Golpo romantic golpo তোমার হাসিতে

তোমার হাসিতে পর্ব ৬


তোমার_হাসিতে

ফারহানাকবীরমানাল

৬.
ছোট চাচার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে বাড়ির লোক সংখ্যা বাড়ছে। পার্মানেন্ট লোক না। অতিথি। সকালে খাওয়ার সময়ই দাদির ছোট বোন ঢুকলেন। তার দু-হাত ভর্তি কমলালেবু। ঠোঙা ছিঁ’ড়ে ফেলেছেন। ছেঁ’ড়া ঠোঙায় সবগুলো ফল ঠিকঠাক মত রাখা যাচ্ছে না। ভীষণ রকমের অসুবিধে হচ্ছে। তবু সামলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আমি তাকে দেখেও দেখলাম না। ভাত খেতে লাগলাম।

ঘরে ঢুকেই তিনি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। তীক্ষ্ণ এবং তীব্র গলায় বললেন, “সবাই কোথায় গেলি? বেলা বারোটার সময় কেউ নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় নাকি?”

ঘড়িতে বেলা বারোটা বাজে না। নয়টা বাজতে তখনও অনেক বাকি। তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ফুফু দৌড়ে এলো। আদুরে গলায় বলল, “খালা তুমি? তুমি কখন এলে?”

“এইতো মাত্রই এসে দাঁড়ালাম। তা বাড়ির আর লোকজন সব কোথায়?”

“আছে কোথাও। তুমি দাঁড়িয়ে থেকো না। এসে বসো। হাতে করে কী এনেছ? কমলালেবু। দাও, আমার কাছে দাও।”

তিনি কমলালেবুর ঠোঙা ফুফুর হাতে দিলেন না। ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। দাদির ছোট বোন মারাত্মক রকমের সুন্দরী। এখনও খানিকক্ষণ রোদে দাঁড়ালে তার গাল লাল হয়ে যায়। যেনতেন লাল না। একদম পাকা টমেটোর মত লাল। আমি তাকে রাঙা দাদি বলে ডাকি। তিনি আমায় খুব স্নেহ করেন। মাকেও ভীষণ ভালোবাসেন।

মা কাপড় ধুচ্ছিল। তার আসতে একটু দেরি হলো। রাঙা দাদি বললেন, “বড় বউ কোথায় ছিলে?”

মা তাকে সালাম দিলো। ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে বলল, “আপনি এখনো এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

“তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি৷ এই নাও। এই কমলাগুলো নাও। সবাইকে ভাগ করে দেবে।”

ফুফু আঁড়চোখে মায়ের দিকে তাকাল। ব্যাপারটা রাঙা দাদির নজর এড়ালো না। তিনি বললেন, “মেহমানদের আনা জিনিস বাড়ির মানুষের কাছে দিতে হয়। বিয়ে হলে মেয়েরা আর বাপের বাড়ির মানুষ থাকে না। তখন তারাও বাড়ির মেহমান হয়ে যায়।”

ফুফু চোখ সরিয়ে ফেলল। দাদি বললেন, “যাইহোক, এখানে আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকিস না। ঘরে গিয়ে বোরকা টোকরা খোল। মুখ হাত ধুয়ে ফেল।”

রাঙা দাদি বললেন, “হ্যাঁ যাচ্ছি। বড় বউ তোমার শরীর ভালো? শরীর ভালো থাকলে এক কাপ চা বানাও। অনেকদিন হলো তোমার হাতের চা খাওয়া হয় না।”

মা একটু হেসে রান্নাঘরে চলে গেল। আমিও হাসলাম। রাঙা দাদির একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে। কাউকে কোন কাজে বলার আগে তার শরীরের কথা জিজ্ঞেস করে নেন। সমসময়ই করেন। এই যেমন– বাবাকে বাজার থেকে পান আনতে বলবেন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন– বড় খোকা তোর শরীর ভালো? শরীর ভালো থাকলে আমার জন্য এক খিলি পান নিয়ে আয় তো। তোর মায়ের পানসে পান আমি খেতে পারি না। না জর্দা, না কিছু। ওই পান আবার খাওয়া যায় নাকি?

আমার খাওয়া শেষ। ঘড়িতে আটটা সাঁইত্রিশ বাজে। এক্ষুনি বের হতে হবে। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে দু কদম যেতে না যেতেই চিৎকার চেঁচামেচি শব্দ কানে এলো। রাঙা দাদি বাজখাঁই গলায় রাগারাগি শুরু করেছেন। তড়িঘড়ি করে বসার ঘরে ঢুকলাম। মা তার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আছে। রাঙা দাদি বললেন, “বউ মানুষ, কান গলা এমন খালি করে রেখেছ কেন? গতবার এসেও তো দেখলাম কানে গলায় আছে।”

মা তার কথার জবাব দিলো না। চুপ করে রইল। রাঙা দাদি আগের চেয়েও তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “কি হলো? সবুর তোমার গহনাপত্র বেচে দেয়নি তো?”

“না খালাম্মা। সাজ্জাদের আব্বা কিছু করেনি।”

“তাহলে কে করেছে? তুমি করেছ? এয়োস্ত্রী গহনা খুলে রাখলে কেমন দেখা যায়?”

মা কিছু বলবে তার আগে দাদি বললেন, “বড় বউয়ের গহনা আমার কাছে।”

রাঙা দাদি তেঁ তেঁ উঠলেন।

“বড় বউয়ের গহনা তোমার কাছে কেন?”

“ওইসব তোর দুলাভাই বানিয়ে দিয়েছিল। এখন ছোটর বিয়ের কথা চলছে। সোনার যে দাম। তাই বড় বউয়ের থেকে চেয়ে নিয়েছি।”

রাঙা দাদি আর একটা কথাও বললেন না। চোখ মুখ লাল করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলেন। আমিও আর দাঁড়ালাম না। নয়টার ভেতরে যাওয়ার কথা। আজ খুব দেরি হয়ে যাবে।

বাদশার মামা ধানক্ষেতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “দেরি করলে যে? আমি তো ভাবলাম তুমি আর আসবে না।”

আমি লজ্জিত মুখে মাথা দোলালাম। নরম গলায় বললাম, “বাড়িতে একটু ঝামেলা আছে। তাই দেরি হয়ে গেল।”

“সে হলো। এখন কাজ শুরু করো। দাঁড়িয়ে নষ্ট করার সময় নেই। রোদ মাথায় উঠলে কাজ করতে কষ্ট হয়ে যাবে।”

কোমরে গামছা বেঁধে কাজ শুরু করলাম। ধান কা’ট’তে এখন আর কোন অসুবিধা হয় না। বাম হাতে শক্ত করে ধরে এক পোঁচে কে’টে ফেলি।

ঘন্টা খানেকের মধ্যে বেশ অনেকটা ধান কে’টে ফেললাম। ক্ষেতের এই দিকটা একটু ভিজে ভিজে। নরম মাটি। পানি শুকায়নি। এখানের কাজ বড়জোর চার দিন আছে। তারপরই শেষ হয়ে যাবে। বেতন যা পাবো, আংটি বানানোর টাকা হবে না। বাদশা দুধ ডেলিভারি দেওয়ার ব্যাপারেও আর কিছু বলেনি। কাস্তে ফেলে দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ইয়া আল্লাহ! আমি তো কোন খারাপ নিয়ত করিনি। হালাল রোজগারের টাকা দিয়ে মাকে একটা গহনা বানিয়ে দিতে চেয়েছি। আপনি তো ভালো কাজে সাহায্য করেন। আমাকেও সাহায্য করেন না! একটা উপায় করে দিন। যেন আমি মাকে আংটিটা বানিয়ে দিতে পারি।”

মাথা নামিয়ে চোখ মুছে ফেললাম। হঠাৎই মনে পড়ল আল্লাহ বলেছেন, “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য পথ বের করে দেন এবং এমন জায়গা থেকে তাকে রিজিক দেন, যা সে কল্পনাও করে না।” (সূরা আত-তালাক, আয়াত ২–৩)

ধানক্ষেতে একপাশে কচু গাছের ঝোপ। অনেক লতি ধরে আছে। হুট করেই মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। দুপুরে খাওয়ার সময় বাদশার মামাকে বললাম, “মামা, ধান ক্ষেতের পাশে অনেক কচু গাছ দেখলাম।”

মামা বললেন, “ওই জমিটাও আমার। শেষ মুহূর্তে পরিষ্কার করার লোক পাওয়া গেল না। তাই আর ধান লাগানো হয়নি।”

“মামা, আমি একটা কথা বলব?”

“বলো।”

“গাছের গোড়ায় অনেক লতি দেখলাম। ওগুলো আমি নেব?”

“শুধু লতি নেবে কেন? লাগলে গাছ শুদ্ধ তুলে নিয়ে যাও। গাঁয়ে গ্রামে অমন কচু গাছের অভাব নেই।”

বিকেলের দিকে একটু জোরে হাত চালিয়ে ধানের কাজ শেষ করলাম। কচুর লতি তুলব। আমাদের ওদিকের বাজারে লতির চাহিদা ভালো। আঁটি হিসাবে বেচলে পনেরো বিশ টাকা করে দাম পাওয়া যায়। খুব খুঁজে খুঁজে তুলে বারো আঁটি হলো। কলার শুকনো পাতা দিয়ে আঁটি বেঁধে নিয়েছি। শক্ত করেই বেঁধেছি। বাজারে গিয়ে দেখব। কচুর চাহিদা থাকলে কাল গাছ তুলে নিয়ে যাব।

সন্ধ্যাবেলা হলেও বাজারে বেশ ভীড়। লোকজন আছে। হাঁটের এক কোণে লতির আঁটি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রথম দিকে বিশ টাকা করে বেচলেও শেষ দিকে পারলাম না৷ শেষ দুই আঁটি একজনে পনেরো টাকায় নিয়ে গেল।

এই ব্যবসা খারাপ না। খরচাপাতি নেই। গরত খাটাতে পারলে রোজগার ভালো৷ হিসাব করে দেখলাম একশ নব্বই টাকা হয়েছে। কাস্তে কেনার টাকা উঠে গিয়েছে প্রায়।

বাড়ি ঢুকতে বেশ দেরি হয়ে গেল। ফুফু বলল, “আজ এত দেরি করলি? কোথাও আড্ডা দিস নাকি?”

ক্লান্ত চোখে ফুফুর দিকে তাকালাম। তিমু বলল, “আড্ডা দেবে কেন? জায়েদার সাথে পড়াশোনা করে।”

ফুফু ভীষণ অবাক হলো। বিস্মিত গলায় বলল, “জায়েদা কে? এত রাতে মেয়ের বন্ধুর সাথে পড়ছিলি?”

“না ফুফু। জায়েদা আমার ক্লাসমেট না৷ বাচ্চা মেয়ে। সিক্সে পড়ে।”

“ওহ! তোর কোন বন্ধুর বোন টোন হবে। সে যাইহোক। হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়। সবাই বসে আছে। খালার ইচ্ছে সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে খাবে।”

হাত-মুখ ধুয়ে খেতে চলে গেলাম। শরীর চলছে না। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। খাওয়ার সময় রাঙা দাদি গহনার প্রসঙ্গ তুললেন। কঠিন মুখে বললেন, “বড় খোকা আমি এসব কী শুনি?”

বাবা ভাত চিবুতে চিবুতে বললেন, “কী শুনেছেন?”

রাঙা দাদি বললেন, “আপা বড় বউয়ের গহনা খুলে নিয়েছে– এ কথা তুই জানিস না?”

বাবা ভাবলেশহীন গলায় বললেন, “জানি।”

“জানার পরেও কিছু বলিসনি?”

“কী বলব?”

ভেবেছিলাম ব্যাপারটা এখানে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু হলো না৷ রাঙা দাদি সবাইকে অবাক করে দিলেন। বরফ শীতল গলায় বললেন, “বড় খোকা, আগে-পরে কখনো তোকে এমন মেরুদণ্ডহীন কাপুরষ মনে হয়নি। মেয়েমানুষের কাছে গহনা শুধু অলংকার না। সম্মানেরও। বড় বউকে দেওয়া গহনা ফেরত নিয়ে ছোট বউকে দেওয়া শুধু খারাপ কাজ না। রীতিমতো বড় বউকে অপমান করা। কঠিন অপমান। স্বামী হয়ে বউয়ের এমন অপমান তুই মেনে নিলি?”

বাবা পাংশুমুখে তাকালেন। রাঙা দাদি বললেন, “বউকে ছোট করে বাকিদের বড় করা মানে বউকে অপমানের সুযোগ করে দেওয়া। শ্বশুর বাড়িতে স্বামী যদি এমন কাপুরুষ হয়, তাহলে মেয়ে মানুষের দুঃখের শেষ থাকে না।”

বাবা থালার ভাত চটকাতে লাগলেন। কাঁপা গলায় বললেন, “আমি ওকে ওইসব গহনা গড়িয়ে দেব। টাকা জমাতে শুরু করেছি।”

এতটুকু কথা বলতে বাবার গলা কাঁপছে। তিনি আর একটা কথাও বললেন না। হাত ধুয়ে উঠে পড়লেন। দাদি বললেন, “তুই এসেই ঝামেলা শুরু করেছিস ছোট। ঝামেলা করতে আমার বাড়িতে এসেছিস?”

রাঙা দাদি একটুও রাগলেন না। শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, “ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে না পারা লোকেদের বিপক্ষের কথাকে ঝামেলা মনে হয়।”

তিনিও আর খেলেন না। উঠে চলে গেলেন। ছোট চাচা বলল, “এই বাড়ির কেউ আমার ভালো সহ্য করতে পারে না। আসতে না আসতেই খালাকে এই গহনার কথা কে বলেছে?”

দাদি তার কথার জবাব দিলেন না। মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাঙা দাদির কথায় ভুল নেই। তবুও সবার সামনে বাবাকে এমন করে বলার ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না। একটুও ভালো লাগল না। কোন রকমে খেয়ে ঘরে চলে এলাম।

ঘরে ঢুকতেই তিমু বলল, “জায়েদার সাথে দেখা হয়নি?”

“এ কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

“তেঁতুলগুলো ফেরত নিয়ে এলে যে? জায়েদা আসেনি?”

“না, ওর সাথে দেখা করার সুযোগ পাইনি।”

“সুযোগ পাওনি? প্রিয় মানুষের জন্য মানুষ কত অপেক্ষা করে। আর তুমি সুযোগ পাওনি?”

“এসব কী বলছিস?”

“জায়েদা তোমার প্রেমিকা না?”

সারাদিনের কাজ পর তিমু এমন অবান্তর কথা সহ্য হলো না। কর্কশ গলায় বললাম, “এইসব ভুলভাল কথাবার্তা বলে আমার খাস না।”

তিমু বলল, “আমি তোমার মাথা খাচ্ছি? বিরক্ত হচ্ছো?”

“হ্যাঁ, খাচ্ছিস। তোর উপস্থিতি ভীষণ রকমের বিরক্তির কারণ। দয়া করে যা।”

তিমু ছলছলে চোখে আমার দিকে তাকাল। তারপরই বেরিয়ে গেল। ওর দিকে নজর দিলাম না৷ মনের মধ্যে ভীষণ রকমের অশান্তি হচ্ছে। শরীরও ক্লান্ত। আমার বাবা মাকে কেউ অপমান করুক এটা আমার চাই না। এই ব্যাপারটা কুৎসিত। ভীষণ রকমের কুৎসিত।

চলবে

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply