Golpo ডার্ক রোমান্স ডিজায়ার আনলিশড

ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৬


ডিজায়ার_আনলিশড

✍️ সাবিলা সাবি

পর্ব-৬

ঘরের দরজা বন্ধ হওয়া মাত্রই জাভিয়ানের চোখের ভাষা বদলে গেল। বাইরে যে দাপট, ঠাট—সব যেন এক নিমেষে মিলিয়ে গেল, জায়গা নিলো এক ধরণের অদ্ভুত নির্লিপ্ততা। তান্বী দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে, আর জাভিয়ান কোনো কথা না বলে সোজা ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল।

জলের শব্দ ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। মিনিট কেটে আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল। তান্বী ততক্ষণে ক্লান্ত চোখে চারপাশ তাকিয়ে সবকিছু পরখ করে যাচ্ছে।—বড় কিং সাইজের নরম বিছানা, মাথার ওপর ক্রিস্টাল ল্যাম্প, আর ঘরজুড়ে এক ধরনের ঘ্রান ছড়ানো কোনো দামি পারফিউমের। যার ঘ্রানে তান্বীর মাথা আরো ভার হয়ে আসছে আরো বেশি অস্থিরতা বেড়ে গেছে।

আরো মিনিট দশেক পরে অবশেষে ওয়াশরুমের দরজা খুলে জাভিয়ান বেরিয়ে এলো কালো রঙের সিল্কের নাইট স্যুটে—হাফ হাতা-শার্ট আর শর্টস পড়ে—দেখতে একদম আরামপ্রিয় কোনো রাজপুত্রের মতোই লাগছে। তার কালচে বাদামী চুলের ডগায় জল গড়িয়ে পড়ছে, হাতে ধরা তোয়ালে।

তান্বী আর অপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে দ্রুত বলে উঠলো— “শুনুন ওই মাফিয়াটার নাম যেনো কি… রিকার্দো নাকি কোন ছাই,ওকে কল দিন!জিজ্ঞেস করুন, আমার বাবা এখন কেমন আছে?”

জাভিয়ান তোয়ালে নামিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল—
“এতো রাতে কল করা যাবে না।”

তান্বীর চোখ লাল হয়ে উঠলো রাগে “কেন করবেন না? আপনি আমার বাবাকে গু/লি করেছেন! আপনি কল করবেন—মানে করবেনই!”

জাভিয়ান এক পা এগিয়ে এসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো—
— “এই মেয়ে, চুপ করো। আমি অনেক আগেই মেসেজ করে দিয়েছি ট্রিটমেন্ট শুরু করার জন্য। আর যদি আমার মুখের ওপর কথা বলো, সেই ট্রিটমেন্টও বন্ধ করে দেবো।”

তান্বীর বুক ধকধক করে উঠলো, চোখে জল ভরে গেলো। রাগে ফেটে যেতে ইচ্ছে করলেও সে চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিচু গলায় বলল— “আমার… খিদে পেয়েছে। আপনার বাসায়… খাবার পাওয়া যাবে?”

জাভিয়ান এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলো—কোনো আবেগ নেই, শুধু অদ্ভুত এক চাহনি, যেন বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটাকে কতটা ভাঙা যায়।

জাভিয়ান ধীর গলায় বলল— “কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার চলে আসবে রুমেই।”

কথাটা শেষ হতেই দরজায় টোকা পড়লো। একজন সার্ভেন্ট ভেতরে ঢুকে পড়ল, ট্রলিতে সাজানো রাতের ডিনার ঠেলে নিয়ে আসছে সে। জাভিয়ান হাতের ইশারায় নির্দেশ করতেই সার্ভেন্ট সোফার সামনের লো-টেবিলের ওপর সুন্দর করে সব সাজিয়ে রেখে নীরবে চলে গেল।

জাভিয়ান সোফায় হেলান দিয়ে বসল। তান্বী কিছুটা দ্বিধা নিয়ে পাশের সোফায় বসতেই জাভিয়ান ভুরু তুলে বলল—“এই মেয়ে, ফ্রেশ না হয়েই এসে বসে পড়লে কেনো?”

তান্বী মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে উত্তর দিল—“I’m very, very hungry right now… আর ক্ষুধা লাগলে আমি চোখে কিছুই দেখি না। আগে খাবো, তারপর ফ্রেশ হবো।”

বলেই সে টেবিলের দিকে তাকাল। জাভিয়ান মুখ বাঁকিয়ে বলল—“How nasty you are…”

তান্বী তোয়াক্কা না করে খাবারের দিকে হাত বাড়াল।টেবিলে রাখা দুটি আলাদা ট্রেতে তার চোখ থেমে গেল—একটাতে ছিল বিদেশি স্বাদের মেক্সিকান ডিশ, রঙিন সালসা, চিজি এনচিলাডা, আর স্যুপের সাথে গার্লিক ব্রেড; আর অন্যটাতে ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত, গরম ডাল, বেগুন ভাজা, আর মসলাদার গরুর মাংস—পুরো বাঙালি ঘরোয়া আয়োজন।

তান্বীর ঠোঁটে এক ফোঁটা হাসি ফুটে উঠল —হয়তো এই ঘরটা পুরোই অচেনা, কিন্তু খাবারের গন্ধে হঠাৎ করে ভেতরে একটু চেনা উষ্ণতা জেগে উঠল তার মায়ের হাতের রান্না করা গুরুর মাংসের কথা মনে পড়ে গেলো।

তান্বীর নজর আবার ও গেলো জাভিয়ানের খাবারের দিকে তখন সে চামচ হাতে নিয়ে কৌতূহলের স্বরে জিজ্ঞাসা করলো “আপনি এটা কি খাবার খাচ্ছেন?”

জাভিয়ান নিজের প্লেট সাজাতে সাজাতে নির্বিকার গলায় বলল— “এগুলো মেক্সিকান আইটেম।”

মেক্সিকান শুনে তান্বীর চোখে দুষ্টু এক ঝিলিক ফুটে উঠল।— “মেক্সিকান? আহা… কখনো ট্রায় করিনি।”

কথা শেষ না হতেই সে বাঙালি খাবার ছেড়ে দিয়ে জাভিয়ানের প্লেটে থাকা স্যুপের দিকে চামচ চালিয়ে দিল।জাভিয়ান দুই সেকেন্ড থমকে রইল, যেন কিছুক্ষণ ধরে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

“এই মেয়ে! আমার খাবার তুমি খাচ্ছ কেনো? আমি কি খাবো?” — জাভিয়ানের গলায় বিরক্তির আগুন।

তান্বী বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললো— “আসলে… মেক্সিকান খাবার কখনো ট্রায় করিনি, তাই ট্রায়াল দিচ্ছি।”

দুই চামচ স্যুপ মুখে তুলতেই তার মুখ কুঁচকে গেল।
“ছিঃ! এটা কোনো স্যুপ? উফ… ইয়াক! এই কেমন স্বাদ? খাবো না আমি আর।”

বলেই প্লেটটা জাভিয়ানের দিকে ঠেলে দিল—“এই নিন, আপনার খাবার আপনিই খান।”

জাভিয়ানের চোখ মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল— “সিরিয়াসলি? তোমার রাখা এটো খাবার আমি খাবো? ফ্রেশ না হয়ে খাওয়া শুরু করেছো, আর তোমার খাওয়া খাবার আমি খাবো।”

তান্বী নির্বিকারভাবে কাঁধ ঝাঁকালো—“আমিতো চামচ দিয়ে খেয়েছি, হাত লাগাইনি। আপনি অন্য চামচ দিয়ে খেয়ে নিন।”

এটুকু বলে সে নির্লিপ্তভাবে নিজের ভাত-মাংস খাওয়ায় মন দিল। জাভিয়ান কটমট করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, ঠোঁট কষে বন্ধ, যেন নিজেকে কষ্টে সংযত করছে।

তান্বী ভাতের থালা থেকে ভাত মুখে তুলতে তুলতে বলল “কি হলো? খাবেন না? আরে খেয়ে নিন, রাতে না খেয়ে ঘুমোতে নেই।”

জাভিয়ান ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইল, কণ্ঠে শুষ্ক বিদ্রুপ—“এই মেয়ে, আমাকে নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা করার দরকার নেই। তুমি বরং তোমার আখেরি খাবার খাও।”

তান্বী চুপ করে গেল। তার মুখে কোনো অভিমান নেই, বরং একরকম উদাসীনতা। যেন জাভিয়ানের কথাগুলো তার গায়েই লাগছে না।সে মাথা নিচু করে খেতে থাকল।

জাভিয়ান হঠাৎ চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাল। পদক্ষেপে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। রাতের আকাশে ম্লান চাঁদ, চারপাশে নিস্তব্ধতা, আর সিগারেটের ধোঁয়া ভেসে যাচ্ছে অন্ধকারে।

মনে মনে সে তিক্ত স্বরে বলল—“গড… আমি কাকে আমার লাইফে নিয়ে এলাম!”
.
.
.
.
গুদামের ভেতরটা আধো অন্ধকার, শুধু একপাশে ঝুলে থাকা টিমটিমে বাতি কংক্রিটের মেঝেতে দীর্ঘ ছায়া ফেলছে। বিশাল লোহার দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ, আর ভেতরে কাঠের বাক্সের স্তূপে ঢেকে আছে পেছনের দেয়াল।

রিকার্দো এক বড় কাঠের টেবিলের সামনে বসে, টেবিলে ছড়ানো ম্যাপ, ডকুমেন্টস, আর কয়েকটি শিপিং শিডিউলের কাগজ। তার আঙুলে ধরা সিগারেট ধীরে ধীরে জ্বলছে, ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।

পাশে দাঁড়ানো লোকটিকে সে ঠাণ্ডা গলায় বলল—“সব কনফার্ম হয়েছে তো?”

লোকটি মাথা নাড়ল—“জি, বস। মেয়েটাকে কাল রাতেই বন্দরের Black Star শিপে তোলা হবে। ডেস্টিনেশন—ইউরোপের private buyer। শিপিং ডেট, রুট, সব লক।”

রিকার্দোর ঠোঁটে এক তৃপ্তির হাসি ফুটল।
“গুড। আর কেউ যেন কিছু টের না পায়। এই কাজটা হবে একদম ক্লিন কারন একমাত্র এই মেয়েটা কি যেনো নাম এলিনা ওকে দেখেই কড়া দাম উঠেছে সব এক্সপেন্সিভ মেয়ের সাথে একে পাঠানো হবে।”

সে আঙুলের ডগায় সিগারেট ছাই ঝেড়ে ফেলল, আর চোখের কোণে খেলা করল এক শিকারির মতো তৃপ্তি।

গুদামের বাইরে নদীর হাওয়া ঢুকে এল, সাথে এক অদৃশ্য অশনি সংকেত—যেন আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস।
.
.
.
মেক্সিকোর বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে, কালো আকাশে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। কালো রঙের SUV গাড়ি এসে থামল স্ট্রোম হাউজের সামনে। গাড়ি থেকে নামলো মেইলস্ট্রোম—চোখে মিশনের ধুলো-ময়লা, গায়ে এখনো সামান্য বারুদের গন্ধ লেগে আছে। কিন্তু মুখে সেই আত্মবিশ্বাসী হাসি, যেন রাত যতই অন্ধকার হোক, তার জন্য কোনো ভয় নেই।

ভেতরে ঢুকতেই লিভিং রুমের নরম আলোয় দেখা গেলো—একজন নারী দাঁড়িয়ে আছেন, গাঢ় কালো ব্লেজার সু্টে মাথায় সোনালি-বাদামি চুল, চোখে রাজকীয় কঠোরতা আর মাতৃত্বের হালকা কোমলতা—ইসাবেলা মোরালেস, মেইলস্ট্রোমের মা।

ইসাবেলা মোরালেস—৪৭ বছরের এক নারী, তবুও তার সৌন্দর্যে সময়ের একফোঁটা ধুলোও পড়েনি। সোনালী চুল নিখুঁতভাবে সেট করা, আলোর ঝলকে যেন সোনার তারের মতো দীপ্তি ছড়ায়। তীক্ষ্ণ সবুজাভ চোখে এমন এক দৃষ্টি, যা এক মুহূর্তে কাউকে মুগ্ধ করতে পারে, আবার পরের মুহূর্তেই মৃ/ত্যুর রায় শুনিয়ে দিতে পারে। ঠোঁটের কোণে সর্বদা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসী এক হাসি, যা মিশে থাকে রহস্য আর বিপদের গন্ধে।

গায়ে ফিটিং কালো ব্লেজার সুট, সিল্কের শার্টের কলার খোলা—গলার হীরের লকেট হালকা দুলছে,যেটা তার ক্ষমতার প্রতীক। হাই হিলের শব্দ মেঝেতে প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিবার হাঁটার সাথে, আর সেই শব্দই যেন চারপাশের লোকদের বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দেয়।

আন্ডারওয়ার্ল্ডে তাকে সবাই চেনে এক নামে—মাফিয়া কুইন। তার নাম উচ্চারণ করলেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাত কাঁপে, আর অনুগতদের চোখে ভয় মেশানো শ্রদ্ধা ভেসে ওঠে।

মেইলস্ট্রোম মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে বলল— “মম…!”

ইসাবেলা মৃদু হাসলেন, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন—
— “Mission complete, I hear?”

মেইলস্ট্রোম একটু পেছিয়ে এসে ঠোঁটে চওড়া হাসি টেনে নিলো— “তোমার ছেলে যে জিনিসে নজর দেয়, সেটা কখনো পায়নি—এমন কি তুমি কোনোদিন দেখেছো?”

ইসাবেলার চোখে মৃদু গর্বের ঝিলিক। কিন্তু সেই মুহূর্তেই পাশের করিডোর দিয়ে তাড়াহুড়ো করে এক লোক ঢুকে পড়ল। কালো স্যুটে, মুখে গুরুতর ছাপ।

“বস… আপনার জন্য একটা ব্যাড নিউজ আছে।”

ঘরের নীরবতা হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। মেইলস্ট্রোমের হাসি মিলিয়ে গিয়ে মুখ শক্ত হলো, চোখে ধীরে ধীরে জমে উঠল ঝড়ের আভাস।

ঘমেইলস্ট্রোম আর ইসাবেলা পাশপাশি দাঁড়িয়ে, তখনই সেই কালো স্যুট পরা লোকটা নিঃশ্বাস সামলাতে সামলাতে বলতে শুরু করলো।

“বস…তান্বী ম্যাডামের পুরো পরিবারকে… কোনো এক মাফিয়া ধরে নিয়ে গেছে। আর…” সে থেমে গিয়ে একবার ঢোক গিলল, তারপর বলল— “…আর তান্বীর ভাই সেই মাফিয়ার সাথেই জড়িত ছিল তাই সবাইকে নিয়ে গেছে।”

মেইলস্ট্রোমের মুখ মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে উঠল, চোখে অদ্ভুত এক তীক্ষ্ণ আলো জ্বলে উঠল। ধীরে ধীরে, যেন প্রতিটা শব্দ ছু/রি দিয়ে কেটে কেটে বলল— “কে… সে মাফিয়া?”

লোকটা মাথা নাড়ল, কণ্ঠে অসহায়তার সুর—
“বস সেটা এখনো জানতে পারিনি তবে খুব শিঘ্রই জানতে পারবো।”

শব্দ শেষ হতেই মেইলস্ট্রোমের হাত কোমরের দিকে গেল—পিস্তল বের করার জন্য। কিন্তু সে পুরোপুরি বের করার আগেই—

গুলি/র শব্দে ঘর কেঁপে উঠল। কালো স্যুট পরা লোকটা নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, কপালের মাঝখানে ফুটে উঠল র/ক্তের লাল দাগ।

মেইলস্ট্রোম ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাল… ষতার মা—ইসাবেলা মোরালেস—দাঁড়িয়ে আছে,হাতে ধোঁয়া উঠা পিস্তল। তার মুখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই, বরং ঠোঁটে ঠান্ডা হাসি।

ইসাবেলা শান্ত গলায় বললেন— “I know my son… তুমি হাফ-কমপ্লিট খবর মানতে পারবে না। আর তখন তুমি যা করতে… সেটা আমি আগেই করে দিলাম।”

মেইলস্ট্রোম এক মুহূর্ত তার মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঝড় যেন বাইরে নয়, বরং এই ঘরের ভেতরেই বইছে।

ইসাবেলা পিস্তল নামিয়ে ধীরে ধীরে মেইলস্ট্রোমের দিকে তাকাল। ঠোঁটে সেই ঠান্ডা, নিয়ন্ত্রণে রাখা হাসি। —“এই তান্বী কে?” তার গলায় কৌতূহল, কিন্তু চোখে ধারালো অনুসন্ধান।

মেইলস্ট্রোম পিস্তল কোমরে গুঁজে দিয়ে, অদ্ভুত এক শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল— “She is… my desire unleashed.”

ইসাবেলার ভ্রু সামান্য কুঁচকে গেল। “তার মানে তুমি প্রেমে পড়েছো… তাও আবার বাংলাদেশি মেয়ের? মেক্সিকোতে এমন সুন্দর সুন্দর মেয়েরা আছে, যারা এক ইশারায় তোমার পায়ের কাছে পড়ে যায়। আর তুমি কিনা… বাংলাদেশি মেয়ের প্রেমে পড়লে?”

মেইলস্ট্রোম ধীরে ধীরে তার মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল— “এই কারণেই তো আমি তাদের পছন্দ করিনি, মা। যারা এক ইশারায় পায়ে পড়ে যায়—তারা আমার কাছে সস্তা। তান্বী আমার চোখে… অনেক বেশি expensive। জানি না কেন, কিন্তু ওর মতো করে কাউকে কখনো ভালো লাগেনি। গাড়ির কাঁচের সাথে সাথে… আমার হৃদয়ের পাথরটাও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে সে।”

ঘর নিস্তব্ধ। বাইরে বজ্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে, যেন প্রকৃতিও এই স্বীকারোক্তির সাক্ষী।ইসাবেলা তাকিয়ে রইল তার ছেলের দিকে—এক মুহূর্তের জন্য তার মুখে কোনো ব্যঙ্গ নেই, শুধু এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি।

মেইলস্ট্রোম পায়ের আঘাতে মেঝের পাশে পড়ে থাকা গুলির খোসা সরিয়ে দাঁড়াল। চোখে হিং/স্র আগুন, গলায় ইস্পাতের মতো দৃঢ়তা।

— “Listen up!” তার কণ্ঠে বজ্রপাতের মতো ঝড়। “২৪ ঘন্টার মধ্যে তান্বী আর সেই মাফিয়ার খবর আমার টেবিলে না পেলে—কাউকে বাঁচিয়ে রাখবো না আমি। যে যেখানে থাকবে, সেখানে ফেলে আসবে শুধু লা/শ।”

তার বাক্যে থেমে থেমে শ্বাস নিচ্ছে ঘরে থাকা সবাই।
মেইলস্ট্রোম তাকাল ইসাবেলার দিকে আর ইসাবেলা তখন বলে উঠলো— “ মাটি খুঁড়ে হলেও সেই মাফিয়ার খবর আমার ছেলের কাছে পৌঁছাতে হবে। না হলে আমার ছেলে কেনো আমিই তোমাদের আগে শেষ করে দেবো—এই কথাটা মাথায় রেখো।”

মেইলস্ট্রোমের চোখে অদ্ভুত এক সন্তুষ্টি, যেন মা ঠিক সেই ভাষায় কথা বলছে যা সে শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে সে ঘুরে দাঁড়াল, আর ইসাবেলা তখন সিড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো তার লাল হিলের শব্দ মেঝেতে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

হাঁটতে হাঁটতে সে তার ব্যক্তিগত সার্ভেন্টের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল—— “বাথটাব সুন্দর করে সাজাও। আমি শাওয়ারে যাবো।”

সার্ভেন্ট মাথা নিচু করে বললো “জি, ম্যাডাম” বলে দ্রুত সরে গেল সে।পেছনে মেইলস্ট্রোমের লোকেরা এখনও ভয়ে থরথর করছে—তাদের কাছে এখন ২৪ ঘণ্টা, আর প্রতিটি মিনিট র/ক্তে লেখা হবে।
.
.
.
.
জাভিয়ান রাতের কফি শেষ করে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো। হাতের মগে এখনো ধোঁয়া উঠছে। নিজের রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখ কপালে উঠে গেল। বিছানায় আরাম করে শুয়ে আছে তান্বী, কম্বল টেনে প্রায় মুখ ঢেকে ফেলেছে।

জাভিয়ান কফির মগ নামিয়ে কড়া গলায় বলল—
“এই মেয়ে, তুমি আমার বিছানায় কী করছো?”

তান্বী আধা চোখ মেলে বিরক্ত গলায় উত্তর দিল—
“কেনো? দেখতে পাচ্ছেন না, ঘুমোচ্ছি?”

জাভিয়ানের ভ্রু কুঁচকে গেল “সরি, আমি আমার বিছানায় একা ঘুমাতে অভ্যস্ত। আমার পাশে কেউ শুলে আমার ঘুম হয় না। আর হ্যাঁ,আমার রুমে আমি একা থাকতে পছন্দ করি… তোমাকে বাধ্য হয়ে থাকতে দিয়েছি রুমে, সেটা আলাদা ব্যাপার তাই বলে তুমি আমায় বিছানা দখল করবে।”

তান্বী তখন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল—
“এক্সকিউজ মি, আপনার পাশে কে ঘুমাবে?”

জাভিয়ান অবাক হয়ে বলল “তাহলে আমি কোথায় ঘুমাবো?”

তান্বী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল “কেনো? ওই ডিভানে ঘুমান না।”

জাভিয়ান কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে, তারপর অবিশ্বাসের স্বরে বলল—”সিরিয়াসলি? আমি, জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী, ওই ডিভানে ঘুমাবো? এর চেয়ে হাস্যকর কথা আমি আমার লাইফে কোনোদিন শুনিনি।”

তান্বী হালকা কণ্ঠে বলল—
“কোনোদিন শুনেন নি, এখন তো শুনলেন।”

জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে বিরক্তি নিয়ে বলল—
“এই মেয়ে, নামো বিছানা থেকে। নিজে গিয়ে ওই ডিভানে ঘুমাও।”

তান্বী চোখ বোলাতে বোলাতে উত্তর দিল—
“আপনি তো একফোটাও জেন্টলম্যান নন। মেয়েদের সামান্য রিসপেক্ট দিতে জানেন না। আর হ্যাঁ, শুনুন, ওই বাংলা সিনেমার মতো, আমি পারব না যে নিচে ফ্লোরে গিয়ে ঘুমাবো, সেই অসহায় অবলা বউদের মতো।”

জাভিয়ান আঙুল তুলে বলল “লিসেন, আমি আর একবার বলবো, না হলে?”

তান্বী চাহনি সরিয়ে বলল— “নাহলে কি?” এটা বলেই পুনরায় কম্বল টেনে শুয়ে পড়লো। আর একটুও নড়লও না। জাভিয়ান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিরক্ত দম ফেলল, তারপর হঠাৎ এগিয়ে এসে তান্বীকে পাঁজাকোলে তুলে নিল। তান্বী অবাক হয়ে প্রতিবাদ করার আগেই জাভিয়ান তাকে ডিভানে নিয়ে গিয়ে হালকা করে ফেলে দিল।

সে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না—পাশ থেকে ড্রয়ার থেকে হ্যান্ডকাফ বের করে তান্বীর এক হাত ধরে ডিভানের পাশে থাকা কাঠের হাতলের সাথে আটকে দিল। ধাতব শব্দের সঙ্গে তান্বীর নিঃশ্বাস আটকে গেল।

জাভিয়ান সামান্য ঝুঁকে মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে বলল—
“এবার এখানে এভাবেই ঘুমাও সারারাত।”

তান্বী চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকাল, কিন্তু জাভিয়ানের মুখে একটুও দ্বিধা নেই—শুধু সেই দৃঢ়, অবিচল চাহনি। আর জাভিয়ান বিছানার দিকে হাঁটা ধরলো।

তান্বী হঠাৎ রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে উঠল—”শুনুন!”

জাভিয়ান দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো, ঠান্ডা দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করল—”কি হলো, চিৎকার করছো কেনো?”

তান্বী পেটে অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করে বলল—
“আমার পেটের মধ্যে একটা প্রশ্ন একুরিয়ামের জেলিফিসের মতো লাফাচ্ছে। প্রশ্নটা হলো আপনি আমাকে কেনো বিয়ে করলেন? তাও আবার ওই বদমাইশটাকে এতো টাকা দিয়ে!”

জাভিয়ান তীর্যক হেসে, বিরক্তি গলায় বলল—
“আমার জীবনে শান্তির কোনো অভাব ছিলোনা। তাই ভাবলাম, শান্তি যখন আছেই, একটু তুমুল আপদ নিয়ে আসি জীবনে। তাই তোমার মতো একটা ‘কুমিরকে’ খাল কেটে নয় একেবারে খালসহ নিয়ে এলাম।”

তান্বী ভ্রু উঁচু করে তাকাল, চোখে তির্যক ঝিলিক—
“বাহ! একদম আমার জীবনের মতোই। কিন্তু আমার জীবনে বিপদের তীব্র অভাব ছিলো।কোনোদিন বিপদ চোখে দেখিনি আর দেখেন হঠাৎ একদিন বিপদ এসে হাজির। আর সেই বিপদ আবার উদার হয়ে আমাকে সরাসরি আরেক মহাবিপদের হাতে তুলে দিলো।”

সে খানিক থেমে কৌতুক ভরা মুখে বলল—”আর সেই আমার ৪ নাম্বার সংকেতের মহাবিপদের নাম হলো। জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী।”

তান্বীর পেটে পুনরায় এক ধরনের অদ্ভুত টান অনুভব করলো। সে আরেকবার কৌতুহল ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করলো “আমার পেটে আরেকটা প্রশ্ন একুরিয়ামের—” তান্বী কথা শেষ করার পুর্বেই জাভিয়ান কড়া, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে থামিয়ে দিলো, “Shut your mouth! আরেকটাও প্রশ্ন যদি করেছো, তাহলে তোমার মুখে টেপ মেরে দিবো। আমি এখন ঘুমাতে যাচ্ছি—Don’t disturb me.”

তান্বী হোঁচট খেয়ে একটু সোজা হয়ে গেল, চোখে রাগ আর লজ্জার মিশ্রণ। সে বুঝতে পারল, জাভিয়ানের সঙ্গে এই মুহূর্তে কোনও তর্ক বা প্রশ্নের সম্ভাবনা নেই।
.
.
.
.

সকালের সুর্য এসে কক্ষে কিরন ছড়িয়ে দিলো। পর্দায় ফাঁক গলিয়ে আলো তান্বীর চোখেমুখে পড়লো আর তান্বী ধীরে ধীরে চোখ মেলল। আড়মোড়া ভেঙে উঠে প্রথমেই টের পেল—হাতের হ্যান্ডকাফ নেই, গায়ের ওপর একটা কম্বল দেয়া। মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তারপর দৃষ্টি গেল ডিভানের পাশে—ফ্লোরে এখনও তার চুলের কয়েকটা গোছা ছড়িয়ে আছে।

ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল জাভিয়ান চুলে এখনো জল গড়িয়ে পড়ছে।

—”সবাই নিচে ব্রেকফাস্ট নিয়ে বসে আছে। আমাদের জন্যও রাখা হয়েছে। এখনই রেডি হয়ে নিচে এসো, আমি যাচ্ছি,” বলে জাভিয়ান দরজার দিকে এগোল।

তান্বী তাড়াতাড়ি বলে উঠল—”শুনুন… আমার মা, বাবা, ভাই, আর বোন—ওরা কেমন আছে? একটু জানাবেন প্লিজ?”

জাভিয়ান থেমে, একবার তাকিয়ে বলল—”তোমার ভাই বাদে সবাই ঠিক আছে।”

তান্বীর গলায় কাঁপুনি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
— “ওদের কবে ছেড়ে দিবে জানেন?”

_”আমি কি করে জানবো? এটা আমার জানার কাজ নয়। আর তোমার ভাই যা করেছে, এটা তার কর্মফল। এসব ডিলারদের সাথে কাজ করলে নীতির লেকচার দিতে হয় না,” ঠান্ডা গলায় বলল জাভিয়ান।

তান্বী একটু চুপ থেকে বলল—”আচ্ছা শুনুন… আমার সামনে পরীক্ষা আছে। আপনার ল্যাপটপটা দিবেন? কিছু ইনফরমেশন দেখতে হবে।”

জাভিয়ান আলমারি থেকে ল্যাপটপ বের করে দিল।

তান্বী ল্যাপটপ হাতে নিয়ে সাবধানে জিজ্ঞেস করল—
— “পাসওয়ার্ড ?”

জাভিয়ান নির্লিপ্তভাবে বলল—”ফা/ক ইউ।”

তান্বী থমকে গেলো মুহুর্তে তারপর অবাক স্বরে জিজ্ঞাসা করলো —”কী বললেন?!”

“পাসওয়ার্ড হচ্ছে—FUCK YOU,” কপাল কুঁচকে বলে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল জাভিয়ান।

(চলবে……)

বোনাস ক্লিপ:

মাঝরাতে হঠাৎ জাভিয়ানের ঘুম ভেঙে গেল। ছোটবেলা থেকেই একা ঘুমানোর অভ্যাস—তার রুমে কারও উপস্থিতি থাকলে যেন চোখে ঘুমই আসে না। আধো ঘুমে হাত বাড়িয়ে ল্যাম্পশেড জ্বালাল। মৃদু আলোয় চোখ অভ্যস্ত হতেই তার দৃষ্টি গিয়ে থামল ডিভানের দিকে।

তান্বী সেখানে ঘুমিয়ে আছে। লম্বা চুলগুলো ডিভানের কিনারা ছুঁয়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়েছে। হাত এখনও হ্যান্ডকাফে বাঁধা—এসির ঠান্ডায় গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে, যেন ঠান্ডা তার শরীরকে আরো ছোট করে ফেলেছে।

জাভিয়ান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে রইল—তার মুখের অভিব্যক্তি বোঝা মুশকিল। তারপর এগিয়ে গিয়ে, কোনো শব্দ না করে, হ্যান্ডকাফ খুলে দিল।

আলমারির দরজা খুলে ভেতর থেকে একটা নরম কম্বল বের করল। কাছে এসে বিনা কথায় কম্বলটা তান্বীর ওপর ছুড়ে দিল। “ঠান্ডায় ফ্রিজ হয়ে ম/রার শখ জেগেছে বোধহয়,” নিচু স্বরে বলল সে, তারপর আবার নিজের বিছানায় ফিরে গেল।

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply