Golpo ডার্ক রোমান্স ডিজায়ার আনলিশড

ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৩


ডিজায়ার_আনলিশড (Desire Unleashed)

✍️ লেখিকা: #সাবিলা_সাবি

পর্ব -১৩

সূর্যটা তখনও পুরোপুরি উঠেনি, কিন্তু আকাশ যেন সোনালি আর কমলা রঙের তুলিতে আঁকা ক্যানভাসের মতোই হয়ে আছে। দূরে সমুদ্রের গর্জন মিলেমিশে যাচ্ছে শহরের হালকা কোলাহলের সাথে। পাখিরা সারি বেঁধে উড়ছে, আর হাওয়ায় ভেসে আসছে ভেজা মাটির গন্ধ। সকালে মেক্সিকোর প্রকৃতি সবসময়ই অন্যরকম থাকে—উষ্ণ তবুও প্রশান্তির ছোঁয়া মাখা।

শহরের অভিজাত অঞ্চলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ভিলা এস্পেরেন্জা—জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরীর প্রাসাদসদৃশ বাড়ি। বাইরে যেমন কঠোর নিরাপত্তা আর ভেতরে তেমনি রাজকীয় সৌন্দর্যে ভরা।

আজকের সকালটা তান্বীর জন্য একবারে আলাদা। প্রথমবারের মতো সে ভিলা এস্পেরেন্জার কিচেনে প্রবেশ করেছে। বিশাল রান্নাঘরে ইতিমধ্যেই কাজ করছে কয়েকজন সার্ভেন্ট—কেউ সবজি কাটছে, কেউ নাস্তার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ তান্বী এগিয়ে গেলো নিজ হাতে চা বানাতে।

সারাদিন প্রাসাদের মতো বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে তার বিরক্তি ধরে গেছে। সে ভেবেছে—”সবসময় অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, অন্তত ছোটখাটো রান্নাটা শেখা দরকার।”

আজ তাই সার্ভেন্টদের চোখ এড়িয়ে, নিজের লম্বা শাড়ির আঁচল সামলে, সে দাঁড়িয়ে গেলো চুলার সামনে। তার সামনে রাখা ছিলো দুধ, পানি, চা পাতা আর কিছু মশলা।

হাত কাঁপছিলো সামান্য, কারণ এর আগে কখনোই সে রান্না বান্নার কাজ করেনি। তবু দৃঢ়ভাবে বললো নিজের মনে— “পারব আমি, আজ চা বানিয়ে দেখাবো।”

চুলায় হাঁড়ি চড়াতেই দুধ ফুটে উঠলো আর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো মিষ্টি সুগন্ধ।

কিচেনের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জাভিয়ানের মা হালকা মুচকি হেসে ভাবলো—”এই মেয়েটা সত্যিই আলাদা…”
.
.
.
.
তান্বী তার নিজের যত্ন করে বানানো চা একে একে কাপগুলোতে ঢাললো। ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে প্রথমে এগিয়ে গেলো জাভিয়ানের বাবা-মায়ের দিকে।

—“এই নিন মম, ড্যাড…আপনাদের জন্য চা।”

সায়েম চৌধুরী অবাক দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে নিয়ে কাপটা হাতে নিলেন। তার কড়া মুখে হালকা নরম ভাব ফুটে উঠলো। অন্যদিকে জাভিয়ানের মা স্নেহভরা চোখে বললেন——“নিজের হাতে বানিয়েছো? দারুণ দেখতে হয়েছে চা।”

কিন্তু পাশেই বসে থাকা লুসিয়া কাপটা ঠেলে দিয়ে বললো——“সরি আমি চা খাই না।”

কক্ষে মুহূর্তের জন্য হালকা অস্বস্তি নেমে এলো। তান্বী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো, তখন জাভিয়ানের মা হেসে বললেন——“মার্কো তো চা খায়। ওকে এক কাপ দিয়ে দাও।”

তান্বী একটু দ্বিধা নিয়ে বললো—“ঠিক আছে, আমি ওনাকে দিয়ে আসি।”

সাথে সাথে মা থামিয়ে দিলেন——“না, তুমি কেন কষ্ট করবে? সার্ভেন্ট আছে, ওদের দিয়ে পাঠাও।”

তান্বী মুচকি হেসে মাথা নাড়লো——“না মম, আমি নিজেই নিয়ে যাই।”

তখন লুসিয়া হঠাৎ বিরক্ত ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো
—“মার্কো ভাইয়া এই সময়ে নিজের প্রাকটিস রুমে আছে, রিভলভার, আর নানান অস্ত্র নিয়ে প্র্যাকটিস করে। তুমি যদি ওকে চা দিতে চাও, ওখানেই যেতে হবে।”

কথাটা বলেই লুসিয়া হালকা হাসলো, যেন ইচ্ছে করেই তান্বীকে ভয় দেখাতে চাইছে।

তান্বী কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু ট্রেটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে গেলো সেই আলাদা রুমের দিকে। করিডোর পেরিয়ে যখন সে অচেনা রুমটার দরজার সামনে দাঁড়ালো, ভেতর থেকে ভেসে আসছিলো ধাতব আওয়াজ আর গুলির খোল ঝনঝন করার শব্দ।

ভিলা এস্পেরেন্জার ভেতরের নির্জন এক করিডর পেরিয়ে তান্বী ছোট্ট ট্রেটা হাতে নিয়ে দাঁড়ানো দরজার সামনে। হালকা কাঁপতে থাকা হাতে তিনবার নক করল সে। ভেতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো—

—“এই সময়ে কে?”

তান্বী দ্বিধা ভরা কণ্ঠে বলল,—“ভাইয়া… আমি চা নিয়ে এসেছি।”

একটু নীরবতার পর ভেতর থেকে উত্তর এল—“দরজা খোলা আছে।”

তান্বী ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। ঘরটা ছিল একেবারে অন্যরকম। চারদিকে অস্ত্রের তাক সাজানো—রিভলভার, পিস্তল, কিছু পুরনো ধাঁচের গান। দেওয়ালে ঝোলানো টার্গেট বোর্ডগুলোতে গুলির দাগ স্পষ্ট। মাঝের টেবিলে রাখা একটা লাল আপেল, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে মার্কো, হাতে ধরা রিভলভার।

সে মুহূর্তেই মার্কো নিশানা করল একটা আর ধাম!—গুলির শব্দে আপেলের অর্ধেক উড়ে মাটিতে পড়ল। ধাতব গন্ধে ঘরটা ভারি হয়ে উঠল।

তান্বী ভয়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,—“আপনি কি… মাফিয়ার ডন টন নাকি, ভাইয়া?”

মার্কো হেসে ফেলল —“ধুর বোকা! আমি কেন মাফিয়া হবো? এগুলো প্র্যাকটিস করি নিজের আত্মরক্ষার জন্য। আসলে সবারই শেখা উচিত, ইভেন তোমারও।”

তান্বীর বুকের ভেতর হঠাৎই দপদপ করতে লাগল। হয়তো সত্যিই আমার শেখা উচিত… একদিন যদি জাভিয়ান চৌধুরীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়, নিজেকে রক্ষা করতে অন্তত চেষ্টা তো থাকবে…তাকে হারিয়ে দিয়ে নিজের পরিবারের কাছে ফেরা যাবে।

সবকিছু ভেবে তান্বী চোখে সাহস এনে সে বলল,
—“আমি ও শিখতে চাই, ভাইয়া।”

মার্কোর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠলো, তারপর একটা গম্ভীর হাসি দিয়ে সে রিভলভারটা উল্টে ধরে তান্বীর হাতে দিল। ঠান্ডা ধাতব স্পর্শে তান্বীর হাত কেঁপে উঠল একটু।

—“রিল্যাক্স,” শান্ত গলায় বলল মার্কো। “ভয় পেলে হবে না। নিশানা ধরো, শ্বাস ঠিক করো… তারপর ট্রিগার টানো।”

তান্বী আপেলের দিকে তাকাল, চোখ শক্ত করে ফেলল, আর ট্রিগার টানল। গুলির শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল, কিন্তু আপেল অক্ষত রয়ে গেলো—বরং টেবিলের পাশে থাকা একটা ফুলদানি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

তান্বী লজ্জায় মুখ নামিয়ে বলল,—“মাফ করবেন ভাইয়া… আমি পারিনি উল্টো আপনার ক্ষতি করে দিলাম।”

মার্কো হেসে উঠল তারপর বললো —“প্রথমবারে কেউই পারে না। আবার চেষ্টা করো পারবে।”

সে আবার নতুন একটা আপেল রাখল টেবিলে। এবার তান্বী দাঁত চেপে মনোযোগ দিল। শ্বাস ধীরে ছাড়ল, নিশানায় চোখ রাখল। ধাম!—গুলির শব্দ হলো কিন্তু এবার ও আপেল অক্ষত থেকে গেলো।

তান্বী এক মুহূর্ত স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর তার ঠোঁটে নিজেই অজান্তে একটা বিরক্তি ফুটে উঠল।

তান্বী বারবার চেষ্টা করেও লক্ষ্যভেদ করতে পারল না। একবার ফুলদানিতে গুলি লাগল, একবার মেঝেতে, আরেকবার ছাদের এক কোণ ঘেঁষে গিয়ে দেয়ালে দাগ কেটে দিল। ঘাম জমল কপালে, হাত কাঁপছিল ক্রমশ তার।

মার্কো কিছুক্ষণ নীরব থেকে গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, তারপর গম্ভীর গলায় বলল—“তোমার নিশানা ভুল হচ্ছে। শুধু হাতের জোরে হবে না, নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। আমি শিখিয়ে দিচ্ছি… বাট, ক্যান আই টাচ ইউর হ্যান্ড?”

তান্বী চোখ মেলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—সে কি রাজি হবে? একজন অপরিচিত পুরুষের হাতের ছোঁয়া নিতে? আবার মনে হলো, শেখা যদি জরুরি হয় তবে লজ্জার দেয়াল ভাঙতেই হবে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শেষমেশ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ল তান্বী। —“ওকে…”

মার্কো তখন ধীরে ধীরে তার পেছনে এসে দাঁড়াল। মাঝখানে সামান্য ফাঁক রেখেই, যেন সীমারেখা অতিক্রম না হয়। কেবল দু’হাত বাড়িয়ে আলতো করে তান্বীর হাতের ওপর নিজের হাত রাখল। রিভলভারের ধাতব ঠান্ডা আর তার আঙুলের দৃঢ়তা মিলেমিশে এক অনিশ্চিত কম্পন তুলল তান্বীর শরীরে।

—“শ্বাস ঠিক করো…” মার্কো ফিসফিস করে বলল।
তার কণ্ঠের ভারী সুর যেন তান্বীর কানে সরাসরি প্রবেশ করল। —“চোখে শুধু টার্গেট দেখো। হাত শক্ত করে রেখো না, আবার একেবারে ঢিলেও নয়… ব্যালেন্স করতে শিখতে হবে।”

তান্বীর বুক দ্রুত ওঠানামা করছিল। সে ঠোঁট কামড়ে চোখ সরাসরি টার্গেটের দিকে রাখল। মার্কোর হাত তাকে গাইড করছিল, ঠিকভাবে নিশানা ধরে রাখার জন্য।

ঘরজুড়ে এক নিস্তব্ধতা নেমে এলো। ধাম! গুলির শব্দে আপেলটা মাঝ বরাবর ছিঁড়ে টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়ল।

তান্বী অবিশ্বাসে তাকিয়ে রইল নিজের হাতে ধরা রিভলভারের দিকে। যেন এ হাতটা তার নয়।

মার্কো হেসে ধীরে সরে গেল পেছনে, তার কণ্ঠে প্রশংসা
—“পারফেক্ট। দেখলে? একবার সঠিকভাবে ফোকাস করতে পারলেই তুমি পারবে।”

তান্বীর চোখে প্রথমবারের মতো ঝিলিক খেল আত্মবিশ্বাসের। ভেতরে ভেতরে মনে হলো— হয়তো আমি সত্যিই একদিন লড়তে পারব।
.
.
.
.
প্র্যাকটিস রুম থেকে বেরিয়ে তান্বী নিজের কক্ষের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চমকে একরকম থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সোফার উপর জাভিয়ান হেলান দিয়ে বসে আছে—পায়ের উপর পা তোলা, সামনে টেবিলে খোলা এক গ্লাস রেড ওয়াইন, আর ঠোঁটে আধভাঙা সিগার। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধীরে ধীরে উপরে উঠছে, ঘরটাকে আরও ভারী করে তুলছিল।

তান্বী অবাক হয়ে বলল—“আপনি… কখন এসেছেন?”

জাভিয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে একরকম তাচ্ছিল্যের হাসি দিল—“কেনো? আমি না এলে বুঝি তোমার ভালো লাগতো?”

তান্বী উত্তর খুঁজে পেল না, শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ হঠাৎ আটকালো সোফার পাশে রাখা কয়েকটা বড় শপিং ব্যাগে।

জাভিয়ান সেদিকেই ইশারা করল, তারপর হাত বাড়িয়ে ব্যাগগুলো তার দিকে এগিয়ে দিল —“নাও, এগুলো তোমার জন্য।”

তান্বী দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে ব্যাগ নিল। বিছানার কোণে বসে একে একে খুলে দেখতে লাগল। একের পর এক থ্রি-পিস, রঙিন কাপড়, ঝলমলে কাপড়ের সঙ্গে মিলে থাকা ইনারও আছে।

ইনারগুলো হাতে তুলে ধরতেই তান্বীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে ধোঁয়া ছেড়ে হেসে ফেলল—একটা ধূর্ত, দমবন্ধ করা হাসি।

তান্বী হাতের পোশাকগুলো দেখে অবাক চোখে তাকাল।—“আমার জন্য শপিং… কখন করলেন এগুলো?”

জাভিয়ান ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে সিগারটা অ্যাশট্রেতে চেপে নিভিয়ে দিয়ে বলল,—“অনলাইন অর্ডার করছিলাম । আজকে ডেলিভারি ম্যান অফিসে পার্সেল দিয়ে গেছে।”

তান্বীর কপালে ভাঁজ পড়ল।—“আপনি আমার জন্য শপিং করেছেন… অনলাইন থেকে! কিন্তু আপনি কি করে জানলেন আমার পার্সোনাল জিনিসের মাপ?”

জাভিয়ান হেসে এক পলক তাকাল তার দিকে। চোখে কেমন যেন বিদ্রূপের ঝিলিক —“আমার চোখদুটো স্ক্যানার। তোমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে ফেলেছি। বাই দ্য ওয়ে, বডি দেখলে বোঝা যায় না ৩৬…”

তার কথা শেষ হবার আগেই তান্বীর মুখ লাল হয়ে উঠল। ক্ষোভ আর লজ্জায় ভরে উঠল ভেতরটা।
—“ছি! আপনি এতো অসভ্যতামি কিভাবে করেন?”

জাভিয়ান কেবল একরকম উদাস ভঙ্গিতে হাসল—যেন তার প্রতিক্রিয়াটা সে আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল।

তান্বী শপিং ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারির পাশের সোফাতেই গা হেলান দিয়ে বসে ছিল জাভিয়ান—ওয়াইনের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ানো, চোখদুটো হালকা আধো-ঘুমন্ত ভঙ্গিতে তান্বীর দিকে।

তান্বী আলমারির দরজা খুলে একে একে ব্যাগগুলো ভেতরে সাজিয়ে রাখতে লাগল। ওপরের তাকে রাখতে গিয়ে সে হাত উঁচু করতেই শাড়ির আঁচল সরে কোমরের মসৃণ অংশটা উঁকি দিল।

জাভিয়ানের দৃষ্টি সেখানে গিয়ে আটকে রইল।
অকস্মাৎ সে দুই আঙুল বাড়িয়ে কোমরের পাশটায় হালকা চিমটির মতো করে টান দিলো।

তান্বী চমকে উঠে এক ঝটকায় সরে গেল।
চোখ বড় বড় করে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,—“আপনি কোন সাহসে আমার কোমড়ে চিমটি দিলেন?”

জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে একরাশ দুষ্টু হাসি টেনে নিয়ে বলল,—“এত খাও তুমি আবার জিমও করোনা …তবুও পেট এত স্লিম কিভাবে?”

তান্বীর মুখ রাগে লাল হয়ে উঠল, সে ফুঁসতে ফুঁসতে পিছিয়ে দাঁড়াল।

কিন্তু জাভিয়ান থামল না।নিঃশব্দে গ্লাসটা নামিয়ে, ঠাণ্ডা অথচ বিদ্রূপ মাখা কণ্ঠে যোগ করল—“বাই দা ওয়ে, তোমার ওয়েস্ট কিন্তু… অস্বাভাবিকভাবে সফ্ট।”

তান্বী নিশ্বাস ফেলে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে পারল না। শাড়ির আঁচল ঠিক করে দ্রুত বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।

জাভিয়ান তখনও সেই একই ভঙ্গিতে হালকা হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইল তার পেছনে।
.
.
.
.
সন্ধ্যার নীরবতা ভেদ করে ফারহান প্রবেশ করল জাভিয়ানের বিশাল প্রাসাদে। গেটের গার্ডরা কেউই তাকে থামাল না—অদ্ভুত নীরবতা যেন সবার ওপর ছড়িয়ে আছে।

অভ্যন্তরে ঢুকতেই ড্রয়িংরুমের ঝাড়বাতির আলোয় চোখে পড়ল চারজন বসে আছে—সায়েম চৌধুরী গম্ভীর মুখে সোফায় হেলান দিয়ে, তার পাশে জাভিয়ানের মা, আরেকপাশে লুসিয়া আর মার্কো। হঠাৎ আগন্তুক দেখে সবাই চমকে উঠল।

—”কে তুমি?” গলা কড়া করলেন সায়েম চৌধুরী।

ফারহান গম্ভীর দৃষ্টিতে চারজনের দিকে তাকাল।—“আমি ফারহান রেহেমান… তান্বীর ভাই। আপনাদের ছেলে জাভিয়ান চৌধুরী আমার বোনকে জোর করে বিয়ে করেছে, আর এখানে বন্দি করে রেখেছে। আমার বোনকে ডাকুন—আমি ওকে নিয়ে যেতে এসেছি।”

কথাগুলো বজ্রাঘাতের মতো নেমে এলো ঘরে। সবার মুখ এক নিমিষে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সায়েম চৌধুরীর হাত থেমে গেল সিগারেট ধরতে গিয়ে। মুহূর্তেই তিনি জোরে ডাকলেন, —“জাভিয়ান!”

সাথে সাথে সিঁড়ির ওপরে ভেসে উঠল দুটো ছায়া। হাত ধরাধরি করে নেমে এলো জাভিয়ান আর তান্বী। যেনো আগেই থেকেই ডাকের অপেক্ষায় ছিলো জাভিয়ান।ফারহান তার বোনকে দেখেই আর নিজেকে সামলাতে পারল না—দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তান্বীকে।

—“তান্বী! আমি তোকে নিতে এসেছি… তোকে আর ভয় পেতে হবে না। এই দানবের সাথে আর তোকে আর থাকতে হবে না। চল আমার সাথে।”

কিন্তু ঠিক তখনই তান্বীর চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক দেখা গেল। সে ধীরে ধীরে ফারহানের হাত ছেড়ে দিল। চারপাশের সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।

তান্বী কাঁপা গলায় বলল, —“আপনি কে?”

তার এই অচেনা প্রশ্নে যেন মুহূর্তেই চারদিকের বাতাস জমে গেল। ফারহানের চোখ বড় হয়ে উঠল, বুকের ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে আসতে চাইছে। আর জাভিয়ান পাশ থেকে ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক শীতল হাসি ফোটাল।

ফারহান বুক ভরা কষ্ট নিয়ে তান্বীর সামনে দাঁড়াল। চোখে জমা কান্না আর কণ্ঠে অস্থিরতা মিশে আছে।

—“আমি জানি তুই আমার ওপর রেগে আছিস, তান্বী। আমি যা করেছি… যা ঘটেছে তার জন্য তোর আমাকে ঘৃণা করা একেবারেই স্বাভাবিক। আমি সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু, বাবা-মা তো কোনো অপরাধ করেনি! তারা এখনো তোর জন্য অপেক্ষা করছে। চল… প্লিজ চল আমার সাথে।”

ঘরে মুহূর্তেই চাপা নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সায়েম চৌধুরী ও তার স্ত্রী বিস্মিত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকালেন। অবশেষে সায়েম গম্ভীর গলায় বললেন,

—“জাভি… এসব কি হচ্ছে? এই ছেলে কে? আর এভাবে তান্বীর ভাই দাবি করছে কেনো? আর কি বলছে তুমি ওর বোনকে জোর করে বিয়ে করে এখানে আটকে রেখেছো?”

তান্বী সবার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে হেসে উঠল, ঠোঁটে অদ্ভুত শীতলতা —“আপনারা ভুল করছেন। আমার তো কোনো ভাই নেই। আর এই ভদ্রলোক আমার নামই কিভাবে জানলো সেটাই তো বুঝতে পারছিনা ?”

কথাগুলো শোনামাত্র জাভিয়ানের দৃষ্টি কঠিন হয়ে উঠল। সে ধীরে ধীরে ফারহানের দিকে এগিয়ে এসে গম্ভীর স্বরে বলল,

—“তোকে এখানে পাঠিয়েছে কে? কার লোক তুই?”

ফারহানের চোখে রক্ত চড়ে গেল। মুহূর্তেই সে জাভিয়ানের কলার চেপে ধরল।

—“বাস্টার্ড! আমার বোনের সাথে কি করেছিস তুই? কেন সে আমাকে অস্বীকার করছে? কি করেছিস ওর সাথে?”

চারপাশে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল। তান্বীর বুক কেঁপে উঠল। সে দ্রুত জাভিয়ানের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। জাভিয়ানের রাগ সম্পর্কে তার ধারনা আছে, তার ভাইকে যেনো কিছু না করে সেই কারণেই হাত চেপে ধরে থামার ইঙ্গিত দিলো।

জাভিয়ান ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি টেনে নিল। ধীরে ধীরে ফারহানের কলার চেপে ধরা হাতের ওপরে নিজের এক হাত রেখে, কানের কাছে মুখ নিয়ে শীতল স্বরে ফিসফিস করল,

—“আমি তোর বোনকে এত ভালোবাসা… এত মধুর আদর দিয়েছি যে এখন ও আমায় ছাড়া কিছুই বোঝে না। কাউকেই আর চিনতে পারবে না।”

ফারহানের দৃষ্টি অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠল। সে ঘুষি মারতে উদ্যত হলো। ঠিক তখনই তান্বী বজ্রের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ফারহানের হাত চেপে ধরল।

—“আপনার সাহস তো কম না!” কণ্ঠে জোরে আগুন ঝরল। “আমার হাজবেন্ডেয গায়ে হাত তুলতে চাইছেন? কতবার বলছি—আমার কোনো ভাই নেই! আপনি কে, কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন জানি না, কিন্তু প্লিজ, এখনই বেরিয়ে যান।”

চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। ঠিক তখনই কার্গো চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লুসিয়া হেসে উঠল ফিসফিসিয়ে, কিন্তু শব্দটা সবার কানে গিয়ে লাগল।

—“বড় আম্মু, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই মেয়েটা নাটক করছে।দেখো ওদের চেহারার মিল আছে… মনে হচ্ছে সত্যিই ভাই-বোন।”

ফারহান হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ধীরে ধীরে সে জাভিয়ানের কলার ছেড়ে দিল। চোখে অসহায় দৃষ্টি, তবু বুকের ভেতর ঝড়।

আর তান্বী ঠাণ্ডা স্বরে আবার বলল,—“আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

তার এই তীব্র অস্বীকৃতির সামনে ফারহানের বুকটা যেন একেবারে ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেল।

ফারহান কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থাকল। চোখে জ্বলন্ত আগুন, বুকের ভেতর দমিয়ে রাখা প্রতিশোধের তাণ্ডব। তারপর হঠাৎ করেই সে তান্বীর দিকে তাকিয়ে জাভিয়ানের দিকে আঙুল তুলে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল—

—“আমি জানি, এই মাদারফাকার তোকে ভয় দেখিয়েছে। সমস্যা নেই, তান্বী। আমি দেখে নেবো ওকে… এখন যাচ্ছি। এরপর যা হবে, তা কল্পনারও বাইরে।”

শব্দগুলো বাতাস ছেদ করে যেন সবার কানে বাজল বজ্রপাতের মতো। কোনো উত্তর না দিয়েই ফারহান দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ভারী পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল প্রাসাদের করিডোরে।

দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে তান্বীর বুক থেকে যেন চাপা শ্বাস বেরিয়ে এলো। সে ঠোঁট কামড়ে চোখ নামিয়ে নিল, যেনো ভেতরের ভয় লুকিয়ে রাখছে।

কিন্তু তার চোখের গভীরে সেই মুহূর্তে অদ্ভুত দ্বন্দ্ব খেলে গেল—ভয়, বিভ্রান্তি আর অব্যক্ত কষ্টের মিশ্রণ।

ফ্ল্যাশব্যাক:

সন্ধ্যার ঠিক আগে, বিকেলের লাল আলো ভিলার বারান্দায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তান্বী তখন নিজের কক্ষে বই পড়ছিল। হঠাৎ দরজাটা ঠাস করে খুলে গেল। জাভিয়ান ভেতরে ঢুকল, মুখে অদ্ভুত গম্ভীরতা।

তান্বী কেঁপে উঠে বলল——“আপনি এভাবে হঠাৎ ঢুকলেন কেন?”

জাভিয়ান ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সোফায় বসল, পকেট থেকে একটা সিগার বের করে ধরাল। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিচু স্বরে বলল——“আজ সন্ধায় তোমার ভাই আসবে এই বাড়িতে।”

তান্বীর বুকটা ধক করে উঠল। সে হতভম্ব হয়ে রইল।
—“ভাইয়া? মানে… ফারহান ভাইয়া?”

জাভিয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে কুটিল হাসি দিল।
—“হ্যাঁ, ফারহান রেহেমান। সে ভেবেছে খুব বীরত্ব দেখাবে, এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি যদি চাই, আমার লোকেরা তাকে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেও দেবে না।”

তান্বী কাঁপা গলায় বলল——“আপনি কি ভাইয়াকে কিছু করবেন?”

জাভিয়ান হঠাৎ ঝুঁকে পড়লো,তান্বীর খুব কাছে ঝুকলো। চোখে তীব্র আগুন জ্বলে উঠল।—“তুমি যদি আজকে সবার সামনে ওকে ‘ভাই’ বলে ডাকো … বা স্বীকার করো যে ও তোমার আপনজন—তাহলেই কাল ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে শুধু লাশ হিসেবে। বুঝলে?”

তান্বীর চোখ ভিজে গেল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল —“কিন্তু… ও আমার ভাই…”

জাভিয়ান তখন তান্বীর চিবুক আঙুল দিয়ে ধরে বলল—
—“শোন, আমি একবার বলে দিচ্ছি। তুমি ওকে চিনবে না। তোমার মুখ থেকে বেরোবে—‘আমার কোনো ভাই নেই’। না হলে, কাল তোমার সেই ভাইকে গুলি খেতে দেখবে।”

তারপর হঠাৎ জাভিয়ান নরম গলায়, কিন্তু ভয়ংকর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল——“আমি ঠিক যা বলব, তাই করবে। না হলে ফারহান মারা যাবে।”

তান্বী বুক চেপে বসে পড়ল সোফায়। জাভিয়ান বেরিয়ে গেল, ঘরে শুধু ধোঁয়ার গন্ধ আর আতঙ্ক ছড়িয়ে রইল।
.
.
.
.
বর্তমান:

ফারহানের পায়ের আওয়াজ থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তান্বীর বুক এক অদ্ভুত কাঁপনে ভরে উঠল। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। মনে মনে বিস্ময়ভরা এক মৃদু শব্দ উচ্চারণ করল—“ভাইয়া… আমায় ভুল বোঝো না।”

তান্বীর চোখের সামনে ভেসে উঠল পরিবারের ছবি—বাবা-মা, আর বোন এলিনা। কণ্ঠস্বরে যেন এক অদ্ভুত স্থির প্রতিজ্ঞা ফোটল,“ দুঃখিত ভাইয়া, তোমাকে বাঁচাতে আমাকে এতো টুকু মিথ্যা বলতেই হতো। তুমি বেচে থাকলে তবেই না বাবা মা আর এলিনা আপাকে দেখে রাখতে পারবে। তোমাদের জন্য আমী নিজেকে সেক্রিফাইস করতে রাজি।”

নীরব হয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে তান্বী ভেতরে ভেতরে আরও একবার নিজের সঙ্গে বলল, “আমি এখানে এতোটাও খারাপও নেই—তবে আমার জন্য তোমাদের কষ্ট হতে দেব না। তোমাদের কোনো আঁচ লাগবে, আমি সেটা সহ্য করতে পারব না। তাই তোমরা ভালো থাকো আমাকে ছাড়াই।”

একটি দীর্ঘ শ্বাস—যেমন তার ভেতর থেকে সমস্ত ভয়, বিপদ আর দ্বিধাকে গিলে ফেলা হলো। ধীরে ধীরে সে ফিরে এলো নিজের কক্ষে।
.
.
.
.

মেক্সিকোর শহরে রাত নেমে এসেছে আকাশ গভীর নীলে আচ্ছাদন।ধূসর মেঘগুলো চাঁদের আলোকে ঢেকে রাখছে। রাস্তার বাতিগুলো নরম হলুদ আলো ছড়াচ্ছে, বাতাসে মৃদু সঙ্গীত— কোনো দূরের গিটার বা মারিয়াচির সুর ভেসে আসছে। রঙিন কাগজের প্যাপেল পিকাডোস বাতাসে দুলছে, দূরের পাহাড় আর সমুদ্রের গলগল শব্দ শহরের নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে।

এই রাতের নিঃশব্দ, উজ্জ্বল, জীবন্ত রহস্যের মাঝে, তান্বী উদাস হয়ে নিজের কক্ষের সোফায় বসে আছে। কাঁচের জানালার দিকে তাকিয়ে তার চোখ শহরের আলো, ছায়া এবং দূরের সঙ্গীতের ছোঁয়ায় ভেসে যাচ্ছে। মন এক অদ্ভুত শূন্যতা আর অচেনা উদাসীনতার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে—যেন এই শহরের রাত তাকে এক অজানা গল্পের অংশ হতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, যেখানে সে একা, কিন্তু গভীরভাবে জীবনের ছায়া অনুভব করছে।

হঠাৎ দরজায় মৃদু শব্দ হলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জাভিয়ান রুমে প্রবেশ করল। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে এসে নিজের কাঁধের ব্লেজার স্যুট খুলে সোফায় ছুড়ে রাখলো। চোখে কৌতূহল, ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি নিয়ে বলল,—“মুখটা এমন পেঁচার মতো করে রেখেছো কেনো? কেউ মেরেছে তোমাকে?”

তান্বী আচমকা সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
—“আপনি তখন আমার ফারহান ভাইয়ের কানে কানে কি বললেন? যার কারণে ভাইয়া এতো রেগে আপনাদের মারতেও চাইলো?”

জাভিয়ান ধীরে ধীরে নিজের শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে সোফায় তান্বীর পাশে বসল। চোখে হালকা হাসি, কণ্ঠে শান্ত স্বর দিয়ে বলল,—“বলেছি আমি, তোমাকে দিনরাত—২৪ ঘণ্টা—কতোটা সন্তুষ্ট করি, যার কারণে তুমি আমাকে ছাড়া এই মুহূর্তেও থাকতে চাইছ না।”

তান্বী রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলল,—“ছি! আপনি এতো নোংরা, নির্লজ্জ! আমি আর জীবনে ভাইয়ার মুখ দেখতে পারবোনা লজ্জায়।”

জাভিয়ান ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে ঝুঁকে বলল,
—“দেখাতে হবে না। তুমি শুধু আমাকে দেখো। ভালো করে দেখো—তোমার হাজবেন্ড কতটা হ্যান্ডসাম।”

তান্বী কাঁপা কণ্ঠে বললো,—“আপনাকে এধরণের চোখে দেখার আগে আল্লাহ যেন আমাদের চোখজোড়া অন্ধ করে দেয়।”

জাভিয়ান ধীরে তান্বীর মুখের সামনের কয়েকটা চুল সরাল। চোখে কৌতূহল, ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি নিয়ে বলল,—“অন্ধ তো তুমি হবেই। তবে আমাকে দেখতে দেখতে একদিন অন্ধ হয়ে যাবে। আর যখন সেই দিনটি আসবে, তখন তুমি শুধু ছটফট করবে— শুধু আমাকে এক নজর দেখার জন্য।”

তান্বী অবাক হয়ে পিছনে হেলে গেলো, চোখে অজানা রাগ আর উত্তেজনার মিশ্রণ। ঘরের নীরবতা যেন এই কথার সঙ্গে আরও ভারী হয়ে উঠল। জানালার পাশে চাঁদের হালকা আলো পড়ছিল, আর তার চোখের সামনে জাভিয়ানের দৃঢ় দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে গেলো। জাভিয়ান তখন হালকা হেসে উঠে চলে গেলো বিছানায়।
.
.
.
.

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তান্বী চমকে উঠলো। সবাই যেনো কেমন তাড়াহুড়ো করছে। যদিও তান্বী বুঝতে পারলো বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হবে, তবে কি ধরনের অনুষ্ঠান সেটা এখনও বুঝতে পারছিলো না।

তান্বী কক্ষে গিয়ে জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” আজকে কি বাড়িতে কোনো স্পেশাল কিছু আছে?”

জাভিয়ান ঠাণ্ডাভাবে বললো, “জানিনা।”

তান্বী তখন পুনরায় হলরুমে চলে এলো। ঠিক সেই সময় মার্কো চোখের সামনে পড়লো মার্কঝ কন্ঠে তাড়াহুড়ো মিশিয়ে বললো,”এই তান্বী, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আজকে সন্ধ্যায় বড় আম্মু আর—আব্বুর ম্যারিজ অ্যানিভার্সারি।”

তান্বী ততক্ষণে রুমে গিয়ে জাভিয়ানের দিকে চোখ তুলে বললো, “আপনি কেন বললেন জানেন না আজকে কি অনুষ্ঠান? আজ তো আপনার বাবা-মায়ের অ্যানিভার্সারি!”

জাভিয়ান নিরবচ্ছিন্নভাবে উত্তর দিলো, “সো হোয়াট? আম নট ইন্টারেস্টেড।”

তান্বী মনে মনে ভাবলো, কেমন ছেলে! আল্লাহ, বাবা-মায়ের বিশেষ দিন, তাও কি সব কথাবার্তা? এমন ছেলে কারোর যেনো না হয়।
.
.
.
.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, আর পুরো বাড়ি ঝলমলে আলোতে সজ্জিত। প্রায় সব অতিথিই পৌঁছে গেছে। কেক সাজানো, বেলুন আর ফ্লাওয়ার দিয়ে হল ঘরে এক আনন্দময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। জাভিয়ানের বাবা-মা একসাথে দাঁড়িয়ে আছেন, বাকিরা উপস্থিত আর তান্বীও সেখানে উপস্থিত, কিন্তু জাভিয়ান নেই।

তান্বী চারপাশে তাকিয়ে ভাবছে—“বাবা-মায়ের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি তো শুরু হয়ে যাচ্ছে, আর এই লোক কেনো আসছেনা?”

হঠাৎ, তান্বী মার্কোর সামনে গিয়ে বলল,“মার্কো ভাইয়া, আপনার বড় ভাইয়া এখনও আসছেনা কেনো? আপনি একটু ওনাকে দেখে আসুন না কি করছেন উনি।”

মার্কো হালকা হাসি দিয়ে উত্তর দিলো,“কে জাভি ভাইয়া? সে এই ইভেন্টে আসবেনা।”

তান্বী অবাক হয়ে বলল,“কিন্তু কেনো?”

মার্কো রহস্যময়ভাবে বলল,“ইটস্… আর সিক্রেট।”

ঠিক সেই মুহূর্তে, হাততালির শব্দ ঘর জুড়ে মিশে গেল। জাভিয়ানের বাবা-মা কেক কাটতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামলো জাভিয়ান। সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সেখানেই—কারণ জাভিয়ান কখনোই এই দিনে নামেনা। আজ সে নেমেছে, তবে নাইট স্যুটেই। তবুও, তার বাবা-মা খুশি দেখে বোঝা গেল, তার আগমনই যথেষ্ট ছিল তাদের জন্য।

জাভিয়ান এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইল। বাবা-মা কেক কাটলো, এবং বাকি সব অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে শেষ হলো।

এরপর মার্কো স্টেজে উঠে মাইক হাতে ধরল, চাচা -চাচীর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি নিয়ে কিছু বলার জন্য, আর একটি সারপ্রাইজ প্রজেক্ট বড় স্ক্রিনে দেখানোর জন্য প্রস্তুত হলো সে।

কিন্তু হঠাৎ করেই, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রজেক্টের বড় স্ক্রিন তার ওপর পড়ে গেল। এক মুহূর্তে পুরো হল চিৎকার আর আতঙ্কে ভরে উঠল। সবাই ছুটে গেল, হতভম্ব হয়ে।

তবুও, সেই বিশৃঙ্খলার মাঝেই এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইল জাভিয়ান—নির্জীব, নিঃশব্দ, এক মূর্তির মতো। চারপাশের ধ্বংসের মধ্যেও তার উপস্থিতি অটল। ঝলমলে আলো, চিৎকার আর ছুটে যাওয়া মানুষ—কিছুই তার অস্থিরতা বা স্থিতিকে স্পর্শ করতে পারল না।

হঠাৎ বিশৃঙ্খলার মাঝে গার্ডরা এসে সবাই মিলে প্রজেক্টের বড় স্ক্রিনটি সরিয়ে তুলল। স্ক্রিনের ছায়া দূর হতেই চোখে পড়ল মার্কোর অবস্থা—নাক থেকে রক্ত ঝরছে, দেহ ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে তুলে নিয়ে গাড়িতে তোলা হলো। পিছে পিছে সবাই ছুটে গেল, আতঙ্ক আর উদ্বেগের ছায়া নিয়ে।

তান্বীও ছুটে যাচ্ছিলো, কিন্তু হঠাৎ কেউ তার হাত টেনে ধরল। সে তাকিয়ে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখল—জাভিয়ান!

চলবে………

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply