Golpo ডার্ক রোমান্স ডিজায়ার আনলিশড

ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২১


ডিজায়ার_আনলিশড

✍️সাবিলা সাবি

পর্ব-২১

সময়টা ছিল দুপুরের নিস্তব্ধতায় ঘেরা। ভিলা এস্পেরেন্জার বিশাল ডাইনিং রুম জুড়ে বিলাসবহুল কাঠের ফার্নিচার এবং কাঁচের ঝলকানি। জাভিয়ান সকাল সকাল অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ায় প্রকোষ্ঠে এক অস্বস্তিকর শান্তি বিরাজ করছিল।বাড়ির অন্য অন্য সদস্যরা দুপুরের খাবার শেষ করে যার যার রুমে ফিরে গেছে। বর্তমানে বিশাল টেবিলের দুই প্রান্তে বসে আছে লুসিয়া এবং তান্বী। লুসিয়া খাবার প্রায় শেষ করে আনলেও, তার ধীর গতির খাওয়া ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, তার মনোযোগ খাবারের দিকে নয়, বরং তান্বীর দিকে।

লুসিয়ার চোখে ছিল অনুসন্ধিৎসা আর এক চাপা কর্তৃত্ব, আর তান্বী ব্যস্ত ছিল তার নিজের ভাবনায়। লুসিয়া জানতো এই সুযোগে তাকে ফারহানের অতীত জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

হঠাৎ লুসিয়া কাঁটা-চামচ প্লেটে রেখে, সরাসরি ঠান্ডা চোখে তান্বীর দিকে তাকালো।লুসিয়া স্বাভাবিকতার আড়ালে চাপা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো “তোমার ভাই, মানে ফারহান, সে মেক্সিকোতে ঠিক কী করছে? বাংলাদেশে তার এত ব্যস্ততা থাকতেও?“

তান্বী তখনো খাবার খাচ্ছিল। সে সামান্য মাথা নাড়লো, তার কাছে বিষয়টি গুরুত্বহীন।সে সহজভাবে উত্তর দিলো “জানি না সঠিক। আর… জানতে চাইও না।“

লুসিয়ার চোখে মুহূর্তের জন্য ধূর্ততা খেলে গেল।সে আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো “বাড়িতে তোমার ভাবি চিন্তা করে না?“

তান্বীর চোখ কৌতূহলে সামান্য বড় হলো। সে অবাক হয়ে লুসিয়ার দিকে তাকালো।তারফর অবাক কণ্ঠে বললো “ ভাবি কোথা থেকে আসবে? আমার ভাই তো আনমেরিড।“

লুসিয়ার চোখে মুহূর্তের জন্য সন্দেহ খেলা করে গেল। সে খাবারের দিকে মন দেওয়ার ভান করলো, কিন্তু তার মনোযোগ ছিল তান্বীর উত্তরের দিকেই। লুসিয়া তখন চিন্তিত, স্বরে এমন ভাবে বললো যেনো সে ফারহানের ভালোর জন্যই বলছে “আচ্ছা, এই যে তোমার ভাই এমন খারাপ সঙ্গের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল, তার গার্লফ্রেন্ড কখনো বাধা দেয়নি? সবার আগে তো প্রেমিকা বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুরই সবকিছু টের পাওয়ার কথা।

তান্বী প্লেটে চোখ রেখেই বললো “না। ভাইয়ার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। সে সিঙ্গেল।“

লুসিয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল। তান্বীর এই সরল উত্তর তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকলো। সে তখন ঠাণ্ডা বিদ্রূপের সুরে বললো “তুমি কী করে জানবে? তোমার ভাই হয়তো গোপনে সম্পর্ক রেখেছিল।“

তান্বী তখন মাথা নেড়ে দৃঢ়তা দেখিয়ে বললো “না, এরকম নয়। তবে তার ভার্সিটির কয়েকটা মেয়ে বন্ধু ছিল। তারা গ্রুপ স্টাডি করত আমাদের বাড়িতে এসে।তবে ফারিহা আপু একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ ছিল। মানে, ফারিহা আপু প্রায়ই নোট দিতে আসত। তখন ভাইয়ার রুমে গিয়ে আলাদা করে আড্ডা দিতো।“

লুসিয়ার ভেতরটা ক্রোধে জ্বলে উঠলো। সে নিজেকে সংযত করার জন্য নিঃশব্দে ফুসতে থাকলো, কিন্তু মুখে কোনো ভাবান্তর আনলো না।লুসিয়া শুষ্ক, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো “তারা কীভাবে আড্ডা দিত? দরজা বন্ধ করে?“

তান্বী তখন খাবারের প্লেট গুছানো শুরু করতে থাকলো আর বললো “না, আমি কখনো তেমন কিছু দেখিনি। তবে ফারিহা আপু আমার এলিনা আপাকে বলেছিল যে, সে ভাইয়াকে পছন্দ করে। ভাইয়া করে কিনা, সেটা অবশ্য বলেনি।“

তান্বী প্লেট গুছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার চোখে একরাশ হতাশা।সে গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো “হয়তোবা ভাইয়াও করে। আর ফারিহা আপু আমার ভাবি হলে ভালোই হতো। অন্তত আমার ভাইটা এই ভুল পথ থেকে দূরে থাকতে পারতো।“

তান্বী প্লেট গুছিয়ে রেখে ডাইনিং রুম থেকে দ্রুত চলে গেল। এদিকে লুসিয়ার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। তার হাতে ধরা জলের গ্লাসটি প্রায় চেপে ভেঙে ফেলার উপক্রম হলো। এই অবাঞ্ছিত ‘ফারিহা’ কে, যে ফারহানের এত কাছে ছিল? লুসিয়ার চোখে তখন সংশয় এবং কঠিন ঈর্ষা ঝলসে উঠলো।
.
.
.

তান্বী চলে যাওয়ার পর ডাইনিং টেবিলে একা বসে রইলো লুসিয়া। তার মনে তখন তান্বীর বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। সে মনে মনে বললো “তারমানে… ওই গুন্ডাটার গার্লফ্রেন্ড আছে!“

এই ভাবনাটাই লুসিয়ার ভেতরে এক চাপা ক্রোধ ও ঈর্ষা জাগিয়ে তুললো। তার জেদ আরও বাড়ল।সে দ্রুত ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। ঠিক সেই মুহূর্তে, তার ফোন বেজে উঠলো।লুসিয়া ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে তার ব্যক্তিগত অনুসন্ধানকারী তাকে জানালো যে সে ফারহানের ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফেলেছে।

সাধারণত এমন খবরে লুসিয়ার খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু এখন তার মুখে কোনো আনন্দের ছাপ পড়লো না। সে ফোনটি কানে নিয়েই ধীরে ধীরে রুমের এক কোণে রাখা ফারহানের সেই চামড়ার জ্যাকেটের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। তার মনে তখন দহন,ঈর্ষা আর এক অজানা আকর্ষণ-বিদ্বেষের এক তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল।
.
.
.
.
রাত গভীর। জাভিয়ান বাড়িতে ফিরেছে। তার পায়ের শব্দ পেতেই তান্বী দ্রুত কমফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। সে সাধারণত এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে না, কিন্তু কালকের সেই চুম্বনের পর লজ্জায় তার আর জাভিয়ানের মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই। চঞ্চল স্বভাবের হলেও, এমন অন্তরঙ্গ অনুভূতির কাছে তান্বী সত্যিই দুর্বল। তাই, জাভিয়ানের সাথে চোখে চোখ মেটানো এড়াতে সে ঘুমানোর ভান ধরলো।

এদিকে জাভিয়ান রুমে প্রবেশ করলো।সে তান্বীর অস্বাভাবিক অবস্থা দেখেই কিছুটা আন্দাজ করলো। ধীরে ধীরে সে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো তারপর আলতো করে তান্বীর মুখ থেকে কমফোর্টারটা সরিয়ে দিলো।

কমফোর্টার সরে যেতেই তান্বী চোখ খিঁচে বন্ধ করে রাখলো। তান্বীর এমন বেহাল দশা দেখে জাভিয়ানের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। কালকের সেই আগ্রাসী চুম্বনের ফলস্বরূপ তান্বী ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক পরে আছে, কারণ তার ঠোঁট প্রায় কালচে হয়ে আছে, কিছুটা ফুলেও আছে, এমনকি দাগও হয়েছে।

জাভিয়ান তখন মৃদু স্বরে বললো “এতো লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আমি কি তোমাকে খেয়ে ফেলেছি নাকি? এখন পর্যন্ত ভালো করে ছুঁয়েও দেখলাম না তাতেই এমন লজ্জাবতী লতার মতো নুইয়ে গেছো? আর যদি সেরকম ভাবে ছুঁয়ে দিতাম, তখন কী করতে?

তান্বী এবার ধীরে ধীরে চোখ মেললো। তাদের দৃষ্টির তীব্র মিলন ঘটলো। জাভিয়ানের চোখদুটো আজ অন্যরকম—সেখানে ছিল না কোনো আগ্রাসন, বরং ছিল এক চাপা কৌতূহল আর বিরল কোমলতা। তান্বী সেই দৃষ্টির গভীরতা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না, দ্রুত অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে এলো। অন্যদিকে চোখ সরিয়ে রেখেই প্রায় ফিসফিস করে বললো “সরে যান প্লিজ।“

তান্বীর এই আবদার জাভিয়ানকে বিস্মিত।তার কণ্ঠে ছিল না কোনো রাগ, বরং ছিলো অসহায়ত্বের এক করুণ সুর। সেই অসহায়তা জাভিয়ানের কঠিন হৃদয়কে স্পর্শ করলো।সে আর কোনো কথা না বলে নীরবে পিছু হটলো।

জাভিয়ান সরে যেতেই তান্বী স্বস্তির বদলে যেন এক অসহ্য শূন্যতা অনুভব করলো। সে দ্রুত, গভীরভাবে শ্বাস টানলো। গতকাল রাতের সেই বর্বর অথচ মোহাচ্ছন্ন চুম্বনের স্মৃতি তার সমস্ত চেতনা গ্রাস করলো। সে চোখ বন্ধ করে, অসহায়ের মতো, কমফোর্টারটা দু’হাতে খামচে ধরলো।তার শরীরে শুরু হলো এক অজানা কম্পন,এক বিদ্যুৎপ্রবাহ যেন শিরদাঁড়া বেয়ে ওঠা-নামা করছে। এটা কী? এক অচেনা, অজানা নিষিদ্ধ অনুভূতি। বিস্ময়কর হলো, এই অনুভূতি বিরক্তিকর ছিল না; বরং এক গাঢ়, গোপন স্বাদ-উপভোগের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তান্বী আরও জোরে জোরে, গভীর শ্বাস নিলো, তার বুক দ্রুত ও অস্থিরভাবে ওঠানামা করতে লাগলো।

বাথরুম থেকে ভেসে আসছিল শাওয়ারের জল পড়ার শব্দ। সেই শব্দকে উপেক্ষা করে, তান্বীর বন্ধ চোখের সামনে বারবার জাভিয়ানের সেই আগ্রাসী ঠোঁটের চাপ আর কর্কশ শ্বাস ভেসে উঠলো। তার শরীরে যেন এক অজানা, উষ্ণ স্রোত তীব্রভাবে প্রবাহিত হচ্ছিল—যা তার ভেতরের সত্তাটিকে এক নতুন, তীব্র সংবেদনশীলতায় ভরিয়ে তুলছিল। সে বুঝতে পারছিল না, কেন নিজেরই সরে যাওয়ার আবদার সত্ত্বেও তার শরীর জাভিয়ানের স্মৃতিতে এমন বিদ্রোহী উষ্ণতা অনুভব করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জাভিয়ান শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো। মসৃণ সিল্কের কালো নাইট স্যুটে তার সুগঠিত দেহ আবৃত। হাতে তোয়ালে নিয়ে চুল মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হলো সে। তান্বী তখনও কমফোর্টারের নিচে, চোখ বন্ধ করে আত্মগোপনের এক করুণ ব্যর্থ চেষ্টায় মগ্ন হয়ে আছে।

জাভিয়ান আলতো করে কমফোর্টার সরিয়ে বিছানায় জায়গা নিলো।তার শরীর থেকে ভেসে আসা ভেজা উষ্ণতা আর পারফিউমের তিক্ত-মধুর ঘ্রাণ—পাশাপাশি শোয়ার মুহূর্তে সেই উষ্ণতা যখন তান্বীর গায়ে হালকা স্পর্শ করলো, সে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো বিছানা ছেড়ে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো।

তান্বীর এই আকস্মিক, আতঙ্কিত প্রতিক্রিয়া জাভিয়ানকে হতবাক করে দিল। জাভিয়ান তোয়ালে নামিয়ে,কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করলো “কী হলো তোমার? এমন পাগলের মতো আচরণ করছো কেন?“

তান্বী কোনো উত্তর দিতে পারলো না। সে কম্পিত দেহে শুধু বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

জাভিয়ান কণ্ঠে কৌতূহল ও চাপা রোষ নিয়ে বললো “হঠাৎ এমন ভয় কেন পাচ্ছো আমাকে তুমি? কালকের একটি চুম্বন কি এতই ভীতিকর ছিল?“

তান্বী দ্রুত বাধা দিয়ে,নিজের ভেতরের নতুন কম্পন ঢাকতে চাওয়ার প্রয়াস নিয়ে বললো “ভয় নয়… আমি তীব্র অস্বস্তি বোধ করছি।”

তান্বীর কণ্ঠে সেই অসহায়ত্বের ছাপ জাভিয়ানকে মুহূর্তের জন্য স্থবির করে দিল। সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো,নিজের ক্ষমতাকে সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করলো। তারপর শান্ত ও ভারি কণ্ঠস্বরে বললো “ডোন্ট ওয়ারি! আমি তোমাকে স্পর্শ করবো না। তুমি শান্তিতে ঘুমাও।“

এই বলে জাভিয়ান বিছানার অন্য পাশ থেকে একটি লম্বা কোলবালিশ তুলে নিলো। সেটি তাদের দুজনের মাঝে সতর্কতার সাথে রেখে দিলো দু’জনর মাঝে প্রাচীরের মতোই। তারপর সে তান্বীর দিক থেকে সম্পূর্ণ অন্যদিকে, নীরব অভিমানে ঘুরে শুয়ে পড়লো।

তান্বী সেই কোলবালিশের প্রতীকী ব্যবধান দেখে ধীরে ধীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সে মনের গভীরে, এক অস্ফুট স্বীকারোক্তি দিলো “আসলে এটা ভয় নয়… অস্বস্তিও নয়। এটি নতুন কিছু—এক অজানা জাগরণ, যা আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আমার ভেতরের এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনই আমাকে জাভিয়ানের সামনে এতটা অস্থির করে তুলেছে।“
.
.
.
রাত আরও গভীর থেকে গভীর হলো। নীরবতা এখন ঘন কুয়াশার মতো রুম জুড়ে। তান্বী এখন গভীর, নিষ্পাপ ঘুমে আচ্ছন্ন। তার অস্থির অভ্যাসের কারণে কমফোর্টার সরে গেছে; শরীরের পোশাকও কিছুটা এলোমেলো, যা তার ঘুমন্ত দুর্বলতাকে উন্মোচিত করছে।

জাভিয়ান হঠাৎই ঘুম ভেঙে উঠে বসলো।সে বিছানার হেডবোর্ডে ভর দিয়ে হেলান দিলো আর পাশে থাকা ল্যাম্পশেডের মৃদু, স্বর্ণাভ আলো জ্বালিয়ে দিলো। সেই আবছা আলোয় সে একদৃষ্টিতে তাকালো ঘুমন্ত তান্বীর দিকে।তান্বীর নাইট স্যুটের টপস উপরে উঠে যাওয়ায় তার নাভির সামান্য অংশ দৃশ্যমান। পাজামা হাঁটু পর্যন্ত উঠে আছে। কিন্তু জাভিয়ানের দৃষ্টি শারীরিক আকর্ষণে নয়, বরং তান্বীর মুখের সরলতা ও নির্দোষ অভিব্যক্তিতেই নিবদ্ধ। তার লম্বা, ঢেউ খেলানো কালো চুলগুলো বিছানা ছাড়িয়ে ফ্লোর পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে।

জাভিয়ান ধীরে, অত্যন্ত সন্তর্পণে তান্বীর দিকে ঝুঁকলো।
জাভিয়ান মনের গভীরে, এক চাপা আর্তনাদ আর যন্ত্রনা নিয়ে ফিসফিস করে বললো “আমার স্পর্শ তোমার কাছে এতটা অসস্থির মনে হয়? জিন্নীয়া… তুমি কি জানো জিন্নীয়া কি? জিন্নীয়া(Jinniah) হলো মোহময়ী পরীসত্তা। আর তুমি সেই জিন্নীয়ার প্রতিচ্ছবি—তবু তোমার চোখে আমার জন্য মুগ্ধতা নয়, কেবল ভয় আর অসহ্য অস্বস্তি?তোমাকে দেখলে আমার ভেতরের পশুটা হিংস্রভাবে জেগে ওঠে! ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে তোমাকে,তোমার এই অক্ষত পবিত্রতা আমার হাতে কলুষিত করে দিতে ইচ্ছে হয়। অথচ আমারই বিছানায়, আমার পাশে—তুমি এখনও কিভাবে নিজের ভার্জিনিটি শুয়ে আছো?

এই ভাবনাগুলো তাকে আঘাতের পর আঘাত হানতে লাগলো। নিজের তীব্র কামনাকে কঠিন হাতে দমন করে, সে আলতো করে তান্বীর পোশাকগুলো সাবধানে ঠিক করে দিলো। তারপর কমফোর্টারটি সাবধানে টেনে তার গায়ে জড়িয়ে দিলো।সে তান্বীর কপালে একটা চুম্বন আঁকতে উদ্যত হলো,কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তার হাত কেঁপে উঠলো আর সে থেমে গেলো। তাঁর ভেতরে তীব্র ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠলো। মুহূর্তেই মনে পড়লো, সামান্য স্পর্শে তান্বীর তাকে সরে যেতে বলার আকুতি—এই প্রত্যাখ্যানের জ্বলন জাভিয়ানকে ভেতর থেকে পুড়িয়ে দিল। সে নিজেকে নির্মমভাবে সংযত করলো। সেই দমিয়ে রাখা রাগের বোঝা নিয়ে সে আর চুমু দিলো না। সে দ্রুত শুয়ে পড়লো আর আলো নিভিয়ে ঘরটিকে আবার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলো।
.
.
.
সকাল হয়েছে। ঘরের পর্দা ভেদ করে ভোরের কোমল আলো প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করেছে।তান্বীর ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে সে প্রথমে নিজের চারপাশে তাকালো অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব হলো। আজ সে দেখলো, সে ওঠার আগেই বিছানার অন্য পাশটি ফাঁকা। জাভিয়ান রুমে নেই।সে দ্রুত উঠে বসলো। বিছানার পাশে রাখা কোলবালিশটি তখনও তাদের দুজনের মাঝে আগের মতোই স্থির হয়ে আছে,কাল রাতের নীরব প্রতিশ্রুতির সাক্ষী হয়ে।

কমফোর্টার সরিয়ে সে ঘরের চারদিকে দৃষ্টি ফেরালো। জাভিয়ানের পোশাক, ঘড়ি বা মানিব্যাগ কোনো কিছুই তার নজরে এলো না। সে বুঝতে পারলো, জাভিয়ান সম্ভবত অনেক আগেই অফিসে চলে গেছে।

তান্বী ধীরে ধীরে বিছানা ছাড়লো। জাভিয়ানের শক্তিশালী উপস্থিতি ছাড়া রুমটি হঠাৎই অনেক বড় এবং শান্ত মনে হলো। কাল রাতে যে তীব্র আবেগ আর অদ্ভুত উষ্ণতার মধ্য দিয়ে সে গেছে, সেই ঘোর এখনও কাটেনি। জাভিয়ানের অনুপস্থিতি তার মনে এক মিশ্র অনুভূতি জাগালো একদিকে স্বস্তি, আবার অন্যদিকে এক অপরিচিত শূন্যতা।
.
.
.
.

ডাইনিং টেবিলে তান্বীর মুখ থেকে ‘ফারিহা’ নামটি জানার পর লুসিয়া স্থির করলো, ফারহানের সঙ্গে এবার সরাসরি কথা বলা অনিবার্য। এটি কেবল ঈর্ষা নয়, এটা ছিল তার অহংকারের প্রশ্ন। নিজের ফোন থেকে ফারহানের নম্বরটি বের করে, লুসিয়া সতর্কতার সঙ্গে মেসেজ টাইপ করলো।

“ফারহান আমি লুসিয়া চৌধুরী। তোমার জ্যাকেটটা আমার কাছে রয়ে গেছে। ওটা নিয়ে কী করবে? আমি ওটা ফেরত দিতে চাই।”

মেসেজটি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ফারহান বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো। সে বুঝতে পারছিল,এটা জাভিয়ানের সেই অহংকারী বোন লুসিয়া।তার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ তার কাম্য ছিল না।

ফারহান তখন রিপ্লাই করলো মেসেজের
“ওটা দরকার নেই। তুমি ওটা ফেলে দাও।”

ফারহানের এই অকপট শীতল প্রত্যাখ্যান লুসিয়ার ভেতরে ক্রোধের এক নতুন আগুন উসকে দিল। তার জেদ এখন চূড়ান্তে। সে পুনরায় লুসিয়া মেসেজ লিখলো
“না। এটা শুধু জ্যাকেট ফেরত দেওয়া নিয়ে নয়। তোমার বোন তান্বী বিষয়ে কিছু অত্যন্ত জরুরী কথা আছে, যা সামনাসামনি ছাড়া আলোচনা করা সম্ভব নয়।”

এই মেসেজটি ফারহানের সমস্ত ঔদাসীন্য ভেঙে দিল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো তান্বীর অসহায় কান্নারত সেই মুখচ্ছবি। বোনের প্রসঙ্গ আসতেই তার সব বিরক্তি মুহূর্তে উধাও হলো।

ফারহান সাথে সাথে রিপ্লাই করলো
“ঠিক আছে। বলো, কোথায় দেখা করতে চাও?”

লুসিয়া দ্রুত সাড়া দিল। তারা ঠিক করলো, আজ বিকেলের দিকে শহরের একটি অপেক্ষাকৃত নির্জন ক্যাফে সংলগ্ন মোড়ে তারা মিলিত হবে।

বিকেলের নরম, আবছা আলোয় লুসিয়া তার বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছালো। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না; গিয়েই দেখলো, ফারহান সেখানে অনেক আগেই চলে এসেছে।

ফারহান তার কালো স্পোর্টস বাইকের সঙ্গে হেলান দিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে। তার পরনে জিন্স আর একটি সাধারণ টি-শার্ট। তার চোখে-মুখে এক ধরনের উদাসীন বিষাদ এবং চাপা বিরক্তি খেলা করছে—যা লুসিয়ার প্রতি তার অনীহা স্পষ্ট করে দিচ্ছিল।

লুসিয়া তার গাড়ি থেকে নামলো। ফারহানকে দেখে তার মনে হলো, ছেলেটির মধ্যে তার ভাই জাভিয়ানের মতো সেই রুক্ষ কর্তৃত্বপরায়ণতা নেই; বরং তার ব্যক্তিত্বে এক ধরণের অশান্ত আবেগ লুকানো আছে।

দুজনের চোখাচোখি হতেই পরিবেশটি তীব্র নীরবতার ভারে ডুবে গেল। এই নীরবতা দুজনের ভেতরের অব্যক্ত ঘৃণা এবং কৌতূহলকে প্রতিফলিত করছিল।

লুসিয়া তার বিলাসবহুল গাড়ির পেছনের সিট থেকে চামড়ার জ্যাকেটটি বের করে ফারহানের দিকে বাড়িয়ে দিলো। ফারহান দ্রুত সেটি নিয়ে, কোনো সৌজন্যতা না দেখিয়ে, নিজের গায়ে চাপিয়ে নিলো। জ্যাকেটের শীতলতা তার ভেতরের বিরক্তিকে আরও বাড়িয়ে দিল।সে রুক্ষ ও দ্রুত কণ্ঠস্বরে বললো “এবার বলো, আমার বোন তান্বী সম্পর্কে কী জরুরি কথা আছে? তাড়াতাড়ি করুন। আমার হাতে একদম সময় নেই। আমি দু’-তিন দিনের মধ্যে দেশে ফিরছি।“

ফারহানের মুখে ‘দেশে ফেরা’র কথা আর তার এই উদাসীন তাড়া শুনে লুসিয়ার মনটা হঠাৎই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এক তীব্র হতাশা তার কণ্ঠ চেপে ধরলো। লুসিয়া চোখে সরাসরি তাকিয়ে কণ্ঠে তীব্র শ্লেষ নিয়ে বললো ”এত তাড়া কিসের? বাংলাদেশে বুঝি ফারিহা অপেক্ষা করছে?“

‘ফারিহা’ নামটি শুনে ফারহান মুহূর্তেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার চোখে বিস্ময়। এই নাম লুসিয়া জানলো কী করে?

ফারহান অবাক ও সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলো “এই নাম… তুমি কিভাবে জানলে?“

লুসিয়া স্বাভাবিকতার ভান করে, কিন্তু চোখে কঠিন হাসি নিয়ে বললো “কেন? তোমার বোন বলেছে।“

ফারহানের কৌতূহল এখন তীব্র। সে লুসিয়ার কাছাকাছি এসে ঝুঁকে দাঁড়ালো।তারপর কণ্ঠে চাপা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো “ওহ! তান্বী… আর কী কী বলেছে আমাকে নিয়ে?“

লুসিয়া এই সুযোগটির জন্যই অপেক্ষা করছিলো।সে ফারহানের মুখের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত বিরতি নিলো, তারপর বিষাক্ত বাক্যগুলো ছুঁড়ে মারলো। সে কঠোরভাবে সরাসরি বললো “বলেছে তুমি একটা গুন্ডা, লোফার, বদমায়েশ এবং একশ’ একটা মেয়েকে নিয়ে বাসায় গ্রুপ স্টাডির নামে নষ্টামি করতে।“

এই মিথ্যা অপবাদ শুনে ফারহানের ধৈর্য ভেঙে গেল। তার চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে উঠলো। সে কঠিন স্বরে গর্জন করে বললো “মোটেও না! আমার বোন কোনোদিনও এই মিথ্যা কথা বলবে না!“

লুসিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো “কেন? আমাকে কি তোমার মিথ্যুক মনে হয়?“

ফারহান এক ধাপ পিছিয়ে গিয়ে, তীব্র ঘৃণা নিয়ে বললো “তোমার মতো মেয়ের থেকে আর কী-ই বা আশা করা যায়!“

ফারহান তার রাগের রাশ ছাড়লো না। তার কণ্ঠে এখন তীক্ষ্ণ ঘৃণা।সে কণ্ঠস্বর কঠিন ও স্পষ্ট কন্ঠে বললো “আর শোনো, বাই দ্য ওয়ে… ফারিহার নাম তোমার মুখে মানায় না। ফারিহা আমার খুব, খুব ভালো বন্ধু, এবং ও অত্যন্ত ভালো মেয়ে সে। ওর মতো মেয়ে সম্ভবত লাখে একটা তৈরি হয়। তোমার মতো নয় যে নিজের ক্যারিয়ার আর ফালতু স্বপ্ন পূরণ করতে পুরুষদের ট্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার করে! আর সেই সুযোগে, ছেলেরা তোমাকে বাজে ভাবে ছোঁয়ার সাহস করে। অন্য পুরুষের স্পর্শ যার শরীরে লেগে আছে, সে অন্তত ফারিহার নাম না নিলেও চলবে।“

লুসিয়া, জীবনে এই প্রথমবার, কারো কথায় এমন তীব্র আঘাত পেলো।সে সবসময় ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাব নিয়ে চলতো; আবেগ বা সমালোচনা কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করত না। অথচ, আজ ফারহানের এই নির্মম, সরাসরি কথাগুলো তার হৃদয়ের গভীরে গিয়ে বিঁধলো। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, চোখে এলো এক অবিশ্বাস্য শূন্যতা। সে ফারহানের দিকে তাকিয়ে রইলো,মনে হলো তার চোখের সামনে পৃথিবীটা ধসে যাচ্ছে।

ফারহান লুসিয়ার এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন লক্ষ্য করলো না। সে তখনো তান্বীর চিন্তায় অস্থির।ফারহান বিরক্তি ঝেড়ে বললো “এসব কথা ছাড়ো। এবার বলো, আমার বোন তান্বী বিষয়ে কী জরুরী কথা আছে? তাড়াতাড়ি বলো।“

লুসিয়ার চোখে তখনো ফারহানের কঠিন কথাগুলোর আঘাতের তিক্ততা লেগে আছে। তার অহংকারী মেজাজ হঠাৎ ভেঙে পড়লো। সে অসহায়ের মতো সত্যি কথাটা বলে দিল।তার কণ্ঠস্বর প্রায় ফিসফিস “না… কোনো জরুরী কথা নেই। জ্যাকেট ফেরত দেওয়ার জন্য মিথ্যা বলেছি। কারো জিনিস আমি আমার কাছে রাখি না তাই ফেরত দিয়ে দিলাম।“

লুসিয়ার এই স্বীকারোক্তি ফারহানের ধৈর্যের বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে দিল। তার কণ্ঠ এখন আগুন ঝরা।সে চিৎকার করে, ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বললো “সিরিয়াসলি?! তুমি আমার মূল্যবান সময় এভাবে নষ্ট করলে! তুমি জানো আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এখানে ছুটে এসেছি! আর তুমি…

ফারহানের বাক্য শেষ হওয়ার আগেই লুসিয়া কিছু বলার সুযোগ পেলো না। ফারহান মুহূর্তের মধ্যে তার কালো বাইকে উঠে বসলো এবং হেলমেটটি মাথায় পড়ে নিলো।

হেলমেট পরার পর সে একবার তীব্র দৃষ্টিতে লুসিয়ার দিকে তাকালো। হেলমেটের আড়ালে শুধু ফারহানের তীক্ষ্ণ চোখ দুটো দেখা যাচ্ছিল। লুসিয়া সেই ক্রোধ মিশ্রিত চোখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হলো। অদ্ভুত এক ঘোর লাগলো তার; মনে হলো, চোখদুটো কী সুন্দর!

কিন্তু সেই মুগ্ধতা স্থায়ী হলো না। লুসিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফারহান বাইক স্টার্ট দিল আর তীব্র গতিতে ধুলো উড়িয়ে স্থান ত্যাগ করলো।

ফারহান চলে যাওয়ার পর লুসিয়া একা, সেই নির্জন রাস্তায় স্তম্ভিত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে হঠাৎ কোনো বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন জগতে এসে পড়েছে। তার ভেতরের সব অনুভূতি যেন পাগলের মতো তোলপাড় করছে।

লুসিয়া—যে কিনা জীবনে কখনো কিছু ‘না’ শোনেনি, যা চেয়েছে মুহূর্তে হাতের মুঠোয় পেয়েছে,সেই লুসিয়া আজ এভাবে তিরস্কার আর প্রত্যাখ্যানের শিকার হলো। ছোটবেলা থেকেই তার জীবন ছিল লাক্সারিয়াস, ফ্রিডম এবং এনজয়মেন্টের অপর নাম। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া লুসিয়ার কাছে প্রতিটি সুযোগ ছিল উন্মুক্ত। তার জীবনে সবচেয়ে বড় শূন্যতা ছিল হয়তো মা-এর অনুপস্থিতি। তবুও বাবা এবং ভাই আর পরিবারের দেওয়া ভালোবাসার প্রাচুর্যে সেই ক্ষত সে ভুলে ছিলো।

কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে, ফারহানের কর্কশ সত্য আর তার ঠান্ডা প্রত্যাখ্যানের পর সেই প্রাচুর্য, সেই বিলাসিতা—সবকিছুই তুচ্ছ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এতদিনের সাজানো জীবন এক বিশাল বৃথা আয়োজন।তাঁর ভেতরের অনুভূতিগুলো এখন নিয়ন্ত্রণহীন। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। মনে হচ্ছে যেন সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। বুকের গভীরে এক তীব্র মানসিক রোগ বাসা বাঁধছে,এমন এক শূন্যতা, যা কোনো অর্থ বা বিলাসিতা দিয়ে পূর্ণ করা অসম্ভব। লুসিয়া সেই ধূসর সন্ধ্যায় কেবল একা দাঁড়িয়ে রইলো, তার ভেতরের তীব্র যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করতে লাগলো।
.
.
.
সেদিনের ঘটনার পর পুরো দু’দিন কেটে গেছে। মার্কো এত দিন বিশ্রাম নিচ্ছিল, কিন্তু তার স্থির স্বভাব আর দীর্ঘ সময় অলস বসে থাকা মেনে নিতে পারছিল না।আজ সকালে, মার্কো স্থির করলো আর নয়। ধীরে ধীরে সে বিছানা ছেড়ে উঠলো। আঘাতের যন্ত্রণা এখনও পুরোপুরি সারেনি, তাই তাকে চলতে হচ্ছে হালকা ওয়াকিং কেন ভর দিয়ে। প্রতিটি পদক্ষেপে তার শরীর জানান দিচ্ছিল যে সে সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। তবুও তার চোখে ছিল এক অদম্য সংকল্প।নিজের হাতে যত্ন করে তার সাদা ফ্রেমের চশমাটা চোখে পরলো। চশমাটি যেন তার দুর্বলতাকে ঢেকে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা এবং দূরদৃষ্টিকে ফুটিয়ে তুলছিল।তারপর সে পোশাক পরিবর্তন করলো এবং ধীর পায়ে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে গেল। লাঠিতে ভর দিয়েই সে তার ব্যক্তিগত গাড়িটি বের করলো। স্টিয়ারিং ধরতেই তার হাত কিছুটা কাঁপলো, কিন্তু সে নিজেকে স্থির করলো।
মার্কো আর এক মুহূর্তও নষ্ট করতে চাইল না। সে তার নিজের কাজে, অর্থাৎ নিজের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
.
.
.
.
এক সকাল পেরিয়ে আরেকটি সকালের ম্লান আলো ভিলার কক্ষগুলিতে প্রবেশ করেছে, কিন্তু জাভিয়ান তখনও ফেরেনি।তান্বীর গত দু’টি দিন যেন ধীরগতির যন্ত্রণায় কেটেছে। কাল রাতের সেই কোলবালিশের ব্যবধান, তারপর জাভিয়ানের শব্দহীন প্রস্থান—সবকিছু মিলে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হয়েছে। জাভিয়ানের এমন অস্বাভাবিক, দীর্ঘ অনুপস্থিতি তান্বীর ভেতরের আত্মবিশ্বাসকে নড়িয়ে দিয়েছে। সে বুঝতে পারছে না, এই অনুপস্থিতি কি তার প্রতি জাভিয়ানের ক্ষোভ নাকি অন্য কোনো গুরুতর কারণ?

সে একবার রায়হানকে ফোন করেছিল—তাৎক্ষণিক, অস্থির এক প্রয়োজনে কিন্তু রায়হান ফোন ধরেনি। এই দ্বিগুণ নীরবতা তান্বীর ভেতরে এক অন্ধকার ভয়ের জন্ম দিয়েছে।তান্বীর এখন আর কোনো কাজে মনোযোগ নেই। তার ভাবনা জুড়ে কেবল একটিই প্রশ্ন: জাভিয়ান কখন ফিরবে? সে বারবার অস্থির পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, তারপর থেমে মেইন দরজার কাছে উঁকি দিচ্ছে। বাইরে থেকে আসা প্রতিটি গাড়ির শব্দে তার বুক ধড়ফড় করে উঠছে; এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে—এই বুঝি সে ফিরে এলো!

তার হৃদয় যেন ফিসফিস করে বলছে: কাল রাতে তাদের মাঝে যে অব্যক্ত স্পর্শ এবং অসহজ নীরবতা ছিল, জাভিয়ানের এই অনুপস্থিতি তারই নিষ্ঠুর শাস্তি। তান্বী আজ বুঝতে পারছে, সে যতই জাভিয়ানকে এড়িয়ে চলতে চেয়েছে, ততই তার উপস্থিতি তার জন্য আরও বেশি অপরিহার্য, এক গভীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার সমস্ত চেতনা এখন সেই অপেক্ষার আগুনে পুড়ছে।

সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে গেছে। দুপুর পেরিয়ে বিকেল, আর সেই বিকেলও শেষ হয়ে নামলো নিঝুম রাত।ভিলাতে ডিনার পর্ব শেষ হলো। প্রত্যেকেই ধীরে ধীরে যার যার কক্ষের দিকে চলে গেল। জাভিয়ানের বাবা সায়েম চৌধুরী, একবার কেবল স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলেছিলেন, “জাভিয়ান হয়তো অফিসের কোনো জরুরী কাজে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।”

কিন্তু তান্বীর মন এই কথা মানতে পারল না। তার ভেতরে একটাই প্রশ্ন কাঁটার মতো বিঁধছে: এত ব্যস্ততা কিসের যে একটা ফোন করারও সময় পেল না জাভিয়ান? একটা মুহূর্তের জন্য কি সে মনে করলো না যে বাড়িতে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে?

তার সমস্ত অস্থিরতা এখন তীব্র অভিমান আর অব্যক্ত আশঙ্কায় পরিণত হয়েছে। জাভিয়ানের এই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা তাকে কেবল উদ্বিগ্ন করছে না, আঘাতও করছে। সে বুঝতে পারছে না—সে কি তার অনুপস্থিতি নিয়ে চিন্তা করবে, নাকি তার প্রতি রাগ করবে?

তান্বী শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলো। মনকে বোঝালো জাভিয়ান ব্যস্ত। বিরক্তি আর অভিমানের ভারী বোঝা নিয়ে সে যখন কক্ষের দিকে প্রস্থান করবে বলে স্থির করলো,ঠিক সেই মুহূর্তেই বাইরে শোনা গেল জাভিয়ানের গাড়ির পরিচিত গর্জন।

তান্বীর হৃৎপিণ্ড এক লাফে থেমে গেল, তারপর দ্বিগুণ গতিতে ধড়ফড় করে উঠলো। এক মুহূর্তে তার সমস্ত ক্লান্তি, অভিমান এবং দুশ্চিন্তা আনন্দের প্লাবনে ভেসে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই সে নিজেকে সংযত করলো। না, জাভিয়ানের সামনে এই খুশি দেখানো চলবে না।

জাভিয়ান দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো। তার মুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও চোখে ছিল এক অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য এবং বিজয়ের হাসি। দরজার কাছে তান্বীকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ভ্রু কুঁচকালো।

জাভিয়ান কণ্ঠস্বরে বিস্ময় ও সামান্য কাঠিন্য নিয়ে প্রশ্ন করলো “এখনও ঘুমাতে যাওনি?“

তান্বী নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে, সামান্য কেঁপে ওঠা কণ্ঠে প্রশ্ন করলো। সে অস্বাভাবিক বিনয়ের সাথে বললো “কোথায় ছিলেন আপনি? এতক্ষণ?“

জাভিয়ান ঠোঁটে এক বক্র হাসি নিয়ে বললো “তোমার জন্য সারপ্রাইজ রেডি করতে।“

তান্বী অবাক হয়ে, কৌতূহল মেশানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো “কিসের সারপ্রাইজ?“

জাভিয়ান আর কথা না বাড়িয়ে, পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করে আলতো করে তান্বীর হাতে দিলো।তার কণ্ঠস্বর চূড়ান্ত শীতল ও অপ্রাসঙ্গিক ছিলো “খুলে দেখো।“

তান্বী কাগজটি খুলে দেখলো। ভেতরের লেখাগুলো চোখে পড়তেই তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কাগজটি ছিল বাংলাদেশের ভিসা—কেবল দু’দিনের মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে! জাভিয়ানের ক্ষমতা যে কতটা অপ্রতিরোধ্য, তা এই মুহূর্তে প্রমাণ হলো। এত বড় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সে মাত্র দু’দিনে নিজের মুঠোয় নিয়ে এসেছে।

তান্বীর হাত থেকে কাগজটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। জাভিয়ান সেটি ধরে ফেললো।সে জয়ের শাণিত দীপ্তি নিয়ে বললো “তোমার মুক্তির চাবি,তোমার ভিসা। কাল রাতেই তোমার ফ্লাইট। তোমার বাবা-মা, ভাইয়ের কাছে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে এবার। সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নাও।“

এই কথা বলে জাভিয়ান এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না। সে ঘুরে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলো। তান্বী সেই দরজার সামনে, ধ্বংসপ্রাপ্ত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। হাতে ধরা ভিসা, যা তার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি।

তান্বী মনের গভীরে, এক চরম দ্বন্দ্বে বললো “আমার তো খুশিতে নেচে ওঠার কথা। আমি অবশেষে মুক্তি পেতে যাচ্ছি! এই বাঁধন থেকে, এই মানুষটার অধিকার থেকে আমি স্বাধীন! কিন্তু… কিন্তু আমার কোনো খুশি লাগছে না কেন? আমার কেন একটুও আনন্দ হচ্ছে না? বরং… মনে হচ্ছে, যেন আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কিছু আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে!“

তার দু’চোখ ভরে এলো এক অজানা বেদনায়, যা মুক্তির আনন্দকে গ্রাস করে এক অসহনীয় শূন্যতার জন্ম দিল।হাতে ধরা ভিসার কাগজ। সেই কাগজটি যেন তার বহু আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির ইশতেহার নয়, বরং জাভিয়ানের চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যানের শীতল সিলমোহর।তান্বীর চোখের কোণ বেয়ে হঠাৎই এক ফোঁটা উষ্ণ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। তা গাল স্পর্শ করার আগেই সে নিজেকে প্রশ্ন করলো—এই অশ্রু কেন? এক মুহূর্তের জন্য সে তার নিজের প্রতিক্রিয়াকেই বিশ্বাস করতে পারল না। তার মনের গভীরে, তীব্র যন্ত্রণায় সে ভাবলো “তার মানে, জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী কোনোদিনই আমাকে চায়নি। তার কাছে আমি ছিলাম স্রেফ একজন বাইরের মানুষ, তার জীবনের একটি অস্থায়ী প্রয়োজনীয় উপলক্ষ মাত্র। এখন তার কাজ শেষ, তাই এই আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে আমাকে বিদায় করে দিচ্ছে!“

সে দ্রুত হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সেই অশ্রুবিন্দু মুছে ফেললো।নিজের ভেতরের দুর্বলতা এবং আবেগিক আত্মসমর্পণকে জোর করে লুকিয়ে ফেলতে চাইছে।
তান্বী নিজের মনকে তীব্র তিরস্কার করে বললো “আমি কেন কাঁদছি? আমার তো কাঁদার কথা নয়! আমার তো তার প্রতি এক বিন্দুও কোনো ব্যক্তিগত অনুভূতি নেই! আমি তো প্রতি মুহূর্তে এই বন্ধন থেকে মুক্তি চেয়েছি! তবে এই যন্ত্রণা কেন? আমার এই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আমার জন্য একটুও আনন্দ নিয়ে এলো না কেন?

এই মিথ্যা সান্ত্বনা তার ভেতরের তীব্র কষ্টকে থামাতে পারল না। জাভিয়ানের নিষ্করুণ বিদায়—যা ছিল চরম ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষের চূড়ান্ত উদাসীনতা—তা তান্বীর হৃদয়ের গহীনে এক অবিশ্বাস্য শূন্যতা এবং গভীর প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বোধ তৈরি করে গেল। এখন এই শূন্যতাই তার মুক্তিকে ম্লান করে দিয়ে এক তীব্র বেদনায় পরিণত হলো।

তান্বী যখন তার মুক্তির বিষাদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক সেই সময়ে, শহরের অন্য প্রান্তে, মেইলস্ট্রোমের গোপন কার্যালয়ে একটি এনক্রিপ্টেড ফোন কল এলো।মেইনস্ট্রোম তখনও তার কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি নিয়ে নিজের চেয়ারে বসেছিলো। ফোনের রিংটোনটি ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও চাপা, যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু জরুরি কলের জন্য ব্যবহৃত হয়। মেইশস্ট্রোম দ্রুত ফোনটি ধরলো তার কণ্ঠস্বর ছিলো শীতল ও কর্তৃত্বপূর্ণ) “বলো“

অপর প্রান্তর কণ্ঠস্বর ছিলো সতর্ক ও দ্রুত “স্যার, খবর নিশ্চিত। আপনার চরম শত্রুপক্ষ ‘দ্য ফিনিক্স’—সে আগামীকাল রাতে রওনা হচ্ছে। ফ্লাইট ডিটেইলস আমরা পেয়েছি। সে রাতের প্লেনেই উঠবে।”

এই খবর শুনে মেইলস্ট্রোমের চোখদুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। তার চেহারায় মুহূর্তের ক্লান্তি দূর হয়ে এলো হিংস্র সংকল্পের কঠোরতা। এই শত্রুকে সে বহু বছর ধরে খুঁজছে। মেইলস্ট্রোমের কণ্ঠস্বর ইস্পাতের মতো ধারালো “প্রস্তুত হও। আমি এই সুযোগ হাতছাড়া করতে পারবো না।“

অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এলো “স্যার, প্লেন হলো সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা। এর পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।”

মেইনস্ট্রোম হাসলো, সেই হাসি ছিলো ভয়ংকর তারপর সে গর্জন করে বললো “পরিণতি আমার অজানা নয়। কালকের ফ্লাইটেই হামলা হবে। ফিনিক্সকে আমি আমার হাতেই চাই। মৃত্যু বা আত্মসমর্পণ—দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। দ্রুত পরিকল্পনা তৈরি করো।“

মেইলস্ট্রোম ফোনটি রাখলো। তার মুখে তখন বিজয়ের এক নিষ্ঠুর হাসি। তান্বীকে পাওয়ার পরিকল্পনার পর এখন তার মনোযোগ সম্পূর্ণভাবে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘দ্য ফিনিক্স’-এর দিকে। এই আক্রমণ হবে তার ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রদর্শনী।

চলবে……….

নোট: প্রিয় পাঠকগণ!রিচেক করিনি ভুলত্রুটি থাকলে সাথে সাথে মন্তব্য করে জানিয়ে দিবেন। আর হ্যাঁ যেহেতু এটা একটা মাফিয়া প্লট তাই কাহিনী একটু ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে কারন এখানে যেকোনো এক চরিত্র নয় কয়েকটা চরিত্র নিয়ে লিখতে হচ্ছে। সবাই মেইন লিড হিসেবে ধরা যায়। সব চরিত্রের সমান গুরুত্ব দেয়া হবে এই গল্পে। আর হ্যাঁ ভবিষ্যতে কাহিনী না পড়ে প্লিজ কেউ উল্টাপাল্টা মন্তব্য করবেন না। আমি কাহিনী যেভাবে আমার ব্রেইনে সাজিয়েছি ওভাবেই চলবে গল্প।

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply