তোমার_হাসিতে
ফারহানাকবীরমানাল
৪.
রোদের তেজ বেড়েছে। তাপ সহ্য করা যাচ্ছে না। সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। এরমধ্যে দুই লিটার পানি খেয়ে ফেলেছি৷ তবুও তেষ্টা মিটছে না। ধান কা’টার কাজ এত কঠিন আগে জানা ছিল না। তবে কাজ করতে খুব একটা খারাপ লাগছে না। তেমন অসুবিধাও হচ্ছে না। বলা যায় ভালোই লাগছে। নতুন কাজের নতুন অভিজ্ঞতা।
ধান ক্ষেতের ধারে একটা কচুগাছ। গাছে দু’টো লতি ধরে আছে। লম্বা হয়ে দু’দিকে চলে গিয়েছে। মা কচুর লতি খেতে খুব পছন্দ করে। তবে আমাদের বাড়িতে কখনো এই খাবারটা রান্না করা হয় না। দাদির এলার্জি আছে। ছোট চাচা পছন্দ করে না। কাজেই বাবা কখনো বাজার থেকে এই বস্তুটি কিনে আনেন না। মা বললেও আনেন না। এড়িয়ে যান। হঠাৎই মন খারাপ হয়ে এলো। কচু গাছের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। বাদশা বলল, “দুপুর হয়ে গেছে। আমি গিয়ে খাবার নিয়ে আসব?”
“নাহ! তোর যেতে হবে না। আমি গিয়ে খেয়ে আসব।”
“কাজ করছিস জানলে আংকেল তোকে বকবে না?”
“আপাতত কাউকে কিছু বলব না।”
“কিছু বলবি না? কিন্তু বাড়িতে ফিরতে তো রাত হয়ে যাবে। প্রশ্ন করবে না?”
“মাকে বলে এসেছি– আনি তোর মামাবাড়িতে। কাজের কথা বলিনি। এমনি ঘুরব বলেছি। দেরি হলে খুব একটা চিন্তা করবে না।”
“তোর গা কুটকুট করছে নাকি?”
“করছে। ভীষণ রকমের কুটকুট করছে। সমস্যা নেই। মানিয়ে নিতে পারছি।”
“তা ভালো। তোর মা অনেক ভাগ্যবতী। তুই তার জন্য কত কষ্ট করছিস।”
“জানিস? মা আমাকে অনেক যত্ন নিয়ে মানুষ করেছে। আমার গায়ে কখনো ফুলের টোকা লাগতে দেয়নি। এখনও একটু রোদে দাঁড়ালে চিল্লাপাল্লা শুরু করে। যেন রোদে দাঁড়ানোর কারণে আমার শরীরে কিছুক্ষণের মধ্যে ফোসকা পড়ে যাবে।”
বাদশা আমার কথার জবাব দিলো না, হাসল।
মায়ের মুখে শুনেছি আমার নানার অনেক ধানিজমি ছিল। একবারে একশ দেড়শ মণ ধান উঠত। ঘরে বছরের চাল রেখে বাকি ধান সস্তা দামে বিক্রি করে দিত। বছরের চাল ঘরে, টুকটাক সদাই-পাতির অভাব পড়লে গায়ে লাগত না। দিব্যি চলে যেত। নানার সেই ধানিজমি এখন আর নেই। বিক্রি করে দিয়েছে। একদিন হঠাৎই সে জমির দলিলপত্র নিয়ে হাঁটা শুরু করল। নানি জিজ্ঞেস করতে বলল, “জু’য়ায় হেরে গেছি। জমি দিতে হবে।”
সেই শুরু। তারপর থেকে সে জমির এতটুকুও অবিশিষ্ট থাকেনি। সব শেষ হয়ে গিয়েছি।
কাজ শেষ হতে সন্ধ্যা নেমে গেল। জায়েদার সাথে দেখা করার সুযোগ পেলাম না। মেয়েটা কিছু বলতে পারত কি-না কে জানে! কাল একটু আগে কাজ শেষ করতে হবে। জায়েদার সাথে দেখা করা জরুরি। সময় নষ্ট করা যাবে না।
সব কাজ শেষে গোসল করে ফেললাম। বারবার করে সাবান ঢলেও গা কুটকুট করা কমেনি। অল্প হলেও রয়ে গেছে৷ বাদশা আমাকে খানিকটা পথ এগিয়ে দিলো। উৎসাহী গলায় বলল, “তোর গায়ে ব্যাথা হয়নি?”
“হয়েছে কি-না বুঝতে পারছি না।”
“হে হে! এখন বুঝতে পারছিস না৷ বাড়িতে গিয়ে এক ঘুম দেওয়ার পর বুঝতে পারবি।”
বাদশা খুব উঁচু গলায় হাসতে লাগল। আমি কোন জবাব দিলাম না। হাতের ব্যাগটা একটু শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। অটোরিকশা এলে তাতে উঠে পড়ব।
মা কচুর লতি দেখে ভীষণ অবাক হলো। খুশিখুশি গলায় বলল, “লতি কোথায় পেয়েছিস?”
“বাদশার মামাবাড়িতে গিয়েছিলাম। ওখানেই দেখলাম অনেকগুলো গাছে লতি ধরে আছে। খেতে ইচ্ছে করল তাই নিয়ে এলাম।”
“খুব ভালো করেছিস। ঘরে কুচোচিংড়ি আছে। বেশ জমিয়ে রান্না করব।”
মা খুব আগ্রহ নিয়ে লতিগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “এই লতি খুব ভালো। কেমন মোটা দেখেছিস? রাঁধলে খেতে খুব ভালো লাগবে।”
আমি শান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনের ভেতরে শান্তি লাগছে। অনেকদিন হলো মাকে এত খুশি দেখিনি।
ফুফু কী কাজে মায়ের কাছে এসেছিল। লতি দেখে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল। বিরক্ত গলায় বলল, “এইসব কে এনেছে? মায়ের এলার্জি আছে৷ ছোট ভাই খায় না। তার উপর এগুলো খেলে গলা ধরে।”
“ঠিকমতো রাঁধতে পারলে গলা ধরে না আপা। আমার তো খুব ভালো লাগে।”
“ভালো লাগে! তোমার ভালো লাগে বললেই হলো নাকি? বাড়ির কেউ এসব খায় না। শুধু শুধু একা মানুষের জন্য টাকা দিয়ে এই ছাই ছাতা কিনে আনার কোন মানে হয় না। সবুর বাড়িতে আসুক। দিনদিন ও এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যাচ্ছে বিশ্বাসই করতে পারছি না।”
“আপনার মানে হওয়ার তো কোন দরকার নেই ফুফু। আপনি তো এগুলো কিনে আনেননি। আব্বাও আনেনি। আমি এনেছি। তা-ও আমার বন্ধুর মামাবাড়ি থেকে। এখানে আপনার এত কথার কী আছে?”
“বন্ধুর মামাবাড়িতে গিয়েছিলি বুঝি? তোর বাবা জানে?”
“জানে। আর না জানলেও কোন সমস্যা নেই। আমি এমন কিছু করে ফেলিনি যা জানলে তার মানসম্মান চলে যাবে। আপনি বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন, ঠিকমতো থাকবেন, খাবেন, ঘুরবেন, ফিরবেন। অহেতুক সংসারে কাজে নাক গলিয়ে ঝামেলা বাঁধানোর তো কিছু দেখি না।”
ফুফু চোখ বড় করে ফেলল। কর্কশ গলায় বলল, “মুখে মুখে চোপা করা শিখেছিস দেখছি।”
“মুখে মুখে চোপা করছি না। আপনি যে কথাগুলো বললেন আমি শুধু সেসব কথার দিয়েছি।”
ফুফু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। মা তাকে থামিয়ে দিলো। আমার দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল, “বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানিস না নাকি?”
আমি মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বাবার বাড়িতে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। এসে এসব শুনলে আবার ঝামেলা শুরু হবে। বোধহয় সেজন্যই মা সবটা মিটিয়ে দিতে চাইল। ফুফু বলল, “যাকগে! তোমাদের ছেলে, ভালো খারাপ তোমরা বুঝবে। আমার কী? আমি যেটা বলছিলাম তিমু শরীরটা ভালো লাগছে না। ভাত খাবে না বলছে। ওকে এক প্যাকেট নুডলস রান্না করে দাও তো।”
মা মাথা দুলিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগল না৷ ফুফু দিব্যি সুস্থ মানুষ। এই সামান্য কাজটুকু করতে তার খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা না। বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘরে চলে এলাম। তানহা এখনও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেনি। ফেজবুক আইডি লক করা। বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই।
খানিকক্ষণ শুয়ে থাকার পরই গায়ের ব্যাথা অনুভব করতে পারলাম। মনে হচ্ছে কেউ আমাকে বেধড়ক মার মে’রে’ছে। হাত পা নড়াতে পারছি না। ধান কা’টায় খুব একটা সমস্যা হয়নি। ধানের বোঝা বয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিতে গিয়ে এই দশা। গায়ে ব্যাথার খুব দারুণ একটা ওষুধ আমার জানা আছে। চৈঝাল ও কালোজিরা ভর্তা। মা খুব চমৎকার করে বানায়। বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালাম।
মা রান্নাঘরে বসে কচুর লতি কুটছে। সে আমাকে দেখেই হেসে ফেলল। আমি বললাম, “এখন রাঁধবে?”
“হ্যাঁ, খুব বেশি রাত হয়নি। নিয়ে এসেছিস, রান্না করে ফেলি।”
“করো। আমাকে তোমার ওই ব্যাথা কমানোর ভর্তাটা বানিয়ে দেবে? গায়ে খুব ব্যাখা হয়েছে।”
“গায়ে ব্যাথা হলো কী করে?”
“বাদশার মামা ধানের বোঝা তুলছে পারছিল না৷ তাই সাহায্য করে দিলাম।”
“তা ভালো করেছিস। এখন গিয়ে একটু শুয়ে থাক।”
“আচ্ছা” বলে নিজের ঘরে চলে এলাম। মা’কে একটা মিথ্যে কথা বলা হয়ে গেল। সুস্থ সবল শরীরে সজ্ঞানে মিথ্যে বলার জন্য মনে মনে তওবা কাটলাম। সত্যিটা বলে দিলে মা কখনো আমাকে কাজ করতে দিতো না। কঠিন মুখে বলত, “আমার ওসব গহনার প্রয়োজন নেই। তোমার কোন কাজ করতে হবে না।”
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাসে বের করে দিলাম। রাতে খাওয়ার সময় ফুফু আমার থালার দিকে তাকাল। সরু গলায় বলল, “চিংড়ি মাছ দিয়ে লতি ভাজা করেছ?”
মা মাথা দোলালো। ফুফু বলল, “আমার একটু দাও তো। খেয়ে দেখি কেমন হয়েছে।”
ইচ্ছে করল দু’টো চারটে কঠিন কথা শুনিয়ে দিই। তবে কিছু বললাম না। চুপচাপ খেয়ে চলে এলাম। সারাদিন কাজের পর বই পড়তে একটুও ইচ্ছে করল না। বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলাম। কাল সকালে একবার কলেজে যেতে হবে। বাদশার মামাকে বলে এসেছি। তিনি অমত করেননি। স্বাভাবিক মুখে বলেছেন, “আজ অনেক কাজ করছ। কাল এমন করে পুষিয়ে দিতে পারলে আমার সমস্যা নেই। আর না পারলে অর্ধেক বেতন নিবে। সমস্যার কিছু নেই। নিশ্চিতে থাকো।”
ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে এসেছিল। ফিসফিস শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি ছোট চাচা ফোনে কথা বলছে। শুধু কথা বলছে না। কথা বলতে বলতে হাসছে। নিশ্চয়ই তানহার সাথে কথা বলছে। তার সাথে কথা বলার সময়ে ছোট চাচা খুব হাসে। দেখে মনে হয় সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
স্যার বই রিভিউ-এর রেজাল্ট ঘোষণা করেছেন। পুরষ্কারটা আমি পাইনি। চাঁদনী পেয়েছে। এই মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো না। সারাক্ষণ গল্পের বই নিয়ে পড়ে থাকে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে লাইব্রেরিতে বসে থাকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পুরষ্কারটা ওরই প্রাপ্য। তবুও আমার মন খারাপ হয়ে গেল। এক হাজার টাকা পেলে অনেকটা এগিয়ে যেতাম। বাদশার মামার ধানিজমি খুব বেশি না। একদিনেই অনেকটা ধান কা’টা হয়ে গেছে। এভাবে চললে সাত আট দিনে কাজ শেষ হয়ে যাবে। অর্ধেক টাকাও জোগাড় হবে না। কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। মন খারাপ করে কাজ চলে গেলাম। দিনটা ওভাবে কাটল।
সন্ধ্যায় তিমু আমার কাছে এলো। ঝলমলে গলায় বলল, “রিভিউ প্রতিযোগিতার রেজাল্ট দিয়েছে? তুমি জিতেছ?”
“না, আমি পুরষ্কার পাইনি।”
“কে পেয়েছে? একটা মেয়ে?”
“হুম। একটা মেয়ে পেয়েছে। কিন্তু তুই কীভাবে বুঝলি?”
“স্বপ্নে দেখেছি। আমি আরও একটা ব্যাপার স্বপ্ন দেখেছি।”
“কী দেখেছিস?”
“তুমিও পুরষ্কার পাবে। কালকের ক্লাসেই স্যার সেটা ঘোষণা করবে। তুমি কিন্তু ক্লাস মিস দেবে না।”
“দেব না। আর কিছু বলবি?”
“বলব। তবে তোমাকে বলব না। সবার সমানে বলব। বসার ঘরে এসো।”
“যেতে ইচ্ছে করছে না।”
“ইচ্ছে না করলেও চলো। আমার কথাগুলো খুবই ভারী। শুনলে হঠাৎ করে জিহ্বার উপর গরম চা পড়ে যাওয়ার মত অনুভূতি পাবে।”
“তবুও ইচ্ছে করছে না।”
তিমু আমাকে ছাড়ল না। বসার ঘর পর্যন্ত নিয়ে তারপরই থামল। শান্ত গলায় বলল, “তোমাদের সবার সাথে আমার একটা কথা আছে।”
দাদি বললেন, “আমাদের সাথে তোমার কী কথা? ছোট মামার বিয়েতে ব্যান্ডপার্টি আনতে চাও নাকি?”
“না। ব্যান্ডপার্টি আনতে চাই না।”
“তাহলে কী বলবে?”
“কথাটা হবু মামানিকে নিয়ে।”
ছোট চাচা সোফায় বসে চা খাচ্ছিল। মুখের সামনে থেকে কাপ সরিয়ে বিস্মিত গলায় বলল, “তাহনাকে নিয়ে কী বলবে?”
তিমু বলল, “আমার কথাগুলো খুব সিরিয়াস। শুনেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতে পারবে না।”
আমি তিমুর দিকে তাকালাম। তার চোখমুখ শান্ত। ঝড় আসার আগে পরিবেশ যেমন শান্ত থাকে, তেমনই শান্ত। কী বলবে তিমু? তানহার ব্যাপারে সে কী এমন জেনেছে?
চলবে
Share On:
TAGS: তোমার হাসিতে, ফারহানা কবীর মানাল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
তোমার হাসিতে গল্পের লিংক
-
তোমার হাসিতে সূচনা পর্ব
-
তখনও সন্ধ্যা নামেনি পর্ব ১
-
তখনও সন্ধ্যা নামেনি গল্পের লিংক
-
তখনও সন্ধ্যা নামেনি পর্ব ২
-
তোমার হাসিতে পর্ব ২
-
তোমার হাসিতে পর্ব ৫
-
তখনও সন্ধ্যা নামেনি পর্ব ৩
-
তোমার হাসিতে পর্ব ৩