ডিজায়ার_আনলিশড
✍️ সাবিলা সাবি
পর্ব নাম্বার ২২
ভিসার কাগজটা হাতে দেওয়ার পর জাভিয়ান যখন নিঃশব্দে নিজের রুমের উদ্দেশ্য চলে গেল, তান্বী তখন সেখানেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। হাতের সেই সামান্য কাগজের টুকরোটা যেন আজ হাজার মণ ভারী হয়ে উঠেছে। এই তো সেই মুক্তি, যার জন্য সে প্রতিদিন প্রার্থনা করেছে—তবে আজ কেন এই স্বাধীনতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে?
সেদিনের ডিনারের টেবিলটা ছিল একদম নিস্তব্ধ।জাভিয়ানের বাবা কিংবা পরিবারের অন্য কেউ জানত না যে ভেতরে ভেতরে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। জাভিয়ান একবারও তান্বীর দিকে তাকাল না, সে অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে খাবার শেষ করে উঠে পড়ল। তার এই নির্লিপ্ততা তান্বীর বুকে তীরের মতো বিঁধছিল। তান্বী মনে মনে ভাবল, “এতটাই সহজ? আমাকে বিদায় করে দেওয়াটা কি ওর কাছে স্রেফ একটা ডিল শেষ করার মতো?”
রাত গভীর হলো। ভিলার প্রতিটি কোণ আজ অদ্ভুত এক হাহাকারে ভরে উঠেছে। তান্বী তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সে জানত, এটাই এ বাড়িতে তার শেষ রাত। কাল এই সময়ে সে মেঘের ওপরে থাকবে, তার নিজের দেশে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, দেশের কথা ভেবে বুকটা আজ আর খুশিতে ভরে উঠছে না।
হঠাৎ সে দেখল বারান্দার অন্য প্রান্তে অন্ধকার কোণে একটা আগুনের ফুলকি জ্বলছে আর নিভছে। জাভিয়ান! সে এক হাতে গ্লাস আর অন্য হাতে সিগারেট নিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেই খুব কাছে, অথচ মাঝে যেন আলোকবর্ষের দূরত্ব।
জাভিয়ান অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়াচ্ছিল সেই কথাগুলো “তুমি আমার থেকে দূরে গেলেই আপাতত নিরাপদে থাকবে।” সে জানত, কাল থেকে এই বারান্দাটা শূন্য হয়ে যাবে। এই ভিলাটা আবার একটা প্রাণহীন অট্টালিকা হয়ে উঠবে। কিন্তু সে তাকে আটকে রাখবে না। তার শত্রুরা চারিদিকে জাল বিছিয়েছে, তান্বীকে কাছে রাখা মানেই তাকে বিপদে ফেলা। তার এই ‘বিদায়’ আসলে তান্বীর প্রতি তার চরম সুরক্ষাকবচ।
তান্বী সাহস করে জাভিয়ানের কাছে যেতে চাইল। সে কি একবার বলবে “আমি যেতে চাই না?” কিন্তু তার আভিজাত্য আর অভিমান তাকে আটকে দিল। সে শুধু দূর থেকে জাভিয়ানের সেই চওড়া পিঠ আর বিষণ্ণ ভঙ্গিটার দিকে তাকিয়ে রইল। জাভিয়ান একবারও ঘুরে তাকাল না, পিছন থেকে যদি তার চোখের সেই আবেগ তান্বী দেখে ফেলে।
পুরো রাতটা তারা কেউ ঘুমাল না। তান্বী তার সুটকেস গুছিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বারবার তার হাত থেমে যাচ্ছিল। প্রতিটি জামা, প্রতিটি জিনিস যেন এই বাড়ির স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে। ওদিকে জাভিয়ান তার ডেন-এ বসে রায়হানের সাথে শেষ মুহূর্তের প্ল্যানিং করছিল।
রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটতেই তান্বী বুঝতে পারল—আজকের সূর্যোদয় তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিচ্ছেদের বার্তা নিয়ে এসেছে। যে মুক্তির স্বাদ সে নিতে চেয়েছিল, আজ সেই মুক্তির স্বাদটা বড় বেশি তেঁতো লাগছে।
.
.
.
ভার্সিটির করিডোর আজ সকালের মিঠে রোদে ঝলমল করছে, কিন্তু লুসিয়ার মনের কোণে জমে আছে একরাশ মেঘ। ক্লাসের ফাঁকে সে ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণে বসে তার প্রাণের বান্ধবী মার্তাকে মনের সবটুকু জমানো কথা খুলে বলছে।
কণ্ঠস্বরে একরাশ বিষাদ নিয়ে বললো “জানিস, আমি নিজেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু ফারহানের প্রতি ওই ভালো লাগাটা কেন যেন দিন দিন আরও বাড়ছে। অথচ ফারহান… সে আমাকে স্রেফ এড়িয়ে চলে। আমার উপস্থিতি ওর কাছে কোনো পাত্তাই পায় না। ও আমাকে একদমই পছন্দ করে না রে!
লুসিয়ার চোখে জল চিকচিক করে উঠল। তার বান্ধবী মার্তা এটা সহ্য করতে পারল না। সে লুসিয়ার হাতটা চেপে ধরে বললো “অনেক হয়েছে! তুই এভাবে একা একা কষ্ট পাবি আর ও হিরো হয়ে ঘুরে বেড়াবে, তা হবে না। ওর নাম্বারটা দে তো আমাকে। আমি আজই মেসেজ করে বলছি যে তুই ওর সাথে দেখা করতে চাস। সরাসরি কথা বললে সব ঠিক হয়ে যাবে।“
লুসিয়া আতঙ্কিত হয়ে বললো “ না না মার্তা! একদম না। ও এমনিতে আমাকে সহ্য করতে পারে না, তুই মেসেজ করলে ও আরও বিরক্ত হবে। প্লিজ, এমন কিছু করিস না।“
লুসিয়া বারবার মানা করল, কিন্তু মার্তা শোনার পাত্রী নয়। সে লুসিয়ার চোখের সামনেই ফোন বের করে ফারহানকে মেসেজ পাঠিয়ে দিল— “ফারহান ব্রো, আমি লুসিয়ার ফ্রেন্ড,লুসিয়া আপনার সাথে খুব জরুরি কথা বলতে চায়। আজ বিকেলে কি দেখা করা সম্ভব হবে?”
মেসেজটা পাঠানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দেখা গেল ‘Seen’। লুসিয়ার বুক ধক করে উঠল। সে ভাবল হয়তো এবার কোনো উত্তর আসবে, হয়তো ফারহান বলবে কোথায় দেখা করতে হবে।
কিন্তু এক মিনিট… পাঁচ মিনিট… দশ মিনিট কেটে গেল। ফারহান মেসেজটা দেখে রেখে দিয়েছে, কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেনি। এই নিস্তব্ধতা যেন লুসিয়াকে করা সবচেয়ে বড় অপমান।
লুসিয়া রাগে আর অপমানে লাল হয়ে বললো “দেখলি তো? আমি বলেছিলাম না ও এমনই! সিন করে রেখে দিল, অথচ একটা রিপ্লাই পর্যন্ত দিল না? আমাকে কি ও এতটাই তুচ্ছ মনে করে?
লুসিয়ার ভেতরের সেই বিষাদ মুহূর্তেই তীব্র রাগে পরিণত হলো। ফারহানের এই অহংকার আর অবহেলা লুসিয়ার জেদকে আরও বাড়িয়ে দিল। সে মনে মনে ঠিক করল, এই অপমানের শোধ সে কোনো না কোনোভাবে নিয়েই ছাড়বে।
.
.
.
বিকেলের ম্লান আলোয় তান্বী ড্রয়িংরুমের সোফায় পাথরের মতো বসে আছে। তার চারপাশের বাতাস আজ বড্ড ভারী। বাড়ির সবাই যখন জানতে পারল যে আজ রাতেই তান্বী চলে যাচ্ছে, তখন পুরো বাড়িতে যেন এক অঘোষিত স্তব্ধতা নেমে এল।
জাভিয়ানের বাবা সায়েম চৌধুরী আর মিসেস কার্গো চৌধুরী হতভম্ব হয়ে তান্বীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। কারো কাছেই এই আকস্মিক সিদ্ধান্তের কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। জাভিয়ান অবশ্য অফিসে যাওয়ার আগে খুব স্বাভাবিক গলায় সবাইকে বলে গেছে, “তান্বী বেশ কিছুদিন হলো ওর বাবা-মাকে দেখে না, তাই ওকে কদিনের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি। বড় কোনো ব্যাপার না।”
কিন্তু বাড়ির সবার মনেই খটকা লেগেছে। জাভিয়ানের মতো মানুষ, যে তান্বীকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে চায় না, সে হুট করে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিল?
তান্বী লক্ষ্য করল, বাড়ির পরিচারিকারা পর্যন্ত ফিসফিস করছে। জাভিয়ানের বাবা এসে একবার তান্বীর মাথায় হাত রাখলেন, কিন্তু তান্বী তার চোখের জল আড়াল করতে দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলল। সে জানে, এই ‘কদিন’ আসলে ‘চিরকাল’। জাভিয়ান তাকে মুক্তি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই মুক্তির ভেতরে যে কতটা অবজ্ঞা আর ত্যাগের বিষ মিশিয়ে দিয়েছে, তা কেবল তান্বীই বুঝতে পারছে।
সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। জাভিয়ান অফিসে গেছে, বলে গেছিলো রাতে ফিরবে এবং নিজেই তাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। তান্বীর মনে হচ্ছে সময়টা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। সে কি জাভিয়ানের আসার জন্য অপেক্ষা করছে? নাকি সেই মুহূর্তটাকে ভয় পাচ্ছে যখন তাকে এই বাড়ি আর এই মানুষটার মায়া ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে হবে?
ওদিকে অফিসে বসে জাভিয়ান হয়তো ফাইলের স্তূপে মুখ লুকিয়ে নিজের ভেতরের দহন কমানোর চেষ্টা করছে। সে জানে, রাতে যখন সে বাড়ি ফিরবে, তখন তাকে তার জিন্নীয়া’কে নিজের হাতে তুলে দিয়ে আসতে হবে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে।
বাতাসে আজ বিচ্ছেদের সুর। তান্বী জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখছে গোধূলির আকাশটা আজ রক্তাক্ত লালের মতো লাগছে—ঠিক যেমনটা তার বুকের ভেতরটা আজ ক্ষতবিক্ষত।
.
.
.
বিকেলের নিস্তব্ধতা ভেঙে লুসিয়া যখন কাঁপা কাঁপা হাতে ফারহানকে ফোনটা করল, তার হৃদস্পন্দন তখন তার নিজের কানেই বাজছিল। রিং হতে হতেই ওপাশ থেকে ফারহানের সেই গম্ভীর অথচ শীতল কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
ফারহান নিরাসক্তভাবে বললো “হ্যালো?“
লুসিয়া খানিকটা থতমত খেয়ে জবাব দিলো “কেমন আছো ফারহান?“
ফারহানের দিক থেকে কোনো সৌজন্যবোধ প্রকাশ পেল না, বরং তার কণ্ঠে ঝরে পড়ল চরম বিরক্তি।সে বিরক্ত স্বরে বললো “কেমন আছি সেটা জানার জন্য তো তুমি ফোন করোনি। আসল কথাটা বলো, ফোন করেছ কেন?“
লুসিয়া দমে গেল না। সে নিজেকে শক্ত করে নিয়ে অত্যন্ত বিনম্র সুরে বলল “আসলে সেদিন আমাকে ওই অ্যালেক্সান্দ্রোর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। সেই কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যই ফোন করেছিলাম।“
লুসিয়া ভেবেছিল তার এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হয়তো ফারহানের বরফ শীতল মনকে কিছুটা গলাবে। কিন্তু ফলাফল হলো উল্টো। ফারহান এক মুহূর্ত চুপ থেকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল।সে বিদ্রূপের সুরে বললো “সিরিয়াসলি লুসিয়া? এতদিন পর তুমি এই সামান্য একটা কথা বলার জন্য আমাকে ফোন করেছ? আমার হাতে অত সময় নেই।“
এই কথাটুকু বলেই ফারহান কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে সজোরে ফোনটা কেটে দিল। ফোনের ওপাশে শুধু ‘টু-টু’ শব্দটা বাজতে থাকল। লুসিয়া স্তম্ভিত হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তার কৃতজ্ঞতাকে ফারহান শুধু অবহেলাই করেনি, বরং সেটাকে স্রেফ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। অপমানে লুসিয়ার চোখের কোণে আবার জল জমল, কিন্তু এবার সেই জলের সাথে মিশে আছে চরম এক জেদ।
.
.
.
অফিসের বিশাল কাঁচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে জাভিয়ান শেষবারের মতো নিজের ফাইলগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল। কক্ষজুড়ে এক ভারী নীরবতা। রায়হান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরেই দ্বিধায় ভুগছিল, অবশেষে সে মুখ খুলল। “স্যার, একটা কথা বলতাম। মিস গজদন্তিনীকে হুট করে এভাবে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?“
জাভিয়ান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তার চোখেমুখে একধরণের কৃত্রিম উদাসীনতা, যা সে খুব যত্ন করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। “কেন ঠিক হবে না? আমি তো বিয়েটা করেছিলাম স্রেফ বাবার চাপে পড়ে। নিজের স্বার্থের জন্যই ওই মেয়েটাকে এই নরকে টেনে এনেছিলাম। এখন আমার উদ্দেশ্য সফল, ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ওর তো একটা নিজস্ব জীবন আছে, রায়হান। সে কেন আমার শেকল পরে এখানে পড়ে থাকবে? ওকে ওর মতো বাঁচতে দাও, আমি ওকে মুক্তি দিচ্ছি।“
জাভিয়ানের কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব নির্লিপ্ত শোনালো, কিন্তু রায়হান তার বসের চোখের ভেতরের সেই দহনটা পড়তে পারল। সে এক পা এগিয়ে এসে খুব নিচু স্বরে বলল। “স্যার, অন্তত আমার সামনে মিথ্যা বলবেন না। আপনি ধরা খেয়ে যাচ্ছেন। আপনার এই মুখোশের আড়ালে কী চলছে, তা আমার চেয়ে ভালো কেউ বোঝে না। আপনি ওকে ভালোবাসেন বলেই নিজের বুক থেকে ছিঁড়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, কারণ আপনি চান না আপনার শত্রুরা ওর কোনো ক্ষতি করুক।“
জাভিয়ান মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সে তপ্ত দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল। “এতো বেশি বোঝা শরীরের জন্য ভালো নয়, রায়হান। আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটাই চূড়ান্ত। যাও, গাড়ি রেডি করো। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।“
জাভিয়ান দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রায়হান দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইল। সে জানে, জাভিয়ান নিজেকে যতই কঠোর দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন, আজ রাতের প্রতিটি সেকেন্ড তার জন্য বিষের মতো হবে। নিজের না বলা ভালোবাসাকে নিজে হাতে বিসর্জন দিতে যাওয়া কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ভিলার বাইরে কনকনে উত্তুরে হাওয়া বইছে, যা জানান দিচ্ছে শীতের প্রকোপ। জাভিয়ান ঠিক সময়েই বাড়ি পৌঁছাল। তার চেহারায় ক্লান্তি আর গাম্ভীর্যের মিশ্রণ। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই দেখল তান্বী তার লাগেজ নিয়ে প্রস্তুত।
ফ্লাইট রাত ৯টায়। হাতে আর একদমই সময় নেই। তান্বী একটা সাধারণ কামিজের ওপর পাতলা ওড়না জড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জাভিয়ান তার আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে শীতল অথচ সতর্ক গলায় বলল “বাইরে অনেক ঠান্ডা। মেক্সিকোর এই রাতগুলো সহ্য করার মতো নয়। যাও, ওপর থেকে ভারী কোনো ওভারকোট পড়ে আসো। মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়লে দেখার কেউ থাকবে না।”
তান্বী কোনো পাল্টা যুক্তি করল না। সে শেষবারের মতো নিজের রুমে গেল। দরজায় হাত রাখতেই বুকটা হু হু করে উঠল তার। এই রুমের প্রতিটি আসবাব, জানালার পর্দা, এমনকি বিছানার চাদরের ভাঁজেও যেন গত কয়েক মাসের অজস্র স্মৃতি লেপ্টে আছে। সে ধীরপায়ে আলমারি খুলে একটা ওভারকোট গায়ে জড়িয়ে নিল। চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল—যেন হৃদয়ে গেঁথে নিতে চাইছে এই শেষ দৃশ্যটুকু।
নিচে নামার আগে সে মার্কোর রুমে গেল। মার্কোর দিকে তাকিয়ে বললো “ভালো থাকবেন মার্কো ভাইয়া। নিজের যত্ন নিবেন।”
মার্কোর চোখে এক ধরণের জিজ্ঞাসা ছিল, কিন্তু তান্বী আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত নিচে নেমে এলো।নিচে ড্রয়িংরুমে তখন এক ভারী পরিবেশ। পরিবারের সবাই উপস্থিত। মিসেস কার্গো চৌধুরী এক কোণে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, তার অভিব্যক্তি বোঝা দায়। লুসিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখেমুখে ফারহানের দেওয়া অপমানের রেশ কাটেনি ঠিকই, কিন্তু তান্বীর চলে যাওয়াটা তাকেও কেন যেন একটু নাড়া দিচ্ছে।
জাভিয়ানের বাবা সায়েম চৌধুরী তান্বীর কাছে এগিয়ে এলেন। তার চোখে ছিল অপরাধবোধ আর মমতা।
সায়েম চৌধুরী: “মা, নিজের খেয়াল রেখো। জাভিয়ান বলেছে তুমি কয়েক দিনের জন্য যাচ্ছো। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।”
তান্বী কোনোমতে মাথা নিচু করে কান্না চাপলো। সে জানে, এই ফেরা আর কোনোদিন হবে না। জাভিয়ানের চাচা সাইফ চৌধুরীও শুকনো মুখে বিদায় জানালেন। জাভিয়ান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল। তার হাতে ধরা গাড়ির চাবিটা সে জোরে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরেছে, যেন নিজের ভেতরের কম্পন থামাতে চাইছে। “সময় হয়ে গেছে। চলো।”
এক নিদারুণ মৌনতা সঙ্গী করে তান্বী ভিলার সদর দরজা পেরিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়াল। পেছনে পড়ে রইল এক বিশাল অট্টালিকা আর কিছু অমীমাংসিত অনুভূতির গল্প।
.
.
.
গাড়িটা রাতের মেক্সিকো সিটির বুক চিরে এয়ারপোর্টের দিকে এগোচ্ছে। বাইরের সোডিয়ামের হলুদ আলো আর ল্যাম্পপোস্টের সাদা তীব্র আলো বারবার গাড়ির ভেতরটা আলোকিত করে তুলছে। সামনে ড্রাইভারের পাশে রায়হান বসে মোবাইলে ফ্লাইটের শেষ মুহূর্তের চেক-ইন নিয়ে ব্যস্ত। পেছনের সিটে জানালার ধারে তান্বী, আর তার পাশেই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে জাভিয়ান। জাভিয়ান জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, তার এক হাত মাঝখানের সিটের ওপর রাখা। হঠাৎ করেই গাড়ির একটা ছোট ঝাঁকুনিতে তান্বী ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। ঠিক সেই মুহূর্তে অজান্তেই তান্বীর হাতটা গিয়ে পড়লো জাভিয়ানের হাতের ওপর। স্পর্শটা লাগার সাথে সাথেই দুজনের শরীর দিয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। জাভিয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে তান্বীর দিকে তাকালো, আর ঠিক সেই মুহূর্তে ওপর থেকে একটা উজ্জ্বল আলো জাভিয়ানের মুখে এসে স্থির হলো।
তান্বী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জাভিয়ানের দিকে। ঠিক তখনই বাইরে থেকে একটা উজ্জ্বল আলো গাড়ির ভেতরে এসে পড়ল। সেই তীক্ষ্ণ আলোয় জাভিয়ানের ফর্সা মুখটা একদম স্পষ্ট হয়ে উঠল। আলোয় জাভিয়ানের মুখটা আজ যেন কোনো গ্রিক দেবতার ভাস্কর্যের মতো স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। তান্বীর নজর স্থির হলো জাভিয়ানের ডান পাশের নাকের ঠিক সেই ছোট্ট তিলটার ওপর—যা তার গাম্ভীর্যকে এক অদ্ভুত মায়ায় মুড়ে রেখেছে।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি তান্বীর বুক কাঁপিয়ে দিল জাভিয়ানের ঠোঁট জোড়া। পাতলা, চিকন আর নিখুঁত ‘লাভ শেইপ’ এর গোলাপী আভার সেই ঠোঁট। ঠিক সেই ঠোঁটের একটু নিচের দিকে একটা কালো কুচকুচে তিল। যা দেখে মনে হয় কোনো শিল্পী সাদা ক্যানভাসে খুব যত্ন করে এক ফোঁটা কালো কালি লেপে দিয়েছেন।
তান্বী মনের গভীরেই,মোহাবিষ্ট হয়ে বললো “একটা পুরুষের ঠোঁট এতোটা সুন্দর হয় কী করে? এই সেই ঠোঁট… যে ঠোঁট দিয়ে সেদিন ও আমাকে পাগলের মতো চুম্বন করেছিল। সেই উত্তাপ, সেই অধিকারবোধ কি সব মিথ্যে ছিল?”
জাভিয়ান কয়েক সেকেন্ডের জন্য তান্বীর চোখের গভীরতায় হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে নিল। তান্বী সেই ঠোঁটের বাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ,সে খুব ধীরলয়ে অথচ স্পষ্টভাবে নিজের হাতটা সরিয়ে নিল।
জাভিয়ানের হাত সরিয়ে নেওয়া মাত্রই তান্বীর হুশ ফিরল। তার মনে হলো, জাভিয়ান তাকে স্রেফ স্পর্শ করতেই চাইছে না। হাতটা সরিয়ে নেওয়ার এই ভঙ্গিটা তান্বীর বুকে কোনো ধারালো অস্ত্রের মতো বিঁধল।
তান্বী মনের গভীরে, তীব্র অভিমানে সে মনে মনে বললো “ও কি আমাকে এতটা অপছন্দ করে? একটা সাধারণ স্পর্শও কি ওর সহ্য হচ্ছে না? অথচ আমি এই মুখটার দিকে তাকিয়ে কত কী ভাবছিলাম!”
তান্বী অপরাধবোধ আর কষ্টে কুঁকড়ে গেল। সে দ্রুত নিজের হাত সরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। তার চোখের কোণটা আবার ভিজে উঠছে। সে ভাবছে, জাভিয়ান হয়তো সত্যিই তাকে আজ মন থেকে বিদায় করে দিয়েছে, অথচ সে এই মানুষটার ছোট ছোট খুঁটিনাটি জিনিসগুলোও ভুলতে পারছে না। জাভিয়ানের এই ‘নিস্পৃহভাবে হাত সরিয়ে নেওয়াটা’ তান্বীর বুকে কোনো বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধল।
জাভিয়ান আবার জানালার বাইরে মুখ ফিরিয়ে নিল, কিন্তু তান্বীর চোখের সামনে তখন কেবল সেই গোলাপী ঠোঁট আর তার নিচের কালো তিলটা ভাসছে। সে বুঝতে পারছে না, সে এই মানুষটাকে ঘৃণা করবে নাকি বিদায়বেলায় এই মায়ায় আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়বে।
বিচ্ছেদের ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে জাভিয়ানের এই অতিমানবিক সৌন্দর্য তান্বীর মুক্তির আনন্দকে পুরোপুরি বিষাদে রূপ দিল।
.
.
.
অবশেষে তারা এয়ার পোর্টে পৌঁছে গেলো। এয়ারপোর্টের উজ্জ্বল আলো আর হাজারো মানুষের ভিড়ের মাঝে তান্বীর মনে হচ্ছিল সে কোনো এক জনশূন্য মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে। লাগেজ নিয়ে সে যখন এন্ট্রান্স গেটের দিকে এগোচ্ছিল, তার পা যেন মাটির সাথে আটকে যাচ্ছিল।
প্রতিটি কদম ফেলার পর তান্বী বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। সে অবচেতনভাবে আশা করছিল, হয়তো জাভিয়ান দৌড়ে আসবে, তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলবে— “যেতে হবে না তান্বী, আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।” কিন্তু যতবারই সে ঘুরে তাকালো, দেখল জাভিয়ান গাড়ির পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে তাকে এক বিশাল পাথরের মূর্তির মতো লাগছিল। জাভিয়ান স্থির, অবিচল। তার দৃষ্টি তান্বীর ওপর নিবদ্ধ থাকলেও তাতে কোনো আকুতি ছিল না, ছিল কেবল এক গভীর, রহস্যময় নিস্তব্ধতা।
তান্বী বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে গেল। সিকিউরিটি চেক-ইন এর দিকে যাওয়ার সময় তার মনে হলো সত্যিই সব শেষ। ঠিক তখনই পেছন থেকে এক পরিচিত কণ্ঠের ডাক এল—”তান্বী!”
গম্ভীর, তীক্ষ্ণ সেই স্বর। তান্বীর হৃদস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। সে বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়ালো। তার মনের গহীনে একরাশ আনন্দ আর আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে ভাবল, জাভিয়ান তবে শেষ পর্যন্ত পারল না তাকে যেতে দিতে? সে কি তবে তাকে থামানোর জন্যই ডাকল? তান্বীর ঠোঁটে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠার আগেই জাভিয়ান তার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো।
জাভিয়ান তার পকেট থেকে একটা ছোট ভেলভেটের পাউচ আর একটা পাসপোর্ট সাইজ ফোল্ডার বের করল। জাভিয়ান খুবই স্বাভাবিক এবং নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো “তুমি তোমার অরিজিনাল বার্থ সার্টিফিকেট আর এই চেইনটা ড্রয়িংরুমের টেবিলে ভুলে ফেলে এসেছিলে। এগুলো ছাড়া তোমার সামনে সমস্যা হতে পারত।”
তান্বীর মুখের সেই চিলতে হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। এক নিমিষে তার সাজানো আশার প্রাসাদটা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সে স্তব্ধ হয়ে জাভিয়ানের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। জাভিয়ান তাকে থামায়নি, সে কেবল তার ফেলে আসা একটা জিনিসের অভাব পূরণ করতে এসেছে।
তান্বী মনের গভীরে, রক্তক্ষরণ হতে থাকা হৃদয়ে বললো “আমি ভাবলাম ও আমাকে ভালোবাসার টানে থামালো, অথচ ও এলো আমার ভুল শুধরে দিতে! আমার অস্তিত্ব কি ওর কাছে কেবল কিছু কাগজপত্রের মতোই মূল্যহীন?”
তান্বী কাঁপাকাঁপা হাতে জিনিসগুলো নিল। জাভিয়ান এক সেকেন্ডের জন্য তান্বীর চোখের দিকে তাকালো—সেই চোখে কী ছিল তান্বী বুঝতে পারল না। জাভিয়ান শুধু বলল, “নিজের খেয়াল রেখো। যাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
জাভিয়ান আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে গেটের বাইরে চলে গেল। তান্বী এবার আর পেছন ফিরে তাকালো না। তার চোখের অবাধ্য জলগুলো এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। সে বুঝে গেল, জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী তাকে সত্যিই বিদায় করে দিয়েছে।
.
.
.
বিমানের জানালার কাঁচের ওপারে মেক্সিকো শহরটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। নিচে জ্বলে থাকা হাজারো আলোকবিন্দু যেন জাভিয়ানের একেকটা স্মৃতি। তান্বী জানালার কপালে মাথা ঠেকিয়ে রাখল। তার বুকটা যেন কেউ আস্ত পাথর দিয়ে চেপে ধরেছে। প্রতিটা সেকেন্ডে মনে হচ্ছে, সে তার আত্মার একটা অংশ ওই শহরে ফেলে এসেছে।
তান্বী মনে মনে বললো “বিদায় জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী… বিদায় মেক্সিকো। তুমি আমাকে মুক্তি দিয়েছ ঠিকই, কিন্তু এই মুক্তির স্বাদ যে এতটা তেঁতো হবে, তা আমি কল্পনাও করিনি।”
ঠিক যখন সে বিষাদ কাটিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল, তখনই পুরো বিমানটা একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল। হঠাৎ লাউডস্পিকারে ক্যাপ্টেনের আতঙ্কিত কণ্ঠ ভেসে এল— “সবাই যার যার সিটে বসে পড়ুন! সিকিউরিটি অ্যালার্ট! বিমানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে!”
মুহূর্তের মধ্যে বিমানের ভেতরটা নরক হয়ে উঠল। কেবিনের পেছন দিক থেকে গুলির তীক্ষ্ণ শব্দ আর মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসছে। আধুনিক মেক্সিকোর দুই মাফিয়া গোষ্ঠী—মেইলস্ট্রোমের কমান্ডো আর ফিনিক্সের খুনিদের মধ্যে মাঝ-আকাশেই লড়াই শুরু হয়ে গেছে। যাত্রীরা ভয়ে সিটের নিচে কুঁকড়ে আছে, কেউবা চিৎকার করে কাঁদছে। তান্বী শুধু দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরল। সে কি এক জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে সরাসরি মৃত্যুর দুয়ারে এসে দাঁড়াল?
পাইলট দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। রানওয়ের কাছাকাছি থাকা একটি ছোট এয়ারপোর্টে বিমানটি আছড়ে পড়ার মতো ল্যান্ড করল। দরজা খোলা মাত্রই যাত্রীরা জীবন বাঁচাতে পাগলের মতো হুড়োহুড়ি করে নামতে শুরু করল। বাইরে তখনও চলছে ব্রাশ ফায়ার আর গ্রেনেড বিস্ফোরণের কান ফাটানো শব্দ।
তান্বী ভিড়ের চাপে পড়ে কোনোমতে বিমান থেকে নিচে নামল। ধোঁয়া আর ধুলোয় চারপাশ অন্ধকার। ঠিক তখনই করিডোরের এক প্রান্ত দিয়ে মেইলস্ট্রোম বিদ্যুবেগে ছুটে আসছিল। তার হাতে উদ্যত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, লক্ষ্য তার চিরশত্রু ফিনিক্স।
ভিড়ের তোড়ে তান্বী যখন একদিকে ছুটছিল, ঠিক তখনই বাঁকের মুখে তার সাথে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল পাহাড়সম কঠিন এক শরীরের। ধাক্কাটা এতটাই জোরালো ছিল যে তান্বী ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেল। তার হাতের ব্যাগটা দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল।
ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বিমানবন্দরের করিডোরে তান্বী যখন ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেল, তখন সময় যেন থমকে দাঁড়াল। সে ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে ওপরের দিকে তাকাতেই তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো।
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি মনে হলো কোনো অন্ধকার জগতের অপার্থিব ভাস্কর্য। লোকটির ঘাড় পর্যন্ত লম্বা গাঢ় বাদামী রঙের চুল, যা কপাল ছাপিয়ে তার চোখের ওপর এসে পড়ছে। সেই অবাধ্য চুলের আড়ালে জ্বলজ্বল করছে একজোড়া গাঢ় ধূসর (Deep Grey) রঙের চোখ—যা দেখতে যতটা সুন্দর, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভয়ংকর।
তান্বীর নজর গেল লোকটির ধারালো চোয়ালে। তার ফর্সা গালে স্পষ্ট একটা ক্রস বা ক্রুশের মতো কাটা দাগ। এই ক্ষতচিহ্নটি তার সৌন্দর্যে এক পৈশাচিক পূর্ণতা দিয়েছে। তার পরনে একটা দামি কালো ব্লেজার স্যুট, কিন্তু তার ভেতরে কোনো শার্ট নেই। স্যুটের খোলা বুক দিয়ে তার পেশিবহুল শরীরের অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে, আর তার চওড়া গলায় দুলছে একটা মোটা সোনালী রঙের চেইন, যা স্যুটের কালোর ওপর আভিজাত্যের ছাপ ফেলছে।
মাঝখানের এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে মেইলস্ট্রোম তখন স্থবির। তার যে ফিনিক্সকে ধরার কথা ছিল, সেই ফিনিক্স তার চোখের সামনে দিয়ে মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে শুধু তাকিয়ে আছে নিচে পড়ে থাকা তান্বীর দিকে। মাসের পর মাস ধরে সে এই মুখটিকেই তার অন্ধকার স্বপ্নে দেখেছে। ধুলো আর ধোঁয়ার মাঝে মেঝেতে পড়ে থাকা তান্বীকে দেখে মেইলস্ট্রোমের মনে হলো সে কোনো দিবাস্বপ্ন দেখছে। ঠিক এই মুখটা, এই মায়াবী চোখজোড়া তার প্রতিটি প্রার্থনায় আর প্রতিটি নেশায় খুঁজে বেড়িয়েছে। আজ রক্ত আর বারুদের গন্ধে ভরা এই বিমানবন্দরে তান্বীকে এভাবে সামনে পাবে, তা সে কল্পনাও করেনি। মেইলস্ট্রোমের শ্বাস থমকে গেল, তার পাথরের মতো কঠিন হৃদয়ে কেউ যেন সহস্র ভোল্টের বিদ্যুৎ বইয়ে দিল।
তান্বী মেইলস্ট্রোমকে চেনে না, কিন্তু লোকটার এই অদ্ভুত সাজসজ্জা আর গালের ওই ক্রুশ চিহ্ন তাকে কুঁকড়ে দিল। তার মনে হলো, কোনো এক আদিম শিকারি তার শিকারকে খুঁজে পেয়েছে। জাভিয়ানের চোখে সে অধিকার দেখেছিল, কিন্তু এই লোকটার চোখে দেখছে এক ভয়ংকর ‘পজিশন’ বা গ্রাস করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। লোকটার শার্টহীন বুকে সোনালী চেইনটা দুলছে আর তার ধূসর চোখের চাহনি তান্বীর আত্মা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
চারপাশে তখন বৃষ্টির মতো গুলি চলছে। মেইলস্ট্রোমের বডিগার্ডরা দেখল তাদের বস একদম হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। শত্রুপক্ষ খুব কাছে চলে এসেছ।ঠিক সেই মুহূর্তে ফিনিক্সের বেঁচে যাওয়া লোকগুলো মেইলস্ট্রোমকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার শুরু করল। ফিনিক্স সেই সুযোগে ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে গেল। মেইলস্ট্রোম তখনও মূর্তির মতো তান্বীর দিকে তাকিয়ে আছে, সে যেন নড়তেই ভুলে গেছে। তার কানে তখন কোনো গুলির শব্দ যাচ্ছে না।
মেইলস্ট্রোমের লোক তখন বললো “বস! ওদিকে যাবেন না! ওরা ঘিরে ফেলছে! আমাদের বেরোতে হবে!”
মেইলস্ট্রোমের দেহরক্ষীরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে তাকে একরকম টেনে-হিঁচড়ে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। মেইলস্ট্রোম চিৎকার করতে চাইল, হাত বাড়াতে চাইল তান্বীর দিকে, কিন্তু তার বিশ্বস্ত অনুচরেরা তাকে হিঁচড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে নিয়ে গেল।
মেইলস্ট্রোম যখন ভিড়ের আড়ালে চলে যাচ্ছিল, তার সেই ধূসর চোখজোড়া তখনও তান্বীর ওপর স্থির ছিল। সে বিড়বিড় করে শুধু একটা নামই উচ্চারণ করল “তান্বী…”।
তান্বী মেঝেতে বসে হাঁপাচ্ছিল। লোকটা কে? কেন ওভাবে তাকিয়ে ছিল? তার সেই ধূসর চোখের চাহনি তান্বীর মনে এক অজানা আতঙ্কের বীজ বুনে দিল। সে বুঝল না যে, জাভিয়ানের হাত থেকে মুক্তি পেলেও সে এখন এক অনেক বড় শিকারির জালে পড়ে গেছে। ভিড়ের মধ্যে মেইলস্ট্রোম অদৃশ্য হয়ে গেলেও তান্বীর মনে হলো, ওই ধূসর চোখজোড়া এখনো তাকে নজরে রাখছে।
.
.
বিমানের জানালা দিয়ে মেক্সিকো শহরটাকে এখন একমুঠো জোনাকির মতো দেখাচ্ছে। আকাশ ছুঁতে চাওয়া অট্টালিকাগুলো নিচে এক একটা বিন্দুতে রূপ নিয়েছে। তান্বী জানালার কাঁচের গায়ে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে; তার তপ্ত নিশ্বাসে কাঁচের ওপর বাষ্পের পাতলা আস্তরণ জমছে। এই শহর তাকে কেবল বন্দিত্ব দেয়নি, দিয়েছে এমন এক মানুষের স্মৃতি যাকে ভোলা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা।
বিমানের ভেতরের হট্টগোল, গুলির শব্দ আর সেই মৃত্যুভয় মাখানো ল্যান্ডিংয়ের পর এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ যখন তড়িঘড়ি করে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য অন্য একটি ছোট যাত্রীবাহী প্লেনের ব্যবস্থা করল, তান্বী তখন যন্ত্রের মতো ভিড়ের সাথে পা বাড়াল। সে ভাবল, নিয়তি বোধহয় এবার তার ওপর সদয় হয়েছে। বিধ্বস্ত শরীরে সে নতুন প্লেনটির জানালার ধারের সিটে গিয়ে বসল। দুশ্চিন্তায় আর ক্লান্তি শেষে সে সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুজল।
ঠিক তখনই শরীরের লোম খাড়া করে দেওয়া এক শীতল অনুভূতি তাকে গ্রাস করল। যেন পাশের সিটে কোনো তুষারমানব এসে বসেছে। তান্বী চোখ মেলল, আর পরক্ষণেই তার হৃদপিণ্ড গলার কাছে উঠে এল।
তার একদম গা ঘেঁষে বসে আছে সেই লোকটা! ঘাড় পর্যন্ত লম্বা গাঢ় বাদামী চুলগুলো অবাধ্যভাবে কপালে এসে পড়েছে, আর সেই চুলের আড়াল থেকে বিঁধছে একজোড়া গাঢ় ধূসর পাথুরে চাহনি। স্যুটের ভেতর দিয়ে তার শ্বেতশুভ্র পেশিবহুল বুক আর সোনালী চেইনটা মৃদু আলোয় ঝিকমিক করছে। লোকটার গালে থাকা সেই ক্রুশ চিহ্নের ক্ষতটা এখন যেন আরও বেশি জীবন্ত লাগছে।
মেইলস্ট্রোম খুব নিচু আর গভীর স্বরে বললো “পালানোর সব দরজাই আজ বন্ধ তান্বী।”
তান্বীর মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরোনোর আগেই মেইলস্ট্রোম অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে একটি রুমাল তার নাকের কাছে চেপে ধরল। একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ তান্বীর স্নায়ুগুলোকে মুহূর্তেই অসাড় করে দিল। তার চোখের মণি স্থির হয়ে এল, চারপাশের দৃশ্যগুলো ঘূর্ণির মতো ঘুরতে শুরু করল। মেইলস্ট্রোমের সেই ধূসর চোখজোড়াই ছিল তান্বীর দেখা শেষ কোনো দৃশ্য, যা ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর মেইলস্ট্রোমের লোকরা অত্যন্ত চতুরতার সাথে সিকিউরিটি ম্যানেজ করে অজ্ঞান তান্বীকে ‘অসুস্থ যাত্রী’ সাজিয়ে ওই বিমান থেকে নামিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর রানওয়ের এক নির্জন কোণে দাঁড়িয়ে থাকা মেইলস্ট্রোমের কালো প্রাইভেট জেটের সিঁড়ি দিয়ে সে উঠে গেল। তার শক্ত দুই বাহুর ওপর অজ্ঞান তান্বী যেন এক ছিন্নমূল লতা। মেইলস্ট্রোমের পায়ের শব্দে জেটের ভেতরের নিস্তব্ধতা ভাঙছে। সে অত্যন্ত যত্নে তান্বীকে ভেতরে সিল্কের নরম বিছানায় শুইয়ে দিল।
জেটের ইঞ্জিন যখন গর্জে উঠল, মেইলস্ট্রোম তার লম্বা আঙুল দিয়ে তান্বীর অবিন্যস্ত চুলগুলো সরিয়ে দিল। তারপর তার সেই পাতলা কিন্তু রুক্ষ আঙুলগুলো স্থির হলো তান্বীর চিবুকে “জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী তোমাকে আকাশ দিয়েছে, কিন্তু আমি তোমাকে দেব এক অদৃশ্য মায়া। যেখানে পৌঁছানোর জন্য কোনো মানচিত্র আজও তৈরি হয়নি।”
জেটটি যখন মেঘের রাজ্য ভেদ করে কোনো এক অজানা গন্তব্যের দিকে ছুটল, মেইলস্ট্রোম একটি মদের গ্লাস হাতে জানালার দিকে তাকাল। তার চোখে তখন বিজয়ের নেশা। সে জানে, এই খবর যখন জাভিয়ান চৌধুরীর কানে পৌঁছাবে, তখন মেক্সিকোর আকাশে রক্তবর্ণ মেঘ জমবে। কিন্তু তাতে মেইলস্ট্রোমের কিছু যায় আসে না। কারণ তার মাসের পর মাস জমানো ‘অবশেসন’ এখন তার হাতের মুঠোয়।
.
.
.
মেক্সিকো শহরের বিখ্যাত ‘পুয়েন্তে দে লা রিফর্মা’ ব্রিজের ওপর আজ যখন জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী এসে দাঁড়ালো,মেক্সিকোর বাতাস তখন বিষণ্ণতার বারুদ হয়ে বইছে।আকাশটা আজ বড় বেশি ধূসর, ঠিক যেমনটা ছিল আজ থেকে অনেক বছর আগে—যেদিন তাঁর ভাইয়ের নিথর দেহটা তার চোখের সামনেই ঝুঁলছিলো।
মা-বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর পারিবারিক যাতাকলে পিষ্ট সেই কিশোর ভাইয়ের মৃ/ত্যু জাভিয়ানকে শিখিয়েছিল,আবেগ হলো এক মরণব্যাধি।
সেই দিন থেকেই সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো,তাঁর জীবনে ভালোবাসার কোনো ঠাঁই হবে না।সে হবে এক নিরেট পাথর,এক চরম অনুভূতিহীন ‘জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী’। কয়েক বছর আগের জাভিয়ান আর আজকের জাভিয়ানের মধ্যে আসমান-জমিন তফাত।
কিন্তু আজ সেই পাথরে ফাটল ধরেছে। তাঁর সাজানো সেই অনুভূতিহীন গাম্ভীর্যের দেয়াল আজ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে।
তান্বীকে বহনকারী প্লেনটি মেক্সিকোর সীমানা ছাড়িয়ে এখন সম্ভবত প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল নীল জলরাশির ওপর দিয়ে বাংলাদেশের পথে। যতবার জাভিয়ান ভাবছে তান্বী ক্রমশ দিগন্তের ওপারে হারিয়ে যাচ্ছে, ততবার তাঁর মনে হচ্ছে নিজের পাঁজরের ভেতর থেকে কেউ যেন একমুঠো জ্যান্ত প্রাণ ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে সে যেন নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে। জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী, যে কোনোদিন হার মানেনি, আজ সে নিজের মনের কাছেই পরাজিত। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে এক বুক শূন্যতা নিয়ে সে আজ প্রথমবার নিজের মনে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল সেই চরম সত্যটা, যা সে এতদিন নিজের কাছ থেকেও লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল—”আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
এই স্বীকারোক্তিটা মেক্সিকোর বাতাসে ভাসা কোনো তথাকথিত রোমান্টিক সংলাপ নয়, বরং একজন আজন্ম শক্ত হৃদয়ের মানুষের ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার শব্দ।
ব্রিজে বাতাসের বেগ বাড়ছে বাতাস,জাভিয়ান তাঁর ওভারকোটের কলারটা শক্ত করে টেনে দিলো,কিন্তু বুকের ভেতরের সেই কনকনে শীতল শূন্যতাটা কোনো দামী পোশাকে ঢাকা যাচ্ছে না।সে রেলিংয়ে হাত রাখলো। শক্ত লোহার সেই হিমশীতল স্পর্শ আজ তাঁর নিজের চরিত্রের মতোই মনে হচ্ছে—উদাসীন, প্রাণহীন আর বড্ড একা।
জাভিয়ান মনে মনে নিজেকেই রক্তাক্ত করছে এক কঠিন প্রশ্নে: কি আছে ওই মেয়েটার মধ্যে? যে মাত্র কয়েকটা সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ব্যবধানে আমার দীর্ঘ বছরের সাজানো আভিজাত্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিল? আমি তো সেই মানুষ, যে নিজের লক্ষ্য আর কাজ ছাড়া আর কিছুই চিনতাম না। যে কোনো মৃ/তদেহের সামনে দাঁড়িয়েও চোখের পলক ফেলেনি।
অথচ আজ একটা সাধারণ মেয়ের প্লেনে উঠে যাওয়া দেখে আমার পৃথিবীটা কেন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে? তান্বী… ও তো কেবল একটা নাম ছিল না। ও ছিল আমার সেই আজন্ম অন্ধকার ঘরের একমাত্র জানালা, যা দিয়ে আমি প্রথমবার রোদেলা আকাশ দেখতে শিখেছিলাম। আমি সেই আলোটা দুহাতে আগলে ধরার আগেই জানালাটা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।
তান্বী যখন পাশে ছিল, জাভিয়ান তখন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলো। সে বুঝতে পেরেছিলো, বেঁচে থাকা মানে কেবল নিঃশ্বাস নেয়া আর যান্ত্রিক লক্ষ্যপূরণ নয়; বেঁচে থাকা মানে কারোর অপেক্ষায় থাকা, কারোর একটু হাসিতে নিজের অজান্তেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা। জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী তাঁর সেই কয়েকটা দিনে প্রথমবারের মতো ‘মানুষ’ হিসেবে বেঁচে ছিলো। তাঁর সেই নিরেট মরুভূমির মতো জীবনে তান্বী ছিল এক পশলা আকস্মিক বৃষ্টি।
কিন্তু আজ চারপাশ বড় বেশি নিস্তব্ধ। তান্বীর চলে যাওয়ার সাথে সাথেই জাভিয়ানের সেই ক্ষণিকের রঙিন জগতটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।সে জানে,কাল থেকে তাঁকে আবার সেই পুরোনো খোলসে ফিরে যেতে হবে।আবার সেই জনমানবহীন বাড়ি, সেই যান্ত্রিক নির্জনতা আর অনুভূতির দেয়াল দিয়ে ঘেরা একাকী জীবন।সে আবার সেই আগের মতো রুক্ষ আর নিস্পৃহ জাভিয়ান হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু তাঁর হৃদয়ের গভীরে যে ক্ষতটা আজ তৈরি হলো, তার রক্তক্ষরণ কোনোদিন থামবে না।
রেলিংয়ের লোহাটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সে। বিড়বিড় করে বললো—”আমি তো এমন ছিলাম না। আমি তো একা চলতেই জানতাম। অথচ আজ মনে হচ্ছে আমার অস্তিত্বের অর্ধেকটা ওই প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারে হারিয়ে যাচ্ছে?এই কয়েকটা দিন কি তবে আমার সারাজীবনের একাকীত্বের চেয়েও বেশি সত্য ছিল?”
জাভিয়ান আজ মেক্সিকোর এই নির্জন ব্রিজে দাঁড়িয়ে নিজের কাছেই চরমভাবে পরাজিত হলো। ভাইয়ের স্মৃতি আর তান্বীর বিচ্ছেদ তাঁকে আজ এক নিদারুণ সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাল। ট্র্যাজেডি এটাই যে—যখন সে তাঁর ভালোবাসার কথাটা স্বীকার করলো, তখন তান্বী তাঁর স্পর্শের অতীত।
কাল থেকে সে আবার সেই অনুভূতিহীন মুখোশটা পরে নেবে সত্য, কিন্তু মেক্সিকোর এই ব্রিজ সাক্ষী রয়ে গেল— আজ এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী নামের এক নিস্পৃহ মানুষ এক সাধারণ মেয়ের প্রেমে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। সে আজ মানতে বাধ্য হচ্ছে—সে তান্বীকে ভালোবেসে ফেলেছে। পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছে।
.
.
.
.
ব্রিজের নিচে অন্ধকার জলরাশি আছড়ে পড়ছে পিলারের গায়ে, ঠিক যেমন জাভিয়ানের বুকের ভেতরে আছড়ে পড়ছে অনুশোচনার ঢেউ। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের মাঝে হঠাতই পেছনে গাড়ির টায়ার ঘষার শব্দ শোনা গেল। জাভিয়ান ফিরে তাকালো না, সে জানে এই অসময়ে তাকে খুঁজে বের করার সাধ্য মেক্সিকোতে কেবল একজনেরই আছে। ভারী বুটের শব্দ এগিয়ে এলো। রায়হান এসে জাভিয়ানের থেকে কয়েক হাত দূরত্বে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। তার হাতে একটা ফাইল, কিন্তু তার চোখজোড়া আজ জাভিয়ানের মতোই আর্দ্র।
জাভিয়ান সামনের দিকে তাকিয়েই, ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলো “তুমি এখানেও চলে এলে রায়হান? তুমি জানলে কী করে আমি এই ব্রিজে থাকবো?”
জাভিয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে রায়হানের দিকে তাকালো। তার সেই তীক্ষ্ণ চোখে আজ কোনো দম্ভ নেই, আছে এক অসীম শূন্যতা। রায়হান হালকা একটু মাথা নিচু করে ম্লান হেসে জবাব দিলো “স্যার, যে মানুষটার প্রতিটি নিশ্বাসের খবর আমি রাখি, সে তার হৃদয়ের সবচেয়ে বড় হারের দিনে কোথায় থাকবে, তা জানতে কোনো গোয়েন্দার দরকার হয় না। আমার চেয়ে ভালো আপনাকে আর কে জানে স্যার?”
জাভিয়ান আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সে রেলিংয়ে রাখা তার পাথরের মতো শক্ত হাতটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো “শুনেছি মানুষ যখন মরে যায়, তখন তার সব বন্ধন ছিঁড়ে যায়। কিন্তু আজ জীবন্ত অবস্থায় আমার মনে হচ্ছে—আমার সব বন্ধন ছিঁড়ে তান্বী মেঘের ওপারে চলে যাচ্ছে। রায়হান, আমি ওকে আর দেখতে পাবো না, তাই না?”
রায়হান এক পা এগিয়ে এলো। সে জানে জাভিয়ান চৌধুরীকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো শব্দ পৃথিবীতে নেই। সে শুধু শান্ত স্বরে বললো—”স্যার, আপনি তকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন যাতে সে ভালো থাকে। কিন্তু মুক্তি দিতে গিয়ে আপনি নিজেই বন্দি হয়ে গেলেন। আপনি আজ মেক্সিকোর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ হতে পারেন, কিন্তু এই মুহূর্তে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব প্রেমিক।”
জাভিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেই দীর্ঘশ্বাসে মেক্সিকোর বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠলো। সে পকেট থেকে তার ফোনটা বের করে একবার অন করলো, স্ক্রিনে তান্বীর সেই ঘুমন্ত একটা ছবি যেটা সে তান্বীর অজান্তেই তুলেছিল। জাভিয়ান মৃদু কন্ঠে বললো “রায়হান, চলো। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আমি হয়তো নিজেকে আর সামলাতে পারবো না। আমি আবার সেই ‘নিস্পৃহ জাভিয়ান’ হতে চাই। যদিও আমি জানি, এখন থেকে প্রতিটি সূর্যোদয়ে আমি কেবল তান্বীর ছায়া খুঁজবো।”
জাভিয়ান গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল। তার প্রতিটি কদম আজ সীসার মতো ভারী। সে জানে না, এই ব্রিজের ওপারেই তার জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ সংবাদ। সে জানে না যে তান্বী এখন কোনো নিরাপদ বিমানে নয়, বরং মেইলস্ট্রোমের সেই অন্ধকার-ডেরার দিকে উড়ে যাচ্ছে।
.
.
.
.
বাইরে মেক্সিকো সিটির হাড়কাঁপানো শীত। ভিলা এস্পেরেন্জার বিশাল ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর ওপারে কুয়াশার ধূসর চাদরে শহরটা মনে হচ্ছে কোনো এক গভীর বিষাদে ডুবে আছে। ভেতরে হিটারের মৃদু গুঞ্জন চললেও পরিবেশটা এক হাড়হিম করা নিস্তব্ধতায় মোড়ানো।
ব্রিজ থেকে ফেরার পর রায়হান জাভিয়ানকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে জরুরী এক কাজে অফিসের দিকে গেছে। জাভিয়ান ধীরপায়ে তার বেডরুমে ঢুকল। অন্ধকার ঘরটায় পা রাখতেই তার মনে হলো বাতাসটা ভারী হয়ে আছে তান্বীর গায়ের চেনা ঘ্রাণে। সে সুইচ টিপে আলো জ্বাললো না, বরং শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো ঘরের প্রতিটি কোণে।
কল্পনায় সে দেখল, তান্বী ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তার লম্বা চুল আঁচড়াচ্ছে। আবার কখনো মনে হলো তান্বী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের আকাশ দেখছে।জাভিয়ানের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠল যখন তার নজর পড়ল সোফার এক কোণে। সেখানে পড়ে আছে তান্বীর ফেলে যাওয়া সেই মেরুন রঙের শাড়িটা। ঠিক যে শাড়িটা প্রথমবার পরতে দেখে জাভিয়ান নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল, আজ সেই শাড়িটাই নিথর হয়ে পড়ে আছে মালিকহীন এক স্মৃতি হয়ে।
জাভিয়ান টলমল পায়ে এগিয়ে গিয়ে মিউজিক সিস্টেমটা অন করে দিল। নিস্তব্ধ ঘর কাঁপিয়ে বেজে উঠল সেই আর্তনাদ মাখানো সুর—”Andhero se tha mera rishta wara, tunehi ujaalo se waqif kiya… Ab lauta main hoon in andhero mein phir… to paya hain khudko begana yha…..”
সে আগে থেকেই অনেকগুলো মদের বোতল এনে ফ্রিজে জমিয়ে রেখেছিল। আজ যেন তার আত্মহত্যার উৎসব। সে একের পর এক বোতল খুলে সরাসরি গলায় ঢালতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পর জাভিয়ান তার বিশাল ডার্ক লেদার সোফায় আধশোয়া হয়ে রইল। তার ফ্যাকাশে মুখে নীলচে ধমনীগুলো স্পষ্ট, মদের প্রকোপ আর অসুস্থতায় চোখের কোণগুলো রক্তবর্ণ। সামনের ইতালীয় কালো মার্বেলের টেবিলটা একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে Dunhill International-এর লাল ফিল্টারের স্তূপ আর Don Julio 1942 ও Macallan 18-এর খালি বোতলগুলো ছড়িয়ে আছে।
ঠিক তখনই রায়হান ফিরে এলো। ঘরের অবস্থা দেখে তার আত্মা শুকিয়ে গেল। সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর ডক্টরের সেই মেডিকেল রিপোর্টটা ছুড়ে দিল, যেখানে জাভিয়ানের লিভার ড্যামেজের চূড়ান্ত সতর্কবাণী দেওয়া ছিল।
রায়হান রুদ্ধশ্বাসে বললো “স্যার, আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? ডক্টর স্পষ্টভাবে লিখেছেন আপনার লিভার আর নিতে পারছে না! এক ফোঁটা অ্যালকোহলও এখন আপনার জন্য সরাসরি বিষ। আপনি কি জেনেশুনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন? স্রেফ একটা মেয়ের জন্য নিজের জীবনটাকে এভাবে শেষ করে দেবেন? আপনার এই অবশেসন এখন আর কোনো সুস্থ মানুষের পর্যায়ে নেই। ড্রাগসের নেশার মতো আপনি মিস গজদন্তনির ওপর অ্যাডিক্টেড হয়ে পড়ছেন। এভাবে চললে আপনার সাম্রাজ্য ধসে পড়ার আগে আপনি নিজেই ধসে পড়বেন!”
জাভিয়ান নড়ল না। তার পাতলা ঠোঁটে ধরা জ্বলন্ত Dunhill-এর অগ্রভাগ থেকে টকটকে লাল আগুনের আভা বেরোচ্ছে। সে দীর্ঘ একটা টান দিয়ে ধোঁয়াগুলো খুব ধীরে ফুসফুস থেকে মুক্ত করে দিল। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক বিষাক্ত, করুণ হাসি।
সে ধীরলয়ে ঘাড়টা সামান্য বাঁকিয়ে রায়হানের দিকে তাকাল। তার চোখের সেই রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে এক ধরণের খুনে নির্লিপ্ততা। “রিপোর্ট? ডক্টর? রায়হান, তুমিও শেষ পর্যন্ত শরীরের এই নশ্বর হিসাব নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালে? কতটা অগভীর তোমার বিচারবোধ যে তান্বীর প্রতি আমার এই তীব্রতাকে তুমি স্রেফ এক সস্তা নেশার সাথে তুলনা করলে?”
জাভিয়ান কাঁপাকাঁপা হাতে টেবিল থেকে হুইস্কির গ্লাসটা তুলে নিল। রায়হান বাধা দিতে চাইলে জাভিয়ানের হিমশীতল চাহনি তাকে স্তব্ধ করে দিল। জাভিয়ান এক চুমুকে সেই জ্বালাময়ী তরলটা শেষ করে দিয়ে বলতে শুরু করল—”শোনো রায়হান, অবশেসন খুব সস্তা এক মানসিক বিলাসিতা। ওটা একটা আগুনের হলকার মতো—প্রচণ্ড উত্তাপ ছড়ায় ঠিকই, কিন্তু জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে একসময় স্রেফ এক মুঠো ছাই ছাড়া আর কিছুই থাকে না। আর অ্যাডিকশন? ওটা তো স্রেফ স্নায়ুর বিশ্বাসঘাতকতা। রিহ্যাবে গেলে এই অভ্যাস বদলে ফেলা যায়, কারণ মানুষ শরীরের দায়ে বাঁচতে চায়।”
জাভিয়ান সিগারেটের ছাইটুকু ঝেড়ে ফেলে গভীর স্বরে বলল—”কিন্তু তান্বী… তান্বী আমার অবশেসন নয় রায়হান। তান্বী আমার ফিক্সেশন।”
রায়হান অস্ফুট স্বরে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু জাভিয়ান তাকে থামিয়ে দিল।
“ফিক্সেশন বোঝো? এটা কোনো ক্ষণস্থায়ী ধুলোঝড় নয় যে মেক্সিকোর এই শীতের শেষে শান্ত হয়ে যাবে। নেশা মানুষ ত্যাগ করতে পারে, অভ্যাস মানুষ ছুড়ে ফেলে দিতে পারে… কিন্তু ফিক্সেশন? ওটা রক্তের মতো ধমনীতে বইতে থাকে। মানুষ কি তার নিজের প্রতিবিম্বকে শরীর থেকে আলাদা করতে পারে কোনোদিন? তান্বী আমার সেই প্রতিবিম্ব। তাকে বাদ দিলে জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীর এই রাজকীয় অস্তিত্ব স্রেফ এক অর্থহীন শূন্যতা।”
জাভিয়ান আবার কাপা হাতে গ্লাসটা পূর্ণ করল। জানালার ওপারে মেক্সিকোর হিমশীতল অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে ম্লান হেসে যোগ করল—”অবশেসন মরে যায় রায়হান, অ্যাডিকশন ছেড়ে যায়… কিন্তু ফিক্সেশন? ওটা কেবল মৃত্যুর সাথে সাথে শান্ত হয়। তার আগে নয়। She is not my obsession, even not addiction… she is my FIXATION.”
চলবে………..
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৮
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৭
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৬
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৯
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৪(প্রথমাংশ+শেষাংশ)
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৮
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১২
-
আযদাহা সব পর্বের লিংক
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১০