Golpo romantic golpo তোমার হাসিতে

তোমার হাসিতে সূচনা পর্ব


ছোট চাচার বিয়ের কথা উঠতেই দাদি মায়ের সব গহনা ফেরত নিয়ে গেলেন। সহজ গলায় বললেন, “এসব গহনা তোমার শ্বশুর গড়িয়ে দিয়েছিল। কথা ছিল বিয়ের পরে ফেরত নিয়ে আমার কাছে রেখে দেব। আমি সে কাজ করিনি। তুমি বউ মানুষ, গহনা পরতে ভালোবাসো। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তামিমের বিয়ে ঠিক হয়েছে। নতুন বউকে কিছু না দিলে মানসম্মান থাকে না। তোমার শ্বশুরের অবস্থা আগের মত স্বচ্ছল নেই। সোনার দামও খুব চড়া। কিছু মনে করো না।”

মা দাদির কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ডাল বাগার দিতে ব্যস্ত হয়ে রইল। দাদি নিজের ঘরে চলে গেলেন। বোধ করি তিনি আরও কিছু বলতেন, বাবার গলা পেয়ে সরে গেলেন। মায়ের গহনাপত্র খুব বেশি না। মাঝারি ধরনের একজোড়া কানের দুল, দু’টো বালা, একটা চেন। সেদিন বিকেলেই মা তার সব গহনা দাদির কাছে বুঝিয়ে দিলেন। আমি দাদির ওষুধপত্র গুছিয়ে রাখছিলাম। মা গহনাগুলো দাদির হাতে দিয়ে বলল, “এই যে সব। আপনার কাছে দিয়ে গেলাম।”

দাদি প্রতিটা গহনা খুব নেড়েচেড়ে দেখলেন। মেকি হাসি দিয়ে বললেন, “আংটিটা দেখছি না যে? হারিয়ে ফেলেছ নাকি?”

তার গলার স্বর খুব কর্কশ শোনালো। মা বলল, “ওটা আমার কাছে রেখে দিয়েছি।”

“সেকি কথা! ওটাতে তো বেশ অনেক সোনা। নকশাটাও চমৎকার। তাছাড়া বিয়েতে আংটি না দিলে হয় নাকি?”

“আসলে আম্মা, আংটিটা আমার খুব পছন্দের তা-ই ভাবলাম।”

“মেয়ে মানুষের গহনা পছন্দ না– এমন কথা কোথাও শুনেছ নাকি? ওই আংটির কথা ভেবেই আংটি গড়ানো হয়নি। শেষ মুহূর্তে এসে আংটি কেনা যায় নাকি? তুমি দিয়ে দাও। বড় খোকাকে বলব পরে যেন তোমায় একটা আংটি গড়িয়ে দেয়।”

মা মাথা দুলিয়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেল। খেয়াল করলাম মায়ের চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। সে চোখের পানি লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

আমার বাবা আহামরি কোন চাকরি করে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী। বেতন খুব বেশি না। তার রোজগারের বেশিরভাগ টাকা সংসারের চাল, ডাল কিনতে খরচ হয়ে যায়। এর উপরে আমাদের ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ তো আছেই। সব মিলিয়ে মাস শেষে তেমন টাকাপয়সা থাকে না। এর মধ্যে বাড়তি খরচ করে গহনা বানানোর পরিস্থিতি বাবার নেই। মাসখানেক হলো ছোট চাচার সরকারি চাকরি হয়েছে। চাকরি পাওয়ার পর থেকে তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু হয়েছে। দাদি খুব আগ্রহ নিয়ে এই কাজটা করছেন। বিয়ে ঠিক হয়েছে মাত্র ক’দিন। মেয়ের বয়স বেশি না। সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। বিয়েতে মেয়ের পরিবারের লোকেদের আগ্রহের শেষ নেই। তারা বলেছে জামাই সরকারি চাকরি করে। গহনাপত্র একটু বেশি করে দিয়েন। সমাজ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। দাদি খুব যত্ন নিয়ে গহনার হিসেব রাখছেন। ছোট চাচাও আগের মত গম্ভীর নেই। হাসি-হাসি মুখ করে ঘুরে বেড়ায়। ঝলমলে গলায় কথা বলে।

দাদির ওষুধ গুছিয়ে মায়ের ঘরে চলে গেলাম। মা বিছানায় বসে কাপড় ভাজ করছে। আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। জড়ানো গলায় বললাম, “আংটি দিয়ে এসেছ মা?”

“না। কাপড়গুলো গুছিয়ে যাব।”

খেয়াল করলাম আংটিটা মায়ের আঙুলে পরা। হয়তো শেষবার মত পরতে ইচ্ছে হয়েছে। হঠাৎই গলা ধরে এলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে গলা ঠিক করে বললাম, “মা, আমার সাথে দু’টো ছবি তুলবে?”

মা ভীষণ বিরক্ত হলো তেঁতো গলায় বলল, “কাজের সময় ঝামেলা করিস না। এখন ছবি তোলার সময় নেই।”

শত জোরাজুরি করার পরেও সে কোন ছবি তুলল না। কাজের বাহানা দেখিয়ে সরে গেল।

বাবারা তিন ভাই বোন। ফুফু সবার বড়। তার বিয়ে হয়েছে অনেক আগে। ঢাকায় থাকে। বছরে দুবার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। বেশিরভাগ সময় ফুফা তাদের সাথে আসে না। মেয়ে দু’টোকে সাথে নিয়ে আসে। মেয়েরা এখানে এসে ঘরে থেকে বের হয় না। এখানকার রোদে নাকি তাদের ত্বক নষ্ট হয়ে যায়। কী অদ্ভুত কথা! রোদ আবার আলাদা হয় নাকি?

ছোট চাচার বিয়ের কথাবার্তা শুরু হবার পর থেকে ফুফু আসার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সুযোগ করে উঠতে পারছে না। তার ছোট মেয়ের পরীক্ষা শেষ হয়নি। এই নিয়ে দাদির আফসোসের শেষ নেই। মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ে। দারুণ মেধাবিণী!ফুফু তার মেয়ের ক্ষ’তি করে ভাইয়ের বিয়েতে আসবে না।

সন্ধ্যা মিলিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। টেবিলে বসে বই খুলে রেখেছি। পড়তে পারছি না। মায়ের মুখ চোখের সামনে ভাসছে। ইসস! আমি যদি মাকে অমন একটা আংটি গড়িয়ে দিতে পারতাম। কতই না ভালো হতো! কিন্তু না। এই মুহুর্তে আমার হাতে কোন টাকাপয়সা নেই। সোনার আংটি চারটিখানি কথা না। দু’হাতে মাথার চুল খামছে ধরলাম। মা বলল, “পড়তে বসে ওমন ভং ধরে আছিস কেন?”

“তেমন কিছু না। মাথাটা একটু ধরছে। এক কাপ চা বানিয়ে দেবে?”

মা টেবিলের উপর চায়ের কাপ রাখল। সহজ গলায় বলল, “চা শেষ করে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যা। তোর ফুফু আসছে।”

“এখন?”

“তিমুর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই রওনা দিয়েছে। দেরি করিস না।”

মা চলেই যাচ্ছিল। দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ব্যস্ত সুরে বলল, “কানটুপিটা নিয়ে যাস। বাইরে অনেক ঠান্ডা।”

মায়ের রান্নার হাত ভালো। দারুণ চা বানায়। এক কাপ চায়ে মাথা ব্যাথা সেরে গেছে। বেশ হালকা লাগছে এখন। তড়িঘড়ি করে কানটুপি পরে নিলাম। ফুফুদের দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। দাদি ভীষণ রেগে যাবেন।

ডিসেম্বরের শুরু। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মত অবস্থা। ফুফু ঘরে ঢুকতেই শোরগোল পড়ে গেল। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরছে। আমাট এসবে থাকতে ইচ্ছে করে না। দেখা হওয়ার পরপরই কেমন আছেন কী জিজ্ঞেস করা শেষ। তাই আর দাঁড়ালাম না। ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। এই মুহুর্তে আমার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে। মা’কে একটা আংটি বানিয়ে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কাল সোনার দোকানে যাব। কত কী লাগবে জিজ্ঞেস করে আসব। তারপর টাকার জোগাড় করতে হবে। হালাল টাকা। মা খুব কঠিন মানুষ। অবৈধ টাকা পয়সার জিনিস নিবে না।

খুব বেশি রাত জাগলাম না। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে। দাদি মায়ের সাথে ঝগড়া করছেন। মা তার কথার জবাব দিচ্ছে না। তড়িঘড়ি মায়ের কাছে গেলাম। কর্কশ গলায় বললাম, “কি হচ্ছে এখানে?”

মা আমাকে সরে যেতে বলল। গেলাম না। পুনরায় একই প্রশ্ন করলাম। দাদি বললেন, “তোর মা গহনা নেওয়ার পর থেকেই মুখ পু’ড়ি’য়ে ঘুরছে। মেয়েটা বাড়িতে আসতে আসতেই তার কান ভাঙ্গানি দিতে শুরু করেছে। এতই যদি গহনার শখ, বাপের বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে আসেনি কেন?”

মায়ের দিকে তাকালাম। মা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ফুফু দূরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট চেপে হাসছে। কাহিনি বুঝতে আমার এতটুকুও বাকি রইল না। বিরক্ত গলায় বললাম, “মা, আব্বা কোথায়?”

দাদি বললেন, “বাপকে ডেকে নালিশ কী নালিশ করবি?”

“নালিশ করব না। জিজ্ঞেস করব সে তোমার পেটের ছেলে কি-না। হতেও পারে আমার বাপ দাদার আগের ঘরের। এজন্য তুমি দুই ছেলেকে দুই চোখে দেখো।”

দাদি আমার কথা শুনে মেঝেতে বসে পড়লেন। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “সবুর আসুক বাড়িতে। আস্কারা দিয়ে দিয়ে ছেলেকে একদম বে’য়া’দ’ব বানিয়ে দিয়েছে। বড়দের মুখে মুখে তর্ক করা শিখেছে।”

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। মা বলতে দিলো না। হাত ধরে টেনে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। নরম গলায় বলল, “তুই এসবের মধ্যে আছিস না। আপা গহনার কথা বলছিলাম আম্মা শুনে ফেলেছে। বুড়ো মানুষ। কী বলতে কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না।”

মায়ের উপর ভীষণ রাগ হলো। তবে মুখের উপর কিছুই বললাম না। অন্যদিকে তো খেয়েদেয়ে কলেজে চলে এলাম।

আমার খুব বেশি বন্ধু নেই। বাদশার সাথে ইদানীং একটু কথাবার্তা হয়। ছেলেটা ভালো। সে আমাকে বসে থাকতে দেখেই ছুটে এলো। হড়বড়িয়ে বলল, “কি রে পুকুর পাড়ে বসে কী করছিস? ক্লাস করবি না?”

“ডিসেম্বরের দিকে ক্লাস খুব একটা হয় না। আজকেও হবে না। বুদ্ধিমানের কাজ হবে শক্তি খরচ করে তিনতলায় না ওঠা।”

“তোর মত অলস ছেলে আমি আমার জীবনে দেখেনি।”

“না দেখলো এমন দেখে রাখ। পরে সবাইকে গল্প দিতে পারবি।”

“তা পারব।”

বাদশা আমার পাশে বসে পড়ল। খানিকক্ষণ উসখুস করে বলল, “তোর কী কিছু হয়েছে? কেমন অন্য রকম লাগছে।”

“একটা ব্যাপার নিয়ে খুব ভাবছি।”

“কী?”

“কিছু টাকা লাগবে। কোথা থেকে পাব সেই চিন্তা করছি।”

“টাকা দিয়ে কী করবি?”

বাদশা আমার দিকে তাকিয়প চুপ করে গেল। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, “ঝালমুড়ি খাবি? আমার পক্ষ থেকে।”

“না, এখন কিছু খাব না। একটা জায়গায় যেতে হবে। কাজ আছে।”

“সাথে আসব?”

“ক্লাস ফেলে আমার সাথে যেতে হবে না।”

“তুই তো বললি ডিসেম্বরের দিকে খুব একটা ক্লাস হয় না। তাছাড়া একদিন ক্লাস ফাঁকি দিলে তেমন কিছু হবে না।”

“চল তাহলে।”

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কাজে যাওয়া হলো না। গেট থেকে বের হতেই স্যারের মুখে পড়লাম। স্যার খুব আয়েশি ভঙ্গিতে বললেন, “তোমরা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ো না?”

বাদশা বলল, “জ্বি স্যার।”

“এদিকে এসো। কয়েকটা বইপত্র নিতে হবে। আজকে ক্লাসে তোমাদের সবাইকে একটা করে বই দেব। খুব চমৎকার একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে চাচ্ছি। আজকেই ঘোষণা।”

স্যার আমাদের কলেজে নতুন এসেছে। বেঁটেখাটো ভদ্রলোক, মাথায় টাক পড়ে গেছে। খুব গুছিয়ে কথা বলে। এতটাই গুছিয়ে কথা বলে যে কেউ তার কথা অগ্রাহ্য করতে পারে না। স্যারের ফাইফরমাশ খাটতে গিয়ে ক্লাসের সময় শেষ। বই খুব বিশেষ কিছু না। স্যার একটা গল্পের বই লিখেছেন। লেখক কপি হিসেবে যা পেরেছে আমাদের ভাগ করে দিয়ে দিয়েছেন। পড়ে দু’দিনের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। সাথে একটা কাগজে বইয়ের রিভিউ লিখতে হবে। যার লেখা সবচেয়ে ভালো হবে স্যার তাকে একটা বই এবং এক হাজার টাকা পুরষ্কার দিবেন।

টাকার অংক বেশ ভালো। প্রতিযোগিতা জিততে পারলে এক হাজার টাকা হয়ে যাবে। আংটি গড়াতে কত লাগবে জানি না। জানতে হবে।

কলেজ থেকে বেরিয়ে সোনার দোকানে চলে গেলাম। বাদশা আমার সাথে আসতে পারেনি। তার টিউশনি আছে। দোকানদার লোকটা ভীষণ বিনয়ী। চেয়ার টেনে বসতে বলল। গলার স্বরে কোমলতা আছে। আমি বসলাম না। সরল গলায় বললাম, “একটা আংটি বানাতে কত খরচ পড়বে?”

“সোনার পরিমাণ কত? তিন আনা দিয়ে বানাতে গেলে আঠারো উনিশ পড়বে।”

দাম শুনে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার দশা। তবে পড়লাম না। অল্প হেসে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। পাশেই সিঙ্গাড়া সমুচার দোকান। দোকান থেকে দু’টো সিঙ্গাড়া কিনে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। হঠাৎই নজরে পড়ল ছোট চাচার হবু বউ একটা ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ অবাক হলাম। পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে তারা রিকশায় উঠে গেল। ছবি তুলতে পারলাম না।

কথাটা বাড়িতে বলতেই তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে গেল। দাদি বললেন, “মায়ের গহনা নিয়েছি বলে এমন বদনাম শুরু করে দিয়েছিস? অবশ্য তোরা আর কী-ই বা করবি! যেমন মা তেমন ছেলে।”

ফুফু বলল, “তোর কাছে কী কোন প্রমাণ আছে? প্রমাণ ছাড়া এসব ভুলভাল কথার কোন মানে নেই। তাছাড়া ছেলেটা যে কেউই হতে পারে। আত্মীয় স্বজন। এই যুগের ছেলে হয়ে তোর থেকে এটা আশা করা যায় না।”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ভুল দেখছি বলে ঘরে চলে এলাম। আমার মাথায় এখন একটাই চিন্তা। টাকা জোগাড় করতে হবে। ছোট চাচার বিয়ের আগেই আমি মাকে অমন আংটি গড়িয়ে দেব।

চলবে

সূচনা পর্ব

তোমার_হাসিতে

কলমে : #ফারহানাকবীরমানাল

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply