ডিজায়ার_আনলিশড (Desire Unleased)
✍️ সাবিলা সাবি
পর্ব ২.
Maelstrom (মেইলস্ট্রোম) —এক গম্ভীর, ঘূর্ণিময় নাম।
এই অদ্ভুত নাম যা,বাতাসে শরতের পাতা যেমন নিঃশব্দে ঝরে পড়ে, ঠিক তেমন নিঃশব্দে মৃ*ত্যুকে ডেকে আনে সে। এই কোডনেমের পেছনের অর্থেই লুকিয়ে আছে তার সত্ত্বার রূপ— সমুদ্রের গভীর কোন এক প্রাচীন ঘূর্ণিতে যেমন জাহাজ তলিয়ে যায় নিঃশব্দে, ঠিক তেমনি Maelstrom (মেইলস্ট্রোম ) ধ্বংস করে দেয় সবকিছু শব্দহীনভাবে আর নিঃশ্বাসহীন করে।
সে শুধু একজন কিলার নয়। সে মানসিক ধ্বংসের এক বিশেষজ্ঞ। সে এক গভীর টর্নেডো, যা আগে ধ্বংসের আশ্বাস দেয়, তারপর গিলে ফেলে।
সে মেক্সিকোর সবচেয়ে প্রভাবশালী মাফিয়া কিং, যার নির্দেশে মুহূর্তে উড়ে যায় কার্টেল প্রধানদের মাথা। তার হাতে খু/ন হয়েছে ৮২ জন, যার মধ্যে ১১ জন ছিলো পুলিশ অফিসার, ৪ জন রাজনীতিবিদ, আর বাকি সবাই ছিলো ক্ষমতালোভী প্রতিদ্বন্দ্বী।চোখে কোনো অনুতাপ নেই। মুখে কোনো হাসি নেই। তবু হাজার হাজার মেয়ে মরে তাঁর ঠান্ডা চাহনির প্রেমে।
সে আসলে কে? জানা যায় না। কিন্তু প্রত্যেকটি তার দেয়া প্রত্যেকটা মৃত্যুর পিছনে ছিলো তার ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা। প্রেমিকার সামনে প্রেমিককে পুড়িয়ে দেওয়া,সক্রিয় পুলিশের মাথা কেটে কুকুরকে খাওয়ানো, দুধের শিশুকে তার মায়ের সামনে গুলি করা—এসব ছিলো তার “বার্তা” সমাজের জন্য। বাচ্চাদের সামনে বাবাকে খুন করেছে, শুধু সময়মতো টাকা না দেওয়ার কারণে।সে এসিড ঢেলেছে এক সাংবাদিকের গায়ে।সে হাত কেটেছে এক থানা ইনচার্জের। আর সে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এক বৃদ্ধাশ্রমে, কারণ সেখানে তার শত্রুরা লুকিয়েছিল।
বলা হয়, কেউ তার চোখে একবার তাকালে, সেখানে নিজের কবর দেখে ফেলে। মেইলস্ট্রোম— নামটা যখন কেউ কানে পায়, তখনই শরীরের ভেতর একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। কারণ সে শুধু মেরে ফেলে না। সে আগে ভয় পাইয়ে তোলে।তারপর আস্তে আস্তে ভেঙে দেয়—মন, দেহ, আত্মা।
.
.
.
.
মেক্সিকোর সিউদাদ দেল কারমেন বন্দর এলাকায়
বিকেলের ক্লান্ত আলো ধীরে ধীরে নেমে আসছে গালফ উপকূলের বাতাসে। বন্দরের পাশ ঘেঁষে পড়ে থাকা একটা পুরনো গুদামঘর—যেখানে মাদক আর অস্ত্রের গন্ধে ভেজা। চারপাশে জংধরা কনটেইনার,কাঠের বাক্স আর ধূলিধূসর ধ্বংসস্তূপের মতো কিছু কাটা রড ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
এটা সবার জানা, লোস কুয়েরভোস কার্তেল এখান থেকে “প্রোটেকশন মানি” তোলে—যাকে সবাই চেনে, মাফিয়াদের ভাষায়, লা কুওটা।আর এই জায়গাটা এখন মেইলস্ট্রোম-এর নিয়ন্ত্রণে।
সেখানে দুই তিনজন তরুণ দাঁড়িয়ে চাঁদা তুলছে। স্থানীয় দোকানদার, ট্রাক ড্রাইভার, এমনকি শিপমাস্টার পর্যন্ত জানে—প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিনে টাকা না দিলে, পরদিন দোকান তো পুড়বেই, সাথে শরীরও অক্ষত থাকবে না।
ঠিক সেই মুহূর্তে এক আধা বয়স্ক লোক, যার চেহারায় ক্লান্তি আর চোখে আতঙ্ক নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
“Señores (মহোদয়গণ)… দয়া করে এই মাসে একটু ছাড় দিন, আমার স্টক এসে পৌঁছায়নি, লোকসান হয়েছে অনেক। আমি পরের মাসে পুরো টাকা দিয়ে দেবো, প্লিজ…”
চারপাশে থাকা ছেলেগুলোর ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটে উঠলো।একজন কানে ফোন তোলে। আরেকজন মাথা নিচু করে বলে—“ডন মেইলস্ট্রোম-এর সামনে এই কথা বললে, টাকাও থাকবে না,তোর মুখও না।”
ফোনের ওপাশে এক ঠান্ডা, হিসেবি গলা ভেসে আসলো
“আই অ্যাম কামিং.”
দশ মিনিটও পেরোয় না—বন্দরের সরু রাস্তা ধরে বিশাল শব্দ তুলে ঢুকে পড়ে এক গাঢ় কালো বুলেটপ্রুফ SUV, যার কাঁচও সোনার গুলি ঠেকায়। চারদিকে কালো কাঁচ, সাইলেন্সারে ঢাকা স্পোর্টস-এনজিনের গর্জন যেন বাতাস ছিঁড়ে ফেলে। স্পোর্টস ইঞ্জিনের গর্জন পুরো গুদাম ঘরের বাতাস কাঁপিয়ে,তার উপস্থিতি মানেই নিশব্দে শকুনেরা চক্কর দেয়।গাড়ির দরজা খুলে যখন মেইলস্ট্রোম নামল, সময় যেনো হঠাৎই থেমে গেল। সে হাঁটছে একদম ধীরে ধীরে।
তার জুতো যা পৃথিবীর অন্যতম দামি ‘টম ফোর্ড ক্রোকোডাইল স্কিন অক্সফোর্ড’ চকচকে কালো।পোশাক ছিলো সিল্কের কালো শার্ট, হাতা গুটানো, উপরে স্লিম-কাট ব্লেজার।
তার ডান হাতে ঝুলছে এক বিশাল, কালো রঙের চেইন, যেন সেটা একটা বন্দীর হাত ভাঙার জন্য বানানো হয়েছে। চোখে হালকা নীল কাচের সানগ্লাস আর মুখের মুখোশটা থুতনিতে নামানো, ঠোঁটে আধভাঙা সিগারেট, যার আগুনটা ধীরে ধীরে জ্বলছে এখন ও।
সেই লোকটা পেছনে হাঁটতে হাঁটতে প্রার্থনা করতে থাকে—“Señor… দয়া করে মারবেন না… আমার পরিবার আছে, একটা মেয়ে আছে… আমি টাকা শোধ করে দেবো…”
মেইলস্ট্রোম একদম সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো লোকটার। কয়েক সেকেন্ড তার চোখে চোখ রেখে চুপ থাকলো। তারপর ঠান্ডা গলায় বললো—”মেইলস্ট্রোম কারো ভুলের জন্য দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। মৃ*ত্যু একবারেই আসে।”
ঠিক পরের মুহূর্তে— সে সজোরে একটা লাথি মারে লোকটার পেটে। লোকটা ছিটকে পড়ে যায় কাঁচের বাক্সের ওপর। ছ্যাঁৎ করে একটা আওয়াজ হলো আর বাতাসে ধুলা উড়তে থাকলো।
মেইলস্ট্রোম ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে লোকটার গলা চেপে ধরে তার ঘাড়ের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়লো মানুষটার কণ্ঠ রুদ্ধ,আর গলা দিয়ে একটা ভোঁতা গোঙানির শব্দ বেরোলো। যেন তার ওজনেই লোকটার শরীরটা চূর্ণ হবে এমন করে। মেইলস্ট্রোম নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, ঘাড়ে পা রেখেই সিগারেট টানতে থাকে। ধোঁয়ায় জায়গায়টা ভরে গেলো। সে সিগারেটটা ঠোঁটে টেনে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেললো। সেই সিগারেটের আগুনটাই তুলে লোকটার চোখের ভেতর ঠেসে দিলো—লোকটার এক চিৎকার উঠে বাতাস কাঁপিয়ে দিলো, আবার মুহূর্তেই সব স্তব্ধ হয়ে গেলো।
তারপর, ঠান্ডা হাতে তাঁর কোমরে বাঁধা কালো চামড়ার হোলস্টার থেকে ধীরে ধীরে পিস্তলটা বের করলো। তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা পড়ল ‘লা সোম্ব্রা নেগ্রা'( black shadow) —এট একটা অস্ত্র নয়, যেন শিল্পের নিখুঁত এক নিদর্শন।
এই পিস্তলটি শুধুমাত্র একটি কপি বানানো হয়েছে মেইলস্ট্রোম-এর জন্য—পুরো বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। ম্যাট ব্ল্যাক বডির গায়ে খোদাই করে বসানো প্ল্যাটিনামের পাতায় জ্বলজ্বলে মেক্সিকান চিহ্ন বাসন—একটি ডানা মেলা কাক। ট্রিগারের চারপাশে সোনালী জরি, আর ব্যারেলের মাথায় ছোট্ট করে খোদাই করা তার কোডনেম—মেইলস্ট্রোম। 50 Action Express—বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যান্ডগানের বুলেট এই পিস্তল। রেঞ্জ 150 মিটার অবধি নিখুঁত হিট। স্পেশাল ফিচার রয়েছে,শব্দহীন ফায়ার মোড
থার্মাল ডিটেকশন স্ক্যানার,বায়োমেট্রিক লক—মেইলস্ট্রোম ছাড়া কেউ ছুঁলেও চলবে না এই পিস্তল।মাত্র ১.৮ সেকেন্ডে টানা ৫ রাউন্ড ফায়ার করতে সক্ষম। এক মুহূর্ত, মেইলস্ট্রোম লোকটার মুখের ভেতর ঠেসে ধরে রিভলবারটা। লোকটার চোখে তখন কেবল অনুরোধ, কান্না আর মৃ*ত্যুভয়।
“তোর গলার স্বরই সহ্য হচ্ছেনা না।” পাটাং! এক শব্দ হলো আর সাথে সাথে মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় লোকটার।
রক্ত ছিটকে পরে আশেপাশে দেয়ালে, মেঝেতে,আর মেইলস্ট্রোমের জুতোতেও। সে নির্বিকারভাবে রিভলবার ফিরিয়ে নেয়, চোখে এক বিন্দু আবেগ নেই। আশপাশের সবাই দম বন্ধ করে দেখছে।
মেইলস্ট্রোম নিজের হাতের ঘড়ি দেখলো, তারপর পেছন ফিরে ধীরে ধীরে বলে ওঠলো—“Time’s up. Payment made.” (সময় শেষ। পেমেন্ট সম্পন্ন।)
মুহূর্ত পরে সেখান থেকে মেইলস্ট্রোম বাইরে বেরিয়ে আসে। তার সঙ্গেই থাকে তার বিশালদেহী নেকড়ে—র*ক্তে লালচে ধূসর লোমে আবৃত, হালকা ঠাণ্ডা চোখ, যার নাম “ক্রেভার”।
সে নেকড়ের দিকে তাকিয়ে বললো— “এই লা/শটা আমার প্রিয় ক্রেভারকে খাইয়ে দাও অনেকদিন হলো ওর তাজা মাংস খাওয়া হয়নি।” ক্রেভার হালকা গর্জনে সাড়া দেয়। যেন সে-ও রক্ত চায়, মৃত্যুর স্বাদ চায়।
এরপর… কালো SUV গাড়িতে উঠে বসে পড়লো মেইলস্ট্রোম। গাড়ি ছুটে চলে সেই মৃ*ত লোকটার গ্রামের বাড়ির দিকে। গাড়ির পেছনে ক্যাশভর্তি একটি বস্তা।
মেইলস্ট্রোম সেই লোকের গ্ৰামের বাড়িতে পৌঁছাতেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু না বলেই সেই টাকার বস্তা ছুড়ে ফেলে দেয় উঠানে। এক গাদা টাকা ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে।
আর সেই লোকটার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো মেইলস্ট্রোম “তোর বাপ চাঁদা দিতে অস্বীকার করেছিল। তাই ওরে ওপরে পাঠিয়ে দিলাম। এই টাকায় যা ইচ্ছা করিস—কাজে লাগাস, কফিন কিন, কিংবা বাচ্চার জন্য খেলনা।”
চারপাশে কান্নার আওয়াজ, আর আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লো। লোকটর স্ত্রী কেঁদে কেঁদে বললো— “শুধু লা*শটা দিন আমাদেরকে… অন্তত তাকে কবর দিই…”
মেইলস্ট্রোম ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে বললো—”লা*শ? ওর তো আর কোনো চিহ্ন নেই… হাড়ও খুঁজে পাবি না।”
তারপর চোখে সানগ্লাস পরে, একপলক না তাকিয়েই গাড়িতে উঠে চলে যায়। পেছনে পড়ে থাকে স্তব্ধতা, শোক, আর আতঙ্ক। যেন কোনো দুঃস্বপ্ন এসে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এটা ছিল মেইলস্ট্রোমের “একবারেই মৃ*ত্যুর” নীতি। সে কেউ না… সে এক তাণ্ডব।
.
.
.
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস – বিকেল তখন সাড়ে পাঁচটা
তান্বী, স্নেহা আর ওদের কিছু বন্ধুবান্ধব মিলে টিএসসির সামনে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
হালকা রোদ পড়েছে গাছের পাতার ফাঁক গলে। পেছনে রিকশার ঘণ্টা, সামনে বকবকানি আর চায়ের কাপের ধোঁয়া। হঠাৎ স্নেহা এক চুমুক দিয়ে বলল—“আচ্ছা স্যার যেদিন বললেন— ‘তুই মাফিয়ার গাড়ির কাচ ভেঙে দিয়েছিস আমার জন্য’ — এটা কি আসলেই মাফিয়ার গাড়ি ছিলো সেদিন?
তান্বী মুচকি হেসে বললো “হ্যাঁ, তাই তো বললো স্যার। আমি ভেবেছিলাম মজা করছে, কিন্তু এখন ভাবলে গা শিউরে ওঠছে কেমন।”
স্নেহা তখন বললো “তুই লোকটাকে দেখেছিস? কেমন দেখতে ছিলো? জানিস তো, মাফিয়ারা দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম হয়, সিরিয়াসলি!”
তান্বী হেসে ফেললো আর বললো “আরে দূর! কে বলেছে যেয়ে দেখ গিয়ে,ডিপজলের ছোট ভাই হবে হয়তো!”
স্নেহা হাসতে হাসতে বললো “আর না পাগল! স্যার তো বললো বাংলাদেশের কেউ না.. ওটা মেক্সিকোর মাফিয়া ছিলো!”
তান্বী চিন্তিত মুখে বললো “এসব ছাড়। আমি ভাবছি, আমিত তার গাড়ির কাচ ভেঙে দিলাম, অথচ সে না আমার বাড়িতে হামলা করলো, না আমার সামনে এসে একটাও কথা বললো, শাস্তি ও দিলো না। এটা কি স্বাভাবিক?”
স্নেহা চুপ করে তাকিয়ে থাকে তান্বীর দিকে তারপর বলে “অস্বাভাবিক, খুব অস্বাভাবিক।”
তান্বী অসহায় চোখে স্নেহার দিকে তাকালো। স্নেহা তখন হঠাৎ করে বললো “আচ্ছা তোর বড় আপাকে কেনো আসতে বললি, তোর ভাইয়াকেই আসতে বলতি ভার্সিটিতে “।
তান্বী তখন চোখ বড় বড় করে বললো “ভাইয়া আমাকে মেরেই ফেলবে! আমি আমার বড় আপুকে সব বলেছি… সে আসবে আজ। প্রফেসরের সাথে দেখা করতে আসবে। এলিনা আপা তার ক্লাস শেষ করেই আসছে।”
স্নেহা চোখ বড় করে বললো ” যাহ আমি ভেবেছিলাম একটু তোর ভাইকে দেখবো কেমন দেখতে”।
তান্বী বুক চেপে ধরে বললো “স্নেহা সিরিয়াসলি বলছি… আমার ফারহান ভাইয়া এমন মানুষ যে একদম মারামারি পছন্দ করে না। আমাদের বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার। তিনি খুব সৎ মানুষ ছিলেন। ভাইয়াও একদম তার মতো হয়েছে। গেঞ্জাম, মারামারি এগুলো একদম সহ্য করতে পারে না, আর এসব কেউ করেছে আমাদের পরিবারে সেটাও মানতে পারবেনা।”
স্নেহা ঠোঁটে হাসি এনে বললো “দূর! আমি ভেবেছিলাম তোর ভাই বুঝি কোনো অ্যাকশন হিরো হবে… আমি তো আরো ভাবছিলাম লাইনে নামবো!”
তান্বী অস্বস্তিতে বললো “কি বলছিস কি স্নেহা…”
স্নেহা হেসে বললো “বর্ণনা শুনে তো মনে হলো তোর ভাই হাদারাম টাইপ কিছু!”
.
.
.
.
“ভিলা এসপেরাঞ্জা”
তখন আকাশে রাত নেমে এসেছে।বাইরে বজ্রপাতের গর্জন শোনা যাচ্ছে। জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে টুপটাপ করে, মাঝে মাঝে হালকা ঝাঁকুনিতে কাঁচটা কেঁপে ওঠে। ঘরের ভেতরে স্যুইডিশ কাঠের দেয়াল, ধোঁয়াটে ম্লান আলো, টেবিলের এক কোণে পুরনো সিগার হিউমিডোর, অন্য প্রান্তে ধীর টিকটিক করা এক অ্যান্টিক ঘড়ি।
জাভিয়ান চুপচাপ বসে আছে কালো চামড়ার একটি বিলাসবহুল চেয়ারে তার ব্যাক্তিগত অফিস রুমে। সামনে রাখা কাঁচের গ্লাসে হুইস্কি আর বরফের টুকরো ধীরে ধীরে ঘুরছে, তার চোখ জানালার বাইরে শহরের ঝলমলে আলোয় স্থির হয়ে আছে।
দরজায় হালকা নক পড়লো।জাভিয়ান মুখ না তুলেই নিঃশব্দে বলে ওঠলো—” এসো।”
দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে রায়হান—তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেক্রেটারি। তার মুখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ।
রায়হান নিচু স্বরে বললো “স্যার… আজ রাতে আপনার ক্যাসিনোতে যাওয়ার খবর আপনার বাবা চৌধুরী সাহেব জানেন। কোনওভাবে কেউ পৌঁছে দিয়েছে পর্বটা তার কানে।”
জাভিয়ান চোখ তুললো না। কেবল গ্লাসে বরফ ঘোরাতে থাকলো।একবার ধীরে বলে ওঠলো—“কে সে?”
রায়হান হালকা সংকোচে নিয়ে বললো “লুইস ওর্তেগা নামে একজন লোক… আগে ক্যাসিনোর সিকিউরিটি টিমে ছিল। এখন মসজিদের সঙ্গে জড়িত। আপনি তো জানেন, আপনার বাবা সাহেব সবার কথা বিশ্বাস করেন যে যা বলে।”
জাভিয়ান এবার ধীরে চোখ তুললো । ঠোঁটে একটুকরো ঠাণ্ডা হাসি খেলে গেলো। আর তখন বাতাসও থেমে গেলো, আর সেই থেমে যাওয়ায় কারও ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে গেলো।
জাভিয়ান চোখে হালকা শীতল দীপ্তি নিয়ে বললো “লুইস ওর্তেগা… এখন ধার্মিক? কী অদ্ভুত তামাশা… পাপ ধুয়ে ফেলার নাটক। কিন্তু ভুলে গেছে, আমি কি জিনিস।”
রায়হান চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
জাভিয়ান এবার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। গ্লাসের শেষ চুমুক নিয়ে সেটি টেবিলে রাখে। ধীরে পেছনে ঘুরে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।আঙুলের সোনার আংটিতা ঘোরাতে ঘোরাতে ধীরে, গম্ভীর গলায় বললো “বিশ্বাস… সেটা যদি ভেঙে যায়, তবে ছায়াও আর নির্ভরতা দেয় না। যে বা যারা চৌধুরী সাহেবের কান পর্যন্ত আমার খবর পৌঁছে দেয়, তাদের মুখের ভাষার অস্তিত্ব আর রাখা যায় না।”
রায়হান তখন জিজ্ঞেস করলো “তাহলে কমান্ড দিন কি করবো স্যার?”
জাভিয়ান পেছনে না তাকিয়ে, ঠান্ডা অথচ ধারালো গলায় বলেষলো— “তার জিভ নিয়ে এসো, রায়হান। যেন সে আবার কোনোদিন কথা না বলতে পারে। আমার বাবার কানে যেন আর কোনও শব্দ না যায়। না, কখনও না।”
বিদ্যুতের ঝলকে হঠাৎ আলো পড়লো জাভিয়ানের মুখে — সেই মুখে ঝড়ের মতো ঠান্ডা প্রতিশোধ আর লৌহ কঠিন নীরবতার ছাপ স্পষ্ট।
.
.
.
.
গভীর রাত। ঝড়ো বাতাসের হালকা গর্জন শোনা যাচ্ছে দূরে। একটি ফার্ম হাউজ—কিন্তু এটা কোনো সাধারণ ফার্ম হাউজ নয়।পুরো বাড়িটাই যেন অন্ধকারের উপাসনালয়। প্রবেশপথ থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত সমস্ত দেয়াল আঁধারে ডুবে আছে। সবকিছুই কালো—দেয়াল, জানালা, আসবাব, এমনকি পর্দাও।
ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল সাপের পিণ্ড আকৃতির টেরারিয়াম, যেখানে বিষধর সাপরা ঘুমিয়ে থাকে।
কিন্তু সেদিকে কারও নজর নেই।
ঘরের মাঝখানে এক অদ্ভুত নকশার চেয়ারে বসে আছে মেইলস্ট্রোম। তার গায়ে ঢিলেঢালা কালো স্যাটিনের নাইট সুট,গলায় একজোড়া ভারী চেইন, আর চোখে আগুনের মতো জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। তার হাতের আঙ্গুলের ডগা থেকে উঠে এসেছে একটি বিচ্ছু—অসাধারণভাবে প্রশিক্ষিত সেই বিচ্ছু টা। একবার হাতে, আবার উঠে যাচ্ছে ঘাড়ে।মেইলস্ট্রোম হাসছে না, কাঁপছেও না।এই বিচ্ছুই যেন ওর আত্মার অংশ।
তার একজন লোক দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে।চোখে শ্রদ্ধা, আর মুখে উত্তেজনা নিয়ে।
লোকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে কাঁধ একটু সামনে ঝুঁকিয়ে বললো “বস… আজ একটু পার্টি করলে কেমন হয়? পুরো টিম দাওয়াত দিচ্ছে।
মেইলস্ট্রোম ঠান্ডা গলায় বললো “যাও, পুরো ক্লাবটা দখল করে নাও। কারো ঢোকার দরকার নেই,এনজয় করো তোমরা”
লোকটা চোখ টিপে বললো “বস, আজকের পার্টিতে একজন অসাধারণ সুন্দরী আসছেন—আমেরিকান। রিয়েল গর্জিয়াস। আপনার সাথে মিট করতে চায়। নেক্সট লেভেলের যদি হবে।”
মেইলস্ট্রোম ধীরে চোখ তুললো, ঠোঁটের কোণে শীতল হাসি নিয়ে বললো “আমার ত্রিশ বছরের জীবনে আমি ওর মতো সুন্দর কাউকে দেখনি।”
লোকটা হতবুদ্ধি হয়ে জিজ্ঞেস করলো “কে বস?”
মেইলস্ট্রোম তখন নীরবে একবার বিচ্ছুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো “বাংলাদেশের সেই মেয়েটা…”
লোকটা হেসে বললো “বস, আমেরিকা, মেক্সিকো, রাশিয়ায় ওর চেয়ে সুন্দরী মেয়ের অভাব নেই। আপনার মতো পুরুষের জন্য তো সবাই রেডি।”
মেইলস্ট্রোম চোখে হালকা নরমতা আনলো কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা রেখেই বললো “সৌন্দর্য একরকম, মায়াবী হওয়া আরেকরকম। ওর চোখে যে গভীরতা আছে, আমি কোনো মডেল, অ্যাক্ট্রেস, বা প্রিন্সেসের চোখেও দেখিনি। আমার মনে ওকে বসিয়ে ফেলেছি। ওই আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী।”
লোকটা অবাক হয়ে বললো “তাহলে বস, ওকে তুলে নিয়ে আসুন। বিয়ে করে ফেলুন।”
মেইলস্ট্রোম চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো
“না…আমি ওকে এখন জোর করবো না।আমার মিশন শেষ হোক, তারপর ওকে আমি আমার করে নেবো… একেবারে। তোমরা পার্টি করো। কিন্তু আমাকে এসবের মধ্যে টেনো না।”
লোকটা একটু বিস্মিত মুখে মুচকি হেসে বল —”আপনি তো সেই মেয়েটার জন্য একেবারে পাগল হয়ে গেলেন, স্যার। মাত একবার দেখেই আর এতটা তো কেউ নিজের প্রিয় অস্ত্রের জন্যেও হয় না।”
মেইলস্ট্রোম ধীর কণ্ঠে, চোখে লালচে আলো জ্বেলে বলল— “ইয়েস… শি ইজ মাই ডিজায়ার আনলিশড (সে আমার উন্মুক্ত আকাঙ্ক্ষা) সে শুধু একটা মেয়ে না… সে আমার কল্পনার আগুন, আমার নরকের মধ্যে এক টুকরো স্বর্গ।”
লোকটা চুপ করে যায়। ঘরে তখন কেবল নিঃশব্দ বিচ্ছুর চলাফেরা আর দেওয়ালের ওপাশে বাতাসের গর্জন শোনা গেলো। অন্ধকারের মাঝখানে একা বসে থাকা সেই পুরুষ—মেইলস্ট্রোম! তার লক্ষ্য শুধুই তার মিশন আর… সে মায়াবী মেয়ে।
লোকটা আর কিছু না বলেই দরজা খুলে বাইরে চলে যায়। ঘরে আর কেউ নেই, শুধু মেইলস্ট্রোম।
ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। তার চোখে জ্বলছে তীব্র এক আগুন, ঠোঁটে জমে আছে শুষ্ক অথচ জেদি এক শব্দ। এক পা, এক পা করে জানালার ধারে এগিয়ে যায় সে। বাইরে অন্ধকার আকাশে কুয়াশার চাদর জমে আছে।
তার কণ্ঠে নিঃশ্বাসের মতো এক বেদনার ধ্বনি ফুটে উঠলো।
মেইলস্ট্রোম নিচু স্বরে বললো “সোলফ্লেম.. আমার সোলফ্লেম।”
তার কণ্ঠ ফেটে যায় তীব্র আবেগে। এক মুহূর্ত থেমে মাথা নিচু করে হাসে—না, সেটি হাসি নয়, কিছুটা র*ক্ত-গরম করা উন্মাদনা।
“তুমি জানো না, মেইলস্ট্রোম কে? তুমি যদি আগুন হও, আমি সেই আগুনে পুড়বো না—আমি সেটাকে নিজের মধ্যে ধারণ করবো। তুমি আমার র*ক্তে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছো। তুমি আমার হবেই হবে, ইচ্ছে করো বা না করো। ভালোবাসা দিয়ে… না হয় শক্তি ক্ষমতাদিয়ে—তবু আমি তোমাকে আমার করবোই। এই শহরের সব আলো যদি নিভেও যায়, তাও আমি তোমায় খুঁজে বের করবো। কারন তুমি আমায় “ডিজায়ার আনলিশড”।
তার চোখে ঝলকে ওঠে এক বিভীষিকাময় স্পষ্টতা। মানবী তার প্রেম, তার পাগলামি—আর তার মালিকানা। জানালার কাঁচে সে একবার ছুঁয়ে দেয় হাত। বাইরে বৃষ্টির শব্দ ভেসে আসে।
.
.
.
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ভবন – প্রফেসর মাহবুবের কক্ষ।
সূর্যের আলো জানালার পর্দা ঠেলে কক্ষে ঢুকছে। বইয়ের গন্ধ মিশে আছে পুরনো কাঠের তাক আর চেয়ারের মাঝে। কক্ষে এখন তিনজন—প্রফেসর মাহবুব, তান্বী, আর তার বড় বোন এলিনা।
প্রফেসর মাহবুব কাঁধে হাত রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার বোন জানো তো, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী হিসেবে তার এই আচরণ কতটা অনুচিত? মিডিয়াতে পর্যন্ত খবর হয়েছে—একজন মাফিয়াপ্রভাবিত লোকের গাড়ির কাচ ভেঙে দিয়েছে!”
এলিনা উত্তরে শান্ত গলায় বললো, “স্যার, ও খুব ইমোশনাল। কিন্তু আমি ওর সাথে কথা বলব এই নিয়ে। দয়া করে ওকে আরেকটা সুযোগ দিন।”
প্রফেসর মাথা নেড়ে বললেন, “সুযোগ তো দিয়েছি কয়েকবার।তবে তোমার দায়িত্বও কম না, এলিনা। তুমি ওর অভিভাবকের মতো।”
তারপর স্যার এক দৃষ্টি তান্বীর দিকে দিয়ে বললো “এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। নাহলে বাইরের দুনিয়া তোমায় শেষ করে ফেলবে, তুমি এখন ও বাইরের জগৎ চিনতে পারোনি তান্বী সেটা কতটা ভয়ানক।”
.
.
.
.
.
ক্যাম্পাস গেটের সামনে একটি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। তান্বী চুপচাপ, মাথা নিচু করে বসে আছে রিক্সায়। আর এলিনা গম্ভীর মুখে তার পাশে বসলো উঠে।
রিকশা চলতে শুরু করলে, এলিনা গলা নিচু করে বলল, “তানু, তুই কেন এসব করিস বল তো? আমি জানি, তুই অন্যদের জন্য এসব করিস—তুই অন্যায়ের প্রতিবাদ করিস—কিন্তু এসব করলে শেষ পর্যন্ত তোর বিপদ হবে। বুঝিস না?”
তান্বী মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো।
এলিনা আবার বলল, “তুই জানিস না আমাদের বাবা কেমন, ফারহান ভাইয়া কেমন। তারা তোর জন্য কত স্বপ্ন দেখেছে। এত কষ্ট করে তোকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলেছে, তুই চান্স পেয়েছিস এত কষ্ট করে।আর এখন তুই এভাবে চললে কী হবে?”
রিকশার চাকা ধীরে ধীরে ঢাকার ভিড় ঠেলে এগোতে থাকলো। এলিনা আবার ও বললো “তুই জানিস না, বাবা আর ভাইয়া তোকে বিয়ে দিতে চায় না এখন কারন তারা চায় তুই ক্যারিয়ার গড়, সম্মান পাস। এমন ভালো ভালো সম্বন্ধ আসছে তোর জন্য তাও তারা তোকে পড়াতে চাইছে। আর তুই এসব করলে—সব ভেসে যাবে, তানু। বুঝিস না?”
তান্বী এবার আস্তে বলল, “বুঝি আপা… কিন্তু অনেক কিছু না বললে চলে না… কেউ না বললে অন্যায়রা বাড়তেই থাকবে এই শহরে।”
এলিনা চুপ করে গেলো তারপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছোট বোনের দিকে। হয়তো রাগের বেশি মমতা, ভয় আর আশা মিশে থাকে তার চোখে। রিকশাটা চলতেই থাকে ঢাকা শহরের ভিড় ঠেলে।
.
.
.
.
রেহেমান প্রিয়াঙ্গন –পুরান ঢাকার এক খণ্ড শান্তির নীড়। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি গলির ভেতর, শত কোলাহলের মাঝেও একটুখানি নীরব নিঃশ্বাস ফেলার মতো জায়গা “রেহেমান প্রিয়াঙ্গন”। নামটা যেন নিজেই একটি কবিতা, একটি নরম স্মৃতির আলপনা।
ছোট্ট, দু’তলা বাড়িটি বাইরে থেকে খুব জমকালো না হলেও, ভেতরে পা রাখলেই বোঝা যায়—এ বাড়িতে ভালোবাসা থাকে, শৃঙ্খলা থাকে, আর থাকে হাজারটা ছোট ছোট গল্প।
ঘরের বাইরের বারান্দাটা লোহার গ্রিল ঘেরা, আর সেখানেই ঝুলছে কত রঙের ফুলের টব—রঙ্গন, বেলি, জুঁই, গাঁদা, মধুমালতী… যেন এই ছোট বাড়িটাকেই সাজিয়ে রেখেছে কেউ বড় যত্নে। একপাশে একটা টিনের ছাউনি দেওয়া চৌকি, যেটা তান্বীর বাবা বিকেলে বসে চা খায় আর খবরের কাগজ পড়ে। এলিনা অনেক সময় এখানেই বসে পড়ে বিকেলে, আর তান্বী আঁকে তার খাতা ভর্তি স্বপ্ন।
ভেতরের দেয়ালগুলো হালকা হলুদ রঙের, কিছু জায়গায় পুরোনো দাগ, তবুও ঝকঝকে পরিষ্কার। বসার ঘরে শোকেসে সাজানো পুরনো কাঁচের গ্লাস আর মা-এর বিয়ের সময়ের কিছু মাটির পুতুল। দেয়ালে টানানো ফারহান ভাইয়ার সম্মাননা সার্টিফিকেট আর বাবা-মার সাদাকালো বিয়ের ছবি।
দোতলায় উঠে গেলে ছোট্ট একটা ছাদ, আর ছাদের এক কোণে রয়েছে এলিনার লাগানো তুলসী গাছ। তান্বীর নিজের হাতে বানানো একটা কাঠের টুল ওখানেই রাখা, যেখানে বসে সে বিকেলে গান গায় বা আকাশ দেখে।
“রেহেমান প্রিয়াঙ্গন” বাড়িটা যেন পুরান ঢাকার বুকের ভিতর এক টুকরো স্বপ্নের মতো — সরল, স্নিগ্ধ আর আপন।
তখন রাত প্রায়। ঘরের ভিতর সাজানো টেবিল। ধুপধাপ শব্দে থালা-বাটি রাখা হচ্ছে। এলিনা, তান্বীর মা, বাবা আর বড় ভাই ফারহান সবাই বসে গেছে ডাইনিং টেবিলে। তান্বী পাশে বসেই চুপচাপ খাচ্ছে। আলগা আলোয় ফারহানের মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সে আজও অফিস থেকে দেরিতে ফিরেছে।
তান্বীর বাবা কাশি দিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলেন,
“আজ একটা ভালো খবর আছে,” — তিনি কাঁঠালের বিচির তরকারি তুলে নিতে নিতে বললেন, “এলিনার জন্য এক বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ এসেছে।”
ঘরের সবাই থেমে গেল। তান্বীর মা মুখ তুলে তাকালেন মেয়ের দিকে।
“বিয়ের প্রস্তাব?” — ফিসফিস করে বললো এলিনা। তার কণ্ঠে একটা চাপা ভয়ের ছোঁয়া।
বাবা মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ।ছেলেটা কানাডা থেকে মাস্টার্স করে এসেছে, এখন ঢাকায় একটা বড় প্রজেক্টে কাজ করছে। কিন্তু ওর পরিবার থেকে চাচ্ছে বিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে, বড় করে করতে হবে। অনেক খরচ হবে…”
মা একটু চিন্তিত স্বরে বললেন “এই অবস্থায় এত বড় খরচ আমরা কেমনে করবো? তান্বীর পড়াশোনা, ফারহানের চাকরি—সব মিলিয়ে চলাটা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে…”
ফারহান তখন চামচ নামিয়ে বলল, “তোমরা কোনো চিন্তা করো না, আব্বা, আম্মা।তোমরা শুধু বিয়ের ব্যবস্থা করো। এলিনার ভাই এখনো বেঁচে আছে। আমার বোনের বিয়ে আমি ধুমধাম করেই দিবো।”
বাবা চোখ তুলে তাকালেন ছেলের দিকে। কণ্ঠে সংশয়,
“কিন্তু তুই তো একটা সামান্য চাকরি করিস ফারহান, এটা দিয়ে কিভাবে সম্ভব?”
ফারহান একটু হেসে বলল,“আমার বস খুব ভালো মানুষ। আমি চাইলে উনি আমাকে লোন ম্যানেজ করে দিবেন। বিশ্বাস রাখো, আমি পারবো। কিছু না কিছু উপায় হবেই। শুধু এলিনার মুখে যেন হাসি দেখতে পাই আমি।
মা তখন আদুরে কন্ঠে বললো “বড় ছেলে হইছিস, আজ আবার সেটার প্রমাণ দিলি।”
তান্বী চুপচাপ বসে আছে, কিছু বলছে না।এক মুহূর্তের নীরবতা। বাইরে বাতাসে জানালার পর্দা নড়ে উঠলো। ঘরের ভিতর কেউ কিছু বললো না, কিন্তু তান্বীর মনে হলো—ফারহানের কথাগুলো ঘরের দেয়াল ছুঁয়ে যেন একধরনের আশ্বাস ছড়িয়ে দিলো।
.
.
.
.
একটি পুরনো পরিত্যক্ত গুদামঘর।য়ঘরের ভেতর আধো অন্ধকার। মাথার উপরে একটা হলকা লাল বাতি জ্বলছে নিঃশব্দে। দেয়ালের এক পাশে বিশাল একটা মানচিত্র টাঙানো, যেখানে কিছু জায়গা চিহ্নিত করা, লাল কালিতে গোল করে ঘেরা। গুদামের মেঝেতে ধোঁয়া উড়ছে—সিগারেটের ধোঁয়া।
রিকার্দো বসে আছে চামড়ার একটা ঘুর্নায়মান চেয়ারে। তার সামনে টেবিলের উপর ছড়ানো কিছু ছবি, কিছু মেয়ের পাসপোর্ট, এবং কয়েকটি মোবাইল ফোন। সে ধীরে ধীরে একটা সিগারেট ধরায়।
তার ডানপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ফিসফিস করে বলে—”এই দলটা মিরপুরের নতুন ক্লাব থেকে তোলা, মালদ্বীপ হয়ে পাঠানো যাবে। ডকুমেন্টস রেডি। শুধু ট্রান্সফার টা বাকি।”
রিকার্দো চোখ সরু করে বললো”এইবার আমি চাই কাজটা নিখুঁত হোক। কোনো নাম, কোনো ছায়া যেন না পড়ে। এবার একটু ভিন্নভাবে করব।”
সে উঠে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে মানচিত্রের কাছে যায়। এক জায়গায় আঙুল রেখে বললো “এই রুট দিয়ে পাঠাব। কক্সবাজার থেকে সামুদ্রিক পথে। বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের নজর এখন ঢাকার দিকে, তাই সী-বর্ডার কম ঝুঁকিপূর্ণ।”
রিকার্দো আবার ও ঠাণ্ডা গলায় বললো “এইবার ফারহানকে দায়িত্ব দেবো। ছেলেটা অনেক ট্যালেন্টেড, মাথা খাটিয়ে কাজ করতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা—ওর মুখোশ কেউ পড়তে পারে না। এমন একজনকেই লাগবে এখন।”
লোকটা একটু দ্বিধায় বললো “কিন্তু স্যার, ফারহান তো শিক্ষিত ছেলে। অনেকেই বলে ওর ভেতর এখনও মানবতা আছে…”
রিকার্দো হো হো করে হেসে বললো “মানবতা? হাহ! টাকা আর ক্ষমতার গন্ধে সবচেয়ে পবিত্র লোকও নষ্ট হয়ে যায়। আমি জানি, ফারহান রাজি হবে। ওর চোখে একটা ক্ষুধা আছে। আর ক্ষুধার জায়গাটা যদি আমি ভরে দিতে পারি… বাকিটা ও নিজেই করে নেবে।”
রিকার্দো সিগারেটের শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
রিকার্দো পুনরায় নির্দয় গলায় বললো “আগামী শুক্রবার রাতে, ওক ডাকো। আমি নিজেই ওর সঙ্গে কথা বলবো। এই খেলার নতুন চালু হওয়া অধ্যায়টা ওকে দিয়েই শুরু করব।”
চলবে………..
(অনেকেই ইতিমধ্যে মেইলস্ট্রাম বানান পড়েছেন কিন্তু ওটা মেইলস্ট্রোম হবে।
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৪(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৩
-
ডিজায়ার আনলিশড গল্পের লিংক
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৬
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১
-
আযদাহা সব পর্বের লিংক
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২২
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৬
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৭