Golpo ডার্ক রোমান্স ডিজায়ার আনলিশড

ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৯


ডিজায়ার_আনলিশড ❤️‍🔥

✍️ সাবিলা সাবি

—পর্ব-১৯—-

বৃষ্টিতে ভিজে, বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করেও জাভিয়ান কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলো। সে তখনো তান্বীকে আলতো করে ধরে ছিল। চোখ বন্ধ তান্বীর কান্না তখনো থামেনি, কিন্তু তার শরীরের বাঁধন আলগা হলো না। জাভিয়ান শান্ত,নিচু কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললো “চলো। এখানে থেকে তোমার ঠান্ডা লাগছে।

এটা বলেই তান্বিকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, অত্যন্ত যত্নে তান্বীকে কোলে তুলে নিলো জাভিয়ান। ভেজা, কাদামাখা শরীর নিয়েই সে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। জাভিয়ান তাকে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো।

সারাপথ তান্বী ছিল সম্পূর্ণ নিথর, যেন তার শরীর থেকে প্রাণশক্তি উধাও হয়ে গেছে। কোনো কথা নেই, কোনো কান্না নেই, এমনকি কোনো নড়াচড়াও নেই। সে শুধু জানালার কাঁচের বাইরে জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার ভেতরের সমস্ত রাগ, ঘৃণা এবং কষ্ট যেন এক গভীর, হিমশীতল নীরবতায় পর্যবসিত হয়েছে।

জাভিয়ান বারবার তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলো, কিন্তু তান্বীর সেই শূন্য দৃষ্টি দেখে তার মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হলো না।
.
.
.
ভিলা এস্পেরেন্জায় পৌঁছানোর পর জাভিয়ান নিজেই তান্বীকে কোলে করে ভেতরে নিয়ে গেলো। কাতারিনা এবং বাকি কর্মচারীরা তাদের এমন বিধ্বস্ত ও অপরিষ্কার অবস্থায় দেখে হতবাক হয়ে গেল। দ্রুত তান্বীকে উষ্ণ পোশাক পরানোর ব্যবস্থা হলো এবং গরম কফি দেওয়া হলো।

তারপর সেই ঝুম বৃষ্টি পর পেরিয়ে গেল দীর্ঘ তিনটি দিন। তান্বীর কক্ষটি পরিণত হলো এক নিস্তব্ধ কারাগার-এ। ঘরের টেবিলে রাখা ছিল জাভিয়ানের আনা খাবার—দামি এবং যত্নের সঙ্গে সাজানো। জাভিয়ান নিজে যখন প্লেট হাতে নিয়ে এলো, তখন তান্বী শুধু ঘরের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। সে খাবারের দিকে ফিরেও তাকালো না। জাভিয়ানের সমস্ত আদেশ দৃঢ়ভাবে নিস্পৃহ তান্বীর কাছে কোনো মূল্য পেল না। মনে হচ্ছিল, সে ক্ষুধা বা শরীরের প্রয়োজন—সবকিছুকেই যেন অস্বীকার করেছে, তার শোকের কাছে।

জাভিয়ান বারবার তার কাছে আসতো। অনুশোচনা তার চোখে স্পষ্ট। সে যতবারই মাথা নিচু করে অনুতপ্ত হতে চাওয়ার চেষ্টা করলো বা এলিনার সেই ভয়ংকর সত্য সম্পর্কে কথা বলতে চাইলো—তান্বী শুধু একবার শূন্য, পাথরের মতো চোখে তার দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে কোনো অভিযোগ ছিল না, কোনো রাগও ছিল না; ছিল কেবল এক অপ্রতিরোধ্য শূন্যতা, যা জাভিয়ানের প্রতিটি শব্দকে গ্রাস করে ফেলছিল। জাভিয়ান অনুভব করলো, তার প্রতিটি বাক্য যেন একটি দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে।
তান্বীর সেই নিরব, স্থির উপস্থিতি জাভিয়ানের কাছে ছিল এক চরম মানসিক টর্চার। সে ঘরের এক কোণে এমনভাবে বসে থাকত, যেন জাভিয়ানের উপস্থিতি তার কাছে একটি অস্বস্তিকর নীরবতা মাত্র।

জাভিয়ান এমন পরিস্থিতি কল্পনাও করেনি। সে তার সাথে ঝগড়া করলে, চিৎকার করলে বা প্রতিবাদ করলে নিয়ন্ত্রণ নিতে পারতো। কিন্তু এই নিদারুণ নীরবতা, এই সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান জাভিয়ানকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তুললো।

সে রাতভর বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল।
জাভিয়ানের ভাবনাতে তখন তার নিজের অস্থিরতা এবং বুকে চেপে আসা ব্যথা অনুভব করে আর মনে মনে ভাবে “সে আমাকে ঘৃণা করুক, চিৎকার করুক সারাদিন বকবক করুক ঝগড়া করুক আমার সাথে—কিন্তু এভাবে চুপ করে থাকলে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে কেন? তার নীরবতা যেন প্রতি মুহূর্তে আমাকে চাবুক মারছে। এই মেয়েটা আমার সমস্ত ক্ষমতাকে এত সহজে ভেঙে দিতে পারলো?“

তান্বীর সেই নীরবতা ছিল জাভিয়ানের অহংকার এবং ক্ষমতার ওপর এক শীতল আঘাত।সে বুঝতে পারলো,সে তার জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে। জাভিয়ান আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে, এই নীরবতা ভাঙার জন্য একটি চরম সিদ্ধান্ত নিলো।

চতুর্থ দিনের রাত। তান্বীর সেই দীর্ঘ, অচঞ্চল নীরবতা জাভিয়ানের সমস্ত হিসেব উল্টে দিয়েছিল। সে তার অস্থিরতা তখন চরম সীমায়। সে কোনো হুমকি বা প্রতিশোধের কৌশল ব্যবহার করে এই নীরবতা ভাঙতে পারছিলো না। এই অবস্থায়, জাভিয়ান কোনো এক গোপন সূত্র থেকে জানতে পারলো আজ তান্বীর জন্মদিন।

এই তথ্য তার কাছে এল এক নতুন সুযোগ হিসেবে। নিজের সমস্ত শীতল যুক্তিকে ক্ষণিকের জন্য একপাশে রেখে, জাভিয়ান এমন একটি পদক্ষেপ নিলো, যা ছিল তার সমস্ত কঠোর ব্যক্তিত্বের বাইরে—কারণ সে জানত, শুধু কোমলতাই এখন এই নীরবতার কঠিন দেয়াল ভাঙতে পারবে।

রাত তখন গভীর। জাভিয়ান হাতে একটি মাঝারি আকারের সুন্দর চকলেট কেক, একগুচ্ছ তাজা গোলাপ ফুল এবং যত্ন সহকারে মোড়ানো কিছু বিলাসবহুল উপহার নিয়ে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো।

সে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। ঘরের মৃদু ল্যাম্পের আলোয় তান্বী তখনও বিছানার এক কোণে জড়বস্তুর মতো বসে ছিল। জাভিয়ান নিচু, শান্ত কণ্ঠে, সামান্য দ্বিধা ও উদ্বেগ নিয়ে বললো “হ্যাপি বার্থডে,মিসেস ট্রমা।“

তান্বী হঠাৎ চমকে উঠলো। সে জাভিয়ানের দিকে তাকালো। তার মনের ভেতর এক তীব্র প্রশ্ন জাগলো: ও তো জন্মদিনের কথা কাউকে বলেনি! জাভিয়ান কিভাবে জানলো? তার চোখে এক ঝলক কৌতূহল ফুটে উঠলো।

জাভিয়ান কেক, ফুল এবং উপহারগুলো টেবিলের ওপর রাখলো। কেকের ওপর জ্বলন্ত মোমবাতিগুলো ঘরের আবছা অন্ধকারকে আরও আকর্ষণীয় করে তুললো।

কেকের ওপরের মোমবাতির সেই উষ্ণ আলো যখন তান্বীর চোখে পড়লো, তখন তার এতদিনকার জমে থাকা কঠিন নীরবতা মুহূর্তেই ভেঙে গেল। এই কেক… এই দিন…অসহ্য এক যন্ত্রণা তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তান্বী। তার কান্নার তীব্রতা এমন ছিল যে সে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লো।

তান্বীর কান্নার কারণ, তার মনে পড়লো, তার জন্মদিনে সবসময় তার বোন এলিনা নিজের হাতে কেক তৈরি করতো। সেই হাতে তৈরি কেকের স্বাদ, তার ঘ্রাণ এবং সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার স্মৃতি এই মুহূর্তে তার কাছে এলিনার মৃত্যুর চরম সত্যকে আরও একবার জীবন্ত ও নির্মম করে তুললো। এই কেকটা তার জন্য ছিল ভালোবাসার প্রতীক, কিন্তু এখন সেটা হয়ে উঠলো এলিনার শূন্যতার এক জ্বলন্ত প্রতীক। এলিনার স্মৃতির তীব্র আঘাতে তান্বী আবার একবার সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হলো। জাভিয়ানের আনা কেক, ফুল বা উপহার—কোনো কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সে শুধু তার বোনকে হারানোর সেই নিদারুণ স্মৃতিতেই ডুবে গেল।

তান্বীর কান্না জাভিয়ানের হৃদয়ে আবারও সেই তীব্র, পরিচিত ব্যথা ফিরিয়ে আনলো।সে বুঝতে পারলো, এই আবেগের কাছে তার সব ক্ষমতা তুচ্ছ।

তান্বীর তীব্র কান্নায় জাভিয়ান আর নিজেকে দূরে রাখতে পারলো না। তৎক্ষণাৎ সে দ্রুত এগিয়ে এসে মেঝেতে বসে পড়লে এবং তান্বীকে পরম যত্নে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তার এই আলতো ছোঁয়া ছিল যন্ত্রণাক্লিষ্ট ক্ষমাপ্রার্থী ও নীরব সান্ত্বনাকারী।

জাভিয়ান নিচু, শান্ত, এবং গভীর অনুতপ্ত কণ্ঠে বললো “আমি জানি তুমি অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছো। আম সরি। এখন শান্ত হও, প্লিজ।

জাভিয়ান তাকে কিছুক্ষণ ধরে সান্ত্বনা দিলো। তারপর তার ভাঙা কণ্ঠে অনুরোধ করলো।আস্তে করে বললো “চলো, কেকটা কাটো। আজতো ও তোমার জন্মদিন।“

কিন্তু তান্বী মাথা নেড়ে মানা করে দিলো। কান্না থামলেও তার সমস্ত শরীর তখন ক্লান্তিতে নিথর। সেই কেকের দিকে তার আর চোখ গেল না। সে উঠে ধীরে ধীরে বিছানায় গেল এবং চুপচাপ শুয়ে পড়লো, দেয়ালের দিকে মুখ করে। তার নীরবতা ফিরে এলো—তবে এবার তা ক্রোধ নয়, বরং গভীর, নিঃশব্দ শোকের।

জাভিয়ান বুঝতে পারলো, এই মুহূর্তে কোনো জোর করা বৃথা। সে কেক, ফুল আর উপহারগুলো টেবিলের ওপর সেইভাবেই রেখে দিলো। সে আর কোনো কথা বললো না। শুধু তান্বীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, নিজের ভুল এবং তার অপরাধের ভার অনুভব করতে করতে।
.
.
.
পরের দিন সকালে, তান্বী ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলে দেখলো—জাভিয়ান ঘরে নেই। ঘর এখন শান্ত। কাল রাতের আবেগের ঝড়ের কোনো চিহ্ন সেখানে নেই, শুধু নীরবতা। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো তান্বী। তার চোখ গেল টেবিলের দিকে। সেখানে কাল রাতে জাভিয়ানের আনা সব জিনিসই রাখা—চকলেট কেক, একগুচ্ছ গোলাপ ফুল এবং মোড়ক লাগানো উপহারগুলো।

বহু দিনের কষ্টের পর, বহু দিনের নীরবতার পর—তার ঠোঁটে তখন মৃদু একটুকরো হাসি ফুটে উঠলো। এই হাসি ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য। হয়তো জাভিয়ানের সেই নীরব সান্ত্বনা এবং অপ্রত্যাশিত উপহারের প্রতি সামান্য কৌতূহল তার মনের তীব্র বরফ গলাতে শুরু করেছিল।

তান্বী ধীরে ধীরে টেবিলের কাছে গেল। সে একে একে উপহারগুলো খুলতে শুরু করলো। ভেতরে ছিল একটি অত্যাধুনিক ক্যামেরা, একটি নোটবুক এবং অন্যান্য শৌখিন জিনিস। উপহারগুলো তার মনে কোনও বড় আনন্দ দিল না, কিন্তু দীর্ঘ দিনের মানসিক যন্ত্রণার মাঝে এই কৌতূহল বা সামান্য কিছু জিনিস তাকে একটুখানি মানসিক শান্তি দিলো। সে তখন উপহারগুলো দেখতে দেখতে জাভিয়ানের প্রতি তার জমে থাকা রাগের কঠিন দেয়াল থেকে সামান্যতম হলেও বিচ্যুত হলো।
.
.
.
সূর্য যখন ডুবে গেছে, ভিলা এস্পেরেন্জা তখন সন্ধ্যার আবছা আলোয় ঢাকা। জাভিয়ান দীর্ঘ দিনের মানসিক চাপ নিয়ে ফিরে এলো। সে ভেতরে প্রবেশ করলো। তার মুখে তখনো সেই উদ্বেগ ও ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।

তান্বী উপহারগুলোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকালো। কণ্ঠস্বরে এক সূক্ষ্ম কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে বললো “ধন্যবাদ। আমার জন্মদিনের জন্য উপহার আনার জন্য।“

জাভিয়ানের চোখে একরাশ স্বস্তি নেমে এলো,মনে হলো সে চরম বিপদ থেকে মুক্তি পেলো। এই কঠিন নীরবতা অবশেষে ভাঙলো। জাভিয়ান আলতো হাসি দিয়ে বললো “ফাইনালি! কথা বললে! উফ… আমি তো সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই নন স্টপ রেডিও বোধহয় একবারে ড্যামেজ হয়ে গেছে আর কখনো বাজবে না“।

মূহুর্তের সেই স্বস্তি কেটে গেল। তান্বী এবার কোনো উত্তর না দিয়ে, তার চোখে অনুসন্ধিৎসু, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তান্বী আচমকা, কঠিন ও সরাসরি প্রশ্ন করে বসলো “কিন্তু… আপনি সেদিন দুপুরে রাস্তার পাশে কবরস্থানে কেন গিয়েছিলেন?

তান্বীর সেই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে জাভিয়ানের স্থির মুখের পেশীগুলি যেন সামান্য কেঁপে উঠলো।সে অপ্রস্তুত ছিলো। কবরস্থানের সেই রহস্যময় স্থানটি এভাবে প্রকাশ্যে আসবে, তা সে ভাবেনি। জাভিয়ান এক মুহূর্ত নীরব রইল। তান্বীর চোখে তখন জবাব জানার তীব্র অপেক্ষা।

জাভিয়ান সাথে সাথেই নিজের সমস্ত দুর্বলতা ঢেকে ফেলল। তার চোখে ফিরে এলো সেই পুরোনো শীতল, নিয়ন্ত্রণকারী দৃষ্টি। সে তখন আরো নিচু স্বরে কিন্তু তীক্ষ্ণ, চরম রূঢ়তা মিশিয়ে বললো “এটা আমার অত্যন্ত পার্সোনাল ম্যাটার। নন অফ ইউর বিজন্যাস! তোমার এতে নাক গলানোর কোনো দরকার নেই। আর লিসন, ভবিষ্যতে আমাকে কী প্রশ্ন করবে, সেই লিমিট মনে রাখবে।

জাভিয়ানের এই রূঢ়, ছুরির ফলার মতো প্রত্যাখ্যান তান্বীর কাছে একটি নির্মম আঘাত হয়ে এলো। তার মুখটা তত্ক্ষণাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে বুঝলো, সে ভুল ভেবেছিল—ভুল ছিল তার সেই মৃদু হাসি এবং কৃতজ্ঞতা। সে ভেবেছিল, তাকে থাপ্পড় মারা আর আলিঙ্গনের সেই চরম মুহূর্তের পর, জাভিয়ান হয়তো তাকে অন্তত সামান্য হলেও ‘নিজের মানুষ’ ভাবতে শুরু করেছে।

কিন্তু এই কঠোর জবাব প্রমাণ করলো—সে জাভিয়ানের কাছে একজন বন্দী মাত্র, এখনও সে বাইরের লোকই রয়ে গেছে। তার হৃদয়ের কোনও কোণে তান্বীর ঠাঁই নেই।তার ব্যক্তিগত জীবনে তান্বীর কোনো অধিকার নেই।

এই নির্মম সত্য উপলব্ধি করে তান্বীর মনের মধ্যে তীব্র কষ্ট ও ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠলো। নিজের বোকামি ও সেই বৃথা আশার জন্য তার ক্ষোভ হলো। সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো, তার ভেতরের সেই প্রচণ্ড ক্রোধ জাভিয়ানের চোখে ধরা না পড়র প্রয়াসে।
.
.
.

সন্ধ্যায়, ভিলা এস্পেরেন্জা থেকে বেরিয়ে এসে লুসিয়া তার ইউনিভার্সিটির— ইউনিভার্সিটি দে লা পাজ-এর (Universidad de la Paz) ক্যাম্পাসের কাছে একটি পাথরের বেঞ্চে তার বান্ধবী মার্তার সাথে বসেছিল। হাতে কফির কাপ, সে তখন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় মগ্ন।

ঠিক সেই সময় লুসিয়া জানতে পারলো—তার বয়ফ্রেন্ড, আলেক্সান্দ্র, যার রেকর্ডিং ডেডলাইনের জন্য সে এত তাড়া দেখাচ্ছিল—অন্য একটি মেয়েকে দিয়ে তার সেই কাঙ্ক্ষিত মিউজিক রেকর্ডিং শেষ করেছে। শুধু তাই নয়, সে শুনেছে আলেক্সান্দ্রো এখন সেই মেয়েটার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ।

লুসিয়া মুহূর্তের জন্যেও হতাশ হলো না। বরং তার ঠোঁটে এক শীতল হাসি ফুটে উঠলো।লুসিয়ার মনে মনে স্বস্তি ও নির্লিপ্তির সঙ্গে ভাবলো “ভালোই হলো! এমনিতেও আমি তোকে শুধু মিউজিকের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছিলাম। যেহেতু তুই অন্য কারো পাল্লায় পড়েছিস, আমার আর সরে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। আমার সময় বাঁচলো।“

লুসিয়া নির্লিপ্তভাবে নিজের সুবিধা-অসুবিধা বিচার করে নিল।

কিন্তু ঘটনা অন্য বিপত্তি নিয়ে এলো। লুসিয়া যখন বান্ধবীর সাথে হাসি-ঠাট্টায় মগ্ন, তখনই তীব্র ব্রেকের শব্দ করে একটি কালো স্পোর্টস কার তাদের সামনে এসে থামলো। গাড়ি থেকে নেমে এলো আলেক্সান্দ্র—তার মুখে রাগের স্পষ্ট ছাপ। সে সোজা লুসিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। আলেক্সান্দ্র কঠোর স্বরে আদেশ করলো “গাড়িতে বসো! এক্ষুনি।

লুসিয়া অবাক হলো। তার নির্লিপ্ততা তখন রাগে পরিণত হলো। সে কঠিন কণ্ঠে বললো “আমি তোমার সাথে কোথাও যাবো না। আমার কাজ শেষ।

আলেক্সান্দ্র আর কোনো কথা বললো না। সে হঠাৎ করেই লুসিয়ার হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে তাকে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।

লুসিয়ার বান্ধবী মার্তা হতভম্ব হয়ে ঘটনাটি দেখছিল। সে কোনো বাধা দেয়নি, কারণ সে ভেবেছিল: ওরা তো বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড। হয়তো লুসিয়া কোনো কারণে অভিমান করেছে, আর আলেক্সান্দ্র মান ভাঙাতে জোর করছে।

বন্ধুর ভুল বোঝার সুযোগ নিয়ে,আলেক্সান্দ্র দ্রুত লুসিয়াকে জোর করে গাড়িতে বসিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল এবং তীব্র গতিতে ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল। লুসিয়া আবার অপহৃত হলো, কিন্তু এবার জাভিয়ানের কোনো শত্রুর হাতে নয়—বরং নিজেরই তৈরি করা প্রতারণার জালে।

আলেক্সান্দ্র ক্যাম্পাস থেকে একটু দূরে স্থানে গাড়ি থামালো। গাড়ি থামতেই লুসিয়া দ্রুত কথা শুরু করলো।সে কঠোর ও স্পষ্ট কণ্ঠে বললো “তুমি যেহেতু অন্য মেয়েকে আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন (মিউজিক রেকর্ডিং) দিয়ে দিয়েছো, আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ। লেটস ব্রেকআপ। এবার আমাকে নামতে দাও!গাড়ি থেকে।“

আলেক্সান্দ্র লুসিয়ার দিকে ঘুরলো। তার চোখে এখন আর প্রেমের ভান নেই, আছে শুধু চরম অহংকার এবং অধিকারবোধ। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো “এত সহজে? আমিতো তোমাকে এখনও পুরোপুরি পেলাম না। আমি তোমার জন্য যে সময় আর অর্থ বিনিয়োগ করেছি, তার মূল্য কি দেবে না? আমি যা চেয়েছি, তার কিছুই তো তুমি দাওনি। শুধু গালে কিস ছাড়া আর কিছুই না,এখন বলছো ব্রেকআপ? ঠিক আছে ব্রেকআপ, কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে আমার পাওনা দেবে! আমার সাথে এখনি এখানেই সে/ক্স করবে তাহলে আমি তোমাকে যেতে দিবো।“

লুসিয়া তার এই চরম অধিকারবোধের কথায় রাগে ফেটে পড়লো। তার সমস্ত ঘৃণা তখন জেগে উঠলো।সে আচমকা কষে একটি থাপ্পড় আলেক্সান্দ্রোর গালে বসিয়ে দিয়ে বললো “তোমার পাওনা নিবে বলেছিলে না?এই নাও এটাই তোমার পাওনা। তোমায় আমি ভালোবাসি না! কেন তোমাকে আমার সবকিছু দেবো? আমাকে ছেড়ে দাও!

থাপ্পড় খেয়ে আলেক্সান্দ্রর চোখ রাগে জ্বলজ্বল করে উঠলো। এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দিল, লুসিয়া নিজেরই তৈরি করা প্রতারণার জালে ফেঁসে গেছে।

আলেক্সান্দ্রোর চোখে রাগের আগুন জ্বলে উঠলো। তার প্রেমের মুখোশ ছিঁড়ে গেল; বেরিয়ে এলো চরম কর্তৃত্ববাদী সত্তা। সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে, লুসিয়াকে টেনে হিঁচড়ে সিটের মসৃণ চামড়ার ওপর শুইয়ে দিলো। তার সমস্ত শরীরী শক্তি প্রয়োগ করে সে লুসিয়াকে চেপে ধরলো। গাড়িটা ছিলো সাউন্ডপ্রুফ। লুসিয়া মরিয়া হয়ে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু তার শক্তি আলেক্সান্দ্রোর আগ্রাসনের কাছে যথেষ্ট ছিল না। সে তখন নিজেকে এক জীবন্ত ফাঁদে বন্দি অনুভব করলো।

হঠাৎ করেই, বাইরে থেকে একটি ভারী ধাতব বস্তুর আঘাতে গাড়ির সামনের দরজার কাঁচ ভয়াবহ শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তীক্ষ্ণ কাঁচের টুকরোগুলো লুসিয়া এবং আলেক্সান্দ্রোর দুজনের ওপরই ছিটকে পড়লো। তাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

ভাঙা কাঁচের ফ্রেমের ফাঁক দিয়ে ফারহান দ্রুত হাত গলিয়ে গাড়ির কেন্দ্রীয় লকটি খুলে ফেললো। চোখের পলকে দরজা খুলে গেল। লুসিয়া বিস্ফারিত চোখে দেখলো, ফারহান—তান্বীর ভাই—সেখানে দাঁড়িয়ে, যার চোখে শুধুই উন্মত্ত ক্রোধ।

ফারহান এক লহমায় আলেক্সান্দ্রোর চুলের মুঠি ধরে টেনে গাড়ি থেকে বের করে আনলো। এর পরের মুহূর্তগুলো ছিল নীরব ধ্বংসলীলা। ফারহান কোনো কথা বললো না;সে দাঁতে দাঁত চেপে ইচ্ছেমতো আঘাত করতে লাগলো। সেই আক্রমণ ছিল বন্য, অপ্রতিরোধ্য, যেন সে আলেক্সান্দ্রোকে নয়, নিজের জীবনের জমে থাকা সমস্ত হতাশা ও ক্রোধকে মারছে।

ছেলেটি প্রতিরোধ করার সামান্য সুযোগও পেল না এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কাদার ওপর অচেতন হয়ে পড়লো—মনে হলো যেন সে আর বাঁচবে না।

দৃশ্যটির চরম হিংস্রতা দেখে লুসিয়া ভয় পেয়ে গেল। সে নিজেকে মুক্ত করে দ্রুত গাড়ির বাইরে এলো। সে ভয় ও উদ্বেগে চিৎকার করে বললো “আরে! তুমি কী করছো? থামো! এ তো মরে যাচ্ছে!

লুসিয়া তখন মরিয়া হয়ে ফারহানের দিকে এগিয়ে গেল এবং তাকে টেনে ধরে মার থামানোর চেষ্টা করলো।আর আর্তনাদ করে বললো “প্লিজ থামো! এখুনি পুলিশ চলে আসবে! আমাদের চলে যেতে হবে! এখানে থেকে।“

লুসিয়ার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ফারহান একটা চূড়ান্ত ধাক্কা দিয়ে ছেলেটিকে ফেলে দিলো এবং সঙ্গে সঙ্গে লুসিয়া তাকে নিয়ে দ্রুত এলাকা ছেড়ে সরে গেলো। পেছনে পড়ে রইলো ভাঙা গাড়ি, আর অচেতন, গুরুতর আহত একটি শরীর।

আলেক্সান্দ্রোকে প্রায় মরার মতো ফেলে রেখে লুসিয়া ফারহানকে নিয়ে কিছুটা দূরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে থামলো। গভীর রাতের অন্ধকারে দুজনেই তখন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। লুসিয়া ভয়, রাগ এবং শারীরিক কষ্টে কাঁপছিল। ফারহান কষ্টে শ্বাস নিতে নিতে, দ্রুত কণ্ঠে বললো “পুলিশ যদি আসেও, উল্টো ওই ছেলেই ফাঁসবে! ও তোমাকে… (এক মুহূর্ত থেমে) ও তোমার উপর জোর খাটাতে চেয়েছিল।

লুসিয়া আতঙ্কিত ও তীব্র হতাশায় বললো “ আরে! তুমি কী বলছো? আলেক্সান্দ্রোর বাবা মেক্সিকোর একজন ভয়ঙ্কর ক্ষমতাশালী শিল্পপতি! পুলিশ ওর কথা শুনবে!

ফারহান তখন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে, নিজের শক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললো “তাতে কী? তোমার বাবা-ভাইও তো কম নয়।“ লুসিয়ার চোখে এক তীব্র, করুণ হতাশা নেমে এলো।
সে কঠিন ও বিষণ্ণ কন্ঠস্বরে তিক্ততা নিয়ে স্পষ্ট করে বললো “আমার ভাই? জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী—সে তো আমাকেই মেরেই ফেলতে বলেছিলো তোমাকে! সে আমার হয়ে কিছুই করবে না।“

ফারহান নীরব রইলো। লুসিয়ার এই চরম পারিবারিক সত্যের স্বীকারোক্তি তাদের সম্পর্কের জটিলতা প্রকাশ করলো।

লুসিয়া তখন হঠাৎ অন্য দিকে মনোযোগ দিলো। তারপর বিস্ময়ের সঙ্গে, ফারহানের দিকে ঘুরে বললো “তুমি! তুমি এখানে কেন? আর তুমি কিভাবে জানলে আমি এখানে?

ফারহান গম্ভীর হয়ে পকেট থেকে একটি ছোট মোড়ক বের করে বললো “আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম। কারণ আজ আমার বোন তান্বীর বার্থডে। আমি তোমার কাছে ওর জন্য একটা উপহার দিতে চাই।“

লুসিয়া অবাক হলো। ফারহান এমন একজন বিদ্রোহী ভাই, এত ঝুঁকি নিয়ে, এত বড় একটা সংঘাতের জন্ম দিয়ে, এখানে এসেছেন শুধুমাত্র তার বোনের জন্মদিনের উপহার পৌঁছে দিতে! লুসিয়া সেই রহস্যময় ছোট উপহারটির দিকে তাকালো, বুঝতে পারলো এই ভাই-বোনের জটিল সম্পর্কের জালেও ভালোবাসা কতোটা প্রখর।

হঠাৎ লুসিয়ার চিন্তা হলো তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু তার ফোন তখন বন্ধ। তার গাড়িও সঙ্গে নেই। লুসিয়া হাত বাড়িয়ে বললো “তোমার ফোনটা দাও। একটা ‘উভার’ (Uber) কল করি।

ফারহানের কণ্ঠস্বরে কোনো পরিবর্তন নেই, কিন্তু চোখ স্থির করে বললো “চলো, আমি তোমাকে পৌঁছে দিই বাড়িতে।“

লুসিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ফারহানের এই হঠাৎ যত্ন নেওয়া তার কাছে অস্বাভাবিক লাগলো।সে বিদ্রুপের সুরে বললো “বাহ, আমার প্রতি এতো কেয়ার হঠাৎ?“

ফারহান মাথা নেড়ে বললো “তোমার প্রতি নয়, ওই উপহারটার প্রতি। যদি বাই এনি চান্স তুমি উপহারটা গাড়িতে ফেলে রাখো, তাই।“

লুসিয়া সামান্য লজ্জিত হলেও কিছু বললো না। ফারহানের এই শীতল জবাব তার আবেগকে আবারও দূরে ঠেলে দিলো। তারা দুজনে হাঁটা শুরু করলো। লুসিয়া চারপাশ দেখতে দেখতে বললো “কোথায় যাচ্ছি আমরা? আর তোমার গাড়ি কোথায়?“

ফারহান আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো “আমার গাড়ি নেই এখানে। আর বাইক আছে, সেটা হোটেলে রেখে এসেছি।“

লুসিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো “তাহলে আমাকে পৌঁছে দেবে কী করে?“

ফারহান স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো “বাসে করে।“

লুসিয়া যেন আকাশ থেকে পড়লো। মেক্সিকোর বাসে চড়া তার কাছে ছিল অকল্পনীয়। সে জীবনেও বাসে চড়েনি, আর বাসের ভিড় বা গন্ধ তার একদম অপছন্দ। তবে নিরুপায়। রাতে এত সহজে অন্য কোনো পরিবহন পাওয়া কঠিন। তাই বাধ্যতামূলকভাবে সে ফারহানের সাথে বাসে উঠে পড়লো।

বাসে ছিল অতিরিক্ত ভিড়। কারন এখন অফিস ছুটির সময়।দাঁড়ানোর সামান্য জায়গাটুকুও নেই। তারা দুজন বাসের পেছনের দিকে, জানালার পাশে কোনোমতে দাঁড়িয়ে রইলো। ভিড়ের ঠেলায় লুসিয়া ক্রমাগত অস্বস্তিবোধ করছিল। সে যে পোশাকে ছিল, তা ছিল সন্ধ্যার আড্ডার জন্য উপযুক্ত, কিন্তু এই বাসের ভিড়ে তা একেবারেই বেমানান। তার নাভি এবং বুকের অংশ কিছুটা দেখা যাচ্ছিলো। লুসিয়া নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।

হঠাৎই ফারহান অত্যন্ত সতর্কতার সাথে লুসিয়ার দুই পাশে জানালার কাঁচের ওপর দুই হাত রাখলো। লুসিয়া রইলো ফারহানের দুই হাতের মাঝখানে—ফারহান তাকে বাইরের ভিড় থেকে রক্ষা করার জন্য এক অদৃশ্য বেষ্টনী তৈরি করেছে।

লুসিয়া আরও অসস্থি ফিল করলো। ফারহান এক মুহূর্ত লুসিয়ার পোশাকের দিকে তাকালো, তারপর দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। সে কিছু না বলে নিজের গায়ের জ্যাকেটটা খুলে লুসিয়ার বুকের ওপর দিয়ে দিলো এবং অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল। এই অপ্রত্যাশিত যত্ন লুসিয়াকে স্তব্ধ করে দিলো।

এরপর কয়েকবার বাসের ঝাকিতে ফারহান লুসিয়ার ওপর পড়ে গেলো। তাদের শরীর একদম কাছে চলে এলো। একবার ঝাঁকুনিতে তাদের মুখ একদম কাছে চলে এলো—তাদের নিশ্বাস প্রায় এক হয়ে যাচ্ছিলো।

ফারহান সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো, যেন লুসিয়ার কাছে তার এই ঘনিষ্ঠতা চরম অস্বস্তির কারণ না হয়। লুসিয়া এক প্রকার বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই প্রথম সে ফারহানকে এতো কাছ থেকে দেখছে। সে লক্ষ্য করলো, বাংলাদেশের হলেও ফারহান যথেষ্ট হ্যান্ডসাম ছিল—তার চোখের গভীরতা এবং মুখের কাঠিন্য লুসিয়াকে এক নতুন ভাবে আকর্ষণ করছিল।

লুসিয়া তখন ফাঁকা দৃষ্টিতে ফারহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে তার নিজের ভেতরের এই পরিবর্তন অনুভব করতে পারছিল। লুসিয়ার মন তখন দ্রুত নিজেকে ধমকে উঠে “ধ্যাত লুসিয়া! ওকে নিয়ে এসব কী ভাবছিস? মেক্সিকোতে ওর চেয়েও অনেক হ্যান্ডসাম ছেলের অভাব নেই! তুই জাভিয়ান আর মার্কোর বোন, আর ও—!“

লুসিয়া নিজের ভাবনাকে জোর করে থামানোর চেষ্টা করলো। ঠিক সেই মুহূর্তেই, বাসটি একটি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেলো। ভিড়ের চাপে ফারহান নিয়ন্ত্রণ হারালো। হঠাৎ করেই ফারহানের ঠোঁট গিয়ে লাগলো লুসিয়ার ঘাড়ে!
লুসিয়ার ঘাড় ছিল তার সবচেয়ে সেনসিটিভ স্পট। এই অপ্রত্যাশিত, বৈদ্যুতিক স্পর্শে লুসিয়া আকস্মিক কেঁপে উঠলো। তার সমস্ত মনোযোগ মুহূর্তের মধ্যে ফারহানের স্পর্শে নিবদ্ধ হলো।

ফারহান যেন নিজেও তীব্রভাবে ধাক্কা খেলো। সে সাথে সাথে সরে গেলো,কিন্তু ভিড়ের কারণে তাদের শরীর তখনও খুব কাছাকাছি। তবুও সে লুসিয়াকে ভিড় থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁর হাত তখনও জানালার ওপর থেকে সরায়নি। লুসিয়া সেই অস্বস্তিকর ঘনিষ্ঠতায় চোখ সরাতে পারছিল না, তার হৃদস্পন্দন তখন চরম গতিতে চলছিল।

কিছুক্ষণ পর বাসটি তাদের গন্তব্যের কাছাকাছি একটি স্টপেজে থামলো। ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেয়ে লুসিয়া দ্রুত বাস থেকে নামলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে দেখলো, ফারহানও তার পিছু পিছু নামলো।

লুসিয়া তখনো সেই আকস্মিক স্পর্শের ঘোর কাটাতে পারেনি, তার গাল সামান্য লাল হয়ে ছিল। সে অন্যদিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। ফারহান একটু দূরত্ব বজায় রেখে, শান্ত কণ্ঠে বললো “এখানেই। এখান থেকে তোমার বাড়ি কাছাকাছি।“

লুসিয়া মাথা নাড়লো। কথা বলার জন্য সে সঠিক শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। সে নিচু কণ্ঠে বললো “থ্যাংকস। তুমি… তুমি না থাকলে কী হতো,জানি না।“

ফারহান তাড়াতাড়ি কথাবার্তা শেষ করে দিতে চাইলো “ঠিক আছে। এখন আমি চলি।“

ফারহান যখন অন্যদিকে হাঁটা শুরু করলো, তখন হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে লুসিয়াকে মনে করিয়ে দিলো তার আসল উদ্দেশ্য। তার কণ্ঠস্বরে আর কোনো আবেগ নেই, শুধু দায়িত্বের সুর নিয়েই বললো “আর শোনো, উপহারটা! তান্বীকে ওটা অবশ্যই দিও। ভুলে যেও না যেন।“

লুসিয়া সেই ছোট মোড়কটির দিকে একবার তাকালো। ফারহানের এই শেষ কথাটি স্পষ্ট করে দিল—তার এই সমস্ত ঝুঁকি নেওয়ার কারণ লুসিয়া নয়, বরং তার বোন তান্বী এবং সেই উপহার। লুসিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ফারহান আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে, দ্রুত ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলো।

লুসিয়া যখন বাড়িতে পৌঁছালো, তখন তার শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে। সে সোজা তান্বীর কক্ষে গেল। তান্বী তখনো ঘরের এক কোণে নিথর বসে ছিল, তার চোখে সেই গভীর শূন্যতা। লুসিয়াস্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো, হাতে মোড়কটি নিয়ে বললো “শোন, তোমার ভাই ফারহান এটা পাঠিয়েছে। তোমার জন্মদিনের উপলক্ষে।“

উপহারের কথা শুনে তান্বীর নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল। তার চোখ জ্বলে উঠলো, কিন্তু তা শোকের নয়—ছিল চাপা রাগের আগুন। তান্বীর কণ্ঠস্বরে তীব্র ঘৃণা ও কঠিনতা ছিলো “ফারহান!ভাই তোমার হাত দিয়ে আমার জন্য উপহার পাঠিয়েছে?“

বলেই তান্বী বিছানা থেকে উঠে এলো। সে এক মুহূর্ত উপহারটির দিকে তাকালো, যেন সেটি কোনো বিষাক্ত বস্তু। তান্বী উন্মত্তের মতো মোড়কটি লুসিয়ার হাত থেকে টেনে নিয়ে বললো “তার সাহস হয় কী করে আমাকে উপহার পাঠানোর,তার পাপের জন্যই আমার বোনটা মরেছে! তার কোনো অধিকার নেই আমাকে কিছু দেওয়ার!“

এই কথা বলেই তান্বী উপহারটি ছুঁড়ে ফেলে দিলো। মোড়কটি দেয়ালে আঘাত খেয়ে মেঝেতে পড়লো। তান্বী চিৎকার করে, প্রতিটা শব্দে তীব্র আক্রোশ নিয়ে বললো “যদি আমার ভাইয়ের সাথে তোমার আবার দেখা হয়,তাকে জানিয়ে দিও—আমি উপহার ফেলে দিয়েছি! তার কোনো কিছুই আমি নেবো না!“ রাগ ও ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে তান্বী দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, লুসিয়াকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে। লুসিয়া বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

তান্বী চলে যাওয়ার পর লুসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে মেঝেতে পড়ে থাকা উপহারটি কুড়িয়ে নিলো। সে বুঝলো, এই ভাই-বোনের সম্পর্ক কত গভীর ক্ষত আর ঘৃণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। উপহারটি হাতে নিয়েই সে নিজের রুমে চলে গেল।

কক্ষে ঢুকে লুসিয়া প্রথমে ফারহানের দেওয়া জ্যাকেটটা খুলে বিছানায় রাখলো। এরপর সে যত্ন করে উপহারটি খুললো। ভেতরে ছিল একটি অত্যন্ত সুন্দর, সূক্ষ্ম কারুকার্যের লকেট। লকেটের নকশাটি ছিল প্রাচীন মেক্সিকান ধাঁচের, যা তার ব্যক্তিত্বের সাথে মানানসই।

লুসিয়া লকেটটা মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো। সে তার সমস্ত মনোযোগ লকেটের রূপে নিবিষ্ট করলো, কিন্তু তার মস্তিষ্ক তখন অন্য পথে হাঁটছিল। হঠাৎ তার মনে একটি স্বেচ্ছাচারী ফ্যান্টাসি এলো: সে দেখলো, ফারহান তার পেছনে দাঁড়িয়ে, তার শক্ত হাতে লকেটটি ধরে লুসিয়ার গলায় পরিয়ে দিচ্ছে। তার ঘাড়ের সেই স্পর্শ, বাসের ভেতরের সেই ঘনিষ্ঠতা—সবকিছু যেন এই ফ্যান্টাসির মাধ্যমে আবার ফিরে এলো।

পরক্ষনেই লুসিয়ার মন সাথে সাথে নিজেকে ধমকে উঠলো “ধ্যাত! লুসিয়া! কীসব আবোল-তাবোল ভাবছিস?এসব তোর সাথে যায়না।“

নিজের দুর্বলতার ওপর ক্ষোভ হলো তার। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো এবং পাশের টেবিলের ড্রয়ার খুলে লকেটটি সেখানে রেখে দিলো। তারপর ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

শুয়ে পড়ার পরেও তার চোখ বারবার যাচ্ছিলো বিছানার ওপর রাখা ফারহানের জ্যাকেটের দিকে।শেষ পর্যন্ত সে আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। লুসিয়া উঠে বসলো, জ্যাকেটটা হাতে নিলো। জ্যাকেটের মধ্যে তখনও ফারহানের গায়ের মৃদু ঘ্রাণ লেগে ছিল। লুসিয়া সেই জ্যাকেটটা নিজের বুকের ওপর শক্ত করে ধরে রাখলো, যেন সেই উষ্ণতার মধ্যেই সে নিজের সব দ্বিধা এবং অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাবে। সেই জ্যাকেটের উষ্ণতা নিয়েই লুসিয়া ধীরে ধীরে ঘুমের গভীরে তলিয়ে গেল।
.
.
.
পরের দিন সকালে। তান্বীর সেই নীরবতা ভাঙার পর এটি ছিল তাদের প্রথম স্বাভাবিক কথোপকথন। জাভিয়ান ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে, কণ্ঠে স্বাভাবিক কর্তৃত্ব নিয়ে বললো “তৈরি হয়ে নাও। আজ বিকেলে আমাদের একটা জরুরি অনুষ্ঠানে যেতে হবে।“

তান্বী কিছুটা অবাক হলো। গত কয়েক দিনের মানসিক ঝড়-ঝাপটার পর এই ধরনের অনুরোধ অপ্রত্যাশিত ছিল। তান্বী আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো “কিসের অনুষ্ঠান?“

জাভিয়ান সংক্ষিপ্ত ভাবে উত্তর দিলো “গেলেই দেখতে পাবে। তৈরি হতে বেশি দেরি করো না।“

তান্বী সিদ্ধান্ত নিলো, জাভিয়ানের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, নিজেকে আর গুটিয়ে রাখবে না। সে তার আলমারির সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটি বেছে নিলো—কাজ করা একটি সোনালী রঙের শাড়ি, যা মেক্সিকোর ফ্যাশনের মাঝেও নজর কাড়বে। হালকা গহনা এবং তার স্বাভাবিক রূপের উজ্জ্বলতা দিয়ে সে নিজেকে প্রস্তুত করলো। জাভিয়ানও তখন ইতালীয় স্যুট পরিহিত, তার ব্যক্তিত্বে সেই একই কঠোরতা।

বিকেলে তারা যেখানে পৌঁছালো, তারা যেখানে পৌঁছালো, সেই পরিবেশ ছিল চোখ ধাঁধানো। ফাতিমা যেহেতু মিস ইউনিভার্স ২০২৫-এর মুকুট জিতেছেন (যা ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়েছিল), তাই এটি ছিল মিস মেক্সিকো ফাতিমার গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। হলভর্তি অভিজাত দর্শক, ঝলমলে আলো এবং ক্যামেরার ফ্ল্যাশ।

অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো, চারিদিকে তখন করতালি আর উচ্ছ্বাস। দীর্ঘ, লাস্যময়ী এবং সদ্য বিশ্বসেরার মুকুট পরিহিতা ফাতিমা তখন সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

অনুষ্ঠানের পর ককটেল আওয়ার চলছিল। জাভিয়ান এবং তান্বী এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলো। এমন সময় লম্বা, লাস্যময়ী এবং সদ্য মুকুট পরিহিতা ফাতিমা বোশ এগিয়ে এলো।ফাতিমা তখন উচ্ছল হাসি নিয়ে বললো “জাভিয়ান! অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভালো লাগলো!“

জাভিয়ান তখন ফাতিমার সঙ্গে হাত মেলালো, মুখে সংক্ষিপ্ত কিন্তু আন্তরিক হাসি নিয়ে বললো “অভিনন্দন, ফাতিমা। জানতাম তুমিই জিতবে।“

ফাতিমার বাবা এবং জাভিয়ানের বাবা দীর্ঘদিনের বিজনেস পার্টনার। তাদের মধ্যে ছিল সেই পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা, যা মেক্সিকোর উচ্চবিত্ত সমাজে স্বাভাবিক। তাদের এই সহজ মেলামেশা এবং ফাতিমার সেই তীব্র সৌন্দর্য—সবকিছুই তান্বীর চোখে পড়ছিল।

জাভিয়ান যখন ফাতিমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো এবং তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলো, তখন তান্বীর ভেতরে এক অচেনা জ্বালা শুরু হলো। সে ফাতিমার সৌন্দর্যকে অস্বীকার করতে পারছিল না, আর জাভিয়ানের চোখে ফাতিমার প্রতি সেই স্বাভাবিক প্রশংসা দেখে তার হৃদয়ে তীব্র ঈর্ষা অনুভব করলো।

তান্বী অবাক হয়ে মনে মনে ভাবলো “আমি তো তাকে ভালোবাসি না। তাহলে কেন এই অন্য মেয়ের সঙ্গে ওর স্বাভাবিক মেলামেশা আমার এতো খারাপ লাগছে?

তান্বীর সেই ঈর্ষা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, যা তার ঘৃণা আর ভালোবাসার মাঝে এক নতুন সংঘাতের জন্ম দিলো। তান্বীর হৃদয়ে তীব্র ঈর্ষার এক শীতল স্রোত বইতে শুরু করলো। তান্বীর মন ভেতর থেকে দগ্ধ হয়ে বললো “নির্ঘাত এই মিস ইউনিভার্সের সাথেও এর আগে ওর ওসব সম্পর্কে ছিলো বা এখন হবে। জাভিয়ান তো একটা প্লেবয়! ও নিজের জীবনের নারীকে শুধু ব্যবহার করতে জানে। আমি কী করে ভুলে গেলাম যে ওকে ঘৃণা করা আমার একমাত্র কাজ!“

তান্বী যখন নিজেকে এই ঘৃণা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, জাভিয়ান তখন ফাতিমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তান্বীর দিকে তাকালো। জাভিয়ান কণ্ঠে স্বাভাবিক ঔপচারিকতা নিয়ে বলো “ফাতিমা,ও হচ্ছে তান্বী।সি ইজ মাই ওয়াইফ!“

ফাতিমা মুকুটের উজ্জ্বলতার মতোই হাসলো। তবে তান্বীর প্রতি তার মনোযোগ ছিল খুবই কম। সে আলতো করে হাত না তুলে শুধু মাথা নেড়ে ইংরেজিতে সংক্ষিপ্ত সম্ভাষণ করলো। ফাতিমা মিষ্টি হাসি এবং শীতল চোখে তাকিয়ে বললো “hello”.

তান্বীও শুধু প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়লো। ফাতিমার সেই অতি-আদুরে “হাই, হ্যালো” তান্বীর কাছে মনে হলো এক চরম উপেক্ষা। সে বুঝতে পারলো, এই ঝলমলে, সফল জগতে সে এবং জাভিয়ান—দুজনেই সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের মানুষ। জাভিয়ানের পাশে দাঁড়িয়েও সে কেবল তার বাহিরের লোকই রয়ে গেল।

ফাতিমা সেই আনুষ্ঠানিক সম্ভাষণের পরই জাভিয়ানের দিকে কিছুটা ঝুঁকলো এবং মেক্সিকোর ভাষায় (স্প্যানিশে) কথা বললো। ফাতিমা জাভিয়ানের দিকে হেসে বললো “Tu esposa es realmente hermosa. (তোমার স্ত্রী আসলেই অনেক সুন্দর।)“

জাভিয়ান ফাতিমার চোখের দিকে তাকিয়ে, প্রত্যুত্তরে স্প্যানিশেই উত্তর দিলো “Mi esposa es Miss Universo en mis ojos. (আমার স্ত্রী আমার চোখে মিস ইউনিভার্স।)“

জাভিয়ান এবং ফাতিমার মধ্যেকার এই গোপন কথোপকথন এবং তাদের হাসি দেখে তান্বীর ভেতরে থাকা ঈর্ষা আরও তীব্র হলো। তান্বী তাদের একটি শব্দও বুঝতে পারলো না। সে শুধু তাদের মুখের অভিব্যক্তি আর সেই অপরিচিত ভাষা শুনতে পাচ্ছিল। তাদের এই একান্ত আলাপে সে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অনুভব করলো। তান্বীর মনে হলো, জাভিয়ান যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে তাদের জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। সে আবারও নিশ্চিত হলো, জাভিয়ানের পাশে সে কেবল একজন নীরব সাক্ষী মাত্র, তার জীবনের কোনো অংশীদার নয়।

ফাতিমা এবং জাভিয়ানের সেই সংক্ষিপ্ত স্প্যানিশ কথোপকথনের পর, তারা ককটেল লাউঞ্জের দিকে এগিয়ে গেলো। সেখানে তাদের পরিচিত মেক্সিকোর আরও বেশ কিছু ধনী ও প্রভাবশালী মুখ উপস্থিত ছিল।

এই ভিড়ের মাঝে একটি বিষয় সবার চোখে পড়লো, যা কেউ সহজে বিশ্বাস করতে পারছিল না: জাভিয়ানের হাতে ওয়াইনের গ্লাস নেই!

জাভিয়ান তার সামাজিক বৃত্তে পরিচিত ছিলো ওয়াইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। প্রতিটি সামাজিক বা ব্যবসায়িক যেকোনো পার্টিতে কেনো প্রতিদিনই ওয়াইন ছিল তার ব্যক্তিত্বের অংশ। কিন্তু সেই রাতে সে শুধুমাত্র মিনারেল ওয়াটার আর নরমাল জুস পান করছিলো।

তাঁদের পরিচিত দলের কেউই ব্যাপারটা সহজে মেনে নিতে পারলো না। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করতে লাগলো।পরিচিত এক বন্ধু অবাক হয়ে ফিসফিস করে বললো “জাভিয়ান! আজ কি কোনো ‘ড্রাই ডে’ নাকি?তোর হাতে ওয়াইন ছাড়া অন্য কিছু!

তান্বীও অবাক হয়ে জাভিয়ানের দিকে তাকালো। সে জানত, জাভিয়ান কখনোই ওয়াইন ছাড়া এমন অনুষ্ঠানে থাকেবে না। জাভিয়ান নিজেও এই নীরব আলোচনার কেন্দ্রে থাকার বিষয়টি উপভোগ না করে পারলো না।

জাভিয়ান তার কণ্ঠে স্বাভাবিক কর্তৃত্ব, কিন্তু চোখে এক শীতলতা নিয়ে তান্বীর দিকে তাকিয়ে বললো “অবাক হচ্ছো কেন? আমাকে একটু পর গাড়ি ড্রাইভ করতে হবে তাই।“

জাভিয়ানের এই সামান্য অজুহাত তার পরিচিত সমাজে যথেষ্ট ছিল না। কারণ তারা জানত, তার ড্রাইভার আছে। জাভিয়ানের এই অস্বাভাবিক সংযম তাদের কাছে ছিল এক নীরব কৌতূহলের জন্মদাতা। তান্বীও বুঝতে পারছিল, জাভিয়ানের এই পরিবর্তন হয়তো তার সাম্প্রতিক মানসিক অস্থিরতারই ফল—যদিও সে এর কারণ জানে না। জাভিয়ানের এই রূঢ় নিয়ন্ত্রণ তার ভেতরের কোনো এক কঠিন সংকল্পের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

মিস ইউনিভার্স অনুষ্ঠান শেষে ভিড় যখন হালকা হলো, জাভিয়ান গাড়িতে এসে বসলো। তান্বী তখনও গাড়ির সিটে চুপচাপ বসে ছিল, তার চোখে ছিল ফাতিমার প্রতি ঈর্ষা এবং জাভিয়ানের প্রতি নীরব ক্ষোভ। কিন্তু জাভিয়ানের মন তখন অন্য জায়গায়।

জাভিয়ান ড্রাইভারকে ইশারা করলো এবং তার সেই অস্বাভাবিক সংযমের কথা ভাবলো, যা অতিথিদের আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। জাভিয়ান তখন স্টিয়ারিং হুইলে আলতো হাত রেখে, মনে মনে ভাবলো “আজ সবাই অবাক হলো… ওয়াইন ছাড়া জাভিয়ান!”

কিন্তু তারা কেউই জানত না, ক’দিন আগেই জরুরি মেডিক্যাল চেকআপ করিয়েছে জাভিয়ান।ডক্টর রিপোর্ট হাতে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে,অতিরিক্ত ওয়াইন পানের কারণে তার লিভার এনজাইমে গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। সে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন—যদি পুরোপুরি ওয়াইন না থামায়, তবে পরিণতি হবে ভয়াবহ। আপাততকালের জন্য ওয়াইন স্পর্শ করাও নিষেধ।

জভিয়ান তিক্ত হাসি হাসলো।আর মনে মনে পুনরায় ভাবলো আগে হলে এসব পাত্তাই দিতাম না। মৃত্যুভয়? ওসব তো কবেই চলে গেছে। বাঁচার কোনো ইচ্ছাই তো ছিল না এই পৃথিবীতে। নিজের অন্ধকার জগৎ আর অভিশপ্ত পথ—মৃত্যু ছিল বরং একটা মুক্তি।

জাভিয়ান চোখ বন্ধ করলো। তার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো তান্বীর মুখ—তার কান্না, রাগ, এমনকি সেই নীরব প্রত্যাখ্যান। জাভিয়ানের ভাবনায় তখন হৃদয়ে এক তীব্র অনুভব হলো “কিন্তু এখন? কেন জানি না, আমি বাঁচতে চাইছি! এখন আর নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে ইচ্ছা করছে না। এই কঠিন, রূঢ় জীবনেও হঠাৎ কেন যেন মনে হচ্ছে… বাঁচার একটা কারণ আছে। আর সেই কারণটা… হয়তো তান্বীই। এই মেয়েটার জন্যই কি আমি নিজের শরীর ও জীবনকে ধরে রাখতে চাইছি? এই দুর্বলতা… এই নতুন আকাঙ্ক্ষা…

সে চোখ খুললো। জাভিয়ানের সেই রূঢ় ক্ষমতা আর অন্ধকার জীবনের আড়ালে, জীবনের প্রতি এক নতুন, তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছে—যা সম্পূর্ণই তান্বীর উপস্থিতির ফল।
.
.
.
.
অন্যদিকে, মেক্সিকো সিটির অন্ধকার জগতের এক গোপন আস্তানায় তখন চলছিল আরেক ঘটনা। টেলিভিশনের পর্দায় মিস ইউনিভার্সের ফাইনাল রাউন্ডের গালা ইভেন্ট চলছিল। মেইলস্ট্রোম তখনো সেই অনুষ্ঠান দেখছিল কোন এক বিশেষ উদ্দেশ্যের কারনে, ঠিক সেই সময় তার নিজস্ব স্পাই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একটি নিশ্চিত খবর এসে পৌঁছালো: জাভিয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটি আর কেউ নয়, তান্বী! এবং সে শুধু অতিথি হিসেবে নয়—জাভিয়ান তাকে সবার সামনে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছে!

জাভিয়ান এবং তান্বীর সেই ঝলমলে উপস্থিতি দেখে মেইলস্ট্রোমের চোখ রাগে জ্বলে উঠলো। তার সমস্ত ধৈর্য এক মুহূর্তে ভেঙে গেল। জাভিয়ান তার একমাত্র প্রেমের শিকারকে এভাবে নিজের কাছে রেখে দেবে, তা সে সহ্য করতে পারলো না।

মেইলস্ট্রোম তখন হিংস্র গর্জন করে বললো “ওয়াইফ! জাভিয়ান! তুই এত সাহস দেখাচ্ছিস তোর ধারনা নেই তুই কাকে তোর ওয়াইফ বলছিস!“

আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে, মেইলস্ট্রোম টেবিল থেকে নিজের পিস্তলটি হাতে নিলো। তার পেশীগুলি শক্ত হয়ে উঠলো। জাভিয়ানের বাড়িতে গিয়ে সরাসরি হামলা চালানোর জন্য সে দ্রুত ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো।

ঠিক তখনই তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন তার মা, ইসাবেলা। ইসাবেলা দরজার সামনে তার ইস্পাত-কঠিন ব্যক্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত মিশ্রণ—আতঙ্ক এবং দৃঢ়তা।

ইসাবেলা দৃঢ় কণ্ঠে, হাতে পিস্তল ধরা মেইলস্ট্রোমের দিকে তাকিয়ে বললো “তুমি কোথায় যাচ্ছো, মেইলস্ট্রোম?”

মেইলস্ট্রোম মাথা নাড়িয়ে, রাগে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বললো “সরে যাও মম! আমি জাভিয়ানের কাছে যাচ্ছি। ওই মেয়েটা—তান্বী আমার ভালোবাসা!—ও ওর কাছেই আছে!”

ইসাবেলা আস্তে করে কিন্তু ভয়ংকর শক্তিতে বললো
“না। তুমি কোথাও যাচ্ছো না। পিস্তল নিচে রাখো।“

মেইলস্ট্রোম তার মায়ের দিকে তাকালো। এই প্রথম সে দেখলো, তার মা তার চরম ক্রোধের সামনেও সামান্যতম পিছু হটছেন না। তাদের দুজনের চোখে তখন চরম সংঘাত। জাভিয়ানের প্রতি তার উন্মত্ত প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা এবং মায়ের নীরব আদেশ—মেইলস্ট্রোম দুটির মাঝখানে থমকে দাঁড়ালো।

চলবে…………..

(রিচেক করিনি কোথাও বানান ভুল বা ঘটনা ভুল থাকলে ধরিয়ে দিবেন প্রিয় পাঠকগণ!)

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply