Golpo ডার্ক রোমান্স ডিজায়ার আনলিশড

ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৪(প্রথমাংশ+শেষাংশ)


ডিজায়ার_আনলিশড

✍️ সাবিলা সাবি

পর্ব ৪. (প্রথমাংশ)

ঢাকা শহরের সকালে আজ একটু বেশি নীরবতা। চৌধুরী নিকেতনের জানালা দিয়ে ভোরের রোদ গলে পড়ছে শীতল মেঝেতে। ছাদের ওপরে দোয়েল পাখির ডাক থেমে থেমে বাজছে—যেন বাতাসও অপেক্ষা করছে কারো ঘুম ভাঙার।

কফির কাপ হাতে জাভিয়ান ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো, চোখ তার দূরে, আকাশের দিগন্তে আটকে আছে। ঢাকার মেঘে মেঘে সে আজ খুঁজে ফিরছে সান্তা লুসিয়ার রোদ, মেক্সিকোর সেই বিকেলগুলো, যেখানে শত্রুতা আর বিশ্বাসঘাতকতার পেছনে ছিলো একান্ত নীরব এক পুরনো যন্ত্রণা।

ঠিক তখনই রায়হান ছুটে এলো—সাদা শার্ট, কালো টাই পরিহিত, মুখে চাপা উত্তেজনা নিয়ে। “স্যার… রিকার্দো ইনভাইট করেছে আপনাকে” রায়হান হঠাৎ বলে উঠল।

জাভিয়ান ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে তাকাল, “কেন?”

“আগামীকাল একটা বড় ডিল হচ্ছে, রিকার্দো সেটার জন্য একটা প্রাইভেট সেলিব্রেশন রাখছে। ও খবর পেয়েছে আপনি বাংলাদেশে এসেছেন।”

জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে একরকম শীতল হাসি টেনে বলল, “রিকার্দো কখনোই কিছু ‘সেলিব্রেট’ করে না, ও শুধু মঞ্চ সাজায়।”

রায়হান মুখ নামিয়ে বলল, “আমি তাহলে রেসপন্স পাঠিয়ে দিই, স্যার?”

“পাঠাও। বলো—আমি যাচ্ছি।”

জাভিয়ানের কণ্ঠ ছিলো স্থির, কিন্তু চোখের পাতার নিচে যেন হঠাৎই সেই পুরনো ক্ষত জ্বলে উঠল। যেটা এখনও এলোমেলোভাবে থাকা তার কালচে সোনালী চুলের ফাঁক থেকে উঁকি দিচ্ছিল—অতীতের নীরব সাক্ষী হয়ে।
.
.
.
.
গুলশান –রাত

লোকেশন: Club Oro, Block C – G1, গুলশান ১, ঢাকা।

শহরের বাতাসে হালকা শীত জমে উঠছে। শহরটা ঘুমোতে যাচ্ছে, কিন্তু গুলশান ১-এর ব্যস্ত সীমানায় এক কোণে আলো ঠিকরে পড়ছে একটি ক্লাবের বাহারি দরজায়—Club Oro।

এই ক্লাব সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এই ক্লাবে ঢোকার জন্য পরিচয় নয়, দরকার “ওজন”।

আজ রাতের জন্য এটি সম্পূর্ণ বুক করেছে—রিকার্দো ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে এখন এক ভয়ংকর নাম। “Club Oro” এর নিচে গোপন একটি ভিআইপি চেম্বার আছে—যেখানে বসবে আজকের মাফিয়া সেলিব্রেশন। কারণ কাল যে ডিল হচ্ছে, তা যদি সাকসেসফুল হয়—ঢাকার নারকীয় পাচারচক্রের আরও একটি নতুন শাখা খুলবে।
.
.
.
.
রাত ঠিক ১১:২২। চৌধুরী নিকেতন।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জাভিয়ান আকাশ দেখছিল।
ঠোঁটে নিভু নিভু একটি সিগারেট—তবু জ্বালায়নি।
মনে হচ্ছিল, সে যেন নিজের শ্বাস ধরে আছে।

পেছন থেকে দরজায় নক পড়ল।রায়হান ঢুকল চুপচাপ, কিন্তু উত্তেজনা লুকাতে পারছে না।

“স্যার… রিকার্দো Club oro বুক করেছে আজকের জন্য। আজ রাতটা…ওর ভাষায়, ‘The real fire starts tonight.’ কাল ওর সবচেয়ে বড় ডিলটা ফাইনাল হচ্ছে।”

জাভিয়ান চোখ নামাল। ধীরে সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে একটা টান দিল—নীরব আগুনের মতো। “Did he say who else will be there?”

রায়হান একটু গলা নামিয়ে বলল— “Some international investors, Russian contacts, and… a couple of showbiz faces too. Plus, imported girls… fresh, clean. সব কিছু ও নিজের মতো সেট করেছে।”

জাভিয়ান ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। চোখে একরকম ছায়া নামল—সামনে ঝড়ের পূর্বাভাসের মতো। একটা ঠান্ডা হাসি ফুটল ঠোঁটের একপাশে, অদ্ভুত ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলল “Ready the car. I want to look like the devil himself tonight.”

রায়হান মাথা নোয়াল, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

ড্রেসিং রুমে ঢুকেই জাভিয়ান তার কালো ভেলভেট ব্লেজারটা তুলে নিল। এর বোতামগুলো ছিল ম্যাট ব্ল্যাক,আর গলার কাছে রেশমের হালকা কাটা। ভিতরে গাঢ় মেরুন রঙা সিল্ক শার্ট, যার দুটো বোতাম খোলা, যেন এক ঝলকে মনে হয়—সে ভদ্র, কিন্তু বিপজ্জনক।

প্যান্ট ছিল স্লিম ফিট কালো সাটিন ট্রাউজার, একেবারে নিখুঁত ফিটিং। পায়ে Christian Louboutin এর কালো লেদার লো-হিল জুতো, যার পেছনে লাল সোল একঝলকে চোখে পড়ে যায়।

চুলটা স্টাইল করল স্লিক ব্যাক করে, হালকা গ্লসি ফিনিশে। হেয়ার জেলটাও ছিল Dior Homme-এর styling clay, যা দীর্ঘ সময় একইভাবে ধরে রাখে।

পারফিউম? Maison Francis Kurkdjian Baccarat Rouge 540. একবার স্প্রে করল গলার কাছে, আরেকবার কব্জিতে—রক্ত-মেশানো মধুর ঘ্রাণ যেন চারপাশে ছড়িয়ে দিল দাবানলের মতো কামনার গন্ধ।

ঘড়ি হিসেবে পড়ল Audemars Piguet Royal Oak, কালো স্টিলের বডি।
.
.
.
.
রাত ১২ টা।
গাড়ি থামল ‘Club Oro’-এর সামনে। বাইরের আলো ছিল ম্লান, কিন্তু লাল কার্পেট আর কাঁচের দরজা ঠিকরে দিচ্ছিল ভেতরের সোনালি আলোর প্রতিচ্ছবি।

জাভিয়ানের গাড়ি ছিল: Aston Martin DBS Superleggera (Black & Red) গাড়ি থেকে নামল ধীর পায়ে, যেন প্রতিটি পদক্ষেপে ছড়িয়ে পড়ছে তার অধিকার।

রায়হান দরজা খুলে ধরতেই জাভিয়ান কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব এক ঝলক দেখে নিল। তারপর ক্লাবের দরজা পার হলো মাথা উঁচু করে।

রিসেপশনিস্টের চোখ স্থির হয়ে গেল তার দিকে, আর শুধু একটা কথাই মুখে এল, “Sir, welcome. They’re waiting for you upstairs.”

জাভিয়ান ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “Let them wait.” তার পদচারণা যেন বাজের মতো—নিঃশব্দে গর্জে ওঠে। ক্লাবের লাল আলো তার মুখে পড়তেই মুখটা কল্পনাতীতভাবে ধারালো আর অনিন্দ্যসুন্দর দেখায়। চারপাশের কেউ তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না।
.
.
.
.
Club Oro — VVIP সেকশন

রাত ১২টা ৩৮ মিনিট। সোনালি ঝাড়বাতির নিচে মোটা গ্লাসে হুইস্কি হালকা কাঁপছে। পাশের অ্যাশট্রে-তে আধপোড়া এক সিগারেট নিঃশব্দে ধোঁয়া ছাড়ছে।

ক্লাবের কোণার এক গোল টেবিলে, জাভিয়ান বসে আছে—পায়ের উপর পা তুলে হালকা হেলান দিয়ে।য়এক হাত সোফার হ্যান্ডেলে, আরেক হাতে সিগারেট। মুখের কোণে অদ্ভুত ঠান্ডা হাসি।

রিকার্দো বসে আছে তার ঠিক সামনের সোফায় বরাবর, কিছুটা অস্থির ভঙ্গিতে হুইস্কির গ্লাস ঘুরিয়ে বললো—রিকার্দোর কণ্ঠে রাগ আর তাচ্ছিল্য মেশানো “সব ঠিক হয়ে গেছে। কাল রাতেই দুবাই থেকে নতুন কন্টেইনার নামবে। কিন্তু একটা প্রবলেম হচ্ছে—আমার ডান হাত যে সবসময় আমার সব ডিল একাই সামলেছে ওই ফারহান শালা এই ডিলটা নিয়া টালবাহানা শুরু করেছে।”

জাভিয়ান, ঠোঁটে সিগারেট চেপে, চোখে চোখ রেখে ধীরস্বরে বললো “বিশ্বস্ত বলেই তো এতদিন টিকেছে…কিন্তু যখন নিজের লোকই কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়—তখন কি করো, রিকার্দো?”

রিকার্দো, গ্লাস নামিয়ে মুখে একটা গালি ফেলে বললো
“শালা বলেছে এই ডিলটা নাকি ও করতে পারবেনা ওর ঘরে নাকি বোন আছে ও অন্য কারো বোনকে বিক্রি করতে পারবেনা! এতদিনে বিবেক জেগেছে! ওকে আজএ পর্যন্ত সময় দিয়েছি আর আজ যদি জবাব না দেয়, ওর জীবন নরক করে দিবো।”

জাভিয়ান ধোঁয়া ছাড়লো—সিগারেটের ছায়ায় চোখগুলো অদ্ভুতভাবে চকচক করে ওঠলো। তার ঠোঁট বাঁকিয়ে উঠে আসে এক শীতল হাসি— “সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে… আঙুল বাঁকাতে হয়। কেউ না বুঝলে বুঝে যাবে। আর তারপরে ও না বুঝলে… You know what to do.”

রিকার্দো, গ্লাস তুলে চুমুক দেয়। চোখে এখন আগুন। “Tonight’s the line, my friend. Either he walks in… or gets wiped out.”

এই বলে রিকার্দো উঠে দাঁড়ায়। হালকা হেলান দিয়ে নিজের শার্ট ঠিক করে পাশের টেবিলের দিকে হাঁটা ধরে—সেখানে অপেক্ষা করছে দুই আন্তর্জাতিক ক্রেতা আর এক রাশিয়ান অনুবাদক।

জাভিয়ান তখনও চুপচাপ সোফায় বসে ধোঁয়া ছাড়ছে। চোখে এক অপার শীতলতা। জীবনের প্রতি কোনো তাড়াহুড়ো নেই। যেন সবকিছু আগেই জানে।

সিগারেটের ধোঁয়া ভরে ওঠে টেবিলের চারপাশে। গ্লাসে পড়ে থাকা বরফের গলন আর হুইস্কির রং তার চোখে প্রতিফলিত হয়। গান, লাইট, হাসি—সবকিছু ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায়… কিন্তু জাভিয়ানের চোখ স্থির, ঠান্ডা, আর একধরনের বিক্ষুব্ধ বিষণ্ণতায় ভরা।

এদিকে তার সেক্রেটারি রায়হান ডান্স ফ্লোরে কয়েকটা মেয়ের মাঝে, হালকা এলকোহলে ঝিম ধরেছে। ডিপ হাউজ বিটের সাথে সে কোমর দুলিয়ে হাসতে হাসতে নাচছে।

জাভিয়ান চোখ সরিয়ে একবার দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বললো “এই রায়হান টাও না, একে দিয়ে যে কী হবে?”

সেই রাতে ক্লাবে সবার চোখ ছিল ঝলমলে আলো আর উচ্চস্বরে বাজতে থাকা মিউজিকে, কিন্তু এক কোণে বসে থাকা জাভিয়ান ছিল ঠিক তার উল্টো। নিঃশব্দ, স্থির আর ভয়ংকরভাবে গম্ভীর। ঠোঁটে সিগারেট, চোখে তীক্ষ্ণ চাহনি—একটা আগুনের মতো শীতলতা ছড়াচ্ছিল তার চারপাশে।

অনেকক্ষণ ধরে এক সুন্দরী মেয়ে জাভিয়ানকে দূর থেকে নজরে রেখেছিল। চোখে ছিল কৌতূহল আর কিছুটা দম্ভ। হঠাৎ করেই সে এগিয়ে এসে জাভিয়ানের পাশে সোফায় বসল, যেন বহুদিনের চেনা। জাভিয়ান ঠোঁটে সিগারেট তুলে চোখ নামাল মেয়েটার দিকে—নির্বিকার, ঠান্ডা অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।

মেয়েটা ধীরে ধীরে নিজের নকশা আঁকা লাল নখগুলো দিয়ে জাভিয়ানের হাতের তালু ছুঁয়ে কাঁধ পর্যন্ত আঙুল চালাল, যেন কোনো শিকারকে ঠাহর করছে। কিন্তু জাভিয়ানের চোখে এক বিন্দু নাড়া খেল না, ঠোঁটের কোণে সিগারেটটা ধোঁয়া ছাড়তেই থাকলো।

হঠাৎ মেয়েটি তার এক পায়ের উপর বসে পড়লো, গ্লাসভর্তি হুইস্কি জাভিয়ানের ঠোঁটের সামনে ধরে বললো “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব একা, নিঃসঙ্গ।”

জাভিয়ান এবার হালকা বাঁকা হেসে মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে থাকল, কিন্তু পরের মুহূর্তেই ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে মেয়েটার উন্মুক্ত উরুতে এতটাই নৃশংসভাবে চেপে ধরল যে সিগারেটের ছ্যাঁকায় মেয়েটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠল—এক লাফে জাভিয়ানের গা থেকে সরে গিয়ে পাশের সোফায় পড়ে গেল।

জাভিয়ান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তারপর নিজেই নিজের ব্লেজারটা ঝাড়তে থাকলো, যেন তার গায়ে কিছু অপবিত্র ছোঁয়া লেগেছে। চোখে ঘৃণার ছায়া স্পষ্ট।

তারপর ব্লেজারটা খুলে মেয়েটার মুখের দিকে ছুঁড়ে দেয়। শান্ত অথচ কর্কশ গলায় বলে ওঠে, “এটা রেখে দাও। তোমার ওই বাজে শরীর ঢেকে রাখার কাজে লাগবে।”

মেয়েটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। জাভিয়ান আর একবারও পেছনে না তাকিয়ে ভারী পায়ে ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেল, পেছনে ফেলে রেখে গেল এক বিবর্ণ, অপমানিত মুখ আর চারপাশে স্তব্ধতা।
.
.
.
.
ক্লাবের বাইরের পার্কিং লট, রাত গভীর।

জাভিয়ান ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসে ধীরে, চোখে বিরক্তির ছায়া, পেছনের আলো-সঙ্গীত আর দম্ভিত কোলাহল থেকে নিজেকে ছিঁড়ে বের করে আনে। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে, কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখলো। চারপাশে রাতের নিস্তব্ধতা, মৃদু হাওয়ায় ঢাকা পড়া শহরের শব্দ।

ঠিক তখনই এক বৃদ্ধা মহিলা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, গায়ে ময়লা শাড়ি, মুখে শ্রান্তি আর চোখে ক্ষীণ আশার দীপ্তি।

মহিলা কাঁপা গলায় বললো “বাবা… কিছু সাহায্য করবা?”

জাভিয়ান ধীরে চোয়াল শক্ত করে তাকায়, পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখলো ফাঁকা তারপর বললো “ক্যাশ নেই এই মুহূর্তে আমার কাছে। তবে ক্রেডিট কার্ড আছে… চলবে?”

মহিলা কানের কাছে হাত এনে বললো “কি কইলা বাবা? কি কাড?”

জাভিয়ান তখন নিজের কালো ওয়ালেট থেকে একটা চকচকে ব্ল্যাক ক্রেডিট কার্ড বের করে মহিলার দিকে বাড়িয়ে দেয়। “এই নিন। চাইলে সব টাকা নিয়ে নিন।”

মহিলা কিংকর্তব্যবিমূঢ়—কার্ডের মানে বুঝে না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঠিক সেই সময় হন্তদন্ত হয়ে রায়হান ছুটে আসে।

রায়হান চোখ বড় বড় করে বললো “আরে আরে স্যার! কী করছেন আপনি! ভিক্ষুকরা আবার ক্রেডিট কার্ড বোঝে নাকি?

সে তাড়াতাড়ি নিজের পকেট থেকে একটা বিশ টাকার নোট বের করে মহিলার হাতে গুঁজে দেয়, আবার স্যার’র হাত থেকে কার্ডটা নিচে নামিয়ে রাখে।

রায়হান চোখ টিপে বললো “স্যার, বাংলাদেশে এসে ডিজিটাল দান করবেন ভাবছিলেন নাকি? এখনো বাংলাদেশ এত উন্নত হয়নি যে এখানে “ডিজিটাল ভিক্ষুক” থাকবে।”

জাভিয়ান তখন হালকা মাথা ঝাঁকায়। একটুও রেগে যায় না। শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “এই দেশটা যেনো আমার পুরোনো দিনের মতো—সব কিছু ধোঁয়াটে, ধোঁয়ায় ঢাকা… কিন্তু কোথাও যেনো একটা সত্যি লুকিয়ে আছে।”

রায়হান হাসে, গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়ে পাশের সিটে। “স্যার, এই দেশে আবেগ দিয়ে চললে পকেট খালি হয়ে যাবে… কিন্তু ভালোবাসায় ভরপুর!”

গাড়ির ভেতর, শহরের আলো পেছনে ফেলে গাড়ি চলছে। জাভিয়ান সামনের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটে সিগারেট। রায়হান পাশে বসে অস্থির, যেন কিছু না বললে গলার কাঁটা নামবে না।

রায়হান বুক ফুলিয়ে হেসে বলল “স্যার, আপনি তো রিকার্দোর সাথে দেখা করলেনই না… একদম হঠাৎ করেই বেরিয়ে এলেন। আমি তো ভাবলাম, আপনি আর ওই মেয়েটা একসাথে… একটু…

জাভিয়ান ঠান্ডা গলায় বললো “আর বেশিক্ষণ থাকলে আমার শরীরটাই নোংরা হয়ে যেত।আর তুমি… আমার থেকে দূরেই থাকো। মেয়েদের সাথে এমন ঘেঁষাঘেঁষি করে এসেছো—ঘামে, পারফিউমে, মিলেমিশে তোমার নিজস্ব গন্ধই বদলে গেছে।”

রায়হান হাসতে হাসতে হাহাহা! করে বললো ” ষএই কথা আপনি ছাড়া আর কেউ বললে ওকে নিয়ে চিকিৎসা করাতাম। আচ্ছা বলেন তো স্যার, কখনো কাউকে ভালো লাগেনি আপনার?

জাভিয়ান চোখ তুলে ধীরে তাকায় আর বলে “ভালো লাগা, প্রেম—এসব দুর্বলদের জন্য।

রায়হান হাসতে হাসতে বললো “ওহ বাবা! স্যার আপনি তো প্রেমে না পড়ে সোজা প্রেমকেই ডিভোর্স করে দিলেন! আচ্ছা প্রেম বাদ একটু তো প্রান খুলে কখনো হাসতেও দেখিনা আপনাকে।”

জাভিয়ান চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো “হাসি? আমার মুখের পেশি সেসব অনুভব করেনা।”

রায়হান ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকাতে না পেরে বললো “আপনার তো চেহারার ভাবটাই এমন। সব টাইম এমন মুখ করে রাখেন যেনো আল্লাহ কপালে ‘দুঃখ’ লেপে দিয়ে পাঠিয়েছে পৃথিবীতে! আপনাকে।”

জাভিয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বললো ” সাট আপ রায়হান। আমি তোমার মতো না আমি মানুষকে ব্রেইন দিয়ে পড়ি, হৃদয় দিয়ে না।

রায়হান হাত নাড়তে নাড়তে বললো “আপনি তো স্যার “হৃদয়হীন গুগল ট্রান্সলেট” আবেগ ঢুকাইলেও রেসপন্স নাই! আচ্ছা বলেন তো, যদি কখনো সত্যি প্রেমে পড়েন… তখন?

জাভিয়ান চোখ সরু করে তাকিয়ে বললো “তখন…ধরে নাও সেই মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে আনলাকি গার্ল আর পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে।”

রায়হান মাথা নিচু করে হাসতে হাসতে বললো “আপনার মুখে শক্তির এত ভার যে হালকা কথা বললেও মনে হয় কেউ মাইক দিয়ে জাতিকে তর্জন করছে!

জাভিয়ান চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে,ঠোঁটে সিগারেট চাপা। রায়হান হেসে কাঁধে কাত হয়, আর জাভিয়ান তখনও… পাথরের মতো চুপ। গাড়ির ভেতরে সেই পুরোনো নীরবতা ফিরে আসে, একপাশে তুফান, অন্যপাশে দেয়াল।
.
.
.
.
গভীর রাত, শহরের এক নির্জন গুদামঘর। বাইরে টিনের চালের ওপর টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ভিতরে অন্ধকার ঘরে একা বসে আছে ফারহান। একটা পুরনো কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ, চোখে গ্লানি আর ঘৃণার মিশেল।

গতকাল রাতেই সে স্পষ্ট করে দিয়েছে—নারী পাচারের এই ডিলে সে নেই। নিজের বন্ধুকে খু/ন করে যা করেছে, তার চেয়েও গা শিউরে ওঠা অপরাধ এটা। “আমার ঘরে দুটো বোন আছে,”—এই কথাটুকু বলে সে চুপ করেছিল। কিন্তু, সে চুপ করলেও—রিকার্দোর বিশ্বস্ত মানুষদের মাঝে একজন চুপ থাকেনি।

অন্যদিকে, রিকার্দোর লুকানো অফিসরুম। মার্বেল ফ্লোর, বিলাসবহুল, কিন্তু নিঃশব্দে আগুন জ্বলছে। রিকার্দো বসে আছে চেয়ারে। সামনে রিকার্দোর সেই লোকটা যে সবসময় ফারহানকে হিংসা করতো এক প্রকার ঈর্ষা করতো কারন রিকার্দো ফারহান ছাড়া কোনো কাজের ডিল করতোই না।

লোকটা চাতুর্যে ভরা গলায় বললো “বস, ফারহান কাকে যেন ফোন করছিল… আমার মনে হচ্ছে ও হয়তো পুলিশের সঙ্গে হাত মিলাচ্ছে। আপনি সব কাজ ওকে দেন আপনার সব তথ্য ওর কাছে …ও যদি পাল্টে খায়?

রিকার্দো চোখ সরু করে বললো ” তুমি কী দেখেছো ওকে ফোন করতে?

লোকটা বললো “আমি শুধু শুনেছি “সব বলব আমি”এই কথাটা…শুনেছি তারপর গাড়িতে চড়ে চলে গেল।

রিকার্দো কিছু বলেনা।ঠান্ডা হয়ে যায় তার মুখ।চোখের মণি কেবল হালকা একবার দুলে ওঠে। তারপর আস্তে করে বলে “ডেকে আনো ওকে।”

আবার সেই গুদামঘর। ফারহানকে ডেকে আনা হয়েছে। ঘরে কয়েকজন অস্ত্রধারী দাঁড়িয়ে আছে। বাতি দুলছে মাথার ওপরে।ফারহান দাঁড়িয়ে আর তার সামনে রিকার্দো।

রিকার্দো গম্ভীর কণ্ঠে বললো “শুনেছি তুই আমার পেছনে পুলিশ লাগাচ্ছিস?”

ফারহান চোখে জ্বলন্ত ঘৃণা নিয়ে বললো “ভুল শুনেছিস আর আমি তো তোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি এই মুহূর্তে।”

রিকার্দো সামনে হেলে বললো “তাহলে বল,কেনো আমার এই ডিলে রাজি হচ্ছিস না?

ফারহানের চোখ লাল হয়ে উঠছে আর রাগান্বিত ভবে বললো “কারণ আমি গ্যাংস্টার! তোর চাকর না‌ আমার যে কাজ ভালো লাগবে আমি সেটাই করবো যেটা লাগবেনা সেটা আমি করবো না। আমি আর তোর এই দাসত্ব করছি না।

একটা মুহূর্ত থেমে যায়। রিকার্দো চেয়ারে বসে থাকে চুপচাপ। ফারহান তখনো দাঁড়িয়ে। হঠাৎ পেছন থেকে এক বন্দুকধারী লোক ফারহানকে ধরতে আসে।

হঠাৎ! ফারহান ঘুরে এক লাথিতে লোকটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে ছোট পিস্তল বের করে পা বরাবর গুলি করে দেয় ফারহান। বাকিরা হতভম্ব।

গোলাগুলি শুরু। একেকজন লোক ফারহানকে ঘিরে ধরে, কিন্তু সে যেন একাই এক সেনাবাহিনী। টেবিলের আড়ালে গিয়ে গুলি চালাচ্ছে, মাটিতে লুটিয়ে পড়া এক জনের বন্দুক নিয়ে আবার ফায়ার।

রিকার্দো প্রথমে চুপ করে দেখছিল। এবার উঠে দাঁড়ায়। চোখে শীতল আগুন।

রিকার্দো ধীরে ধীর বললো “তুই অনেক বড় ভুল করলি ফারহান।”

সময় থেমে যায় আরেকটা গুলির শব্দে। বাতি দুলছে। মেঝে রক্তে লাল। কিন্তু ফারহান দাঁড়িয়ে আছে। নিঃশ্বাস ভারী। চোখে আগুন জ্বলছে।
.
.
.
.
শহরের এক অন্ধকার কোণা, বৃষ্টিভেজা রাস্তায় ফারহান হেঁটে বেরিয়ে আসছে গুদামঘর থেকে। কিন্তু হঠাৎই— ফোন বেজে ওঠে। এক অচেনা নম্বর থেকে।ফোনটা ধরতেই তার কানে আসে ভয়ানক কিছু কথা…

রিকার্দোর এক গুন্ডা ওপাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বললো “ফারহান তোর বাড়িতে পৌঁছে যেতে আর বেশি সময় নেই… এখন রিকো বলেছে, প্রথমে ওদেরকেই শেষ করতে হবে।”

এক সেকেন্ডের জন্য ফারহানের দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর… ছুটে দৌড় শুরু করে বাড়ির দিকে।


রেহমান প্রিয়াঙ্গন। শান্ত, গাছপালা ঘেরা পুরান ঢাকার এক এলাকা।কোলাহল থেকে অনেকটাই দূরে, এই জায়গাটা বরাবরই ছিলো নিরাপদ—অন্তত ফারহানদের জন্য তাই ছিলো এতদিন।

রাত গভীর হলেও আজ ঘরে আলো জ্বলছিল। এলিনার গায়ে হলুদ ঠিক দু’দিন পর। তাই ঘরে মা, বাবা, এলিনা আর তান্বী ব্যস্ত ছিলো প্রস্তুতিতে। হাসি-আড্ডা আর আলো জ্বালানো ঘরের ভিতরে কারো কল্পনাতেও ছিল না—ভবিষ্যতের একটা ছায়া দরজার দিকে এগিয়ে আসছে।

হঠাৎ— ঘরের দরজা বিকট শব্দে খুলে গেল।

ফারহান দৌড়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে। মুখে আতঙ্ক, শরীরে ধুলো-মাটি, আর বুকের মাঝে অদ্ভুত এক তাড়না।

এলিনা চমকে উঠে দাঁড়াল, কণ্ঠ কেঁপে উঠলো—
— “ভাইয়া! কী হয়েছে? এমন দৌড়ে আসছো কেন?”

ফারহান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “প্রশ্ন করিস না! একটুও সময় নেই! এখনই আমাদের এখান থেকে বের হতে হবে! সব কথা পরে বলবো—কিন্তু এখন না গেলে… আমরা কেউ বাঁচবো না!”

তান্বী তখন সামনে এসে পড়ে। কণ্ঠে ভয় আর উদ্বেগ—“ভাইয়া… কারা আসছে? কেনো আমরা পালাচ্ছি?”

বাবা উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু হঠাৎ এমন কী হলো, ফারহান?”

কথা থেমে গেল। চারজনের চোখই তখন আটকে রইলো ফারহানের মুখে।আর সেই মুখে…ছিলো এক নিঃশব্দ বার্তা। চোখে ছিল দগদগে আতঙ্ক, যেন সে মৃ/ত্যু দেখতে পেয়েছে একেবারে সামনে থেকে।

ফারহান কিছু না বলে এক ঝটকায় মা-বাবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো বাইরের করিডোরের দিকে। “চলো! এক মুহূর্তও দাঁড়ালে শেষ!”

তারা দরজার কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই, হঠাৎ—
বাইরে গাড়ির গর্জন। তারপর…ব্রেক কষে থামে একের পর এক গাড়ি।

বাতাসে ধুলো উড়ে যায়। শব্দহীন রাত্রি আর থাকলো না।

ফারহান ঘুরে দাঁড়ায়, জানালা দিয়ে তাকায় বাইরে। তারপর চোখ ঘুরিয়ে এলিনা আর তান্বীর দিকে বললো “তোরা দুজন মা-বাবাকে নিয়ে ওই স্টোররুমে যা! ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করো! এখনই! এক সেকেন্ড দেরি করলে শেষ!”

এলিনা থরথর করে কাঁপছে। এলিনা মায়ের হাত ধরে টান দিলো। ফারহান এবার আরেকটু নরম গলায় বলল,
— “বাবা… মা… প্লিজ! শুধু একবার আমার কথা শুনো। এই একবার…”

তারা কিছু না বলে তাকিয়ে থাকলো ছেলেটার দিকে—আর কিছু বলার সময় নেই। চোখে জল নিয়ে মা আর বাবা এলিনা-তান্বীর সঙ্গে ভেতরে চলে গেলেন। ফারহান একা রয়ে গেল দরজার সামনে।

ধীরে ধীরে সে হাঁটতে শুরু করলো বাইরে।

জ্যাকেট খুলে ফেলল। শরীরে লেগে আছে রক্তের দাগ।
প্যান্টের পেছনে পিস্তলের হাতল। চোখে আগুন, মুখে দৃঢ়তা।

সে মেইন গেটের সামনে এসে দাঁড়াল।

গেটের ওপাশে কালো পোশাকে কয়েকজন মুখ বাঁধা লোক নামছে গাড়ি থেকে। তাদের হাতে অস্ত্র। শব্দহীন। ভয়াবহ নিঃশব্দ। ফারহান দাঁড়িয়েই বলল “এই বাড়িতে আজ কেউ নেই। যেখান থেকে এসেছো সেখানেই ফিরে যাও। তা না হলে আমি কাউকেই বাঁচতে দেবো না। কাউকেই না।”

গেটের দুই পাশে দাঁড়ানো লোকেরা অস্ত্র উঁচিয়ে ধরে।

ফারহান নিজের দুই হাত কোমরে রাখে। পিস্তলের হাতল ছুঁয়ে। জ্যাকেটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে তার যোদ্ধার শরীর। চোখে আগুন, ঠোঁটে নীরব প্রতিজ্ঞা। বাতাস থেমে যায়। এ যেন এক নিঃশব্দ যুদ্ধের সূচনা।

ফারহান দাঁড়িয়ে ছিলো গেটের সামনে। রাত গভীর, বাতাস থেমে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু তার হৃদস্পন্দন যেন নিজেই নিজের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল।

হাতের পিস্তলটা মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। চোখে ছিলো আগুন। হঠাৎ একটা কালো গাড়ি এসে থামে। হেডলাইট নিভে যায়। গাড়ির দরজা খুলে ধীরে ধীরে নামলো রিকার্দো। পরনে ভারী কোট, হাতে ধোঁয়া ওঠা সিগারেট, মুখে সেই চিরচেনা ঠান্ডা বিকৃত হাসি।

রিকার্দো একটু এগিয়ে এসে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
— “তুই জানিস, আমি কাকে বিশ্বাস করতাম? তুই-ই ছিলি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত। আর আজ তুই-ই আমার পেছনে ছুরি মারলি, ফারহান?”

ফারহানের বুক ফুলে ওঠে। কণ্ঠ কাঁপে না, চোখেও একটুও ভয় নেই। “বিশ্বাস? তোর বিশ্বাস মানে তো ব্যবসা! মানুষকে বিক্রি করে, পরিবার ধ্বংস করে। আমি আর তোর নিচু কাজগুলো করবো না, রিকার্দো।”

এক মুহূর্তের নীরবতা। দুজন দাঁড়িয়ে থাকে চোখে চোখ রেখে। তারপর রিকার্দোর ঠোঁটের কোণ বাঁকলো। মুখের সেই ঠান্ডা হাসি আরেকটু গভীর হলো। কোমরের কাছ থেকে ধীরে বন্দুকটা বের করল সে।

সবচেয়ে আগে টের পেল ফারহান। তার হাতও উঠল।

কিন্তু… হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হলো।

রিকার্দোর ছোঁড়া গুলি বুক ভেদ করে বেরিয়ে গেল ফারহানের। তার শরীরটা একটু কেঁপে উঠল, পিঠ দিয়ে গুলিটা বেরিয়ে পাশের কাঠের দরজায় গিয়ে লাগল—
একটা ফুটো হয়ে গেল দরজায়।

তারপর রিকার্দো থামল না।আরও তিনটা গুলি করলো আর তা লাগলো গিয়ে লাগল দরজায়। যেন ভেতরে থাকা মানুষগুলোকে জানিয়ে দিল—”আমি এসেছি।”

ফারহান তখনো পড়েনি। এক হাঁটুতে নেমে এসেছে, শরীর দুলছে। ঠিক তখনই ফারহানের বুকে পড়ে এক লাথি। রিকার্দোর কোনো লোক ফারহানকে উড়ে এসে লাথিটা মেরে ছিলো। ফারহান সেই লাথিতে উড়ে গিয়ে সরাসরি দরজায় আছড়ে পড়ে। কাঠ ভেঙে যায়, গুঁড়ো উড়ে যায়। সে ঘরের ভেতরে পড়ে থাকে, নিঃশ্বাস আটকে আসা শরীরটা মেঝেতে।

উপরের দিকে চোখ তুলে চেয়ে দেখে—তার মা, বাবা, এলিনা আর তান্বী দাঁড়িয়ে। সবার মুখ স্তব্ধ। কেউ কিছু বলতে পারছে না। তখনই যেন সময়টা এক মুহূর্ত থেমে যায়।

মা চিৎকার করে ওঠেন “ফারহা—আআআআন!!!”

তান্বী আর এলিনা একসাথে চিৎকার করে “ভাইয়া!!!”

ফারহানের ঠোঁট থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে তাকিয়ে থাকে শুধু তাদের দিকে। চোখে ছিল একটা নীরব অনুরোধ “ওদের কিছু করিস না। ওরা নির্দোষ।”

আর তখনই ঘরের বাইরে থেকে ধীরে ধীরে ভেসে আসে জুতোর শব্দ। রিকার্দোর জুতো। একেকটা ধাপ যেন মৃত্যু/র বার্তা। সবার বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে।

ঘরের দরজাটা একদম ভেঙে পড়ে আছে। চারপাশে ধুলা আর কাঠের গুঁড়ো। সেই গুঁড়োর ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকছে রিকার্দোর লোকজন। সবার হাতে বন্দুক। চোখে সেই চিরচেনা হিংস্রতা—যা কোনো দয়া চেনে না।

ফারহান তখনো মেঝেতে পড়ে। বুকের রক্ত এখন শুকিয়ে গিয়েছে, কিন্তু শরীর চলছে কোনোমতে—হাত দিয়ে নিজেকে টেনে এগোতে চাইছে।

হঠাৎই একজন লোক সামনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কলার ধরে তাকে এক ঝাঁকুনিতে উঠিয়ে নিলো, তারপর টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে শুরু করলো দরজার দিকে। ফারহানের পা মেঝেতে টান পড়ছে, রক্তের দাগ রেখে যাচ্ছে পেছনে।

পেছন থেকে মা ছুটে এসে ছেলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন, কাঁপা গলায় চিৎকার করলেন “ছেড়ে দিন আমার ছেলেকে! প্লিজ… ওকে মেরে ফেলবেন না!”

লোকটা এক পলক তাকিয়ে কষ্টে হেসে বলল, “তোদের কেউ বাঁচবে না, বুড়ি। সবাইকে নিচে পিষে দেব, এক এক করে!”

এদিকে এলিনা, তান্বী আর বাবা-মাকে ধরে ধরে ঠেলে বের করে আনছে বাকিরা। কেউ পড়ে যাচ্ছে, কেউ ঠেলায় কাঁদতে কাঁদতে উঠে পড়ছে।

তান্বী তখন রুমের কোণায়। ভয়ে জমে গেছে, কিন্তু চোখ খুঁজছে সুযোগ। হঠাৎ… এক লোক ওর হাত ধরে টানছিলো, পেছনে ফিরতেই তান্বী পুরো শক্তিতে পা তুলে…এক লাথি! মারলো ঠিক লোকটার পেছনের সবচেয়ে দুর্বল জায়গায়।

লোকটা ছিটকে পড়ে গেল। মুখে বিকৃত ব্যথা।
সবাই চমকে তাকালো। এক এক সেকেন্ডের নীরবতা।

তারপরই রিকার্দো নিজেই সামনে এসে দাঁড়ালো।
চোখে আগুন, গলার স্বর ছুরির মতো ধারালো।

এক ঝটকায় তান্বীর গালে এক থাপ্পড় মারলো।তান্বীর মাথাটা ঘুরে যায় পাশের দিকে, মুখে লাল দাগ ফুটে ওঠে। সে কোনো শব্দ করে না—চোখে জল এসে পড়ে, কিন্তু সে নড়ে না।

রিকার্দো চুল চেপে ধরে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় দরজার দিকে। “তোদের পরিবার মানেই কি বিষ নাকি?এইটুকু মেয়ের এত সাহস?”

বাকি সবাই—মা, বাবা, এলিনা—কেউ আর বাধা দিতে পারছে না। তাদেরও একে একে ধাক্কা মেরে গাড়ির পেছনে তোলা হচ্ছে।

মা কাঁদছেন। বাবার মুখ নিস্তব্ধ, ফ্যাকাসে। এলিনা মুখ ঢেকে চুপচাপ কাঁদছে।

আর ঠিক তখনই… গাড়ির ধারে পড়ে থাকা ফারহান, আধমরা শরীরে চোখ মেলে তাকায়। চোখের সামনে তার পুরো পরিবারকে একে একে গাড়ির পেছনে তোলা হচ্ছে।

সে কোনো শব্দ করতে পারে না, শরীর নড়ে না, শুধু বুকটা ওঠানামা করছে ভারী নিঃশ্বাসে। চোখে একটাই জ্বলন্ত অনুভব—অপরাধবোধ। ভেতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর যেন দগদগে আগুনের মতো ছুটে আসছে “তাদের কিছু হলে… আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না…”

ফারহানের দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় তান্বীর মুখে। এক মুহূর্ত, এক অনন্তকাল। গাড়ির দরজা বন্ধ হয়। সব শেষ বলে মনে হয়… কিন্তু ফারহানের চোখ তখনো খোলা।

(চলবে……….)

পর্বটা অনেক বড় লিখেছি এডিট করতে সময় লাগবে তাই দুই অংশে দিচ্ছি। এই পর্বের শেষাংশ আগামীকাল দিবো। এখানে ৩৫০০ শব্দ আছে।

ডিজায়ার_আনলিশড

✍️ সাবিলা সাবি

পর্ব ৪. (শেষাংশ)

রিকার্দোর ব্যক্তিগত আস্তানা—একটি পুরনো পরিত্যক্ত কারখানার নিচতলা।

ভাঙা কংক্রিটের গায়ে লেগে থাকা মরিচা আর ছেঁড়া ইলেকট্রিক তারে ঝুলে থাকা আলোগুলো টিমটিম করে জ্বলছে, আবার নিভছে। চারপাশে ভেসে আছে এক ধরণের ঘমঘমে গন্ধ—ঘাম, রক্ত আর ভয়ের।

এই কারখানার নিচে তৈরি করা হয়েছে এক নির্জন হলঘর। তিনটি আলাদা অংশে ভাগ করে রাখা হয়েছে মানুষগুলোকে—যারা এখন শুধুই বন্দি।

প্রথম জোনে—ফারহান উল্টো ঝুলছে। এখন ও বেঁচে আছে তবে গুলি বিদ্ধ জায়গা থেকে র/ক্ত বের হচ্ছে প্রচন্ড। হাত-পা মোটা দড়িতে বাঁধা, মাথা নিচে ঝুলে আছে মেঝের দিকে। মুখ রক্তে ভেজা, ঠোঁট ফেটে গেছে, চোখে তীব্র যন্ত্রণা… তবু এক বিন্দু দমও যেন হারায়নি।

দ্বিতীয় জোনে— ফারহানের মা আর বাবা, এক কোণে পাশাপাশি। চোখে কালো কাপড় বাঁধা, মুখ দড়ি দিয়ে বাধা যেন চিৎকার করতে না পারে। শরীর ভয়ে গুটিয়ে আছে, বয়স যেন হঠাৎ আরও বেড়ে গেছে কিছু বছর।

তৃতীয় জোনে—এলিনা আর তান্বী। দুজনকে একত্র করে বসানো হয়েছে এক ভাঙা লোহার চেয়ারে, রুক্ষ দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে হাত-পা। তান্বীর চোখে জল জমে আছে, কিন্তু মুখ কঠিন। এলিনা নিচু গলায় প্রার্থনা করছে নিঃশব্দে।

ঠিক তখনই…জুতোর শব্দে কারখানার ঘর কেঁপে ওঠে।

রিকার্দো ধীরে ধীরে প্রবেশ করে। হাতে এক গ্লাস রেড ওয়াইন, ঠোঁটে সেই চিরচেনা বিকৃত হাসি। চোখে হিংস্র শিকারির আত্মবিশ্বাস।ও এগিয়ে আসে তান্বী আর এলিনার সামনে। ওদের চেয়ারের চারপাশে হাঁটতে থাকে ধীরে ধীরে।

রিকার্দো নিচু গলায় ফিসফিস করে বলে “সুন্দরী… একেবারে ঝকঝকে দুইটা গয়না। যদি ইউরোপে ট্র্যাকে তুলে দিই, চাহিদা হবে আকাশ ছোঁয়া।” এট বলে একটু থামলো তারপর পুনরায় বললো “ফারহান তো আমার পুরোনো পছন্দের লোক, তাই ভাবছি… তোদের প্রথম শিফটে পাঠাবো।

তান্বী তখন আর চুপ থাকতে পারে না।
ফুঁসে উঠে বললো “তোর সাহস কিভাবে হয়? পশু কোথাকার।”

রিকার্দোর মুখে কোনও রাগ নেই, বরং সে হেসে মুখটা একেবারে তান্বীর মুখের কাছে নিয়ে আসে, গলার স্বরটা হয়ে ওঠে ছায়ার মতো ঠাণ্ডা “পশু? হাহা… এই জঙ্গলের রাজা আমি।ৎবাঘের মুখে কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে কী হয়, জানো?

এই দৃশ্যের ঠিক উল্টোদিকে রশিতে বাঁধা অবস্থায় ফারহান ছটফট করছে। তার চোখে তখন কেবল আতঙ্ক নয়, প্রতিশোধের আগুন। সে নিজের শক্তিতে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, শরীর পেঁচিয়ে যাচ্ছে।

একটা মুহূর্তে গলা তুলে চিৎকার করে ওঠলো ” রিকার্দো! যদি একটা চুলও ছুয়েছিস ওদের… আমি তোর শরীর ছি*ন্নভিন্ন করে দেবো!

রিকার্দো ঘুরে ফারহানের দিকে তাকায়। ঠোঁটে ঠান্ডা হাঁসি। এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় ফারহানের কাছে।

” হুম… এই ভয়টাই তো তোর দুর্বলতা, ফারহান।
আজ তোর পরিবারই হবে তোর শাস্তি।”

সে থেমে যায়, তারপর আবার বললো “আর যেহেতু তুই নারী পাচার করতে রাজি হোসনি, ভাবলাম… তোর নিজের বোনদের দিয়েই শুরু করি। শিখে নে, কেমন করে ব্যবসা চলে!

রুমের ভেতর হঠাৎ এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে।
ফারহানের চোখে রক্ত চাপা প্রতিজ্ঞা জমাট বাঁধে।
তার দেহটা বাতাসে ধীরে ঘুরে যায়, মাথা নিচে —
কিন্তু চোখে তখন শুধু আগুন।

চোখে লেখা— “একবার বাঁধন খুলে দে, দেখ তোকে কি করি।”
.
.
.
.

সাঁতসেঁতে সেই কারখানার কুয়াশাভরা ঘরে হঠাৎই রশিতে ঝুলতে থাকা ফারহানের মুখ নিচু থেকে একটু বাঁ দিকে ঘুরে যায়। চুলগুলো রক্ত আর ঘামে ভেজা, ঠোঁট ফেটে গেছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে—কিন্তু তার চেয়ে বড় ছিল চোখের অভিমান।

এমন সময়েই এক কোণে বাঁধা বাবা-মার চোখের কাপড়টা কেউ একজন খুলে দেয়।

কাপড় খুলতেই তারা যা দেখে… সেটা যেন বিশ্বাস আর বুক ভেঙে পড়ার একসাথে আঘাত।

ছেলে… ফারহান… ঝুলছে উল্টো, বন্দি হয়ে। আর তার আশপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই ভয়াল অস্ত্রধারীরা।

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কাঁপা গলায় বললো
— ছি ফারহান… ছি! তুই এই নোংরা কাজ গুলো করেছিস এতো দিন? আমরা তো ভেবেছিলাম তুই আলাদা… সৎ, নির্ভীক… আমার আদর্শবান ছেলে।

মা হঠাৎই গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠেনৎএই মুখ নিয়ে কোথায় যাবো?মহল্লায় গর্ব করে বলতাম — “আমার ছেলে একদিন পুলিশ হবে, সব অন্যায় থামাবে!” আজ তাকেই দেখছি এই দানবদের সাথে… নারী পাচারের মাঝখানে!

বাবার কণ্ঠ ফেটে যায় “মহল্লার কেউ আমাদের মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পেত না, আর আজ… আজ তোর সেই বোনদের গায়ে হাত পড়লো… তোর জন্যই! আজ তোর জন্যই আমরা বন্দি, লাঞ্ছিত! তুই কী করে পারলি, ফারহান?”

রশিতে ঝুলে থাকা ফারহান যেন ভেঙে পড়ে মুহূর্তে।
রক্তাক্ত মুখটা উপরে তোলার চেষ্টা করে, গলাটা কাঁপে, চোখে আগুন, জলে ঝাপসা।

ফারহান চিৎকার করে বললো “না আব্বু! না আম্মু!
আমি খুন করেছি… অনেক ক্রাইম করেছি… হ্যাঁ, স্বীকার করছি! কিন্তু নারী পাচার? নারীর ইজ্জতের সাথে বেঈমানি? না! সে রাস্তা আমি কখনও পা দিইনি!

কান্নায় গলা জড়িয়ে আসে, রক্ত আর চোখের জল মিশে যায় — “আমি রিকার্দোর প্রস্তাবে রাজি হইনি…আমি এই জাহান্নাম ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলাম।”

ঘরে নিঃশব্দ জমে ওঠে। মা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। ঠোঁট কাঁপছে, কান্না আটকাতে পারছেন না।

বাবা চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন ছেলের দিকে, চোখে অস্পষ্ট জ্বালা। সাঁতসেঁতে সেই অন্ধকার কারখানায়, বাতাস থমকে আছে। বাতির আলো ফ্লিক করছে। রশিতে উল্টো ঝুলে থাকা ফারহানের মুখে রক্ত জমে কালচে হয়ে গেছে, কিন্তু চোখ জ্বলছে তীব্র লজ্জা আর অভিমানে।

বাবা-মা চুপচাপ তাকিয়ে আছেন তার দিকে। দৃষ্টিতে ঘৃণা, যন্ত্রণা আর বিশ্বাসভঙ্গের ক্ষত।

একসময়, ফারহান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বুকের ভেতর জমে থাকা কথা ফেটে পড়ে—

ফারহান গলা ফেটে চিৎকার করে বললো ” হ্যাঁ! আমি চেয়েছিলাম অনেক বড়লোক হতে! আমি চেয়েছিলাম তুমি গাড়ি চড়ে নামো, লোকজন বলুক “এই সেই ফারহানের বাবা!” তান্বী আর এলিনা লাক্সারি লাইফ লিড করুক, ব্রান্ডেড জিনিসপত্র, জামাকাপড় ব্যাবহার করুক।য়তুমি আর আম্মু ওষুধের জন্য রাত জেগে ফার্মেসি খুঁজে বেড়াবে না।

কান্না গিলে ফেলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে ওঠে‌। “ভুলে গেছো বাবা? তোমার নিজের ভাই… আমার চাচা আমাদের সাথে কেমন করেছে?একটা বিশাল সম্পত্তি রেখে… তোমাকে শুধু একটা পুরনো ছাদের নিচে ঠেলে দিয়েছিলো। তারা গাড়িতে ঘোরে, বিদেশ যায়… আর আমরা সংসার চালাতে হিমশিম খাই।

শ্বাস নিতে নিতে কথা বলে ফারহান।— “আমি সবকিছু ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম বাবা…এই পরিবারের মর্যাদা… তোমার মুখে হাসি…তাই আমি ভুল পথে গেলাম। আমি ভাবলাম, একবার টাকা এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে… কিন্তু… আমি জানতাম না… এত অন্ধকার, এত নোংরা।

তখনই… বাবা কাঁপা গলায় দাঁত চেপে ওঠেন। চোখে আগুন, কিন্তু গলার আওয়াজ ঠাণ্ডা — তীব্র, ছেদনকারী।

বাবা রাগে কাঁপা কণ্ঠে বললো ” চুপ কর, ফারহান।
চুপ কর ওইসব হারাম টাকার কথা। তুই যদি ভাতের অভাবে মরতি, আমি তোর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে গর্ব করতাম —”আমার ছেলে সৎ ছিল”।

“কিন্তু এইভাবে? এইভাবে সন্ত্রা/সীদের সাথে নোংরা খেলায় জড়িয়ে… আমার জীবনের প্রতিটি ঘাম মিথ্যে করে দিলি?

চোখে জল আসে, গলায় ফাটল ধরে —” তুই গাড়ি দিতে চেয়েছিলি? আমি বলছি — তোর বাবা মরবে, কিন্তু ওই হারাম টাকার গাড়ির সিটে কখনও বসবে না।”

ঘরে তখন নিস্তব্ধতা। তান্বী আর এলিনার চোখে জল, মা মুখ ঢেকে কাঁদছেন।ফারহানের চোখের জল থামছে না, গলায় আর আওয়াজ নেই।

রশিতে ঝুলে থেকে শুধু ফিসফিসিয়ে বললো “বাবা… আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি সব পুড়িয়ে শেষ করে দেবো… আমি মরলেও রিকার্দোকে শেষ করে যাবো।”
.
.
.
.
ঘরটা নিঃস্তব্ধ, অন্ধকার। ঘরের অন্য পাশে, ধূলি-ঢাকা একটি পুরনো সোফায় আধাশোয়া ভঙ্গিতে বসে আছে রিকার্দো। ঠোঁটে জ্বলন্ত চুরুট, চোখে হিমশীতল নিষ্ঠুরতা। তার চারপাশের বাতাসেও একটা ভয় ছড়িয়ে আছে—জ্যান্ত, ছুরি-ধরা ভয়ের মতো।

এই সময় তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সাঙ্গপাঙ্গ, ভিক্টর, ধীরে পায়ে ঘরে ঢোকে। চুপচাপ কিছুক্ষণ ফারহানের ঝুলন্ত দেহের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে, ভিক্টর নীরবতা ভেঙে বললো— “ভাই..এত কিছু হইলো, এই ফারহান শালারে এখনও বাঁচাইয়া রাখছেন কেন? এই শালারে তো গু/লি কইরা মাইরা ফেললেই হইতো।

রিকার্দো মুখে ঠোঁট রেখে চুরুটের ধোঁয়া টানলো। তারপর ধোঁয়াটা ধীরে ছেড়ে হালকা হালো। হাসির নিচে চাপা পড়ে থাকা হিংস্র/তা যেন মেঝে বেয়ে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।

রিকার্দো ধীরে, শীতল কণ্ঠে বললো — “ওরে মেরে ফেললে একবারেই শেষ হয়ে যাবে, ভিক্টর। কিন্তু বাঁচিয়ে রাখলে… ওর বুকের ভেতরের আগুনটারে আমি ঘি দিতে পারি বারবার।”

একটু থেমে, ঠান্ডা কণ্ঠে আবার বললো— “ওর বোনেরা এখন আমার হাতে। ওর মা-বাবা আমার খাঁচায়।এই ফারহান যত বড়ই হোক না কেন, পরিবার তো ওর নরম জায়গা। সেই নরম জায়গাটাতে আমি যদি আগুন দিই,তাহলেই দেখবি—ও নিজ হাতে এমন কাজ করবে, যা করার কথা ওর শত্রুও কল্পনা করবে না।”

ভিক্টর এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, চোখের পাতা পড়ে যায়। তারপর ধীরে জিজ্ঞেস করে—”তাইলে… ব্ল্যাকমেইল করবেন?

রিকার্দো এবার মাথা নাড়ে। চোখ সরু করে, ঠোঁটে ছায়া-হাসি টেনে বলে — “না ওরে ব্ল্যাকমেইল না। ওরে আমি নিজের হাতে গড়ে তুলবো। একটা নতুন সত্তা বানাবো—যে নিজের হাতেই নারীর গায়ে হাত দেবে, নিজের হাতেই ঘর পুড়িয়ে দেবে,নিজের চোখেই দেখবে মৃ/ত্যু…কিন্তু ওর বিবেকে একটুকুও লাগবে না।”

— “আমি ওকে এমন জায়গায় আনব, যেখানে
মানুষ বলে কিছু থাকবে না…শুধু আমার তৈরি একটা ছায়া, একটা বেহায়া ছায়া থাকবে।”

ভিক্টরের ঠোঁটে ধীরে একটা মুচকি হাসি ফুটে ওঠে।

ভিক্টর আস্তে বললো— “ভাই… আপনে তো সত্যি ডেভিল!”

রিকার্দো চুরুটের ছাই মাটিতে ঝেড়ে, ফিসফিসিয়ে উত্তর দেয় —”ডেভিল না…আমি গড।”

একটা থামলো তারপর চোখ সরু করে বললো— “পার্থক্য শুধু এই—গড মানুষ বানায়। আর আমি… মানুষের ছায়া বানাই।”

ঘরে আবার নিস্তব্ধতা নামে। ঝুলে থাকা ফারহানের চোখে তখনো আলো আছে—কিন্তু সেটি এখন ভীত নয়, শান্ত নয়। সেই চোখে জন্ম নিচ্ছে কিছু…একটা অভিশপ্ত ছায়া।
.
.
.
.

কারখানার ভিতরের একটা গোপন কনফারেন্স রুমের আশপাশটা অস্বাভাবিকভাবে নীরব। দেয়ালের পেইন্ট উঠে গেছে, বাতি ফ্লিক করছে, বাতাসে কেমন একটা ভারী চাপা গন্ধ।

জাভিয়ানের সেক্রেটারি রায়হান এসেছিল মাত্র একটা ছোট কাজের জন্য। গতরাতের ক্লাবে জাভিয়ানের ফোনটা রেখে গিয়েছিল সে। ওটাই ফেরত নিতে। কিন্তু ঘরে পা রাখতেই, ভেতরের কাঁপানো নিঃস্তব্ধতা তার হৃদয়ে হালকা শীতল একটা স্রোত নামিয়ে দেয়।

হঠাৎ পাশের ঘরের আধা খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে তার চোখ পড়ে।

তার দৃষ্টিতে প্রথম ধরা পড়ে ফারহান— রশিতে উল্টো ঝুলে আছে, পুরো শরীর রক্তা/ক্ত। চোখ দুটো যেন এখনো জ্বলছে—ভয়ের নয়, রাগ আর অপমানের আগুনে।

ঘরের এক কোণে দুটো পুরনো ভাঙা লোহার চেয়ারে বসে, আছে দুজন মেয়ে। তাদের হাত বাঁধা, মুখ নিস্তব্ধ।কিন্তু তাদের চোখে ধরা পড়ে এক অপূর্ব বৈপরীত্য—ভয়, কান্না আর তবু এক রকম অপরাধহীন নিরীহত্ব।

রায়হান আর এগোয় না। দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়েই দেখে সবকিছু। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়। বুকের ভেতর কেমন একটা চিনচিনে অস্বস্তি জমে।

তার চোখ পড়ে মেয়েদের একটুর দিকে। চোখে পানি ঝুলে আছে, কিন্তু মুখে এক নরম, নিষ্পাপ চেহারা।

সে নিজের মনেই ফিসফিস করে বলে ওঠে—”ইনোসেন্ট… একদম নিষ্পাপ। জাভিয়ান স্যার তো বলেছিল এমন কাউকেই খুঁজতে—যার চোখে তাকালে কারো কলুষিত জীবনটাও যেন ধুয়ে যাবে… যার মুখের শান্তিতে কেউ নিজের যন্ত্রণা ভুলে যেতে পারবে… এই দুইজনের মধ্যে হয়তো একজনই হতে পারে সেই…

কথা শেষ করেনি সে। মনের কথা আর ভাবার সুযোগ নেই।

এই মুহূর্তে যা ঘটছে তা অনেক বড়, অনেক গভীর।
এই জায়গায় নিষ্পাপদের জন্য স্থান নেই, আর রায়হানের মতো পর্যবেক্ষকদের জন্যও নয়। সে পা টিপে পেছনে সরে আসে, মুখে কড়া দৃঢ়তা— এখন চিন্তা নয়, এখন দরকার আসল কাজের।
.
.
.
.
চৌধুরী নিকেতন, রাত ১টা।

চারদিক নিস্তব্ধ।শহরের বাতাসে ঘুম ঘুম গন্ধ ছড়িয়ে আছে, কিন্তু চৌধুরী নিকেতনের এই ঘরে—ঝড় জমে উঠছে।

জাভিয়ান জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে সিগারেট ধরাচ্ছিল। শহরের আলো তার মুখে ছায়া ফেলে রেখেছে। চোখের নিচে গাঢ় গম্ভীরতা, যেন বহু রাতের ঘুমহীন হিসেব।

হঠাৎ দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে যায়। রায়হান প্রায় দৌড়ে ঢুকে পড়ল জাভিয়ানের রুমে।

রায়হান হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল— “স্যার… আপনার জন্য অনেক ভালো খবর এনেছি।”

জাভিয়ান ধীরে চোখ সরিয়ে তাকাল ওর দিকে। সিগারেটের আগুনটা একবার লাল হয়ে উঠল।

জাভিয়ান কঠিন গলায় বললো “বল, রায়হান।”

তখন রায়হান ফিসফিস করে সব বলে গেল— রিকার্দোর গোপন আস্তানা, একটা ছেলেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে… তার পরিবার বন্দী… দুই বোন ভয়ে নিশ্চুপ…হয়ে আছে সেই নিষ্ঠুর ঠাণ্ডা পরিবেশ।

“স্যার… আপনি যেরকম বলছিলেন না… ইনোসেন্ট একটা মেয়ে লাগবে, এমনই দুটো মেয়ে খুঁজে পেয়েছি।”

জাভিয়ান না তাকিয়ে বললো “বিস্তারিত বল।”

রায়হান তখন আবার ও বলা শুরু করলো “রিকার্দো কাল একটা ফ্যামিলি ধরে এনেছে। আটকে রেখেছে কোনো কারনে। তাদের মধ্যে দুইটা মেয়ে আছে—একদম চুপচাপ, চোখে ভয়, মুখে নিষ্পাপ ভাব। ভদ্র ফ্যামিলি বলেই মনে হয়েছে। আর মেয়েদুটো দেখতে সুন্দর… কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, আপনার চাওয়া মতো—একদম ইনোসেন্ট।স্যার, আপনার হাতে বেশি সময় নেই। এটাই বোধহয় একমাত্র উপায়।”

জাভিয়ানের মুখ থেমে যায়।সিগারেটের ধোঁয়া আর মুখের অভিব্যক্তি—দুটোই একসাথে থেমে থাকে কয়েক মুহূর্ত।

তারপর সে ধীরে ফোনটা তোলে। একবারে চোখ না চেপেই রিকার্দোর নাম্বার ডায়াল করে।

রিং হয় একবার… দুইবার… তারপর ওপ্রান্তে হাসির আওয়াজ।

রিকার্দো অভিনয় করা উল্লাসে বলে উঠলো “আহা! ঈদের চাঁদ পেলাম মনে হচ্ছে। হঠাৎ জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীর কল এসেছে আমার নাম্বারে।”

জাভিয়ানের চোখে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠে।
কিন্তু গলা বরফের মতো ঠাণ্ডা। ঠোঁট শক্ত করে কষে বলে ওঠে— “একটা পরিবার নাকি তোমার কাছে বন্দি হয়ে আছে? সাথে দুটো মেয়ে আছে? আমি ওদের মধ্যে একজনকে চাই। আমার লাগবে।”

রিকার্দো অবাক হয়ে বললো “হাহা! হঠাৎ তোমার কী হলো রে ভাই? তুমি তো মেয়েদের ধারেকাছেও থাকো না… এখন হঠাৎ করে মেয়ে লাগবে?”

জাভিয়ান দম চেপে বললো “ডোন্ট টক টু মাচ। জিনিস দেবে দাম নেবে। এইটা একটা ডিল। তোমার যত টাকা লাগে, পাবে। কিন্তু আপাতত, মেয়েদুটোর গায়ে যেনো কেউ হাত না দেয়।”

ওপাশে হঠাৎ একটু থেমে যায় রিকার্দো। তারপর আবার সেই হাসির আওয়াজ রিকার্দো নরম স্বরে, কিন্তু কুৎসিত ভঙ্গিতে বললো “না না… চিন্তা করোনা জাভিয়ান… ওদের গায়ে এখন ও পর্যন্ত হাত দেয়নি কেউ। মেয়েদুটো একদম ফ্রেশ মাল।”

জাভিয়ান ফোন কেটে দেয় না। চোখে তখন এমন এক আগুন, যা শুধু রিকোর বিরুদ্ধে নয়—নিজের ভেতরের শূন্যতার বিরুদ্ধেও। সে ধীরে ফোনটা নিচে নামিয়ে রাখে।
রায়হানের দিকে না তাকিয়েই জাভিয়ান নিজের মনেই বলে উঠলো “মেয়ে দুটো কারা, জানি না। কিন্তু এইবার যদি ওদের মধ্যে একজনকে না পাই তবে বাবার কাছে হেরে যেতে হবে।”

ঘরের বাতাস থেমে যায়। জাভিয়ান সিগারেটটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে, আর পায়ের নিচে পিষে ফেলে আগুনটা।
.
.
.
.
সিয়ুদাদ হুয়ারেস, মেক্সিকো। সময়: রাত ৩:৪০।

শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, মেক্সিকোর এক পুরনো ফ্যাক্টরির নিচে লুকিয়ে আছে মেইলস্ট্রোমের ব্যক্তিগত সিকিউর ঘাঁটি।

এই ঘরটা বাইরের কেউ জানে না।এখানে সোনার বার, হিরার বাক্স, পুরনো টাকাপয়সা আর অনেক দেশের ব্যাংক-নোটে ভর্তি বাক্স সারি সারি সাজানো।

ঘরের একপাশে একটা সাইবার টার্মিনাল (Cyber Terminal – হাই টেক কম্পিউটার), যেখানে দাঁড়িয়ে মেইলস্ট্রোম কাজ করছিল টানা কয়েকদিন ধরে। কাজটা খুবই স্পর্শকাতর – এক গোপন আন্তর্জাতিক ফিনান্সিয়াল প্রজেক্ট যার নাম Project Exchequer (প্রজেক্ট এক্সচেকার – অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থা)।

আগামী ৭২ ঘণ্টার (৩ দিন) মধ্যে সেই প্রজেক্টের ডেমো দিতে হবে। যদি সে সফল হয়, তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে গোপন টাকার লেনদেনের চেইনের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে সে।

এই কারণে মেইলস্ট্রোম নিজেকে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফোন বন্ধ, ইন্টারনেট অফ, কেউ তাকে খুঁজতে পারবে না। এমনকি তার লোকদের মেসেজও তার কাছে পৌঁছাবেনা।

এই অবস্থায়, সে হঠাৎ করেই দেয়ালের পাশে এক গোপন সুইচ চাপ দেয়। “ক্লিক” – শব্দ করে খুলে যায় একটা লোহার বাক্স।

ভেতরে আছে তিনটা জিনিস। একটা ভাঙা পুরনো হ্যান্ডগান (পিস্তল),র/ক্তমাখা এক চিঠি, আর একটা ব্রোঞ্জের (তামা-মিশ্রিত ধাতু) মেডেল – যা তার জীবনের একমাত্র বিশ্বাসঘাতকতা ও কষ্টের প্রমাণ।

মেইলস্ট্রোম ধীরে মেডেলটা হাতে নেয়।চোখে একরাশ পুরনো স্মৃতি জমে উঠে। মেইলস্ট্রোম নিজে নিজে ফিসফিস করলো “ওরা ভাবে আমি হারিয়ে গেছি… ওরা জানে না, আমি যদি ফিরি… তাহলে কেউ আর আগের মতো থাকবে না।”

এই মুহূর্তে সে জানে না, বাইরে অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে।

তান্বী—যাকে সে অনেকদিন ধরে গোপনে নজরে রেখেছিল, যার চলাফেরা, চিন্তা, নিরাপত্তা—সব ছিল তার লোকের নজরে— আজ সেই তান্বী রিকার্দোর হাতে বন্দি। কিন্তু মেইলস্ট্রোম সেটা এখনো জানে না।

তার মন বলে— “এই মিশন শেষ হলে আবার সব ঠিক করে নেবে… তখন সময় নিয়ে ভাববে তান্বীর কথা।”

কিন্তু জীবন তাকে সময় দেবে তো?

বাইরে আগুন জ্বলছে। আর ভেতরে সে এখনো বরফের মতো ঠান্ডা।
.
.
.
.
পরের দিন সকাল।

সূর্যটা একটু ধীরে ধীরে উঠেছে আজ, যেন জানে—জাভিয়ানের জীবনে আজকের দিনটা আলাদা। দরজা খুলে জাভিয়ান বেরিয়ে আসে। কালো শার্টের ওপরে কালো ব্লেজার আর চোখে রোদচশমা, মুখটা আজ আরও গম্ভীর। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গাড়ির দিকে যায়। মাথায় একরাশ চিন্তা—কিন্তু চেহারায় প্রকাশ নেই।

গাড়িতে বসে দরজা বন্ধ করতেই পাশের আসনে রাখা বাবার ছবি চোখে পড়ে যায়। কাঠের ফ্রেমে গম্ভীর এক মুখ। ছবিটা তুলে নিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে জভিয়ান। তারপর আস্তে করে বললো,

“আপনার কাছে আমি কোনদিনও হারবোনা মিস্টার চৌধুরী! আপনাকে হারাতে আমি একটা বিয়ে করতে যাচ্ছি। কিন্তু জানেন তো, আমি কিছুই অনুভব করতে পারছি না। আজ যে মেয়েটাকে আমি ঘরে তুলবো… সে কি জানে, আমি তাকে ভালোবাসবো না কোনদিন ও?”

তার চোখে কিছু একটা যেন আটকে থাকে—না বলা কথা, না বোঝা অনুভূতি। গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হয়। রাস্তা ধরে গাড়িটা ছুটে চলে—উদ্দেশ্য, রিকার্দোর আস্তানা। সেখানেই আজ এক চুক্তির বিয়ে, এক অজানা মেয়ের সঙ্গে… জাভিয়ানের নতুন জীবনের শুরু,অথচ তার মনে কোনো উন্মাদনা নেই—শুধু নিঃসঙ্গতা, চ্যালেঞ্জ, আর একরাশ ফাঁকা অনুভব।

(চলবে…….)

(আগামী পর্বে দেখা হচ্ছে যাচ্ছে তানবি আর জাভির এবার গল্প কোথা থেকে কোথায় মোড় নেয় তা দেখার পালা)

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply