Golpo romantic golpo তাজমহল সিজন ২

তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৪


#তাজমহল#দ্বিতীয়_খন্ড

#পর্ব_৪

#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

কনকনে ঠান্ডা পড়ছে। কম্বলের উম থেকে শাইনার উঠতে ইচ্ছে করছে না। ভোরের কাকের ডাক শোনা যাচ্ছে। অবশ্য কম্বলের উম ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাজদার সিদ্দিকীর গায়ের উষ্ণতায়। শাইনাকে একটা হাত এমন সুকৌশলে জড়িয়ে ধরে রেখেছে শাইনা নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারছেনা। ফোন হাতড়ে খুঁজে নিল সে। সময় এখনো সাড়ে ছ’টা। সে আবারও তাজদার সিদ্দিকীর দিকে তাকালো। তাজদারের চোখজোড়া বন্ধ। ঘুমালে সব মানুষকেই নিষ্পাপ লাগে। তাজদার সিদ্দিকীও তার ব্যতিক্রম নয়। শাইনা তাকে জড়িয়ে ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো তারপর চেষ্টা করলো উঠে যেতে। কিন্তু লোহার মতো ভারী হাতটা তাকে পেঁচিয়ে রেখেছে। এভাবে উঠা সম্ভব নয়। শাইনা এবার বিড়বিড় করলো কিছু একটা। তাজদারের কানেও গেল না কথাটা। এভাবে হবে না। শাইনা ভাবলো সুড়সুড়ি দেবে। সে তাজদারের বুকের কাছে হাত নিয়ে গেল। শার্টের কয়েকটা বোতাম খোলা। শুরুতেই চোখ আটকে গেল সেলাইয়ের দাগে। চট করে শার্ট দিয়ে সে জায়গাটা ঢেকে দিল। গলা শুকিয়ে এসেছে। এত মোটা দাগ! এত বড়ো বড়ো সেলাই হয়েছে! সকাল সকাল তার শরীর খারাপ লাগতে শুরু করলো। তবুও পুরোটা দেখার ইচ্ছে সে দমাতে পারলো না। কাঁপা-কাঁপা হাতে শার্ট অনেকটা সরাতেই বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলো। ঠোঁট পর্যন্ত শুকিয়ে এল। সে চোখ বন্ধ করে নিয়ে শার্ট ছেড়ে দিয়ে ধীরেধীরে শ্বাস ছাড়তে লাগলো। তাজদার সিদ্দিকী ছোট ছোট চোখ করে তাকালো কিছুক্ষণ পর। সদ্য ঘুম ভেঙেছে। ঘুমের ভার চোখেমুখে লেপ্টে আছে।

“হোয়াট ইজ দিজ? আমার বুকের ভেতর লুকিয়ে চুরিয়ে কি দেখা হচ্ছে শাইনা মমতাজ?”

সে মজা করছে কিন্তু শাইনা সেটা নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। নিজেকে স্বাভাবিক করে তাজদারের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করলো। কিন্তু এবারও সম্ভব হলো না। তাজদার বোতাম আরও কয়েকটা খুলে দিয়ে বলল,”আরও ভালো করে চাইলে দেখতে পারো।”

শাইনা এবার লজ্জা পেল। চোখেমুখে সেটা ফুটে উঠলো। তাজদার তা দেখে মনে মনে হাসলো খুব। কিন্তু মুখ গম্ভীর রইলো। শাইনা তার দিকে বোতামগুলো লাগিয়ে দিয়ে বলল,”সব ক্ষতস্থান দেখাতে নেই এটা আপনার মতো মানুষের খুব ভালো করে জানার কথা না বাবুমশাই?”

তাজদার তার সম্বোধন শুনে বলল,”আই লাইক ইট!”

“কি? আশ্চর্য! “

“ডাকটা। মনে হয় তুমি অনেক আদর করে বাবুমশাই ডাকো।”

শাইনা একটু অপ্রস্তুত হলো। বলল,”অনেকদিন পর সবাই বাড়ি এসেছে। আমার আজকে সকালের চা’টা বসানো উচিত।”

তাজদার বোতামের সাথে তার চুল আটকে দিল। চোখ বন্ধ করে রইলো। শাইনা উঠলো একটুখানি। তার বুকের উপর ঝুঁকে চুলটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,”সারারাত কম জ্বালাননি। এখন যেতে দিন।”

তাজদার চট করে চোখ খুলে বলল,”আমি জ্বালিয়েছি? আমি ধরামাত্রই কাত হয়ে যায় কে?”

শাইনা অবাক হয়ে বলল,”আপনি জ্বালাননি? এতবড়ো মিথ্যেবাদী।”

“আমি জ্বালালেই তোমাকে জ্বলতে হবে কেন?”

শাইনা চুল ছাড়িয়ে নিতে লাগলো আবারও। এটা কেমন বদভ্যাস। বোতামের সাথে তার চুল লাগিয়ে দেবে। হিরো বনে যেতে চান সবসময়! উফ!

শাইনা একটা বোতাম থেকে চুল ছাড়িয়ে নিতেই তাজদার তার খোলা চুলে হাত গলিয়ে বোতামের সাথে আরও এলোমেলো চুল জড়িয়ে দিল। শাইনা এবার বিপাকে পড়ে কাঁদোকাঁদো দৃষ্টিতে তাকলো। তাজদার তা দেখেও বলল,

“এমনি এমনি তো আর আমার বুকের উপর উঠে আসবে না। তাই আমাকে এই কাজটা করতেই হলো।”

“আপনি খুব খারাপ…

তাকে থামিয়ে দিয়ে তাজদার বলল,”আমি খারাপ মানুষ সেটা জগত জানে। কিন্তু তুমি আজকাল ঘৃণা করছো না কেন? ভালো হওয়ার জন্য কিছু তো করিনি এখনো?”

“সকাল সকাল কি আমরা ঝগড়া করবো?”

“কত মানুষ এমন মিষ্টি যন্ত্রণার জন্য ছটফট করে জানো? স্বামীর বুকে উপর শুয়ে ঝগড়া করতে মহিলাগুলোর কপাল তো মারাত্মক। তুমি কপাল করেই এসেছ। বলো শুকরিয়া।”

শাইনা চুল ছাড়িয়ে নেয়ায় মনোযোগ দিল। সারারাত তাকে জ্বালিয়েছে। বুকে ব্যাথা করছে বলে ভয় দেখিয়েছে আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। সব চুল ছাড়িয়ে নিতে প্রায় অনেক সময় লাগলো। তাজদার আচমকা তাকে বুকের উপর থেকে আবার বুকের নিচে ফেলে দিল। কপাল কুঁচকে ফেলে বুকে হাত চাপা দিল। চোখমুখ কুঁচকে ফেলে চুপ করে রইলো। শাইনা বলল,”সবকিছু নিয়ে মজা করা যায় না। আপনাকে আমি কতবার বলেছি? কি হয়েছে? আমার কনুইয়ের ব্যাথা পেয়েছেন?”

তাজদার কিছুক্ষণ কথা বললো না। শাইনা বেশি উত্তেজিত হচ্ছে দেখে বলল,

“খেয়ালই করিনি এখানে একটা বড়ো সেলাই হয়েছে। কিভাবে চাপ দিয়েছ?”

শাইনা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তাকালো। শুকনো গলায় ঢোক গিললো। তাকে এত যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য আর কোনো মানুষ পায়নি আল্লাহ?

“এতবড়ো সেলাই আর আপনি আমাকে বুকে তুললেন কেন?”

শাইনা খুব আতঙ্কিত হয়ে কথাটা বলছে। তাজদার তাকে সেই ফাঁকে পুরোটাই আয়ত্তে নিয়ে ফেলে বলল,”তোমার মাথার চুল সাদা হয়ে যাবে কিন্তু তুমি আমাকে চিনতে পারবে না।”

শাইনা আকাশ থেকে পড়লো। হাঁ করে চেয়ে রইলো। আবারো বোকাবনে পাঠিয়েছে তাকে? সে ক্ষোভসমেত চেয়ে রইলো। সে নিজের সর্বশক্তি ব্যবহার করে তাজদারকে সরিয়ে দিতে যেতেই তাজদার বলল,”জুনিয়র কিন্তু দেখছে তুমি তার বাবার সাথে কি কি করছো।”

“আপনি আমার সাথে কি কি করছেন সেটাও দেখছে।”

“সিউর?”

শাইনা ভড়কে গেল তার প্রশ্নের ধরণ দেখে। মানে?

তাজদার তাকে বলল,

“রাতে কি করেছি সেটাও দেখেছে বলছো?”

শাইনা আশ্চর্য হয়ে বলল,”এসব কেমন কথা? আপনি না বাবা হতে যাচ্ছেন? আমি এ কোন এলিয়েনের পাল্লায় পড়লাম আল্লাহ?”

তাজদার বলল,”তুমি একটা ইচ্ছেধারী নাগিন। দিনের বেলায় ফণা তুলে ফোঁসফোঁস করো। আর রাতের বেলায় পেঁচিয়ে ধরো। আর সব দোষ হয়ে যায় আমার। যত দোষ তাজদার ঘোষ।”

“আমি পেঁচিয়ে ধরি? আপনি কি করলে আমি পেঁচিয়ে ধরি সেটাও বলুন।”

“ওকে, লেট মি এক্সপ্লেইন।”

শাইনা বুঝতে পারেনি মুখ ফস্কে কি বলে ফেলেছে। সে তাজদারকে আটকাতে গেল। মুখ চেপে ধরলো। তাজদার মুখ থেকে তার হাত সরিয়ে নিতে নিতে বলল,”আমি একটা ঢুসা মারলেই তুমি কাত হয়ে পড়ে যাও তারপর…

শাইনা আবারও মুখ চেপে ধরলো।

“না না ছিঃ!”

তাজদার তার দু-হাত চেপে গালে নাক চেপে দিতে দিতে বলল,”তারপর আমি তোমাকে এভাবে ওভাবে সেভাবে…

শাইনা চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখে অস্ফুটস্বরে কি কি যেন বলতে লাগলো। তাজদার সিদ্দিকী তার কান্ড দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। এত সকাল সকাল মানুষ এভাবে হাসে? শাইনা লজ্জায় আর না পেরে তার মুখ ঠেকিয়ে তাজদারের হাসি বন্ধ করতে চাইলো। তাজদার তার মুখ নামিয়ে এনে তার গালে চেপে দিয়ে কম্বলটা মাথার উপরে তুলে দিতে দিতে,”আল্লাহ আমি এটাকে রেখে লন্ডনে যাব কিভাবে?”

_________________

রওশনআরা ইনিয়েবিনিয়ে শাইনাকে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার জন্য ভালোই কথা শুনিয়ে দিলেন। নানান প্রসঙ্গ টেনে এনে বকুনি চলল বেশ কিছুক্ষণ। জোহরাও বেগমও তাতে সায় দিলেন—

“আটটার সময় কেউ ঘুম থেকে ওঠে? তাও আবার এই অবস্থায়?”

শেষমেশ আনোয়ারা বেগম শান্ত স্বরে শুধু একটা কথাই বললেন,“তাজও দেরিতে উঠেছে।”

সঙ্গে সঙ্গে ঘরে নেমে এলো স্তব্ধতা। আর কেউ মুখ খোলার সাহস পেল না। শাইনা পরোটা বানানোর কাজে হাত লাগালো। শাইনার পরোটা খেতে ইচ্ছে করছেনা। মোটকথা তেল জাতীয় খাবার সে মুখেও তুলতে পারছেনা। পরোটা আর ডিম ভাজা শেষে সে কিছু পাউরুটিতে জেল মাখিয়ে খেতে বসলো। তাসনুভা এসে নিজের প্লেট নিয়ে খেতে বসলো। খেতে খেতে শাইনার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোমার ম্যাক্সি নেই?”

শাইনা একটু থতমত খেল।

“আছে, বাড়িতে রেখে এসেছি। এখন পরবো না তাই।”

জোহরা বেগম বলল,”তুমি ফিতা দিয়ে সালোয়ার পরছো এখনো? তুমি জানো ফিতা দেয়া সালোয়ার পরা যায় না? আজকালকার মেয়েরা নাকি সব জানে। তুমি জানো না?”

শাইনা খাওয়া থামিয়ে বলল,”ভাবি বলেছে আর দুমাস পর পরতে।”

জোহরা বেগম আর কিছু বললেন না। তাসনুভা খেতে খেতে বলল,”ম্যাক্সিগুলো নিশ্চয়ই এখানকার কোনো কাপড় বিক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া। তুমি ওসব এখানে আর এনো না। এগুলোর ফ্যাব্রিক ভালো না।”

শাইনা আর কিছু বললো না। রাতে তাসনুভা তার শোরুম থেকে ফিরে সোজা শাইনার ঘরে চলে গেল। শাইনা তার মায়ের পাঠানো কাঁথাগুলো ভাঁজ করছিল বসে বসে। কাঁথাগুলো কি ছোট ছোট! হাতে নিতেই শাইনার হাসি পাচ্ছে।

তাসনুভা তখুনি দরজা ঠেলে ঢুকে বিছানায় একটা প্যাকেট ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল। শাইনা ভাবলো তাজদার সিদ্দিকী কিছু আনতে বলেছে। তাই সে তেমন আগ্রহ দেখালো না। তাজদার ঘরে আসামাত্রই ফোন চার্জে দিল। তারপর শাইনার দিকে তাকিয়ে বলল,”এইসব খেলনাপাতি কে পাঠালো?”

“আম্মা। দেখুন।”

একটা ছোট্ট ফুলতোলা কাঁথা তাজদারকে দেখালো সে। তাজদার সেটা দেখে বলল,”এটা যার জন্য পাঠানো হয়েছে, তারচেয়ে তার আম্মার বেশি দরকার পড়বে চোখের পানি নাকের পানি মোছার জন্য।”

শাইনা আর কিছু বললো না। সবসময় তাকে পচানোর ধান্ধা। তখুনি তার চোখে পড়লো তাসনুভার রেখে যাওয়া শপিং ব্যাগটা। সেটা হাতে নিতেই দেখলো কতগুলো নরম ড্রেস। শাইনার কৌতূহল জাগলো। বের করে দেখলো গোলগাল কতকগুলো ফ্রক সিস্টেম ম্যাটারনিটি কুর্তি। শাইনা খুশি হলো। তাজদার কপাল কুঁচকে তাকালো।

“এগুলো কি?”

“মেঝ আপু দিয়ে গেছে। আমি ভাবলাম আপনার কিছু তাই খুলে দেখিনি।”

তাজদার আর কিছু বললো না। তিতলি এসে বলল,”ড্রেস দেখি।”

ড্রেসগুলো দেখে তিতলি বলল,”এগুলো পরলে তোমাকে একদম বাবু বাবু লাগবে।”

শাইনা তাজদার সাথে সাথে একে অপরের দিকে তাকালো। তাজদার চোখের কোণা দুই আঙুল দ্বারা হাঁটতে হাঁটতে সেখান থেকে সরে গেল। শাইনা তিতলিকে ফিসফিস করে বলল,”তুমি আর কথা বলার জায়গা পেলে না?”

তিতলিও ফিসফিস করে বলল,”কার বাবু সেটা বললে ভালো হতো?”

শাইনা ঠাস করে একটা চড় মারলো তার গায়ে। তিতলি হেসে উঠে বলল,”যাই বলো মহারাণী কিন্তু এবার বেশ ভালো কাজ করেছে। একটা কাজের কাজ করেছে। অবশ্য ভাইয়ার পকেট হাতানোর ধান্ধা।”

“সেটা তুমিও করো।”

তিতলি লজ্জা পেয়ে বলল,” তুমিও পকেট মারতে পারো। বরের পকেট মারা হালাল।”

শাইনা তার পিঠে আরেকটা চড় বসিয়ে বলল,”যাহ।”

তিতলি বেরিয়ে যেতেই তাজদার শাইনার হাত ধরে টেনে তুলে বলল,”তুমি এখান থেকে এখুনি একটা পরো। কুইক। তোমাকে কীসের মতো লাগছে আমাকে দেখতে হবে। পরো।”

“এসব কেমন কথা! এখন পরবো কেন?”

“এগুলো অনেকটা নাইট ড্রেসের মতোই।”

শাইনা তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল তাজদার তার হাত শক্ত করে ধরে বলল,”চলো আমি পরিয়ে দিই।”

শাইনা আর না পেরে বলল,”আচ্ছা আচ্ছা আমি পরছি। বের হোন ঘর থেকে।”

তাজদার পাঁচ মিনিটের জন্য বের হলো। তাজদার চার মিনিটেই ভেতরেই ঢুকে এল। শাইনার গায়ে তখন ওড়না নেই। সে ওড়না নিতে বিছানার কাছে ছুটছিল। তাজদার তাকে টেনে এনে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,

“আরেহ মিষ্টিকুমড়া!”

চলমান….

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply