Golpo romantic golpo তোমার হাসিতে

তোমার হাসিতে পর্ব ৫


তোমার_হাসিতে ৫

ফারহানাকবীরমানাল

৫.
তিমু সরল চরিত্রের মেয়ে। অন্তত আমার ধারণায় তেমনটাই জানতাম। আজ হঠাৎই আমার সেই ধারণা বদলে গেল। ব্যাপারটা শুধু আমার সাথে ঘটলো এমন নয়। বাড়ির বাকি সবার ধারণাও বদলে গেল। সাদাসিধে ছোট্ট মেয়েটা খুব বড় একটা কথা বলে ফেলল। সে বলল, “হবু মামানির এক ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে। ছোট মামার সাথে বিয়ের দিনে সে ওই ছেলের সাথে পালিয়ে যাবে। তোমাদের দেওয়া গহনাগুলো সাথে নিয়ে যাবে বিধায় বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। না হলে বিয়ের আগেই পালিয়ে যেত।”

তার কথায় ছোট চাচা কাঁপতে শুরু করল। চায়ের কাপ রেখে তেড়েফুঁড়ে উঠল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “এই ধরনের কথা বলার সাহস কোথায় পেয়েছ? কে তোমাকে এসব কথা বলেছে?”

তিমু একটুও বিচলিত হলো না। আগের চেয়েও শান্ত গলায় বলল, “আমার কথাগুলো খুবই সিরিয়াস। তোমরা এত সহজে এই কথা নিতে পারবে না। তবে আমি একটুও মিথ্যে বলছি না।”

“মিথ্যে বলছ না? তাহলে বলো। এসব কথা তুমি কোথা থেকে জানলে? কে তোমাকে এমন কথা বলল? তানহা বলেছে?”

তিমু খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ডানে বামে মাথা দোলালে লাগল। ছোট চাচা আগের চেয়েও কঠিন মুখে বলল, “চুপ করে থাকার জন্য প্রশ্ন করিনি। আমার কথার জবাব দাও।”

“স্বপ্নে দেখেছি।”

“স্বপ্নে দেখেছ? সামান্য স্বপ্নে দেখে এত বড় কথা বলে ফেললে?”

তিমু মাথা নিচু করে ফেলল। তার চোখ-মুখ আগের মতই শান্ত। দাদি বললেন, “এমন স্পর্শকাতর ব্যাপার নিয়ে মজা করছ? এগুলো কিন্তু খুব খারাপ। তোমার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের কাছ থেকে এমন কিছু আশা করা যায় না।”

“মজা করছি না। সত্যি বলছি। আমি স্বপ্নে দেখেছি…”

তিমু তার কথা শেষ করতে পারল না। এর আগেই ফুফু ওর গালে খুব জোরে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিলো। তিমু মেঝেতে পড়ে গেল। কাঁদল না, কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। ফুফু একটা থা’প্প’ড় মে’রেই ক্ষান্ত হলো না। ছোট বাচ্চাদের মত করে তিমুকে মা’র’তে লাগল। দাদি বললেন, “ওকে মে’রে কী হবে? এই বাড়িতে কানপড়া দেওয়ার লোকের অভাব আছে নাকি?”

কথাগুলো বলেই তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি তার কথার জবাব দিলাম না। নিজের ঘরে চলে এলাম। বসার ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। ছোট চাচা খুব জোর চিৎকার করছে। ফুফু দাদি সবাই মিলে তিমুকে নানান কথা বোঝাচ্ছে। এতসব কথার মাঝে একবারও মায়ের গলা পেলাম না৷ বোধকরি সে কোন কথা বলেনি৷ বললেই সবাই তাকে ঘিরে ধরবে। মা বুদ্ধিমতী। খুব না হলেও মোটামুটি ধরনের বুদ্ধি তার আছে। সে এসব ঝামেলায় জড়াবে না।

রাতে কেউ খাওয়ার কোন আগ্রহ দেখাল না। ফুফু তিমুকে মে’রে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। সে এক গ্লাস দুধ খেয়ে তড়িঘড়ি করে শুয়ে পড়ল। ছোট চাচার মেজাজ খারাপ। তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে যে-সব অশান্তি শুরু হয়েছে সেগুলো সে মানতে পারছে না। অতিরিক্ত ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে মুখের উপর কিছু বলতেও পারছে না। নিজে নিজে ফোঁস ফোঁস করছে। একমাত্র দাদিই একটু গুছিয়ে খেলেন। খাওয়া শেষে মা’কে ডেকে বললেন, “খাবারদাবার সব গুছিয়ে রেখে দাও। ছেলেটার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে এই বাড়িতে যা শুরু হয়েছে। মানুষের কুনজর লেগেছে। আমার ছেলের সুখ কেউ সহ্য করতে পারছে না। বাড়িতে মিলাদ দিতে হবে।”

মা তার কথার জবাব দিলো না, অল্প হাসল।

বরাবরই আমার শীত একটু বেশি। মা বলে আমি খুব শীতকাতুরে। রাতের বেলা একটা কম্বল একটা লেপ গায়ে চাপিয়েও মাঝেমধ্যে শীত মানায় না। আজকেও মানাচ্ছে না। ঘরের জানালা বন্ধ করা হয়নি। জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। বরফ শীতল বাতাস। কম্বলের ভেতর থেকে বেরিয়ে জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে করল না৷ ওভাবেই গুটিসুটি মে’রে পড়ে রইলাম।

শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঠিক খেয়াল করতে পারছি না। ঠান্ডা কমেনি। গায়ের কম্বলটা আর একটু জড়িয়ে নিয়ে লম্বা হাই তুললাম। কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মেয়ে মানুষের কান্না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এত রাতে কে কাঁদছে?

তিমু বেলকনির কোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। পায়ের শব্দ শুনে এক পলক পেছন ঘুরে তাকাল। ভেজা গলায় বলল, “তুমি এখানে কেন এসেছ?”

“কান্নার শব্দ শুনে দেখতে এলাম। এত রাতে এই ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদছিস কেন? ফুফু মে’রে’ছে সেজন্য?”

“না, সেজন্য কাঁদছি না।”

“তাহলে কেন কাঁদছিস? গায়ে ব্যাথা করছে?”

“না, গায়ে ব্যাথা করছে না।”

“তাহলে?”

“সবার মত তুমিও আমার মিথ্যাবাদী মনে করেছ, তাই না?”

“না। তা মনে করব কেন? তুই তো মিথ্যে কথা বলিসনি। যা স্বপ্নে দেখেছিস তাই বলেছিস। এখানে তো মিথ্যের কিছু নেই।”

“তাহলে সবাই এমন করল কেন? মা কেন আমাকে এত মা’র’ল?”

“আমাদের দেখা স্বপ্নগুলো নিজের কাছে সত্যি মনে হয় ঠিকই, তবে বাস্তবে এর কোন ভিত্তি নেই। তাছাড়া কোন ধরনের প্রমাণ ছাড়া তুই কারো উপর এমন অভিযোগ তুলতে পারিস না।”

তিমু আবারও কাঁদতে শুরু করল। আমি বললাম, “কাঁদিস না তিমু। তোর কান্নার শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যাবে।”

“গেলে যাবে।”

“বাচ্চাদের মত করিস না। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

“তুমি দেখো– বিয়ের দিনই হবু মামানি পালিয়ে যাবে। সমস্ত গহনাপত্র নিয়ে পালিয়ে যাবে।”

“গেলে যাবে। তোকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই ঘরে যা। এখানে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“লাগলে লাগবে। আমার কিছু হলে কার কী?”

“বোকাদের মত কথা বলিস না।”

“বলব। আমি তো বোকাই। বোকাদের মত কথা বললে আমার কোন দোষ হবে না।”

অদ্ভুত ঝামেলায় পড়লাম। আমি আর এক মুহুর্তও এখানে দাঁড়াতে পারছি না। ঠান্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছে। তিমুটাও ঘরে যেতে চাইছে না। ওকে এখানে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে। রাতভর ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে জ্বর-টর বাঁধিয়ে ফেলবে। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলাম। যথাসম্ভব কোমল গলায় বললাম, “তিমু, ঘরে যা। তোর ঠান্ডা লেগে যাবে।”

তিমু বলল, “তুমি আমাকে তুই তুই করে কথা বলবে না। তুমি বলবে।”

“কি বলব!”

“তুমি করে বলবে। এই যেমন মাত্রই বললে– তিমু, ঘরে যা। তোর ঠান্ডা লেগে যাবে। এই কথাটাই তুমি করে বলবে। বলবে যে– তিমু, ঘরে যাও। তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।”

ওর কথায় ভীষণ রকমের বিরক্ত হলাম। ছোটবেলা থেকে তুই করে বলছি। আজ হঠাৎই তাকে তুমি বলতে হবে। কী অদ্ভুত আবদার! তবে বিরক্তি প্রকাশ করলামনা। যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললাম, “তিমু, ঘরে যাও। তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।”

তিমু এক পলক তাকাল। তারপরই ঘরে চলে গেল। আমিও বিছানায় এসে লেপ কম্বলের ভেতরে হাত পা চুবিয়ে দিলাম। ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। এক্ষুনি মায়ের গলা পাওয়া যাবে। সে খুব কোমল গলায় বলবে, “সাজ্জাদ, নামাজ পড়তে ওঠো।”

খুব ইচ্ছে করল আজ আগে আগে উঠে মাকে চমকে দিই। দিলাম না। বিছানায় পড়ে রইলাম। মায়ের ডাক শুনতে ভালো লাগে। ভীষণ রকমের ভালো লাগে।

আজকে আর কলেজ যাওয়া হয়নি। বাদশা গিয়েছে। ওকে বলেছি– স্যার আমার খোঁজ করলে জানাতে। স্যারের আমাকে খোঁজ করার কারণ নেই। তবুও বলে এসেছি। তবে কী আমি তিমুর ওই উদ্ভট স্বপ্নে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি? হয়তো হ্যাঁ। ওই স্বপ্নে আশা আছে। সেজন্যই বোধহয় বিশ্বাস করছি।

ধান ক্ষেতে কেউ নেই। কোমরে গামছা বেঁধে নিয়েছি। কাজ শুরু করব। ঠিক সেই সময়ে বাদশার মামা এলেন। তার হাতে প্লাস্টিকের টিফিন বাক্স। তিনি বাক্সটা আমার হাতে দিলেন। সহজ গলায় বললেন, “ভাপা পিঠা আছে। খেয়ে নাও।”

“জ্বি?”

“আহা! দুপুরের খাবার না। এমনিতেই দিলাম। তোমার মামি বানালো। খেয়ে নাও। এমন স্বাদের পিঠে আগে-পরে খেয়েছ বলে মনে হয় না।”

আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালাম। মামা চলে গেলেন। রোদের তাপ ভালো। কাজ করতে আরাম লাগছে। আজ বিকেলে জায়েদার সাথে দেখা করতে হবে। মেয়েটা তানহার ব্যাপারে খোঁজ দিবে বলেছিল। কিছু জানতে পারল কি-না কে জানে।

দুপুরে খাবার ভালো, তবে আমার পছন্দ না। ছোট মাছ রান্না, লাউ পাতার বড়া। মলা ঢেলা মাছ কোন কালেই আমার পছন্দ না। কাটা বেছে খেতে পারি না। আজকেও পারলাম না। লাউ পাতার বড়া দিয়ে কোন রকমে খেয়ে উঠলাম। কাজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দেরি করা যাবে না। বিকেলের আগে কাজ শেষ করতে হবে।

জায়েদা দু’পাশে দু’টো বেণী করেছে। কানের একপাশে দু’টো গোলাপ ফুল গুঁজে রেখেছে। ভালো লাগছে দেখতে। মেয়েটা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই হাসল। মাথা নিচু করে চাপা গলায় বলল, “আগেরদিন এলেন না যে?”

“কাজ ছিল। কিছু জানতে পারলে?”

“জেনেছি।”

“কি জেনেছ?”

“ওই যে সরকারি চাকরিজীবী ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। তানহা আপুর তাকে পছন্দ না। বিয়ে করতে চায় না। সে কোন এক ছেলেকে পছন্দ করে রেখেছে, তাকে বিয়ে করতে চায়।”

“এ কথা তোমাকে কে বলল?”

“এই নিয়ে আপুর মা আপুকে খুব মে’রে’ছে। আমি তখন ওদের বাড়িতে তেঁতুল চাইতে গিয়েছিলাম। আমাকেও খানিকক্ষণ বকাবকি করল।”

“তোমাকে বকলো কেন?”

“তেঁতুল চেয়েছিলাম বলে।”

”তেঁতুল পছন্দ?”

“খুব পছন্দ।”

“ঠিক আছে। আমি তোমাকে তেঁতুল এনে দেব।”

জায়েদার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝলমলে গলায় বলল, “তানহা আপুর সাথে আমার খুব ভাব হয়েছে। ওইদিন আপু মা আপুকে মা’রার পর আমি ওষুধ নিয়ে গিয়েছিলাম। আপু আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতে বলল– জায়েদা আমি ওই বুড়ো লোকটাকে বিয়ে করতে চাই না। লোকটা আমার চেয়ে এগারো বছরের বড়। গুণে গুণে এগারো বছর।”

“আর কী বলল?”

“আর কিছু বলেনি। কেঁদেছে।”

“আচ্ছা। তুমি এখন যাও। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।”

জায়েদা চলে গেল। সন্ধ্যায় বাদশার সাথে দেখা। টিউশন পড়তে গিয়েছিল। আমাকে দেখেই থাকল।

“স্যার তোকে খোঁজেনি।”

“ওহ আচ্ছা! ঠিক আছে।”

“ঠিক আছে। তোর কাজ কেমন চলছে?”

“ভালো চলছে। দুই চারদিনেই সব ধান কা’টা হয়ে যাবে।”

“তাহলে তো খুব মুসকিল। তোর টাকার জোগাড় হবে না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অল্প হাসলাম। বাদশা বলল, “আমার কাছে অন্য একটা কাজের সন্ধান আছে।”

“কী কাজ?”

“গরুর দুধ ডেলিভারি দিতে হবে। তবে বেতন খুব অল্প।”

“হোক অল্প। কোথায় ডেলিভারি করতে হবে?”

“তা তো ঠিক জানি না। আমার এক বন্ধু বলল। ওদের গরুর ফার্ম আছে।”

“কোন বন্ধু?”

“আজকেই পরিচয় হলো। টিউশনিতে এসেছে।”

বাদশা খুব বাঁচাল। প্রচুর কথা বলে। খুব সহজেই মানুষকে নিজের বন্ধু বানিয়ে ফেলে।

আমাদের বাড়িতে তেঁতুল গাছ আছে। গাছ ভর্তি কাঁচা তেঁতুল। এখনও পাকতে শুরু করেনি। সকাল সকাল হাত-মুখ ধুয়ে তেঁতুল গাছের কাছে এসে দাঁড়ালাম। গাছে উঠতে আমার কোন সমস্যা হয় না। কাঠবিড়ালির মত তরতর করে গাছে উঠতে পারি তেঁতুল পাড়া শেষ হতেই তিমু এসে গাছের নিচে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে বলল, “এত তেঁতুল দিয়ে কী হবে?”

“জায়েদাকে দেব। কাল বলল তেঁতুল ওর খুব পছন্দ। তাই পাড়লাম।”

তিমু খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কিছু না বলে ঘরে চলে গেল।

চলবে

আমার লেখা ই-বুকসমূহ পড়ুন বইটই অ্যাপে। অ্যাপ লিংক কমেন্ট বক্সে

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply