ডিজায়ার_আনলিশড
✍️ সাবিলা সাবি
পর্ব-১৬
সকালবেলা। ভিলা এস্পেরেন্জায় আজ যেন নতুন এক ব্যস্ততা। জাভিয়ানের বাবা-মা হসপিটালে আছেন মার্কোর কাছে, আর এরিমধ্যে বাড়িতে এসেছেন জাভিয়ানের ফুফা এবং তাঁর মেয়ে।
অনেকক্ষণ পর যখন সবাই ডাইনিং টেবিলে নাস্তার জন্য আসন গ্রহণ করলো, তখন তান্বী ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। তান্বীর চোখে তখনো ঘুমের রেশ।
সে ডাইনিংরুমের প্রবেশপথ থেকে চোখ তুলে তাকাতেই মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। তার চোখ দুটো যেন বড় বড় হয়ে গেল।
টেবিলের এক কোণে বসা মেয়েটিকে দেখে তার ভেতরে যেন বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেলো। মেয়েটির নাম মিতুল—জাভিয়ানের ফুফাতো বোন।
জাভিয়ানের খালা রেজিনা হেসে তান্বীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এসো তান্বী। ইনি জাভিয়ানের ফুফা আর ইনি আমাদের মিতুল, জাভিয়ানের ফুফাতো বোন।”
কথাটা কানে যেতেই মিতুলের চোখ কপালে উঠলো। সে জাভিয়ানের স্ত্রীর পরিচয় পাওয়ার পর মুহূর্তেই যেন মাথা খারাপ হয়ে গেলো! মিতুলের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো।
মিতুল তখনও ভুলে যায়নি কলেজের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা। কলেজে একবার মিতুল রাগ সামলাতে না পেরে তান্বীর এক বেস্ট ফ্রেন্ডের চুল টেনে ধরেছিল। আর সেই রাগের প্রতিশোধ নিতে তান্বী সেদিন সরাসরি এসে মিতুলের কোঁকড়া চুলগুলো কাঁচি দিয়ে এলোমেলোভাবে কেটে দিয়েছিল! সেই ঘটনায় কলেজ জুড়ে তোলপাড় হয়েছিল।
আজ মিতুল যেন অবিশ্বাস্য এক আতঙ্কে ভুগতে লাগলো। সেই অসভ্য মেয়েটা, যাকে দেখে তার এখনো ভয় হয়—সে এখন তার বড় ভাই জাভিয়ানের স্ত্রী! তবুও সে চুপ করে থাকলো আর তান্বীও কিছু বললো না।
.
.
.
.
নাস্তা শেষ হতেই পরিবেশ হালকা হওয়ার বদলে আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। মিতুল দ্রুত বারান্দার দিকে গেলো। সে তখনো কলেজের সেই অপমানের জ্বালা ভুলতে পারেনি। বারান্দায় একা পেয়ে সে মুহূর্তের মধ্যে তান্বীর ওপর আক্রমণ করলো।
মিতুল পেছন দিক থেকে এসে সপাং করে তান্বীর লম্বা চুল টেনে ধরলো। তার বড় বড় চুলগুলো নিজের হাতে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে সে টেনে ধরলো। অপ্রত্যাশিত আক্রমণে তান্বী কিছুক্ষণ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু মিতুলের রাগের জোর ছিল মারাত্মক।
অবশেষে কৌশল অবলম্বন করলো তান্বী। সে এক ঝটকায় মাথা ঘুরিয়ে মিতুলের হাঁটুতে সজোরে একটি লাথি মারলো! মিতুল ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে চুল ছেড়ে দিতেই, তান্বী ঘুরে দাঁড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে মিতুলের গলা চেপে ধরলো। রাগে তার চোখ জ্বলছে, সে কোনো কথা না বলে মিতুলের গালে জোরে একটি থাপ্পড় মারলো।
দুই নারীর চিৎকারে এক পর্যায়ে বাড়ির বাকি সবাই ছুটে এলো বারান্দায়। জাভিয়ানও নিজের রুম থেকে দ্রুত ছুটে এলো। সবাই অবাক, কী এমন হয়েছে যে মারামারি হচ্ছে?
জাভিয়ান কঠিন চোখে জানতে চাইলো, “কী হয়েছে? কিসের জন্য মারামারি?”
মিতুল তখনও রাগে কাঁপছে। সে জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, “জাভি ভাইয়া! এই সেই মেয়ে! কলেজে এই মেয়ে আমাকে অপমান করে চুল কেটে দিয়েছিল! মনে আছে? আমি তোমাকে বলেছিলাম এর বিচার করতে, কিন্তু তুমি এতই ব্যস্ত ছিলে যে সেদিন কলেজে যাওনি ওকে শাস্তি দিতে!”
তান্বীও ছাড়লো না। সে মিতুলের দিকে আঙুল তুলে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, “যোগ্য দোষেই আমি তোকে মেরেছি! তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে মেরেছিলি—তাই!”
এই কথা শোনা মাত্রই জাভিয়ানের ফুফা, মিতুলের বাবা, রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর মেয়ের ওপর এমন আক্রমণ তিনি সহ্য করতে পারলেন না। তিনি কোনো কথা না বলে তান্বীর গালে সজোরে একটি থাপ্পড় মারলেন!
তান্বী সেই আকস্মিক আঘাতে ঘুরে গেল। তার মাথায় আগুন ধরে গেল—ইচ্ছে করলো ওই লোকটাকেও মারতে। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে সেই রাগ ঘুরিয়ে দিলো মিতুলের দিকে।
“আমার গায়ে হাত তুললে,” চিৎকার করে সে মিতুলকে আরেকটা মারলো, “আমি আপনার মেয়েকে মারব!”
এবার জাভিয়ানের ফুপা রাগে এগিয়ে এসে আরও একবার তান্বীকে মারতে গেলেন।
কিন্তু তিনি আঘাত করার আগেই জাভিয়ান এক বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে এলো। তার চোখ তখন হিংস্র লালে জ্বলছে। জাভিয়ান কোনো কথা না বলে সরাসরি তার ফুপাকে সজোরে এক লাথি মারলো!
জাভিয়ানের ফুপা ছিটকে দূরে সরে গেলেন। মুহূর্তের জন্য পুরো বাড়ি থমকে গেল। জাভিয়ানের এই অভাবনীয় রূপ দেখে সবাই হতবাক। সে তার ফুপাকে লাথি মেরেছে!
জাভিয়ান তার ফুপাকে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে—এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে পুরো ভিলা এস্পেরেন্জা যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবার চোখে ছিল অবিশ্বাস, কিন্তু সব থেকে বেশি হতবাক হয়েছিলেন জাভিয়ানের ফুফা।
তিনি ব্যথায় ও অপমানে দাঁড়িয়ে উঠে তীব্র কণ্ঠে বললেন, “জাভিয়ান! তুই আমার গায়ে হাত তুললি?”
জাভিয়ান তখন আগুনের মতো লাল চোখে ফুফার দিকে ফিরলো। তার কণ্ঠে ছিল শীতল, তীক্ষ্ণ আদেশ—
“বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে! কবে কী হয়েছে না হয়েছে, তার জন্য আমার ওয়াইফের সাথে আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে এমন অপমান আমি সহ্য করবো না। প্লিজ, লিভ মাই হাউজ!”
জাভিয়ানের এই চূড়ান্ত নির্দেশে ফুফা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। অপমানে তিনি মিতুলের হাত ধরে টেনে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
জাভিয়ানের খালা রেজিনা এই পরিস্থিতিতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জাভিয়ানের চোখের সেই হিংস্র রূপ দেখে তিনিও চুপ করে গেলেন। বাড়িতে তখন জাভিয়ানের বাবা-মা কেউই নেই, ফলে জাভিয়ানের ওপর আর কোনো বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না।
সবথেকে বেশি অবাক হয়েছিল কাতারিনা। সে স্থির দৃষ্টিতে জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিল। জাভিয়ান যে তান্বীর সামান্য অপমানের জন্য নিজের ফুফাকে মারতে পারে এবং নিজের ফুফাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে, তা তার ধারণার বাইরে ছিল। তান্বীর জন্য জাভিয়ানের এই উন্মত্ত আচরণ দেখে কাতারিনার মনে জ্বলে উঠলো হিংসার নতুন আগুন।
সবাই চলে যাওয়ার পর পুরো হলরুম থমথমে। জাভিয়ান স্থির, কিন্তু তার চোখে তখনো সেই রাগের আগুন। সে ধীরে ধীরে তান্বীর দিকে এগিয়ে এলো। তার কণ্ঠস্বর ছিল শীতল, যেন পরিস্থিতি শান্ত হলেও ভেতরের ঝড় থামেনি।
জাভিয়ান তান্বীর একদম সামনে এসে কঠিন চোখে তাকালো, “তুমি আসলে তোমার লাইফে কত আকাম ঘটিয়েছো, বলোতো তান্বী?”
তান্বী এতক্ষণের ধাক্কা আর উত্তেজনার পরেও মাথা নত করলো না। সে জাভিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে এক ঝটকায় উত্তর ছুড়ে দিলো— “হিসেব ছাড়া।”
কথাটা বলেই তান্বী আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। সে দ্রুত পা চালিয়ে সেই বারান্দা থেকে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। জাভিয়ান তখনো সেই বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে রইলো, তার চোখে ফুটে উঠলো এক জটিল দৃষ্টি—রাগ, কৌতূহল এবং কিছুটা বিস্ময় মেশানো।
.
.
.
.
মেক্সিকোর সেই পুরোনো, রহস্যময় ভিলাতে সকালের আলো সবেমাত্র প্রবেশ করেছে। লুসিয়ার গভীর ঘুম ভাঙতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করলো শক্ত করে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায়। হাত-পা ছোড়াছুড়ি করলো সে, কিন্তু দড়িগুলো এতই শক্ত যে সামান্য নড়তেও পারলো না। আতঙ্কিত হয়ে সে চিৎকার করে উঠলো।
লুসিয়ার চিৎকারে সেই ঘরের দরজা খুলে গেলো। ভেতরে প্রবেশ করলো ফারহান, হাতে একটি ট্রে, তাতে সকালের নাস্তার সরঞ্জাম। তার মুখে শান্ত, ঠান্ডা হাসি।
লুসিয়ার চোখ তখনো রাগে জ্বলছে। সে চিৎকার করে জানতে চাইলো, “এটা কী হচ্ছে? তুমি কেন আমাকে কিডন্যাপ করেছো?”
ফারহান খুব ধীরেসুস্থে ট্রে-টা টেবিলের ওপর রাখলো। তারপর লুসিয়ার চেয়ারে সামনে ঝুঁকে এসে শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো, “খুব সিম্পল, লুসিয়া। কারণ তোমার ভাই জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী আমার বোনকে ভয় দেখিয়ে জোর করে তার কাছে আটকে রেখেছে।”
ফারহানের চোখ দুটো মুহূর্তের মধ্যে কঠিন হয়ে উঠলো। সে লুসিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা ভরা কণ্ঠে বলল, “জাভিয়ান আমার বোনের জীবন নিয়ে খেলছে। তাই আমিও তোমাকে নিয়ে এসেছি। এটা গিভ অ্যান্ড টেক হবে। তোমার ভাই যখন আমার বোনকে মুক্তি দেবে, তখন তুমিও মুক্তি পাবে।”
লুসিয়া তখন আতঙ্কিত। সে পুরোপুরি বুঝতে পারলো—সে এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের খেলার শিকার হয়েছে।
.
.
.
চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় ফারহানের দেওয়া শর্ত শুনে লুসিয়া ক্রোধে ফেটে পড়লো। সে চিৎকার করে জানতে চাইলো, ” কাল রাতে আমাকে কিডন্যাপ করেছো,তাহলে এখনো কেনো আমার বাড়িতে ফোন করোনি? আমাকে কেন কেউ খুঁজছে না?”
“করবো, রিল্যাক্স,” ফারহান নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে উত্তর দিলো। “আগে ব্রেকফাস্ট করো।”
এই বলে ফারহান টেবিলে থাকা খাবারগুলো লুসিয়ার সামনে রাখলো। প্লেটে ছিল সাধারণ কিছু মেক্সিকান রুটি ও বিনসের তরকারি।
লুসিয়া নাক কুঁচকে ঘৃণায় মুখ ফেরালো, “ছি! এসব কোনো খাবার? আমি জীবনেও এই ফালতু খাবার খাইনি! আমার বাড়ির সার্ভেন্টরাও এগুলো খায় না।”
লুসিয়ার অহংকার দেখে ফারহান হেসে উঠলো—এক তাচ্ছিল্যের হাসি।
“তুমি কি ভেবেছো, তোমাকে কিডন্যাপ করেছি দামি রেস্টুরেন্টের খাবার খাওয়ানোর জন্য?” ফারহান সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালো। “খেতে হলে খাও, নাহলে না খেয়েই থাকো। এই নাও, খাবার রেখে গেলাম।”
এই বলে ফারহান ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।
এদিকে কাল রাত থেকে কিছু না খেয়ে খিদেতে লুসিয়ার পেট জ্বলছিল। সে আর সহ্য করতে পারলো না। ফারহান দরজার দিকে যেতেই লুসিয়া দ্রুত ডাকলো, “শোনো! আমি খাবো। আমার হাত খুলে দাও, আমি খাবো।”
ফারহান থামলো। “হাত খোলা যাবে না।”
“তাহলে খাবো কী করে?” লুসিয়া অসহায়ভাবে প্রশ্ন করলো।
ফারহান একটি চামচ তুলে নিলো। তাতে খাবার ভরে সে লুসিয়ার মুখের সামনে ধরলো। লুসিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, “আমি তোমার হাতে খাবো না!”
ফারহান কোনো বিতর্কে না গিয়ে আবারও বেরিয়ে যেতে চাইল। এক মুহূর্ত দেরি হলো না লুসিয়ার। ক্ষিদে আর নিরুপায় অবস্থায় সে দ্রুত রাজি হলো—”ঠিক আছে! তুমিই খাইয়ে দাও।”
বিজয়ীর হাসি হেসে ফারহান চামচটি লুসিয়ার মুখের দিকে এগিয়ে ধরলো। সেই মুহূর্তে লুসিয়ার চোখে ছিল অসহায় আত্মসমর্পণ।
ক্ষিদেতে পাগলপ্রায় লুসিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চামচে দেওয়া খাবারগুলো গিলে নিলো। তার চোখে ছিল ফারহানের প্রতি তীব্র ঘৃণা, কিন্তু পেটের কাছে তার অহংকার হার মেনেছিল।
খাওয়া শেষ হতেই হঠাৎ ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে লুসিয়ার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা ছিল ফারহানের পকেটে। ফারহান ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। তাতে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম—’Honey’।
লুসিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফারহানের দিকে তাকালো, “আমার ফোনে কে ফোন করেছে?”
ফারহান কোনো কথা না বলে ফোনটা রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিলো।
ওপর পাশ থেকে ভেসে এলো একজন পুরুষের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, মেক্সিকান অ্যাকসেন্টে ইংরেজিতে তিনি বললেন, “বেইবি, হোয়্যার আর ইউ নাও? তোমার মিউজিক রেকর্ড শুরু হবে! আর তুমি কোথায়?”
কথাটা শোনা মাত্রই লুসিয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এটা তার বয়ফ্রেন্ড যার বাবাই আজকের মিউজিক রেকর্ডিং এর প্রোডিউসার! সে কিছু বলার আগেই ফারহান ফোনটা কেটে দিলো।
লুসিয়া তখন আর রাগ নয়, আতঙ্ক ও মিনতি নিয়ে ফারহানের দিকে তাকালো। তার কণ্ঠে ছিল অসহায় আকুতি—
“প্লিজ! আমাকে যেতে দিন! আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দিন আজ! আজকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মিউজিক রেকর্ডিং! এই দিনটার জন্য আমি এত বছর সাধনা করে এসেছি। সব শেষ হয়ে যাবে!”
ফারহান শীতল দৃষ্টিতে লুসিয়ার দিকে তাকালো। তার চোখে কোনো দয়া ছিল না।
“আই ডোন্ট কেয়ার,” ফারহান নিস্পৃহ কণ্ঠে উত্তর দিলো। “তোমার ভাইয়ের জন্য আমার বোনেরও সব শেষ হয়ে গেছে।”
লুসিয়া তখন পুরোপুরি বুঝতে পারলো। ফারহানের চোখে প্রতিশোধের আগুন। মিনতি করে আর কোনো লাভ হবে না—সে এখন জাভিয়ানের ক্রোধের শিকার। লুসিয়া নিঃশব্দে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলো। তার স্বপ্নগুলো যেন ফারহানের নির্দয় হাতের মুঠোয় আটকে গেল।
.
.
.
.
মেক্সিকো সিটির বিখ্যাত রেকর্ডিং স্টুডিওর ভেতরের পরিবেশ তখন থমথমে। কন্ট্রোল রুমের গ্লাস ভেদ করে আলেক্সান্দ্রে (Alexandre), লুসিয়ার বয়ফ্রেন্ড চিন্তিত মুখে ট্র্যাকের দিকে তাকিয়ে ছিল। মিউজিক রেকর্ডিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু লুসিয়ার কোনো খবর নেই।
ঠিক তখনই, স্টুডিওতে অপেক্ষারত আরেকজন উঠতি গায়িকা, যার নাম ঈভা (Eva), ধীরে ধীরে আলেক্সান্দ্রের কাছে এগিয়ে এলো। সে পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছিল।
ঈভা নরম গলায় বললো, “আলেক্সান্দ্রে, তোমার লুসিয়া মনে হচ্ছে আজ আর আসবে না। তাহলে… চান্সটা আমাকে দাও?”
আলেক্সান্দ্রে মাথা না ঘুরিয়েই উত্তর দিলো, তার চোখে তখন বিরক্তি, “বিনিময়ে আমাকে কী দেবে?”
ঈভা এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে সরাসরি বললো, “লুসিয়া যা দিয়েছে, তাই দেবো।”
আলেক্সান্দ্রে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার চোখে ক্লান্তি আর হতাশা। সে মৃদু স্বরে যেন নিজের মনেই বললো—
“লুসিয়াকে পুরোপুরি পাওয়ার জন্য কত নাটক, কত ভয় নিয়ে মিউজিক রেকর্ড করাচ্ছি। আর লুসিয়া কী করলো? আজকেই এলো না! আমি চেয়েছিলাম, আজকেই ওর রেকর্ড শেষ হলেই আমি ওকে আমার রুমে নিয়ে যেতাম।”
আলেক্সান্দ্রের কন্ঠে তখন ভালোবাসা নয়, ছিল আকাঙ্ক্ষা আর হিসাবের স্পষ্ট সুর। তার কাছে লুসিয়াও যেন ছিল সাফল্যের আরেকটি সোপান, যার বিনিময়ে সে নিজের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চেয়েছিল।
.
.
.
.
রাতে, জাভিয়ানের মা কার্গো চৌধুরী এবং বাবা সায়েম চৌধুরী হাসপাতাল থেকে ভিলা এস্পেরেন্জায় ফিরে এলেন। ততক্ষণে বাড়ির অন্য সদস্যদের কাছ থেকে তাঁরা দিনের বেলায় ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা—বিশেষ করে জাভিয়ান যে তার ফুফাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে এবং তাকে লাথি মেরেছে—তা জানতে পেরেছেন।
ক্ষুব্ধ সায়েম চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে জাভিয়ানকে ডেকে পাঠালেন।
জাভিয়ান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এসে বাবার সামনে হাত পেছনে বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
সায়েম চৌধুরী চোখ-মুখ কঠিন করে প্রশ্ন করলেন, “অমন কাণ্ড কেন করলে, জাভি? নিজের ফুফাকে মারার সাহস দেখালে কি করে?”
জাভিয়ান শান্ত, কিন্তু শীতল কণ্ঠে উত্তর দিল, “আমার ওয়াইফের গায়ে হাত দেওয়ার রাইট তার নেই। আর দ্বিতীয়বার এমন কিছু করলে আমি তার হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবো।”
সায়েম চৌধুরী হতভম্ব হয়ে গেলেন। “আমি বেঁচে আছি, আমাকে বলতে! আমাকে ফোন করতে!”
জাভিয়ান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। “কেন? আপনাকে কেন ফোন করতে হবে, মিস্টার চৌধুরী? আমার ওয়াইফকে আমাকেই প্রটেক্ট করতে হবে।”
সায়েম চৌধুরীর মুখ ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো। তিনি তীব্র স্বরে বললেন, “তাহলে তো দেখা যায়, তোমার ওয়াইফের জন্য ভবিষ্যতে তুমি আমার গায়েও হাত তুলবে!”
জাভিয়ান এই কথা শুনে আর এক মুহূর্তও স্থির থাকলো না। সে শান্ত পায়ে হেঁটে তার বাবার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সায়েম চৌধুরীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো—
“হাত তো তুলবই না, দরকার পড়লে জানে মেরে ফেলব… বিকজ আই হেইট ইউ।”
সেই ফিসফিসানি যেন ছিল একটি ধারালো ছুরির মতো। সায়েম চৌধুরীর মুখ ভয়ে ও অপমানে সাদা হয়ে গেল। এই মুহূর্তে জাভিয়ানের চোখে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
জাভিয়ানের চরম স্বীকারোক্তিতে সায়েম চৌধুরী তখন পাথরের মতোন দাঁড়িয়ে। অপমান এবং ঘৃণার এই তীব্র প্রকাশে তিনি যেন বাকরুদ্ধ। তিনি কিছু একটা বলতে চাইলেন, মুখটা সামান্য খুললেন—হয়তো ছেলেকে থামানোর জন্য, অথবা নিজের কোনো যুক্তি দেওয়ার জন্য।
কিন্তু সেই কথাগুলো বের হওয়ার আগেই জাভিয়ান ঘুরে দাঁড়ালো। সে তার বাবাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে, আঙুল তুলে কঠোরভাবে দেখালো।
“আর একটাও প্রশ্ন করবেন না।”
সেই সংক্ষিপ্ত, তীব্র আদেশ ছুঁড়ে দিয়ে জাভিয়ান আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না। সে দ্রুত পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সায়েম চৌধুরী কেবল তার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার চোখে তখন অসহায় ক্রোধের সাথে মিশে ছিল পুত্রের কাছ থেকে পাওয়া ঘৃণার দগদগে ঘা।
জাভিয়ান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরও সায়েম চৌধুরী সেই একই স্থানে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। জাভিয়ানের চোখের সেই তীব্র ঘৃণা এবং কানের কাছে ফিসফিস করে দেওয়া চরম বাক্যটি এখনো যেন হলরুমের বাতাসে ভাসছে।
তিনি জানতেন, এই ঘৃণা জাভিয়ানের কাছ থেকে তাঁর পাওনা ছিল, এটি তার প্রাপ্য। নিজের সন্তানের প্রতি বছরের পর বছর ধরে করা অবহেলা, কঠোরতা এবং ভুল সিদ্ধান্তের ভার—আজ সেই সবের চরম পরিণতি। জাভিয়ানের ঘৃণার কাছে তিনি কোনো প্রতিবাদ করতে পারলেন না; কারণ, তিনি নিজেই জানেন, এই বিদ্বেষ তিনি নিজের হাতেই তৈরি করেছেন। অসহ্য এক আত্মগ্লানি নিয়ে তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
.
.
.
রাতে, তার বাবার সাথে তীব্র বাগ্যুদ্ধের পর জাভিয়ানের মাথার ভেতরটা তখনো ঝোড়ো। যখন তার প্রচন্ড অস্বস্তি হয় বা রাগ চরমে পৌঁছায়, জাভিয়ান তখন সবসময় ইচ্ছেমতো ড্রিঙ্কস করে। রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য সে সোজা তার ব্যক্তিগত আলমারির দিকে গেলো।
আলমারি খুলে সে দেখলো, দিনের বেলায় আনা ওয়াইনের কয়েকটি দামি বোতল সেখানে রাখা ছিল। জাভিয়ান বোতলগুলো বের করতে গিয়েই থমকে গেলো—সব বোতল খালি!
জাভিয়ান অবাক হলো বটে, তবে মুহূর্তেই বুঝতে পারলো এই কাজ কার। রাগে তার চোখ লাল হয়ে উঠলো।
সে তীব্র কণ্ঠে তান্বীকে ডাকলো। তান্বী কক্ষে প্রবেশ করতেই জাভিয়ান কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “আমার ওয়াইনের বোতল খালি কেন?”
তান্বী সহজভাবে উত্তর দিলো, “ওহ, ওগুলো? ওগুলো আমি বাথরুমে ফেলে দিয়েছি।”
জাভিয়ান রাগে ফুঁসতে লাগলো। “তোমার সাহস হয় কী করে? আমার জিনিস! আমার অনুমতি ছাড়া তুমি ফেলে দিয়েছ?”
তান্বীও ছাড়বার পাত্রী নয়। সে স্পষ্ট জবাব দিলো, “আপনার ভালোর জন্যই ফেলেছি। ওসব বাল-ছাল খেয়ে আপনার কিডনি ড্যামেজ হয়ে যাবে, তারপর সোজা কবরে চলে যাবেন! সেটা হতে দেব না।”
জাভিয়ানের চোখে এবার ক্রোধের সাথে মিশে গেল অবিশ্বাস। “বাল-ছাল! হোয়াট দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ!” সে সামান্য হাসলো, তবে সে হাসিটা ক্ষতিকারক। “যাই হোক, আমি ওয়াইন পান করে করে কিডনি ড্যামেজ হয়ে মরে গেলে তোমার কী?”
তান্বীর চোখে এবার কোনো রাগ নয়, ছিল দৃঢ়তা। সে জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে শান্ত অথচ তীব্র কণ্ঠে বললো, “কারণ আমি নিজের ওপর ‘ডিভোর্সি’ ট্যাগ নিলেও ‘বিধবা’ ট্যাগ’ মেনে নিতে পারবো না।”
কথাটা শুনে জাভিয়ানের চোখে এক ঝলক বিস্ময় খেলা করলো। সে ধীরে ধীরে তান্বীর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তার মুখে এবার দুষ্টুমি ভরা হাসি।
“আচ্ছা, বেশ! তাহলে শোনো,” জাভিয়ান একদম তান্বীর কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, “এসব কোনো ট্যাগই মানতে হবে না। চলো, তোমাকে বরং ‘প্রেগন্যান্ট’ ট্যাগ লাগিয়ে দিই।”
এই বলে জাভিয়ান এক ঝটকায় তান্বীকে নিজের কাছে টেনে নিলো। তান্বী অবাক হলেও নিজেকে আর সরিয়ে নিলো না।
জাভিয়ান যখন তাকে কাছে টেনে নিলো, তান্বী তখন নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। তার মুখে ছিল দ্বিধা—লজ্জা আর ইচ্ছার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ।
জাভিয়ান তার প্রতিরোধ গ্রাহ্য না করে, তাকে আরও শক্ত করে ধরে রাখলো। তার চোখে তখন শিকারীর দৃষ্টি। জাভিয়ান ফিসফিস করে বললো, “আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি ইচ্ছে করেই করেছো। যাতে করে সেদিনের মতো করে আমার কাছে থেকে পানিশমেন্ট পাও, তাই না? কারণ, আমার চুমু তো তোমার ভালো লেগেছে।”
জাভিয়ানের কথায় তান্বীর গাল দুটো লাল হয়ে গেলো। তার চোখ ছলছল করছে।
জাভিয়ান তার মুখের কাছে মুখ এনে বললো, “ঠিক আছে। তাহলে চলো, আজকে তোমার ঠোঁটে লেগে থাকা ওয়াইন পান করব। আর তুমি কি জানো? তোমার ঠোঁটের নেশা ওয়াইনের চেয়েও প্রখর।”
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই জাভিয়ান আর কোনো সুযোগ না দিয়ে তান্বীর ঠোঁটের ওপর ঝুঁকে পড়লো। সেই মুহূর্তের তীব্রতা যেন রুমের সমস্ত বাতাস শুষে নিলো।
ঠোঁটে ঠোঁট মিশে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে, তান্বী নিজেকে এক ঝটকায় সরিয়ে নিলো। তার মুখে তখনো সেই একই দ্বিধা—এবং ভয়। সে প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে দ্রুত বললো, “সরি! সরি! আমি আর কোনোদিন ফেলব না আপনার ওয়াইন।”
জাভিয়ানের চোখের তীব্রতা সামান্য কমে এলো। সে তান্বীর চোখের দিকে তাকালো, তার ভেতরে চলছিল অন্য কোনো ঝড়। তার গলার স্বর এবার শান্ত শোনাল: “আমার আজকে মুড ভালো না। তুমি কি আমাকে একটু সময় দেবে?”
তান্বী অবাক! জাভিয়ান এমন অনুরোধ করছে—সে কী বলবে বুঝতে পারলো না।
জাভিয়ান আর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। সে তান্বীর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। তাদের ঘর সংলগ্ন বারান্দা পেরিয়ে একটি বিশাল সুইমিং পুলের সামনে তাকে বসিয়ে দিলো। তান্বী ইতস্ততভাবে পুলের পাড়ে বসতেই জাভিয়ান আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সশব্দে জলে ঝাঁপ দিলো।
সুইমিং পুলের শান্ত জল তোলপাড় হলো। কিছুক্ষণ জাভিয়ান ভেসে রইলো জলের নিচে, যেন নিজের ভেতরের আগুনকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ সে তান্বীর একদম কাছে ভেসে উঠলো। তার চোখ স্থির, কণ্ঠে জোর—”নামো পানিতে।”
তান্বী রাজি হলো না। “আমি সাঁতার পারি না,” সে ক্ষীণ স্বরে বললো।
কিন্তু জাভিয়ান তখন মানসিকভাবে অস্থির। সে কোনো বাধা মানতে রাজি নয়। জাভিয়ান এক ঝটকায় তান্বীকে সুইমিং পুলে টেনে নিলো। শীতল জলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তান্বী ভয়ে চিৎকার করে উঠলো।
পরের মুহূর্তেই জাভিয়ান তাকে শক্ত করে নিজের বাহুতে ধরে রাখলো। তান্বীর শরীর ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু জাভিয়ানের বলিষ্ঠ বাহুর উষ্ণতা তাকে যেন এক অজানা সুরক্ষা দিচ্ছিল।
সুইমিং পুলের শীতল জলে নিক্ষিপ্ত হয়ে তান্বী আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠলো। তার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। সে ছটফট করতে করতে জাভিয়ানকে বললো, “ছাড়ুন আমাকে!”
জাভিয়ান এক লহমার জন্য তার বাহুর বাঁধন আলগা করে দিলো।
মুক্তি পেয়েই তান্বী দেখলো, পুলের পানি আসলে অনেক গভীর—তার পা কোনোভাবেই নাগাল পাচ্ছে না। জলে ভেসে থাকার সামান্য কৌশলও তার জানা নেই। এক তীব্র ভয়ে তার দম আটকে আসতে চাইলো। সে হাঁপাতে হাঁপাতে মুহূর্তের মধ্যে আবার জাভিয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তার শরীর ভয়ে কাঁপছিল।
তান্বীর এই অপ্রত্যাশিত আচরণে জাভিয়ান হেসে উঠলো। সেই হাসিটা ছিল বিজয়ীর, কিছুটা দুষ্টুমি ভরা।
জাভিয়ান নরম অথচ উত্যক্তকারী কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো, “কী হলো? এখন তো নিজেই আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরছো! পরে কিন্তু কোনো অঘটন ঘটে গেলে আমি দায়ী নই।”
জাভিয়ানের কথায় তান্বী আরও বেশি লজ্জায় তার বুকের কাছে মুখ লুকিয়ে ফেললো। শীতল জলের গভীরে তাদের দুজনের শরীর তখন উষ্ণ, ঘনিষ্ঠ এক আশ্রয়ে বাঁধা।
অন্যদিকে, ভিলা এস্পেরেন্জা থেকে বেশ দূরে অবস্থিত সেই সুরক্ষিত হাসপাতালে। দীর্ঘ, অপেক্ষার প্রহর শেষে আজ সকালে সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো। মেইলস্ট্রোম, যার অবশেষে জ্ঞান ফিরে এলো।
এতগুলো দিন সে গভীর কোমায় ছিল, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ডাক্তাররা যখন প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই এই অলৌকিক ঘটনা।
ইসাবেলা, যিনি প্রতি রাতে ছেলের পাশে বিনিদ্র প্রহর কাটিয়েছেন, এই খবর শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগলো—সেটা কষ্টের নয়, চরম স্বস্তির। তার ছেলের জ্ঞান ফিরেছে!
ইসাবেলা দ্রুত নিজের ছেলেকে দেখতে গেলেন। এই খবর যেন ইসাবেলার জীবনের সব হতাশা আর উদ্বেগ এক মুহূর্তে দূর করে দিল। মেইলস্ট্রোম সুস্থ হয়ে উঠছে—এই আনন্দময় খবরটাই এখন ইসাবেলার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
এদিকে মার্কোর বিষয়ে হাসপাতালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ডাক্তাররা তার বাবা সাইফ চৌধুরীকে জানালেন যে, যেহেতু মার্কো এখন স্থিতিশীল এবং অবস্থার দ্রুত উন্নতি হচ্ছে, তাই আগামীকালই তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হবে।
দীর্ঘদিন পর মার্কো এবার ভিলা এস্পেরেন্জায় ফিরতে পারবেন। এই খবর সাইফ চৌধুরীকে আনন্দকে যেন আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো। জাভিয়ানের বাবা সায়েম চৌধুরীও এই খবরে স্বস্তি পেলেন। পারিবারিক সমস্যা এবং জাভিয়ানের চরম আচরণের পর মার্কোর এই প্রত্যাবর্তন হয়তো বাড়িতে কিছুটা হলেও স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনবে—এমনটাই আশা করলেন সবাই।
.
.
.
.
গভীর রাত। ভিলা এস্পেরেন্জার সুইমিং পুলের শীতলতা তখনো তান্বী ও জাভিয়ানের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের উষ্ণতাকে ধরে রেখেছে। ঠিক তখনই জাভিয়ানের ফোনটা বেজে উঠলো। জাভিয়ান দ্রুত ফোন ধরলো। এটি ছিল ফারহানের কল।
অন্যদিকে, মেক্সিকোর সেই গোপন আস্তানায় লুসিয়া তখনও চেয়ারে বাঁধা। ফারহান ফোন রিসিভ করেই তা লাউডস্পিকারে দিলো।
ফারহান ঠান্ডা, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো “লুসিয়া আমার কাছে আছে, জাভিয়ান। তোর বোন। তাকে আমি কিডন্যাপ করেছি। তোর বোনকে যদি জীবিত ফিরে পেতে চাস, তাহলে আমার বোন তান্বীকে মুক্তি দে।”
জাভিয়ান এক মুহূর্তও ভাবলো না। তার চোখ তখন হিংস্র লালে জ্বলছে।
জাভিয়ান হিংস্র ও চূড়ান্ত কণ্ঠে বললো “মেরে ফেল ওকে! ওকে মেরে ফেললেও তুই তোর বোনকে পাবি না! কারণ, তান্বী এই জীবনে আমার কাছ থেকে কোনোদিনও মুক্তি পাবে না।”
ফোনটা লুসিয়ার সামনেই লাউডস্পিকারে ছিল। নিজের ভাইয়ের এমন নির্দয় কথা শুনে লুসিয়া যেন বাকরুদ্ধ। তার চোখ ছানাবড়া—তার ভাই তাকে অন্য একটি মেয়ের জন্য মেরে ফেলতে বলছে!
ফারহান ফোন রেখে লুসিয়ার দিকে তাকালো। তার মুখে ছিল করুণা মেশানো তাচ্ছিল্যের হাসি।
ফারহান লুসিয়াকে লক্ষ্য করে, ফিসফিস করে বললো “হাউ আনলাকি সিস্টার ইউ আর। তোমার ভাইয়ের তোমার প্রতি একটুও মায়া নেই… এ কেমন ভাই?”
ফারহানের কথাটা শেষ হতেই লুসিয়া তখনও ভয়ে কাঁপছে। তার ভাইয়ের সেই নির্মম কণ্ঠস্বর কানে বাজছে—’মেরে ফেল ওকে!’
লুসিয়া তখন আর কোনো কথা বললো না। আর ফারহান কেবল মনে মনে এক কঠিন সত্য উপলব্ধি করলো: যার নিজের বোনের প্রতি দয়া-মায়া নেই, সে আমার বোনকে কি আগলে রাখবে?
জাভিয়ান তান্বীকে মুক্তি দেবে না—এই কথাটি লুসিয়ার কাছে যেন জাভিয়ানের নিষ্ঠুরতা ও ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রমাণ। আর অন্যদিকে ফারহান বুঝতে পারলো, তার বোন তান্বীর ভাগ্য জাভিয়ানের হাতে কতটা অনিরাপদ।
চলবে…..
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৮
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৩
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২৩
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৯
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২০
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২২
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৮
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৩