Golpo romantic golpo ডেনিম জ্যাকেট

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৩


#ডেনিম_জ্যাকেট —- পর্ব ৩৩ (বিয়ে পর্ব – |||)

#অবন্তিকা_তৃপ্তি

‘Once a cheater; always a cheater’— কথাটায় কুহু চরমভাবে বিশ্বাসী!ঠিক এই কথাটাই কুহুর মস্তিষ্কে খুঁচিয়ে খাচ্ছে তখন থেকে, যখন থেকে কুহু–কাব্যের এনগেজমেন্ট ঠিক হয়েছে আগামীকাল।

কুহু ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে ছাদের মধ্যে পায়চারি করছে। হাতে চেপে ধরা মুঠোফোন, ডায়াল লিস্টে সিয়ামের নামটাই স্পষ্ট ভাসছে। ইতিমধ্যে বিশটা কল পৌঁছেছে সিয়ামের ফোনে। দুর্ভাগ্যবশত সিয়াম কুহুর একটা কলও রিসিভ করছে না আজ।

মূলত কুহু চেয়েছিল— সিয়াম নিজে এসে বলুক ওর বাবাকে, যে ওদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন।আজ ফোনেই কুহু সিয়ামের সাথে সবটা শেষ করে দেবে। আর তারপর সিয়ামের সাথে যা আছে সব শেষ করার পর কাব্য ভাইকে বিয়ে করার দরকার পড়বে না কুহুর। প্লেন মোতাবেক,বিদেশের কোনো ভার্সিটিতে আবেদন করবে ও। আর দেশেই থাকবে না। আংটি পরানোর পরপরই কোনো একটা ষড়যন্ত্র করে সবার মন জুগিয়ে চুপিচুপি কুহু চলে যাবে এই দেশ থেকে।

তারপর. . এটাই হবে কুহুর এত মাসের কাব্য ভাইয়ের দেওয়া নিষ্ঠুরতম জ খমগুলোর বদলা. !

ছাদে পায়চারি করতে করতে সেসব ভীষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে ভাবছিল কুহু। হঠাৎ কারোর চিকন মেয়েলি কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো ওর-

‘কুহুপু, এখানে কি করছ?’

কায়া পেছন থেকে ডেকেছে তখন। কুহু পেছন ফিরে তাকাল কায়ার দিকে। কায়া দেখতে পায়- কুহুর চোখ–মুখ উদ্ভ্রান্ত, দিশেহারা পথিকৃ ন্যায় দেখাচ্ছে ওকে।

কায়া অবাক হলো সম্ভবত। ও ধীর পায়ে কুহুর কাছে এসে দাঁড়াল। কুহুর হাতে ধরা ফোনের দিকে একবার চেয়ে সিয়ামের নাম দেখে কায়ার ভ্রু সাথেসাথেই কুঁচকে গেল। ও কিছুটা বিরক্ত গলায় কুহুকে জিজ্ঞেস করল———‘সিয়াম ভাইয়ার সাথে কন্টাক্ট করছো তুমি? কুহুপু, তোমার বিয়ে অলরেডি ঠিক হয়েছে, জানো তো?’

কুহু অস্থির, সাথেসাথেই ফোন থেকে সিয়ামের নম্বর সরিয়ে কায়ার দিকে সতর্ক দৃষ্টি ছুড়ল———‘আস্তে কথা বল, শুনে ফেলবে কেউ।’

কায়া কিছু না বুঝে তাকিয়ে রইলো কুহুর দিকে। কায়ার এভাবে তাকানো দেখে কুহু না চাইতেও জবাব দিল———‘কিসের বিয়ে? হু? আমি বিয়ে করছি না, কাউকেই না। দরকার হলে কুমারী থাকব সারাজীবন। তবুও কাব্য ভাইকে বিয়ে করছি না আমি; গট ইট?’

কুহুর এমন পাগলাটে-বাচ্চামো ভাবনায় কায়া চুড়ান্ত হতাশ, সেভাবেই বলল———‘এই কাব্য ভাইকেই তুমি ভালোবাসতে কুহুপু। আর কাজ যখন সবটা আল্লাহ নিজে ঠিক করতে চাইছেন- ঠিক তখন তোমার এসব পাগলামি শুরু হয়ে গেল। বখে গেছো তুমি পুরোপুরি!’

কুহু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কায়ার দিকে, নিজেও বাঁকাভাবে কথা শোনায়——‘আমি ঠিকই আছি, কায়া। আমার দিল এতটাও নরম না। এতকিছুর পরে তাকে এতটা সহজে নিজেকে হস্তান্তর দিতে পারব না কায়া। আমি এতটা সহজলভ্য নই, বল? কাব্য ভাই চাইলেন, আর আমাকে পেয়ে গেলেন? আর আমি? আমি যখন চাইলাম, তখন তো আমি তাকে পাইনি। উনি এসব ভুলে গেলেও: তার দেওয়া থাপ্পড়-অপমান আমি. . আমি কিচ্ছু ভুলিনি।’

একটু থেমে কুহু এবার চোখ-মুখ শক্ত করে,কঠিন কণ্ঠে শোনায়——‘আই নিড রিভেঞ্জ!’

সাথেসাথেই কায়া ভ্রু বাঁকালো। কুহুর কঠিন-কঠোর মুখটুকু দেখে আশ্চর্য হয় ভীষণ। কতটা মায়াবি ছিলো কুহু ছয়মাস আগে, আর এখন। প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে গেছে রীতিমত। মায়াবী মুখটার আজ কোথাও কোনো দয়ার-ভালোবাসার-স্নেহের রেশটুকুও নেই।

কায়া বোঝায় এই পাগলকে—-‘কার থেকে? কার থেকে রিভেঞ্জ নিবে কুহুপু? কাব্য ভাইয়ের থেকে? যাকে তুমি এখনো, লিট্রেলি এখনো ভালোবাসো। যা হয়েছে, হয়েছে কুহুপু। ভুলে যাও ওসব। এখন তো সবটা সুন্দর হচ্ছে, কেন যেচে কষ্ট আনছ নিজের জন্যে?’

কুহু পাগলের কায়ার হাতটা নিজের থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে, জেদ দেখিয়ে চিৎকার করে উঠে—-‘না, না! এত সহজে না। আমাকে থাপ্পড় দিয়ে রিজেক্ট করা, ক্রমাগত দূরে সরিয়ে রাখা, একটার পর একটা কষ্ট! এসব . . এসব এত সহজে আমি অন্তত ভুলবো না। সে ভেবেছে একটা সরি; একটু ভালোবাসার কথা আর আমি সবটা ভুলে যাব? এতটা মূর্খ না আমি।’

কুহু থামলো, তারপর শ্বাস টেনে নিয়ে পুনরায় বললো——‘এখন যদি উনি খুব সহজে আমাকে পেয়ে যায়, বলা যায়না আজ থেকে কয়েক বছর পর উনার আবার আমার উপর থেকে মন উঠে গেলে একইভাবে কষ্ট দিতে তার বুকে বাধবে না। আমি দেখতে চাই— সে আমার জন্যে কতটা দূর যেতে পারে। তারপর আমি এই বিয়ে নিয়ে ভাববো; তার আগে না।’

কায়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো, কুহুর গোলগাল মুখটার দিকে চেয়ে নিস্তেজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল———‘কি করতে চাইছো তুমি? বদলাটা নিবে কিভাবে? কাব্য ভাইয়ের পেটে ছু ড়ি ঢুকিয়ে?’

কুহু হালকা হাসল, অদূরে ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে চেয়ে ম্লান কণ্ঠে জবাব দিল——‘উহু; মারবো না আমি তাকে। কি করি, সেটা দেখবি কালকের পর। অলরেডি হাফ প্ল্যান করা শেষ। কিন্তু সিয়ামকে দরকার ছিল এখন, সে তো কলটাই ধরছে না।’

কায়া বিরক্ত হলো এইবার, বলল———‘কাব্য ভাইয়ের হাতে তুমি নির্ঘাত আবার পেটানি খাবে। এবার কিন্তু একটা থাপ্পড়ও কম হবে তোমার জন্যে।’

কুহু আবার সিয়ামকে কল দিতে দিতে রহস্য হেসে জবাব দিল———‘সে এসব জানবেও না।’

এতক্ষণেও সিয়াম কল ধরছে না। এবার না পেরে কুহু সিয়ামের ফ্রেন্ডকে মেসেজ রিকোয়েস্ট দিল———‘Vaiya, ami Kuhu. Siam kothay? Or sathe dorkar chhilo amar. oke bolben, amake call dite…’

ব্যাস, মেসেজ রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ছোট শ্বাস ফেলে কুহু কায়ার দিকে তাকাল। কায়া চোখ বড়বড় করে আশ্চর্য হয়ে এই নতুন কুহুকে দেখে যাচ্ছে।

কায়ার এমন হতবম্ব চোখ দেখে কুহু কায়ার কাঁধে হাত রাখল, নিস্তেজ কণ্ঠে বললো——‘ডোন্ট ওরি। আমার এই প্ল্যানে ফ্যামিলির কেউই কষ্ট পাবে না। যা কষ্ট পাওয়ার সব ও পাষাণ লোকটা পাবে।’

কায়া এবার মেজাজ হারালো। কুহুর দিকে বিরক্তকর চাওনি নিক্ষেপ করে ওর হাত ছাড়িয়ে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে এলো ছাদের দরজা থেকে।

কিন্তু আচমকা দরজার সামনে থমথমে মুখে কাব্যকে দেখে কায়া রীতিমতো ভড়কে গেল, দু’কদম পিছিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল———‘কা… কা… কাব্য ভাই!’

কাব্য দরজার সামনে আড়াআড়ি বুকে হাত ভাঁজ করে দাড়িয়ে আছে। সেভাবেই ও একবার দরজার ওপাশে একবার কুহুর দিকে উঁকি দিয়ে দেখে আবার কায়ার দিকে তাকাল, কায়ার ফ্যাকাশে মুখটা দেখে একসমিয় ভীষণ শান্ত স্বরে বলল———‘প্ল্যান করা শেষ দুই বোনের?’

কায়ার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কায়া তোতলাতে তোতলাতে বলল———‘ভাইয়া আমি… আমি না। কুহু. . .’

সাথেসাথেই কাব্য ধমকে দিল———‘এক্ষুনি স্নিগ্ধের রুমে যাও; আমি আসা পর্যন্ত ওখানেই থাকবে। কথা আছে তোমার সাথে। গো রাইট নাও!’

এক ধমকেই কায়ার পিত্তি নড়ে উঠল বোধকরি, সাথেসাথেই মাথা ক্রমাগত নাড়িয়ে বলতে লাগলো——‘জি… জি! যাচ্ছি।’

বলেই কায়া আর একবার কাব্যের মুখের দিকে তাকানোর সাহস করলো না। সেভাবেই এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে কাব্যের ফ্ল্যাটের দিকে ছুটল!

কায়া যেতেই কাব্য ধীরে এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। কুহু ওদিকে তাকিয়ে ক্রমাগত সিয়ামের নম্বরে কল দিচ্ছে। কাব্য দরজায় হেলান দিল। মাথাটা আলগোছে ঠেসে রাখলো দরজায়। বুকের উপর আড়াআড়ি হাতগুটিয়ে ভীষণ গাঢ় কণ্ঠে, ম্লান কণ্ঠে বলে যায়——-‘আমাকে আয়োজন করে কষ্ট দেওয়ার কতকত ভাবনা তোর কুহু। অথচ বোকা তুই জানলি না— একটাবার আমার দিকে ঘৃণার চোখে তাকালেই আমি মরে যাই, খানখান হয়ে ছাই হয়ে যাই।’

বলতে বলতে কাব্য হাসলো: ঠান্ডা-মরা একটা হাসি! মাথাটা দরজায় ঠেসে না প্রাণহীন দৃষ্টিতে সেভাবেই দেখতে লাগলো— সিয়ামের নম্বরে একের পর এক কল করতে থাকা কুহুকে।

_______________

কাব্যদের ফ্ল্যাটে, স্নিগ্ধের রুমে।

স্নিগ্ধ-কায়া বিছানার উপর বসে আছে। কাব্য ওদের সামনে চেয়ারে বসে কিউব মেলাচ্ছে পায়ের উপর পা তুলে। দরজাটা ভেতর থেকে সিটকিনি দিয়ে আটকে দেওয়া। কাব্য কিউবটা পুরপুরি মেলাতে মেলাতে চোখ সম্পূর্ণ কিউবেই ফোকাস রেখেই গুরুগম্ভীর স্বরে সোজাসাপ্টা কায়াকে জিজ্ঞেস করল———‘কায়া, ভাসুর হিসেবে তোমাকে আমি প্রশ্ন করছি। আমার কারেক্ট এন্ড অ্যাকুরেট ইনফরমেশন চাই সেসবের।’

কায়া ঢোক গিলে অসহায় চোখে একবার স্নিগ্ধের দিকে তাকাল; স্নিগ্ধ কঠোর মুখভঙ্গি করে রেখেছে— যেন আজ কায়াকে মিথ্যা বললে মোটেও মাফ দেওয়া হবে না। ভাইয়ের জীবনের ব্যাপারে সে ভীষণ সিরিয়াস। কায়া এযাত্রায় ভীষণ অসহায় বোধ হলো,ও একবার কাব্যের দিকে চেয়ে মিনমিন করে বলতে চাইল——-‘কুহুপুর প্রাইভেসি—!’

কাব্য সাথেসাথেই কিউবটা ছুড়ে ফেলে গর্জে উঠে—-‘ফাঁক ইওর প্রাইভেসি! আমার লাইফ হেল হয়ে যাচ্ছে এখানে; তুমি এখানে প্রাইভেসির কথাবার্তা শোনাচ্ছো!’

কাব্যের এমন জোরে-চেঁচিয়ে ধনকে কায়া চমকে উঠলো; গুটিয়েই গেল কেমন। স্নিগ্ধ হয়তোবা সেটা বুঝে, ও কায়ার হাতটা ধরে আলতো করে, থমথমে কণ্ঠে বলল——-‘ভাইয়াকে সব বল, ভাইয়া ভীষণ ডিস্টার্ব কদিন থেকে। কুহু বারবার ঊর্মি আপুর কথা বলছে ভাইয়াকে— ভাইয়া সন্দেহ করছে যে কিছু একটা হয়েছে ওদের দুজনের মধ্যে। একমাত্র তুই হেল্প করতে পারবি ওকে।’

কায়া অসহায়, মানা করতে যাবে— তার আগেই স্নিগ্ধ ভীষণ নরম কণ্ঠে হাতের মধ্যে আলতো চাপ দিয়ে বলে উঠল——-‘প্লিজ।’

স্নিগ্ধের এমন নরম-আদ্র কণ্ঠে দোটানায় পরে যায় কায়া। ও তবুও দ্বিধা করছে দেখে এবার কাব্য থমথমে কণ্ঠে শাসানোর চেষ্টা করে বলে উঠে—‘সংসার করার সাধ আছে কায়া? লিসেন- যে বিয়ে আমি নিজে পরিয়ে দিয়েছি, সেই একই বিয়ে আমি একমুহূর্তে ভাঙতেও পারি। ভেবে নাও!’

স্নিগ্ধ সাথে সাথেই মুখটা কালো করে বলল——-‘ভাইয়া, এটা কিন্তু ব্ল্যাকমেইল!’

কাব্য স্নিগ্ধের দিকে তাকাল, ভ্রু কুচকে কঠিন কণ্ঠে পালটা জবাব দিল——-‘যেটা ভাবার ভাব। আমি ডোন্ট কেয়ার। এখন দুজন মিলে ভাব- তোদের সংসার না ওই ফাজিলটা? কোনটা চাই? আমি জীবনে সুখী না হতে পারলে: স্নিগ্ধ তোকে সুখী হতে দিব না।’

স্নিগ্ধ মুখটা কালো করে তাকাল কাব্যের দিকে। স্নিগ্ধ জানে— কাব্য এসব রাগের মাথায় শুধুমাত্র কায়ার মুখ থেকে কথা বের করার জন্যে বলছে। তাই ও এতটা ঘাটালো না। ও নিজেও এবার কায়ার দিকে অসহায় চোখে তাকাল। স্নিগ্ধের ওই এক চাওয়াতেই কাজ দিল।

কায়া তারপরই তোতাপাখির ন্যায় বলা শুরু করল একে একে সব——-

‘কুহুপু আপনার জন্যে শুরু থেকেই পাগল ছিলো। আমি নিজের চোখে দেখেছি তার এসব পাগলামি! কুহুপু আপনার প্রতিটা ব্যাপারে অত্যন্ত অবসেসড ছিলো। আপনি যা যা পছন্দ করেন, সেসব কুহুপু নিজের মধ্যে এনেছে। সাজেকে গিয়েছিল শুধুমাত্র আপনাকে প্রপোজ করবে বলে। তারপর সেখানে রিজেকশন পায়। শুরুতে হয়তো কুহু একটা রিজেকশন ভুলে যেতে পারত। কিন্তু ঊর্মি আপু সেদিন হাসপাতালে এসে সদ্য স্যুই-সাইড থেকে বেঁচে ফেরা কুহুপুকে যা মন চায় তাই বলে অপমান করে— সাথে এটা বলে আপনি পাঠিয়েছেন ওকে। উনি প্রপোজ করার বিষয় নিয়ে কুহুপুকে অনেক নিচু করে। লজ্জায় সেদিনের পর কুহুপু আপনার মুখোমুখিও হতে চায়নি। তারপর একে একে প্রতিদিন ঊর্মি আপুর বাজে মেসেজ, আপনার-তার হাসিখুশি ছবি। যেদিন আপনি যেই বিষয়ে কুহুপুর সাথে কথা বলতেন, ঊর্মি আপু সেদিনই কুহুপুকে কল দিয়ে সেই বিষয় নিয়ে তাকে কুকুরের মতো অপমান করত, সাথে বলতো আপনি এসব শেয়ার করেছেন উনার সাথে। আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কুহুপুর সাথে আপনার যেসমস্ত কথা হয়েছিল সেসবও ঊর্মি আপু জেনে গিয়েছিল। ও বলেছে আপনি ঊর্মি আপুকে বলেছেন এসব। সেটা নিয়েই ঊর্মি আপু কুহুপুকে অপমান করে। তারপর সিয়ামের সাথে রিলেশন…।’

এক এক করে সমস্ত কথা বলে যেতে থাকে কায়া।

কাব্য রীতিমতো আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে থাকে কায়ার দিকে। ওর হাত থেকে আপনা আপনি কিউব নিচে পড়ল। সাথেসাথেই কিউব ভেঙে গেল, টুকরো টুকরো হয়ে গেল— যেমনটা হচ্ছে স্বয়ং কাব্যের হৃদয়খান! অথচ সেদিকে হুঁশ নেই কাব্যের। ওর চোখে নিদারুণ বিস্ময়! কাব্য বিশ্বাস করছে না এসব… ঠিক এসব ঘটেছে ওর অজান্তে কুহুর সাথে।

কায়া সবগুলো কথা বলতে বলতে কেঁদে উঠে ফুঁপিয়ে বলল——

‘কুহুপুর অবস্থা ভালো নেই কোনো। ও যেভাবে কষ্ট পেয়েছে, যে পরিস্থিতিতে গেছে সেটা আমার নিজের চোখে দেখা। সেদিনের পর প্রতিটা রাত আতঙ্ক করে কুহুপুর এখন শ্বাসকষ্ট উঠে। পাগলের মতো ইনহেলার খুঁজে মুখে লাগায় যখন— আমার ভেতরটা ফেটে যায় কাব্য ভাই। মাঝেমধ্যেই হঠাৎ একা বসে বসে কাঁদে, কাঁদতে কাঁদতে চুল ছিঁড়ে। আমি পাশে বসে স্রেফ শান্তনাই দিতে পারি তখন। আপনি… আপনি জানেন না কিছু কাব্য ভাই। আজ কুহুপু পাগল, ডিপ্রেসড— সবটা একমাত্র আপনার জন্যে।’

কায়া নাক টানল। কাব্যের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল হঠাৎ, বুকে কিসের যেন যন্ত্রণা উপলব্ধি করলো কাব্য। ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এসব… এসব ও কিছুই জানত না। কখন হয়ে গেল এসব ঘটনা? কুহু চোখের সামনে থেকে এতটা দুঃখে, কষ্টে মেতেছিল? কাব্যের একবারের জন্যেও নজরে এলো না এসব?

সত্যি তো— কুহু তো সত্যি বলে। এখন এতকিছুর পরে কোন মুখে কাব্য যায় ওর সামনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে? কিসের অধিকারে?

কাব্যের চোখের সামনে সেদিন ও ঊর্মিকে হসপিটালে দেখেও কেন সন্দেহ করলো না? কেন কুহুর পাল্টা রাগের উপর ও নিজেও জেদ দেখিয়ে চলে জেল, পালিয়ে গেল সবকিছু থেকে?

কাব্যের গলাটা কাঁপছে! ওর হাতে শিভারিং হচ্ছে! কায়া কথা বলে যাচ্ছে, কাব্যের কানে বাকি কথা ঢুকতে অব্দি পারছে না। ও আটকে গেছে! জমে গেছে একপ্রকার..

রীতিমত কাব্যের চোখটা জ্বলছে, মনে হচ্ছে চোখ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। কাব্য সাথে সাথেই চোখদুটি ডলে। ওকে এখন পাগল পাগল দেখাচ্ছে। কাব্যের এই অস্থিরতা দেখে স্নিগ্ধ চুপচাপ এক বোতল পানি এগিয়ে দিল।

কাব্য সাথে সাথেই বোতলের ছিপি খুলতে থাকে। পারে না, ওর হাত কাঁপছে রীতিমতো। স্নিগ্ধ সেটা দেখে কাব্যের হাত থেকে বোতল নিয়ে ছিপি খুলে দিল। কাব্য ওর দিকে অসহায় চোখে তাকায়। স্নিগ্ধ স্রেফ কাব্যের কাঁধে হাত রাখল——‘পানিটা খাও। ঠান্ডা হও আগে।’

কাব্য সাথে সাথেই ধকধক করে পুরোটা বোতল পানি শেষ করে ফেলল। পানি খেতে খেতে ওর চোখে ভাসতে থাকে— কুহুর কান্না, ও কল্পনা করে কুহু কিভাবে কাঁদতো, কষ্ট পেত, চুল ছিঁড়ত খামচে। চোখে একের পর এক ভাসতে থাকে সবটা!

কাব্য আর স্থির থাকতে পারে না। ওর দুই চোখ রক্তিম হয়ে উঠল; সাথেসাথেই পানি খাওয়া ছেড়ে ছুড়ে ফেলে বোতলটা দেয়ালের ওদিকে। কায়া বোতল ছোড়ার শব্দে চমকে উঠল যেমন, কথা থামিয়ে বড়বড় চোখে তাকাল কাব্যের দিকে।

কাব্য মাথাটা নিচু করে দুহাত মুখের সামনে এনে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। ও পাগলের মতো এক্সপ্রেশন করছে হঠাৎ। পা দুটো নড়াচ্ছে একসাথে। সেই সাথে মাঝেমধ্যে নাক ডলছে। বারবার চোখে ভাসছে সবটা! কুহুর এতটা কষ্ট— সবটা ওর জন্যে।

কুহুর দোষ নেই। একটা ছোট-কিশোরি মেয়েকে ওভাবে টর্চার করা হচ্ছিল। কাব্য কোথাও ছিলো না। কুহু একের পর এককে কষ্ট পেয়েছে। কাব্য স্রেফ হেঁয়ালি করে গেছে।

সব দোষ ওর! কুহুর দেওয়া সমস্ত কষ্ট মঞ্জুর, কুহুর বলা সমস্ত কথার আঘাত মঞ্জুর; সব. . সবটা মঞ্জুর, কবুল, কবুল।

কাব্য এখন বুঝতে পারছে— কেন কুহু ওকে বিশ্বাস করে না, মাফ করতে পারছে না।

সবটা ঠিক এখন: এই মুহূর্তে একে একে মাথায় ক্যাচ করতে থাকে।

স্নিগ্ধ কায়ার দিকে তাকাল, বলল———‘ভাইয়া মাফ চেয়েছে তো, কুহু এবার মুভ অন করা উচিত।’

কাব্য এই প্রশ্নে সাথেসাথে মাথা তুলে কায়ার দিকে তাকাল; ও শুনতে চাইছে ভীষণকরে। কায়া একবার অস্থির কাব্যকে দেখে স্নিগ্ধকে জবাব দিল——-‘মাফ করবে না কুহুপু। আজকের কথা শুনে বুঝলাম কুহুপু বিয়ে ভাঙার জন্য কোনো প্ল্যান করছে। বিয়েটা করবে না ও। আর না কাব্য ভাইকে এত সহজে মাফ করবে।’

কাব্য চোখটা বুজে ফেলল। তারপর ধীরে ধীরে তাকাল কায়ার দিকে।

—-‘আমার ঊর্মি আর ওর মেসেজ দরকার, এনে দিতে পারবে?’

কাব্যের গলার স্বর কাপলো সম্ভবত, মুখ-চোখ ঊর্মির কথা বলতে বলতে রাগে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

কায়া নিচু কণ্ঠে জবাব দিল——‘কুহুপু তো সিম বদলে ফেলেছে। আগের সিম কোথায় রেখেছে জানি না, খুঁজতে হবে।’

‘খুঁজে বের—!’

স্নিগ্ধ বাকি কথা বলার আগেই কাব্য হঠাৎ আটকে দিল ওকে——‘খোঁজা লাগবে না, আমি বের করে ফেলব।’

স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করল——‘কিভাবে?’

কাব্য উঠে গেল হঠাৎ চেয়ার থেকে। শার্টের বোতাম ছাড়তে ছাড়তে কাবার্ডের দিকে গেল। সদ্য কেন একটা কালো পাঞ্জাবি বের করে সেটা তাড়াহুড়ো পড়তে পড়তেই থমথমে কণ্ঠে জবাব দিল——‘বিয়েটা আজকে, এখন, এই মুহূর্তেই হবে।’

স্নিগ্ধ-কায়া দুজনেই সাথেসাথেই অবাক হয়ে তাকাল কাব্যের দিকে। কাব্যের চোখ আজ ভীষন লাল হয়ে আছে। ওর হাত স্পষ্ট কাঁপছে, বোতাম লাগানোর সময় হাতের কাপুনি লক্ষ করেছে স্নিগ্ধ। কাব্য পাঞ্জাবির বোতাম কোনোমতে লাগিয়ে সোজা দরজা খুলল।

তারপর বেরিয়ে যাওয়ার আগে কি মনে করে আবার পিছিয়ে এসে কায়ার দিকে তাকাল, ম্লান কণ্ঠে কায়াকে বলল——-‘স্নিগ্ধের জন্য তুমিই পারফেক্ট। সংসার ভাঙব না আমি তোমাদের- ওটা জাস্ট ভয় দেখানোর জন্যে বলেছি। আর. . আমার পাগলটার আমার অবর্তমানে খেয়াল রাখার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ!’

বলে দ্রুত নাক ঘষতে ঘষতে চলে গেল বাইরে। কায়া-স্নিগ্ধ স্রেফ তাকিয়ে রইল! কায়া এবার কিছুটা আতঙ্ক নিয়েই স্নিগ্ধের দিকে তাকাল; বলল——-‘কুহুপু যদি জানে আমি এসব বলেছি কাব্য ভাইয়াকে, শিউর মেরে ফেলবে আমাকে।’

স্নিগ্ধ কায়ার কোমর ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে নিতে বলল——-‘সেটা বড় কথা না, বড় কথা এটা— যে ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে গেলেই আমার রাস্তা ক্লিয়ার। তারপর কে কাকে কিভাবে মারে, সেটা তখন দেখা যাবে।’

কায়া মুখে মিছে রাগ দেখাল; স্নিগ্ধের বাহুতে থাপ্পড় বসাতে বসাতে বলল——‘ফাজলামি করার সময় এখন? আমার ভয়েই জান চলে যাচ্ছে। কাব্য ভাই রেগে আছে ভীষণ মনে হলো।’

স্নিগ্ধও ভাবছে, সেভাবেই অন্যমনস্ক কণ্ঠে উত্তর দিল——-‘হু। দেখা যাক এখন। দেখা গেল ভাইয়ার বিয়ের বাসর ঘর আমাদের দুজনের আজকেই করে দেওয়া লাগতে পারে— যেভাবে কুহু-ভাইয়া আমাদেরটা করে দিয়েছিল। যদিও বাসর ঠিকঠাক করতে পারিনি এটা অন্য কথা; মেইন দুঃখের কথা তো এটাই আসলে। আজও আফসোস হয়— সামনে তরতাজা খাবার রেখেও সেদিন ফিরিয়ে দেওয়া লাগল।’

স্নিগ্ধের আফসোসের কারণে মুখ-চোখ ব্যথিত করে তাকালো কায়ার দিকে। কায়া ভ্রু কুচকে তাকাল, পরপর রেগেমেগে আক্রমণ করে স্নিগ্ধর গলায় হাত চেপে ওকে শুইয়ে দিতে দিতে চেঁচালো——‘চুপ; আর একবার ফাজলামি করলে মেরে দিব একদম!’

স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে সেভাবেই কায়ার কোমরটা চেপে ওর দিকে টেনে নিলেই, কায়া ঝুঁকে পড়ল সোজা স্নিগ্ধর বুকে। স্নিগ্ধ কায়ার কানের কাছে ফিসফিসালো——‘গলায় এভাবে চেপে ধরলে কি ফিল হয় জানিস? বলবো? বুঝিস কিছু? ‘Punish me harder babe’— এটার অর্থ কি বল? ঠিক উত্তর দিতে পারলে দুই মার্ক পেয়ে পাশ করবি, সাথে একটা খাস চুমু বোনাস পাবি। বল বল, দ্রুত বল।’

কায়া লজ্জায় তখন প্রায় নাস্তানাবুদ। সাথে সাথেই স্নিগ্ধর গলা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইল, তবে পারলো না। তার আগেই স্নিগ্ধ দুহাতে কায়াকে আটকে দিয়েছে, বন্ধ করে দিয়েছে পালানোর সব পথটুকু!

তারপর কাব্য সোজা গিয়েছে নিজের বাবা-মায়ের ঘরে। কাব্যের বাবা আনোয়ার সবেই ফিরেছেন বাইরে থেকে। রুমে এসে পাঞ্জাবি খুলছেন; পাশেই শামিমা লেবুর শরবতের গ্লাস নিয়ে দাড়িয়ে আছেন।

কাব্য ঠিক তখন ঠাস করে দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকে গেল।এমন শব্দ করে দরজা খোলাতে শামিমা-আনোয়ার দুজনেই তাকালেন ছেলের দিকে।

কাব্য অস্থির; চোখ দুটো ভয়ানক লাল, সেভাবেই কাপতে কাপতে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বলল——-‘আমি… আমি কুহুকে আজ এক্ষুনি বিয়ে করতে চাইছি। চাচ্চুকে ফোন করে অনুমতি নাও।’

শামিমা-আনোয়ার রীতিমতো বেক্কল হয়ে তাকালেন কাব্যের দিকে। কাব্য হাপাচ্ছে ভীষণ! ও বেপরোয়া শ্বাসের গতি নিয়ে ফের থেমেথেমে বলল——-‘আমি জানিনা তোমরা চাচ্চুকে কি বলে রাজি করাবে। এসব আমার দেখার না, কিন্তু বাই হুক ওর ক্রুক— কুহুকে আজকের মধ্যে আমি আমার বউ হিসেবে এই ফ্ল্যাটে দেখতে চাই। নাহলে . . !’

আনোয়ার ভ্রু কুচকে ফেললেন; বিতৃষ্ণা নিয়ে বললেন——‘অসভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো কাব্য। বিয়ে তো পরশু হচ্ছেই, এত তাড়া কিসের?’

কাব্য অতিষ্ট গলায় বলতে থাকে——‘বাবা, বাবা, বাবা.! আজ বিয়ে নাহলে এই বিয়ে আর কখনোই হবে না। প্লিজ বাবা! একটু বুঝো! চাচ্চুর সাথে কথা বলো, অন্তত এইবার আমার রিকুয়েস্ট রাখো। প্লিজ!’

আনোয়ার কিছু বলার আগে শামিমা কাব্যের দিকে এগুলেন——‘আচ্ছা আচ্ছা: আমরা বলবো কথা। তুই আগে শান্ত হো; আব্বু ঠান্ডা হো, শ্বাস নে ভালো করে। কি হয়েছে আব্বু? বল আম্মুকে? কুহু কিছু বলেছে? কিছু হয়েছে তোদের মধ্যে? আব্বু, বল।’

কাব্য শ্বাস ফেলতে ফেলতে নিজেকে হঠাৎ ভেঙ্গে ফেললো মায়ের সামনে। আচমকা শামিমার সামনে চুড়ান্ত বিধ্বস্তের ন্যায় ভাঙা স্বরে বলল——‘তোমরা জাস্ট বিয়েটা করিয়ে দাও: ব্যাস! কিছু জানতে চেও না। আমার কাছে জবাব নেই কিছুর। না তোমার না কুহুর, কারোর জবাব নেই আমার কাছে।’

কাব্য থামে। ফের ক্লান্ত কণ্ঠে, মাথাটা হালকা কাত করে আবার বলে——-‘বি. . বিয়েটা করিয়ে দাও আম্মু, প. . প্লিজ। আই জাস্ট নিড দিস ম্যারেজ টু বি ডান, ডেসপারেটলি!’

শামিমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেন নিজের গুরুগম্ভীর, ভদ্র ছেলেটার ভঙ্গুর বিধ্বস্ত; ভাঙা রূপটা। যে আজ ছোট বাচ্চাদের ন্যায় শামিমার কাছে কুহুকে একপ্রকার ভিক্ষা চাইছে। শামিমার বুকটা কেমন যেন করে উঠলো।

#চলবে

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply