তাজমহল #দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব_২১
প্রিমাফারনাজচৌধুরী
দুই বাড়িতে ইতোমধ্যেই রটে গেছে তাদের ঝগড়ার কারণটা। বর বলেছে তার বাচ্চাকে মা তার সামনে আদর মহব্বত করছে না। আর বউ সেটা শুনে খেপে গিয়েছে। তার সন্তানকে সে আদর করছে না এতবড়ো কথা তাজদার সিদ্দিকী বলতে পেরেছে?
বাচ্চার বাবার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে বড্ড কৃপণ করা শাইনা মমতাজের প্রতি তাজদার সিদ্দিকীর এই অভিযোগ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টা যুক্তিতর্ক চলছে।
শাইনা বাপের বাড়িতেই আছে। পড়াশোনা আর বাচ্চাকে নিয়ে সে ভীষণ ব্যস্ত। বাড়িতে এত আলাপ আলোচনা চলছে সেদিকে তার মনোযোগ নেই। ইচ্ছে করেই নিজেকে সরিয়ে সরিয়ে রেখেছে এসব থেকে। রীতিমতো বিরক্তবোধ করছে সে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে নিয়ে নিজের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও পালাতে।
তাজদার সিদ্দিকী আর তার সম্পর্কের সমীকরণটা কখনো সরলরৈখিকভাবে হওয়ার নয়। এভাবে এভাবেই হয়তো চলবে। ওই ঘটনার পর সে নিজ থেকে ফোন করেনি। তাজদার সিদ্দিকীও না। তবে তাজদার সিদ্দিকী মেয়েকে দেখার জন্য ঠিকই ফোন করেছে। তিতলি বাবুকে দেখিয়েছিল। শাইনাকেও দেখাতে চেয়েছে ভাইয়ার আগ্রহ দেখে কিন্তু শাইনা সামনে আসেনি।
তারা দুজনেই কেউ কাউকে আর কোনো অভিযোগ জানায়নি নিজেদের ব্যাপার নিয়ে। কিন্তু দুই বাড়ির লোকের ঘুম হারাম। তারা নিজেরা নিজেরাই তর্কবিতর্ক করে চলেছে ব্যাপারটা নিয়ে।
শাইনার এখন মনে হচ্ছে বেশি আবেগ দেখিয়ে মা দাদীর সামনে কেঁদে ফেলাটা উচিত হয়নি। শাহিদা বেগম অবশ্য নিজের মেয়েকেই বকেছেন। পরের ছেলেকে কি দোষ দেবেন? বলেছেন, ছেলেটা চায় তার সামনে তার মেয়েটাকে একটু আদর কর। এটাতে ভুল কি বলেছে? মা হয়ে গেছিস। এখনো এটুকু বুঝিস না?
অপরদিকে রওশনআরাও তাজদারকে বকাঝকা করার পর বলেছে, “তোমার বাপ চাচারাও এভাবেই চিন্তাভাবনা না করে কথা বলে ঝামেলা বাড়াতে ওস্তাদ ছিল। তুমিও তাদের মতোই হয়েছ।”
তিনি তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর চৌদ্দ গুষ্টি টেনে কথা বলতে লাগলেন তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর সামনে।
তাজউদ্দীন সিদ্দিকী অবাক হয়ে বললেন,”এখন আমার গুষ্ঠি কি দোষ করলো বলো তো।”
তাজদার আর শাইনা দুজনেই মায়ের বকুনি খেয়ে আপাতত চুপচাপ আছে। তাদের মুখ থেকে আর কিচ্ছু শোনা গেল না দেখে দুই বাড়ির লোকজন একটু শান্ত হয়েছে।
তাসনুভা বাড়ি ফিরলে বাবুকে নিয়ে যায়।ঘন্টাখানেক ওই বাড়িতে রাখে। তারপর কান্নাকাটি করলে আবারও নিয়ে আসে। তিতলি কিছুক্ষণ পরপর ওই বাড়িতে আসাযাওয়া করছে। শাইনার সাথে একসাথে পড়ছে আবার খাওয়াদাওয়াও ওখানেই করে ফেলছে। ও সরলমনা। শাইনা খেতে বললে ফেরায় না।
ননদ ভাবি দুজনেই একসাথে প্রস্তুতি নিচ্ছে। শাইনার মন ভালো থাকে ও আশেপাশে থাকলে। বাচ্চাকেও সামলায় তিতলি।
তাসনুভা আজ বাবুকে দুই ঘন্টা নিজের কাছে রেখেছে। দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো শাইনার চুলের অবস্থা খুব বাজে। চুল না আঁচড়ে পেঁচিয়ে বেঁধে রেখেছে।
বিছানায় বই খাতা খোলা। তাসনুভা তাকে ভালো করে পরখ করে বলল,”তুমি কিছু হেয়ার ট্রিটমেন্ট নিতে পারো। তোমার চুল খুব রাফ হয়ে গেছে। আমি গত সপ্তাহে কেরাটিন ট্রিটমেন্ট নিয়েছি। ওদের সার্ভিস ভালো। ওখানে যেতে পারো। তোমার চুলে ডিপ কন্ডিশনিং, প্রোটিন ট্রিটমেন্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
শাইনা তিতলির দিকে তাকালো। তিতলি কলম কামড়ে ধরে কথা শুনছে চুপচাপ। বাবু ঘুম। তাই তাসনুভা বাবুকে দোলনায় রেখে চলে যাচ্ছিল তখুনি তিতলি বলল,”আপু আমি রিবন্ডিং করাবো।”
“দরকার নেই। চুলের যত্ন নাও। সুস্থ চুল দরকার সবার আগে।”
“সবসময় আমার সাথে তুমি অবিচার করো। আমার কোনোকিছুর কেয়ার লাগবে না।”
“না লাগবে না। তুমি ন্যাচারাল বিউটি ধরে রাখো। যত কম প্রডাক্টস ইউজ করবে ততই বেটার।”
“তুমিও আমার মতোই। কিন্তু তুমি তো ইউজ করো।”
“কারণ আমাকে বাইরে যেতে হয় সবসময়। বাইরে কি পরিমাণে ধূলোবালি তোমার ধারণা আছে? তাছাড়া আমাকে মডেলিং করতে হয়। আমার স্কিনের আলাদা কেয়ার দরকার। তুমি কি বুঝবে এসবের? বাই দ্য ওয়ে তুমি এখানে পড়ছো নাকি দুজন মিলে গল্পগুজব করছো?”
“আমি পড়ছি, খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, আর বাবু সামলাচ্ছি।”
আর দাঁড়ালো না তাসনুভা। সোজা বেরিয়ে গেল। তিতলি একটা নির্লজ্জ মেয়ে। ওর কোনো লজ্জা নেই।
সে চলে যেতেই শাইনা তার সামনে বসে বলল,”তুমি এত তর্কে জড়াও কেন?”
তিতলি হেসে বলল,”তুমিও জড়াও ভাইয়ার সাথে।”
শাইনাও তার সাথে হাসলো। গালে হাত দিয়ে বলল,”এটা তো খুব স্বাভাবিক।”
“কিভাবে স্বাভাবিক?”
শাইনা শ্রাগ করে বলল,
“বরের সাথে সব বউয়েদেরই তর্ক হয়। এটা নতুন না।”
তিতলি মানতে চাইলো না। তাই শাইনা বলল,
“হ্যাঁ, সমস্যা এখানেই যে আমার আর তোমার ভাইয়ার তর্কটা বেশিই হয় অন্যদের চাইতে।”
তিতলি বলল,
“আমি বাবা কোনো ঝগড়াঝাঁটি করবো না। একদম কোলে উঠে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। বর হচ্ছে ভালোবাসার মানুষ। ঝগড়া করার নয়। ধুত্তেরি।”
শাইনার চোখ কপালে উঠে গেল। কি বলে এই মেয়ে! তিতলি তার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বলল,
“এভাবে কি দেখছো?”
শাইনা তাকিয়েই আছে। তিতলি বিছানায় কাত হয়ে পড়ে বালিশের নিচে মুখ আড়াল করলো। এভাবে তাকালে লজ্জা লাগে। শাইনা অনেকক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইলো।
কিছুক্ষণ পর বাবু কেঁদে উঠলো ঘুমের মধ্যে। শাইনা তার একটা ওড়না রাখলো বাবুর গায়ের উপর। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোল দিতে দিতে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তিতলি বালিশের নিচে থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলো,
“ভাইয়ার সাথে তুমি কথা বলবে না? তোমরা নাকি পণ করেছ একে অপরের মুখ দেখবে না, কথা বলবে না?”
“তোমাকে এইসব কে বলেছে?”
“দাদুদের মুখ থেকে শুনেছি।”
শাইনা চুপ করে রইলো। তিতলি হঠাৎই চমকে ওঠার মতো প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা তুমি কি ছোটোবেলার ওইসবের জন্য ভাইয়ার উপর এখনো রাগান্বিত? ভাইয়া তখন তোমাদের সাথে বাজে বিহেভ করতো।”
শাইনা সাথে সাথে তার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকালো। কপাল কুঁচকে বলল,”কেন জিজ্ঞেস করছো?”
তিতলি ফোকলা হাসলো।
“এমনি, তোমাদের মধ্যে না প্রেমপ্রেম ভাবটা নেই। কেমন কাঠখোট্টা দুজনেই। তোমরা দুজনেই দুজনের কাছ থেকে হাজারবছর দূরে থাকতে পারবে। কিন্তু যারা আদর্শ বরবউ তারা কক্ষনো এমনটা পারবে না।”
শাইনা তার এইকথা সরাসরি অস্বীকার করলো না। বলল,”অতিরিক্ত সিরিয়াল দেখার ফল।”
“আমি আজকাল সিরিয়াল দেখছিনা কিন্তু। কার্টুন দেখছি শুধু।”
“কথা কম। ম্যাথ শেষ করো।”
বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তিতলি বলে উঠলো,”তুমি নিজ থেকে ভাইয়াকে একটিবার ফোন দাও। অনেকদিন তো হয়ে গেল। এত টেনশন নিয়ে কিভাবে পরীক্ষা দেবে তুমি? আচ্ছা তোমার কি ভাইয়ার জন্য একটুও মন পুড়ে না? ভাইয়া কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে চায়। তুমি একটু ইঙ্গিত দিলে নিজ থেকে ফোন করবে।”
শাইনা বলল,”তোমার ভাইয়া আমার সাথে কথা বলে না। ঝগড়া করে। ফোন দিচ্ছে না ভালোই হচ্ছে। ঝগড়াটা তো অন্তত কম হচ্ছে।”
“তোমাদের কষ্ট হয় না কথা না বললে? আমার ক্লাসমেট ওর প্রেমিকের সাথে কথা বলতে না পারলে পাগল হয়ে যায়। আর তোমার তো বর।”
শাইনা আর কিছু বললো না। তার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে না। তার কিছুই ফিল হচ্ছে না। আর এখানেই তার অশান্তি। এখানেই তার যত দুশ্চিন্তা। তাজদার সিদ্দিকীর ক্ষেত্রেও কি একই?
~
শাইনা তিতলিকে নিয়ে শহরের পার্লারে গিয়েছে। ফেসিয়াল, ডিপ কন্ডিশনিং, প্রোটিন ট্রিটমেন্ট,পেডিকিউর মেনিকিউর নিয়েছে। তিতলিও। খরচ শাইনা দিয়েছে।
তাজদার সিদ্দিকী প্রতিমাসে তার একাউন্টে ২০০ পাউন্ডের মতো পাঠায়। এত টাকা তার দরকার পড়ে না। কিন্তু তবুও টাকা হাতে থাকায় এখন কারো মুখ চেয়ে থাকতে হয় না।
বাবুর অসুখবিসুখ লাগলেই সে শাওনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চলে যায়। ঔষধপত্র কিনতে পারে। বাবুর জন্য কিছু কিনতে হলে তা কিনে নিতে পারে। তাদের মা মেয়ের খরচাপাতি নিয়ে কাউকে ভাবতে হয় না।
তাজদার সিদ্দিকীর প্রতি সে কৃতজ্ঞ। তার চোখে দেখা অসংখ্য ঘটনা আছে যেখানে স্বামীর যথেষ্ট টাকাপয়সা থাকা স্বত্বেও বউকে দশ টাকা দেয়ার সময়ও কৈফিয়ত চায়। আলহামদুলিল্লাহ তার স্বামী এমন হয়নি। তাকে কারো দ্বারস্থ হওয়ার মতো সিচুয়েশনে রাখেনি। কিন্তু শাইনার মন থেকে এখনো অনেক দুশ্চিন্তা যায়নি। তাই সে অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় খরচ করতে চায় না।
সেদিন মাকে একহাজার ভাংতি করে দিয়েছিল। পরদিন আবার নিয়ে ফেলেছে। সে কতটাকা তার পেছনে আর বাবুর পেছনে খরচ করছে তা লিখে লিখে রাখছে। বাকি টাকা জমা থাকছে একাউন্টে। তাজদার সিদ্দিকী যদি কোনোদিন কখনো হিসেব চেয়ে বসে? কিংবা তার পরিবার? এই ধরণের চিন্তাভাবনা মাথায় আসায় শাইনার যদিও নিজেকে ছোটো মনে হচ্ছে। কিন্তু সে চাইলেও মন থেকে ভয়টাকে তাড়াতে পারছে না। তাজদার সিদ্দিকীর সবকিছুর উপর তার অধিকারের সত্যতা সম্পর্কে সে এখনো নিশ্চিন্ত নয়। কারণ স্বামীর খেয়েপড়ে আবার পড়ে খোঁটা শুনে হজম করতে পারার শক্তি আল্লাহ তাকে দেয়নি। খোঁটা দিলেও তার কিছু করার থাকবে না। কিন্তু সে জানে না সেদিন তার মনের অবস্থা কীরূপ হবে।
~~~~
বাবুর চল্লিশ দিন পার হতেই শাইনা শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছিল। ক’দিন পরই শুরু হলো তার পরীক্ষা। এতদিন পার হয়ে যাওয়ার পরও তাজদার সিদ্দিকীর সঙ্গে সে কথা না বলে থেকেছে এটা পুরোপুরি সত্য নয়। তারা কথা বলেছে। তবে সেই কথোপকথন সীমাবদ্ধ ছিল বাবু পর্যন্ত।
আলোচনার বিষয় ঘুরেফিরে বাবু।
বাবু কেমন আছে,
বাড়ির সবাই কেমন আছে এই পর্যন্তই।
ছোট ছোট সংলাপ, সংযত, নিরাসক্ত। তাজদার সিদ্দিকীর কথায় আগের সেই রসবোধ, রসিকতার ছোঁয়া পাওয়া গেল না। সম্বোধনেও পরিবর্তন। শুধুই শাইনা। মমতাজ শব্দটা সে ভুলেও মুখে আনে না। কথার ধরণ হয় ঠিক এমন,
“শাইনা আমি মাগরিবের পর ফোন দিলে একটু রিসিভ করতে হবে।”
“কিছুক্ষণ পর ফোন দিচ্ছি।”
“বাবুকে ভিডিও কলে দেখতে চাই।”
“বাবু কি ঘুম?”
“বাবু জেগে?
“বাবু খেয়েছে?”
“বাবুর এই প্রবলেম সলভ? ওই প্রবলেম সলভ?”
এইটুকুই।
স্বামী-স্ত্রীর একান্ত কোনো মিষ্টি কথা, কোনো অন্তরঙ্গতা এই কথোপকথনের ভিড়ে আর জায়গা পায়নি। অবশ্য শাইনা এর বাইরে আর কোনোকিছু ভেবে দেখেনি। এমনই তো হয়। বাচ্চা হওয়ার পর স্বামী স্ত্রীর আবার আলাদা সময় কীসের? অন্তত যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তাজদার সিদ্দিকী আর শাইনা মমতাজের মতো অমীমাংসিত?
পরীক্ষা শুরু হতেই শাইনাকে শাহিদা বেগম আবারও বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। পরীক্ষা চলাকালীন শাইনার তিরিক্ষি মেজাজটা আবারও খেয়াল করলেন শাহিদা বেগম। কিছু বললেই চেঁচামেচি করে দরজা বন্ধ করে মেয়েটাকে নিয়ে বসে থাকে। আশেপাশের লোকজন বলল, কেউ তাবিজ করেছে কিনা দেখে গিয়ে। নইলে বিয়ের আগে এই মেয়ের চেঁচামেচি তো দূর, গলার আওয়াজ পর্যন্ত শুনিনি।
পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় একেকটা ঝামেলা বাঁধিয়ে তারপর বিরক্তমুখে ঘর থেকে বের হয়। শাহিদা বেগম নিজেই যান নাতনিকে নিয়ে মেয়ের পরীক্ষা সেন্টারে। কি যে কষ্ট দুধের বাচ্চা সামলানো! ভয়ে বলতে পারেন না আর কীসের পড়ালেখা? এই পড়ালেখার জন্যই তো জামাইয়ের জন্য এত মনোমালিন্য হয়েছিল একসময়। তাই ভয়ে কিছু বলেন না।
মেয়েটা কেমন যেন হয়ে গেছে ইদানীং। ভালো কথা বললেও তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।
শাইনা আধঘন্টা পরপর হল থেকে বেরিয়ে এসে বাবুকে খাইয়ে যায়। মেয়ের কান্না শুনলেই পরীক্ষার খাতায় ওর কলম আর চলে না।
খাইয়ে আসার পরও যখন কাঁদে, তারউপর পরীক্ষার প্রশ্ন হয় কঠিন তখন তার ইচ্ছে করে হাত পা ছেড়ে বসে কাঁদতে। তার এই কষ্টের কথা কে শুনবে মন দিয়ে? এত একা লাগে তখন নিজেকে। নিজেকে এত একা কখনো মনে হয়নি তার। এখন মনে হয় সে একা। তার মতো একা আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে।
পরীক্ষা তখন আর একটা বাকি ছিল। তাজদার সিদ্দিকী বাবুর সাথে কথা বলার জন্য তাসনুভাকে দিয়ে একটা বাটনফোন কিনে পাঠিয়েছে এই বাড়িতে। ছোট্ট পাতলা একটা মোবাইল সেট। যাতে বাবু সেটাকে হাত দিয়ে ধরতে পারে। এন্ড্রয়েড ফোন ভারী হয়। সে হাত দিয়ে ধরতে চাইলেও পারবে না।
ওই বাটন ফোনটা বাবুর কানের পাশে রাখলেই সে সেখান থেকে বাবার কণ্ঠ শুনতে পায়।
এটুকুনি একটা মেয়ে। দূরদেশী একটা মানুষ যার কোলে সে জন্মের পর একবারও উঠেনি, যে তাকে এখনো স্পর্শ করতে পারেনি তার কণ্ঠে “আম্মু” ডাক শুনলেই সে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায়। হাত পা নাড়া থামিয়ে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে থাকে। শাইনার এত কান্না পায় তখন। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করে।
এর কারণ কি? কারণ অনেক খুঁজেছে সে। কারণ হিসেবে সে যা খুঁজে পেয়েছে তা ছিল ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটাকে সে হিংসে করছিল। মেয়ের সাথে কথা বলা শেষ করে তাজদার শাইনাকে ফোন দেয়। এখন একটা নিয়ম হয়েছে। অফিসে যাওয়ার আগে একবার। ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার সে শাইনার ফোনে কল দেয়। পরীক্ষা কেমন চলছে। শরীর কেমন। তারপর নীরবতা। নয়তো কথা বলার অজুহাত খোঁজা। শাইনা তখন নিজ থেকেই ফোন রেখে দেয়।
মা, দাদীমা কেউ কিচ্ছু বোঝাতে এলেই সে চিৎকার করে ওঠে,”ওই লোকের হয়ে যে কথা বলবে তাকেই খুন করবো। শয়তানের দল সবকটা।”
সাবরিনা শাহিদা বেগম আর দাদীমাকে বকে।
“কিছু একটা তো হয়েছে ওর। ওকেই সমাধান করতে দিন। আপনারা ওকে আর জ্বালাবেন না।”
শাওনও এখন তার সাথে হিসেব করে কথা বলে। মাঝেমধ্যে শাইনা যখন একটু হাসিখুশি থাকে বলে,”পোকোনি তোর পোকা কমেছে?”
শাইনা তখন আবারও জ্বলে ওঠে। আফসার সাহেব তো মেয়ের সামনেই আসেন না। নাতনিকে কোলে নেন আড়ালে। কখন না জানি বলে বসে, তোমাদের জন্য আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
আনিস মায়ের মুখ থেকে রোজ সব শোনে। সেদিন খেতে বসে সে আঁড়চোখে ছোটো বোনটার দিকে তাকালো। ওর কি হলো আবার? ওকে তো বিয়ের আগে একবারও অশান্ত, রাগী, বদমেজাজি মনে হয়নি।
শাইনা সেটা টের পেয়েছে। তার নিজেরও লজ্জা লাগছিল সবার এমন চাহনি দেখে। সবাই তাকে কি ভাবছে কে জানে।
সে নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করছে। মেয়েকে নিয়ে তিতলি তৌসিফ শাওনকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফাস্টফুড খাচ্ছে, দোলনায় চড়ছে, পার্কে যাচ্ছে। শুধু নিজেকে ভালো রাখার জন্য। কারণ মেয়েটার জন্য তাকে ভালো থাকতে হবে।
কিন্তু সেদিন আচমকা বাবুর পাতলা পায়খানা হলো। তা দেখে রওশনআরা বললেন, সে ফাস্টফুড খেয়েছে তাই এমন হয়েছে। শাহিদা বেগমের নীরবতা রওশনআরার অভিযোগকে সমর্থন জানালো। রওশনআরা শাহিদা বেগম শুনিয়ে শুনিয়ে আরও বলে গেলেন তাদের চেয়ে বড়লোক বাড়ির মেয়ে বউ করে নিয়ে গেলেও মেয়েটা তাদের ছেলেটাকে শান্তি দিত, সম্মান দিত। তাদের ছেলের কপালের দোষ। তাই যেচেপড়ে পাশের বাড়িতে মরতে গিয়েছে।
শাইনা রাগে দুঃখে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা দিনভর কাঁদলো। তাজদার সিদ্দিকীও বাড়ির সবার সাথে ফোনের উপর ফোন করেই যাচ্ছে।
রাতে শাইনা ফোন রিসিভ করতেই তাজদার বলল,”আম্মু কথার কথা বলে ফেলেছে। আমি বলেছি এরকম কথা যেন আর না বলে। কান্না থামাও প্লিজ।”
শাইনা তাকে আর কিচ্ছু বলতে দিল না। চোখের জল মুছে নিঃশ্বাস বন্ধ করে একনাগাড়ে বলে গেল,
‘আপনি দেশে এসে আমাকে তালাক দিন। না আমি আপনাকে কখনো ঘৃণা করা থামাতে পারবো। না আপনার আর আপনার পরিবারের মনের মতো হতে পারবো। আমি এইসব নিয়ে বাঁচতে পারব না। দেশে এসে যত জলদি পারেন আমাকে মুক্তি দিন। এই সম্পর্কে আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি আপনাকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারব না। ঘৃণা থামাতে পারব না। চেষ্টা করেও লাভ নেই। দয়া করে আমার কথাটা শুনুন। প্লিজ।”
“তোমার শরীর খারাপ মমতাজ?”
শাইনা তার কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
“ফালতু কথা বলে কথা ঘোরাবেন না। আমি একদম সুস্থ। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। আপনি দূরে কোথাও চলে যান আমার জীবন থেকে। ভীষণ থেঁতো লাগছে আপনাকে। আমি এই সম্পর্ক চাই না। একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমাকে দিয়ে এসব হবে না। আপনাকে আমি ভাবতেই পারি না। আপনাকে আমি ভাবতে চাই না। আপনাকে এমনকি আপনার কোনো কিচ্ছু আমি আমার আশেপাশে চাই না। আপনার নামটা পর্যন্ত আমি শুনতে চাই না। এবার বুঝে নিন ঘৃণার পরিমাণ কতটুকু। আর আমি আপনার কাছে কেন থাকতে চাই না।”
তাজদার আর কিছু বললো না। শাইনা তাকে থামিয়ে দিল,”দেশে এসে সব সমাধান করে দিয়ে যান। কোনো সান্ত্বনা শুনতে চাই না।”
তাজদার বলল,”ভিডিওকলে আসো। একবার। প্লিজ। শাইনা!”
“না। দেশে আসুন। বাকি কথা তখন।”
“একবার আসো। শুধু একবার। আচ্ছা শেষবার। প্লিজ।”
শাইনা ফোন রেখে দিল। ভোলাভালা চেহারাটা দেখিয়ে তাকে আবারও ফাঁসাবে। সে আর ফাঁসবে না। বাবু ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। মায়ের কোল না পেয়ে কাঁদছে। শাইনা তার দিকে চেয়ে রইলো। শাহিদা বেগম এসে দেখলো মা মেয়ে একসাথেই কাঁদছে।
চলমান….
Share On:
TAGS: তাজমহল সিজন ২, প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২৫
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৯
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৫+১৬
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৬
-
তাজমহল সিজন ২ গল্পের লিংক
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২০
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১০
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২৩
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৪