Golpo ডার্ক রোমান্স ডিজায়ার আনলিশড

ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৫


ডিজায়ার_আনলিশড

✍️ সাবিলা সাবি

পর্ব-১৫

ক্যাসিনো ক্লাব তখনও মুখর, মিউজিকের উচ্চ শব্দ আর লাল-নীল আলোর ঝলকানিতে চারপাশ ঝলমল করছে। জাভিয়ানের ঠিক সামনে তান্বী ঠায় দাঁড়িয়ে—তার চোখে স্পষ্ট রাগ, গলায় যেন আগুনের স্বর।

পাশে বসা মেয়েটি হঠাৎই ঠোঁট বাঁকিয়ে ইংরেজিতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “What’s your problem, girl? Why are you making a scene here? your husband isn’t here to go home with you. Men come here to enjoy, not to follow their wives back home. Go back—he’ll come when he wants to. (অনুবাদ: কী সমস্যা তোমার? এখানে এত নাটক করছ কেন? তোমার স্বামী তো তোমার সঙ্গে বাড়ি যেতে এখানে আসেনি। পুরুষরা এখানে আসে ফুর্তি করতে, বউকে বাড়ি পৌঁছে দিতে নয়। ফিরে যাও—ওর যখন ইচ্ছা হবে, তখন ফিরবে।)

কথাগুলো সবার সামনে কানে যেতেই তান্বীর মুখে যেন রক্ত উঠে গেল। রাগ, অপমান আর হিংসায় ওর চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। এক মুহূর্তও না ভেবে সে পাশের টেবিল থেকে একটি ওয়াইনের গ্লাস তুলে সপাং করে ছুঁড়ে মারল মেয়েটার মুখের দিকে!

ছপ্! ওয়াইন ছিটকে পড়ল মেয়েটার মুখে, আর কিছুটা গিয়ে লাগল জাভিয়ানের দামি সাদা শার্টেও।

মুহূর্তে চারপাশ নিস্তব্ধ। সমস্ত দৃষ্টি এখন তাদের দিকে।

জাভিয়ান হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলো। ঠিক তখনই তান্বী আরেকটা গ্লাস ছুঁড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু পেছন থেকে জাভিয়ান দু’হাত দিয়ে ওর কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তান্বীর পিঠ ঠেকে গেল তার বুকের সঙ্গে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে চিৎকার করে উঠলো, “ছাড়ুন! এবার গ্লাসটাই ওর মুখে মারবো আমি! ছাড়ুন!”

জাভিয়ান গম্ভীর, নিচু গলায় বলল, “অনেক হয়েছে, তান্বী…”

তবুও তান্বী হাত-পা ছুঁড়ে মেয়েটার দিকে যেতে চাইল।

ঠিক তখনই, মেয়েটি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উঠে দাঁড়ালো। চোখ লাল, চুল এলোমেলো—গালি দিয়ে একটা থাপ্পর মারতে উদ্যত হলো “You bloody bitch!”

কথাটা শোনা মাত্রই জাভিয়ানের চেহারায় যেন আগুন নেমে এলো। সে তান্বীকে ছেড়ে দিয়ে এক ঝটকায় মেয়েটার হাত চেপে ধরলো, পেছন দিকে এমনভাবে মোচড় দিলো যে মেয়েটি ব্যথায় কাতরিয়ে উঠলো।

জাভিয়ান বাঘের মতো গর্জে উঠলো—“How dare you! How dare you call my wife a bitch!”

পুরো ক্লাব তখন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। জাভিয়ানের চোখ আগুনের মতো লাল, আর কণ্ঠে ঝড়ের গর্জন —“A cheap prostitute like you isn’t even worth a single penny,to Javien Emilio Chowdhury.”

মেয়েটি চোখ নামিয়ে ভয়ে কেঁপে উঠলো। আর তান্বী—সে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো জাভিয়ানের দিকে। যে মানুষটাকে সে এতকাল ভেবেছিল কেবলই ঠান্ডা, নির্দয়, সেই মানুষ আজ নিজের হাতে, আগুনের মতো গর্জে উঠে তার সম্মান রক্ষা করছে।

ক্যাসিনো ক্লাব তখন থমথমে। সঙ্গীত বাজছিল বটে, কিন্তু সেই সুর যেন নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা।জাভিয়ানের চোখ তখনো রাগে লাল, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল সেই মেয়েটি—যে কয়েক মিনিট আগেও তান্বীকে অপমান করার সাহস দেখিয়েছিল।

ঠিক তখনই ক্লাবের ম্যানেজার দৌঁড়ে এসে উপস্থিত হলো। জাভিয়ান শীতল, শান্ত কণ্ঠে আদেশ ছুঁড়ে দিলো, “Get her out of here.”

ম্যানেজার এক মুহূর্তও দেরি না করে হাতের ইশারায় দ্রুত দু-তিনজন মেয়ে কর্মচারী আর একজন বডিগার্ডকে ডাকলো। তারা সবাই মিলে মেয়েটিকে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে ক্লাবের বাইরে নিয়ে গেল।

চারপাশে আবারও সঙ্গীত বেজে উঠলো বটে, কিন্তু পরিবেশ আর আগের মতো হলো না। ক্লাবের প্রতিটি চোখ তখন তাকিয়ে রইলো কিংবদন্তি মানুষটার দিকে—জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী।

কাতারিনা পুরো দৃশ্যটা দেখছিলো। তার চোখ বড় বড়, মুখ ফ্যাকাসে। সে ভালোমতোই টের পেল, জাভিয়ানের রাগ কতটা ভয়ংকর হতে পারে।

তান্বী কোনো কথা বলছিল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল, শুধু বুকের ভেতরটা হালকা কাঁপছিল—এই কাঁপুনি রাগের নাকি ভয়ের, সে নিজেও বুঝতে পারছিল না।

হঠাৎ জাভিয়ান হাত বাড়িয়ে ধরলো। তার কণ্ঠে কোনো অনুরোধ ছিল না, ছিল শুধু স্থিরতা, “Let’s go, Tanbi.”

তান্বী আর কিছু জিজ্ঞেস না করে নীরবে জাভিয়ানের হাত ধরলো। জাভিয়ানের বড়, শক্ত হাতটা যেন পুরো ক্লাবের ভিড় থেকে ওকে টেনে তার একান্ত নিজস্ব জগতে নিয়ে এলো।

তাদের পেছনে কাতারিনার চোখে অদ্ভুত এক ঝিলিক। রাগ, হিংসা আর কৌতূহলের এক মিশ্রণ নিয়ে সে ওদের পিছু নিলো।

বাইরে তখন রাতের হাওয়া বইছে, ক্যাসিনোর গেট নিয়ন আলোয় ঝলমল করছে। জাভিয়ান তান্বীকে নিয়ে এসে গাড়ির পেছনের দরজা খুললো।

“Sit”—তার কণ্ঠে কোনো প্রশ্ন ছিল না, ছিল এক নিঃশর্ত আদেশের ভার। তান্বী চুপচাপ পেছনের সিটে বসে গেলো। জাভিয়ানও তার পাশে আসন নিলো।

কাতারিনা ঠিক তখনই দরজা খুলে পেছনের সিটে তাদের পাশে বসতে যাচ্ছিল। হঠাৎ জাভিয়ান ঠান্ডা চোখে তার দিকে তাকিয়ে কঠোর স্বরে বলল, “You sit in the front.”

এক মুহূর্তে কাতারিনার মুখের রঙ পাল্টে গেল। তার ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠলো—ড্রাইভারের পাশে বসতে হবে? এই প্রথম কেউ তাকে এভাবে প্রকাশ্যে অপমান করলো।

তবুও মুখে একটি কথাও বললো না। কাতারিনা চুপচাপ পেছনের দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে বসল।

আর পেছনে তান্বী—জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু তার মুখে ছিল একটি ক্ষীণ হাসি। মনে মনে ভাবলো, “এইবার ঠিক হয়েছে।” আসার সময় কাতারিনা তাকে যেভাবে অপমান করে সামনের সিটে বসতে বাধ্য করেছিল, আজ সেই অপমানের জবাবটা যেনো প্রকৃতি নিজেই দিয়ে দিল।

গাড়ি তখন ধীরে ধীরে ক্লাবের সামনে থেকে বেরিয়ে পড়লো, আর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তিনটি অচেনা অনুভূতি—জাভিয়ানের রাগ, তান্বীর প্রতিশোধের তৃপ্তি, আর এক অদ্ভুত নীরব ভালোবাসা।
.
.
.

গাড়ি ততক্ষণে ক্যাসিনোর নিয়ন আলো পেছনে ফেলে রাতের অন্ধকারে ছুটছে। গাড়ির পেছনের সিটে জাভিয়ানের পাশে বসে আছে তান্বী। জাভিয়ান তখনও রাগে ফুঁসছে, তার চেহারায় সেই উত্তাপ স্পষ্ট। নীরবতা ভেঙে তান্বী হঠাৎ দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে কিছু বলতে গেল—

“বলছিলাম যে—”

কিন্তু তার কথা শেষ করার আগেই জাভিয়ান ভয়ঙ্করভাবে গর্জে উঠলো, তার কণ্ঠস্বর গাড়িতে একটি ধাক্কার মতো শোনাল—”শাট আপ! আর একটাও কথা বলবে না তুমি!”

তান্বী চমকে উঠলো। জাভিয়ান তার দিকে ঘুরে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো: “তুমি কেন ক্লাবে এসেছ? এই ক্লাবের মানে তুমি জানো? এমন জায়গায় কেন এসেছ তুমি?”

তান্বী ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, “আমার কী দোষ? আপনার মা আর খালাই তো বললেন—”

আবারও জাভিয়ান তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল, তার কণ্ঠস্বরে কোনো দয়ামায়া ছিল না—”শাট আপ! আর কোনোদিন, কখনোই তুমি এরকম জায়গায় আসবে না!”

তান্বী আর কোনো কথা বললো না। জাভিয়ানের এই তীব্র রাগের সামনে সে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। গাড়ির ভেতর তখন কেবল নিঃশ্বাসের শব্দ আর জাভিয়ানের চাপা ক্রোধের উষ্ণতা। কাতারিনা সামনে বসে নিঃশব্দে রিয়ার-ভিউ মিররে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল।

জাভিয়ানের কঠিন ধমকের পর গাড়িতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরবতা বিরাজ করল। কিন্তু তান্বী এবার আর চুপ রইল না। তার ভেতরের অভিমান আর রাগ মিশে এক জেদি স্বর বেরিয়ে এলো—”আমি এসেছি বলেই দোষ? আর আপনি নিজেই যে এখানে প্রতিদিন আসেন, সেটা কী? হ্যাঁ! কত কত মেয়ের সঙ্গে বসে এখানে আড্ডা দেন, কত কী করেন! আপনি এনজয় করতে পারলে আমাকে কেন বাধা দিচ্ছেন?”

তান্বীর সরাসরি পাল্টা প্রশ্নে জাভিয়ান হঠাৎ হাসলো। সে হাসিটা তাচ্ছিল্যের, কিছুটা নির্মম।

“এখানে আসে প্রস্টিটিউটরা। তুমি কি তাই?” জাভিয়ানের কণ্ঠ ছিল শীতল।

তান্বীর মুখে রক্ত উঠে গেল। এক লহমায় তার সমস্ত ভয় উধাও হলো। জাভিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে সে স্পষ্ট উত্তর দিলো—”এখানে আসা মেয়েদের যদি আপনি ‘প্রস্টিটিউট’ বলেন, তাহলে এখানে আসা ছেলেদের আমি লম্পট বলব!”

গাড়ির ভেতরে মুহূর্তের জন্য যেন বাতাস জমে গেল। কাতারিনা সামনের সিটে বসেও স্পষ্ট শুনতে পেল তাদের এই বাকযুদ্ধ। জাভিয়ানের মুখের হাসিটা তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে গেল। তান্বীর এই অপ্রত্যাশিত সাহসিকতা যেন তাকে মুহূর্তের জন্য হতবাক করে দিলো।

সামনের সিটে বসা কাতারিনা এতক্ষণ তাদের বাকযুদ্ধ শুনে মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিল, কিন্তু জাভিয়ান আর তান্বীর তীব্র ঝগড়াতে সে বেশ খুশি হলো। সামনের রিয়ার-ভিউ মিররে তার ঠোঁটের কোণের সেই সন্তুষ্টির হাসিটা মুহূর্তের জন্য ধরা পড়ল। আর ঠিক সেটাই দেখতে পেল জাভিয়ান।

সঙ্গে সঙ্গে জাভিয়ান যেন এক নাটকীয় পরিবর্তন আনলো। তার রাগান্বিত মুখের ভাব এক লহমায় পাল্টে গেল। সে আচমকা তান্বীকে নিজের দিকে টেনে নিলো। তান্বী কিছু বোঝার আগেই তার মাথাটা সশব্দে গিয়ে পড়ল জাভিয়ানের বাহুর ওপর।

জাভিয়ান হঠাৎ মিষ্টি, নরম স্বরে কথা বলতে শুরু করলো, যেন কিছুক্ষণ আগের ক্রোধ তার ছিলই না।

“আই’ম সরি, বেইব! আসলে আজকে মুডটা ভীষণ খারাপ ছিল, তাই ক্লাবে এসেছিলাম। তুমি তো জানো, তুমি আমার লাইফে আসার পর আমি এসব জিনিস প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।”

তান্বী অবাক! জাভিয়ানের এমন আকস্মিক পরিবর্তন দেখে সে হতভম্ব। এইমাত্র যে মানুষটা রাগে গর্জান দিচ্ছিল, সে এখন এমন কোমল সুরে কথা বলছে!

কিন্তু হঠাৎই জাভিয়ান অত্যন্ত নিচু স্বরে, প্রায় ফিসফিস করে, তান্বীর কানের কাছে ঝুঁকে এসে বললো—

“কাতারিনার সামনে আমাদের সম্পর্কটা একদম ঠিক আছে, সেটা অভিনয় করো।”

তান্বী এবার পুরো ব্যাপারটা বুঝলো। জাভিয়ান এই সব করছে কেবল সামনের সিটে বসা কাতারিনার জন্য। সে নীরব সম্মতি জানাল, জাভিয়ানের বাহুতে আরও একটু সেঁটে গেল। আর সামনে বসা কাতারিনা তখন স্থির চোখে রিয়ার-ভিউ মিররে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখের হাসিটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

জাভিয়ানের বাহুতে এভাবে মিশে থাকতে হঠাৎ করেই তান্বীর খুব ভালো লাগছিল। এই মুহূর্তে তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। সে ভুলে গিয়েছিল কিছুক্ষণ আগের সমস্ত ঝগড়া আর তিক্ততা।

হঠাৎই জাভিয়ান চাপা স্বরে একটি চিমটি কাটলো—যেন কিছু একটা বলার জন্য ইশারা করছে। তান্বী সাথে সাথেই জাভিয়ানের চোখে চোখ রাখলো।

সে অভিনয় করার বদলে নিজের ভেতরের চাপা অনুভূতিগুলোই যেন প্রকাশ করে দিল। নরম, ঈষৎ অভিমানের স্বরে বললো, “আজকের মতো মাফ করে দিলাম। কিন্তু আর কখনো আপনি এখানে আসবেন না। আপনি জানেন, আমার কতটা জেলাসি হচ্ছিল যখন ওই মেয়েটা আপনার পাশে বসে ছিল? ইচ্ছে করছিল ওর চুল ধরে ছিঁড়ে দিই।”

তান্বী কথাগুলো বললো ঠিকই, কিন্তু এর মধ্যে কোনো অভিনয় ছিল না। এটি ছিল তার একদম ভেতরের কথা। জাভিয়ান স্থির দৃষ্টিতে তান্বীর চোখে তাকিয়ে থাকলো। তার মন যেন বুঝতে পারছিল—তান্বী এই কথাগুলো মন থেকেই বলছে, কাতারিনার সামনে নাটক করার জন্য নয়। এক গভীর, অচেনা অনুভূতি জাভিয়ানকে মুহূর্তের জন্য আচ্ছন্ন করে দিলো।

সামনের সিটে বসে থাকা কাতারিনা তখন মনে মনে ফুঁসছে। সে স্থির চোখে রিয়ার-ভিউ মিররে জাভিয়ান আর তান্বীর নাটকীয় ঘনিষ্ঠতা দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, ‘এরা আসলে আমার সামনে ভান করছে। ভাবছে আমি কিছুই বুঝি না।’ তাদের ঝগড়ার পরই এমন মধুর পরিবর্তন কাতারিনার কাছে ছিল পুরোপুরি সাজানো নাটক। সে নিশ্চিত ছিল, তাকে রাগানোর জন্যই এই জাভিয়ানের অভিনয়।

এর মধ্যেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। গাড়ির একঘেয়ে শব্দ আর রাতের মৃদু হাওয়ায় তান্বীর চোখ বুজে এলো। জাভিয়ানের বাহুর উষ্ণ আশ্রয়ে সে কখন যে ক্লান্তিতে তলিয়ে গেছে, তা টেরও পায়নি।

একসময় জাভিয়ান তাকিয়ে দেখলো, তার বাহুতে মাথা রেখে তান্বী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

তার মুখের সব রাগ, জেদ আর অভিমান ঘুমের অতলে হারিয়ে গেছে। জাভিয়ান নীরবে তান্বীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

সামনের সিটে কাতারিনার উপস্থিতি, কিছুক্ষণ আগের ঝগড়া, আর তান্বীর অকপট স্বীকারোক্তি—সবকিছু যেন এক মুহূর্তে জাভিয়ানের মন থেকে মুছে গেল।

একসময় সে খুব আলতো করে তান্বীর কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো। এরপর প্রায় নিঃশ্বাস ফেলার মতো মৃদু স্বরে, কেবল তান্বীর কানে শোনার জন্য ফিসফিস করে ডাকলো—”জিন্নীয়া…”

সেই ডাকের মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক অধিকারবোধ, কিছুটা স্নেহ আর গভীর এক নীরব ভালোলাগা। বাইরের কোলাহল, ভেতরের ঝগড়া—সব পেরিয়ে ওই এক শব্দেই যেন তাদের দু’জনের জগৎ থেমে গেলো।
.
.
.
.
গাড়ি এসে থামলো বিলাসবহুল ভিলা এস্পেরেন্জার বিশাল ফটকের সামনে। কাতারিনা দ্রুত আগে নেমে পড়লো। সে একবার দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে দেখলো জাভিয়ান নামছে কিনা, তারপর বিরক্তি নিয়ে সরাসরি বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

এদিকে ড্রাইভার দ্রুত এসে পেছনের দরজা খুলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু জাভিয়ান তখনি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ‘হুশ’ করে তাকে থামিয়ে দিলো। কারণ তান্বী তখনো তার বাহুতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

খানিকক্ষণ পর জাভিয়ান খুব আলতো করে তান্বীর মাথাটা গাড়ির সিটে ঠেকিয়ে দিলো। এরপর অত্যন্ত যত্নে তাকে কোলে তুলে নিলো।

কোলে নিতেই তান্বীর ঘুম ভেঙে গেলো। সে চোখ খুলে নিজেকে জাভিয়ানের কোলে আবিষ্কার করে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। জাভিয়ান তখন বাড়ির দরজার প্রায় অর্ধেক পথে চলে এসেছিল, সে আলতো করে তান্বীকে মাটিতে নামিয়ে দিলো।

তান্বী নেমে দাঁড়ালো। তার চোখে তখন ঘুমজড়ানো বিরক্তি আর পুরনো রাগ। সে জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বললো—”আপনার ওই নোংরা হাতে আমাকে স্পর্শ করবেন না! ক্লাবের ওই খারাপ মেয়েদের ছোঁয়া আছে আপনার শরীরে।”

কথাটা বলেই তান্বী দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। জাভিয়ান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তার চোখে তখন রাজ্যের হতাশা আর নীরবতা।
.
.
.
.
রাত তখন বেশ গভীর। মেক্সিকো সিটির প্রাণবন্ত এলাকা পোলানকোতে অবস্থিত বিখ্যাত ক্লাব ‘এল সোল ডে লা নচে’ (El Sol de la Noche) থেকে বেরিয়ে এলো লুসিয়া। ‘এল সোল’-এর প্রবেশপথ তখনও নিয়ন আলোয় ঝলমল করছে, ভেতরে বাজছে ল্যাটিন পপ আর ইলেকট্রনিক মিউজিকের এক উন্মাদ মিশ্রণ। ক্লাবের ভেতরে যেমন উত্তাপ, বাইরেও তেমনই রাতের আর্দ্রতা।

লুসিয়ার চোখে-মুখে তখনো পার্টির রেশ। হাসি-খুশি মুখে তার বন্ধুরা একে একে তাকে বিদায় জানাল। “কাল দেখা হবে!”—এই বলে তাদের গাড়িগুলো ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

এবার লুসিয়া একা। সে তার গাড়ির দিকে হেঁটে গেলো। সিলভার রঙের টেসলা মডেলের দরজা খুলে সে ভেতরের শীতল সিটে নিজেকে এলিয়ে দিলো। শহরের নিয়ন আলো তার কাঁচের জানালার ওপর পিছলে যাচ্ছিল। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ইঞ্জিন স্টার্ট করলো এবং রাতের মেক্সিকো সিটির পথে তার গন্তব্যের দিকে চলতে শুরু করলো।

মেক্সিকো সিটির পথ ধরে লুসিয়ার টেসলা দ্রুত ছুটে চলছিল। কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে তার নিয়ন্ত্রণ তখন আলগা। মাঝরাস্তায় এসে হঠাৎ একটি মোড়ে সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে সামনের একটি গাড়ির পেছনের অংশে ধাক্কা মারে।

ধুম!

সংঘর্ষের শব্দে রাতের নীরবতা ভেঙে গেল। সামনের গাড়িটির ড্রাইভার রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দ্রুত বেরিয়ে এলো। সে লুসিয়াকে দু-কথা শোনাতে যাবে, তার আগেই লুসিয়াও টলতে টলতে নেমে এলো। সে এখন সম্পূর্ণ মাতাল, রাগ আর মদের ঘোরে চোখ লাল। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে উল্টো তাকেই মারার জন্য হাত তোলে লুসিয়া।

ঠিক তখনই, ধাক্কা খাওয়া সেই গাড়িটির পেছনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো এক সুদর্শন ছেলে। দ্রুত এসে সে লুসিয়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো।

লুসিয়া অবাক হলো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি অবাক হলো কারণ ছেলেটিকে তার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।

ছেলেটি তখন ড্রাইভারকে শান্ত স্বরে বললো, “ঠিক আছে, আপনি চলে যান। আমি ব্যাপারটা দেখছি।” ড্রাইভারও আর ঝামেলা না বাড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়লো।

ফারহান তখনও লুসিয়ার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। লুসিয়া ঝাপসা চোখে, জড়ানো গলায় বলতে থাকলো, “হুঁ? হু আর ইউ? কেমন চেনা চেনা লাগছে…”

ছেলেটি শান্তভাবে উত্তর দিল, “ইয়েস, লুসিয়া চৌধুরী।”

লুসিয়ার নামটা বলার পরই ফারহান, মনে মনে যেন একটা প্রতিজ্ঞা করলো। তার চোখে তখন প্রতিশোধের তীব্র আগুন “এটাই সুযোগ প্রতিশোধ নেওয়ার। আমার বোনকে আটকে রেখেছে, এবার আমিও তার বোনকে আটকে রাখব। দেখি এবার কী করে জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী!”

এই কথা ভেবেই ফারহান লুসিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো আর তাকে তার গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিলো। এরপর নিজে দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। লুসিয়া তখনো ঘোর কাটেনি, বুঝতে পারছিল না কী ঘটতে চলেছে।

মেক্সিকো সিটির আলোকিত পথ ছেড়ে ফারহানের গাড়ি তখন বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে। একসময় সে শহরের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন, পুরোনো আর নির্জন একটি এলাকার মাঝে এসে থামলো। সামনে জীর্ণ, লতানো গাছপালায় ঢাকা একটি লোহার গেট। জায়গাটা নীরব, রহস্যময় আর অন্ধকারাচ্ছন্ন।

গাড়ি থামার ঝাঁকুনিতে লুসিয়া তার মাতাল অবস্থাতেই চোখ খুলে চারদিকে তাকালো। তার চোখে ঘোর, দৃষ্টি ঝাপসা। চারপাশের দৃশ্য দেখে তার মনে সন্দেহ জাগলো। সে জড়ানো কণ্ঠে ফারহানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল—”এ… আপনি আমাকে এটা কোথায় এনেছেন? এটা তো আমার বাসা নয়!”

ফারহান কোনো উত্তর দিল না। সে দ্রুত নেমে এসে লুসিয়ার গাড়ির দরজা খুলে দিলো। লুসিয়া তখনও সিটে টলছে, কিছু বোঝার আগেই ফারহান এক ঝটকায় তাকে কাঁধে তুলে নিলো।

লুসিয়া সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো, “ছাড়ুন! আমাকে নিচে নামান!” সে পা ছুঁড়ে, হাত-পা ছুঁড়ে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা করলো, কিন্তু মদ্যপ অবস্থায় তার শরীরে যথেষ্ট জোর ছিল না। ফারহানের বলিষ্ঠ পেশীর কাছে তার কোনো চেষ্টাই ফলপ্রসূ হলো না। সে বাধ্য হয়েই ফারহানের কাঁধে ঝুলে রইলো।

ফারহান তাকে নিয়ে বিশাল লোহার গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এটি ছিল মেক্সিকোর এক নির্জন, পরিত্যক্ত ধাঁচের ভিলা—যা একসময় রিকার্দোর গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভেতরের বাতাস ঠান্ডা এবং ভারী, যেন বহুদিনের পুরনো কোনো রহস্য এখানে লুকিয়ে আছে। ফারহান শক্ত হাতে লুসিয়াকে নিয়ে সেই রহস্যময় ভবনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
.
.
.
.
স্ট্রোম হাউজের বিলাসবহুল নিরাপত্তা বেষ্টনীও যেন এখন ইসাবেলার অস্থির মনকে শান্ত করতে পারছে না। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন রহস্যময় নাইট রেভেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু নাইট রেভেন এমন একজন মানুষ, যিনি নিজে না চাইলে এই পৃথিবীতে কেউ তার নাগাল পাবে না। তার আড়াল এতটাই নিশ্ছিদ্র।

ইসাবেলা অবশ্য হাল ছাড়েননি। তিনি তার নিজস্ব গুপ্তপথ ব্যবহার করে নাইট রেভেনের কাছে একটি জরুরি বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। বার্তায় তিনি জানতে চেয়েছেন—কেন নাইট রেভেন তার ছেলে মেইলস্ট্রোমের ওপর এমন মারাত্মক হামলা করিয়েছেন? মেইলস্ট্রোম কি এমন কোনো কাজ করেছে যার ফলস্বরূপ এই আক্রমণ?

এখন ইসাবেলা সেই বার্তার উত্তরের জন্য পাগলপ্রায়। প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে উদ্বেগ আর আশঙ্কায়। কখন সেই নীরব, অদৃশ্য শক্তির কাছ থেকে একটি জবাব আসবে, কখন তিনি জানতে পারবেন—তাঁর ছেলের জীবনের ওপর নেমে আসা এই বিপদের পেছনের আসল কারণ। নাইট রেভেনের নীরবতা ইসাবেলাকে ক্রমশ এক কঠিন মানসিক চাপে ঠেলে দিচ্ছে।
.
.
.
.
পরের দিন সকাল। ভিলা এস্পেরেন্জার সকালের আলো সবেমাত্র জানালার কাঁচ ভেদ করে ঢুকছে। জাভিয়ান কোনো কথা না বলে তান্বীকে বাড়ির একটি অচেনা, তালাবদ্ধ কক্ষের দিকে নিয়ে গেল। তান্বী অবাক হয়ে জাভিয়ানের পিছু নিল। কক্ষের দরজা খুলে জাভিয়ান ভেতরে প্রবেশ করলো, তান্বীও তাকে অনুসরণ করলো।

কক্ষটি ছিল শীতল এবং প্রযুক্তিনির্ভর। সেখানে কোনো আসবাবপত্র নেই, শুধু একটি দেয়াল জুড়ে বসানো বিশাল একটি সিসিটিভি স্ক্রিন। জাভিয়ান একটি বোতাম চাপতেই স্ক্রিনটি সচল হয়ে উঠলো।

স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সুদূর বাংলাদেশের একটি পরিচিত দৃশ্য। তান্বীর বুকটা কেঁপে উঠলো। পরিষ্কার ফুটেজে দেখা যাচ্ছে—তাদের বাড়ির ভেতরের দৃশ্য।

তান্বীর বাবা সেখানে হুইলচেয়ারে বসে আছেন। তাঁর মুখ শান্ত, হাতে একটি সংবাদপত্র। আর পাশেই রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে কাজ করছেন তান্বীর মা। মায়ের মুখে কোনো ক্লান্তি নেই, যেন সবকিছু স্বাভাবিক।

তান্বী নিঃশব্দে সেদিকে তাকিয়ে রইল। জাভিয়ান কোনো কথা বলল না। শুধু তান্বীর বাবা-মায়ের প্রতি মুহূর্তে নজর রাখা হচ্ছে—এই কঠিন সত্যটা জাভিয়ান এমন নীরব উপায়ে তান্বীর সামনে তুলে ধরলো। সেই বিশাল স্ক্রিনে তার বাবা-মায়ের জীবন যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল।

বিশাল স্ক্রিনে বাবা-মাকে দেখতে পেয়ে তান্বী আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল। হুইলচেয়ারে বসা বাবার স্থিরতা আর মায়ের স্বাভাবিক ব্যস্ততা দেখে তার মন কিছুটা শান্তি পেল। কিন্তু সেই শান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

হঠাৎই তার মনে পড়লো, আর একজনের অভাব। আবেগ সামলে নিয়ে সে অস্থিরভাবে জাভিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো, “মা আর বাবা আছে, কিন্তু… আমার এলিনা আপাকে কেন দেখাচ্ছে না? সে কোথায়?”

জাভিয়ান নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলো, “আমি কী করে জানব তোমার বোন কোথায়? হয়তো বাইরে গিয়েছে।”

জাভিয়ানের এই সহজ উত্তরেও তান্বীর মন শান্ত হলো না। বরং তার অস্থিরতা যেন আরো বেড়ে গেল। এলিনা সাধারণত এত ভোরে বা এত দীর্ঘ সময়ের জন্য বাইরে থাকে না। জাভিয়ানের নির্বিকার কণ্ঠস্বর তার ভেতরের আশঙ্কাকে আরো গভীর করে তুলল।

তান্বীর মনে হলো, কিছু একটা ঠিক নেই। এই ঘরের ঠান্ডা পরিবেশ আর জাভিয়ানের শীতল দৃষ্টি যেন কোনো এক কঠিন সত্য গোপন করছে।
.
.
.

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। জাভিয়ানের বিলাসবহুল ভিলা এস্পেরেন্জা আজ বেশ প্রাণবন্ত। জাভিয়ানের খালু এসেছেন, আর সঙ্গে এসেছে কাতারিনার পাঁচ বছর বয়সী ভাগ্নে। কাতারিনার বড় বোনের ছেলে। যার নাম নিকোলাস (Nicolás)।

তান্বী তখন ড্রয়িংরুমের পেলব সোফায় গা এলিয়ে বসে টিভিতে স্প্যানিশ চ্যানেল দেখছিল। হঠাৎই তার চোখ গেল ছোট্ট নিকোলাসের দিকে। ছেলেটি ফ্লোরে বসে একটি বড় প্যাকেট নিয়ে খেলা করছে। প্যাকেটটির নাম ‘Subritas Adobadas’—এক ধরণের মেক্সিকান চিপস, যা তীব্র মরিচ ও লেবুর স্বাদে টক-ঝাল-মিষ্টির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ।

তান্বীর জিভে জল চলে এলো। বাংলাদেশে সে চিপসের পাগল ছিল, আর মেক্সিকান এই ‘আডোবাডাস’ চিপসের গন্ধই অন্যরকম! সে সিদ্ধান্ত নিলো, যেমন করেই হোক এর স্বাদ নিতেই হবে।

“নিকোলাস বেবি কাম হেয়ার,” মিষ্টি হেসে তান্বী ছেলেটিকে নিজের কোলে ডেকে নিলো।

নিকোলাস সরল মনে তার কোলে উঠে বসতেই তান্বী আদর করার ভান করে বললো, “মাই প্রিন্স, তুমি এত মজার জিনিস খাচ্ছো! আমাকে একটা টেস্ট করতে দেবে?”

বাচ্চাটি এক টুকরো চিপস বের করে তান্বীর মুখের কাছে ধরতেই তান্বী সেটা খেয়ে ফেললো। তার মুখটা সঙ্গে সঙ্গে সুখে ভরে গেল—উফ! কী দারুণ স্বাদ! এই টক-ঝাল-মসলার লোভ সে আর সামলাতে পারলো না।

এবার তান্বী তার ‘ছোছা’ স্বভাবের পূর্ণ ব্যবহার করলো। সে এমন ভাব করলো যেন নিকোলাসের গল্প শুনতে সে খুব ব্যস্ত। অন্যদিকে তার দু’হাত দ্রুত প্যাকেটের ভেতরে ঢুকে গেল। কথা বলতে বলতে সে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি চিপস নিজের হাতে নিয়ে নিলো এবং দ্রুত মুখে পুরে খেতে লাগলো। তার চোখ তখন নিকোলাসের দিকে নয়, চিপসের দিকে!

কিন্তু যখন প্যাকেটের তলানি দেখা গেল, তখন নিকোলাসের হুঁশ হলো। সে দেখলো, তার প্রিয় চিপসের প্যাকেট প্রায় ফাঁকা! সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটা বিকৃত হলো এবং সে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো!

তান্বী তখন মহা বিপদে। তার মুখে তখনো গালের ভেতরে চিপসের ডেলা। দ্রুত সে মুখের ভেতরের সব চিপস বের করে কোনোমতে প্যাকেটের মধ্যে ভরে দিলো (এক বিন্দুও নষ্ট করলো না)। তারপর তার নরম, ছোট্ট মুখে হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো

“চুপ! একদম চুপ নিকোলাস! কাঁদতে নেই! আমি তোমাকে দুইটা নতুন প্যাকেট কিনে দেবো! প্রমিজ! কেউ যেন না জানে!” ভয়ে আর লজ্জায় তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে গিয়েছিল, কারণ জাভিয়ানের বাড়ির কারও সামনে এমন ‘চিপস চুরি’র ঘটনা ফাঁস হোক, সে চাইছিল না।

নিকোলাস যখন হাউমাউ করে কাঁদছে এবং তান্বী তাকে থামাতে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরে প্রবেশ করলো জাভিয়ান। সে শান্ত অথচ তীব্র দৃষ্টিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলো।

“কী হয়েছে, মামা?” জাভিয়ান সরাসরি নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো। যেহেতু বাচ্চাটি মেক্সিকান, তাই জাভিয়ান তার সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বললো।

নিকোলাস দ্রুত তান্বীর কোল থেকে নেমে জাভিয়ানের কৌশলী কোলে উঠে পড়লো। জাভিয়ান জানে, ভাগ্নেকে একবার কোলে নিলেই সে অভিযোগের সব বাঁধ ভেঙে দেবে।

বাচ্চাটি কিছু বলার আগেই তান্বী দ্রুত মুখ খুললো। তার চোখে তখনো ‘চিপস চুরি’র ভয়। সে এক মুহূর্তেই সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গল্প ফেঁদে বসলো—”ও আসলে কাঁদছে, কারণ ও আমাকে ওর সঙ্গে খেলতে বলছিল। তাই আমি বলেছি, ‘আসো, একসঙ্গে টিভি দেখি।’ কিন্তু ও খেলবে, তাই রেগে গিয়ে কাঁদছে।”

তান্বীর কথায় ছিল দ্রুততা আর চতুরতা। জাভিয়ান এক পলক তান্বীর দিকে তাকালো, যেন তার মিথ্যাটা সে মুহূর্তেই ধরে ফেলেছে। কিন্তু সে কোনো কথা বললো না। জাভিয়ানের চোখে ছিল নীরব উপহাসের ছাপ।

এরপর জাভিয়ান আর কোনো মন্তব্য না করে নিকোলাসকে কোলে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তান্বী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
.
.
.
.
.
রাতের নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে ভিলা এস্পেরেন্জাকে। ডাইনিং টেবিলের দামি আলো ঝলমল করছে বটে, কিন্তু পরিবেশ ছিল ভীষণ ভারী। টেবিলের মাঝখানে উপচে পড়া খাবার থাকা সত্ত্বেও সেখানে কোনো উষ্ণতা ছিল না। জাভিয়ানের মা কার্গো এইমাত্র হাসপাতাল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে গেছেন—কারণ, জাভিয়ানের ভাই মার্কো এখনো হাসপাতালের বেডে ভর্তি।

মিস্টার চৌধুরী, জাভিয়ানের বাবা, কাঁটা চামচটা শব্দ করে প্লেটে নামিয়ে রাখলেন। তিনি সরাসরি জাভিয়ানের দিকে তাকালেন।

“তোমার ভাই এখনো হাসপাতালে সেই ঘটনার পর থেকে। আর একবারও তো গেলে না, জাভিয়ান? একটুও কি মায়া নেই তোমার ভাইয়ের প্রতি?” বাবার কণ্ঠে ছিল চাপা হতাশা।

জাভিয়ান তার প্লেটের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। বাবার কথা শেষ হতেই সে এক ঝলক চোখ তুললো এবং এমনভাবে হাসলো, যে হাসিটা ছিল শীতল এবং নির্মম।

“আমার নিজেকে ছাড়া আর কারও প্রতি মায়া লাগে না, মিস্টার চৌধুরী। আর কতদিন গেলে এটা বুঝবেন?” জাভিয়ানের কণ্ঠস্বর ছিল পাথরের মতো কঠিন।

এক নীরবতা নেমে এলো। সেই নীরবতা ভেঙে তান্বী হঠাৎই বলে উঠলো, তার কণ্ঠে ছিল মানবিকতা—

“আমি যাবো কাল মার্কো ভাইয়াকে দেখতে।”

সঙ্গে সঙ্গে জাভিয়ান মাথা ঘুরিয়ে তান্বীর দিকে তাকাল। তার চোখ দুটো যেন সতর্ক সংকেত দিলো।

“কোথাও যাবে না,” জাভিয়ান শান্ত কিন্তু চূড়ান্ত আদেশের সুরে বললো, “আমার পারমিশন ছাড়া তুমি কোথাও যাবে না।”

তান্বী থমকে গেল। সেই মুহূর্তে জাভিয়ানের শীতল দৃষ্টি তাকে মনে করিয়ে দিলো—এই বাড়ির সব সিদ্ধান্ত তার একার।

ডাইনিং টেবিলে অস্থিরতা,ডাইনিং টেবিলের চাপা উত্তেজনা তখনো কাটেনি। জাভিয়ানের খালা রেজিনা সম্ভবত মার্কোকে দেখতে যাওয়ার বিষয়ে জাভিয়ানকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর মুখ খোলার আগেই জাভিয়ান হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলো—বোঝার বাকি রইল না যে কারও কোনো কথা বা অনুরোধ শোনার মতো সময় কিংবা ইচ্ছা তার নেই।

এই থমথমে পরিবেশে হঠাৎ কাতারিনা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। তার কণ্ঠে ছিল উদ্বেগ, কিন্তু তার চোখ জাভিয়ানের দিকে স্থির—”লুসিয়া কোথায়? এত রাত হলো, এখনো বাড়ি আসছে না কেন?”

কাতারিনার প্রশ্ন শুনে জাভিয়ানের বাবা হতাশভাবে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই প্রজন্মের ওপর তার বিরক্তি যেন আর চাপা রইল না।

তিনি হতাশা ভরা কণ্ঠে বললেন, “আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে কোনো দয়ামায়া নেই! ভাইটা হাসপাতালে পড়ে আছে, আর বোন কোথায় যেয়ে বসে আছে!”

টেবিলের ওপরের ঝলমলে আলোতেও পারিবারিক সম্পর্কের শীতলতা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো। জাভিয়ান এই সব কথার কোনো উত্তর না দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তার খাবার দেখছিল।
.
.
.

ডিনারের পর সেই চাপা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে তান্বী দ্রুত নিজের রুমে চলে এলো। রুমে ঢুকেই সে আলমারিটা খুললো—রাতের পোশাক বের করার জন্য।

কিন্তু আলমারির দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো। ঝরঝর করে চিপসের বৃষ্টি শুরু হলো!

তান্বীর চোখ কপালে। পুরো আলমারির ভেতরটা আর মেঝের একটা অংশ ভরে গেল সেই চিপসে—একটানা প্যাকেটের পর প্যাকেট subritas Adobadas! সেই চিপস, যেটা সে সন্ধ্যায় নিকোলাসকে কাঁদিয়ে প্রায় চুরি করে খেয়েছিল

তান্বীর বুঝতে আর বাকি রইল না। এই কাজ জাভিয়ানের। তার মানে, জাভিয়ান শুধু নিকোলাসের কান্না শুনেই বেরিয়ে যায়নি—সে সবকিছু দেখেছিল। তার চিপসের প্রতি লোভ, চুরির মতো করে সেগুলো দ্রুত হাতে নেওয়া, আর তারপর নিকোলাসকে মিথ্যা বলে ধমকে থামানো—এক মুহূর্তের মধ্যেই জাভিয়ান তার সমস্ত ভণ্ডামি দেখে ফেলেছে এবং তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে!

জাভিয়ান তাকে প্রমাণ করে দিলো, সে ছোট একটা বাচ্চার জিনিস কীভাবে লোভের বশে হাতানোর চেষ্টা করেছে!

লজ্জায়, অপমানে এবং জাভিয়ানের কাছে এমন নোংরাভাবে ধরা পড়ার যন্ত্রণায় তান্বীর ঠোঁটের কোণের হাসিটা পুরোপুরি মুছে গেল। সে সোজা আলমারির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। নিজের ভাগ্যের দিকে নয়, নিজের তুচ্ছ কৃতকর্মের দিকে তাকিয়ে সে সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললো।

এই কান্নাটা ছিল নিজের প্রতি ধিক্কারের। এই দামি ভিলা এস্পেরেন্জায়, জাভিয়ানের মতো মানুষের সামনে সে এমনভাবে সামান্য চিপসের জন্য লোভী সেজে ধরা পড়লো! তান্বী কাঁদতে কাঁদতে চিপসগুলো দু’হাতে সরিয়ে দিতে লাগলো। জাভিয়ান তাকে যেন এই চিপসগুলো দিয়ে বুঝিয়ে দিল, সে তার সমস্ত দুর্বলতা এবং ছেলেমানুষি এমন সহজে আবিষ্কার করে ফেলেছে, আর এই মুহূর্তে সে সম্পূর্ণরূপে জাভিয়ানের হাতের মুঠোয়!

চলবে………..

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply