ডিজায়ার_আনলিশড ❤️🔥
✍️ সাবিলা সাবি
পর্ব-১২
আজকের সকাল থেকেই ভিলা এস্পেরেন্জায় যেন উৎসবের আমেজ। বাড়ির প্রতিটি কোনায় ব্যস্ততা, দৌড়ঝাঁপ আর সাজসজ্জার হইচই।
লুসিয়া যেনো নিজের বিউটি পার্লার খুলে ফেলেছে। একসাথে তিনজন বিউটিশিয়ান নিয়ে এসেছে কেবল নিজের জন্য—চুল, মেকআপ, নখ, সবকিছু নিখুঁত হতে হবে তার কাছে।জাভিয়ানের মা-ও প্রস্তুতি নিচ্ছেন, নিখুঁত রুচি আর রাজকীয় শোভায়।
অন্যদিকে ভিলার পুরুষরা—সায়েম চৌধুরী, সাইফ চৌধুরী আর মার্কো রেয়েস চৌধুরী—সবাই আগেই তৈরি হয়ে বিশাল লিভিং হলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের স্যুটের দীপ্তি আর আত্মবিশ্বাস মিলে যেন পুরো পরিবেশকে আরও ভারী করে তুলেছে।
তান্বী আজকে অন্য এক মানুষ। তার ছোট্ট জীবনে কখনো এমন আয়োজন হয়নি। সবসময় তার সাজসজ্জার দায়িত্বে থাকতো তার বোন এলিনা—মুখে একটু কাজল,আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, ব্যস।
কিন্তু আজ… আজকের সাজ অন্যরকম। জাভিয়ানের মায়ের কথাতেই প্রথমবার বিউটিশিয়ানের হাতে নিজেকে সঁপে দিলো তান্বী।
তার গায়ে গাঢ় মেরুন রঙের পাতলা জর্জেটের শাড়ি—পুরোটাই সূক্ষ্ম সিকুয়েন্সের ঝলমলে ভরা। আলো পড়লেই যেনো প্রতিটি ভাঁজ থেকে রঙিন জ্যোতি বের হয়। গলায় হালকা হীরের নেকলেস, কানে ছোট ঝুমকা—চোখে একদম ভারসাম্যপূর্ণ আভিজাত্য।
চুলগুলো কার্ল করে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে কাঁধ বেয়ে, যেন ঢেউ খেলানো রেশমের ধারা। মেকআপ একেবারে মিনিমাল হলেও তার সতেজ মুখে সেই স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে গেছে— গর্জিয়াস অথচ কোমল।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে তান্বীও থমকে গেলো। সে কি আসলেই সেই মেয়ে, যে একসময় পুরান ঢাকার উঠোনে ফ্রক আর কুর্তি পড়ে দৌড়াতো?
আজকের সে একেবারে নতুন—নির্ভার অথচ অভিজাত, সরল অথচ অপরূপ।
বিউটিশিয়ান প্রথমেই তান্বীর চোখে লেন্স পরিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু মুহূর্তেই থেমে গেলো—কারণ, লেন্স ছাড়াই তান্বীর চোখ যেনো অদ্ভুত জাদু ছড়াচ্ছিলো। তার প্রাকৃতিক হালকা বাদামি চোখ দুটো এতটাই গভীর, এতটাই মুগ্ধকর যে সেখানে আর কোনো কৃত্রিম রঙের প্রয়োজনই পড়লো না।
একইভাবে মাশকারার হাতও প্রায় অচল হয়ে গেলো।কারণ তান্বীর চোখের পাপড়ি এত ঘন আর লম্বা যে সাজাতে গিয়েই সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।
শেষমেষ, খুব বেশি কিছু করা হলো না। শুধু একটুখানি নিখুঁত আইলাইনার, আর ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক—এই সামান্য স্পর্শেই যেনো তান্বীর সৌন্দর্য নিজের পূর্ণতায় প্রস্ফুটিত হলো।
.
.
.
.
সকালের আলোটা আজ যেনো ভিন্নভাবে ঝলমল করছে। “Esperanza Corporation” এর পুরো অফিস আজ উৎসবের রঙে মোড়া। গেট থেকে শুরু করে ভেতরের বাগান, ড্রাইভওয়ে, এমনকি প্রধান প্রবেশদ্বার পর্যন্ত আলো আর ফুলের সাজে ঝলমল করছে।
আজ জাভিয়ানের জীবনের সবচেয়ে বড় দিন—
তার নতুন অফিসের উদ্বোধন।
সকাল থেকেই ব্যস্ততা তুঙ্গে। লাক্সারি গাড়ি একে একে এসে থামছে, নামছে স্যুট-পরা অতিথিরা। ভেতরে মিউজিকের হালকা সুর বাজছে, লাল কার্পেট বিছানো পথ ধরে সবার প্রবেশ।
রায়হান আজ একেবারে অন্য রকম—গাঢ় নীল স্যুটে, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অতিথিদের রিসিভ করছে। সবাইকেই একে একে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।
জাভিয়ানের বন্ধুবান্ধব, ব্যবসায়িক পার্টনার, পরিচিত মুখ—সবাই আজ এখানে জড়ো হয়েছে। কারণ আজ শুধু একটা অফিস উদ্বোধন নয়, আজ ঘোষণা হবে যে চৌধুরী পরিবারের উত্তরসূরি জাভিয়ান, আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসার নতুন যুগ শুরু করছে।
.
.
.
.
বাড়ির হলরুমটা নীরব।
জাভিয়ান একা দাঁড়িয়ে আছে, কালো ব্লেজার সু্টে একবারে বিরক্ত মুখে। বাবা, চাচা আর মার্কো অনেক আগেই গাড়িতে উঠে অফিসের পথে চলে গেছে। সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে শুধু তার মা আর বোন লুসিয়ার অপেক্ষায়।
ঠিক তখনই—উপরতলা থেকে ভেসে এলো হালকা পদধ্বনি। জাভিয়ানের দৃষ্টি সেদিকেই উঠলো।
সিঁড়ি বেয়ে নামছে তান্বী। শাড়ির কুচি এক হাতে ধরে, অন্য হাতে আচল সামলাচ্ছে। হালকা বাতাসে তার খোলা চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে, সিঁড়ির রেলিংয়ের ফাঁক গলে আলো পড়ে চকচক করছে তার গালের ওপর।
জাভিয়ানের শ্বাস কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলো।
চোখ আটকে গেলো সেখানে—সে যেন ভুলেই গেলো, এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কার জন্য অপেক্ষা করছে।
তান্বী ধীরে ধীরে নামছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেনো ধ্বনিত হচ্ছে জাভিয়ানের বুকের ভেতরে।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো—পুরো ভিলা, পুরো হলরুম অন্ধকারে ঢাকা, আর আলো কেবল সেই সিঁড়ির ওপরে নামতে থাকা মেয়েটির ওপরেই থেমে আছে।
তান্বী এবার জাভিয়ানের একদম সামনে এসে দাঁড়ালো।
জাভিয়ান তো হকচকিয়ে তাকিয়ে রইলো। এতক্ষণ সে বুঝতেই পারেনি, কিন্তু এখন তো চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে তান্বী।
জাভিয়ানের হঠাৎ হুঁশ ফিরতেই সে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলো “তুমি কোথায় যাচ্ছ এতো সেজেগুজে?
তান্বী আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বললো “আপনার মা-ই তো বললেন রেডি হতে। আজ নাকি আপনার অফিসের উদ্বোধন হবে।”
জাভিয়ান কড়া স্বরে বললো “কিন্তু আমি কি তোমাকে ইনভাইট করেছি সেখানে যাওয়ার জন্য?
তান্বী রাগ চাপা দিয়ে বললো “আপনার মা বলেছেন বাড়ির সবাই যাবে। তাই আমাকেও যেতে হবে।”
জাভিয়ান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো “বাড়ির সবাই আমার ফ্যামিলি… তুমি আমার কে?
তান্বী চোখ রাঙিয়ে তখন বললো “সেটা আগে বলতে পারতেন! যে আপনার অফিসের ইভেন্টে আমি যেতে পারবো না।”
জাভিয়ান ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিলো “কেন? তোমার কি কমন সেন্স নেই? আমি বলেছি আমার বাড়ির লোকের সামনে আমার ওয়াইফের মতো বিহেভিয়ার করো। কিন্তু আমি এটা বলিনি—পুরো দুনিয়ার সামনে আমার ওয়াইফ সেজে হাজির হও!
তান্বী তখন রাগান্বিত হয়ে বললো “লিসেন, মিস্টার! আমার কোনো শখ নেই আপনার বউ সাজার! পুরো দুনিয়া তো দূরের কথা,একা রুমেও আপনার সামনে আমি আপনার স্ত্রী সেজে থাকতে চাই না!
তান্বী বিরক্ত হয়ে নিজের শাড়িটা ঠিক করতে করতে বকতে থাকলো “ধ্যাত! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। সকাল থেকে না খেয়ে রেডি হয়েছি, জীবনে এত গর্জিয়াস কিছু গায়ে নিয়ে ঘুরিনি, আর এতো কষ্টের পর এখন কিনা এসব শুনতে হচ্ছে!
তান্বী তখন শাড়ি সামলাতে সামলাতে গজগজ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পরেই ড্রইংরুমে আসলেন জাভিয়ানের মা আর বোন লুসিয়া। জাভিয়ানের মা হতভম্ব গলায় জিজ্ঞেস করলো “এ কি! তান্বী এখনো নামেনি?”
জাভিয়ান শান্ত অথচ বিরক্ত ভঙ্গিত বললো “ও যেতে পারবেনা।”
কার্গো চৌধুরী চোখ কুঁচকে বললো “কেনো পারবেনা?”
জাভিয়ান গম্ভীর মুখে মিথ্যে বানিয়ে বললো “ও একটু অসুস্থ হয়ে গেছে। মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। এখন চলো… আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
জাভিয়ানের মা মুখে কিছু না বলে নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। আর লুসিয়া ভেতরে ভেতরে খুশিতে ভরে উঠলো— “ভালোই হয়েছে, অন্তত আজকে বউ সেজে আমার ভাইয়ের পাশে বসতে পারবে না।”
ওরা তিনজন মিলে গাড়িতে উঠে ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।
.
.
.
.
এদিকে তান্বী নিজের কক্ষে ঢুকেই দরজা ধপ করে বন্ধ করলো। শাড়ির আঁচল এক ঝটকায় খুলে ছুঁড়ে ফেললো বিছানার উপর। এক এক করে গলার হার, কানের দুল, চুড়ি সব খুলে ফেলে টেবিলে ছুঁড়ে রাখলো।
আর গজগজ করতে করতে বললো “বদমাইশ! বজ্জাত,লম্পট একটা! সারাদিন না খেয়ে সাজসজ্জা করলাম, শাড়ির ভারে অস্থির হয়ে গেলাম, এখন কিনা শুনতে হলো ‘আমি কি তোমাকে ইনভাইট করেছি!’ … ধ্যাত!”
ও একবার আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো—চোখে বিরক্তি, ঠোঁটে রাগ, আর বুকের ভেতর কষ্ট জমে আছে। শাড়ির ভাঁজ টেনে খুলতে খুলতে আবার বিড়বিড় করলো “যেন আমি মরেই যাচ্ছি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য… হুম! যত বড় বিজনেস টাইকুনই হোক না কেন, আমার কাছে তো একেবারে বদমাইশ মানুষ!”
তান্বী গয়না সব খুলে চুল এলোমেলো করে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো।
.
.
.
.
অফিস ভবনের লবি যেন উৎসবের সাজে সেজেছে। চারপাশে ফুল আর আলোর ঝলকানি, সাংবাদিক আর অতিথিদের কোলাহল ভরে রেখেছে পুরো পরিবেশ। উদ্বোধনের মুহূর্ত, তাই সবার চোখ একসাথে ফিতার দিকে নিবদ্ধ।
রায়হান একটা থালার উপর রাখা কাঁচি হাতে নিয়ে সায়েম চৌধুরীর কাছে এগিয়ে এসে সম্মানের ভঙ্গিতে বলল, —“বড় স্যার, অনুগ্রহ করে উদ্বোধন করবেন।”
সবার দৃষ্টি তখন সায়েম চৌধুরীর দিকে। কিন্তু তিনি সামনে না এসে গম্ভীর মুখে বললেন, —“আমি ফিতা কাটব না। জাভিয়ান আমারই বিজনেস রিভ্যালের অফিস কিনেছে—একবারও আমাকে জানাল না পর্যন্ত সে কিনা নিজের বাবার শত্রুর সাথেই বিজনেস ডিল করবে।”
চারপাশ হঠাৎ নিস্তব্ধ। এক মুহূর্তের জন্য যেন বাতাসও থমকে গেল। রায়হান বিব্রত হয়ে এক পা পিছিয়ে গেল।
তখন জাভিয়ান ধীর পায়ে এগিয়ে এল। কাঁচি হাতে তুলে নিল, চোখে ছিল শীতল কঠোরতা। চারপাশের সবার দিকে তাকিয়ে সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,—“বাদ দাও, রায়হান। কেউ যদি না চায়, তাকে জোর করতে হবে না। একবারই বলা যথেষ্ট, বারবার কারও পেছনে ঘুরে ঘুরে তেল দেওয়ার সময় কারো নেই।”
এই কথা বলেই জাভিয়ান নিজে ফিতার মধ্যে কাঁচি চালাল। লাল ফিতাটা কেটে গেল—এক টুকরো আকাশের মতো খুলে গেল ভবনের নতুন দ্বার। সঙ্গে সঙ্গে কনফেটি উড়ে উঠল, হাততালির শব্দে ভরে গেল চারদিক।
জাভিয়ানের ঠোঁটে এক হালকা হাসি ফুটল, কিন্তু চোখে রয়ে গেল চাপা ক্ষোভ। তার বাবা সেই মুহূর্তে অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু কার্গো চৌধুরী দ্রুত তার হাত ধরে ফেললেন। চোখের ভাষায় বোঝালেন—“না, থামো। অতিথিদের সামনে পারিবারিক অশান্তি করোনা।”
জাভিয়ান ভেতরে ভেতরে সবকিছু গিলে নিয়ে অতিথিদের দিকে মাথা নুইয়ে বলল,—“ধন্যবাদ সবাইকে। আশা করছি এই উদ্যোগ আপনাদের আস্থা রাখবে।”
.
.
.
.
উদ্বোধনের পর অনুষ্ঠান জমে উঠল। সাংবাদিকেরা একে একে জাভিয়ানের কাছে এগিয়ে এল।কেউ প্রশ্ন করছে, কেউ ছবি তুলছে। —“মিস্টার জাভিয়ান এমিলিও চৌধুরী, নতুন অফিস নিয়ে আপনার ভিশন কী?”—“আপনি কোন বিশেষ মার্কেটে টার্গেট করছেন?”
জাভিয়ান ধৈর্যের সঙ্গে একে একে উত্তর দিল। পাশে অতিথিদের জন্য আয়োজন করা হলো কফি, স্ন্যাকস আর কেক। আলো ঝলমলে পরিবেশে সবাই মিলে গল্প, পরিচয় আর শুভেচ্ছা বিনিময় করল।
শেষে পরিবারের সবাই একত্র হলো—জাভিয়ান, তার বাবা-মা, চাচা, আর ভাই মার্কো চৌধুরী আর বোন লুসিয়া। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠল, হাসি আর কোলাহলে জমে উঠল ফ্যামিলি ফটোশুট। ছোট ছোট ভিডিও রেকর্ড হলো, সবাই যেন নিখুঁত এক আনন্দময় মুহূর্তে বাঁধা পড়ল।
—
অন্যদিকে, সেই সময়ে তান্বী একা বসে আছে বাড়ির সোফার রুমে। টিভির সামনে চা-এর কাপ অর্ধেক খাওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ থেমে গেল।
স্ক্রিনে ভেসে উঠলো লাইভ নিউজ—“চৌধুরী গ্রুপের নতুন অফিসের উদ্বোধন আজ সম্পন্ন হলো, উপস্থিত ছিলেন পরিবারের সবাই…”
টিভির পর্দায় স্পষ্ট দেখা গেল জাভিয়ান আর তার পরিবারকে। সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে, একে অপরের সঙ্গে হাসছে। আলো ঝলমল, সবার মুখে খুশির আভা।
তান্বীর বুকের ভেতর হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ আটকে গেল স্ক্রিনের দিকে। তার নিজের পরিবারের কথা মনে পড়ল—যাদের আর কখনো দেখার সুযোগ নেই।
চোখে জল ভরে উঠতেই সে মনে মনে বলল, —“সত্যিই, পৃথিবীর সবার ভাগ্য সমান হয় না। জাভিয়ান অন্তত এদিক থেকে ভাগ্যবান… তার পরিবার আছে, তারা তার কাছে। একসাথে থাকতে পারছে। আর আমি? আমার বাবা, মা, বোন, ভাই—কাউকে আর একটুখানি দেখারও সুযোগ নেই।”
কথাগুলো মনে মনে উচ্চারণ করতেই বুক ভেঙে কান্না চলে এলো। সোফায় বসেই তান্বী মুখ চেপে কাঁদতে লাগল—একলা, নিঃশব্দ, অথচ ভেতরে ভেতরে অশেষ বেদনায় ভরা।
.
.
.
.
এদিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাতের ব্যস্ততা তুঙ্গে। ভেতরে ঝকঝকে আলো আর যাত্রীদের তাড়াহুড়ো। ফারহান হাতে বোর্ডিং পাস শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে অনমনীয় দৃষ্টি, বুকভরা সংকল্প।
আজ তার ভিসা হয়ে গেছে, আর আজ রাতের ফ্লাইটে সে উড়ে যাচ্ছে মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে।
মনের ভেতর শুধু একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—”আমি আসছি, তান্বী। এবার তোকে ওদের হাত থেকে বের করে আনব।”
প্লেনের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ফারহানের আঙুল আরও শক্ত হলো। তার চোখে জ্বলছে দমে না যাওয়া আগুন।
কেবিনের সিটে বসেই সে গভীর শ্বাস ফেলল। প্লেন ধীরে ধীরে রানওয়ে ছেড়ে আকাশে উঠল। জানলার বাইরে রাতের কালো আকাশ আর দূরে ছড়ানো শহরের আলো যেন এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞার সাক্ষী হলো।
ফারহানের বড় লক্ষ্য একটাই—তার বোন তান্বীকে জাভিয়ান চৌধুরীর কাছ থেকে যেভাবেই হোক উদ্ধার করা।
.
.
.
.
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। সাংবাদিকদের ভিড় হালকা হয়ে আসছে, অতিথিরাও ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। চারপাশে এখনও আলো আর সাজসজ্জার ছটা ঝলমল করছে, কিন্তু জমকালো মুহূর্তটা শেষের দিকে এগোচ্ছে।
এই সময় জাভিয়ানের মা বললেন,—“আজ বাসায় ফেরা হবে না। আমরা আজ রাতে তোমার ফুপুর বাড়িতে থাকব।”
জাভিয়ানের ফুপু থাকেন Polanco, Mexico City–তে। নামি-দামি রেস্তোরাঁ, শপিং মল আর অভিজাত ভিলার জন্য পরিচিত এই এলাকা। জাভিয়ানের ফুপুর বাড়িটা সেখানকার Campos Elíseos Avenue–তে অবস্থিত এক বিশাল ভিলা, সামনে সবুজ লন আর ভেতরে আভিজাত্যের ছাপ।
পরিবারের সবাই গাড়িতে উঠলো ফুপুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
—
এদিকে, অতিথিরা চলে যাওয়ার পর জাভিয়ান একা থাকল অফিসের প্রাইভেট রুমে। কিন্তু একা নয়—সাথে তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। টেবিলের ওপর সিগার, কফি আর কিছু দামি ওয়াইনের বোতল রাখা। বড়সড় চামড়ার সোফায় হেলান দিয়ে বসে জাভিয়ান গম্ভীর ভঙ্গিতে সিগার ধরালো।
তার এক বন্ধু মজা করে বলল,—“অফিসের উদ্বোধন তো দারুণ হলো, এখন তো উদযাপন হওয়া উচিত, ভাই।”
জাভিয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে অল্প হাসলো, ধোঁয়ার রিং ছেড়ে দিলো বাতাসে।—“হুম… উদযাপন হবেই।”
রুমে হাসি-আড্ডা জমে উঠল, কেউ গ্লাসে ওয়াইন ঢালছে, কেউ সিগারের ধোঁয়ায় ভরাচ্ছে পুরো ঘর। বাইরের কোলাহল মুছে গিয়ে ভেতরে শুরু হলো এক ভিন্ন আড্ডা।
হঠাৎ করেই কয়েকজন বাংলাদেশি আর মেক্সিকান বন্ধু এগিয়ে এলো জাভিয়ানের দিকে। চাপা হাসিতে একজন বলল,—“এই সময়ে একটা গান হোক না! জাভি, তুই তো অনেক ভালো গান গাইতে পারিস।”
জাভিয়ান ভুরু কুঁচকে একটু হেসে দিলো।
—“এখন? এই অনুষ্ঠানে গান?”
আরেকজন মজা করে যোগ করলো, —“কী হলো! বিয়ের রিসেপশনে তো আত্মীয়দের জন্য গেয়েছিলি। তুই তো সবসময় কাউকে না কাউকে ডেডিকেটেড করে গান গাস। আজ না হয় তোর নতুন কোম্পানির জন্য গা।”
কথাগুলো শুনে জাভিয়ান কিছুক্ষণ চুপ রইল। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি খেলে গেলেও চোখে যেন এক অচেনা ভারী ভাব। নিঃশ্বাস টেনে মাথা নাড়তেই বন্ধুরা উল্লাসে গিটার ধরিয়ে দিলো তার হাতে।
জাভিয়ান সোফায় কালো রঙের গিটার হাতে বসা। মুহূর্তেই চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবার দৃষ্টি থেমে রইল তার দিকে। আঙুল ছুঁতেই স্ট্রিংগুলো থেকে ভেসে উঠলো প্রথম সুর।
তারপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল জাভিয়ানের কণ্ঠ—
🎶
কাজল কালো দুটি চোখে,
সে যখনই আমায় দেখে—
পড়ে না চোখেতে পলক,
আর আসেনা কথা মুখে।
তার চলে যাওয়া, ফিরে একটু চাওয়া,
এই বুকেতে ঝড় তুলে যায়।
যার ছবি এই মন একে যায়,
যার কথা ভেবে দিন কেটে যায়।
সেই কি জানে, শুধু তাকেই
ভালোবাসে আমার হৃদয়… 🥀
🎶
গিটারের মিষ্টি সুরে আর কণ্ঠের আবেগে যেন পুরো হল থেমে গেলো। বন্ধুরা নিস্তব্ধ, কেউ কেউ ফোন বের করে রেকর্ড করতে লাগলো। বাংলাদেশি বন্ধুরা গানের প্রতিটি শব্দে মুগ্ধ হলেও, মেক্সিকানরা শুধু সুরের আবেগটা বুঝতে পারছিলো।
রায়হান এক কোণে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে প্রশ্ন উঠলো—”এটা কি সত্যিই কোম্পানির জন্য গাওয়া? নাকি কারো জন্য? কেনো যেন মনে হচ্ছে এ গানটা বিশেষ কারো উদ্দেশে… তবে যদি তার জন্য হয়ও, তাতে লাভ কি? সে তো আজ এখানে নেই।”
.
.
.
.
গান শেষ হতেই হঠাৎ এক বন্ধু উচ্ছ্বাসে বলল,—“জাভি!আজকে অনুষ্ঠানে সবাই ছিলো তোর পরিবারের, কিন্তু তোর বউকে দেখলাম না যে?”
জাভিয়ান ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি ধরে বললো “She’s not feeling well today.”
সবাই প্রায় তখন মোটামুটি ড্রাংক অবস্থায় ছিলো। কেউ কেউ হালকা আঙুল উঁচিয়ে আবার কেউ উল্লাস করার চেষ্টা করছিল।
কিন্তু হঠাৎ একজন বন্ধু মজা করে বলল, —“আরে, নিয়ে আসতে পারতি, আমরা একটু উল্লাস করতে পারতাম।”
এই কথায় জাভিয়ানের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। রাগে মাথায় রক্ত গরম হয়ে উথালপাথাল করতে লাগলো, হাতের মাংসপেশী শক্ত হয়ে উঠলো আর রাগে দাঁতে দাঁত চাপলো। হঠাৎ করে জাভিয়ান মূহুর্তেই একটা কাঁচের মদের বোতল হাতে তুলে নিয়ে সেই বন্ধুর ঘাড়ের মধ্যে আঘাত করলো। বোতল ভেঙে কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে গেলো আর সেই টুকরো ছিটকে গেলো চারিদিকে। আঘাতের জোরে তার বন্ধু ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ল, ঘাড়ে হাত চেপে ধরে।
কিন্তু জাভিয়ান থেমে থাকলো না। রাগ আর শক্তির ঝড়ে সে তার বন্ধুর দিকে ঝুঁকে পড়ে আরো মারতে থাকলো। একের পর এক নাকে মুখে কপালে ঘুষি দিতে থাকলো। প্রায় মারতে মারতে আধমরা করে ফেললো। আর তখনি সব বন্ধুরা তাকে টেনে ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আজকে তার শক্তির কাছে কেউই টিকতে পারছিলো না।
অবশেষে সবাই মিলে তাকে টেনে তুললো। ফ্লোরে পড়ে থাকা আধমরা বন্ধুকে কয়েকজন অন্য বন্ধু ধরে ধরে তুলে নিয়ে গেল। বাকিরাও ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো।
প্রাইভেট রুমটা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল। শুধু রায়হান আর জাভিয়ান দাঁড়িয়ে রইল। রায়হান বাধা দেয়নি, কারণ সে জানে— জাভিয়ান যেটা করেছে একদম ঠিক করেছে।
এক মুহূর্ত চুপ থাকার পর, রায়হান ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, —“স্যার, বাড়িতে চলুন।”
জাভিয়ান তার দিকে ধীরে ধীরে তাকালো। চোখে রাগের ছায়া এখনও বিদ্যমান, কিন্তু সেই সঙ্গে কোথাও একটা অদ্ভুত প্রশান্তি। রায়হানের উপস্থিতি যেন মুহূর্তে তার উত্তেজনা কিছুটা শান্ত করলো।
.
.
.
.
রাতের শহরে রায়হান গাড়ি চালাচ্ছে, আর জাভিয়ান পাশের সিটে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ রায়হান ভেসে আসা শব্দের মতো ধীরভাবে বলল,—“একটা কথা বলবো স্যার?”
জাভিয়ান এখনও বাইরের দিকে তাকিয়ে ধীরস্বরে বলল, —“বল।”
রায়হান কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তারপর বলল,—“স্যার, এর আগে কোনোদিন আপনাকে এতোটা উন্মাদ হতে দেখিনি।”
জাভিয়ান হঠাৎ রায়হানের দিকে তাকাল, চোখে হালকা কৌতূহল——“মানে? কি বলতে চাইছো?”
রায়হান গভীর নিশ্বাস নিয়ে বলল,—“মানে, এর আগে কেউ আপনার বিরুদ্ধে কিছু বললে আপনি সবসময় ঠান্ডা মাথায় শাস্তি দেওয়ার অর্ডার দিতেন। কিন্তু আজকে… নিজেই নিজের বন্ধুকে এভাবে মারলেন?”
জাভিয়ান অল্পক্ষণ চুপ থেকে বলল,—“ও তান্বীকে নিয়ে বাজে কথা বলেছে। আর যদি তান্বীর জায়গায় লুসিয়াও থাকত, আমি ঠিক এটাই করতাম।”
রায়হান একটু ভয়ভীতি মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,—“কিন্তু স্যার, এর আগে তো কলেজে একটা ছেলে লুসিয়াকে বাজে কথা বলেছিল। আপনি সেদিন তাকে পুলিশের হাতে দিয়েছিলেন, নিজে কিছু করেননি।”
জাভিয়ানের চোখে হালকা আভাসে রাগ ফুটলো। ধীরে ধীরে সে বলল, —“রায়হান, গাড়ি থামাও।”
রায়হান অবাক হয়ে বলল,—“কেনো স্যার? বাড়িতো এখনো আসিনি।”
জাভিয়ান চুপ থেকে বলল,—“নামো গাড়ি থেকে।”
রায়হান গাড়ি থামিয়ে অবাক চোখে নামলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। জাভিয়ানও গাড়ি থেকে নামলো।
পরের মুহূর্তে জাভিয়ান ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। রায়হান বাইরে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকাল। জাভিয়ান ধীরভাবে বললো, —“ উবার ডেকে নিও।”
রায়হান আর কিছু বলতে পারলো না। জাভিয়ান ইঞ্জিন স্টার্ট করলো, আর গাড়ি চললো, রাস্তা ধরে রাতের আলো ছড়িয়ে দিলো। এদিকে রায়হান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কারন এই প্রথম রায়হানকে জাভিয়ান রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গেলো তাও মাত্র সামান্য প্রশ্নের কারনে।
.
.
.
.
রাতের বেলায় স্ট্রোম হাউজে একটি ভয়ঙ্কর খবর পৌঁছালো—রিকার্দোকে কেউ হ/ত্যা করেছে তার লাশ পাওয়া গেছে । কিন্তু শুধু হ/ত্যা নয়, সেটা করা হয়েছে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে।
খবর পেয়ে মেইলস্ট্রোমের চোখে আগুন জ্বলে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে সে তার হাতে থাকা বন্দুকটি শক্ত করে ধরল। হাউজের কোণায় থাকা কয়েকজন লোক—তার শিকার হয়ে গেল। একের পর এক গুলির শব্দ কানে বাজতে লাগল।
মেইলস্ট্রোম থামলো না—তার রাগ যেন আরও তীব্র হয়ে উঠল। সে আরও কয়েকজন লোককে নির্দেশ দিল, কণ্ঠস্বর গম্ভীর আর হিমায়িত,—“খবর বের করো, কে মেরেছে রিকার্দোকে। এখনই!”
হাউজের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। প্রতিটি ধাপে ফ্লোর কেঁপে উঠছে, ভয়ংকর কণ্ঠে সবাই যেন থেমে গেছে। চোখে অদ্ভুত ঝলক—নিষ্ঠুর, হিসাববুদ্ধিময় আর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা একজন শিকারির ঝলক।
কেউ দেরি করতে সাহস পাচ্ছিল না। মেইলস্ট্রোমের রাগ আর শক্তির উপস্থিতি পুরো হাউজকে নিঃশ্বাসরুদ্ধকরে পরিণত করেছিল।
.
.
.
.
আর এক মুহূর্তও দেরি না করে মেইলস্ট্রোম তার মায়ের কাছে যাচ্ছিলো রিকার্ডোর মৃত্যু/র খবর দিতে। সে কক্ষের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে দেখলো, ইসাবেলা নিজের ল্যাপটপে নিউজ চ্যানেল চালাচ্ছেন—আর সেখানে জাভিয়ানের অফিসের নতুন কোম্পানির উদ্বোধনের খবর চলছে।
মেইলস্ট্রোমের রাগ এক মুহূর্তেই ফেটে পড়ল। সে হঠাৎ করে ইসাবেলার হাত থেকে ল্যাপটপ নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো। ল্যাপটপ মাটিতে পড়ে ঝকঝক করে চমকানো শব্দ করল।
—“মম, এখনও? তুমি এখনও তাকে দেখছ?”—চিৎকার করলো মেইলস্ট্রোম।
ইসাবেলা চোখের কোণে হালকা দম বন্ধ রেখে বলল,—“মেইলস্ট্রোম, এটা কি করলে তুমি! আমি তো শুধু এমিলিওকে দেখছিলাম… ওর হাসিমাখা মুখটা। আজ ওর নতুন কোম্পানির উদ্বোধন হয়েছে।”
মেইলস্ট্রোমের চোখ আরও কঠিন হয়ে গেল। কণ্ঠস্বর ঘুরিয়ে বলল,—“কিন্তু মম, সেখানে শুধু জাভিয়ান চৌধুরী একা নয়। এটাও মাথায় রাখো—আমি ওই লোকটাকে তোমাকে কখনোই দেখতে দেব না। আর কখনোই আমার সামনে ওই লোকটার ছায়াও যেনো না পড়ে।”
ইসাবেলা হঠাৎ থেমে গেল, চোখে মিশ্র অনুভূতি—ভয়, বিস্ময় আর ছেলে মনের অদম্য শক্তির সম্মিলন।
.
.
.
.
এদিকে জাভিয়ান বাড়িতে পৌঁছে গেলো। গাড়ি পার্ক করে সে ধীরে ধীরে বাড়িতে প্রবেশ করলো। ভিতরে ঢুকতেই দেখলো পুরো বাড়ি যেন স্তব্ধ—নীরবতা আর শীতলতায় ঘিরে রয়েছে।
নিজের কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখলো তান্বী ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। আর তার সেই সকালের শাড়ি, গহনা—সবই এলোমেলো ছড়িয়ে আছে একেক জায়গায়। বোঝাই যাচ্ছিল, রাগে সব ছুড়ে ফেলেছে।
জাভিয়ান তখন আলমারি খুললো। নিজের নাইটসুট হাতে নিলো। কিন্তু হঠাৎ তার চোখে পড়ল—তার প্রাইভেট জিনিসগুলো একদম উল্টাপাল্টা হয়ে আছে। মুহূর্তেই সে বুঝে গেলো, এটা তান্বী করেছে।
মাথায় রাগ উঠে গেলো তার। সে এক ঝটকায় ঘুমন্ত তান্বীকে টেনে তুললো আর সাথে সাথে পাশে থাকা টেবিল থেকে পানি নিয়ে মুখে এক গ্লাস পানি ছুড়ে দিলো।
তান্বী হকচকিয়ে উঠল। জাভিয়ান তাকে কোন সময় সুযোগ না দিয়েই টেনে তুললো, একবারে আলমারির সাথে চেপে ধরলো, তার চোয়াল চেপে ধরে গভীর রাগে জিজ্ঞেস করলো—“কোন সাহসে, কোন সাহসে তুমি আমার পার্সোনাল জিনিস ধরেছো? অন্য কারো পার্সোনাল জিনিস ধরা যে অন্যায় তুমি কি জানো না? অন্য কারো ডায়রিতে হাত দেওয়া যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা শেখোনি?”
তান্বী হঠাৎ ভয়ে পেয়ে গেলো আজ আর খানিকটা কাঁপতে কাঁপতে বলল,—“আমি আপনার ডায়রি ধরিনি, বিশ্বাস করুন। আমি কিছু পড়িনি… শুধু ওই একটা লকেট ছিল, সেটাই আপনা-আপনি পড়ে গেছে ডাইরির মধ্যে থেকে।”
জাভিয়ান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তান্বীকে ছেড়ে দিল। আর সোজা সে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলো।
আর তখনি তান্বী তার পেছন থেকে গুঞ্জর করে প্রশ্ন করল, —“R দিয়ে কার নাম?”
জাভিয়ান পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো তারপর আঙুল তুলে, ঠোঁটের কোণে হালকা কঠোরতা নিয়ে বলল,—“None of your business।”
বলেই সে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল।
তান্বী কিছুটা অবাক হয়ে রয়ে গেল। আজ জাভিয়ান যেন একটু ভিন্ন—তার চোখে অতিরিক্ত রাগ, আচরণটাও অন্য দিনের মতো হিসাবকৃত, নিয়ন্ত্রিত নয়। বরং কঠোর…
তান্বী নিজে বুঝতে পারছিল না কেনো আজ তাকে কেনো এতটা ভিন্নভাবে লাগছে। মনে হচ্ছিল, এই জাভিয়ান আসলেই কিছুটা রহস্যজনক। শরীরের ভয় কমে এলেও, চোখে অজান্তে কৌতূহলের ঝলক ফুটে উঠল তান্বীর।
.
.
.
.
অনেক্ষণ পর।
তান্বী তখন সোফায় বসে ছিল। জাভিয়ান শাওয়ার শেষে টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।
হঠাৎ তান্বী প্রশ্ন করল, কণ্ঠে অল্প কম্পন নিয়ে—“আপনার বাবা-মা… ওনারা কোথায়? ওনারা আসবেন না?”
তান্বীর চোখে ভয় স্পষ্ট। আজ সে জাভিয়ানের সাথে একা এই রুমে থাকতে একটু ভীত হয়ে পড়েছে।
জাভিয়ান শান্ত কণ্ঠে বলল,—“মম, ড্যাড, সবাই ফুপির বাড়িতে গিয়েছে। কাল আসবেন।”
এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তান্বীর ভয় আরও বেড়ে গেল। সে উঠে দাঁড়ালো আর কক্ষের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করল।
জাভিয়ান তার পেছন থেকে প্রশ্ন করলো,—“এই মেয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
তান্বী কিছুটা দ্বিধা করে বলল,—“আমি আজকে পাশের রুমে ঘুমাবো।”
বলতেই সে বাইরের দিকে পা বাড়াতেই, জাভিয়ান ছুটে এসে এক হাত দিয়ে হ্যাঁচকা টানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। জাভিয়ানের হাত দুটো তান্বীর কোমড়ে শক্ত করে ধরা। সে গম্ভীর স্বরে বললো —“আমি বলেছি তোমাকে এই ঘর থেকে যেতে?”
তান্বী হকচকিয়ে গেলো, চোখে ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে অজান্তে একটা অদ্ভুত উত্তেজনার ঝলক ফুটে উঠলো। মুহূর্তটা যেন থেমে গেল।
তান্বী কণ্ঠে অল্প ভয় আর দ্বিধা নিয়ে বলল,—“আজকে তো বাড়িতে ওনারা কেউ নেই… তাহলে আমি অন্য রুমে ঘুমালে কি হবে?”
জাভিয়ান ধীরে ধীরে বলল,—“আমি তোমাকে অন্য রুমে যেতে অনুমতি দিচ্ছিনা। আর তুমি হঠাৎ আমাকে ভয় পাচ্ছ কেন?”
তান্বী একটু কাঁপতে কাঁপতে উত্তর দিল,—“আপনি বোধহয় আজকে রেগে আছেন… আমার এখানে থাকা ঠিক হবে না, যদি রেগে আমাকে মেরে ফেলেন।”
জাভিয়ান হালকা করে হাসলো, চোখে অদ্ভুত ঠাণ্ডা উজ্জ্বলতা।—“যদি চাও, আমি তোমাকে মেরে না ফেলি… তাহলে তোমাকে এই রুমেই থাকতে হবে। অন্য রুমে গেলে, সত্যি আমি তোমাকে মেরে ফেলব।”
তান্বী তখন নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে মনে মনে বলল,—“এই বদমাইশের মনে আবার কি বদমাইশি চলছে?”
তার চোখে অজান্তে আতঙ্কের সঙ্গে কৌতূহলও জেগে উঠল। মনে হচ্ছিল, আজ জাভিয়ানের শক্তি, রাগ আর নিয়ন্ত্রণের মিলনে একটা নতুন খেলায় সে নিজেও অংশ নিচ্ছে—যা ভয়ঙ্কর অথবা অজানা আকর্ষণীয়।
তান্বী কণ্ঠে কম্পন নিয়ে পুনরায় বলল,—“আমাকে এভাবে ধরে রেখেছেন কেনো… আমকে ছাড়ুন।”
জাভিয়ান ধীরে ধীরে তান্বীর দিকে আরও ঝুঁকে এলো। দুজনের মুখ একে অপরের অনেক কাছে। নিঃশ্বাস যেন প্রায় মিলেই গেছে, কক্ষের বাতাস যেন থেমে গেছে।
এক মুহূর্ত চুপ থাকার পর জাভিয়ান গভীর কণ্ঠে বলল,
—“যদি না ছাড়ি?”
তান্বী চোখ বড় করে তাকালো, ভয় আর দ্বিধায় মুখ লাল হয়ে ওঠে। —“আপনি তো সকালে বলেছিলেন, আমি আপনার কেউ নই। তাহলে এভাবে কোন অধিকারে আমাকে ধরে রেখেছেন?”
জাভিয়ানের চোখে এক অদ্ভুত ঝলক ফুটে উঠলো—রাগ আর অভিমান মিশ্রিত ঝলক। তবুও জাভিয়ান তান্বীকে ছাড়লো না। উল্টো, দুহাত দিয়ে তার কোমর শক্ত করে ধরলো। চোখে আগুন, কণ্ঠে কঠোরতা।
—“আমার যখন ইচ্ছে, তোমাকে বউ হিসেবে মানবো। আর যখন ইচ্ছে, মানবো না। সবই আমার ওপর ডিপেন্ড করে। কারণ আমি তোমাকে টাকা দিয়ে কিনে এনেছি।”
তান্বী রেগে কণ্ঠে তীব্রতা নিয়ে বলল,—“আমি মানুষ! কোনো প্রোডাক্ট নই যে আপনি কিনে আনার অধিকার খাটাবেন।”
এই কথাগুলো বলতেই তান্বী হঠাৎ তার চোখ তান্বীর কোমরের দিকে নেমে গেল। দেখলো, জাভিয়ানের ডান হাত ক্ষতবিক্ষত, লালচে কালো রক্ত জমাট বাঁধা।
—“কার সাথে রেসলিং খেলতে গিয়েছিলেন?”—চমকে প্রশ্ন করলো তান্বী।
জাভিয়ান হালকা হেসে উত্তর দিল,—“তোমার মতোই একটা বেয়াদবকে মেরেছি।”
—“তাহলে যান, আগে ড্রেসিং করুন হাতে,”—কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললো তান্বী।
জাভিয়ান চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলল, —“এসব আলগা পিরিত দেখানোর কোনো দরকার নেই। তবে দরকার হলে, অরজিনাল পিরিত দেখাতে পারো। মানা করবো না।”
তান্বীর বারবার হকচকিয়ে যাচ্ছে জাভিয়ানের এসব কথাবার্তায়। তান্বী হঠাৎ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল —“ছাড়ুন! আমাকে, কত মেয়ের সঙ্গে… না জানি, ওইসব করেছেন!”
জাভিয়ান হালকা হেসে ধীরে ধীরে উত্তর দিল,—“বেশি না… ৯৭ জন। তবে হ্যাঁ, তুমি করলে ৯৮ জন হয়ে যাবে। উফ্, বিশ্বাস করো, অনেকদিন হয়ে গেছে কাউকে টাচ করিনি… কেমন কেমন যেনো লাগছে…”
তান্বী ঘৃণায় ভরা কণ্ঠে বলল,—“ছিঃ! ছাড়ুন আমাকে! আপনার ওই নোংরা হাতের স্পর্শ… আমাকে অপবিত্র করে দিচ্ছে।”
জাভিয়ান ধীরে ধীরে তান্বীর দিকে আরো এগিয়ে এসে বলল,—“তাহলে তোমার পুরো শরীর আজকে অপবিত্র করে দেব। যাও, ওই শাড়িটা পড়ে আসো।”
তান্বী চোখ বড় করে, অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,—“কোন শাড়ি?”
জাভিয়ান শান্ত কণ্ঠে বলল,—“সকালে যেটা পড়েছিলে।”
তান্বী কিছুটা দ্বিধা করল, কণ্ঠে হালকা অসন্তোষ—
—“এই মাঝরাতে আমি শাড়ি পড়ব? কোন দুঃখে?”
জাভিয়ান হেসে উত্তর দিল, চোখে অদ্ভুত আগুন—
—“দুঃখে নয়, সুখে। কারণ আমি চাই তুমি পড়বে। তাই পড়বেই। আমি আবার দেখবো তাই।”
তান্বী চোখ লাল করে, কণ্ঠে রাগ আর অবিশ্বাসের মিশ্রণ দিয়ে বলল, —“পাগলের সুখ মনে মনে! আমি জীবনেও পড়ব না ওই শাড়ি। আর তাছাড়া,এই ধরনের শাড়ি আমি পড়তে পারি না। আমাকে তখন ওই বিউটিশিয়ানরা এই শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছিলো।”
জাভিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে,তারপর তান্বীকে ছেড়ে দিয়ে বলল,—“ঠিক আছে। আর কখনোই পড়োনা ওই শাড়ি। আর সাজগোজ তো ভুলেও করোনা … একদম ঠাকুমার ঝুলির ওই শাকচুন্নীটার মতো লাগছিলো।”
রাগে তান্বী ফুঁসতে থাকলো। আর এদিকে জাভিয়ান বিছানায় গিয়ে নিজের গায়ে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লো।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জাভিয়ান ধীরে ধীরে উঠে আবার বলল, কণ্ঠে সতর্কতার বানি নিয়ে—“লিসেন, ভালো করে ঘুমাবে। আবার যদি আমার ওপর পা দিয়েছো, এবার দেখবে… আমি ঠিক কী করি।”
তান্বী হকচকিয়ে যায় অজান্তে শরীর কেঁপে উঠল। জাভিয়ানের এই হালকা সতর্কতা মনের ভিতর কেমন ভয় ঢুকিয়ে দিলো।
(চলবে ……)
Share On:
TAGS: ডিজায়ার আনলিশড, সাবিলা সাবি
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৫
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৩
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১১
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৯
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ১৮
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৭
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৮
-
আযদাহা সব পর্বের লিংক
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ২৩
-
ডিজায়ার আনলিশড পর্ব ৬