ডিজায়ার_আনলিশড (Desire Unleased)
✍️ সাবিলা সাবি
পর্ব ৩.
মেক্সিকো সিটি|| স্ট্রোমহাউজ ||
অন্ধকার, ঠান্ডা আর হালকা ধোঁয়ার চাদরে মোড়ানো এক মার্বেল ঘর।যার দেয়ালে ঝুলছে কালো ভেলভেটের পর্দা,ঘরের বাতি জ্বলছে না—শুধু ধোঁয়াটে গ্লো লাইটে যেন ধুকপুক করছে সময়।
ঘরের মাঝখানে বসানো বিশাল এক কালো পাথরের বাথটাব।ৎগরম জল ফুসফুসিয়ে উঠছে—অ্যালকোহল মেশানো সেই পানির বুদবুদের শব্দে যেন ফেটে পড়ছে নিরবতা। এলকোহলের বাথটাবের জলের মধ্যে আধভাসা এক রাজা।
মেইলস্ট্রোম।
তার নগ্ন পিঠে চকচকে কালি দিয়ে আঁকা এক বিশাল পাইথনের ট্যাটু—সাপটা যেন ওর মেরুদণ্ড ঘিরে উঠেছে ঘাড় পর্যন্ত। আর কানের ঠিক পেছনে রয়েছে তার গর্ব—একটা বিচ্ছুর ট্যাটু, ছোট নয়, একদম অস্বস্তিকরভাবে স্পষ্ট।
তার চোখ আধবোজা। ঠোঁটে জমে আছে বিদ্রুপের এক টান। এক হাতে ধরা গাঢ় লাল ওয়াইনের বোতল, অন্য হাতটা জলের উপরে ভেসে আছে—চক্রাকারে ধীরে ধীরে ঘুরছে।
এক কানে তিনটি দুল—একটা ওপরের লতিতে কালো পাথরের রিং, মাঝখানে ছোটো হিরে বসানো এক বল, নিচে রক্তের মতো লাল স্টোনের ছোট হ্যাঙ্গিং দুল। শীতল আর বিপজ্জনকভাবে শৈল্পিক লাগছে।
ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো থেকে পানি টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে, আর সামনের চুলগুলো চোখের ওপর পড়ে তাকে আরও বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে। মুহূর্তটাতে সে যেন আরও নির্দয়, আরও অপ্রতিরোধ্য।
হঠাৎ—ঘরের একপাশে অটো-স্লাইডিং দরজা খুলে গেলো। দুইজন সার্ভেন্ট প্রবেশ করলো ঘরে। একজনের হাতে বিলাসবহুল কালো তোয়ালে, আরেকজনের হাতে কালো ভেলভেটের বাথরোব।
মেইলস্ট্রোম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় এলকোহলের টব থেকে। জল পড়ছে তার উন্মুক্ত বুক বেয়ে নিচে। শরীর জুড়ে পেশি টান, চোখে হিংস্র*তা— এ যেনো আরেকটা যুদ্ধ জেতার আগে চূড়ান্ত প্রশান্তি।
একজন সার্ভেন্ট নিঃশব্দে তার দিক তোয়ালে এগিয়ে দেয়। মেইলস্ট্রোম সেটা নিয়ে তার চুল মুছতে লাগলো।এরপর আরেকজন তার গায়ে বাথরোব জড়িয়ে দেয়—কালো রঙের মধ্যে সোনালী পাড়ে মেইলস্ট্রোমের ইনিশিয়াল এম-ব্লেড আঁকা।
তৃতীয় একজন হাঁটু গেঁড়ে বসে তার সামনে পোলিশ করা কালো চামড়ার জুতো এগিয়ে দেয়। মেইলস্ট্রোম নিঃশব্দে জুতো পরে দাঁড়িয়ে যায়।
সে হেঁটে যায় তার ড্রয়িং রুমে।
ড্রইং রুমের দেয়ালে গাঢ় রঙের তৈলচিত্র—বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিক, বিষাক্ত মেয়েদের মুখ, আর পাথরের মতো কঠিন চোখের এক মহিলা—তার মা।
ড্রয়িংরুমের ঠিক মাঝখানে সেই রাজার সিংহাসনের মতো সোফা। মেইলস্ট্রোম বসলো পায়ের ওপর পা তুলে। তার আঙুলে একখানা রিং—কালো অনিক্স পাথরে বাঁধানো বিষধর এক বিচ্ছুর প্রতিচ্ছবি।
ঘরের বাতাস ভারী। হালকা নীল আলোয় ভেসে আছে পুরো লিভিংরুমটা, ছাদ থেকে নামানো আড়ষ্ট বাতি ফিকে আলোর ছায়া ফেলে রেখেছে মেইলস্ট্রোমের গায়ে। ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা তার ভেজা চুলগুলো এখনও জলধারায় বয়ে যাচ্ছে,আর সামনের ঝুলে পড়া চুল চোখের ওপর এসে জমে আছে, যেন এক অন্ধকার পর্দা।
তার হাঁটুর ওপর পা রাখা, একহাতে সিগারেট। অন্য পাশে রাখা একটা চৌকোনা সোনালি ট্রে, যার ভেতর সাজানো হিরোইন, কোকেন, এলএসডি—মেইলস্ট্রোম যা যা নেশায় ভাসে সব। র*ক্তলাল টারবাইন ফিল্টারের সিগারেটের ধোঁয়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে।
ঠিক তখন দরজা ঠেলে ঢুকল মেক্সিকোর কুখ্যাত ডিলার—ডিয়েগো কারভাজাল। মুখে কৃত্রিম হাসি লেগে আছে আর তার গায়ে সিল্কের ঢোলা শার্ট, পেছনে তার সেক্রেটারি—একজন শান্ত চেহারার যুবক, নাম আন্দ্রেস।
মেইলস্ট্রোম কোনো কথা বলে না, শুধু দুই চোখে তাকিয়ে থাকে ডিলার ডিয়েগোর দিকে। ডিলার উঠে দাঁড়িয়ে প্যাকেটের হিসাব দেয়ার সময় তার সেক্রেটারি আন্দ্রেস নরম স্বরে বলে, “দামটা ওখানে একটু হেরফের হয়েছে স্যার, কিন্তু আইজি বলেছে ওটা সামলে নিতে…”
এই কথাটা বলার সাথেই হঠাৎ মেইলস্ট্রোম কোমরের কাছে হাত নিয়ে যায়, ঝট করে পিস্তল বের করে, “ট্যাক!”—একটানা গুলির শব্দ। আন্দ্রেসের কপালে গর্ত হয়ে যায়, সে ঢলে পড়ে পেছনে। র*ক্ত ছিটকে গিয়ে লাল করে দেয় সাদা মার্বেল মেঝে।
ডিলার ডিয়েগো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেকেন্ডের মধ্যে তার মুখ শুকিয়ে যায়।
“আইজি কি এখন তোমার হিসাব করে দেয়?” মেইলস্ট্রোম ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জিজ্ঞেস করে, ঠোঁটের কোণে হালকা হেসে।
গুলির শব্দে হঠাৎ পাশের কাচঘেরা শেড কেঁপে উঠে। যেন সেই শব্দেই একটার পর একটা ব্ল্যাক-ডেজার্ট স্করপিয়ন বেরিয়ে আসে। বিশাল, মেটে রঙের, প্রশিক্ষিত বিষধর বিচ্ছুরা। সেগুলোর জন্য ঘরের এক কোণে রাখা আছে আলাদা গ্লাসভর্তি “ভিভারিয়ামে”—যেটা অনেকটা একুরিয়ামের মতো দেখতে, কিন্তু বিচ্ছুর জন্য তৈরি।
বিচ্ছুগুলো একে একে বেরিয়ে আসে, ধীর গতিতে ঘুরে বেড়াতে থাকে ডিলারের চারপাশে। একটা দুটো ওর পায়ের ওপর উঠতে শুরু করে।
ডিলার তখন ভয়ে চিৎকার দেয়ার মতো করে শ্বাস নিতে নিতে হঠাৎই দুই পা তুলে নেয় সোফার ওপর, যেন মেঝে এখন লোহার মতো গরম।
ডিলারের চোখ এখনো বিস্ফারিত। সেক্রেটারির মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কাঁচের টেবিলের ওপর। চারপাশে গা শিউরে ওঠা নিস্তব্ধতা।
মেইলস্ট্রোম দাড়িয়ে পড়ে তারপর ডিলারের দিকে সামান্য ঝুঁকে ঠাণ্ডা গলায় বলে, “আমি হিসাব চাই, নাটক না। যদি আর কোনো হিসাবের ভেতর আইজির ছায়া পাই, তবে তোমার লা*শটা রাখার জায়গাও এখানে হবে না।”
ডিলার কাঁপা গলায় ফাইলটা বাড়িয়ে দেয়। বাইরে তখনও একটার পর একটা বিচ্ছু ঘুরে বেড়াচ্ছে…কালচে শরীর, খোলা দাঁড়া, গা কাঁপানো নীরবতা। র*ক্তের গন্ধে পাগল হয়ে উঠেছে যেন ওরা।
মেইলস্ট্রোম হালকা হেসে বললো “ওরা পছন্দ করে লোকে যখন মিথ্যে বলে। আরও বেশি পছন্দ করে যখন র*ক্ত গড়ায়।”
মেইলস্ট্রোম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। একটা বিচ্ছু এবার ডিলারের জুতার ওপর উঠেছে।
“তুমি এসেছো আমার কাছে কিছু চাওয়ার জন্য, বুঝলে? আমার সময়, আমার লোক, আমার এলাকা ব্যবহার করবে। ডিলটা কিসে হচ্ছে, সেটা এখন ঠিক করি।” মেইলস্ট্রোম ঠান্ডা গলায় বললো।
ডিলার বসে ছিলো কাষ্ঠখচিত চেয়ারটায়, ঘরের বাতাসে তীব্র আতঙ্কের গন্ধ। মেইলস্ট্রোমের চোখের দিকে একবার তাকাতেও তার সাহস হচ্ছিল না। তার কণ্ঠ কাঁপছিলো, গলায় শুকনো থুতু গিলে বলল,
“প-পঞ্চাশ কিলো, কলম্বিয়ান… খাঁটি মাল। (কোকেন যেটা কলম্বিয়া থেকে এসেছে) খুব ক্লিন কোয়ালিটি, স্যার। পুরোটা একসাথে না, দু’বারে পৌঁছাবে। দু’টা চালান… খুবই সাবধানে পাঠানো হবে।”
তার কণ্ঠস্বর আরেকটু নেমে এলো, যেন গলা পর্যন্ত ভয়ে ডুবে যাচ্ছে।
“অ-অ্যাডভান্স… মানে, টাকা আগে দিতে হবে, ডেলিভারির পরে না। নিরাপদ রুট নেওয়া হবে… সালার্নো বন্দরের মাধ্যমে( সালার্নো ইতালির একটি সমুদ্রবন্দর) ওইখানে কাস্টমস থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখার লোক আছে আমাদের। একদম সেফ।”
সে থেমে গেল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকালো মেইলস্ট্রোমের দিকে—দৃষ্টি যেন করাত কেটে যাচ্ছে।
কিছু বলবে কি না, সেই অপেক্ষায় ডিলার যেন প্রাণভয়ে দম ধরে রেখেছিল।
মেইলস্ট্রোম একটা ধোঁয়া ছেড়ে বললো, “বেশ। তবে দাম কিছুটা বাড়বে। র*ক্ত মুছতে হয় আমাকে, বডি ডিসপোজ করতে হয় আমার লোককে, আর বিচ্ছুরা তো ফ্রি খায় না, তাই না?”
ডিলার মাথা নাড়ে, “Whatever you say… deal.”
মেইলস্ট্রোম আবার বসে পড়ে, পা তুলে রাখে আগের মতো। একটা বিচ্ছু চুপচাপ ফিরে যায় তার পায়ের নিচে। অন্যগুলোও ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়।
.
.
.
.
ভিলা এসপেরাঞ্জা—চৌধুরী বংশের ঐতিহ্যের প্রতীকের অভ্যন্তরে লম্বা ছাদের নিচে ঝুলছে স্ফটিকের ঝাড়বাতি, দেয়ালের দেয়ালে মূল্যবান চিত্রকর্ম আর গোল্ডেন ফ্রেমে টাঙানো পুরানো পারিবারিক ছবি।
ডাইনিং টেবিলের চারপাশে তখন চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা—এসপেরাঞ্জার উত্তরসূরি আর বর্তমান কর্ণধার সায়েম চৌধুরী, তার স্ত্রী কার্গো চৌধুরী, বড় ছেলে জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী, ভাতিজি লুসিয়া চৌধুরী আর ভাতিজা মার্কো রেয়েস চৌধুরী।
হালকা গ্লাসে ওয়াইন আর নীরব অথচ রাজকীয় পরিবেশের মাঝখানে সায়েম চৌধুরী হঠাৎ কণ্ঠ পরিষ্কার করে বললেন—
“বাংলাদেশে আমার একটা অনেক বড় বিজনেস ডিল হচ্ছে। জাভিয়ান, আমাদের দু’দিন এর মধ্যে ঢাকা ফিরতে হবে।”
এক মুহূর্তেই টেবিলজুড়ে নামল এক স্তব্ধতা। পরিবেশের উষ্ণতা হঠাৎ যেন হিম হয়ে এলো।জাভিয়ানের চোখে বিরক্তি ফুটে উঠলো—মনে মনে সে বলতে চাইল, “আবার সেই দেশ?” কিন্তু উচ্চারণ করলো না। কারণ সে জানে—”আর মাত্র পাঁচদিন… যদি এই সময়ের মধ্যেই কোনো মেয়েকে হাজির করতে না পারে, তাহলে চুক্তি অনুযায়ী বাবার আদেশেই যেকোনো মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।”
তাই জাভিয়ান চোখ নামিয়ে একটু মাথা হেলিয়ে সে সম্মতির চিহ্ন দেয়।য়ষয়এই সময় পাশে বসা লুসিয়া মুখে এক গ্লাস জুস তুলে নিয়ে অলস ভঙ্গিতে বলে ওঠে—”আমার কিছু মিউজিক রেকর্ডিং বাকি, আমি এই মুহূর্তে দেশ ছাড়তে পারবো না।”
আর টেবিলের প্রান্তে বসে থাকা মার্কো, বইয়ের পাতার মতো মুখ আর সাদা চশমার পেছনে লুকানো নির্দোষ চোখে বললো—”আমি এখানেই থাকব বড় আব্বু। আমার থিসিস জমা দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।”
মার্কো রেয়েস চৌধুরী পরিবারের এক ‘জ্যান্ত উইকিপিডিয়া’—একটা লাইব্রেরির মতো ছেলে।যাকে পুরো পরিবারের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট, ইনোসেন্ট এবং নরম প্রকৃতির বলা হয়, জাভিয়ানের সম্পূর্ণ বিপরীত। গায়ে পরিপাটি শার্ট, বুক পকেটে কলম, আচরণে সবসময় বিনয় আর ভদ্রতা।তার ঢেউ খেলানো বাদামি চুল, গম রঙা ত্বক আর শান্ত চোখে যেন এক অন্যরকম স্বচ্ছতা।
সায়েম চৌধুরীর গলা তখন আরও গভীর হয়ে ওঠে—”এই ভ্রমণ শুধু ব্যবসা না, জাভিয়ান। এটা আমাদের রক্তের স্মৃতি… আমাদের পিতৃভূমিতে পা রাখার আনন্দ ও।”
ডাইনিং টেবিলের আলো, খাবারের গন্ধ, আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিপদের ছায়া—সব মিলিয়ে জাভিয়ানের জন্য শুরু হচ্ছে এক নতুন সফর, যা শুধু ব্যবসা নয়, ভাগ্যকেও বদলে দিতে চলেছে।
.
.
.
.
দুই দিন পরে…
ভিলা এসপেরাঞ্জা—চৌধুরী বংশের মেক্সিকোর বাড়িটা—আজ অনেকটাই নীরব। সাদা মার্বেলের বিশাল বারান্দায় এখন আর কেউ নেই, শুধু পড়ন্ত রোদের ঝিলিক যেন নরম আলোয় ফেলে যাচ্ছে শেষ বিদায়ের সোনালি ছায়া। সমুদ্রের গর্জন পেছনে ফেলে এসেছেন তারা, এখন সামনে শুধু এক অনিশ্চিত সফরের ছায়া।
সকাল সকাল সব ব্যাগ গোছানো শেষ। দুইটা কালো Bugatti ধীরে ধীরে পাহাড়ি রাস্তায় চলতে থাকে। লক্ষ্য—মেক্সিকো সিটি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।
অবশেষে ২৮ ঘন্টার পর….
ঢাকা, বাংলাদেশ—আজকের রাত।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট খুলে যায় নির্দিষ্ট সংকেতে। আলো আর নিরাপত্তার ঘনঘটা মিলে তৈরি করে এক অভিজাত দৃশ্য। সাদা লাইন লাগানো কালো টয়োটা এলফারগুলো দাঁড়িয়ে আছে প্লেন আসার সিগন্যালে প্রস্তুত।
মেক্সিকো থেকে আগত ভিআইপি ভিসাধারী যাত্রীদের মধ্যে সবার আগে বেরিয়ে আসে এক পুরুষ—স্মার্ট ব্ল্যাক ট্রাউজার, চকচকে ব্রাউন চামড়ার জ্যাকেট, চোখে কালো সানগ্লাস আর তীক্ষ্ণ চিবুকের থুতনিতে বাদামী তিল—জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী।
তার পেছনে আসলো এক পরিপাটি মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক—সায়েম চৌধুরী, যিনি আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও রাজনীতির জগতে এক পরিণত নাম। গায়ে হালকা ধূসর স্যুট, মুখে গাম্ভীর্য আর চোখে বিশ্লেষণের প্রখরতা।
তার পাশে ধীরভাষী, মার্জিত এক মেক্সিকান নারী—কার্গো চৌধুরী, সায়েমের স্ত্রী, এবং এই পরিবারের শান্ত অথচ দৃঢ় ভিত্তি।
শেষে হেঁটে আসে জাভিয়ানের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি—রায়হান। বাংলাদেশই তার জন্মভূমি। চোখে চশমা, মুখে উত্তেজনার ছায়া। ব্যাগ টানতে টানতেই সে বলে ওঠে “স্যার, অবশেষে দেশে ফিরলাম! আব্বু-আম্মুকে চমকে দেব একদম!”
জাভিয়ান এক ঝলক তাকিয়ে দেখে তাকে, ঠোঁটে উঠে আসে সেই পরিচিত, হালকা কিন্তু ধারালো হাসি— “তোমার দেশের প্রতি এই আবেগ দেখে মাঝে মাঝে ঈর্ষা লাগে, রায়হান।”
কার্গো চৌধুরী নরম ভঙ্গিতে বলে উঠেন—“তুমি এবার তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে একটু সময় কাটাও রায়হান, এরপর অনেক কাজ আছে।”
সায়েম চৌধুরী ঠিক তখনই টয়োটা এলফার গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে বলেন—“এই সফরটা আমাদের জন্য শুধু ব্যবসার না… সম্মানের প্রশ্ন। এক মাসের মধ্যেই পুরো স্ট্রাকচার দাঁড় করাতে হবে।”
জাভিয়ান কিছু বলে না।সে শুধু সামনের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।তার মাথার মধ্যে তখন ঘুরছে একটাই চিন্তা— “আর মাত্র দু’দিন এর মধ্যেই কোনো মেয়েকে খুঁজে পেতে হবে নাহলে…”
সানগ্লাসের আড়ালে থেকেও তার চোখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত কঠিনতা।আলো-ছায়ার খেলার মাঝে ঢাকার রাত তাকে আরেক যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সময় অল্প, এবং দায়িত্ব অনেক বেশি।
.
.
.
.
চৌধুরী নিকেতন, গুলশান-২, ঢাকা।
আকাশে মেঘ জমলেও চৌধুরী নিকেতনের বিশাল লোহার গেট খুলতেই বাড়ির পুরোনো গন্ধ আর স্মৃতিরা যেন হু হু করে ছুটে এলো জাভিয়ানের বুকে। লম্বা, পিচঢালা ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে টয়োটা এলফার গাড়িগুলো একে একে থামল বারান্দার সামনে। চৌধুরী নিকেতন—একটি রাজকীয় পুরাতন বাংলো টাইপ বাড়ি, যার দেয়ালে এখনো রয়ে গেছে ধূসর শৈল্পিকতা আর এলিট ঐতিহ্যের ছাপ।
সবার আগে নামলেন জাভিয়ান। ব্রাউন জ্যাকেট ঠিক করতে করতে সামনে এগোলো। তার পেছনে তার সেক্রেটারি রায়হান যার মুখে ছিলো খানিক কৌতূহল আর স্মৃতিমাখা আবেগ।
বারান্দার দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কেয়ারটেকার হাজী সফিক সাহেব। বয়স ষাট পেরিয়েছে, তবু চোখে এখনো আগের মতোই অনুগত দীপ্তি। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার স্ত্রী রাহেলা বেগম, আর নাতি মুন্না—যার হাতে ছিলো এক গ্লাস ঠাণ্ডা শরবত আর মুখে লাজুক হাসি।
“আসসালামু আলাইকুম, বড় সাহবে!” — হাসিমুখে বললেন হাজী সফিক।
“ওয়ালাইকুম সালাম সফিক, কেমন আছো?” — সায়েম চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
এরপরই বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই সামনে এলেন সুফিয়া চৌধুরী—সাদা শাড়ি পরা, ধবধবে চুলে একটা আলগা খোঁপা, হাতে তসবিহ, চোখে-মুখে বয়সের রেখা থাকলেও চাহনিতে ছিল চিরন্তন দৃঢ়তা।
“আমার ছেলে আর নাতি ফিরেছে… অনেক বছর পর…” — দাদি বললেষ, আর তার গলার ভেতর কেঁপে ওঠে একটুকরো কান্না।
সায়েম চৌধুরী আর কার্গো চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে তার পা ছুঁয়ে সালাম করলো। সুফিয়া চৌধুরী আলতো করে মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন দুজনকেই। তার চোখের পানি কারও অজানা রইল না। আর জাভিয়ান তার দাদিকে জড়িয়ে ধরলো।
একটা মুহূর্তের জন্য সবকিছু থেমে যায়। তারপর ভিতরের ডাইনিং হলে হাজী সফিক তাদের নিয়ে যান, যেখানে আগে থেকেই সাজানো ছিলো খাবার—বিরিয়ানি, রোস্ট, আর রসগোল্লা।
.
.
.
.
রেহমান প্রিয়াঙ্গনে আজ যেন সাজসাজ রব। বারান্দা থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত ঝুলছে সোনালী লাইটিং, ঝকমকে আলোয় ভরে উঠেছে প্রতিটি কোণা। বারান্দার রেলিংয়ে ঝোলানো হয়েছে শিমুল ফুলের লাল-কমলা মালা, একেকটা ঘরে ঘরে অতিথিদের হাঁকডাক, হাসি-কান্না আর মিষ্টি গানের কলতান—সব মিলিয়ে যেন ছোটখাটো কোনো রাজকীয় উৎসব।
আজ এলিনার এনগেজমেন্ট। তান্বীর (তানবি) বড় বোন সে। সকাল থেকেই গেটের সামনে বিলাসবহুল গাড়ির লাইন, গাড়ি থেকে নেমে আসছেন বরপক্ষের আত্মীয়স্বজনেরা, কারো হাতে উপহারের প্যাকেট, কেউবা ফুল হাতে নিয়ে এলিনাকে দেখতে চায় এক ঝলক।
ছেলের পরিবার এক দেখাতেই মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত বিয়ের দিন স্থির করতে চায় তারা। বর লন্ডনে থাকে, অফিসের ছুটিও সীমিত—তাই বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই মঙ্গল।
এদিকে এলিনা গোলাপি রঙের জরির শাড়ি আর মাথায় পাতলা ওরনা পরে সাজঘরে বসে আছে। চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে ম্লান গোলাপি রঙ, মুখে হালকা সংকোচ—আনন্দ আর অজানা এক শঙ্কার মিশেলে যেন ওর চোখে নতুন এক পৃথিবীর দ্বার খুলছে।
তান্বীর অবস্থা আজ যেন দুই ভিন্ন জগতে আটকে পড়া এক দূত। একদিকে তার বোনের এনগেজমেন্ট, ঘরে ঘরে অতিথিদের অভ্যর্থনার দায়িত্ব, অন্যদিকে ফারহানের দায়িত্ব পালন করছে —সবকিছু সামাল দিচ্ছে সে একাই। অথচ এই মুহূর্তে যে মানুষটির পাশে থাকা দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি—ফারহান—সে এখনো বাড়ি ফেরেনি।
তান্বী বাবা বারবার ফোন হাতে নিচ্ছে, আবার রেখে দিচ্ছে। ফারহানকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ ইতিমধ্যে বরের পুরো পরিবার বসে গেছে ড্রইংরুমে। সময় যেন চলেছে তার নিজের গতিতে, কিন্তু ফারহানের অনুপস্থিতি তার বাবার চোখে খানিক অস্বস্তির ছায়া এনে ফেলেছে।
চারপাশে মানুষের কোলাহল, নতুন নতুন মুখ, আর পরিচয়ের মধ্য দিয়ে বাড়িটা আনন্দিত হয়ে উঠেছে ।
তান্বী মাথায় সানগ্লাস চাপিয়ে সদ্য দেখা দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “এই যে মিস্টার দুলাভাই! শুনেছি আপনি নাকি ইঁদুর ভয় পাষ? তাহলে আজ রাতেই আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।”
তার কথা শুনে আশপাশের সবাই হেসে ওঠে, বিশেষ করে তার বান্ধবীরা—নুসরাত,আদিবা আর স্নেহা,যারা জানে তান্বীর এমন দুষ্টুমি নতুন কিছু না।
দুলাভাই হেসে বললেন “তান্বী, তুমি কিন্তু আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছো!”
তান্বী চোখ টিপে বললো, “দুলাভাই, আমি তো চ্যালেঞ্জই! আমাকে সামলাতে পারলেই আপনি রেহমান পরিবারের যোগ্য সদস্য হতে পারবেন।”
তার মা দূর থেকে ডেকে বলে, “তান্বী! আর দুষ্টুমি কোরো না, অতিথিরা এসেছেন।”
তান্বী মুখ টিপে হাসে, তারপর বলল,“আসলে দুলাভাই আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি জানতাম না তান্বীর বড় বোনের কপাল এত ভালো হতে পারে!”
তান্বী রেহমান বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য, একেবারেই পরিবারের প্রাণ। বয়স ১৯ পেরিয়ে গেলেও ওর স্বভাব এখনো একেবারে শিশুদের মতোই সরল, আর প্রাণবন্ত। পড়ালেখায় অনেক পারদর্শী সে খুব ছোট বয়সে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো। তান্বীর জীবনে কোনো দুঃখ, কষ্ট কখনোই প্রবেশ করতে পারেনি। কারণ, পরিবারের প্রত্যেকেই যেন তাকে ভালোবাসায় মুড়ে রেখেছে—বাবা-মা, বড় বোন এলিনা আর বড় ভাই ফারহান, সবাই মিলে তান্বীকে আগলে রেখেছে সবসময়। যেন কোনো দুঃখ-কষ্টের ছায়াও না পড়ে তার উপর।
তান্বীর মুখে সেই চিরচেনা হাসি—যেটা দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। জীবন নিয়ে ওর একটাই দর্শন, “হাসি-ঠাট্টা আর ভালোবাসা থাকলেই সব ঠিক।” ওর চোখে এখনও রঙিন স্বপ্ন খেলা করে, কল্পনার জগতে ডুবে যেতে ওর দেরি লাগে না। তান্বী জানেই না জীবন কতটা কঠিন হতে পারে—কারণ সেই কঠিন বাস্তবতা তার কাছে কখনোই পৌঁছাতে পারেনি।
সে যেন একটা রংধনু, যে ঘরের যেকোনো কোণ আলো করে রাখে। তান্বী যখন থাকে, তখন চারপাশে শুধু হাসির শব্দ বাজে—একা একা নয়, তার বান্ধবীরা যখন আসে তখন পুরো বাড়ি যেন ছোটদের স্কুলে পরিণত হয়। তার বড় বোনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত চলতে থাকা খুনসুটিতে বোঝাই যায়, সে কতটা প্রাণবন্ত, কতটা চঞ্চল।
তান্বী জানে না কষ্ট কাকে বলে। আর সবাই যেন চায়—তান্বীর সেই না-জানা জগৎটাই বেঁচে থাকুক যতদিন সম্ভব।
.
.
.
.
রাত গভীর। মেক্সিকো সিটির বুকে বিস্তৃত আকাশজুড়ে নেমে এসেছে নরম অন্ধকার, শহরের আলো ঝলমলে দৃশ্য যেন দূর থেকে জ্বলন্ত রত্নপুঞ্জ। উঁচু স্ট্রোমহাউজের বিশাল কাচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন পুরুষ—নির্জন, নির্লিপ্ত, যেন স্বয়ং অন্ধকারের পুত্র।
মেইলস্ট্রোম।
তাঁর হাতে এক গ্লাস রেড ওয়াইন, রক্তের মতো ঘন লাল। ঠোঁটে এক ফোঁটা অবহেলা, চোখে নিঃসংশয় আগুন। শহরের দিকে তাকিয়ে যেন মেপে নিচ্ছে ভবিষ্যৎ শিকার।
ঠিক তখনই পিনপিনে শব্দে বেজে ওঠে ফোন। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটি নাম—”Mamá”।
সে এক মুহূর্ত চুপ থাকলো। তারপর আঙুল ছুঁয়ে ফোনটি রিসিভ করলো। “হ্যালো! মম.”
ওপাশ থেকে ধীরে ভেসে আসে এক নারীকণ্ঠ। গভীর, ভারী, অথচ তীক্ষ্ণ। যেন শত লা/শের ধারে গড়ে ওঠা কণ্ঠস্বর—একজন রাণীর, মাফিয়া সাম্রাজ্যের মালিক।
ইসাবেলা মোরেলোস। “আরো একটা খু*ন করেছো শুনলাম?” নারীটি হাসে। সেই হাসিতে ছায়া আছে, ছুরি আছে, অভ্যস্ত গর্ব আছে।
মেইলস্ট্রোম একটুও না কাঁপে উত্তর দেয়, ঠান্ডা কণ্ঠে।
“না মম! দুটো যোগ হয়েছে।”
সেই উত্তরে ওপাশ থেকে হঠাৎ নেমে আসে প্রশংসার ভার। “সাবাস! এই তো আমার ছেলে!” তার গলা যেন গর্জে ওঠে অদৃশ্য সিংহাসন থেকে।
একটা মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপর ইসাবেলা আবার বলে ওঠে, এবার আরও গভীর উচ্চারণে— “পুরো মেক্সিকোকে তোমার পায়ের নিচে এনে ফেলেছে, মেইলস্ট্রোম… কিন্তু আমি চাই, এখন পুরো পৃথিবীটাই তোমার পায়ের নিচে থাকুক।”
মেইলস্ট্রোম জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। নিচের আলো তার চোখে প্রতিবিম্ব ফেলছে, কিন্তু তার চোখের ভেতর ঢুকতে পারছে না। একেকটা শহর, একেকটা দেশ যেন তার মানচিত্রে দাগ টানা লক্ষ্যমাত্রা।
তার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসে এক নিঃসংশয় প্রতিশ্রুতি— “হবে, মম। সব হবে।”
আলো ধীরে ধীরে উপরে উঠে যায়, মেক্সিকো সিটি হারিয়ে যায় অসীম অন্ধকারের মধ্যে। দূর থেকে ভেসে আসে এক টুকরো স্প্যানিশ পিয়ানো সুর—নরম, বিষাদময়, যেন রক্তে ভেজা সুরের আলেখ্য।
.
.
.
.
গোডাউন অফ ফর্চুন, দক্ষিণ মেক্সিকো।
সূর্য তখন মেক্সিকোর গাঢ় আকাশে রক্তিম আলোর রেখা ছড়াচ্ছে।শহরের প্রান্তে এক নিষিদ্ধ অঞ্চল। মরুভূমির মাঝে ধূলিকণার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক ধাতব গেট—গোডাউন অফ ফর্চুন। এটা কোনো সাধারণ ভল্ট নয়, বরং একটা এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি সিস্টেম দিয়ে সুরক্ষিত মাল্টি-লেভেল আন্ডারগ্রাউন্ড কোষাগার। চারপাশে উচ্চ সিকিউরিটির প্রাচীর। ভারি লোহার গেটের সামনে দাঁড়াতেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট, রেটিনা স্ক্যান আর কণ্ঠস্বর যাচাইয়ের পর গেটটি ধীরে ধীরে খুলে গেল।
মেইলস্ট্রোম ধীর পায়ে সেখানে প্রবেশ করলো। তার চোখে ছিল সেই পুরনো অভ্যস্ততা, কিন্তু আজকের আগমনটা ছিল বিশেষ। আজ সে এখানে আরও কিছু মূল্যবান সম্পদ সংরক্ষণ করতে এসেছে।
ভিতরে ঢুকতেই দেখা গেল বিশাল এক ভূগর্ভস্থ হল, যেন ধাতব কোনও প্রাসাদ। চোখ ধাঁধানো সোনার বার সারি সারি রাখা। এক কোণে বিশাল স্টিলের আলমারিতে গুচ্ছ গুচ্ছ হিরা—প্রতিটি হিরাই আলাদা এক ইতিহাসের সাক্ষী। দেয়ালের পাশে সাজানো রয়েছে বিশ্বসেরা আর্ট গ্যালারির চুরি হয়ে যাওয়া চিত্রকর্ম—মোনালিসার একটি গোপন অনুলিপি, ভ্যান গঘের চুরি হওয়া একখানা পেইন্টিং।
একটা কাচের বাক্সে রাখা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মুদ্রা, যার দাম—অমূল্য। আরেক পাশে রয়েছে কোটি কোটি ডলারের ক্যাশ, গোছানো ভাবে রাখা—ডলার, ইউরো, ইয়েন, টাকায় ভর্তি।
একটা বিশেষ চেম্বারে, সর্বোচ্চ সুরক্ষায়, রাখা আছে কালো টাইটানিয়াম কন্টেইনার—যেখানে সে পৃথিবীর ১০টি সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন রেখে দিয়েছে।
আজ তার সঙ্গে এসেছে ছয়টি সেফ কন্টেইনার—প্রতিটিই টাইটেনিয়াম কাঠামোতে মোড়া।
কন্টেইনারগুলোতে ছিল একটি আফ্রিকান রাজপরিবারের ঐতিহাসিক সোনার মুকুট। প্লুটোনিয়ামের তৈরি ক্ষুদ্র এক খণ্ড, যা কেবল কালোবাজারেই চালান হয়
অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচ থেকে উদ্ধার করা ১৫ হাজার বছরের পুরনো হিরার টুকরো। জাপানের একটি বিলুপ্ত প্রাচীন তলোয়ার। ভার্জিন অস্ট্রেলিয়ার নীল অ্যামেথিস্ট পাথরের সংগ্রহ।এক বিলিয়ন ইউএস ডলারের নগদ অর্থ, বাণ্ডলে মোড়ানো, হেলিকপ্টারে আনা হয়েছে।
দুইজন ফোরেনসিক এক্সপার্ট আর তার বিশেষ সহকারী ডেমেট্রিয়াস গোডাউনের ভিতর ঢুকিয়ে একে একে কন্টেইনার খুলে ফাইনাল ইনভেন্টরি নিচ্ছিলো।
মেইলস্ট্রোম হাত গুটিয়ে তাকিয়ে থাকলো চারপাশে। দেয়ালের শেলফগুলোতে স্তরে স্তরে রাখা আছে—
ইউরোপের চুরি হওয়া শিল্পকর্ম।বিল গেটসের ব্যবহার করা পুরোনো ঘড়ি। রাশিয়ার হোয়াইট ডায়মন্ড সিরিজ।
আর একটি জিনিস যার নাম নেই—কেবল কোড দেওয়া “PX-09″—যার সম্পর্কে শুধু সেই জানে।
তার ঠোঁটে এক হালকা হাসি ফুটে উঠলো “সবচেয়ে দামি জিনিসগুলো কিনে রাখা যায় না,” সে ফিসফিস করে বলল, “তবে লুকিয়ে রাখা যায়। ইতিহাসও আমার কাছে বন্ধক হয়ে থাকবে।”
.
.
.
.
একটি গুদামঘরের ভিতর কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ। বদ্ধ ঘর, আধা-আলো, দেয়ালে ঝুলছে দামি আর্টওয়ার্ক। রিকার্দো রিকার্দো সিগারেট হাতে বসে আছে। তার পাশে বসে আছে দেহরক্ষীরা। সামনে ফারহান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
রিকার্দো ঠাণ্ডা কণ্ঠে বললো “তোর জন্য অনেক প্ল্যান করছি, ফারহান। এই অপারেশনটা শেষ হলে তোকে আমি মেক্সিকো টিমে তুলে দেব।”
ফারহান চোখে ঘৃণা নিয়ে বললো “নারী পাচার? এটা আমার কাজ না। আমার ঘরে দুটো বোন আছে। আমি কীভাবে অন্যের বোনকে বিক্রি করবো?”
রিকার্দোর চোখে আগুন জ্বলে উঠলো “বোনের কথা মনে থাকে, আর আমার কাজের কথা মনে রাখিস না? আমি তোকে এখানে তুলে এনেছি, বাঁচিয়ে রেখেছি। এখন যদি নিজের নীতি দেখাস, তো আমি ভুল লোককে বিশ্বাস করেছি এতো দিন হ্যাঁ তুই তো আমার ডান হাত ছিলিস।”
ফারহান চোখের দৃষ্টি শক্ত করে বললো “চাইলেই আমার মতো ছেলেকে পাবেন না আপনি, রিকার্দো। আমি বন্দুক বেচেছি, গাড়ি চালিয়েছি, সোনা পাচার করেছি এমনকি নিজের হাতে নিজের ছোটবেলার বন্ধুকে খু/ন করছি আপনার জন্য কিন্তু নারীর ইজ্জত নিয়ে খেলব না।”
রুমের পরিবেশ থমকে যায়। রিকার্দোর চোখ লাল হয়ে আসে, দেহরক্ষীরা চুপচাপ তাকিয়ে আছে।
রিকার্দো গম্ভীর গলায় বললো “তুই জানিস না আমি কী করতে পারি…”
রিকার্দো পুনরায় কঠোর স্বরে বললো “তোর এই নরম মনোভাব চলবে না রে, ফারহান। এখনই সিদ্ধান্ত নে। করবি, না কি তোর জীবন মরন সবটা আমার হাতে।”
ফারহান চোখ বন্ধ করলো, ঘামছে তারপর ধীরে বললো “আমাকে একটু সময় দিন। আমি… ভাবছি।”
রিকার্দো ঠাণ্ডা গলায় বললো “ভেবে নিস। বেশি সময় দিচ্ছি না। মাত্র আজকের রাতটা ভাবার সময় পাবি।”
এনগেজমেন্টের সাজসজ্জায় ঝলমল করছে পুরো বাড়ি। বাগানজুড়ে ঝাড়বাতি, ফুলের মালা, আর গানের সুরে উৎসবের ছোঁয়া। কিন্তু জমায়েত হওয়া লোকজনের দৃষ্টি বারবার গিয়ে পড়ছে মূল ফটকের দিকে।
ফারহানের মা মৃদু স্বরে, একপলক ফটকের দিকে তাকিয়ে বললো “ফারহান এখনো এল না…”
ঠিক তখনই, রেহমান প্রিয়াঙ্গনের প্রধান ফটকে কড়া নাড়ার শব্দ। দরজাটা আস্তে করে খুলে যায়। আলো-আঁধারির ভেতর দিয়ে ফারহান ঢুকে পড়ে। সে সাদা জমকালো পাঞ্জাবিতে, কিন্তু মুখটা থমথমে। চোখে গভীর দুশ্চিন্তা, আর ঠোঁটে যেন একটা ম্লান, পরাজিত হাসি।
মা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বললো “ফারহান! তুই… কোথায় ছিলি এতক্ষণ?”
ফারহান জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। হাসে। কিন্তু সে হাসিতে কোনো উষ্ণতা নেই—শুধু ক্লান্তি। আঙটি পরানোর মুহূর্তটা আটকে আছে ওর জন্য, কিন্তু সে যেন এক অনুপস্থিত ছায়া।
এলিনা সাজে সেজেছে ঠিকই কিন্তু চোখে এক টুকরো খালি খালি ভাব ছিলো তার ভাই ছাড়া জীবনের এত বড় দিনে তার আনন্দটা যেন অপূর্ণ হচ্ছিলো।য়আর এখন ফারহানকে দেখতে পেয়ে স্বস্তি ফিরে পেলো সবাই।
ফারহানের পোশাক আর চুল কিছুটা এলোমেলো হয়ে আছে। সবাই চুপ করে তাকিয়ে থাকলো ওর দিকে।
তান্বী তখন ফারহানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো “ভাইয়া অবশেষে চলে এসেছো তুমি। এলিনা আপা তো কাঁদতে বসেছিল…”
ফারহান মুচকি হাসে, তবে মুখে সেই চেনা রুক্ষতা। ওর চোখ যেন হাজারো কথা চেপে রেখেছে। ফারহান এগিয়ে গিয়ে এলিনার কপালে চুমু খায়। “শুভ এনগেজমেন্ট,এলিনা।”
সেই মুহূর্তে বর পক্ষ আঙটি পড়ায় এলিনাকে। হাততালির গর্জনে উঠোন ভরে যায়। কিন্তু ফারহানের মুখে সেখানে কোনো হাসি নেই। শুধু একটা বিষন্নতা, একটা ভয়, আর একরাশ অনুশোচনার ছাপ— কারণ সে জানে, তার জীবন হয়তো এবার নরকে পরিণত হবে।
চলবে………
(সবাই বেশি বেশি রেসপন্স করবেন আর অবশ্যই গঠনমুলক কমেন্ট করবেন।)
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১০
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৬
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৭
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৯
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২০
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১১