Golpo ডার্ক রোমান্স ডিজায়ার আনলিশড

ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৫


ডিজায়ার_আনলিশড

✍️ সাবিলা সাবি

পর্ব – ৫

ঢাকার উপকণ্ঠে, নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো এক পাটের গুদামঘর। চারপাশে ঝোপঝাড়, পাখির ডাক নেই—শুধু ভেতর থেকে ভেসে আসছে মানুষের কর্কশ হাসি আর গ্লাসের ঠোকাঠুকির শব্দ। বাইরে মোটা লোহার গেট, সামনে দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিকার্দোর লোক—গায়ে স্লিভলেস, বাহু ভর্তি ট্যাটু, হাতে দেশি-বিদেশি অস্ত্র, আর চোখে ঠান্ডা সন্দেহ।

হঠাৎ দূরে গাড়ির শব্দ ভেসে আসে। কালো একটা চকচকে দামি গাড়ি ধুলো উড়িয়ে গেটে এসে থামে। গাড়ির দরজা খুলে নামে জাভিয়ান—গায়ে নিখুঁত কাটিংয়ের কালো স্যুট, চোখে সানগ্লাস, মুখে এমন নিরাবেগ ভাব যেনো মৃ/ত্যুর হুমকি আর চা খাওয়া তার কাছে সমান স্বাভাবিক ব্যাপার।

গার্ডদের কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই, গেট ভেতর থেকে খুলে যায়। অন্ধকার করিডর পেরিয়ে, জাভিয়ান প্রবেশ করে মূল ঘরে। ঘরের এক পাশে পুরনো সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে রিকার্দো—হাতে সিগারেট, ধোঁয়া ছেড়ে ধীর গলায় বলল, “ওহো… জাভিয়ান! সকাল সকাল কী বাতাসে উড়ে এলে আমার গোপন আস্তানায়?”

জাভিয়ান দাঁড়িয়ে, ঠান্ডা স্বরে জবাব দিলো
“ডিলের বিষয়ে জাভিয়ান বাতাসের গতিতেই চলে আসে সেটা তোমার অজানা নয় রিকার্দো।”

রিকার্দো ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড নীরবতা, শুধু সিগারেটের ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। দরদামহীন চুক্তি—যা টাকা লাগবে, দেওয়া হবে। শর্তে কোনো ফাঁক নেই।

জাভিয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে, রায়হানকে কল দিলো— “একটা ব্ল্যাংক চেক নিয়ে আসো, এখনই।”

কিছুক্ষণ পর গাড়ির শব্দে দরজা আবার খুলে যায়। রায়হান ঢোকে হাতে একটা ব্রিফকেস নিয়ে। জাভিয়ান ব্রিফকেসটা টেবিলে রাখলো,আর চোখ সরাসরি রিকার্দোর দিকে—“মেয়েদুটোকে নিয়ে আসো এখনি।”

রিকার্দো আঙুলের ইশারায় লোক পাঠায় ভেতরে।
কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরই ভেতরের দিক থেকে হৈচৈ শোনা যায়। একজন লোক দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে—“বস… বড় মেয়েটা, যেটার নাম এলিনা… শ্বাস নিতে পারছে না একবারে অসুস্থ মনে হচ্ছে!”

তখনি রিকার্দো বললো “তাহলে ওটাকে রাখো। ওই ছোট মেয়েটাকেই নিয়ে আসো।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের ভেতর থেকে দুইজন গার্ড তান্বীর বাঁধন খুলে দিয়ে,তাকে টলতে টলতে বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়— তান্বীর মুখটা একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে আছে ,সে হাঁপাচ্ছে, তার বুক ওঠা-নামা করছে অস্বাভাবিকভাবে।

এ দৃশ্য দেখে এলিনার চোখ মুহূর্তেই বদলে যায়। এতক্ষণ দড়িতে বাঁধা তার ওপর নিজের শ্বাসকষ্ট থাকলেও সে হঠাৎ শক্তি পেয়ে ওঠে। “আমার বোন! ওকে ছেড়ে দাও!”—চিৎকার করে ছুটে যেতে চায়।

তান্বী একপ্রকার নিজকে ছাড়িয়ে ছুটে যায় এলিনার দিকে। কিন্তু এলিনাকে বুকে জড়ানোর আগেই, অন্য গার্ডরা তাকে ঠেলে আলাদা করে দেয়। তান্বী আবার ধাক্কা দিয়ে এগোতে গেলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় মেঝেতে। চোখে পানি জমে ওঠে, কিন্তু গলায় ভয় আর রাগ মিশে আছে।

ঘরের অন্য পাশে তান্বীর বাবা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন— “আমার মেয়েকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”

মা কান্না ভেজা গলায় বললো— “ওদের ছেড়ে দাও! প্লিজ ছেড়ে দাও আমার মেয়েদের!”

ফারহান চেষ্টা করে বাঁধন ছিঁড়ে ফেলতে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এক গার্ড তাকে এমন এক আঘাত করে যে ফারহান আর কথা বলার মতো অবস্থায় থাকেনা।

সবকিছুর মাঝখানে জাভিয়ান স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় না কোনো অনুভূতি আছে—শুধু এক অটল, শীতল দৃঢ়তা। রিকার্দো তার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি দিলো—যেনো জানে এই মুহূর্তটা কারো জীবনের গতিপথ বদলে দেবে।

গুদামের ভেতরে ম্লান আলো। দেয়ালে ঝুলছে মরিচা ধরা ফ্যান, ঘুরছে ধীরে, আরেক কোনায় ধোঁয়াটে বাতাসে ভাসছে সিগারেটের গন্ধ। দূরে বসে আছে জাভিয়ান—পা দুটো ক্রস করে সোফার ওপর, এক হাত পেছনে সোফার মাথায় টানটান রাখা, অন্য হাতে ধীরে ধীরে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। তার চারপাশে নীরবতা, শুধু সিগারেটের আগুনের লালচে ঝিলিক আর গার্ডদের দূরের গুঞ্জন।

হঠাৎ পাশের করিডর থেকে হট্টগোল শোনা গেলো— দুইজন বলিষ্ঠ লোক টেনে হিচড়ে আনছে তান্বীকে। তার কালো মেঘের মতো হাঁটু ছোঁয়া চুল এলোমেলো ভাবে দুলছে আর সামনের চুলগুলো মুখের সামনে পড়ে আছে, শ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে তার। একজন গার্ড ঘাড় চেপে ধরে এমনভাবে টানলো যে এলোমেলো চুলের গুচ্ছ কপাল আর গালের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে তান্বীর।

তান্বী গলা কাঁপিয়ে, রাগ আর কান্না মেশানো স্বরে বললো—“আমাকে ছেড়ে দে বলছি। আমার বোনের কাছে যাবো ও অসুস্থ!”

লোকেরা তাকে টেনে এনে দাঁড় করায় ঠিক জাভিয়ানের সামনে। জাভিয়ান তখনো সোফায়, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মাথা ধীরে ধীরে তুললো।

এই প্রথম তার চোখ তান্বীর মুখে থামলো। অগোছালো চুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে বড় বড় ভয়ভরা ঘন পাপড়ির একজোড়া চোখ, ফর্সা ত্বকটা ফ্যাকাশে আভায় ভরে উঠেছে, পাতলা মসৃণ গোলাপী ঠোঁটজোড়া শক্তভাবে চেপে ধরা। চোখজোড়ায় দুর্বলতা আছে, কিন্তু ভেতরে এক অব্যক্ত অটলতাও স্পষ্ট।যেন শেষ মুহূর্তেও লড়াই চালিয়ে যাবে।— তান্বীর সৌন্দর্য যেন পৃথিবীর কোটি কোটি মেয়ের মাঝে এক অবিকৃত ফুল, যা অন্য সবাই থেকে আলাদা আলোকিত। তার চুল ছিল যেমন অরণ্যের গভীরতার মতো, মসৃণ ও মুক্ত, আর তার চোখে যেন সবকিছুর কথা লুকানো এক অনন্য গভীরতা, যা হাজারো মানুষই স্বপ্নেও দেখতে পায় না। মুখমণ্ডল ফর্সা, মসৃণ আর নিখুঁত, যেন বরফে জড়ানো এক কোমল কুসুম। তার ঠোঁট পাতলা, গোলাপের পাপড়ির মতো কোমল ও আদর প্রার্থনা করে। এমন রূপ ছিল যা সাধারণ চোখে সহজে ধরা পড়ে না—তবুও যে একবার দেখবে, তার স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। তান্বী ছিল সেই মায়াবী সুন্দরী, যার ছোঁয়া পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ স্বপ্নের মতো—একদম বিরল, একদম মূল্যবান।

তান্বীও তাকায়— দেখে, সামনের মানুষটা অস্বাভাবিকভাবে শান্ত। চোখে কোনো উত্তেজনা নেই, হাসি নেই, রাগ নেই—শুধু এক ঠান্ডা স্থিরতা, যা একই সাথে ভয়ঙ্কর আর রহস্যময়। সিগারেটের ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে তার দৃষ্টি যেন সরাসরি তান্বীর ভেতরটায় ঢুকে যাচ্ছে।

সময় যেন এক মুহূর্ত থেমে যায়—পেছনে রিকার্দোর সিগারের ধোঁয়া, পাশে গার্ডদের দাঁড়ানো ছায়া, সামনে তান্বীর দ্রুত শ্বাস আর জাভিয়ানের নিরাবেগ দৃষ্টি। এটাই তাদের প্রথম দেখা, কিন্তু এই চোখাচোখি যেন অদ্ভুতভাবে দুজনের ভেতরে কোনো অদৃশ্য সুতো বেঁধে দেয়।

গুদামের ধোঁয়াটে পরিবেশে মুহূর্তটা আটকে ছিল—
জাভিয়ানের চোখ তান্বীর চোখে গেঁথে আছে, দুজনের মাঝে যেন অদৃশ্য সুতোর টান। চারপাশের শব্দ মিলিয়ে যায়, কেবল ধোঁয়া আর নীরবতা।

কয়েক সেকেন্ড পর— জাভিয়ান ধীরে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
তার মুখের অভিব্যক্তি বদলায়নি, কিন্তু যেন নিজের ভেতরের কোনো অচেনা ঝড়কে আড়াল করল—যেন কারও সামনে দুর্বলতা ধরা পড়তে দেওয়া যাবে না।

ঠিক তখন পাশ থেকে রায়হান কানে কানে ফিসফিস করে বললো—“স্যার…মেয়েটার চুল দেখেছেন ? পুরাই রূপানজেলের মতো।”

জাভিয়ান ঠান্ডা, স্থির স্বরে বলল—“বড় চুল শুধু রূপানজেলের হয় না, ডাইনিদেরও হয়।”

রায়হান ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলল—
“কিন্তু মেয়েটাকে দেখে তো ডাইনি মনে হচ্ছে না…আমার কাছে তো বেশ সুন্দর লাগল।কাল যখন দূর থেকে দেখেছি ততো ভালো করে চেহারাটা বুঝিনি, কিন্তু আজকে সামনাসামনি দেখে আমি হতবাক—সত্যি বলছিলাম স্যার, মেয়েটা কিন্তু অদ্ভুত রকমের সুন্দর।”

জাভিয়ান হঠাৎ তার দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন এক মুহূর্তে সব রসিকতা গিলে ফেললো—“সুন্দর হোক আর অসুন্দর… আমরা এখানে কেন এসেছি, সেটা মনে রেখো রায়হান।”

রায়হান ঠোঁট চেপে চুপ হয়ে গেল।কিন্তু মনে মনে সে জানল—এই মেয়েটার চোখে যা দেখেছে, সেটা কোনো ডিল, কোনো টাকার লেনদেন, কোনো বন্দুকের শক্তি দিয়েও পাওয়া যায় না।

দুইজন বলিষ্ঠ লোক তান্বীকে টেনে এনে একটা পুরনো লোহার চেয়ারে বসিয়ে দিল। ওর হাত-পা বাঁধল না—শুধু মাথার পাশে ঠান্ডা, ধাতব পিস্তলের মুখ চেপে ধরল, যেন নিঃশ্বাসের সাথেই হুমকিটা গায়ে লেগে থাকে।

তান্বীর বুক ধুকপুক করছে, শ্বাস ভারী—তবুওও একটা শব্দও বলল না। শুধু চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ঠিক সামনে বসা লোকটার দিকে।

কালো স্যুট, নিখুঁতভাবে বাঁধা টাই, ধূসর ধোঁয়ায় ছায়া পড়া মুখ একবারে নিখুঁত বাঙালি চেহারাও না একবারে মেক্সিকানও না দুটোর মিশ্রনে এই মুখ। আর সেই মুহূর্তে তান্বীর চোখ আটকে যায় সামনে বসা মানুষটার মুখে।

সোনালী রঙের চোখ—ধূসর আলোয় যেন গলিত ধাতুর মতো ঝলমল করছে। চোখদুটো এতটাই তীক্ষ্ণ যে, একবার তাকালে মনে হয় ভেতরের সব গোপন কথা পড়ে ফেলবে।

তার চেহারা যেন কোনো টিভি তারকার মতোই—তীক্ষ্ণ গালের রেখা, তবুও একধরনের স্থির সৌন্দর্য। চিকন আর পাতলা ঠোঁট… আর ঠোঁটের নিচে ডানপাশে ছোট্ট কালো তিল, যা অদ্ভুতভাবে নজর কেড়ে নেয়ার মতো।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আটকে যায় তার গালের উঁচু হাড়ে—একটা কাটা দাগের ওপর,সোজা আর আরেকটা বাঁকাভাবে, একেবারে গভীরভাবে খোদাই করার মতোই দেখতে, অনেকটা খ্রিস্টানদের ক্রুশ চিহ্ন লকেটের মতোই। দেখে মনে হয় যেন ছোটবেলায় কোদালের অথবা অন্যকিছুর কো/প খেয়েছিলো, আর সেই দাগ আজও তার মুখে অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছে। আর এটাই যেনো জাভিয়ানের চেহারার সবচেয়ে সৌন্দর্যের দিক।

এই দাগ, এই চোখ, এই ঠান্ডা ভঙ্গি—সব মিলিয়ে মানুষটা যেন এক অদ্ভুত ধাঁধা। তান্বীর মনে হলো, সামনে বসা লোকটা যেমন ভয় জাগাতে পারে, তেমনই চোখ ফিরিয়ে নেওয়াও অসম্ভব।

কিন্তু পরক্ষনেই তান্বীর মনে যে কথাগুলো হঠাৎ জ্বলে উঠল—“এ আবার কে? দেখতে তো পুরো মাফিয়ার বসের মতো… একটা মাফিয়াতে হচ্ছিলোনা আবার আরেকটা এসে হাজির! আমাকে এর সামনে বসানো হলো কেন?”

ওর চোখে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত এক চ্যালেঞ্জের রেখা—যেনও নিজেকে ভাঙতে দেবে না।

জাভিয়ান তখনো চুপ। কোনো প্রশ্ন নয়, কোনো অস্থিরতা নয়—শুধু তীক্ষ্ণ, গভীর চোখে যেন তান্বীর ভেতরের প্রতিটি স্তর খুলে পড়ছে… শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, নীরবে, ধীরে, নিশ্চিতভাবে।

রিকার্দো মুচকি হেসে হাত নাড়ল, সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে পাক খাচ্ছে। “এই নাও, জাভিয়ান—তোমার প্রোডাক্ট এসে হাজির।”

তান্বীর বুকের ভেতর অস্বস্তি গুমরে উঠল। তার চোখে ঝলসে উঠল অবিশ্বাস—”প্রোডাক্ট?এভাবে একজন মানুষকে ডাকা যায়?”

জাভিয়ান ধীরে রায়হানের দিকে তাকাল। মাথা সামান্য কাত করে একটুখানি ইশারা—শব্দহীন, কিন্তু তীক্ষ্ণ। রায়হান কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

টেবিলের ওপর রাখা কালো ব্রিফকেসটা জাভিয়ান নিজের দিকে টেনে নিল, শান্ত, যান্ত্রিক ভঙ্গিতে খুলল।ভেতর থেকে বের করল একটা ব্ল্যাংক চেক—কলমের কালো নিবের মাথায় ঝিকিমিকি আলো, যেন এই কাগজের টুকরোতেই অনেক জীবনের দাম লেখা আছে।

চেকটা ঠান্ডা ভঙ্গিতে রিকার্দোর দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বলল “যত খুশি এমাউন্ট বসিয়ে নাও।”

তান্বীর চোখ বড় হয়ে গেল। মাথায় যেন বাজ পড়ল—
এ…আমাকে বিক্রি করে দিচ্ছে? টাকার বিনিময়ে, একজনের হাতে তুলে দিচ্ছে!

তার শ্বাস ভারী হয়ে উঠল। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল—“হাউ ডেয়ার ইউ?! আমি কোনো প্রোডাক্ট না! আমি হিউম্যান! আপনি আমাকে কোনোভাবেই টাকায় কিনতে বা বিক্রি করতে পারেন না, আপনার কোনো অধিকার নেই আমাকে বিক্রি করার!”

রিকার্দোর চোখে আগুন জ্বলে উঠল। সে ঝট করে হাত তোলে, সোজা তান্বীর মুখের দিকে—এক থাপ্পর বসাতে যাচ্ছিল, কিন্তু…পাশে বসা জাভিয়ানের দৃষ্টি তার হাত থামিয়ে দিল। কোনো শব্দ নেই, শুধু সোনালী চোখের বরফঠান্ডা চাপ, যেন সেই দৃষ্টি বলে দিচ্ছে—এই মুহূর্তে থামো… নাহলে পরের পরিণতি তুমি চাইবে না।

রিকার্দো দাঁত চেপে রাগ গিলে ফেলে বললো “এই মেয়ে… চুপচাপ বসো। অতিরিক্ত চেঁচামেচি করবে না।”

তান্বীর বুকের ভেতর শ্বাস উঠানামা করছে, কিন্তু চোখে ভয় নেই। শুধু অবিশ্বাস আর তীব্র ক্ষোভ জমে আছে,
যেন এই মুহূর্তে সে এই ঘরের দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে যাবে আর সামনে বসা মানুষটা…তার ভেতরের এই আগুনটা নিভিয়ে দেবে নাকি আরও প্রজ্বলিত করবে,তা কেউই এখনো জানে না।

কিছুক্ষণ টানটান নীরবতা। ঘড়ির টিকটিক শব্দ যেন ঘরের ভেতর আরও জোরে বাজছে।হঠাৎ দরজা খুলে গেল।রায়হান ঢুকল—তার সাথে এক জন কোট-টাই পরা ভদ্রলোক, হাতে মোটা ফাইল আর কিছু কাগজপত্র। ঘরের সবার দৃষ্টি তাদের দিকে ঘুরে গেল।

লোকটা এসে চুপচাপ চেয়ারে বসল। রিকার্দো কপাল কুঁচকে, গলায় কৌতূহল আর অবিশ্বাস মিশিয়ে জিজ্ঞেস করল—“এ আবার কে জাভিয়ান?”

জাভিয়ান সোজা হয়ে বসে শান্ত, নিখুঁত ভঙ্গিতে বলল—
“কাজী সাহেব। বিয়ের কাজ শুরু করুন।”

ঘরের ভেতর এক মুহূর্তে যেন বাতাস জমে গেল।
রিকার্দো এক সেকেন্ড জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর হো হো করে হেসে উঠল। “কি বললে?! তুমি… এই মেয়েকে বিয়ে করবে?”

তার হাসি থামতেই মুখে এক ধরনের ব্যঙ্গ ফুটে উঠল।
“জাভিয়ান, তুমি টাকার বিনিময়ে মেয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছো তাও আবার বিয়ে করে?এটা তো একেবারে ইতিহাসে নাম তোলার মতো কাণ্ড।”

রায়হান সঙ্গে সঙ্গে যোগ করল— “জী স্যার, এখানে বিয়ে করতেই এসেছে।”

রিকার্দো মাথা নেড়ে আবার হেসে ফেলল। “জীবনে প্রথম দেখছি, এক ডিলার মাফিয়ার কাছ থেকে ‘বউ’ কিনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। গিনিজ বুকে নাম লেখার মতো বিয়ে এটা।”

রায়হান ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে বলল—“আমার স্যারের বিয়েটা তো খবরের কাগজেও শিরোনাম হবে।”

রিকার্দো পাশ থেকে খিকখিক করে হেসে উঠল।
আর তান্বী… একেবারে হতভম্ব। তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে— এ কেমন মানুষ? বিয়ে করছে, তাও ডিল করে… তান্বীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

“আপনারা… কার বিয়ের কথা বলছেন? আর কিসের বিয়ে?” তান্বী বিষ্ময়ে জিজ্ঞেস করলো।

রিকার্দো ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে বলল—
“আরে মেয়ে, তোমারই বিয়ে! এই যে, সামনে বসে আছে, চেনো? মেক্সিকোর সবচেয়ে পাওয়ারফুল বিজনেসম্যানের ছেলে— জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী। তোমাকে আমার কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে…তাও আবার বিয়ে করার জন্য।”

তান্বী অবিশ্বাসে হেসে ফেলল, কিন্তু চোখে ছিল তীব্র রাগ। “মামা-বাড়ির আবদার হ্যাঁ, বিয়ে কি ছেলেখেলা?
আমি কেন ওনাকে বিয়ে করব? চিনি না, জানি না, কোথা থেকে চলে এসেছে—বললেই হলো?”

জাভিয়ান ঠান্ডা দৃষ্টিতে তান্বীর দিকে তাকাল।
তার মুখে কোনো পরিবর্তন নেই, চোখে শুধু স্থির তীক্ষ্ণতা—যেন প্রতিটা শব্দ নীরবে মাপছে।

পাশ থেকে রায়হান ফিসফিস করে বলল, “স্যার, এর তো মুখ নয়, যেন বুলেট ট্রেন! থামার নামই নেই।”

জাভিয়ান ধীর স্বরে, কোনো আবেগ ছাড়া বলল—
“ট্রেন যত দ্রুতই চলুক…গন্তব্যে থামতেই হয় রায়হান।”

রায়হান ভেতরে ভেতরে হেসে মাথা নিচু করল, কিন্তু তান্বীর বুকের ভেতর রাগ আরও গরম হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারছে না— এই লোকটা আসলে কেমন? ঠান্ডা, গম্ভীর, নাকি পুরোপুরি রহস্যে ঢাকা?

কাজি তখন ধীরে ধীরে বলে উঠলো, “বাবা বলেছিলাম কনের বাবা-মাকে তো লাগবে বিয়ের সময়।”

জাভিয়ান রিকার্দোর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওর বাবা মাকে নিয়ে আসো এখানে।”

কিছুক্ষণ পরে,তান্বীর বাবা-মাকে নিয়ে আসা হলো। তবে প্রত্যেকের হাত-পা বাঁধা, শুধু মুখ খোলা। বিয়ের কাজ শুরু হওয়ার আগেই তান্বীর বাবা-মা পুরো দৃশ্যটা দেখে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।তাদের চোখে আতঙ্ক আর কষ্টের ছায়া।

বাবা কাঁপা কণ্ঠে বললো “এসব কি হচ্ছে আর কার বিয়ের আয়োজন হচ্ছে এখানে? আমার মেয়েকে এখানে কেনো বসিয়ে রেখেছো?”

মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন “আমার মেয়েটাকে তোমরা ছেড়ে দাও দয়া করে।”

তান্বী বুক ভেঙে চিৎকার করে বলল, “মা, এই গুন্ডারা আমাকে এই লোকটার সঙ্গে টাকার বিনিময়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।”

এদিকে কাজি সাহেব পবিত্র বিয়ের কাজকর্মের সূরা পাঠ শুরু করলেন, গম্ভীর গলায়— “আল্লাহর নামে শুরু করছি, যিনি পরম দয়ালু, পরম করুণাময়। তিনি কোরআন থেকে সূরা বের করে পড়তে শুরু করলেন—প্রথমে সূরা ফাতিহা,তারপর সূরা নিকাহ, আর শেষে সূরা ইখলাস।

তারপর কাজী সাহেব তান্বীকে কবুল বলতে বললেন। কিন্তু তান্বী একদম নীরব, মুখে কোনো শব্দ নেই।

কাজি মাথা ঝুঁকিয়ে জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা, মনে হচ্ছে মেয়েটা রাজি নয় এই বিয়েতে।”

হঠাৎ জাভিয়ান পকেট থেকে পিস্তল বের করে কাজীর মাথায় ঠেকিয়ে বলল, “বিয়ে পড়াতে এসেছেন বিয়া পড়ান। এতো কথা কেনো বলছেন? আপনার মুখে শুধু বিয়ের সূরা থাকবে বাড়তি কথা না‌‌, নাহলে কথা বলার জন্য সেই মুখই থাকবে না আপনার। আমি চিরতরে বন্ধ করে দিবো।”

কাজি ভয়ে কম্পমান গলায় তান্বীর দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, কবুল বলো, বলো কবুল…” কিন্তু তান্বী রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

রায়হান তখন ধীরে বলল, “স্যার, মনে হচ্ছে এই মেয়ে একদম নিষ্পাপ নয়। একে বাদ দেওয়াই ভালো।”

জাভিয়ান কাঁপা রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “না রায়হান, হাতে সময় কম আমাদের। আর তাছাড়া, এই মেয়েটা আমাকে রাগিয়ে দিয়েছে, আমি একেই বিয়ে করবো।”

রায়হান হালকা সুরে পুনরায় জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, আমি আবারও বলছি আমার মনে হয়,মেয়েটাকে বিয়ে করার দরকার নেই। দেখুন তো, দাঁত দুটো দুই পাশে ওপরে আরো দুটো দাঁত গজিয়েছে ,একদম ভ্যাম্পায়ারের মতো! এই মিস গজদন্তনীকে! বিয়ে করলে, ঝগড়ার সময় কামড়ে দিতে পারে আপনাকে আর যদি একবার এই দাঁত আপনার মেইন পয়েন্টে!”

সবাই একটু হেসে উঠলো রিকার্দো সহ, কিন্তু জাভিয়ান চুপ। একটু থেমে, তারপর কঠিন কণ্ঠে বলল—“রায়হান, তোমার কাছে কসটেপ আছে?”

রায়হান ব্যাগ থেকে কসটেপ বের করে জাভিয়ানের দিকে এগিয়ে দিল। জাভিয়ান একটা ঝটকায় রায়হানের মুখে কসটেপ মেরে দিল। রায়হান একদম অবাক, চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। রিকার্দো পাশে থেকে খানিকটা হাসল।

কাজীর জোরালো আহ্বানের পরেও তান্বী নিরবতা ভেঙ্গে কবুল বলছেনা। দূরে ফারহানের মুখ বাঁধা, ঝুলন্ত অবস্থায় সে কোনো কথা বলতে পারছে না।বাবা-মায়ের কান্না আর মায়াবী নিরবতা চারপাশে বিষাদ মিশিয়ে দিয়েছে।

জাভিয়ানের ধৈর্য্য শেষের মুখে এসে ঠেকলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে তান্বীর কাছে এগিয়ে গেল। হঠাৎ পিস্তল বের করে তুলে তার কপালে ঠেকিয়ে দিল।

তান্বী চুপচাপ চোখ খুলে তার দিকে তাকাল, চোখে কোনো ভয়ের ছায়া নেই, বরং গভীর এক অদম্য দৃঢ়তা।
শান্ত গলায় বলল—“আপনার মতো একটা গুন্ডা-মাস্তানকে বিয়ে করার চেয়ে, আমি মরনকেই বেশি ভালোবাসবো এই মুহূর্তে। কাম অন সুট মি!”

জাভিয়ানের ঠোঁটের কোণে বাঁকা এক হাসি ফুটে উঠল।
সে উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎ তান্বীর বাবার পায়ের কাছে গুলি ছুড়ে দিলো।

তান্বী চিৎকার করে উঠল—“না! বাবা!”

জাভিয়ান দ্রুত এগিয়ে এসে তার মুখ চেপে ধরে বলল—
“এখন বলো—আমাকে বিয়ে করার চেয়ে নিজের বাবার মৃত্যু/কে বেশি ভালোবাসবে?”

তান্বীর চোখে রাগ আর দুঃখের জোয়ার উঠল। কিন্তু সে থেমে গেলো, মুখে কথা বের হলো না… সেই দৃঢ়তা আর অপ্রতিরোধ্য আত্মবিশ্বাসের মাঝে যেনো একটা ছোট্ট লড়াই চলছে—জীবন আর মৃ/ত্যুর মাঝে।

তান্বী হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পা দুটো উঁচু করে, দু হাত জোর করে জাভিয়ানের কলার টেনে ধরল। চোখ ঝলমল করছে আগুনের মতো, গলার কণ্ঠে ছিল দৃঢ় অথচ দমন করা ক্ষোভ, “আপনি কেন আমার বাবাকে গু*লি করলেন? বলুন, কেনো?”

জাভিয়ান চুপচাপ তাকিয়ে ছিল তান্বীর মুখোমুখি।
তার চোখ ঠান্ডা, নিঃসঙ্গ, যেন কোনো মানবিক আবেগ সেখানে স্থান পায়নি। হাত দিয়ে শক্ত করে ধরল তান্বীর দু’হাত, ধীরে ধীরে পেছনের দিকে ঠেলে দিলো হাত দুটো— আর টেবিলের কাছে নিয়ে এসে হাতদুটো পেছন দিকে মুচড়ে ধরে রাখলো যেনো পালানোর কোনো সুযোগ না থাকে।

তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো “কবুল বলো,”
তার গলায় ছিল হিমশীতল হুমকি, “এবার কবুল না বললে, পরের গু/লিটা তোমার মায়ের ঠিক মাথায় করা হবে।”

তান্বীর চোখে অগ্নি ঝলমল করল, কিন্তু সে বুঝল—আর কোনো দৌড়ঝাঁপ আর তর্ক করার সুযোগ নেই। সে মুখ বুজে, কণ্ঠ ভেঙে ফিসফিস করল, “কবুল, কবুল, কবুল…”

জাভিয়ানের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক ধরনের রহস্যময় খুনসুটি হাসি,“এইতো গুড গার্ল! তুমি এই কবুলটা আরেকটু আগে বললে, তোমার বাবাকে গু/লিটা খেতে হতো না। আর আমার একটা বুলেট নষ্ট হতো না—তুমি জানো এটা কত স্পেশাল,আর এক্সপেন্সিভ বুলেট ছিলো।”

সে ধীরে ধীরে পিস্তলটা পুনরায় কোমড়ে রাখলো,কিন্তু তান্বীর মনে একটা অদ্ভুত গর্জন উঠল—নিস্তেজ নয়, বরং আগুন যা আরও তীব্র হয়ে জ্বলে উঠলো।

বিয়ের কাগজপত্র গুছিয়ে নেওয়া হলো, তান্বীর হাতে পেন ধরিয়ে সিগনেচার করানো হলো। তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল, কিন্তু মুখে কোনো প্রতিবাদ বা স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। বিয়ের গম্ভীর মুহূর্তে ঘরটা যেন স্থির হয়ে গেলো, সময়ের গতিও যেন থেমে গেল।

তান্বীর বাবা-মায়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল।
বেদনার অশ্রু আর করুণ চিৎকারের মাঝে তারা বসে আছে, একটু আগের শোকে ছিন্নভিন্ন, আর একটু পরের ব্যথায় নিস্তব্ধ। মায়ের গলার কন্ঠ ফেটে ফেটে কাঁদছে, বাবা গু/লিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, আর পাশে বসে কাঁপছে।

সবাই গা ছমছমিয়ে চুপ হয়ে গেলো, ঘরের গন্ধ যেন কেবল ব্যথা আর অস্থিরতার মিশেল। এখন তান্বীকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হলো।হঠাৎ করে তান্বী বেঁকে বেঁকে চিৎকার করে ছুটে গেলো তার বাবা-মার কাছে, “আমি তোমাদের ছেড়ে যাবো না! আমাকে যেতে দিওনা মা!”

জাভিয়ান শীতল চোখে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ফারহানের সামনে। রিকার্দোর দিকে তাকিয়ে বললো তার কণ্ঠে কঠোর অথচ স্পষ্ট হুঁশিয়ারি, “এই সেই তোমার বিশ্বস্ত ডান হাত, রিকার্দো? তারপর পুনরায় ফারহানের দিকে তাকিয়ে বললো “তোর বোন এখন আমার সঙ্গে যাচ্ছে। শুকরিয়া কর যে ও আমার সঙ্গে যাচ্ছে—নাহলে হয়তো কোনো নরখাদদের কাছে চলে যেত।”

ফারহান কিছু বলতে চাইল, কিন্তু সে অক্ষম। শুধু রিকার্দোর দিকে তাকাল, তারপর মুখ নামিয়ে নীরব হয়ে রইলো।

জাভিয়ান জোর করে তান্বীর হাত ধরে টানতে লাগল,
তান্বী প্রতিরোধ করতে চাইল—হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ছোটাছুটি করল, মুক্তির জন্য লড়ল, গলার গভীর থেকে হাহাকার উঠল। কিন্তু জাভিয়ানের এক হাত দ্রুত কাঁধে উঠে গেলো, তার শক্ত হাতেই তান্বী কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই বঞ্চিত হয়ে পড়ল।

হাওয়ার মতো ভারী নিশ্বাস নিয়ে জাভিয়ান ওকে কাঁধে তুলে নিলো, তান্বীর শরীর কাঁপছিলো, চোখ থেকে ঝরে পড়ছিলে অশ্রু মিশ্রিত হতাশা।

গাড়ির কাছে এসে পৌঁছতেই, জাভিয়ান তান্বীকে ধীরে ধীরে পেছনের সিটে ফেলে দিলো। তার হাত দুটো দ্রুত ধরে নিয়ে শক্ত হ্যান্ডকাফে বেঁধে দিলো সিটের সঙ্গে। হ্যান্ডকাফের কাঁটা শব্দে চারপাশ আরও সংকীর্ণ হয়ে উঠল যেন। আর মুখে কসটেপ লাগিয়ে দিলো‌।

তান্বীর ছলছলে চোখ চারপাশে ঘুরলো,দূরবীন দিয়ে খোঁজার মতো এক আশঙ্কা আর অসহায়তার ছাপ মাখানো ছিল তার মুখে।

রাতের ঘন অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইট ছড়িয়ে দিচ্ছে এক মসৃণ আলো। পেছনের রাস্তা যেন নিঃশব্দে পিছিয়ে যাচ্ছে। পাশের সিটে বসে রায়হান মুখে ছাপিয়ে হাসি নিয়ে হালকা কণ্ঠে বলল—“স্যার, আজকে আপনি একদম ডিপজলের মতো করে বিয়েটা করলেন!”

জাভিয়ান থমকে তাকিয়ে, সোনালী চোখে অবিশ্বাস জ্ঞাপন করল—“ডিপজল, হু ইজ ডিপজল?”

রায়হান আবার মজার ছলে উত্তর দিল,
“আরে রে স্যার, ডিপজলকে চেনেন না? বাংলা সিনেমার ভিলেন, যার মতো করে আজকে এই বিয়েটা করলেন! মনে হলো, আজকে বাংলা সিনেমার বিয়ে দেখতে পেলাম!”

জাভিয়ান ঠাণ্ডা, ধারালো চোখে রায়হানের দিকে চেয়ে বলল “সাট ইউর মাউথ, রায়হান!”

রায়হান আরেকবার হেসে উঠল, আর বললো “কিন্তু সত্যি কথা বলতে, বিয়েটা কিন্তু এক্সট্রিম লেভেলের ছিলো।”

জাভিয়ান গম্ভীর হয়ে ভ্রু ভাঁজ করে বলল—“এক্সট্রিম হোক বা না হোক, মিস্টার চোধুরীর কাছে আমি হারিনি এটাই অনেক।”

সবার মধ্যে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা বিরাজ করছিল,
আর তান্বী,যার মুখে টেপ লাগানো যে দমবন্ধ করে পড়ে আছে গাড়ির পেছনে।
.
.

গাড়ি চৌধুরী নিকেতনের সামনে থেমে গেলো।
জাভিয়ান দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পেছনের সিটে ঢুকে তান্বীর দিকে ঝুঁকে পড়ল। তার কণ্ঠে মৃদু হলেও কর্কশ ছায়া ছিলো,“শোনো মেয়ে, মন দিয়ে একটা কথা শুনো। আমার বাড়ির লোকদের সামনে আমার বউয়ের মতো আচরণ করবে—একদম সোজাসাপটা, যেন কেউ বুঝতেই না পারে আমি তোমাকে জোর করে এনেছি।আর যদি কেউ ভুলেও বুঝে যায়, বা তোমার কোনো অন্যরকম আচরণ দেখতে পায়, তাহলে মনে রেখো, আমি একটা ফোন করব, আর সঙ্গে সঙ্গে তোমার পুরো গুষ্টির..ডেড বডি পাবে।”

তান্বীর চোখে ভয়ের সঙ্গে এক গভীর আকাঙ্ক্ষা আর লড়াইয়ের আগুন জ্বলতে লাগল। জাভিয়ানের হুঁশিয়ারি যেন এক বিরাট ঘণ্টার মতো তার মাথায় বাজতে লাগল।

রাতের নীরবতা যেন মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিলো। তান্বীর চোখে মিশে ছিলো বিস্ময় আর হতবুদ্ধি, হৃদয়ে যেন অজানা ভয়ের স্রোত বইছিলো। এই কয়েক মুহূর্তে তার জীবন যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করেছে—যে লোকটার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, আবার সেই লোক তাকে তার বাড়িতে নিয়ে এসেছে, এ যেন স্বপ্ন আর বাস্তবতার রেখা মিশে গিয়েছে,আর তান্বী নিজেই বুঝতে পারছিলো না আজকের এই পরিণতি কীভাবে হলো তার জীবনে।

জভিয়ান এবার তান্বীর হাতের হ্যান্ডকাফ আর মুখে বাঁধা কসটেপ খুলে দিলো। আর অবিচল ঠাণ্ডা গলায় বললো, “এখন নিজের জামাকাপড় আর চুল ঠিক করে, বাইরে বেরিয়ে আসো।”

তান্বী নিঃশ্বাস নিয়েও শান্ত থাকার চেষ্টা করল। সে হাতের বাঁধন মুক্ত হতে পেরে প্রথমবারের মতো কিছুটা স্বস্তি অনুভব করল। ধীরে ধীরে চুলের ছত্রভঙ্গ বুনন ঠিক করল, গায়ে পড়া জামাকাপড়ের সামান্য ভাঁজ মেলাল। একপ্রকার নির্বিকার দৃষ্টিতে গাড়ির বাইরে তাকালো এবার সে বুঝে গেলো, এখন থেকে তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না—এই কথা তার মনে বারবার ঘুরে ফিরে এল।

গাড়ির দরজা খুলে বাইরের অন্ধকারে পা রেখে দাঁড়ালেও,তার হৃদয় জোরে জোরে ধুকপুক করে উঠল যেন নতুন এক অজানা যাত্রার শুরু হলো তার জন্য।

রায়হান কোথা থেকে হাতে এক জোড়া মালা নিয়ে এসে বলল, “স্যার, এটা গলায় পড়ে নিন, না হলে তো মনে হচ্ছেনা যে বিয়ে হয়েছে আপনাদের!”

জাভিয়ান মালাগুলো দেখে হালকা বিরক্ত নিয়ে বললো,
“এটা কিসের মালা?দেখেতো মনে হচ্ছে গরুর মালা।”

রায়হান একটু অস্বস্তি নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,”আরে স্যার,মালা তো মালাই একটা হলেই হলো।এতো রাতে ফুলের মালা কোথায় পাবো। আর তাছাড়া আপনার বিয়েটা তো গরুর মতোই হয়েছে—মানুষ যেমন হাট থেকে গরু কিনে নিয়ে আসে, আর আপনি বউ কিনে নিয়ে এসেছেন!”

এ কথা শুনে তান্বী তীব্র কটাক্ষে মুখ খুলে বললো “এক্সকিউজ মি, আমি গরু নই! তবে হ্যাঁ, আপনি একটা ভেড়া আর ছাগল।”

এটা বলেই সে মালাটা রায়হানের গলায় জড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা আপনার গলাতেই বেশ মানিয়েছে!”

এটা বলেই তান্বী চোধুরী বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।

রায়হান জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে মুখে বিরক্ত আর খুশির হাসি ছড়িয়ে বলল, “স্যার, এটা কি মেয়ে ধরে আনলেন? সত্যি বলছি, কথা শুনে তো মনে হচ্ছে একটা ঝগড়াটে বউ পেয়েছেন!”

জাভিয়ান কাঁধ তুলে বিরক্তি মিশ্রিত গম্ভীর স্বরে বলল,
“কি ধরে এনেছি জানিনা, আর জানতেও চাই না।”

রাতের অন্ধকারে চৌধুরী নিকেতনের দরজা খুলতেই ঘরটা যেন একসঙ্গে স্থবির হয়ে গেলো। সোফায় বসে ছিলেন সায়েম চৌধুরী,কার্গো চৌধুরী আর দাদি সুফিয়া চৌধুরী। জাভিয়ান আর তার পাশে একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা বিষ্ময়ে উঠে দাঁড়ালেন।

সায়েম চৌধুরী ধীরে ধীরে উঠে এগিয়ে এসে চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,“জাভিয়ান, কে এই মেয়ে আর এত রাতে তোমার সঙ্গে? What’s going on here?”

জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আহ মিস্টার চৌধুরী আপনার ব্রেইন দিনদিনই ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছে নাকি। শর্তের কথা ভুলে গেলেন? Time’s up today! আর আমি জিতেছি। বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছি আপনার দেয়া শর্ত আর সময়ের মধ্যেই।”

সায়েম চৌধুরীর চোখ বড় হয়ে গেলো। সবার মুখে হঠাৎ বিস্ময়ের ছাপ পড়ল, জাভিয়ানের মা কার্গো চৌধুরী এগিয়ে এসে কন্ঠে ভরা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “জাভি, তুমি কি সত্যিই বিয়ে করে ফেলেছো?”

জাভিয়ান পকেট থেকে বের করে আনল কাবিন নামা, হাত বাড়িয়ে বাবার হাতে তুলে দিলো, “এই নিন, মিস্টার চৌধুরী আপনার প্রুফ। আমাদের বিয়ের সার্টিফিকেট। এখন কি আমরা আমাদের রুমে যেতে পারি?”

সায়েম চৌধুরী মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে বললেন,
“wait a minute, কথা এখনো শেষ হয়নি আমার।”

জাভিয়ান মুখে বিরক্তির আঁচড় নিয়ে বলল, “উফ! মিস্টার চৌধুরী। আমি আর কিছু শুনতে চাইছি না এই মুহূর্তে। আমার মুড নেই এই মুহূর্তে আর কোনো এক্সপ্লেইন দেয়ার। অনেক রাত হয়ে গেছে। বিয়ে করেছি অনেকক্ষণ আগে,অলরেডি ভোর হয়ে আসছে।সকাল হয়ে যাচ্ছে বাসর করবো কখন? আমার তো এখন বাসরের মুড হয়েছে।”

কার্গো চৌধুরী লজ্জায় পেছনে সরে গেলেন। আর সায়েম চৌধুরী রাগে ঘৃনায় অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। তান্বী এই সমস্ত কথা শুনে লজ্জায় চোখ নিচু করে ফেললো,কান গরম হয়ে গেলো মনে হচ্ছে কেউ কানে শিসা ঢেলে দিয়েছে। ঘৃণার মতো একটা অনুভূতি মিশে গেলো তার চোখে, যেন এই সব কথা তার কাছে অযোগ্য আর অপমানজনক।

সায়েম চৌধুরী আর কার্গো চৌধুরী একে অপরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারেননি, শুধু অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।

জাভিয়ান তখন তান্বীর দিকে চোখ রেখে বলল,“Its okay,darling, let’s go to our room.” সবাই বিস্ময়ের মিশ্রণে তাকিয়ে থাকল, আর জাভিয়ান হালকা হাসি দিয়ে তান্বীকে কোলে তুলে নিয়ে গেলো সিঁড়ির দিকে।

ঘরটা যেন মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো, আর সবাই ভাবতে লাগলো—এই ছেলে আসলেই কতটা লাগামহীন আর নির্লজ্জ!

চলবে…………

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply