Golpo ডার্ক রোমান্স ডিজায়ার আনলিশড

ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২৩


ডিজায়ার_আনলিশড

✍️ সাবিলা সাবি
পর্ব -২৩

বাইরে মেক্সিকো সিটির ব্যস্ত রাস্তাঘাট। কিন্তু মার্তার অ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িংরুমে আজ এক গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস, যার লক্ষ্য কোনো রাজপ্রাসাদ দখল নয়, বরং এক কঠিন হৃদয়ের মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া। লুসিয়া ধপ করে সোফায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ফারহানের সেই পাথুরে চাহনি আর অবহেলা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

মার্তা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মেকআপ ঠিক করতে করতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা লুসিয়া, ফারহান আসলে ঠিক কেমন মেয়ে পছন্দ করে? কোনো ধারণা আছে তোর?”

লুসিয়া বিরস মুখে জানালার বাইরে তাকিয়ে উত্তর দিল, “কেমন মেয়ে আবার? বাঙালি মেয়েরা যেমন হয়। অনেকটা ওই ওর বোনের মতো—যার মধ্যে একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতা থাকবে।শান্ত, মায়াবী… আর সব সময় শাড়ি জড়িয়ে থাকবে। ফারহান বোধহয় আমার শর্ট ড্রেস আর এই রুক্ষ মেক্সিকান মেজাজটা সহ্যই করতে পারে না।”

মার্তা ঘুরে দাঁড়িয়ে লুসিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “তাহলে তুইও সেটাই কর। একবার ওর মনের মতো হয়ে চেষ্টা করে দেখ না।”

লুসিয়া আঁতকে উঠে ঝামটা দিয়ে উঠলো, “কী বলছিস তুই! মার্তা, মেক্সিকোর কালচারে বড় হয়েছি আমি। এই জীবনে কোনোদিন ওসব শাড়ি-টাড়ি চোখেও দেখিনি ঠিকমতো। বাংলাদেশের ওই প্যাঁচানো পোশাক সামলানো কি আমার কাজ? জীবনেও পারবো না।”

মার্তা এবার লুসিয়ার পাশে এসে বসলো। তার কাঁধে হাত রেখে বুঝিয়ে বললো, “আরে একবার চেষ্টা করে দেখলেই তো হয়। শাড়ি পরে একটা ছবি ফারহানকে পাঠা। দেখ ও কী রিঅ্যাকশন দেয়। আম শিওর! ও অন্তত এটা বুঝবে যে, তুই ওর জন্য নিজের জাত-পরিচয় ভুলে ওর মতো হওয়ার চেষ্টা করছিস। ভালোবাসার জন্য মানুষ কী না করে?”

লুসিয়া অনেকক্ষণ গুম মেরে বসে রইলো। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে নিচু স্বরে বললো, “কিন্তু শাড়ি কোথায় পাবো এই মুহূর্তে?”

মার্তা হেসে বললো, “সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।” সে সাথে সাথে ফোনের স্ক্রিনে আঙুল চালিয়ে অনলাইন থেকে একটা দামি ইন্ডিয়ান সিল্ক শাড়ি অর্ডার করে দিলো।

এক্সক্লুসিভ ডেলিভারি বলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মার্তার ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলো একটি শৌখিন পার্সেল। লুসিয়া পার্সেল খুলে বের করলো একটি গাঢ় খয়েরী বেনারসি সিল্কের শাড়ি। শাড়ির সোনালী সুতোর কাজগুলো বিকেলের আলোয় চিকচিক করছে। লুসিয়া শাড়িটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর ইউটিউব খুলে ‘How to wear a saree’ টিউটোরিয়াল দেখে যুদ্ধ শুরু করলো।

প্রায় এক ঘণ্টার কসরত, চার-পাঁচটা সেফটি পিন হারানো আর নিজের ওপর বিরক্তি প্রকাশের পর অবশেষে সে সফল হলো। যদিও শাড়ির কুঁচিগুলো সামলাতে গিয়ে লুসিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম, কিন্তু যখন সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, মুহূর্তেই তার সব বিরক্তি উধাও হয়ে গেল।
আয়নায় দেখা যাচ্ছে এক সম্পূর্ণ অন্য লুসিয়াকে। খয়েরী শাড়ির আঁচলটা তার ফর্সা কাঁধের ওপর দিয়ে যখন মেঝে ছুঁয়ে আছে, তখন তাকে মনে হচ্ছে কোনো প্রাচীন উপন্যাসের নায়িকার মতো। সে চোখে গাঢ় কাজল দিয়েছে, আর কপালে একটা ছোট্ট খয়েরী টিপ। হালকা গয়না আর উন্মুক্ত চুলের সেই সাজে লুসিয়া নিজেই নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইল।

লুসিয়া আয়নার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো “সত্যিই কি আমাকে অন্যরকম লাগছে? ফারহান কি আমাকে এভাবে দেখে একবারও থমকে দাঁড়াবে না?”

মার্তা পেছন থেকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে বললো, “অবিশ্বাস্য লুসিয়া! তোকে আজ অভাবনীয় সুন্দর লাগছে। একদম সেই বাঙালি বধূর মতো স্নিগ্ধতা ফুটে উঠেছে তোর মুখে। এবার জলদি একটা ছবি তোল আর পাঠিয়ে দে ফারহানকে। দেখি ওর হিমশীতল হৃদয় আজ গলে কি না!”

লুসিয়া বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিল। সে জানতো না, এই শাড়ি পরা ছবিটা পাঠাতে পাঠাতে ভিলা এস্পেরেন্জায় তার ভাইয়ের জীবনে প্রলয় শুরু হয়ে যাবে।

লুসিয়া অনেকগুলো অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুললো। কোনো ছবিতে তাকে মায়াবী দেখাচ্ছে, কোনোটিতে সে একটু লাজুক। বুক দুরুদুরু কাঁপুনির মাঝে সে ছবিগুলো ফারহানকে পাঠিয়ে দিল। প্রতিটি সেকেন্ড তখন তার কাছে ঘণ্টার মতো মনে হচ্ছে।

আধা ঘণ্টা পর দেখা গেল ফারহান মেসেজগুলো সিন করেছে। লুসিয়া ভাবল, হয়তো এবার কোনো প্রশংসা আসবে। হয়তো ফারহান বলবে, “তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।” কিন্তু দশ মিনিট পেরিয়ে গেলেও কোনো উত্তর এলো না। লুসিয়ার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ঠিক তখনই ফোনের স্ক্রিন জ্বলে উঠল। ফারহানের রিপ্লাই।

লুসিয়া কম্পিত হাতে মেসেজটা পড়ল: ফারহানের মেসেজ ছিলো “তুমি আমাকে হঠাৎ এসব ছবি কেন পাঠাচ্ছো? আর শাড়ি পড়েছ কেন? আর যেই জন্যই পড়ে থাকো না কেন, শোনো—এসব তোমার সাথে যায় না। তোমার অ্যাটিটিউডটাই বিদেশি কালচারের। তুমি যতোই দেশি কালচারের সাজতে চাও না কেন, তোমাকে একটুও মানাচ্ছে না। বিশ্বাস করো, তোমাকে একটুও মায়াবতী লাগছে না। অযথা এসব করা বাদ দাও।”

মেসেজটা পড়া মাত্রই লুসিয়ার চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল। এক মুহূর্তের মধ্যে তার সব স্বপ্ন, সব সাজগোজ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে নিজেরই অদ্ভুত আগন্তুক মনে হতে লাগল। সে ভেবেছিল এই খয়েরী শাড়ি হয়তো তাদের মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে আনবে, কিন্তু ফারহানের এই তীক্ষ্ণ কথাগুলো তার বুকটা বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধে গেল।

মার্তা পাশ থেকে মেসেজটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু লুসিয়া তার আগেই দ্রুত হাতে শাড়ির পিনগুলো খুলতে শুরু করল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শাড়িটা যেন এখন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরা কোনো অভিশাপ।

লুসিয়া কান্নাভেজা স্বরে বললো “ও ঠিকই বলেছে মার্তা। আমি মেক্সিকান লুসিয়া, আমি কোনোদিন মায়াবী বাঙালি মেয়ে হতে পারবো না। আমি কেন ওর জন্য নিজেকে বদলাতে গেলাম?”

লুসিয়া ঝাপসা চোখে শাড়িটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিল। শাড়ির সেই সোনালী কাজগুলো অবহেলায় পড়ে রইল ঘরের এক কোণে। ঠিক যেমনটা পড়ে আছে লুসিয়ার অবহেলিত ভালোবাসা।
.
.
.
.

মেক্সিকো সিটির সেই পিনপতন নীরবতা আজ বিষাক্ত বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে। ভিলা এস্পেরেন্জার ড্রয়িংরুমে যখন রায়হান এসে খবরটা দিল যে তান্বী নিখোঁজ, তখন জাভিয়ানের হাতের দামী Macallan 18-এর গ্লাসটা মার্বেল ফ্লোরে আছড়ে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। সেই ভাঙা কাঁচের শব্দের সাথেই যেন জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীর ভেতরের শেষ মানবিকতাটুকুও বিলীন হয়ে গেল। সে আজ আর কোনো প্রেমিক বা বিজনেস ম্যান নয়; সে এখন এক বিধ্বংসী আগ্নেয়গিরি।

কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শহরের গোপন কমান্ড সেন্টারে জাভিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে ডজনখানেক মনিটর। এয়ারপোর্টের প্রতিটি ইঞ্চি সিসিটিভি ফুটেজ তার নির্দেশে স্ক্যান করা হচ্ছে। জাভিয়ানের চোয়াল শক্ত, কপালে রাগের নীল ধমনীগুলো দপদপ করছে। হঠাৎ একটা স্ক্রিনে সে থমকে দাঁড়াল। জুম করা ফুটেজে দেখা গেল—কুয়াশার আড়ালে রানওয়ের শেষ প্রান্তে একটা ছাই রঙের প্রাইভেট জেট নিঃশব্দে ডানা মেলছে। মেইলস্ট্রোম তান্বীকে নিয়ে আকাশপথে পাড়ি জমিয়েছে।

জাভিয়ান তখন কর্কশ, নিচু বজ্রপাতের মতো আদেশের স্বরে বলল “রায়হান, এই মুহূর্তে গোটা মেক্সিকোর আকাশ এবং সমুদ্রসীমা সিল করে দাও। আমি চাই না ওই পাখিটা যেন সীমানা পার হতে পারে।”

রায়হান শিউরে উঠে বলল, “কিন্তু স্যার, আর্মি আর পুলিশের ক্লিয়ারেন্স লাগবে… সরকারি অনুমতি ছাড়া এটা—”

জাভিয়ান টেবিলে সজোরে ঘুষি মেরে বললো “আইন? অনুমতি? আমার তান্বীকে ওরা নিয়ে গেছে আর তুমি আমাকে আইনের কথা শোনাচ্ছ? সেনাবাহিনী থেকে ইনটেলিজেন্স—সবাইকে জানিয়ে দাও, জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী আজ যমরাজের ভূমিকায় আছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ওকে না পেলে এই শহর আমি জ্বালিয়ে ছারখার করে দেব!”

কয়েক মিনিটের ব্যবধানে বদলে গেল পুরো মেক্সিকোর মানচিত্র। সমুদ্রের বুক চিরে গর্জে উঠল শয়ে শয়ে কালো গানবোট, আর আকাশের বুক চিরে ডজন ডজন ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার সার্চলাইট দিয়ে অন্ধকার খুঁড়ে ফিরছে। সাধারণ মানুষ ভাবছে কোনো মহাযুদ্ধ লেগেছে, কিন্তু তারা জানে না—এই পুরো রণসজ্জা কেবল একজনের ‘ফিক্সেশন’-এর জন্য।

মেক্সিকোর আকাশ তখন ডজন ডজন ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের সার্চলাইটে ফর্সা হয়ে উঠেছে। জাভিয়ান নিজেই একটি হেলিকপ্টারের ককপিটে বসে ছিল, কানে হেডফোন, চোখে রাডারের সিগন্যাল। কিন্তু প্রতিটি সিগন্যাল যেন তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। মেইলস্ট্রোম অত্যন্ত ধূর্ত; সে মাঝ-আকাশেই রাডার ফাঁকি দিয়ে তার ছাই রঙের প্রাইভেট জেটটি বদলে অন্য একটি অচিহ্নিত বিমানে তান্বীকে সরিয়ে নিয়েছে বহু আগেই। আকাশপথে সিসিটিভি নেই, আর মেইলস্ট্রোমের এই চতুরতা জাভিয়ানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিল।
.
.
.

এক ঘন্টার মধ্যেই মেইলস্ট্রোমের বিলাসবহুল প্রাসাদের সামনে যখন জাভিয়ানের কালো ল্যান্ড রোভারটা সজোরে ব্রেক কষল, তখন বাতাসও যেন ভয়ে থমকে গেল। জাভিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলল “মেইলস্ট্রোম, তুই আমার ‘ফিক্সেশন’এ হাত দিয়েছিস। আজ তোর বাড়ি আমি শ্মশান বানাবো।”

গাড়ি থেকে নামার আগেই জাভিয়ানের হাতে গর্জে উঠল তার কাস্টমাইজড এম-ফোর রাইফেল। মেইলস্ট্রোমের ডজনখানেক সশস্ত্র গার্ড তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু জাভিয়ান আজ এক ক্ষুধার্ত দানব। বুলেটের পর বুলেট তাদের বুক চিরে দিল।প্রতিটি করিডোরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে, গার্ডদের হাড়গোড় গুঁড়িয়ে দিয়ে জাভিয়ান শেষ পর্যন্ত বাড়ির সেই বিশাল ডাইনিং হলে এসে পৌঁছালো।

সেখানে স্থির হয়ে বসে ছিলেন মেক্সিকোর আন্ডারওয়ার্ল্ডের সেই রহস্যময়ী মাফিয়া কুইন—ইসাবেলা মোরেলাস।

যাকে সবাই ‘মাফিয়া কুইন’ বলে চেনে, যার সাথে জাভিয়ানের সম্পর্কের শেকড় অনেক গভীরে পোতা।
চারপাশের গোলাগুলি আর আর্তনাদের মাঝেও তিনি পাথরের মতো বসে আছেন।

জাভিয়ান তার রক্তমাখা হাত দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা একটা দামী কাঁচের ফুলদানি আছড়ে ভাঙল। তার হাতের গানটা তখন লক্ষ্য করা ইসাবেলার দিকে।

জাভিয়ানের এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল, রক্তবর্ণ চোখ আর সেই ভারী নিশ্বাস পুরো ঘরে এক ভয়ংকর আতঙ্কের সৃষ্টি করল।

সে ধীরপায়ে ইসাবেলার একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তার গলার স্বর এখন অস্বাভাবিকভাবে শান্ত, কিন্তু সেই শান্ত স্বরে লুকিয়ে আছে প্রলয়ের গর্জন। সে ইসাবেলার চোখের দিকে তাকিয়ে একদম নিচু আর শীতল কণ্ঠে গর্জে উঠল—”Where is my girl?”

ইসাবেলা কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু জাভিয়ান তার বন্দুকের নলটা ইসাবেলার কপালে ঠেকিয়ে চিৎকার করে আবার বলল “আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। তোমার ছেলে আমার বুক থেকে আমার প্রাণ কেড়ে নিয়ে গেছে। বলো, মেইলস্ট্রোম কোথায় লুকিয়ে রেখেছে আমার তান্বীকে? যদি এক সেকেন্ডের ভেতরে উত্তর না পাই, তবে আজ এই বাড়ি তোমার রক্তে লাল হবে!”

জাভিয়ানের সেই রুদ্ররূপ দেখে বাড়ির দেয়ালগুলোও যেন কাঁপতে শুরু করল। তার সেই ‘ফিক্সেশন’ আজ তাকে এক মরণঘাতী খেলায় নামিয়ে দিয়েছে।

ইসাবেলা পাথরের মতো শান্ত চোখে জাভিয়ানের দিকে তাকালেন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তাঁর ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি। তিনি ধীর গলায় বললেন, “আমি জানি না মেইলস্ট্রোম ঠিক এই মুহূর্তে কোথায়। তবে সে কোথায় কোথায় থাকতে পারে, তার সম্ভাব্য লোকেশন লিস্ট আমি তোমাকে দিতে পারি।”

জাভিয়ান রাগে অন্ধ হয়ে বন্দুকের নলটা তাঁর কপালে আরও জোরে চেপে ধরে বললো “মিথ্যা! তুমি সব জানো। তোমার পেটে তোমার ছেলের সব খবর আছে। আমার সাথে খেলা করো না!”

ইসাবেলা এবার তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, “এমিলিও! ভুলে যেও না, আমিই তোমাকে প্রথম সতর্ক করেছিলাম যে মেইলস্ট্রোম ওই মেয়ের খোঁজ পেয়ে গেছে। আমার কথাতেই তুমি তড়িঘড়ি করে তাকে লুকিয়ে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছিলে। কিন্তু কপাল খারাপ জাভিয়ান… কো-ইনসিডেন্সিলি মেইলস্ট্রোম সেই একই প্লেনে ছিল তার নিজের অন্য এক মিশনের জন্য। সেখানে গিয়ে সে তান্বীকে দেখে ফেলে।”

জাভিয়ান স্তব্ধ হয়ে গেল। তার হাত থেকে বন্দুকটা যেন একটু আলগা হয়ে এল। তার মানে, সে যাকে বাঁচাতে চেয়েছিল, তাকে সে নিজেই বাঘের মুখে ঠেলে দিয়েছে?

ইসাবেলা তখন বললো “মেইলস্ট্রোম এখন আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই জাভিয়ান। সে এখন তার নিজের ‘প্যাশন’ আর ‘রিভেঞ্জ’ নিয়ে খেলছে। আমি তোমাকে লিস্টটা দিচ্ছি, কিন্তু মনে রেখো মেইলস্ট্রোমের আস্তানা থেকে ফিরে আসা সহজ নয়।”

জাভিয়ানের রক্তবর্ণ চোখ দুটোয় তখন অবিশ্বাসের ছায়া। সে বুঝল, এই খেলায় ঘুঁটি চালার আগেই সে হেরে বসে আছে। কিন্তু জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী হার মানার পাত্র নয়।

জাভিয়ান ঠান্ডা কন্ঠে বললো “লিস্টটা দাও। আর যদি তোমার কোনো ইনফরমেশন ভুল হয়, তবে মনে রেখো—এই বাড়িটা তোমার কবর হতে এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না।”

জাভিয়ান লিস্টটা ছিনিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তার চোখে তখন যুদ্ধের দাবানল। সে মেইলস্ট্রোমের প্রতিটি ডেন চুরমার করে হলেও তার তান্বীকে ফিরিয়ে আনবে। আজ মেক্সিকোর আকাশে কেবল রক্তের রং দেখা যাবে।
.
.
.
সমুদ্রের উত্তাল নীল জলরাশির ঠিক মাঝখানে এক নিঃসঙ্গ দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে ‘গ্রে শ্যাডো’ (Grey Shadow)। এটি কোনো সাধারণ রাজপ্রাসাদ নয়, বরং এক বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় খোদাই করা এক মরণঘাতী দুর্গ। দুর্গের দেয়ালগুলো আগ্নেয় শিলা আর ধূসর মার্বেলের এক অদ্ভুত মিশেল, যা দেখে মনে হয় পাথরগুলো যেন জীবন্ত মানুষের রক্ত চুষে এই বর্ণ ধারণ করেছে।

দুর্গের ভেতরে কোনো জানালা নেই। বাইরের পৃথিবীর আলো সেখানে প্রবেশাধিকার পায় না। ঘরের মেঝেগুলো স্বচ্ছ কাঁচের, যার নিচে গভীর নোনা জলে কিলবিল করছে বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপ আর কাঁকড়াবিছা। করিডোরের দেয়াল জুড়ে ঝোলানো মেইলস্ট্রোমের পূর্বপুরুষদের তৈলচিত্র; যাদের প্রত্যেকের চাহনিতে এক আদিম হিংস্রতা আর আধিপত্যের তৃষ্ণা। কৃত্রিম নীলচে আলোয় পুরো আবহাওয়াটা হাড়হিম করা এক বিষাদ বয়ে নিয়ে বেড়ায়।

তান্বীর যখন প্রথম জ্ঞান ফিরল, তখন তার মনে হলো সে কোনো কবরের অন্ধকারে শুয়ে আছে। মাথাটা অসম্ভব ভারী, চোখের মণি নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। নাকে ঝাপসা এক ক্লোরোফর্মের গন্ধ আর ভ্যাপসা এক ভয়ের ঘ্রাণ। সে অনুভব করল সে একটি বিশালাকার কাঁচের প্রকোষ্ঠের মাঝখানে শুয়ে আছে।

ধীরে ধীরে সব মনে পড়তে লাগল তার—সেই মেক্সিকো এয়ারপোর্টের বিশৃঙ্খলা, সেই ধূসর চোখের পাহাড়সম মানুষটা আর নাকে চেপে ধরা সেই রুমাল। তান্বী উঠে বসার চেষ্টা করতেই অস্ফুট এক আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার গলা দিয়ে।

ঘরের চারদিকের দেয়ালে বড় বড় সব ভিভারিয়াম (খাঁচা) সাজানো। আর সেই কাঁচের খাঁচাগুলোর ভেতরে কয়েকশো বিষধর বিচ্ছু আর সাপ একে অপরের ওপর কিলবিল করছে। হঠাৎ তান্বীর নজর পড়ল তার পায়ের কাছে। একটি বিশালকায় কালচে বিচ্ছু লেজ উঁচিয়ে তার পায়ের আঙুলের ঠিক কয়েক ইঞ্চি দূরে স্থির হয়ে আছে।

তান্বী চিৎকার করে বললো “বাঁচাও! কেউ আছ? দয়া করে আমায় এখান থেকে বের করো!”

ঠিক তখনই কক্ষের ভারী লোহার দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। অন্ধকারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সেই অপার্থিব অকল্পনীয় সুন্দর অথচ ভয়ংকর পুরুষ— মেইলস্ট্রোম। তার পরনে কালো ব্লেজার, গলায় দুলছে এক মোটা সোনালী চেইন, আর গালের সেই ক্রুশ চিহ্নটা কৃত্রিম আলোয় এক বিভীষিকাময় আভা ছড়াচ্ছে।

মেইলস্ট্রোম ধীরপায়ে এগিয়ে এল। তান্বীর সেই আকাশফাটানো আতঙ্ক তাকে স্পর্শও করল না। সে বরং নিচু হয়ে মেঝে থেকে সেই জীবন্ত বিষাক্ত বিচ্ছুটাকে খালি হাতে তুলে নিল। তান্বী অবিশ্বাসে পাথর হয়ে গেল যখন দেখল—মেইলস্ট্রোম নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সেই বিচ্ছুটাকে নিজের মুখে পুরে দিল। দাঁতের নিচে বিচ্ছুর শক্ত খোলস ভাঙার সেই ‘কড়মড়’ শব্দ তান্বীর স্নায়ু অবশ করে দিল। মেইলস্ট্রোমের ঠোঁটের কোণ দিয়ে কালো বিষাক্ত রস গড়িয়ে পড়ল।

এই বীভৎস দৃশ্য দেখে তান্বী আর নিজেকে সামলাতে পারল না; পাকস্থলী উল্টে এক প্রবল বমি করে সে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। মেইলস্ট্রোম তখন উন্মত্ত পশুর মতো তার কোমর থেকে রিভলবার বের করল। কান ফাটানো শব্দে একের পর এক গুলি চালিয়ে সে চারপাশের ভিভারিয়ামগুলো চুরমার করে দিল। কাঁচের টুকরো আর মৃত সরীসৃপের মাঝে ঘরটা এক শ্মশানে পরিণত হলো।

তান্বী কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করল, “কে আপনি? কেন আমাকে এখানে পশুর মতো আটকে রেখেছেন কি চান আপনি?”

মেইলস্ট্রোম তার রক্তমাখা ঠোঁটে এক বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলল। সে তার আসল পরিচয়—বাংলাদেশের সেই মাফিয়া যার গাড়ির কাঁচ তান্বী ভেঙেছিল—তা গোপন রেখে এক সুনিপুণ মিথ্যা সাজাল।

“তোমাকে এখানে আনার কারণ কঠিন কিছু নয় তান্বী, বরং প্রতিহিংসা। তোমার একটাই দোষ—তুমি জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী-র স্ত্রী।”

তান্বী থমকে গেল। মেইলস্ট্রোম আরও কাছে এগিয়ে এসে তার চিবুকটা শক্ত করে ধরে বললো “জাভিয়ান এমন এক মানুষ, যে গত কয়েক বছরে আমার বহু নারীকে নিজের বিছানায় তুলে নিয়েছে। সে এক চরম চরিত্রহীন লম্পট। তাই আমি ঠিক করেছি, তার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ—তার পারমানেন্ট নারীকে আমি আমার করে নেব।”

তান্বীর হৃদয়টা মুহূর্তের মধ্যে শতখণ্ড হয়ে গেল। জাভিয়ান তাকে মায়া থেকে মুক্তি দিয়েছিল বলে সে ভেবেছিল, কিন্তু এখন জানল জাভিয়ান আসলে এতটাই নিচ আর চরিত্রহীন? মেইলস্ট্রোম তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল—”আমার আর জাভিয়ানের মধ্যে একটা অলিখিত নিয়ম আছে তান্বী। আমার যা পছন্দ আমায় জিনিস সেটা জাভিয়ান হাত বাড়ায় তার করে নেয় আর জাভিয়ান যা কেনে বা পছন্দ করে, আমার চোখ ঠিক সেখানেই পড়ে। আর যা জাভিয়ানের একান্ত নিজস্ব, তা কেড়ে নেওয়াতেই আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।”

তান্বী অঝোরে কাঁদতে লাগল। সে বুঝতে পারল না সে কার ওপর বেশি ঘৃণা করবে—তাকে বন্দি করা এই মেইলস্ট্রোমকে, নাকি তার বিশ্বাস ভেঙে দেওয়া সেই চরিত্রহীন জাভিয়ানকে।

তান্বী মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। মেইলস্ট্রোমের সেই ভয়ংকর অপবাদগুলো তার কানে তীরের মতো বিঁধছিল। সে ধরা গলায় চিৎকার করে বলল— “আমাকে ছেড়ে দিন! আপনি ভুল করছেন। আমি ওনার কোনো পারমানেন্ট নারী নই। জাভিয়ানের সাথে আমার কেবল একটা ডিল বা চুক্তি ছিল। উনি আমাকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন, এমনকি হয়তো খুব শীঘ্রই আমাকে ডিভোর্সও দিয়ে দেবেন। আমি ওনার কেউ নই!”

মেইলস্ট্রোম এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল, তারপর হঠাৎ এক বিকট অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সে ধীরলয়ে হাততালি দিতে দিতে তান্বীর চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে বললো “ওয়াও! গ্রেট! তান্বী, তুমি তো আমার কাজটা আরও সহজ করে দিলে। সে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে? তাহলে তো তোমাকে আমার করে নিতে আর কোনো আইনি বা নৈতিক বাধাই রইল না। জাভিয়ান যেটা ছুড়ে ফেলে দেয়, সেটা কুড়িয়ে নিয়ে হীরা বানিয়ে রাখাটাই মেইলস্ট্রোমের নেশা।”

মেইলস্ট্রোম হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। তার ধূসর চোখে ফুটে উঠল এক আদিম আধিপত্য। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তার ছায়াসঙ্গী গার্ডদের দিকে ইশারা করে আদেশ দিলো “এই ঘরটা এখনই পরিষ্কার করো। এখানে কোনো বিচ্ছুর চিহ্ন যেন না থাকে। আর শোনো, এই মেয়েটিকে পাশের ভিআইপি স্যুইটে নিয়ে যাও। একে সুন্দর করে ক্লিন করে দামী পোশাক পরিয়ে দাও। আজ রাতে গ্রে শ্যাডো-তে এক বিশেষ উৎসব হবে।”

তান্বী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু মেইলস্ট্রোমের দীর্ঘদেহী নারী রক্ষীরা তাকে একরকম পাঁজাকোলা করে নিয়ে গেল।

করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় তান্বী দেখল, এই বাড়িতে কোনো জানালা নেই। কেবল ধূসর দেয়াল আর কৃত্রিম আলো। প্রতিটি কোণে সিসিটিভি ক্যামেরা আর সশস্ত্র প্রহরী। দেয়ালে টাঙানো মেইলস্ট্রোমের পূর্বপুরুষদের ছবি, যাদের সবার চোখ মেইলস্ট্রোমের মতোই শীতল ও ধূসর।

আধঘণ্টা পর। ‘গ্রে শ্যাডো’র হিমশীতল পাথুরে দেয়ালের আড়ালে তান্বীকে একরকম জোর করেই গোসল করানো হলো। মেইলস্ট্রোমের দীর্ঘদেহী নারী রক্ষীরা যান্ত্রিক হাতে তার শরীরের ধুলো আর ক্লান্তি ধুয়ে দিলেও, মনের ওপর জমে থাকা বিষাদের মেঘগুলো সরাতে পারল না। তারা তান্বীর শরীরের ওপর চাপিয়ে দিল রক্তবর্ণের এক দামী সিল্কের গাউন। সিল্কের সেই মসৃণ স্পর্শও আজ তান্বীর চামড়ায় আগুনের মতো বিঁধছে।

বিশাল এক সোনালী ফ্রেমের আয়নার সামনে দাঁড় করানো হলো তাকে। আয়নায় নিজের পাণ্ডুর, রক্তহীন মুখটা দেখে তান্বী শিউরে উঠল। তার মনে হলো, সে জাভিয়ানের সাজানো সোনার খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে এখন এক অন্ধকার পাথুরে নরকে এসে আছড়ে পড়েছে। কিন্তু শরীরের এই বন্দিত্বের চেয়েও তার হৃদয়ে এখন সহস্র গুণ বেশি রক্তক্ষরণ হচ্ছে মেইলস্ট্রোমের দেওয়া সেই বিষাক্ত তথ্যে। জাভিয়ান কি সত্যিই এতোটাই চরিত্রহীন? এই প্রশ্নটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

তান্বী আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের চোখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করতে লাগল, “জাভিয়ান… তবে কি ওই মায়াবী চাহনি, ওই আগলে রাখা—সবই ছিল নিপুণ অভিনয়? তুমি কি সত্যিই আমাকে স্রেফ একটা ব্যবসায়িক ‘ডিল’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলে?”

মেইলস্ট্রোমের সেই পৈশাচিক কথাগুলো তার কানের কাছে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে ভাবতে পারছে না যে জাভিয়ান, যার বুকে মাথা রেখে সে এক চিলতে আশ্রয়ের স্বপ্ন দেখেছিল, সে আসলে মেইলস্ট্রোমের মতো মানুষের সাথে নারীদের নিয়ে এক নোংরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

তান্বী মনে মনে বললো “আমি কি তবে এক মিথ্যে মরীচিকার পেছনে নিজের সর্বস্ব হারিয়েছি? যাকে আমার মুক্তিদাতা ভেবেছিলাম, সে কি তবে অন্য কোনো নারীর দীর্ঘশ্বাসের কারণ? মেইলস্ট্রোম যদি সত্যি বলে থাকে, তবে তোমার দেওয়া ওই স্বাধীনতার চেয়ে এই বন্দিত্বই বোধহয় আমার পাওনা ছিল।”

তার চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সেই দামী গাউনের ওপর। যে মানুষটার জন্য সে মেক্সিকো ছাড়ার সময় বুকফাটা আর্তনাদ করছিল, এখন সেই মানুষটার নাম নিতেও তার ঘৃণা হচ্ছে। বিশ্বাসের সেই বিশাল পাহাড়টা আজ এক মুহূর্তের ঝড়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেল।
.
.
.
.
কয়েক ঘন্টার মধ্যেই গ্রে শ্যাডো’ ক্যাসেলের একটি গোপন মেডিকেল উইংয়ে এখন সাজ সাজ রব। মেইলস্ট্রোম একটি সাদা বিছানায় শুয়ে আছে, তার মুখমণ্ডল এখন ফ্যাকাশে থেকে নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। তার শরীরের শিরদাঁড়া দিয়ে এক তীব্র যন্ত্রণার কম্পন বয়ে যাচ্ছে। চারপাশে অত্যাধুনিক সব লাইফ সাপোর্ট মেশিন বসানো।

মেইলস্ট্রোমের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ড. ভিল সজোরে তার নাড়ি পরীক্ষা করছেন। তিনি জানেন, মেইলস্ট্রোম যে বিচ্ছুটি খেয়েছে সেটি ছিল মেক্সিকোর সবচেয়ে বিষধর ‘ব্ল্যাক ডেথ স্ক্রপিয়ন’। এই বিচ্ছুর এক ফোঁটা বিষ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্যারালাইজড করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

মেইলস্ট্রোমের শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বিচ্ছুর নিউরোটক্সিন বিষ তার স্নায়ুতন্ত্রের ওপর আক্রমণ করেছে, যার ফলে তার হৃদপিণ্ডের গতি বারবার ওঠানামা করছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সে এখনো বেঁচে আছে।

কেন সে মরল না?এর পেছনে রয়েছে মেইলস্ট্রোমের এক ভয়ংকর অতীত অভ্যাস। সে ছোটবেলা থেকেই এক বিশেষ পদ্ধতিতে তার শরীরে বিভিন্ন বিষধর প্রাণীর বিষ অল্প পরিমাণে প্রয়োগ করত (Mithridatism)।

বছরের পর বছর বিষের সাথে লড়াই করতে করতে তার রক্তে এখন এক ধরণের প্রাকৃতিক ‘অ্যান্টি-ভেনম’ তৈরি হয়ে গেছে। তার লিভার এই বিষ সহ্য করার মতো অস্বাভাবিক ক্ষমতা অর্জন করেছে। বিষ তাকে মেরে ফেলতে পারছে না ঠিকই, কিন্তু এক অসহ্য নরক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার রক্তে এখন লোহিত রক্তকণিকাগুলো ভাঙতে শুরু করেছে, যা তাকে তীব্র জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতেও মেইলস্ট্রোমের ঠোঁটে সেই অদ্ভূত হাসি।ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তার রক্ত থেকে বিষ দূর করতে। কিন্তু মেইলস্ট্রোম যেন কোনো এক ঘোরের রাজ্যে বিচরণ করছে। যন্ত্রণায় তার কপালে ঘাম আর রক্তের বিন্দু জমেছে, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে সেই রহস্যময় বিজয়ের হাসি।সে জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে বলতে লাগল—”তান্বী… দেখ… আমি বিষকেও আজঅমৃতের মতো হজম করে নিয়েছি। এই বিষ আমাকে মারতে পারবে? না… আমি মরব না। মৃত্যু আমাকে ছোঁয়ার সাহস পাবে না, কারণ আজ আমার কাছে আমার বহু মাসের সাধনা আছে… আজ আমার কাছে আমার তান্বী আছে।”

একজন চিকিৎসক মেইলস্ট্রোমকে শান্ত করার জন্য ইঞ্জেকশন দিতে গেলে সে এক ঝটকায় তাঁর হাত সরিয়ে দিল। তার ধূসর চোখ দুটো এখন রক্তবর্ণ, সেই চোখে অসহ্য যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও এক পৈশাচিক আনন্দ চিকচিক করছে।

মেইলস্ট্রোম অস্ফুট স্বরে বললো “এই তুচ্ছ বিষ আমার কী ক্ষতি করবে? যে হৃদয়ে মাসের পর মাস ধরে তান্বীকে পাওয়ার তৃষ্ণা বয়ে বেড়িয়েছি, সেই তৃষ্ণার আগুনের কাছে এই বিচ্ছুর বিষ তো নগণ্য। বিষ তো আমাকে নীল করতে পারে, কিন্তু আমার জয়কে তো আর কেড়ে নিতে পারবে না। আমি ওকে পেয়েছি… আমি মরে গিয়েও যদি ওকে নিজের করে রাখতে পারি, তবে সেই মৃত্যুও আমার কাছে জান্নাত।”

সে হাসপাতালের সাদা চাদরটা মুচড়ে ধরল। তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে, মেশিনগুলো উচ্চস্বরে বিপিং করছে, কিন্তু মেইলস্ট্রোমের কানে তখন কেবল তান্বীর সেই ভয়ার্ত চিৎকারের প্রতিধ্বনি বাজছে। সে অনুভব করতে চাইছে—এই প্রথম সে জাভিয়ান চৌধুরীকে এমন এক জায়গায় আঘাত করেছে, যে ক্ষত কোনোদিন শুকাবে না।

চিকিৎসকরা তাকে সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু অবচেতন মনেও মেইলস্ট্রোম যেন তান্বীর নাম উচ্চারণ করে যাচ্ছিল। তার কাছে এই শারীরিক যন্ত্রণা আজ এক পরম পুরস্কারের মতো মনে হচ্ছে, কারণ এই যন্ত্রণার ওপারেই সে তার বহু আরাধ্য তান্বীকে বন্দি করে রেখেছে।
.
.
.
তান্বীকে যখন ভিআইপি স্যুইট থেকে তার জন্য বরাদ্দ করা রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, করিডোর দিয়ে যাওয়ার পথেই তার চোখে পড়ল ওপেন-ডোর মেডিকেল ইউনিটের সেই বীভৎস দৃশ্য। রক্ষীদের কড়া পাহারার মাঝেই সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল।

ভিতরে তখন যমের সাথে লড়াই চলছে মেইলস্ট্রোমের। তান্বী দেখল, বিছানায় শুয়ে থাকা মেইলস্ট্রোমের শরীরটা বিষের নীলচে রঙে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ডাক্তাররা মরিয়া হয়ে তার মুখে অক্সিজেন পাইপ ঢোকানোর চেষ্টা করছে, আর প্রতিবার পাম্প করার সাথে সাথে তার মুখ ও নাক দিয়ে কালচে রঙের জমাট বাঁধা রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসছে। মেইলস্ট্রোমের শরীরটা যন্ত্রণায় ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে, কিন্তু তার চোখের সেই স্থির উন্মাদনা যেন এখনো তান্বীকে তাড়া করে ফিরছে।

তান্বী ভয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিল। তার আত্মা যেন খাঁচাবন্দি পাখির মতো ছটফট করতে লাগল।

তান্বী (মনে মনে) বললো “এই লোকটা মানুষ নয়! এ এক আদিম পিশাচ। যে অবলীলায় নিজের জীবন নিয়ে এভাবে পাশবিক খেলা করতে পারে, সে আমার মতো একটা মেয়েকে ছিঁড়ে খেতে দুবার ভাববে না। জাভিয়ান… জাভিয়ান হয়তো চরিত্রহীন হতে পারে, কিন্তু সে অন্তত এই লোকটার মতো এমন পৈশাচিক আর বিকৃতমনা ছিল না।”

মেডিকেল ইউনিটের সেই হুলুস্থুল কাণ্ড আর ডাক্তারদের ছোটাছুটি দেখে তান্বীর মনে এক পলকের জন্য পালানোর চিন্তা উঁকি দিয়ে গেল। সে চারদিকে তাকাল—হয়তো এই বিশৃঙ্খলার সুযোগে সে বের হতে পারবে। কিন্তু পরক্ষণেই তার সেই আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। করিডোরের প্রতিটি ইঞ্চি পাথুরে গার্ডদের দখলে। তাদের হাতের অত্যাধুনিক রাইফেল আর নিস্পৃহ চাহনি বলে দিচ্ছে—মেইলস্ট্রোম যদি মারাও যায়, তবে এই জীবন্ত কবর ‘গ্রে শ্যাডো’ থেকে তান্বীর লাশ ছাড়া আর কিছুই বের হতে পারবে না।

নারী রক্ষীরা তাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেল। তান্বী টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করল, “একজনের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আমি শয়তানের ডেরায় এসে পড়লাম। আল্লাহ, আমার কপালে আর কত লাঞ্ছনা বাকি আছে?”

সে যখন তার জন্য বরাদ্দকৃত বিলাসবহুল স্যুইট রুমে ঢুকল, তখন পেছনের ভারী দরজাটা এক অমোঘ শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। বাইরের সেই মরণ-চিৎকার ছাপিয়ে এখন এক নিস্তব্ধতা তাকে ঘিরে ধরল—যে নিস্তব্ধতা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।
.
.
.

মেক্সিকোর অন্ধকার জগতের ইতিহাসে এমন তাণ্ডব আগে কখনো কেউ দেখেনি। জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী আজ এক চলন্ত আগ্নেয়গিরি। ইসাবেলার দেওয়া লিস্টের প্রথম তিনটি আস্তানায় জাভিয়ান তার নিজস্ব কমান্ডো বাহিনী নিয়ে হানা দিয়েছে। একেকটি ডেন-এ সে যেন ঝড়ের মতো প্রবেশ করছে। বুলেটের গর্জনে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে, কিন্তু প্রতিটি আস্তানার শেষ প্রান্তে গিয়ে সে যা পাচ্ছে, তা হলো কেবল শূন্যতা।

মেইলস্ট্রোম অত্যন্ত সুকৌশলে তার প্রতিটি ঘাঁটি আগেভাগেই খালি করে দিয়েছে। জাভিয়ান যে কয়টি বাড়িতে হামলা চালিয়েছে, সেখানে কেবল লাশ আর পোড়া বারুদের গন্ধ ছাড়া তান্বীর কোনো চিহ্নই নেই।

তৃতীয় আস্তানায় জাভিয়ান লাথি মেরে একটা লোহার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। তার হাতে ধরা এম-ফোর রাইফেলটা তখনো উত্তপ্ত। মেঝেতে পড়ে থাকা শেষ গার্ডের মাথায় পা চেপে ধরে সে গলায় সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করল—”কোথায় সে? বল মেইলস্ট্রোম কোথায় লুকিয়ে আছে?”

গার্ডটি যন্ত্রণায় গোঙাতে গোঙাতে বলল, “জানি না… বস কাউকে কিছু বলেনি… সব জেট আর গাড়ি আলাদা আলাদা দিকে গেছে…”

জাভিয়ান এক মুহূর্ত দেরি না করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ট্রিগার টিপে দিল। তার সাদা শার্টে রক্তের ছিটেফেঁটা এখন জমাট বেঁধে গাঢ় লাল হয়ে গেছে। সে পাগলের মতো চারপাশের দামী সব আসবাবপত্র আর কাঁচের জাড় ভাঙতে শুরু করল। তার চোখের সেই ‘ফিক্সেশন’ এখন এক অন্ধ আক্রোশে রূপ নিয়েছে।

রায়হান পেছন থেকে দৌড়ে এসে তাকে থামানোর চেষ্টা করল।”স্যার! শান্ত হোন। লিস্টের এই জায়গাগুলোতে ও নেই। মেইলস্ট্রোম আমাদের বিভ্রান্ত করছে। সে হয়তো শহর থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে গেছে।”

জাভিয়ান রায়হানের কলার চেপে ধরে দেয়ালে আছড়ে ফেলল। তার কন্ঠস্বর এখন মানুষের নয়, কোনো হিংস্র পশুর মতো শোনাল।”শান্ত হব? আমার শরীরের প্রতিটি কোষ জ্বলছে রায়হান। মেইলস্ট্রোম আমাকে চেনে না। সে ভেবেছে লিস্ট দিয়ে আমাকে গোলকধাঁধায় রাখবে? আমি পুরো মেক্সিকো মাটি খুঁড়ে বের করব। যদি ও এই মাটির ওপর থাকে, তবে ওর রক্ত আজ আমি পান করব।”

জাভিয়ান পকেট থেকে তার ফোনটা বের করে স্পেশাল ইনটেলিজেন্স ইউনিটকে ডায়াল করল।”শোনো, মেক্সিকোর প্রতিটি স্যাটেলাইট সিগন্যাল ট্র্যাক করো। আমি চাই ওই ছাই রঙের জেটের প্রতিটি সেকেন্ডের মুভমেন্ট। যদি কোনো রাডার ডিসকানেক্ট হয়ে থাকে, তবে তার শেষ লোকেশন থেকে শুরু করে ৫০০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে যা কিছু আছে—সব স্ক্যান করো। আই ওয়ান্ট হার ব্যাক!”

সে বুঝতে পারছে, মেইলস্ট্রোম তাকে কেবল সময় নষ্ট করার জন্য এই লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জাভিয়ানের ভেতরের সেই বিধ্বংসী সত্তা এখন এক অন্য পরিকল্পনা করতে শুরু করেছে।

চলবে………..

(রিচেক করিনি তাই ভুলত্রুটি থাকলে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন। আর অবশ্যই বেশি বেশি রেসপন্স করবেন)

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply