪৪
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৪১
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৬
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ১৯
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ৭
-
নির্লজ্জ ভালোবাসা পর্ব ২৯